নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

মিউনিখ বিমান দুর্ঘটনা

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১২:১৫

মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। সকালে বিকালে বদলায়, দিনে রাতে বদলায়, কারণে অকারেণে বদলায়।



তবে এই বদলে যেতে যেতেই কেউ কক্ষচ্যুত হয়, কেউ আবার দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যায় অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। সর্বকালের অন্যতম সেরা আক্রমণাত্বক মিডফিল্ডার, ইংল্যান্ডের ৬৬’র বিশ্বকাপ জয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, ইংল্যান্ড জাতীয় দল এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সর্বোচ্চ গোলদাতা, সা¤প্রতিক সময়ে ভেঙে যাবার আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ড জাতীয় দল এবং ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের হয়ে সবচেয়ে বেশী ম্যাচ খেলা--এমন অসংখ্য অর্জন স্যার ববি চার্লটনের। যার প্রায় শতভাগ অর্জনই ১৯৫৮র পরের। অথচ ১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্র“য়ারীই থেমে যেতে পারতো পরবর্তীতে কিংবদন্তী হয়ে ওঠা এই ফুটবলারের পথচলা।



১৯৫৮র ৬ ফেব্র“য়ারী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে এবং ইংল্যান্ড ফুটবল ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। জার্মানির মিউনিখে এক বিমান দুর্ঘটনায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ৮ জন খেলোয়াড়সহ নিহত হন ২৩ জন।



স্যর এ্যালেক্স ফার্গুসন পূর্ব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সবচেয়ে সফল এবং সবচেয়ে বেশী সময়ের ম্যানেজার স্যার ম্যাট বাসবির তরুণ ”বাসবি বেইবস”খ্যাত দলটির সাথে সতীর্থ, ক্লাব কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং সমর্থকদের নিয়ে ববি চার্লটন সেদিন তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেড থেকে ম্যানচেস্টারে ফিরছিলেন। বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লীগের পূর্বসূরি ইউরোপিয়ান কাপের কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে যুগোস্লাভিয়ার রেড স্টার বেলগ্রেডের সাথে ফিরতি লেগের খেলা ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। বেলগ্রেডে ৩-৩ এ ড্র করে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৪ এ এগিয়ে থেকে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে খুশিমনে সেদিন ঘরে ফিরফিল ইউনাইটেড। দুই লেগ মিলিয়ে চার্লটন একাই করেন ৩ গোল যার দুটিই করেন বেলগ্রেডের এ্যাওয়ে ম্যাচে।



মাত্রই তিন বছর আগে ১৯৫৫ সালে উয়েফা ইউরোপের সেরা দল গুলোকে নিয়ে চালু করে ইউরোপিয়ান কাপ। ১৯৫৫-৫৬ মৌসুমে চেলসি লিগ শিরোপা জিতলেও লিগ কর্তৃপক্ষ ”ইংলিশ ফুটবলের বৃহত্তর স্বার্থে” চেলসিকে অনুমতি দেয়নি ইউরোপিয়ান কাপে খেলতে। পরের মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড শিরোপা জিতেও লিগ কর্তৃপক্ষের একই বাধার মুখে পড়ে। কিন্তু ইউনাইটেড বস বাসবি এবং চেয়ারম্যান হ্যারল্ড হার্ডম্যান বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আদায় করে নেন অনুমতি এবং প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ইউনাইটেড খেলে ইউরোপিয়ান কাপে। প্রথমবারের চেষ্টাতেই তারা সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌছে যায় এবং শেষ পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে থামে তাদের সংগ্রামী পথ চলা। পরের বার ১৯৫৮ সালেও লিগ চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং এবারও তাঁদের ইউরোপিয়ান কাপে বন্ধুর পথ।



ঘরোয়া খেলা হতো শনিবারে এবং ইউরোপিয়ান কাপ মাঝ সপ্তাহে। ঘরোয়া লিগ কর্তৃপক্ষকে ভুল প্রমাণ করার জন্য ঘরোয়া লিগের সূচিতে যাতে করে কোন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য সপ্তাহের মাঝে ইউরোপের অন্য কোথাও খেলেই সপ্তাহান্তে দেশের মাটিতে উপস্থিত থাকার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টাই করতে হতো তাদের। যদিও তৎকালিন প্রেক্ষাপটে বিমান ভ্রমণ বেশ ঝুকিপূর্ণই ছিল, কিন্তু লিগ কর্তৃপক্ষকে ভুল প্রমাণ করতে এছাড়া আর কোন পথও খোলা ছিল না ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষের।



সামরক রোভারস এবং ডুকলা প্রাগ কে প্রাথমিক এবং প্রথম রাউন্ডে হারানোর পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা পরে যুগোস্লাভিয়ার রেড স্টার বেলগ্রেডের সাথে। প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ২-১ এ জিতে এগিয়ে থেকেই বেলগ্রেড যায় ইউনাইটেড। আগের রাউন্ডেই প্রাগ থেকে ফেরার পথে ইংল্যান্ডের ঘন কুয়াশার কারণে তারা আকাশ পথে ইংল্যান্ডে ফিরতে না পেরে তারা সেখান থেকে আমস্টারডাম হয়ে ফেরি এবং ট্রেনে করে ফিরেছিল ম্যানচেস্টারে। এবং এই ধকল সামলাতে না পেরে লিগে পরের ম্যাচে ইউনাইটেড বার্মিহাম সিটির সাথে ৩-৩ গোলে ড্র করে ম্যাচটি।



লিগের সুচিতে বিঘœ না ঘটাতে এবং আবার দীর্ঘ সড়ক বা রেল পথের ঝক্কি এড়াতে ইউনাইটেড ব্রিটিশ ইউরোপিয়ান এয়ারওয়েজের একটি প্লেন ভাড়া করে। রাইট ফরওয়ার্ড জনি বেরি তাঁর পাসপোর্ট হারিয়ে ফেললে বেলগ্রেড থেকে বিমান ছাড়তেই দেরী হয় ঘন্টাখানেকের। জনি কোন অবচেতনে কোন ইশারা পেয়েছিলেন কিনা কে জানে। এলিজাবেথান এয়ারস্পিড এয়ারক্রাফটের বেলগ্রেড থেকে ম্যানচেস্টার পর্যন্ত সরাসরি উড্ডয়ন সক্ষমতা না থাকায় তা তৎকালিন পশ্চিম জার্মানির মিউনিখের মিউনিখ-রেম বিমানবন্দরে অবতরণ করে জ্বালানি সংগ্রহের জন্য।



জ্বালানি সংগ্রহ শেষে পাইলট বিমান উড্ডয়নের জন্য দুই বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এমনকি এক পর্যায়ে বিমান থেকে সবাইকে নামিয়ে লাউঞ্জে পাঠিয়ে দেয়া হয়। খেলোয়াড়দের অনেকেরই সেদিন মন আর সায় দিচ্ছিল না উড্ডয়নে। ডানকান এডওয়ার্ডস ম্যানচেস্টারে তার বাড়িওয়ালিকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েও দেন সব ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে। তিনি আগামি কাল আসবেন। ডানকান তখনও জানতেন না যে সেই আগামি কাল তিনি আর পাবেন কিনা। ততক্ষণে মিউনিখের আকাশে শুরু হয়ে গেছে তুষারপাত। শিডিউল ঠিক রাখতে বিমানের ক্যাপ্টেন মিউনিখে রাত কাটানোর পরিকল্পনা বাতিল করে দেন। আবার যখন যাত্রীদের বিমানে ডাকা হয় কেউই ঠিক ভরসা পাচ্ছিলেন না। অনেকেই একটু অধিকতর নিরাপত্তার আশায় পূর্বের আসন অন্যদের সাথে পরিবর্তন করে নেন, কেউবা পেছনের দিকের সিটে গিয়ে বসেন। চার্লচন এবং ডেনিস ভায়োলেট তাঁদের আসন বদল করেন টমি টেইলর এবং ডেভিড পেগের সাথে।



সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে তৃতীয়বারের মতো টেক-অফের চেষ্টা করতেই বিমানটি রানওয়ের তুষারের পাতলা আবরণের উপর দিয়ে গতি সঞ্চারের চেষ্টা করতেই ছিটকে রানওয়ের বাইরে চলে যায়। রানওয়ের বাইরে একটা বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে বিমানের বাম ডানা ভেঙ্গে যায়। পাশের বেড়া এবং গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে প্রায় দ্বিখন্ডিত হয়ে থেমে যাবার আগে ভেঙ্গে যায় আরেক ডানা এবং লেজের অংশ বিশেষ। প্রচন্ড কালো ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারপাশ।



খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, ক্রু, সাংবাদিক এবং সমর্থক সহ ৪৪ জনের মধ্যে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ২০ এবং পরবর্তিতে হাসপাতালে আরও ৩ জন সহ মোট ২৩ জন মারা যায় সেই দুর্ঘটনায়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলোয়াড়ই মারা যায় ৮ জন।



পাসপোর্ট হারিয়ে বেলগ্রেডেই বিমানটিকে ঘন্টাখানেক দেরী করিয়ে দেয়া জনি বেরী দুর্ঘটনা থেকে মারাত্মক আহত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে গেলেও আর কখনোই খেলতে পারেননি ফুটবল। প্রাণে বেঁচে যাওয়া আরেক খেলোয়ারড় জ্যাকি ব্লাঞ্চফ্লাওয়ারেরও আর কখনও সৌভাগ্য হয়নি বলে লাথি মারার। মিউনিখ বিমান বন্দর থেকে বাড়িওয়ালিকে টেলিগ্রাম পাঠানো ডানকান এ্যাডওয়ার্ডস জীবিত অবস্থায় আর কখনোই ফিরে যেতে পারেন নি ম্যানচেস্টারে। বিমান দুর্ঘটনার ১৫ দিন পর মিউনিখের হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। যাদের সাথে আসন বদল করেছিলেন সেই টমি টেইলর এবং ডেভিড পেগ ঘটনাস্থলেই মারা গেলেও অল্পের উপর দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান চার্লটন এবং ভায়োলেট।



সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়ে ভায়োলেট, চার্লটন, ফোক্সরা পরবর্তীতে ক্লাব ও জাতীয় দলের কিংবদন্তী হয়ে উঠলেও জিওফ বেন্ট, ডানকান এডওয়ার্ডস, ডেভিড পেগ, টমি টেইলররা ২৪-২৫ বয়সেই না ফেরার দেশে পারি জমিয়ে ট্র্যাজিক হিরো হয়ে কেবল রয়ে যান শোকবহ ইতিহাসের পাতায়।



সেমি ফাইনালে প্রথম লেগে ওল্ড ট্রাফোর্ডে মিলানের বিপক্ষে ২-১ গোলে জিতলেও সান সিরোতে পরের লেগে ৪-০ গোলে হেরে ইউরোপিয়ান কাপ থেকে বিদায় নেয় ভগ্ন হৃদয় ম্যানচেস্টার। আর ফাইনালে মিলানকে ৩-২ গোলে হারিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ টানা তৃতিয়বার জিতে নিজের করে নেয় ইউরোপিয়ান কাপের প্রথম ৩ টি শিরোপাই। এই বিমান দুর্ঘটনা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ইতিহাসেতো বটেই সমস্ত ফুটবল বা সমগ্র ক্রিড়া ইতিহাসেরই অন্যতম বিয়োগান্তক একটা ঘটনা। ওপার থেকে দলের বিদায় দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না জিওফ বেন্ট, রজার বার্ন, এডি কোলম্যান, ডানকান এডওয়র্ডস, মার্ক জোন্স, ডেভিড পেগ, টমি টেইলর, বিলি হুয়েলানদের। এতকিছুর পরও খেলা চালিয়ে যাওয়াই বড় কথা। ববি চার্লটনরা আর কিই বা করতে পারতেন?



সেদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখতে বিধাতার ইচ্ছের যথার্থতাই সারাটা খেলোয়াড়ি জীবনে প্রমাণ করে গেছেন স্যার ববি চার্লটন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.