নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সে অশ্রুজল বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন তাহার সান্তনা পাইবার কোন যো নাই

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৫০

২৮ দিনে ৪৬ সাধারণ মানুষের মৃত্যু, নেতা-কর্মী খুন ৮১।-দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৩।



মরনে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময় যেন একটি স্নেহকরস্পর্ষ তাহার ললাটে পৌছে--যেন একটিও করুনাদ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও একফোটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।



দেবদাশের মতো একটা রোমান্টিক উপন্যাসে শরৎচন্দ্র গ্রহণযোগ্য মৃত্যুর একটা সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেন। আমাদের যে মানুষগুলো পেট্রোল বোমা আর বাসে দেয়া আগুনে পুড়ে মরছে তাদের কারো কারো “সৌভাগ্য” হচ্ছে বটে ” মরিবার সময় যেন কাহারও একফোটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিবার”। হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে তারা কেউ কেউ দেখে যাচ্ছেন অসহায় স্ত্রী, অভাগা পিতা বা অবুঝ সন্তানের একফোটা চোখের জল। তাদের মৃত্যু হয়তো এক বিচারে সার্থক। বিয়ের মাস ছয়েকের মাথায় ব্যাংক কর্মকর্তা মারা গেল, বাবাকে খুজতে থাকা যুবক গেল, বাবা অন্য আরেকজনের সাথে সংসার শুরু করায় পরিবারের হাল ধরতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সতের বছরের কিশোর গেল, মায়ের সাথে পুড়ে মরল ছয় বছরের শিশু, অনেকেই তো গেল। কজনের আর ভাগ্যে জুটলো কাহারও একফোটা চোখের জল দেখিয়া যাইবার? যারা আগুনে পুড়ে সাথে সাথেই মারা গেল তারা আর অন্যের চোখের জল দেখার সুযোগ পেল কৈ?



যদি মৃত্যুর পরও সুযোগ থাকে তবে তারা নিশ্চই দেখবে--ফোটায় ফোটায় নয়, দেখবে স্বজনের অঝোর ধারার চোখের জল। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তির বিদায়, হয়তো স্ত্রীর বয়স ত্রিশের নিচেই, হয়তো সন্তানের বয়স পাঁচ-সাত, নির্ভরশীল বাবা-মার বয়স সত্তুর পেরিয়েছে। এই স্বজনের অঝোর চোখের জল ছাড়া আর কিই বা আছে? একাত্তুরে শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের সন্তান জাহীদ রেজা নূরের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় পরিবারের সেই একজনের অভাব কী জিনিস।



নূরজাহান সিরাজী, বাবার আদরের নূরী, আমাদের চলার পথকে সহজ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন। বাবাকে হারানোর বছর কুড়ি পরে যখন একটু একটু করে অভাব কেটে যেতে থাকল, তখন আমরা চেষ্টা করেছি মাকে একটু ভালো কিছু খাওয়াতে। কিন্তু এত দিনের অভ্যাসের কারণে বাসি খাবারই খেয়ে গেছেন তিনি। সবার খাওয়া শেষে যা বাঁচত, সেটাই ছিল মায়ের খাওয়া। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চাহিদাহীন ছিলেন তিনি। ছোট্ট একটা শরীরে কী অসাধারণ শক্তি ধারণ করতেন নূরজাহার সিরাজী! ভাবতে অবাক লাগে, দুঃসময় পাড়ি দেওয়ার সময় কখনোই আমাদেও ভেঙে পড়তে দেননি। ঈদের সময় আমরা ছোট তিন ভাই-ই কেবল পেতাম নতুন জামাকাপড়। আগের বছরে বানানো ট্রাউজার তত দিনে গোড়ালি ছেড়ে ওপরে উঠে আসত। আমরা ছিলাম বাড়ন্ত, তাই নতুন জামাকাপড় না দিলে পরার মতো কিছু থাকত না। মনে পড়ে, এক ঈদে আমাদের তিনজন ছাড়া শুধু সেলিম ভাইকেই (পঞ্চম ভাই) ফুটপাতের ঝুড়ি থেকে ৪০ টাকা দিয়ে এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে বড় তিন ভাইয়ের দুজন বাইরে গেলে তৃতীয় জনকে বসে থাকতে হতো বাড়িতে, কারণ বাইওে যাওয়ার পোশাকই ছিল দুজনের মতো। সোহাগ পরিবহনে যখন গ্রামের বাড়ি মাগুরার শরুশুনা গ্রামে যেতাম, তখন আমাদের পরিবার বাদে অন্য সবাইকেই সকালের নাশতা দিত পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ছোট আমরা অবাক হয়ে অন্যদেও নাশতা খাওয়া দেখতাম। টিকিট কাটার সময় ওই নাশতার টাকাও জোগাড় করা যেত না বলে কম দামে নাশতা ছাড়া টিকিটই কাটতে হতো। আমার মা এসবই সহ্য করেছেন। তখন তাঁর চোখের জল কীভাবে লুকাতেন মা, জানতে ইচ্ছে করে।



বেশির ভাগ শহীদ পরিবারের জীবন-নাটকের চিত্র এ রকমই। আমরা ব্যতিক্রম নই। ... বুঝতাম, আমরা হারিয়েছি বাবাকে, তিনি হারিয়েছেন স্বামীকে। ৩২ বছর বয়সে আট সন্তানকে নিয়ে তিনি বিধবা হয়েছেন।"




একটু স্বার্থপর শোনালেও আমার কাছে মনে হয় মরে যাওয়াটা খারাপ নয়। অন্তত এই বাস্তবতায় এবং যিনি মারা যান তার জন্যে। এখানে বুদ্ধদেব বসুর মতো বলতে ইচ্ছে করে, আমি যদি মরে যেতে পারতাম এই শীতে, তবে আমাকে প্রতিনিয়ত মরে যেতে হতো না ভালো থাকার চেষ্টায়। যে মরে গেল সে এই দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো বেঁচেই গেল। বরং তারাই মরে গেল, যারা বেঁচে রইল। কিন্তু তাই বলে এমন মৃত্যূ?



একজন জাহীদ রেজা নূর, একজন শমী কায়সার বা আসিফ মুনীররা তবুও পিতা হারানোর শোকে নুয়ে পড়লেও পরক্ষণেই বুক ফুলিয়ে, মাথা উচু করে দাড়াতে পারেন। সেই সব মহান লোকেদের কথা ভেবে তারা বরং একটা সান্তনা পান, একটা তৃপ্তি পান, একটা গৌরব অনুভব করেন যেই মানুষেরা তাদের একটা পরিবারের উর্ধে উঠে হয়ে গেছেন সার্বজনীন। তারা একেকটা পরিবারকে নিঃস্ব করে গেছেন, কিন্তু ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গেছেন পুরো জাতিকে। সেই পরিবারের সন্তানের, সেই পরিবারের পিতা-মাতার, সেই পরিবারের স্ত্রী বা স্বামীর তবুও আকড়ে ধরার কিছু একটা আছে, কিন্তু গত কিছুদিনে যেই ছাত্র মারা গেল, যেই চাকরীজীবী মারা গেল, যেই সিএনজি চালক, বাসের হেলপার, ব্যাংকার, যেই মানবতা মারা গেল তারা কোথায় খুঁজবে সান্তনা? একথা কি ইতিহাসে লেখা থাকবে? এর কোন বিচার কি কোনদিন হবে?



মরনে ক্ষতি নাই, সত্য। সে সময় যেন একটি স্নেহকরস্পর্ষ তাহার ললাটে পৌছে-- হাসপাতালের বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুপথযাত্রীর ললাটে স্নেহকরস্পর্ষ পৌছাচ্ছে। চারিদিকে বরং করুনাদ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতেই জীবনের অন্ত হচ্ছে হতভাগ্য লোকগুলোর। মরিবার সময় কেবল একফোটা নয়, বরং চোখে জলধারা দেখিয়াই তারা মরিতেছে।



এই বিখ্যাত সংজ্ঞার প্রতিটি ধারা-উপধারা প্রমাণ করেই মরছে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার আমাদের দেশের অভাগা মানুষগুলো। তারপরও স্বয়ং শরৎচন্দ্রও এ মৃত্যুকে মহিমা দান করতে ব্যর্থ। কারণ তিনি তিনি যেই সময়ের কথা বলেছেন, সেই সময় এই সময় নয় ; যেই বাঙালীর কথা বলেছেন, এই বাঙালী সেই বাঙালী নয়; তিনি যে বাংলার কথা বলেছেন এই বাংলা সেই বাংলা নয়। তখন তত্বাবধায়ক ছিলনা সর্বদলীয় সরকার ছিল না, তখন এমন হরতাল ছিল না অবরোধ ছিলনা, তারচেয়েও বড় কথা তখন আওয়ামীলীগ ছিল না, বিএনপি ছিল না, জামায়াত-শিবির ছিলনা।



নেতা-কর্মীর মৃত্যুতে আসলেই বিচলিত হবার কিছু নাই। রাজনীতি একটি অতি লাভজনক ব্যাবসায়। এবং যে ব্যবসায় যতটা লাভজনক তাতে ঝুকির পরিমাণও ততটাই। হাই রিস্ক, হাই রিটার্ন। নেতা-কর্মী দলের দুর্দিনে মারা গেলে তো গেল। আর মারা না গেলে দলের দিন ফিরলে পাঁচ বছরেই আয় বাড়ে ৩৫১ গুণ, ২০ একর জমি হয় ২৮৬৫ একর, স্বামী-স্ত্রীর যৌথ আয় ১৯ লাখ থেকে কেবল স্ত্রীর আয়ই হয় দুই কোটি টাকা, কেউ চাইলে পাঁচ বছরে ৬ কোটি নয় ৬০০ কোটি কামাতে পারেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় স্বীকারও করেছেন এই সরল সমীকরণ--ক্ষমতায় থাকলে আয় বাড়ে এটাই স্বাভাবিক। কেবল একালের নয়, প্রাচীণকালের বর্বরদেরও বাড়তো। ধর্ম একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের যেমন পারত্রিক মুক্তির উপায়, রাজনীতি তেমনি একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর ঐহিক মুক্তির পথ। মামলা-মোকদ্দমা, কেস-কাচারী, অর্থ-ক্ষমতা সব, সব কিছুর এক অপূর্ব সমন্বয়। তাই নেতা-কর্মীর মৃত্যুতে আমার কোন আক্ষেপ নাই। আমার আক্ষেপ অ-নেতা-কর্মীর মৃত্যুতে।



জাহীদ রেজা নূর, আপনার লেখাটি পড়তে পড়তে আমার দুচোখ ভিজে উঠেছে বারবার। কিন্তু এইসব মৃত্যুর মিছিল দেখে বরং মনে হয় এই সব পরিবার আপনার থেকেও অনেক বেশী বঞ্চিত, অনেক বেশী হতভাগ্য। এরা বুদ্ধিজীবী নয়, এরা মূলত শ্রমজীবী। তাই এদের জীবন তো নগন্যই, এমনকি মৃত্যুও অকিঞ্চিৎকর। এই জীবন কোন রাজনৈতিক নেতার জীবন নয়, এই মৃত্যু নয় কোন বিদগ্ধজনের। এই মৃত্যু একটা আখ্যান নয়, এই মৃত্যু একটা সংখ্যা। এইসব মৃত্যুর জন্য সরকার দেখাচ্ছে বিরোধী দলকে, বিরোধী দল বলছে সরকারই দায়ী। এই আত্মত্যাগ মহান হয়ে উঠবে না, এই আত্মত্যাগ গৌরবের হবে না, এই মৃত্যুকে ইতিহাস মনে রাখবে না। এই মৃত্যুর কথা লেখা হবে কেবল আপনজনের অশ্র“জলে। এবং এই অশ্রুজল বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন, তাহার সান্তনা পাইবার কোন সুযোগ নাই।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৫৭

মোঃ আসিফ-উদ-দৌলাহ বলেছেন: “সোহরাব রুস্তুম” :: সময়ের সাথে প্রাসংগীক

পৃথিবীর কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না।

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:২০

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: সেটাই কাম্য।...তাই হোক।

২| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৫৮

সোজা কথা বলেছেন: সত্যিই অসাধারণ।আমজনতার মৃত্যুতে কোন শোকবার্তা আসবে না,পরিবার কোন টাকা-পয়সা পাবে না,রাজনৈতিক ইতিহাসও এদেরকে অন্তরে গাঁথবে না।শুধুমাত্র বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে যাওয়া পরিবারের অশ্রুই তাদের প্রাপ্তি হবে।হয়ত মৃত্যুকালে তারা এটা দেখতেও পাবে না।স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা যে আমরা এখনো পেলাম না !

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:১৫

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: আমরা বিকাই "বাংলা লিংক" দামে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.