নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কয়েক বছর আগে ফেইসবুকে মাঝে মাঝেই দেখতাম একটা অপরিচিত জমকালো মেয়ের ছবি, তার পেছনে দাড়ানো পরিচিত আরও আট-দশজনের ছবি। অর্থ্যাৎ আরও একটি মেয়ের বিয়ে হলো। মেক আপের কারনে চেনা মানুষটিকেও বিয়ের ছবিতে এক দেখায় চিনতে কষ্ট হয়। তার পর শুরু হলো দুএকজন পরিচিত ছেলের বিয়ের সময়। এর পর আবার শূরু হলো মেয়েগুলার নবজাতকের ছবি আপলোড করা। ফেইস বুকটা সব কিছু অনেক সহজ করে দিয়েছে। ক্লাসের এক মেয়ের স্ট্যাটাসটা বেশ ভালো লেগেছিল। বিয়ের দিন সকালে তার ফেইসবুক স্ট্যাটাস ছিল--”আজ... ..”! যাই হোক, এর পর আবার এক-আধজন ছেলে বন্ধুর বাচ্চা-কাচ্চার ছবিও ফেইসবুকে আসতে শুরু করলো।
ফেইসবুক সব সহজ করে দিলেও ’আমি বাবা হতে চলেছি’ এ ধরনের একটা নিউজ শুভানুধ্যায়ীদেও কিভাবে দেওয়া যায় কে জানে। প্রেমের খবর দেয়ার চেয়ে বোধ হয় বিয়ের খবরও দেয়া সহজ। এবং সবচেয়ে দুরহ কাজ হলো সন্তান হতে চলেছে এই খবর কাওকে দেয়া। ’মা হতে চলেছি’ কথটা হয়তো কিছুদিন পর লোকজন এমনিতেই টের পেয়ে যায়, এবং এই কারনেই কাউকে রলাও সহজ, কিন্তু বাবা হতে চলার খবর কাওকে বলা আসলেই কঠিন।
এসব নিয়ে আজকাল এত ভাবছি কারণ আমরাই এখন আর লেটেস্ট জেনারেশন নই। বান্ধবীদের কথা নাহয় বাদই দিলাম, বন্ধুদের মধ্যেও ডাক্তারের বাচ্চা হলো, শুভর, নাদিমের, এবং তারও আগে একটু দূরের আরও দু-একজনের; আরও নতুন প্রজন্ম এসে গেছে, আর আমরা যারা সময়ের লেটেস্ট ভার্সন ছিলাম ক্রমেই ব্যক ডেটেড হয়ে যাচ্ছি।
নাদিমের ছেলে দেখতে গেলাম।
চুলায় হাত-পা শেকে তারপর আমরা কিউতে দাড়ালাম। বরকতের হাতের উপর দিয়ে চার-পাঁচজন ভাগ্নে-ভাগ্নি পার হয়েছে। ও কনফিডেন্টলি কোলে তুলে নিল। আমি আর মৃদুল শাহস পেলাম না। বেশীই ছোট। নাদিমের কোলে দেখতে দেখতেই ভাবলাম আমরা হঠাৎই অনেক বড় হয়ে গেলাম। মনে আছে আমি প্রথম শেভ করা নিয়ে কত দ্বিধান্বিত বিনিদ্র রজনী পার করেছি। সবাই কিভাবে নেবে। কত দিন আগে আর? সেই আমি এখন ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমাই!
নাদিমের ছেলে দেখলাম। বাকিরা বুঝল ছেলে বাবার মতো নাকি মা’র মতো হয়েছে। আমি ঠিক বুঝিনা এসব। সকল সদ্যজাত এবং সকল সদ্যপরিণীতা আমার কাছে একই রকম লাগে।
বাচ্চা-কাচ্চার ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুদ লাগে। আমার কাছে মনে হয় এটা পৃথিবীর বুকে নিজের একটা স্বাক্ষর রেখে যাওয়া। নিজের একজন প্রতিনিধি রেখে যাওয়া। হাজার বছর পরও যে সাক্ষ্য দেবে কোন একদিন আমি পৃথিবীতে এসেছিলাম। মহৎ লোকের কাজই সাক্ষ্য দেয় যে তারা একদিন পৃথিবীর বুকে বিচরণ করেছেন। গীতাঞ্জলী সাক্ষ্য দেয় একদিন রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীতে বিচরণ করেছেন, e=mc2 সাক্ষ্য দেয় আইনস্টাইন এসেছিলেন, মোনালিসা সাক্ষ্য দেয় ভিঞ্চি এসেছিলেন। আর আমরা যারা আম জনতা তাদের মাস্টার পিস ওই একটাই। আমি সাক্ষ্য দিই আমার পিতামহ পৃথিবীতে এসেছিলেন। আমার সন্তান সাক্ষ্য দেবে আমি পৃথিবীতে এসেছিলাম।
সন্তান-সন্ততি একটা পরিবারের ক্যাটালিস্ট। স্বামী-স্ত্রীর চার্ম কত দিন থাকে কে জানে। তবে এই একটা ক্যাটালিস্ট বাকি সবকিছুকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। আর তাছাড়াও এটা একট খেলনা। বাকি জীবন খেলা যায়। খেলা-ধূলায় সুস্থভাবে বাঁচা যায়। কারও সন্তান না থাকাটা বা একটা প্রতিবন্ধী সন্তান আমার মনে হয় একটা অভিশাপের মতো। একটা যাবৎজীবন কারাদন্ড।
নাদিমের কাছে জানতে চাইলাম লাইফে কী কী চেঞ্জ এসেছে। বলল তেমন কিছু না। শুধু রাতে ঘুমাতে পারছে না। একঘন্টা পরপর উঠতে হয়। অফিসে যেয়ে ঘুম ঘুম ভাব। কাজে মনযোগ কম। কাজের ভুলের হার বাড়ছে। বস্ নাকি বলেই বসেছে, এক ছেলে নিয়েই এই অবস্থা! বাবা ডাক শোনা কি এতই সহজ? বাবা ডাক শোনা কত কঠিন কে জানে, তবে নাদিম এর চেয়েও গুরুতর একটা সমস্যার কথা বলল। বাসায় অনেক লোকজন আসছে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা হাজারো দর্শনার্থী। পোলাপান সব বাবুটাকে দেখছে, ভাইয়া ভাইয়া করছে। এই সব ভাইয়া ভাইয়া শুনতে শুনতে ছেলেকে কোলে নিয়ে নাদিমের মুখ দিয়েও নাকি ভাইয়া ভাইয়া চলে আসছে!
বাবা ডাক শোনা আসলেই কঠিন কিনা আমি জানিনা। তবে বাবা-মায়ের যে ত্যাগের কথা ছেলে-মেয়েদের শোনানো হয়, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে জেগে থাকা, নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ানো ইত্যাদি, এই ত্যাগকে যতটা মহিমান্বিত করে দেখানো হয় আমি তার সাথে পুরোপুরি একমত হতে পারিনা। কোন স্বামী-স্ত্রীকে যদি বলা হয় সন্তান হলেতো আপনাকে এত এত কষ্ট করতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, কী দরকার, বরং আপনারা কোন সন্তান নিয়েন না, আমি নিশ্চিত কেউই আমার এই সদুপোদেশে খুশি হবে না। তারা বরং সানন্দে এই কষ্ট করতে চায়। এই ত্যাগ স্বীকার করতে চায়। এসব বিবেচনায় বলা যায় এই ত্যাগ যতটা না সন্তানের কারনে তার চেয়ে অনেক বেশী নিজেদের কারনে। একজন দম্পতির নিজেদের প্রয়োজনীয় সন্তান থাকার পরও যদি এমন হয় রাস্তা থেকে কোন এতিম শিশুকে নিয়ে আসে লালন-পালনের জন্য, এবং সেই শিশূর জন্য একটা রাতও নির্ঘুম কাটায় সেটাকে বলা যায় নির্জলা ত্যাগ। আর আমি সারা রাত জেগে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল দেখে সকালে কষ্ট করে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যেয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে যদি বলি ফুটবলের জন্য, বায়ার্ন মিউনিখের জন্য ত্যাগ স্বীকার করলাম, জানিনা লোকজন সেই ত্যাগ বায়ার্নের প্রতি ত্যাগ হিসেবে ধরবে নাকি আনন্দের জন্য সেলামী বলবে।
সকল পিতা-মাতার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী তাদের মহিমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য, এবং এখনও প্যারেন্টস ক্লাবে যোগ না দিয়ে অনধিকার চর্চার জন্য। তবে এটুকু বলা যায় ত্যাগ-তিতিক্ষা-ভালোবাসার যত যত উল্লেখ করা হয় তত তার মহিমা ক্ষুন্ন হয়।
সব নবীন পিতা-মাতার বোধহয় নতুন সন্তান নিয়ে কিছু প্ল্যান-প্রোগ্রাম থাকে। সন্তান কে এটা করাবো, সেটা শেখাবো, এভাবে মানুষ করবো, সেভাবে গড়ে তুলব ইত্যাদি। আর থাকে কিছু প্রতিজ্ঞাও। সন্তানকে কখনও বঞ্চিত করব না, আমি যা পাইনি সন্তান যেন সেটা পায়, আমি যেটাতে কষ্ট পেয়েছি সন্তান যেন তাতে কষ্ট না পায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এটাও ঠিক, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক সময়ের বিপ্লবী সন্তান পরবর্তী সময়ে বাবা-মা হতে হতে একজন কট্টর রক্ষণশীল পিতা-মাতায় পরিণত হয়ে যায়। ঠিকই চিপস-চকোলেট খেতে বারণ, ঠিকই বেশী খেলা-ধূলা করতে বারন, ঠিকই প্রেম-প্রীতিকে সন্দেহের চোখে দেখা ইত্যাদি চলতেই থাকে। এরই মাঝে নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন বাবা-মা’রা যতটুকু উদার হতে পারে সেটাও যুগের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রতুল হয়ে থাকে।
আমাদের পিতামহ-পিতামহী রা তাদের সন্তানদের ছেলে-মেয়েদের পারস্পারিক দেখা দেখিই অপছন্দ করতেন। সেই সন্তানদের দাবি ছিল একটু চোখের দেখা, দুটি কথা এপর্যন্তই। আমাদের বাবা-মা আমাদেরকে বিপরীত লিঙ্গের সাথে বন্ধুত্ব পর্যন্ত সহজভাবে মেনে নিলেন। কিন্তু প্রেম-ভালোবাসাকে ঠিক সহজভাবে নিতে পারলেননা। আমাদের দাবি ছিল প্রেম-ভালোবাসাটাকে সহজ ভাবে মেনে নেয়া পর্যন্ত। আমরা বাবা-মা হয়ে সন্তানের প্রেম-ভালোবাসাকে সহজভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু তারা হয়তো চাইবে আরও বেশী কিছূ।
সন্তান জেনারেশন যতটুকু চাইবে, প্যারেন্টস জেনারেশন ততটুকু দিতে প্রস্তুত থাকবেন না, আর প্যারেন্টস জেনারেশন যতটুকু দিতে প্রস্তুত থাকবেন সন্তানদের কেবল অতটুকুতে পোষাবে না, এই গ্যাপ টা বোধহয় রয়েই যাবে।
২| ০২ রা জুন, ২০১৩ রাত ১:৪২
অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ।
৩| ০২ রা জুন, ২০১৩ সকাল ১০:১২
গ্য।গটেম্প বলেছেন: ভাল লিখেছেন
৪| ০৩ রা জুন, ২০১৩ রাত ১২:২৫
অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: :-)
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা জুন, ২০১৩ রাত ১২:৫৯
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
সন্তান ও বাবা মায়ের এই গ্যাপটা কমে আসবে যদি প্রচলিত ধ্যান ধারনার বাইরে এসে জীবনটাকে ঠিক উপভোগ করা যায় তবেই। চমৎকার একটি বিষয় তুলে ধরেছেন।