নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটা শিশুতোষ অভিমান নিয়ে আড্ডায় একা বসে থাকি। কাউকে ফোন করি না।
দু-একজন নিশ্চিতভাবেই আশে পাশে আছে। একটা ফোন দিলেই চলে আসবে। কিন্তু কেন ফোন দেব? ওরাতো জানেই আড্ডার টাইমিং। ফোন করলে হয়তো অন্য কোন কাজ ফেলে আসবে। এই আড্ডার চেয়ে যার অন্য কাজ বেশী গুরুত্বপূর্ণ তার আসার প্রয়োজন নেই আড্ডায়।
গত বছর এই সময়েও মাসুদ ভাইএর চায়ের স্টলে তিনটা বেঞ্চে চাপাচাপি করে মোট দশ-বারোজন বসেও দুএকজনকে দাড়িয়ে থাকতে হতো। আমরা জানতাম এই দিনটা একদিন আসবে। কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি সেটা জানতাম না।
মাজহার পাগলা চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম আছে, সুস্থই আছে। মৃদুল এতদিনে এসে বিদেশ যাবার জন্য অফিসের সকাল-সন্ধ্যার পর রাতে আইইএলটিএস আর জিআরই নিয়েই ব্যস্ত। আরিফ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেছে। এখন কুমিল্লা থাকে। ডাক্তার নারায়ণগঞ্জ-এ ফ্ল্যাট কিনে সেটেলড। এদের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু বাকিরা? শুভ একটা চাকরি না হওয়া পর্যন্ত আর আড্ডায় আসবে না এমন একট ধনুকভাঙা পণ করে গত মাস ছয়েক যাবৎ নিখোজ। সোহাগ প্রেম-ট্রেম করে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল। এখন বোধহয় আড্ডা বাদ দিয়ে গুটিয়ে নেয়ার ফাইনাল স্টেজ-এ আছে। রূপক সারাদিন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থেকে রাতেও তার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারছে না। মাকসুদটা আটটা নয়টা পর্যন্ত অফিস এবং শুক্র-শনি এমবিএ নিয়ে ব্যস্ত। ধুর শালা। বাকি যারা আছে তারাও দেখা যাবে হয় গ্রামের বাড়িতে, নয়তো শ্বশুড় বাড়িতে কিংবা অন্য কোন শাখা বন্ধুর আড্ডায়।
এই আড্ডায় মাকসুদের পরই আমি চাকরি পাই। রাত আটটা পর্যন্ত অফিস করেও তা মনে রাখিনা যদি এক ঘন্টার একটা আড্ডা দিতে পারি। কিন্তু সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অফিস করেও যদি আড্ডায় না যেতে পারি মনে হয় আমি চব্বিশ ঘন্টা একটানা অফিস করলাম। বৌয়ের আহ্বান, ঝিরঝির বৃষ্টি, হরতালের ককটেল--কিছ্ইু আড্ডায় যাওয়া ঠেকাতে পারেনা। গত আট-দশ মাসে আরও চার-পাঁচ জন চাকরি পেল, দু-এক জন বিয়ে-শাদি করল। আর এদেরই কেউ কেউ আজ ’অফিসের পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি কিংবা নতুন জীবনের ব্যস্ততা’র নামে বরং উল্টোটা অর্থাৎ ’অফিসের ব্যস্ততা এবং নতুন জীবনজনিত ক্লান্তি'র দোহাই দিতে দ্বিধা করেনা। কিন্তু এরা ভুলে যায় চাকরি কিংবা বিয়ে, দু-একটা আমরাওতো করেছি!
আটটা পর্যন্ত অফিস করলাম, কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এর পর থেকেই সমস্যা শুরু হতে থাকে। সময় যত এগুতে থাকে মেজাজের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। কারণ সাড়ে আটটা পার করে অফিস থেকে বেড় হলে আর আড্ডাটা ধরা যাবে না। সময়টা পথই খেয়ে ফেলবে। বাসায় মেহমান এসেছে, সব ভালো, কিন্তু নয়টা-সোয়া নয়টা বাজার পর থেকে মেহমানদারিতে মনযোগ কমতে থাকে। এমনও হয়েছে, তুলিকে নিয়ে সন্ধ্যার পর মার্কেটে গিয়েছি, ও এই দোকান, সেই দোকান ঘুরছে। আর আমি ঘড়ি দেখছি। মেয়েদের সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী একের পর এক দোকান ঘুরবে। সারাদিন ঘুরে ফিরে প্রথম দোকানের পছন্দ হওয়া জিনিসটাই কিনবে, কিন্তু এরই মাঝে অমূল্য কিছু সময় নষ্ট করবে। তুলির যদিও এই স্বভাব একটু কমই, তবুও আমি সময় বাড়ার সাথে সাথে অসহিষ্ণু হতে থাকি এবং সাড়ে নয়টার দিকে সামান্য কথায় একথা সেকথার পর আগামীদিনের প্রতিশ্র“তি দিয়ে মার্কেট থেকে ফিরে এসেছি।
এমন অনেক দিন হয়েছে, আমি সাড়ে নয়টার দিকে বাসার নিচ দিয়ে হেটে হেটে আড্ডায় যাচ্ছি। চারতলার বারান্দায় বউ দাড়িয়ে আছে। আমি ওর সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে এটা-সেটায় ভুলিয়ে ’আজকে না গেলে হতো না?’র মতো নতুন বউএর হৃদয়স্পর্ষী অনুরোধ পাশ কাটিয়ে আড্ডায় গেছি। সেই আড্ডায় গিয়ে যদি দেখা যায় পোলাপান নাই, এবং কারণ জানা যায় হয়তো গত পরশু দিনের কোন ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচের পুন:প্রচার দেখা বা সারা দিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি কিংবা শুভর মেসে বা বরকতের বাসায় কার্ড খেলা এবং তাতে যদি কেউ আড্ডায় এসে একা একা বসে থাকার অভিমান করতে চায় তাকে নিশ্চই দোষ দেওয়া যায় না।
এরকম কষ্ট আগেও পেয়েছি। আমার প্রথম জীবনের খুব ভালো একজন বন্ধু সোহেল। ওরা যখন এই এলাকা ছেড়ে খিলক্ষেতের দিকে চলে গেল আমি বুঝলাম এই যাওয়াই শেষ যাওয়া। এখনও হঠাৎ দেখা হয়। কিন্তু কেউই কাউকে সেরকম আর ফিল করি না। এরকম মনে হয়েছিল যেদিন রিমি অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। বুঝলাম এই যাওয়াই সেই যাওয়া। যেদিন শাওনরা বাসাবো ছেড়ে মগবাজার চলে গেল, বুঝলাম আর সে আর ফিরবে না। যেদিন জানলাম শাওন, শৈবাল, শিপলুরা সব আমাদের ছেড়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস-এ এমবিএ করবে। আমি আর নজরুল শুধু স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট-এ এমবিএ করলাম। ডিপার্টমেন্ট অফিস থেকে কতবার চেয়ারম্যানের সাইন করা ওদের মাইগ্রেশন লেটার আমি আর নজরুল ওরা আসার আগেই সরিয়ে ফেলেছি! কারণ আমরা জানতান এজীবনে ওদের সাথে আর সেভাবে জমবে না। জমেও নি, সেভাবে জমেও না।
একটা সময় মনে হতো ঢাকার বাইরে গিয়ে বোধহয় আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। মুক্ত বাতাস আমার নয় , এই কার্বনের বাতাসেই সয়ে গেছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ভালো কোথও সুযোগ না পেলে শেষ পর্যন্ত কী করতাম কে জানে, কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত ছিলঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেলে বরং জগন্নাথএ পড়র। জগন্নাথ তখনও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। কদিন আগেও মনে হত, চাকরিতে ঢাকার বাইরে যদি কোথাও ট্রান্সফার করে প্রয়োজনে হেড অব এইচআর এর পা ধরে পড়ে থাকব, তবু আমাকে ঢাকা রাখুন। পোলাপানের মতিগতি যা দেখছি, এখন আমাকে যদি বুড়িমারি তে একটা ব্রাঞ্চ খুলে পোস্টিং দিতে চায় আমি আগের চেষে অনেক কম অখুশি হব। চোখের সামনে মরতে দেখার চেয়ে অনেক দূরে গিয়ে মৃত্যু সংবাদ পাওয়া অনেক স্বস্তিকর। আড্ডাটা চোখের সামনে মরতে দেখছি।
যদিও প্রতিবারই পরের অন্য কিছুতে জড়িয়ে গেছি, হয়তো জমেও গেছি, তবুও কেই বা বাকির নেশায় নগদ ছাড়তে চায়?
©somewhere in net ltd.
১| ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১:১৩
শিব্বির আহমেদ বলেছেন: প্লাস