নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এখনও পাসপোর্ট করাতে পারিনি। তারপরও অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত যেখানে পৌছালাম সেখান থেকে ভূটানের চেয়ে ঢাকার দূরত্ব বেশী! ঢাকা ৪৫৭ কিলোমিটার আর ভুটান ২৭৮ কিলোমিটার। দার্জিলিং-শিলিগুড়ি ভূটানের চেয়েও কাছের।
সকালে তুষভান্ডার রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে যাত্রা শুরু করেছিলাম। দিনের পরিকল্পনা অনেক--বুড়িমারি স্থল বন্দর, তিনবিঘা করিডোর, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল, সম্ভব হলে তিস্তা ব্যারেজ। যথেষ্ট শীত বস্ত্র সাথে থাকলে শীতের সকালে রেলভ্রমণের একটা আলাদা আবেদন আছে। দুপাশের জমিতে কচি তামাক চারা পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক আর সেই মাঠের মাঝের রেলপথ ধরে এগিয়ে যাওয়া। সূর্য্যি উঠতে চাচ্ছে, কিন্তু আলসেমি ছাড়াতে পারছে না। সেই অলস সকালে আমরা পাটগ্রাম হয়ে বুড়িমারি যেয়ে নামলাম। বুড়িমারি স্টেশন থেকে সামান্য দুরত্বেই বুড়িমারি বন্দর। আর সেই বন্দরের দেয়ালেই টাঙানো সেই বিখ্যাত দূরত্ব-তালিকা।
বিখ্যাত যায়গার কাছাকাছির গল্প যখন বলছিলাম শ্রোতারা আমাকে থামিয়ে দিয়ে সহাস্যে স্মরণ করিয়ে দিল অনেক বিখ্যাত যায়গার ’খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া’র আমার পুরনো অভ্যাসের কথা। এই ’প্রশংসা’র পর ’কাহিনী’ যতই জমজমাট হোকনা কেন আর এগুনো যায়না। আমিও থমকে যেতে বাধ্য হলাম।
সেদিনও থমকেই গিয়েছিলাম। আমরা হাটতে হাটতে বাংলাদেশের শেষ সীমায় গিয়ে অপরাপর সহযাত্রীদের মতন থমকেই গিয়েছিলাম। কে বলে বাঙ্গালী সীমা লঙ্ঘন করতে ভালোবাসে? দু’একজন ভিসাধারী ছাড়া আমরা কেউই রেলিংঅতিক্রম করার চেষ্টা করলামনা। শুধু দেখলাম এক সারমেয় তার সঙ্গীকে নিয়ে দিব্যি হেলতে দুলতে দুলতে আমাদেরকে বুড়িমারিতে রেখে ওপারের চ্যাংরাবান্ধায় চলে গেল। ওরা ডেটিং এ বাংলাদেশ এসেছিল নাকি হানিমুনে ভারত গেল ঠিক বোঝা গেলনা। কেবল বুকের মাঝে একটা কাব্যিক আক্ষেপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো--কখনো কখনো পশু-পাখির চেয়েও মানুষ অসহায়। মানুষের কাটা তারে আমারা মানুষেরাই বন্দী।
বুড়িমারি জিরো পয়েন্টে নেমে জনৈক বিজিবিকে শুধিয়েছিলাম কত দূর যাওয়া যায়। সে ফটিকের মতো উত্তর দিল--ওই হোথা। তবে তার পরের কথাতেই অবশ্য আবার স্পষ্ট করে বলল, ছবি তুলতে মানা, বিএসএফ খুব মাইন্ড করে। যখনই বলল ছবি তুলতে মানা, ছবি তোলার তৃষ্ণা আমাদের কয়েক গুণ বেড়ে গেল। আরও অনেকের মতোই লুকিয়ে Welcome To India লেখা ব্যানার আর বিএসএফ দাদাদের গোটা কয়েক ছবি তুলতে সচেষ্ট হলাম।
বুড়িমারি স্থলবন্দর-জিরোপয়েন্ট ঘুরে তিন বিঘা করিডোর হয়ে গেলাম দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা পর্যন্ত। ছিটমহল কী জিনিস তা কেবল সাধারণজ্ঞানের বইতেই পড়ে এসেছি। তাই এবার নিজের চোখে দেখতে আসা। খালিচোখে ছিটমহল বাংলার আর দশটা সাধারণ গ্রামের চেয়ে আলাদা কিছু না। আমাদের পরিচিত চেহারা আর দৈহিক গরনের সব মানুষ, পরিচিত গাছগাছালি আর পশুপাখি। কিন্তু খালি চোখের বাইরেই ছিট মহল এক আজব বস্তুু।
মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে দেখা যায় দশ বছরের বালকের পেটে সন্তান! জন্মগত কোন অস্বাভাবিকতার কারনে একটা ভ্রুণের ভিতর আরেকটা ভ্রুণ ঢুকে যায়। প্রথম ভ্রুণটি স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে জন্ম নেয় আর দ্বিতীয় ভ্রুণটি সেই স্বাভাবিক মানুষটির ভেতরে অস্বাভাবিক একটা জীবন যাপন করতে থাকে। এইসব ছিটমহলগুলোও অনেকটা সেরকম। জন্মকালীন ত্রুটির কারনে একটা ভ্রুণ স্বাভাবিক জীবন পেয়েছে আর অভাগা ভ্রুণটি ঊণজন্ম নিয়ে ধুকছে। সে বাংলাদেশ, কিন্তু পুরোটাই ভারতের শরীরের ভেতরে। সে ভারত, কিন্তু পুরোটাই বাংলাদেশের শরীরের ভেতরে। বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশে যেতে হয় ভারতের ভেতর দিয়ে। সেই উনজন্মের সন্তানেরাও উনমানুষ। নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, বঞ্চিত মানবিক অধিকার থেকে। নাকি ছিটমহল মানে কোন একটা ভূখন্ডে পৌছানোর অপেক্ষায় একেকটা নৌকায় সাগরে ভাসতে থাকা চারশত-পাচশত বাংলাদেশী বা রোহিঙ্গা?
আমরা অবশ্য সেখানে মানবতার সঙ্কট নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পেলাম না। বরং পর্যটকের উচ্ছাস নিয়ে যত্রতত্র ছবি তুলে বেড়ালাম। ফেরার পথে তিনবিঘা করিডোর হেটেই পার হলাম। করিডোরের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে জলপাইগুড়ির দিকে চলে গেল একটা লোকাল বাস। আমাদের যাদের ছুটি-ছাটায় নেপাল-ভূটান বা থাইল্যান্ড যাবার সংস্কৃতি নেই তারা ওই জলপাইগুড়ির দিকে চলে যাওয়া রাস্তাতে সেকেন্ড ত্রিশেক দাড়িয়েই স্বাদ নিই বিদেশের মাটির!
পড়নÍ দুপুরে পাটগ্রাম ফিরে দুপুরের খাবার সেরে আবার ছুটলাম তিস্তা ব্যারেজ দেখতে। পাটগ্রাম থেকে বাসে জলঢাকা। জলঢাকা থেকে অটোতে তিস্তা ব্যারেজ। পৌছাতে পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যা। শীতের সন্ধ্যা। ব্যাস্ত অবসর কেন্দ্র তিস্তা ব্যারেজ সেই সন্ধ্যায় অনেকটাই বিরান। জনতার একটা আবেদন থাকে, থাকে নির্জনতারও একটা আবেদন। অনন্যোপায় আমরা দ্বিতীয়টাতেই সারা দিলাম। ব্যারেজের দুপাশের পনির উচ্চতা আট-দশ ফুট বা তারও বেশী ব্যাবধান। পানির গতি পাল্টে তা উপহার দেয়া হয় বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়ার শুষ্ক অঞ্চলে বিনিময়ে তারা আমাদেও উপহার দেয় সোনালী ফসল।
রাতে রংপুর যেয়ে থাকার পরিকল্পনা ছিল। যাতে করে আগামীকাল সারাদিন রংপুর ঘুরে সন্ধ্যায় ঢাকার বাস ধরতে পারি। সেই অনুযায়ী রাজু ভাই্ এর বাসা থেকে একরকম চুড়ান্ত বিদায় নিয়েই বের হয়েছিলাম। কিন্তু তিস্তা ব্যারেজ থেকে বের হতে হতে রাত হয়ে গেল। রাত করে অচেনা শহরে যাবার চেয়ে চেনা যায়গাতে যাওয়াই শ্রেয় মনে হলো। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলাম। দ্বিতীয় রাত কাটালাম লালমনির হাটে।
***
বড় বড় পর্যটকেরও একসময় ঘরে ফেরার জন্য মন আকুলি বিকুলি করে। আর আমাদের মতন শৌখিন পর্যটকের তো কথাই নেই। পরদিন সকাল সকাল উঠে রংপুরের পথ ধরলাম। রংপুরে পৌছে প্রথম কাজ বাসের টিকেটের বন্দোবস্ত করা। তিন দিন ছুটির পর আগামী কাল অফিস, বাস টিকেটের আকাল হবে জানাই ছিল। চড়া দামে সেই টিকিট যোগাড় করে হাফ ছেড়ে বাচলাম। সারাদিনের কোন বাসের টিকেট নেই। সন্ধ্যার দিকে আছে তাও দু’একটার। তাই সই।
টিকেট নিশ্চিত করে মাঝের সময় টুকু কাজে লাগাতে গিয়েছিলাম তাজহাট জমিদার বাড়ি। ছিমছাম গোছানো। এরশাদ সরকারের আমলে প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় জামিদার বাড়ির ভৌত কাঠামো যথেষ্ট শক্তিশালীই দেখা গেল। কিন্তু বাইরে ফিটফাট বাড়ির ভেতরে নাম মাত্র কিছু প্রতœ-ঐতিহাসিক নিদর্শন। যারা টিকেট কেটে যাদুঘরে ঢুকছে জমিদার বাড়ির ওই রাজসিক সিড়িতে ছবি তুলেই টাকা ওসুল করছে। আমরাও টাকা বিফলে যেতে দিলাম না।
সব পাখি নীড়ৈ ফেরে, সব নদী। সব শেষ করে আমরা আবার বাস স্টপেজে ফিরে সময় গুণতে থাকলাম। সময় গুণতে গুণতেই টিভিতে প্রথমবার দেখলাম শিশু জিহাদের করুণ মৃত্যুর খবর আর তা নিয়ে আমাদের প্রশাসনিক প্রহসন। জিহাদের বাসা আমার বাসার খানিকটা কাছেই ছিল সেই দুর রংপুরে বসে জানলাম। আমি যে তাও শেষ পর্যন্ত জানলাম শিশু জিহাদ সেটা জেনে যেত পারল না। শিশু জিহাদ আমার সন্তানের চেয়ে বছর খানেকের বড় হবে। প্রশাসনের কি কোন সন্তান থাকে? থাকলে ভালো হতো।
যে দেশে হাজার মৃত্যুর পরও এত হল্লা প্রশাসনকে তাড়িত না করে বরং বিরক্ত করে সেখানে সামান্য একটা মৃত্যু নিয়ে এত হাঙ্গামা? প্রশাসনের বিরক্ত হবার কারন আছে বৈ কি। এদেশে আমরা সন্তানই একদিন বড় হয়ে হয়তো হবে এই প্রশাসনের অংশ।
বিধাতা ঠিক ঠাক ঢাকা পৌছে দিলেই আমি খুশি।
২৬.১২.১৪ - ২৭.১২.১৪
©somewhere in net ltd.