নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমাদের কলম্বাসরা

২৯ শে মে, ২০১৫ দুপুর ২:১২


এক সময় খুব শখ ছিল নাবিক হবার।

জাহাজে পাল তুলে দিয়ে ঘুরে বেড়াব মহাসাগর থেকে মহাসাগরে, দ্বীপ থেকে দ্বাীপান্তরে। সাগরের ঝড়, নাবিক বিদ্রোহ, জলদস্যুর আক্রমণ। অজানা পথে দিনের পর দিন ভাসতে ভাসতে হয়তো একদিন চোখে পড়বে কোন দূরতম দ্বীপের রেখা। যেই সৈকতে আমার জাহাজ ভিরবে সেখানে হয়তো আমিই হব সভ্য জগতের প্রথম মানুষ। খুব শখ ছিল কলম্বাস, ম্যাগেলান বা ক্যাপ্টেন কুক দের সাথে জাহাজে করে ভেসে পড়ার। নতুন কোন ভূখন্ড বা নতুন কোন জলপথ আবিষ্কার করে ইতিহাসের পাতাভরা নিজের নাম, জাহাজ ভরা নতুন আবিষ্কৃত সম্পদ আর দুহাত ভরা সাফল্য নিয়ে একদিন দেশে ফিরব। বন্দরে অপেক্ষা করবে রাজকীয় অভ্যর্থনা।

রবিনসন ক্রুসো, কোরাল আইল্যান্ড, মিউটিনি অব বাউন্টি ধরনের বইগুলো আমার মনকে পরিণত করেছিলো এক দুরন্ত নাবিকে। সব কষ্ট সহ্য করেও যে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী বেসেই ফেরে। তখন আর মাথায় থাকে না যে সফলদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশী ব্যর্থ অভিযান চালানো হয়েছিল। সামুদ্রিক ঝড় বা জলদস্যুর আক্রমণ বা অন্য কোন কারনে অজ¯্র নাবিক অচেনা সাগরে চিরতরে পথ হারিয়েছে। ব্যর্থদের কথা ভেবে ভীত হবার বয়স তখন নয়, সফলদের দেখে অনুপ্রাণিত হবার স্বপ্নই তখন চোখে মুখে।

একটু বড় হবার পর বুঝলাম সেই সব দিন এখন আর নেই। প্রয়োজন ফুরিয়েছে পালতোলা জাহাজে ভেসে নতুন জগৎ আবিষ্কারের। জাহাজ নিয়ে সাগরে ভেসে বেড়িয়ে বেড়িয়ে নতুন দেশ, নতুন বানিজ্য পথ বা নতুন সম্পদ খোজার কিছু বাকি নেই। পৃথিবীতে খুব কম স্থানই আছে বর্তমান বিশ্বে অনাবিষ্কৃত। বা একান্ত প্রয়োজনে কিছু খুঁজতে চাইলে আছে রাডার বা জিপিএস এর মত প্রযুক্তি। অথবা পাঠালেই হলো উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কোন আধুনিক জাহাজ। পালতোলা জাহাজ, সমুদ্র নায়ক বা জলদস্যু সবই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। এখন আর কেউ অজানা সমুদ্রে বেড়িয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে না।

তবে আর আরও খানিকটা বড় হবার পর জানলাম মাঝের এতদিন যা জেনে এসেছি তাও পুরোপুরি সত্য নয়। সোমালিয়ার উপকূলদিয়ে এখনও আছে জলদস্যূ, বাণিজ্যতরী কব্জা করে পণ আদায় করা জলদস্যু। আর গত কয়েক মাসে সংবাদ পত্রে যা দেখলাম তাতে জানলাম অজানা সমুদ্রে বেড়িয়ে পরার নেশা মানুষের আজও মরেনি। আজও মানুষ ভেসে বেড়ায় সাগর থেকে সাগরে, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে, আজও মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ছুটে বেড়ায় জঙ্গল থেকে জঙ্গলে, ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে। জানলাম ম্যাগেলান-কলম্বাসরা মরেনি। তারা এসে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশে, মিয়ানমারে।

কলম্বাসরা অজানার পথে যাত্রা করেছেন সত্য, কিন্তু সাথে নিয়েছেন তাদের নিজেদের সমুদ্র-ভূগোল-জ্যোতির্বিদ্যার সর্বশেষ জ্ঞান, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা। নিয়েছেন যুগের সর্বোৎকৃষ্ট জাহাজ, নাবিক, যোদ্ধা, খাবার-পানীয় ও অন্যান্য রসদ। আর এই বাংলাদেশী বা রোহিঙ্গা নাবিকেরা ভাস্কো দা গামা-কলম্বাস-কুকদের চেয়েও দু:সাহসী, দুরন্ত। সমুদ্র সম্পর্কিত কোন প্রকার জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তারা ভেসে পড়ছে সাগরে। এমনকি পর্যাপ্ত খাবার বা পানী ছাড়াই। সাগরের ঝড়কে তারা পরোয়া করছে না, খাবার নিয়ে সহযাত্রীর সাথে মারামারি করে কেউ প্রাণ দিচ্ছে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে কাউকে জীবিত ছুড়ে ফেলা হচ্ছে সাগরে। কিছুই থামাতে পারছে না তাদের আবিষ্কারের নেশা।

কলম্বাসদের মতো তাদেরও আশা দিনের পর দিন ভাসতে ভাসতে হয়তো একদিন চোখে পড়বে কোন দূরতম দ্বীপের রেখা। সেখানে তাদের ভাগ্য পাল্টে যাবে। তারা সেই নতুন দেশে দুহাত ভরে টাকা কামাবে, তিন বেলা পেট ভরে ভাত খাবে ভাত। দেশে টাকা পাঠাবে, অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝার পর বৃদ্ধ পিতা-মাতা জীবনের বাকি দিনগুলো একটু আয়েশে কাটাবে। সংসারে সচ্ছলতা আসলে ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাবে। ইতিহাসের পাতায় না হোক, খাতার পাতায় তারা লিখতে শিখবে নিজের নাম, পিতার নাম।

কিন্তু, তাদের ভাগ্য সহসাই পাল্টায় না। যেই সৈকতে কলম্বাস-কুকদের জাহাজ ভিড়েছে তার অনেকগুলোতেই তারাই ছিলেন সভ্য জগতের প্রথম মানুষ। দ্বিপ বাসী ’নেটিভ’রা তথাকথিত অসভ্য। এখনও এখানে তাই। জলেভাসা মানুষগুলো ঝড়-বিদ্রোহ সব সয়ে সভ্যতার সর্বশেষ বার্তা নিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত তীরের কাছাকাছি পৌছে যাচ্ছে ’অসভ্য নেটিভরা’ এসে তাদের আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে সাগরে। আমাদের নাবিকেরা সভ্য কোন অভ্যর্থনা পাচ্ছে না দ্বীপবাসীর কাছ থেকে। ইন্দোনেশিয়া বলছে ওরা মালয়েশিয়া যেতে চায়, মালয়েশিয়া বলছে ওরা থাইল্যান্ড যেতে চায়। অতএব দু-চার প্যাকেট বিস্কিট, বোতল কয়েকা পানি দিয়ে ওদের আবার সমুদ্রে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

ব্রিটিশ জাহাজ বাউন্টিতে বিদ্রোহের পর ক্যাপ্টেন ব্লাইকে ২৩ ফুটের ছোট একটা নৌকায় করে আঠারজন অনুগত সহ নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। সাথে দেয়া হয়েছিল সপ্তাহের মত খাবার, একটা কম্পাস আর চাঁদা। ক্যাপ্টেন ব্লাই ৪৭ দিন আর ৬৭০০ কিলোমিটার পার করে দিয়ে তাহিতি থেকে পৌছে যান বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়--হয়ে যান ইতিহাস।

আমাদের নাবিকেরা ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছে কীভাবে? ও এর চেয়ে কম দু:সাধ্য আর কী করছে? দেড়শ’ জনের ট্রলারে চারশ’-পাঁচশ’ জন মানুষ। নড়াচরা বা শোয়ার সুযোগও সীমিত। খোলা ট্রলারের দিনের বেলা প্রচন্ড রোদ আর রাতের বেলা হাড় কাপানো শীত। এর মধ্যে নারীদের আলাদা করে চলে অহর্নিশি যৌন নিপীড়ন। দুই বেলা নাম মাত্র খাবার আর পানি। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কেউ আরেকটু পনি বা খাবার দাবি করলে তাকে পেটানো হচ্চে লাঠি আর রড দিয়ে। প্রয়োজন মনে করলে গুলি করে লাশ সাগরে ফেলে দেয়া হচ্ছে। সাগরে ফেেেল দেয়া হচ্ছে অসুস্থ মানুষদেরকেউ।

ক্যাপ্টেন ব্লাই তার সেই ঐতিহাসিক অভিযানে দেশ-কালের উর্ধে উঠে হয়ে গিয়েছিলেন দু:সাহসিকতার সার্বজনীন উদাহরণ। আমাদের অভিযাত্রীরাও পরিবার, দেশ, কালের উর্ধে উঠে যাচ্ছেন। কেবল একটু অন্য ভাবে। তারা আর বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে পরিচিত থাকছেন না, তারা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের নন। একসময় তারা আর মানুষ হিসেবেই পরিচিত থাকছেন না। তারা চারশত, পাঁচশত, আট হাজার আর পচিশ হাজার হয়ে যাচ্ছেন।

আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ বিরোধী দলের সার্বিক পর্যবেক্ষণেই তার যাবতীয় মেধা, শ্রম এবং সময় এমন ভাবে নিয়োজিত করেছে যে অন্য কোনদিকে তাদের নজর দেবার ফুসরৎ নেই। বিরোধী দল ফিসফিস করে কোথায় কী প্ল্যান আটছে সব খবর তাদের কাছে আছে অথচ অসহায় মানুষ চিৎকার করে কাঁদছে কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষের কানে পৌছাচ্ছে না। বিরোধী দল কর্তৃক সরকার পতন ঘটানোর পরিকল্পনা চুড়ান্ত হবার আগেই গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারছে, ্আর দিনের পর দিন এসব জলজ্যান্ত মানুষ পাচার হয়ে যাচ্ছে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ কোন বিভাগ, কোন মন্ত্রণালয় কেউ কিছু জানতে পারছে না।

রোহিঙ্গাদের ঢল আটকাতে আমরা কঠোর হয়েছিলাম। আমাদের ঢল আটকাতে অন্যকোন দেশ কঠোর হলে আমরা নীতিগতভাবে তার সমালোচনা করতে পারিনা। কেবল ওদের কাছে মানবিক আবেদন করতে পারি। ওদেরকে সাগরে ঠেলে পাঠানোও ওদের হত্যা করা, দেশে ফেরত পাঠানোও হত্যার চেয়ে কম কিছু নয়--ইতিমধ্যেই পাচারকারীদের সহায় সম্বল বিক্রি করে দুই তিন লাখ টাকা করে পরিশোধ করা হয়ে গেছে। ওদের মানবিক আশ্রয় দিলে, দু’চার বছরের জন্য কোন কাজ দিয়ে বাধিত করলে বেচে যায় আমাদের কলম্বাস, আমাদের ভাস্কো দা গামা, আমাদের ম্যাগেলান, কুক, ব্লাইরা।

পশ্চিমাবিশ্ব কর্তৃক রাশিয়ার উপর বরাদ্দ বন্ধ এবং ভিসা বন্ধ করার প্রেক্ষিতে রাশিয়ার উপ প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি রগজিন বলেছিলেন--ট্যাঙ্কের কোন ভিসা লাগেনা। তাই ট্যাঙ্ক বিনা ভিসায় ঢুকে যায় ইরাকে, আফগানিস্তানে, ইউক্রেনে। মানুষের ভিসা লাগে। তাই মৃতপ্রায় মানুষ ভিসার অভাবে সৈকত থেকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে আবার ফিরে যায় গভীর সমুদ্রে।

[email protected]

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৩:২৬

চলন বিল বলেছেন: দুঃখজনক

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.