নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বন্ধু বিদায়

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১১:৫২

একবছরেরও বেশী সময় পর অভিমান ভুলে গত রাতে বাড়ি ফিরে গেছে জিয়া, জিয়া বন্ধু। প্রথম চরণ পড়েই বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ ভ্রু কুচকে তাকাতে পারে। বঙ্গবন্ধুর কোন প্রতিদ্বন্দী দাড় করানোর জাতীয়তাবাদী কোন হীন চেষ্টা নয়তো? যে যাই ভাবুক, প্রথমেই আশ^স্ত করে নেয়া যাচ্ছে যে, জিয়া বন্ধুর সাথে জনাব জিয়াউর রহমান বা বঙ্গবন্ধুর কোন সম্পর্ক নেই। যদি একান্তই মিলে যায়, তা আমাদের অনভিপ্রেত কাকতালমাত্র।

বন্ধুর ফেইসবুক নামও ওই ’জিয়া বন্ধু’। আমর বড় ভাইএর মোবাইলেও দেখি ওর নাম জিয়া বন্ধু নামেই সেভ করা। সোহাগের ছোট ভাই এবং তার বন্ধুরাও দেখি দেখা হলে ওকে জিয়া ভাই না বলে ডাকে জিয়া বন্ধু বলেই। এমনকি নতুন কারো সাথে পরিচিত হবার সময় সে নিজেও হ্যান্ড শেইক করতে করতে ”নেইম ইজ বন্ড, জেমস বন্ড” স্টাইলে নিজের পরিচয় দেয় ’জিয়া, জিয়া বন্ধু’ বলে।

ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়ায় আপাতত শেষ হলো ঐতিহাসিক এক অধ্যায়ের।

আজ থেকে অনেক অনেক আগে কোন এক সোনালী যুগের প্রতিভাবান লোকেদের ছিল এই ঘর পালানো রোগ। বাউন্ডুলে থেকে এক সময় তারা হয়ে উঠতেন মস্ত কোন কবি, সাহিত্যিক, চিত্রনায়ক, ব্যবসায়ী বা বিপ্লবী। বাড়ি ঘর, সমাজ সংসার ছেড়ে তারা হয়ে উঠতেন সার্বজনীন, সর্বকালীন। গল্প উপন্যাসে পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি এমন সব মহান মানবের কথা। আামার ধারনা ছিল এই কলিকালে সেই সব মহানায়কেরা আজ বড় বিপন্ন। কিন্তু এই জিয়া বন্ধু প্রমাণ করে দিল মহা মানবেরা অস্ত্র জমা দিলেও ট্রেনিং কখনো জমা দেয় না। তারা হয়তো তাদের সেরা সময়টায় নেই, কিন্তু যেটুকু বাবার ঘুম হারাম করতে সেটুকুই যথেষ্ট।

ক্লাস টেন পর্যন্ত ঢাকায় পড়ালেখা করে এসএসসি পরীক্ষা দিতে যাই বগুড়ার নন্দ্রীগ্রামে। এসএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়েই ওদের সাথে পরিচয়--জিয়া, চৈতালী, ওবায়দুলদের সাথে। তখন গায়ে গতরে, শরীরে ও মনে আমরা সবাই ছোটই। জিয়া বন্ধু সেই ছোটদের মধ্যেও আকারে আরও ছোট, সহজ সরলের মধ্যে আরও সহজ সরল।

বন্ধু এসএসসিতে পেল ২.৭৫, বাবার খুব আশা ছিল ছেলে অন্তত ৩.০০ পাক। পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় বসল সে। পয়েন্ট কিছুটা উন্নতও করলো ছেলেটা। বাবার স্বপ্ন তবুও পূরণ করতে পারল না। দ্বিতীয় বারে সে পেল ২.৮৮! এইচএসসি পাশের পর বাবার ইচ্ছা ছেলেকে অনার্স পড়াবেন, ছেলে জোটাতে পারল ডিগ্রি। এক বছর ডিগ্রি পড়ার পর পিতার স্বপ্ন পূরণে আবারও অনার্স ভর্তি পরীক্ষা। এবার শিকে ছিড়লো। বন্ধু বাংলায় ভর্তির সুযোগ পেল। তাই সই। অনার্স তো। এসব করে করে জিয়া বন্ধু যতদিনে অনার্স-এর যাত্রা শুরু করতে পারল ততদিন আমাদের ¯œাতক শেষের দিকে, তৃতীয় বর্ষ চলছে।

যাই হোক এই বাংলায় পড়তে পারাটা বন্ধুর অনেক উন্নতি সাধন করেছিল। এসএসসির পর আমি ঢাকায় চলে আসায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি-পত্র। সেই চিঠি পত্রেই নিয়মতি যোগাযোগ চলতে থাকে বন্ধুর সাথে। জিয়া বন্ধুর সেই চিঠির সাথে মিল পাওয়া যায় একালের বাংলাদেশী চলচিত্রের নায়ককুলশিরমণি অনন্ত জলিলের সাথে। তার ভাষার ব্যাবহার, অলঙ্কারের প্রয়োগ এবং চিঠির বিষয় বস্তু সবকিছ’ই। অনন্ত জলিলের কঠিন বাস্তবতাধর্মী সিনেমা দেখতে দেখতেও যেমন দর্শক শ্রোতাদের মুখে একটা স্মিতহাষ্য রেখা দেখা যায়, জিয়া বন্ধুর চিঠিও তেমনি একটা বাস্তবধর্মী বিনোদন। সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল তার বিরাম চিহ্নের অভিনব ব্যবহার। সে অবলিলায় লিখে গেছে ”বন্ধু, আজকে আমার মনটা খুব খারাপ!” কিংবা ”বন্ধু, আমার নতুন একটা প্রেম হয়ে গেল?”র মত চিরন্তনী চরণগুলো।

যে বাবার জন্য জিয়ার এত এত ত্যাগস্বীকার সেই বাবার কারণেই বন্ধুর বারংবার গৃহত্যাগ। অনার্স প্রথম বর্ষে ফেল করার অপরাধে বাবার হাতে চড় খেয়েই প্রথমবার ঘর ছাড়তে হয়েছিল বন্ধুকে। অনার্স পড়–য়া একটা ছেলে, ফেইল করার শোক না হয় সে সহ্য করতে পারে, কিন্তু পিতার হাতে প্রহার? না, এ শোক, এ অপমান অসহনীয়। অতএব চিরতরে পিতার চোখের আড়ালে চলে যেতেই সেবার পৃহপলায়ন।

সেবার এসে মাস তিনেক ছিল ঢাকায়। তখন আমরা ঢাকার বন্ধুরা মিলে একটা কোচিং সেন্টার দাড় করানোর চেষ্টা করছিলাম। জিয়া বন্ধুকে সেই কোচিংএর ম্যানেজারির চাকরি দিয়ে দিলাম। সাথে একটা টিউশনি। Failure is the pillar of success এর সার্থকতা প্রমাণ করেই যেন সে রাতারাতি শিক্ষক বনে প্রমাণ করে দিল ”Those who can, do; those who can't, teach.” এবং শিক্ষকতার গাম্ভীর্য নিয়ে ভালোই কাটাচ্ছিল দিন কাল। কিন্তু বাড়ির ক্রমাগত আহ্বান, আমন্ত্রণ আর নিজে উপার্জন করে ঢাকা শহরে বসবাসের কঠিন বাস্তবতায় যথা সময়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাড়ি ফিরেও গিয়েছিল ছেলেটা। আমে দুধে মিলে মিশে গেল আর আটী গেল মরা ঘাসে। পিতা-পুত্র ঠিকই মিলে গেল, অথচ ওকে ’রাজনৈতিক আশ্রয়’ দেবার অপরাধে আমি ও আমর ঢাকার বন্ধুরা ওর বাবার কালো তালিকাভূক্ত হয়ে গেলাম। তার পরও বন্ধুত্বেও নামে কিছু একটা করতে পারার শ্লাঘা নিয়ে আমরা দিন যাপন করতে লাগলাম। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে ভেবে একবার জিয়ার সাথে ওর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর হাতের নাগালে পেয়ে আমাকে উপযুক্ত শিক্ষাও দিয়েছিলেন ওর বাবা।

ন্যাড়া একবারাই বেল তলায় যায়। প্রথম পলায়নের বছর চারেক পর জিয়া বন্ধু ন্যাড়া মাথায় আমাকে দ্বিতীয়বারের মতো নিয়ে গেল বেলতলায়। বলাবাহুল্য এই চার বছরেও সে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে এক বিষয়ে অকৃতকার্যতাসহ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। প্রেমে পড়ার এক অনন্য ক্ষমতা আছে জিয়া বন্ধুর--টানে সবাইকে, কাউকে বাধনে জড়ায় না। পড়ালেখার চেয়ে প্রেমই যার পরম আরাধ্য দু’চার বিয়ষে পাশ-ফেইল এ তার কী বা আসে যায়। কিন্তু পিতৃক’ল কবে যথাসময়ে সন্তানের ভালোবাসার মূল্য বুঝতে পেরেছে? অতএব আমাদের ধারনা গৃহত্যাগের পটভ’মি এবারও একই। তাই এবার যখন সে আবার বাড়ি পালাল আমি এবং আমার এলাকার বন্ধুরা বাড়ি ফিরে যাবার জন্য ভালোমতোই চেপে ধরেছিলাম ওকে। কিন্তু বন্ধু আমাদেরকে বললো ওর পিতা মহাশয় নাকি দ্বিতীয়বরের মতন দ্বার পরিগ্রহণ করতে ইচ্ছুক, সে জন্যই তার এই প্রতিবাদ। তাই এবার ও কিছুতেই বাড়ি ফিরে যাবে না। বাড়ি ফিরতে হলে নাকি যাবে ওর লাশ। প্রয়োজনে সে রিকশা চালাবে, নাপিতের কাজ করবে তবু ওই পিতার মুখ সে আর দেখতে চায় না, পিতাকে দেখাতে চায় না নিজের মুখ। সত্যি সত্যি ওর এলাকার কোন এক রিক্সাওয়ালার ফোন নাম্বার জোগাড় করে একটা রিক্সার জন্য ঘোরাঘুরি শুরু করলো। বুয়েট এলাকায় ওর গ্রামের এক ছেলে একটা সেলুন চালায়। দু’চার বার তার সাথেও দেখা করে আসল।

তার পরও ওর পিতার সেই ”শিক্ষার কথা” মনে করে আমি বাড়ি ফিরে যেতে বললে ক’দিন আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, সোহাগের বাসায় গিয়ে থাকে। সোহাগ বাড়ি যেতে বললে ক’দিন ওর বাসা ছেড়ে আমার বাসায় এসে থাকে। দু’জনে একসাথে বললে এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করা আরেক বন্ধুর কাছে গিয়ে ক’দিন এক্স-রে রুমে ঘুমায়। আর সবাই একসাথে বাড়ি চলে যেতে বললে কমলাপুরের দিকে হাটা দেয়। সুইসাইড করতে, নাকি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবার জন্যে কমলাপুর যায় কে জানে। শেষ পর্যন্ত কমলাপুর যেয়ে বিআরটিসির বাস ডিপোর পাশে ঘোরাফেরা করতে করতেই ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটে বিআরটিসি এ/সি বাসের সুপারভাইজারের একটা কাজ জুটিয়ে ফেলল।

আর গত এক বছরে বাসের হেলপারি-সুপারভাইজারি, টিকেট চেকার, কাউন্টারে টিকেট বিক্রেতা, নাটকের শ্যুটিং ইউনিটের সহাকরী, পদ্মাসেতুর এক প্রজেক্টের অফিস সহকারী--অনেক কাজই করল ছেলেটা। অথচ গ্রামের দু’চারজন সম্পদশালী প্রভাবশালীর একজন ওর বাবা, যিনি বছরে দু’এক বার মটর সাইকেলের মডেল পাল্টান। ওদের নিজেদের জমি চাষ করতেই আছে নিজস্ব ট্রাক্টার, আছে নিজস্ব গভীর নলকূপের সেচের ব্যবস্থা, আছে গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু। ওই এলাকার ঐতিহ্য অনুযায়ী আছে মাটির দোতলা বাড়িও। সেই ছেলে ঢাকায় এসে একটা মসজিদের মেসের ছোট্ট রুম দুইজন ভাগাভাগি করে থাকে। রুমমেটের চৌকি আছে চৌকিতে ঘুমায়, ওর ওসব কিছু না থাকায় ফ্লোরেই ঘুমায়। সোহাগের বাসা থেকে কিছু কাথা বালিশ, আমার বাসা থেকে কিছু হাড়ি-পাতিল নিয়ে একার একাহারি সংসার।

এভাবেই কাটিয়ে দিল এক বছরের বেশী কাটিয়ে দিল। মায়ের চোখের জল, ভাই এর আহ্বান আর ভাবীর আকুতি যা পারেনি তা পারল কোন এক পদ্মাসেতু প্রকল্প। পদ্মা সেতুর কাজ বারং বার পিছিয়ে যাওয়াতে মাস খানেকের বেতন না পাওয়ায় অবশেষে মাইকেল মধুসূদনের মতো তারও বোধোদয় হয়--’’ওরে বাছা মাতৃকোষে রতনের রাজি/ এ ভিখারি দশা তবে তোর কেন আজি?/ যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে”।

কদিন যাবৎই বলছিল চলে যাবে। যাবার দিন অফিসের নিচে আসল দেখা করতে। পাঁচশত টাকা আর বিদায় নিয়ে সহজভাবেই চলে গেল বন্ধু। আমি যতবার বগুড়া গিয়েছি কিংবা বন্ধু যতবার ঢাকায় বেড়াতে এসেছে প্রতিবারই চোখের জলে বিদায় নিয়েছে সে। বগুড়া থেকে আমাদের বাসে উঠিয়ে দিয়ে হন হন করে হেটে চলে যেত। পাছে ওর চোখের জল ধরা পড়ে যায়। বিদায় বেলায় জিয়া বন্ধু আমাদের জন্য যতবার চোখের জল ফেলেছে আমি নিশ্চিত সোহাগ, আমি, দিপু বা আরও যেসব বন্ধুরা আছি, যত নারী আমাদের ভালোবাসতে পেরেছে আর যারা ভালোবাসতে পারেনি তারা কেউই আমাদের জন্য এতবার চোখের জল ফেলেনি। এবং অবশ্যই বারো মাসে তেরবার ’নতুন প্রেম হয়ে যাওয়া’ জিয়া বন্ধু তার কোন ’নায়িকা’র জন্য কখনও অশ্রু বিসর্জন করেনি।

তাই এবারের বিদায় বেলায় বন্ধুর নির্লিপ্তি দেখে শুধু এটুকুই বুঝলাম যান্ত্রিক ঢাকা শহর অনেকটাই বদলে দিয়েছে আবেগী জিয়া বন্ধুকে। বিদায় নিয়ে চলে যাবার ঘন্টা খানেক পর বন্ধুর একটা এসএমএস পেলাম--”তোর ৫০০ টাকা হারিয়ে ফেলেছি?”

হঠাৎই মনে পড়ল জীবনের শেষ ইনিংসে স্যার ডন ব্রাডম্যানের বিখ্যাত ”ডাক”-এর কথা। অনেকেই বলেন ভক্তদের ভালোবাসায় আপ্লুত ব্রাডম্যানের মনসংযোগ নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকবে। জিয়া বন্ধুও কি ব্রাডম্যান রোগে আক্রান্ত হয়েছিল? ঘর পালানো রোগ, ব্রাডম্যান রোগসহ সকল রোগ থেকে জিয়া বন্ধু দ্রুত আরোগ্য লাভ করুক, সে তার অভিমান, প্রেম এবং পিতাকে নিয়ে সুখী হোক। আমিন।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১১:২৪

আমিনুর রহমান বলেছেন:




যান্ত্রিক ঢাকা শহর এমনই যান্ত্রিক এখানে সবাইকে যান্ত্রিক বানিয়ে দেয়।


পোষ্টে +

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.