নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বুলবুলি নিরব নার্গিস বনে

১৭ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৪৭

বাড়ির নাম ফলকে বড় বড় করে লেখা আকবর আলী খান, বিএ, মেমোরিয়াল। বাড়ির মালিক যখন বিএ পাশ করেছিলেন তখন তা অবশ্যই একটা বিশেষ বস্তুই ছিল। আজ থেকে শতবর্ষপূর্বের একজন স্নাতক এই বাংলায় আর ক’জন ছিল কে জানে।



তবে এই শতবর্ষ পরেও এই আকবর আলী খান, বিএ মেমোরিয়ালের পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে আমাদের দাড়ানোর কারণ তার সেই বিএ পাশ করার অসামান্য যোগ্যতা নয়, বরং আপাত দৃষ্টিতে তার খুবই সামান্য একটা যোগ্যতা। তার সেই বিরল মেধার চেয়েও, সেই বিএ পাশের অর্জনের চেয়েও আমাদের মতো পরিব্রাজকের কাছে খান সাহেবে কালজয়ী অর্জন সৈয়দা খাতুন নামের এক তরুনীর মামা হতে পারা। এতদিন পরে এসে তার বিএ পাশের সার্টিফিকেটের চেয়ে সেই ভাগ্নীই তার মুখ উজ্জল করে তুলল আমাদের কাছে। সেই সৈয়েদা খাতুন, যার রূপ মুগ্ধ করেছিল তরুণ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। নজরুলকে মুগ্ধ করা সেই অপরূপ রূপই সারা জীবন কাঁদিয়ে গেছে সৈয়দা খাতুনকে। সৈয়দা খাতুনের সবচেয়ে সৌভাগ্যেটিই শেষ পর্যন্ত যার হয়ে গেল তার সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ইতিহাস।



কলকাতার মুসলিম সাহিত্য সমিতিতে প্রকাশক আকবর আলী খানের সাথে প্রথম পরিচয় হয় কবি নজরুলের। খান সাহেবের সাথে ২২ বছরের তরুণ নজরুল প্রথম দৌলতপুর আসেন ১৯২১ সালে। প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব আর প্রাণপ্রাচুর্যেপূর্ণ নজরুল দ্রুতই মিশে যান খান সাহেবের বাড়ির লোকজনের সাথে। খান সাহেবের দুুই বিধবা বোনও থাকতেন একই বাড়িতে। এক বোনের মেয়েই ছিল এই সৈয়দা খাতুন। তরুণ নজরুল তার প্রতিভায়, প্রেমে, বাশির সুরে মুগ্ধ করেছিলেন সৈয়েদা খাতুনকে। আর ষোড়শী সৈয়েদা খাতুনের রূপ দিওয়ানা করেছিল নজরুলকে।



সেবার দৌলতপুরে মাস দুয়েক ছিলেন নজরুল। প্রথম যৌবনের সেই উত্তাল প্রেমে দু মাসই হয়তো যথেষ্ট--ভেসে যেতে থাকেন দু’জন। আলি আকবর খান মেমোরিয়ালের পাশেই পুকুর, বাধানো পুকুর ঘাট। পুকুর পারেই টাইলস বাধানো মৃত আম গাছের গুড়ি। যেই আম গাছ তলে, যেই পুকুড় পাড়ে বসেই হয়তো নজরুল লিখেছেন তার বেদনা-অভিমান, অবেলা, অনাদৃতা, পথিক প্রিয়া, অকরুণ প্রিয়া, শেষের গান, বেদনামনি, লক্ষিছাড়া, বিদায় বেলা’র মতো গান-কবিতাগুলি। পাশেই কোথাও ছিল ঝিঙে ফুল কবিতার ঝিঙে ফুলে ছাওয়া মাচা। এই দৌলতপুরে বসেই বেশকিছু কবিতা ও গান লেখেন নজরুল। কারো কারো মতে ১৬০ টি গান এবং ১২০ টির মতো কবিতা রচনা করেন এসময়। বলা বাহুল্য সেই সব গান-কবিতার মূল উপজীব্য সেই উত্তাল প্রথম প্রেম আর পল্লী প্রিয়া সৈয়দা খাতুন। যাকে ভালবেসে নজরুল ডাকতেন নার্গিস নামে।



এই প্রণয়কে দ্রুতই পরিণয়ে রূপ দেবার উদ্যোগও নেয়া হয় নার্গিসের পরিবার থেকে। ১৯২১ সালের ১৭ই জুন শুক্রবার নজরুল-নার্গিসের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়, তৈরী করা আমন্ত্রণপত্রও । কিন্তু নজরুল-নার্গিসের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল কিনা তা নিয়ে ধোয়াশাই রয়ে যায়। খান বাড়ির কোন আচরণ, আকবর আলী খান, বাড়ির অন্য কেউ বা স্বয়ং নার্গিসের কাছ থেকে কিছুটা অনাদর নজরুলের সংবেদী কবি মনকে মারাত্বক ভাবে আহত করেছিল। কলকাতাসহ বিভিন্ন যায়গায় থাকা নজরুলের বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ীরাও এই বিয়ের ব্যাপারে ঠিক ইতিবাচক মনভাব পোষণ করতে পারেননি। সর্বোপরি বিয়ের কাবিননামায় বিয়ের পর নার্গিসকে নিয়ে নজরুলের দৌলতপুরে স্থায়ী হবার ধারাটিও ক্ষুদ্ধ করেছিল নজরুলকে। সবকিছু মিলিয়ে নার্গিসরা বাউন্ডুলে নজরুলকে গৃহী করার বদলে আরও করে তোলে বাধনহারা। নজরুল কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসর রাতেই ত্যাগ করেন দৌলতপুর।



এর পর আরও চার বার কুমিল্লা আসলেও আর কখনও দৌলতপুর ফিরে আসেননি নজরুল। কখনই ফিরে আসেননি প্রিয়া নার্গিসের কাছে। এমনকি উত্তরও দেননি নার্গিসের আকুতি ভরা চিঠিগুলোর। নার্গিস নানান ভাবে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন একটিবার কবির সাথে দেখা করার। নজরুল সযত্নে এড়িয়ে গেছেন দেখা হবার সকল সম্ভবনা। শুধু তাই না, নানাভাবে নিবৃত করার চেষ্টাও করেছেন নার্গিসকে। প্রিয়ার কাছে লেখা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম উজ্জল এক চিঠিতে অনেকটা স্পষ্ট করেই বলেন নিজের বক্তব্য। সেই রাতের সেই ঘটনার ১৬ বছর পর ১৯৩৭ এর জুনে লেখা এক চিঠিতে কবি বলেন—



...আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি--তা দিয়ে তোময় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। ...তোমার যে কল্যান রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মত চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে।



...আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব,--তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।



দেখা? না-ই হ’ল এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগ্ধ, হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাস আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো পিয়তমাকে পায়নি।



...যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষ রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করোনা। ... তুমি সুখি হও, শান্তি পাও--এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই--এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।




নার্গিসের সাথে বিয়ের ঘটনার মাত্র বছর তিনেক পরেই এই কুমিল্লারই মেয়ে প্রমিলাকে বিয়ে করে নজরুল সংসারী হলেও নার্গিস অপেক্ষা করে গেছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। সুদীর্ঘ ১৭ টি বছর আশায় আশায় নজরুলের পথ চেয়ে কাটিয়েছেন নার্গিস। এমনকি এই ’বিদায়ী চিঠি’র পরও কী এক আশা নিয়ে নার্গিস কলকাতায় গিয়েছিলেন কবির সাথে দেখা করার জন্য। কলকাতার এক হোটেলে কবির সাথে শেষ বারের মতন দেখা হয় নার্গিসের। অপ্রস্তুত নজরুল তেমন কোন কথা বলতে পারেন নি। শুধু বলেছিলন খুব শীঘ্রই ঢাকায় এসে দেখা করবেন। কিন্তু নজরুলের সেই ’খুব শীঘ্রই’ আর কখনোই আসেনি নার্গিসের জীবনে।



কবি তার অভিমান হয়তো কখনই ভুলতে পারেননি। নার্গিসের একের পর এক চিঠির প্রত্যুত্তরে নিজেই লিখে গেছেন একের পর অভিমানী-বিরহী গীতি-কবিতা। অভিমান ভরেই কবি লিখে গেছেন--



যারে হাত দিয়ে মালা দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখ তারে?

ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।।




কিন্তু জীবন থেকে নার্গিসকে চিরতরে সরিয়ে দিলেও নার্গিস বারংবার ফিরে এসেছে কবির কবিতায়, গানে, রচনায়--



তবু মাঝে মাঝে আশা জাগে কেন

আমি ভুলিয়াছি ভোলেনি সে যেন

গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে

আজও সে পথ চাহি সাজে।।

আজও মধুর বাশরী বাজে

গোধূলী লগনে বুকের মাঝে।।




কলকাতার হোটেলের সেই দেখাই কবির সাথে নার্গিসের প্রেম উপখ্যানের শেষ দৃশ্য। উপখ্যানের পরও পরিশিষ্ট থাকে। নজরুলের জন্য দীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষার পর ১৯৩৮ সালে ৩৪ বছর বয়সে কবি আজিজুল হাকিমকে বিয়ে করেন নার্গিস। নজরুলের কাছ থেকে দূরেই সরে যেতে চেয়েছিলেন নার্গিস। একবুক কষ্ট নিয়ে ১৯৮৫ সালে ৮১ বছর বয়সে নজরুলের ঢাকা থেকে অনেক অনেক দূরের ম্যানচেস্টার শহরে পরলোক গমন করেন নার্গিস।



কুমিল্লার মুরাদনগর থানার দৌলতপুরের নজরুল গেটে পৌছাতে পৌছাতে গোধূলী লগ্ন হয়ে গেল। আশ না মিটতে মিটতেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল। বাইরের মাঠের নজরুল মঞ্চে বসে বসে বারবার মনে হলো আরেকটু আগে বের হলেই ঠিকমত ঘুরে দেখা যেত পুরো এলাকাটা, হয়তো খুজে পাওয়া যেত নজরুল বা নার্গিসের স্পর্ষ, তাদের প্রেমময় সোনাঝরা দিনগুলোর দিনপঞ্জি। যেখানে মাটিতে, ঘাসে, পুকুর পাড়ে, গাছের ছায়ায় পদচিহ্ন আর এক কিশোরী হৃদয়ে ভালোবাসার চারা রোপন করে রেখে চলে গেছেন কবি। আর বছরের পর বছর কবির অপেক্ষায় সেই চারা গাছে পানি দিয়ে, রোদ দিয়ে, ছায়া দিয়ে বড় করে তুলেছেন কবির ভালোবাসার নার্গিস।



আরেকটু আগে না আসার আক্ষেপের সাথেই মনে হলো এই আক্ষেপ, এই অতৃপ্তিই তো নার্গিসের প্রকৃত পরিচয়।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৫৪

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:


অনেক অজানা কিছু জানলাম।

২| ১৭ ই আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

স্নিগ্ধ শোভন বলেছেন: অজানা কিছু জানলাম।

৩| ১৮ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:০১

সুমন কর বলেছেন: কেমন আছেন?
অনেক দিন পর, আপনার লেখা পেলাম। পরে পড়তে হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.