নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

জনৈক র‌্যাব ও বনবাসের গল্প

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৪০

একজন র‌্যাব গতরাতে ফোন করেছিল হঠাৎ।

অনেক কথা অনেক প্রশ্ন করল আমাকে, অনেক কথা জানতে চাইল। অনেকের নাম-ধাম ধরে জানতে চাইল তারা বর্তমানে কে কোথায় আছে, কী করছে। আমি সত্য বই মিথ্যা বলিলাম না--যতদূর জানি সবই জানালাম। শাওন বরিশালে, আহসান কুমিল্লায়, শৈবাল চট্টগ্রামে, নজরুল এখনো পুরান ঢাকাতেই অবস্থান করছে। এমন কি র‌্যাব এক সময় আমার স্ত্রী এবং শিশু সন্তানের কথাও জানতে চাইল। আমি ভীত না হয়ে স্ত্রী-সন্তান এবং পিতা-মাতাকে নিয়ে যে ভালোই আছি বরং আনন্দের সাথেই তাকে তা জানালাম। পুত্র অফিসে যাবার সময় পিতার জুতা ব্রাশ করে দিতে শিখেছে, শিখেছে পিতার পকেটে মোবাইল-মানিব্যগ ভরে দিতে, অফিস থেকে ফেরার সময় বারান্দায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে...

এসব শুনতে শুনতে র‌্যাবও একসময় র‌্যাবের বুকও বুঝি খা খা করে উঠলো। র‌্যাবের চোখও বুঝি খানিকটা স্বপ্নীল হয়ে উঠলো। আমার অফিসের সব ক্লান্তিই যে বাসায় ফেরা মাত্র এক নিমিষেই দূর হয়ে যায় একপর্যায়ে নিজে থেকেই র‌্যাব সে কথাও বলল। কথায় বোঝা গেল সন্তানের পেছন পেছন ছুটো-ছুটি করতে করতে শ্রান্ত হয়ে সেও দূর করতে চায় তার অফিসের সকল ক্লান্তি। বোঝা গেল সেই র‌্যাবের বুকের ভেতরে ভেতরে একজন স্বামী, একজন পিতা বেড়ে উঠছে।

র‌্যাবেরও যে প্রেম থাকে, থাকে সন্তান বাৎসল্য তা যেন কিছুটা নতুন করেই আবিস্কার করলাম। নতুন করে আবিস্কার করলাম কারণ আমরা আমজনতা জানি যে র‌্যাবের কালো পোশাক, চোখে কালো চশমা আর হাতে কালো বন্দুক ছাড়া তাদের আর কিছু নেই। বন্ধু নেই, পরিবার নেই, কোন বাৎসল্য নেই, কোন ভালোবাসা নেই, আদি নেই, অন্ত নেই, তারা র‌্যাব। কিন্তু গতরাতেই জানলাম যে ক্রসফায়ারের বাইরেও আর দশজন মানুষের মতন র‌্যাবের আরও অনেক কিছুই থাকে। র‌্যাবেরও বন্ধু থাকে, ভালোবাসার নারী থাকে, থাকে সন্তানের আকাংখাও ।

র‌্যাবের নামে বাঘে-মহিষে যেখানে এক ঘাটের জল খায় সেখানে আমার মতন একজন সাধারণ মানুষের নির্লিপ্তির কারণ হতে পারে দুটি--এক. র‌্যাবকে র‌্যাব হিসেবে যথাযথ ভাবে চিনতে পারার সুস্থ জ্ঞানের অনুপস্থিতি এবং দুই. কঠিন বিপদের সময় মানুষের বোধশক্তি লোপ পাওয়া। তবে আমার বেলায় এই দুটির বাইরেও তৃতীয় আরেকটি কারন ঘটল। তৃতীয় কারনটি হলো এই র‌্যাব আমার পূর্বপরিচিত, যার সাথে একই রুমে বসে বছর ছয়েক ক্লাস করেছি, গ্রুপ এ্যাসাইনমেন্টে একই মঞ্চে দাড়িয়ে প্রেজেন্টেশন করেছি, হলে ওর বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করেছি। তখন অবশ্য সে র‌্যাব ছিল না। তখন ও ছিল একজন সন্তান, একজন শিক্ষার্থী, একজন প্রেমিক, একজন বন্ধু। এখন সবকিছু ছাপিয়ে ওর বড় পরিচয় ও র‌্যাব।

একজন ছাত্র যত বড়ই হোক, শিক্ষকের কাছে সে আজীবন ছাত্র। বা একজন সন্তান, সে যত বড়ই হোক পিতা-মাতার কাছে সে আজীবন সন্তানই--তেমনি বন্ধু যত বড়ই হোক, তার যত অর্জনই থাক বন্ধুর কাছে সে আজীবন বন্ধুই। অন্তত অর্জনে পিছিয়ে পরা বন্ধুটির কাছে।

সে দাবীতেই বন্ধুকে বলে বসলাম সে দু’চার জনকে পিটিয়েছে কিনা। বন্ধু অবাক হয়ে বলল দু’চারজন? দু-চারশ পিটিয়েছে। ক্রস ফায়ার? বন্ধর উত্তরের সাথে কোথায় যেন বেশ ক’বছর আগে শোনা রিকি পন্টিং এর উত্তরের মত লাগলো। একের পর এক রেকর্ড নিজের করে নিচ্ছিলেন পন্টিং। এত রেকর্ড কিভাবে করছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পন্টিং-এর বিনয়ী উত্তর ছিল--দীর্ঘদিন ক্রিকেট খেললে কিছু রেকর্ড এমনিতেই হয়ে যায়।

বন্ধুকে আবার ফস করে বলে বসলাম সে ফায়ার করেছিল কিনা?

অনেকক্ষণ নিরবতার পর বন্ধু জানালো- প্রেশার থাকেই। বাট আই ডিডনট।

আমি শুধু বললাম, কিপ দিজ ভার্জিনিটি...যতদিন পারা যায়। এবং সে কথা দিয়েছে।

তার পরও ’প্রেশার’ কথাটা কনে বাজছিল। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ সেই কবেই বলে গেছেন হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও নাকি দৃষ্টি যায় পশু পাখির দিকে। সেখানে হাতে বন্দুক এবং সাথে গুলি করার প্রেশার... এই প্রেশার থেকে কতদিন দুরে থাকবে আমাদের বন্ধরা?

ক্রসফায়ারের পর অনুভূতি কী? সে রাতে বাসায় ফিরে ওর নাকি খুব খারাপ লাগছিল। জানিনা এই খারাপ লাগা সারাদিন ক্লাস করে টিউশনি করিয়ে হলে ফেরা ছাত্রের খারাপ লাগা, গার্মেন্টস থেকে ফেরা শ্রমিকের খারাপ লাগা, প্রেম ভেঙ্গে দেয়া প্রেমিকের খারাপ লাগা নাকি অন্য কোন খারাপ লাগা। তবুও একটা ক্রস ফায়ারের পর একজন র‌্যাবের মন খারাপ হয় শুনে কোথায় যেন একটু আশার আলো উকি দিয়ে যায়। বন্ধুর প্রতি সহমর্মীতা থেকেই বললাম--এটাই পেশা, আমরা সবাই পেশার কাছে আমাদের স্বত্তা উৎসর্গ করি। মনে গোপন আশা, বন্ধুর অ-র‌্যাব সত্তা উৎসর্গীত না হোক, চিরঞ্জীবী হোক।

অথচ দু’বছর আগেও এই বন্ধু প্রতি মাসে হাজার টাকার উপর বই কিনত। দর্শনের বই, কবিতার বই। তার পরিকল্পনা ছিল চাকরির বেতন থেকে প্রতিমাসে তার ১০% বরাদ্দ থাকবে তার বই কেনার জন্য। জানিনা তার সে পণ এখনও আছে কিনা। যে ছেলে জীবনানন্দের কবিতা পড়ত তার বন্দুকের ক্রস ফায়ারেও একদিন মানুষ মরবে।

এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়াতে বন্ধু কিছুটা আহত হলো। তারপর শুধু হ্যামলেট-এর সুরে বলল--To be kind to mass sometimes you need to be cruel to someone.

***

আমাদের এলাকায় গত পরশু একজনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছে র‌্যাব। জানাগেল তার স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্তা। আমার শুধু মনে হলো বিধাতা কেন পিতার মৃত্যুর পরও সন্তানের জন্মের ব্যবস্থা রেখেছেন? মাতার মৃত্যুর মত পিতার মৃত্যুর পরও যদি সন্তানের জন্মের ব্যবস্থা বন্ধ রাখতেন! আর মাস দুয়েক পর যে শিশু ভুমিষ্ঠ হবে তাকে কী জবাব দেব আমরা? দূরহ হলেও স্ত্রীর পক্ষে হয়তো এর পরও একজন স্বামী পাওয়া সম্ভব, কিন্তু এই শিশু কী করে পাবে তার পিতাকে? এই ক্রসফায়ার থেকে অনেক অনেক দূরে আমার বন্ধুর পোস্টিং। তার পরও যখন আমার সন্তান আহ্লাদে-আপদে ছুটে এসে আমার বুকে আশ্রয় নেবে একজন র‌্যাবের বন্ধু হয়ে এই শিশুর সামনে আমি কিভাবে মাথা উচু করে বাঁচবো? সেই শিশুকে কে বোঝাবে হাজারো মানুষের প্রতি সদয় হতে গিয়েই তার পিতার প্রতি নিষ্ঠুর হতে হয়েছিল আমার বন্ধুদের?

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৪৫

সুপ্ত আহমেদ বলেছেন: অসাধারনঃ আমাদের এলাকায় গত পরশু একজনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছে র‌্যাব। জানাগেল তার স্ত্রী সাত মাসের অন্তঃসত্তা। আমার শুধু মনে হলো বিধাতা কেন পিতার মৃত্যুর পরও সন্তানের জন্মের ব্যবস্থা রেখেছেন? মাতার মৃত্যুর মত পিতার মৃত্যুর পরও যদি সন্তানের জন্মের ব্যবস্থা বন্ধ রাখতেন! আর মাস দুয়েক পর যে শিশু ভুমিষ্ঠ হবে তাকে কী জবাব দেব আমরা? দূরহ হলেও স্ত্রীর পক্ষে হয়তো এর পরও একজন স্বামী পাওয়া সম্ভব, কিন্তু এই শিশু কী করে পাবে তার পিতাকে?

২| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:০৬

হাসান মাহমুদ ১২৩৪ বলেছেন: To be kind to mass sometimes you need to be cruel to someone. :(

৩| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:২৬

সচেতনহ্যাপী বলেছেন: বাস্তব এবং সত্যিকথা হলো চাকুরী তথা পরিবারের কথা ভেবে সময়ে মানুষকেও অমানুষ হতে হয়,বাস্তবতার প্রেক্ষিতে।।
ধন্যবাদ সুন্দর একটি লেখার জন্য।।

৪| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১:৩৩

প্রফেসর মরিয়ার্টি বলেছেন: ক্রসফায়ারের নির্মমতা এবং পাশাপাশি র‌্যাবের সাথে সংশ্লিষ্টদের মানবিক দিক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

৫| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ ভোর ৪:৫৩

বিবাগী শাহেদ বলেছেন: Thanks for the nice humane writing. However, whatever job we are doing, we must not lose our conscience. These cross fires will hunt the responsible RAB members someday, may be after death, if we believe in life after death.

৬| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:৪৮

আমিনুর রহমান বলেছেন:




চমৎকারভাবে নির্মম বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছেন।

৭| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:৫২

তুষার কাব্য বলেছেন: নির্মম বাস্তবতার চিত্র ...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.