নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আর্থার অ্যাশ--টেনিসের ম্যান্ডেলা

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৫১

রোঁলা গ্যারো, রড লেভার এরেনা আর উইম্বলডন পার্ক এর পাশাপাশি নিতান্ত হালের টেনিসপ্রেমির কাছেও আর্থার অ্যাশ নামটা বেশ পরিচিতই হবার কথা। মাত্র চারটি গ্রান্ড স্ল্যামের একটি ইউএস ওপেন এর প্রধান টেনিস স্টেডিয়ামটির নাম আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়াম। তবে স্টেডিয়ামটির নামকরণের সার্থকতাই আশির দশকে অবসরে যাওয়া আর্থার অ্যাশের নামটিকে নবীন একজন টেনিস ভক্তের কাছেও পরিচিত করে তুললেও একটি স্টেডিয়াম নামাঙ্কিত হওয়ার চেয়েও আর্থার অ্যাশ অনেক মহান একজন মানুষ, একজন মহৎ ক্রিড়াবিদ।



মাত্র একটি করে ইউএস ওপেন, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং উইম্বলডন জেতা অ্যাশকে হয়তো একালের রজার ফেদেরার বা পিট সাম্প্রাসের সাথে তুলনা করে ঠিক বুঝে ওঠা যাবে না। কেননা প্রকৃত আর্থার অ্যাশকে জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যানের চেয়ে বিচার করতে হবে তৎকালীন জাতিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আলোকে যখন শুধু গায়ের রং কালো হবার কারনে একজন মানুষের অধিকার ছিল না সব খেলায় অংশগ্রহনের, যেকোন মাঠেই অনুশীলন করার। এমনিক ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠেয় দক্ষিণ আফ্রিকা ওপেনে আর্থারকে ভিসা দেয়া হয়নি কেবল কালো চামড়ার কারণে। অবশ্য পরবর্তীতে এই দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ৩১ জন প্রভাবশালী আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন হয়ে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর্যবেক্ষক হিসেবে।



মার্টিন লুথার কিং-এর ভাবশিষ্য আর্থার অ্যাশ তার প্রথম গ্রান্ড স্ল্যাম শিরোপা জেতেন কিং-এর মৃত্যুর বছরই। ১৯৬৮ সালে যাত্রা শুরু করা উন্মুক্ত যুগের প্রথম ইউএস ওপেনের শিরোপাটিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে জিতে নেন আর্থার অ্যাশ। ১৯৭০ এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং ১৯৭৫ সালের উইম্বলডনও জেতেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই। তিনিই এখন পর্যন্ত ইউএস ওপেন, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন বা উইম্বলডন জেতা একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ এবং ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতা ইয়ানিক নোয়াসহ যেকোন গ্রান্ড স্ল্যাম বিজয়ী কৃষ্ণাঙ্গদের অতি সংক্ষিপ্ত তালিকার দুইজনের একজন। প্রথম কষ্ণাঙ্গ হিসেবে টেনিস র‌্যাঙ্কিং-এর শীর্ষেও ওঠেন আর্থার অ্যাশই। তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমেরিকার পক্ষে ১৯৬৩ সালের ডেভিস কাপে অংশগ্রহণ করেন। এবং ১৯৬৩, ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং ১৯৭৮ সালে আমেরিকার ডেভিস কাপ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে তার নেতৃত্বেই ১৯৮১র ডেভিস কাপে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শিরোপা জেতে যুক্তরাষ্ট্র।



লুথার কিং-এ অনুপ্রাণীত কালো আমেরিকান আর্থার নিজেকে শুধু টেনিসেই আবদ্ধ রাখেন নি। নিজেই বলেছেন, যদি আমি শুধু টেনিস নিয়েই মেতে থাকতাম আমি আরও ভালো একজন প্রতিযোগী হতে পারতাম। কিন্তু একই সাথে তিনি আবার তার কথা এবং কাজের দ্বারা প্রমাণ করেছেন তিনি কেবলই একজন ”প্রথম” কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিড়াবিদ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাননি, তিনি পুরোপুরি পালন করতে চেয়েছেন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে তার ”সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা”। সামাজিক এই দায়বদ্ধতার কারনে জেলও খেটেছেন একাধিক বার।



১৯৪৩ সালের ১০ই জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বাবা আর্থার অ্যাশ সিনিয়র এবং মা ম্যাটি কর্ডেলের ঘরে জন্ম নেয়া আর্থার অ্যাশ জুনিয়র তার সংক্ষিপ্ত জীবনে পেয়েছেন অনেক ঈর্ষণীয় সাফল্য এবং বিরল সম্মান। সমাজ, জাতি এবং দেশকে দিয়ে গেছেন অনেক কিছুই। প্রতিদানে পেয়েছেনও তৎকালিন প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ সম্মান। কিন্তু প্রকৃতি অনেক সময়ই কোন একজন মানুষকে দুহাত উজার করে দেয় না। অন্য কোথাও কমতি দিয়ে চেষ্টা করে অভাবনীয় সাফল্যের একটা ভারসাম্য তৈরী করার। একদিকে পাহাড় সমান সাফল্য যেমন আর্থার অ্যাশের পায়ে এসে লুটিয়েছে অন্যাদিকে সেই আর্থার অ্যাশকেই বয়ে বেড়াতে হয়েছে অপ্রাপ্তি-অতৃপ্তির সীমাহীন বেদনা।



আর্থার অ্যাশ ১৯৭৭ সালে ফটোসাংবাদিক জিন মৌটুসামির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের ৯ বছর পর নিঃসন্তান এই দম্পতি ১৯৮৬ সালে একটা কন্যা সন্তান দত্তক নেন। মায়ের পেশার সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রাখা হয় ক্যামেরা অ্যাশ! সামাজিক বঞ্চনার যন্ত্রণা, সন্তানহীনতার যন্ত্রণার সাথে একসময় যোগ হয় শারিরিক যন্ত্রণা। ভক্ত-সুভানুধ্যায়ীদের বিস্মিত করে চমৎকার ফিটনেসের আর্থার ১৯৭৯ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং তাকে যেতে হয় শল্যবিদের ছুরির নিচে। ১৯৮৩ সালে আবার একই সমস্যা তাকে দ্বিতীয়বারের মতো নিয়ে যায় বাইপাস সার্জারিতে। এরকম পরিপ্রেক্ষিতে তার পক্ষে খেলা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবসর পরবর্তি জীবনে টাইম ম্যাগজিনের জন্য লেখালেখি, এবিসি স্পোর্টসের ধারাভাষ্যকার, জাতীয় জুনিয়র টেনিস লীগ এর জন্য তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। ছয় বছরের সাধনায় ১৯৮৮ সালে তিনি তিন কিস্তির একটা বইও লেখেন এ হার্ড রোড টু গ্লোরি: এ হিস্টোরি অব দ্যা আফ্রিকান-আমেরিকান এ্যাথলেট নামে।



১৯৮৮ সালে আর্থার আবার হাসপাতালে ভর্র্তি হন ডান হাতে পক্ষাঘাত নিয়ে। বিভিন্ন টেস্ট, ব্রেইন সার্জারি এবং তৎপরবর্তী আরও নানাবিধ পরীক্ষার পর আবিস্কার হয় আর্থার এইচআইভি পজেটিভ। ১৯৯২ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে তার এইচআইভি নিয়ে আর্থার নিজেই বলেন, ”আমরা শতভাগ নিশ্চিত যে আমার এই এইচআইভি ১৯৭৯ সালের বাইপাস বা ১৯৮৩ সালের অস্ত্রপচারের সময় দেয়া রক্তের মাধ্যমেই সংক্রমিত হয়েছে। এবং আমরা ৯৫ শতাংশ নিশ্চিত যে এটা ৮৩র অস্ত্রপচারের সময়ই হয়েছে।”



মৃত্যুর আগে মেয়ে ক্যামেরাকে উদ্দেশ্য করে লিখে যায়, ”এখন যেমন তোমার পাশাপাশি আছি আমি হয়তো সমস্ত পথ বা পথের অধিকাংশই তোমার সাথে এভাবে থাকতে পারব না। যখন তোমার আমাকে প্রয়োজন আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে না থাকতে পারি বা সুস্থ বা বেচে থাকতে না পারি রাগ করোনা। সবসময় তোমার পাশে থাকার চেয়ে আমার কাছে প্রিয় আর কিছুই নেই। যদি আমি না থাকি আমার জন্য মন খারাপ করোনা। যখন আমরা একসাথে ছিলাম আমি তোমাকে গভীর ভালোবেসেছি এবং তুমিও আমাকে যে ভালোলাগা উপহার দিয়েছ সেই মূল্য আমি কোনদিন পরিশোধ করতে পারব না। ক্যামেরা, যখনই তোমার মন খারাপ হবে এবং জীবন নিরর্থক মনে হবে কিংবা তুমি চলার পথে হোচট খাবে এবং পড়ে যাবে এবং জানবে না কিভাবে উঠে দাড়াবে, শুধু আমার কথা ভেব। যেন আমার হাসি আমার আনন্দ নিয়ে আমি তোমার পানেই চেয়ে আছি।”



মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলা কথাগুলোয় সারাজীবন বলতে চেয়েছেন তার স্বজাতি কালো ভাই-বোনদের, বঞ্চিত, অবহেলিত মানবতাকে। ১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী নিউইয়র্ক হাসপাতালে ৪৯ বছর বয়সে আর্থার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৬ বছর আগের আর্থারের বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করা এন্ড্রু ইয়ং পরিচালনা করেন তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানও । রিচমন্ড-এর গভর্নর ম্যানসনে তাকে সমাহিত করা হয়।



নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল বৈষম্যহীন আধূনিক বিশ্ব গড়তে আর্থার অ্যাশের মতো মহামানবদের আত্মত্যাগের প্রাসঙ্গিকতা। ১৯৬৮ সালের আজকের এই দিনে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে র‌্যাঙ্কিং-এ শীর্ষে উঠে আসার গৌরব অর্জন করেন এই মহৎ ক্রিড়াবিদ ।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩১

জীবনানন্দদাশের ছায়া বলেছেন: চমৎকার এবং বিস্তারিত :)

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:২৫

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।

২| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:২৮

রেজওয়ানা আলী তনিমা বলেছেন: দারুন ভালো লাগলো পোষ্ট পড়ে। আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামের নামই শুধু জানতাম। নামকরনের পেছনের মানুষ ও তার অবদানের কথা জানতে পারলাম আপনার লেখা পড়ে। শুভকামনা থাকলো।

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৩১

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: এরকম আরও অনেক কিছুই আপনাদের জানানোর জন্য নিজেই জানার চেষ্টা করছি। বাঁচতে হলে জানতে হবে...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.