নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

যে কথা বলতে এসেছি

১৪ ই মে, ২০১৫ রাত ২:৪৬

যে কথা বলতে এসেছি তার বছর তিন চারেক আগের কথা।

তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক এক ছাত্র। সেই টগবগে যৌবনেও বোন-বান্ধবীদের নিয়ে কোন পার্কে-টার্কে বেড়াতে কেন যেন নিরাপত্তাজনিত আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগতাম। সবচেয়ে কম অনিরাপত্তা বোধ হতো আমার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং এর অতি আশেপাশের কিছু এলাকায়। তাই আমার বিবাহপূর্ব বছর পাচেকের প্রেম জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কেটেছে টিএসসি, ডাস আর সামসুন্নাহার হলের সামনে বসে বসেই। ’কেন একই যায়গায় বার বার’ এই প্রশ্নের জবাবে কখনো কবির মতন, কখনো দার্শনিকের মতন উত্তর দিতে হয়েছে ’এই বিশ্ববিদ্যালয়ইতো আমার সব’। ফাস্টফুডে বসার সামর্থ্য কিংবা সোহরাওয়ার্দী-রমনায় বসবার সাহস কোনটির অপ্রতুলতাই ঠিক পুরুষোচিত নয় বলে কাব্য কিংবা দর্শন ছাড়া কোন গতিও ছিল না।

যে কথা বলতে এসেছি তার বছর তিন চারেক আগের কথা।

সেবারও কোন এক শুভ বাংলা নববর্ষ। আমার ছোট বোন এবং গ্রাম থেকে আসা ফুপাতবোন পহেলা বৈশাখ দেখতে যাবে। সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে আমার আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। মল চত্বর, অপরাজেয় বাংলা, রাজুর পাদদেশ সব যায়গায় কনসার্ট চলছে। বড় বড় কনসার্ট ফেলে ওদের নিয়ে মল চত্বরের ছোট কনসার্টেই গেলাম। কারন মল চত্বর আমার আরও একধাপ নিজের এলাকা। আরও একটু নিরাপদ যায়গা।

এর ওর পরে কনসার্টে মিলার গান শুরু হলো। মিলার গান শুরু হতেই শুরু হলো দর্শক-শ্রোতাদের উন্মাদনা। উন্মাদনা এক পর্যায়ে কনডমের তৈরী বেলুন ফুলিয়ে ছোড়াছুড়িতে পৌছালো। মিলা গানের এক পর্যায়ে বলতে বাধ্য হলেন যে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে অন্তত আরও উন্নত ব্যবহার আশা করেছিলেন।

পহেলা বৈশাখের মতো সার্বজনীন একটা উৎসবের সেই কনসার্টে হয়তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বাদেও আরও অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিল। তারপরও ছোট দুই বোনের সামনে আমার উচু মাথা কিছুটা নিচু হয়ে গেল এই জন্যে যে, এটুকু অন্তত নিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছাড়া বহিরাগত কেউ কনডম ওড়ানোর আগে একশবার ভাববে।

যে কথা বলতে এসেছি তার বছর তিন চারেক আগের কথা।

আমার তখনও জানতে বাকি ছিল মানুষের মাথা উচুতে উঠতে উঠতে যেমন এভারেস্টকে ছাড়িয়ে যেতে পারে তেমনি নামতে নামতে পারে মারিয়ানা ট্রেঞ্চকেও ছাড়িয়ে যেতে।

কিছুক্ষণ পরে শুরু হয়েছিল হৃদয় খানের গান। হৃদয় খান যে তের-চৌদ্দ বছরের মেয়েদের হৃদয় কিভাবে খেয়ে বসে আছেন সেদিন দেখলাম। আমার দুই বোনের সেকি উচ্ছাস। সাথে আরও শত তরুণীর। গান শেষে আয়োজকরা খান সাহেবকে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে তার গাড়ি পর্যন্ত আর সেই মানব দেয়াল ঘিরে পরিমরি ছুটছে তার ভক্তরা। সাথে আমার দুই বোন। ওরা যাতে হারিয়ে না যায় সাথে সাথে যাচ্ছি আমিও। হৃদয় খান গাড়িতে ওঠার সময় যে জটলা তৈরী হলো আমি তার বাইরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দুই বোনের উপর চোখ রাখছিলাম। আমার হাত খানেক দুরত্বেই দেখা গেল বৈশাখী পাঞ্জাবী পরিহিত এক যুবক সকল বিপদ থেকে আগলে রাখার মতো করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তার সামনের তরুণীকে; পিতা যেমন আগলে রাখে সন্তানকে কিংবা স্বামী আলিঙ্গনে রাখে স্ত্রীকে, তেমনি দৃঢ়তার সাথে। যুবকটি যে তরুণীর পিতা কিংবা স্বামী নয় তা সহজেই অনুমেয় মেয়েটির হতচকিত দুচোখের ভাষা এবং অশ্রুধারা দেখে।

এমন পরিস্থিতিতে একজন সাহসী মানুষ কী করে কে জানে। কিন্তু একজন দুর্বল মানুষ কী করে আমি জানলাম। আমি কেবল যুবকটিকে মৃদু একটা ধাক্কা দিতে পারলাম। যুবকটি আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে ভিড়ে মিশে গেল। আর যে মেয়েটি এতক্ষণ তার সর্বস্ব সাথে নিয়ে হৃদয় খান নামের এক স্বপ্নের পেছন পেছন ছুটছিল হঠাৎই যেন সে যেন স্বপ্ন ভঙ্গের পর নিঃস্ব হয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির পথ ধরলো।

একজন সাহসী মানুষ হয়তো এক ঘুষিতে যুবকটিকে ধরাশায়ী করে ফেলত। আর আমার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটি আসলো তা হলো ছেলেটি কোন ছাত্র নেতা নয় তো? কিংবা ভিরের মধ্যে তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা কত জন আছে? তাছাড়া কোন ঝামেলা হয়ে গেলে আমার বোন দু’জনকে কে বাসায় পৌছে দেবে? এমন হাজারো চিন্তা। ছেলেটা তার অপকর্মের জন্য ভীত হয়েছিল কিনা কে জানে অথচ আমি ওই এক মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিজেই ভীত হয়ে পড়লাম--কোন ভুল করে ফেললাম না তো?

জানিনা এই ঘটনা আমার বোনদের বেলায় ঘটলে আমি কী করতাম। তখনও কি আমার আর দশটা সাধারণ মানুষের মত আপাত যুক্তিগত ব্যাক্তিক চিন্তাই প্রাধান্য পেত নাকি আমি যুক্তির নিকুচি করে ঝাপিয়ে পরতাম? কে জানে আমার মতন মানুষেরা হয়তে তখনও লোকলজ্জার ভয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রচার না বড়িয়ে বেছে নিতাম পেছনের দরজা দিয়ে পলায়ন।

যেদিনের কথা বলতে এসেছি তা হয়তো সেই যুবক ভুলেই গেছে। ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক, কেননা সে বর্ষবরণ বা অন্য যেকোন জনসমাবেশেই হয়তো এই চেষ্টা করে থাকে। আগে বা পরে হয়তো আরও ঘটনা ঘটেছে তার হাত দিয়েই। তার ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। আমিও ভুলেই গিয়েছিলাম। কারন যেদিনের কথা বলা হল তা কোন পত্রিকায় আসেনি। আসেনি কোন টিভি চ্যানেলে। ধরা পরেনি কোন সিসি ক্যামেরায়। কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই জানি, এই স্মৃতি কোনদিন মুছে যাবে না সেই তরুণীর হৃদয় থেকে।

অবশ্য ভুলতে পারলেই তার জন্য ভালো হতো। কেননা একজনের জাপটে ধরার প্রতিকার চাইতে গেলে জাপটে ধরবে ডজন খানেক পুলিশ, যৌন নিপীড়নের সেই বেদনা নিয়ে সে যদি প্রতিকার চাইতে যায় তাকে ঘরে ফিরতে হবে পুলিশের পীড়নের ক্ষত শরীরে নিয়ে।

সেই যুবক যদি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে থাকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমি লজ্জিত। একজন পুরুষ হিসেবে আমি অপরাধী। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেই ছাত্র সুযোগ বুঝে কোন তরুণীকে জাপটে ধরতে সিদ্ধহস্ত তারাই হয়তো একদিন বড় হয়ে পুলিশ হয়, হয় নীতি নির্ধারক। ...আট ক্রোশ পথ হাটা বিদ্যা যে সকল ছেলের পেটে তারাইতো একদিন বড় হইয়া গ্রামের মাথা হয়। দেবী বিণাপানির বরে সংকীর্ণতা তাহাদের মধ্যে আসিবে কী করিয়া?... সংকীর্ণতা তাহাদের মধ্যে আসেও না।

নেপলিয়ন অনেক আগেই বলে গেছেন----“the world suffers a lot. Not because of the violence of bad people, but because of the silence of good people.”

এই ”নিরব ভালো মানুষ”গুলোর জন্যই আজ আমাদের সমাজের এই অবস্থা। এসব ঘটনা বারংবার ঘটে যতটা না যারা ঘটায় তাদের কারনে তার চেয়ে বেশী ঘটে যারা এর প্রতিবাদ করেনা, প্রতিকার করে না তাদের কারনে। আমার মতন মানুষগুলো সমাজে থাকা একটা আফসোস। আর একটা আফসোস হলো এই যে এই সব ঘটনাবলি প্রতিকার বিহীন এমন একটা সময়ে যখন বিগত সিকি শতাব্দীতে এই দেশের সর্বময় ক্ষমতায় সেই নির্যাতিত সমাজেরই একজন প্রতিনিধি

যে কথা বলতে এসেছি তা বছর তিন চারেক আগের কথা। সেটিই যে শেষ ঘটনা ছিল তা নয়। গত তিন চার বছরে এর পর নিশ্চিত ভাবেই ঘটেছে এমন হাজারো ঘটনা। আজই যদি কোন ব্যবস্থা না নেয়া যায় আগামী তিন চার বছরে তা চলতেই থাকবে। চলতেই থাকবে আগামী ত্রিশ চল্লিশ বছরেও।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই মে, ২০১৫ রাত ৩:৪৯

অপ্রতীয়মান বলেছেন: সমস্যাটা হচ্ছে এদের যারা আশ্রয় দিচ্ছে তারা। এদের এইসব নোংরা কাজকর্মের জন্যে যদি পেছন থেকে সমর্থন না পেতো। নীতিগত দিক থেকে ভুলের জন্যে যদি ওনারাই শাস্তির বিধান করতো তাহলে এই এদের দৌরাত্ব এতদূর পর্যন্ত গড়াত না। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টো। আর সেই কারণেই ঘটনা গুলির পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে।

তবুও আপনি নিজের অবস্থান থেকে সাহস করে হাত তুলেছেন। বহিরাগত কেউ তো সেটাও করার সাহস পাবে না, আবার যখন এই অবস্থা দেখবে তখন সে বাইরে এসে আলোচনা করবে সেই আপনাদের নিয়েই।

২| ১৪ ই মে, ২০১৫ সকাল ৮:১০

সমুদ্রতীর বলেছেন: একটা ব্যপার এখন পরিস্কার যে ছাত্রলীগের পান্ডারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এই সব অপকর্ম করছে এবং এ কারনেই পুলিশ সব কিছু দেখেও নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে।সরকারের কাছে প্রতিকার চাইতে গেলে উল্টো পুলিশি হামলার শিকার হতে হয়।


৩| ১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ১২:৩০

সুমন কর বলেছেন: নেপলিয়ন অনেক আগেই বলে গেছেন----“the world suffers a lot. Not because of the violence of bad people, but because of the silence of good people.”

কেমন আছেন?

১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ১২:৪০

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: সুমন ভাই, সবকিছুর পরও ভালোই আছি। আমরা ভালোই থাকি। আপনি?

৪| ১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ১২:৩৯

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: অনেকেই প্রতিকার চায়। এসব নির্মুল করতে চায় সমাজ থেকে। কিন্তু সেই প্রতিবাদের শক্তি অর্জন করতে তাদের যে ন্যুনতম অবস্থানে যাওয়া প্রয়োজন, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী কিংবা সরকারের পদধারী হবার সেই ন্যুনতম অবস্থানে যেতে যেতে তারা পৌছে যায় লঙ্কায়।

আর যেই যায় লঙ্কায় ....

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.