নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিরুদ্ধ রহমান

[email protected]

অনিরুদ্ধ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভূকম্পন ও কিছু আত্মকথা

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:১৬

যাদের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল তারা আবার ঘুমাতে গিয়েছিল একটা অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে, আতঙ্ক, উত্তেজনা, ছুটোছুটি--একটা জীবনমুখী অভিজ্ঞতা। আর যাদের ঘুম ভাঙ্গেনি, তারাই বরং ভালো ছিল। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় যাদের ঘুম ভাঙ্গেনা তারা ভালোই থাকে। অবশ্য পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এই ভূমিকম্পের কথা শুনে তাদের অনেকেই আবার রোমাঞ্চ থেকে বঞ্চিত হবার আফসোসে পুড়েছে। একটা বিপদ নিজে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়ে পাড় করে দিতে পারলেই মানুষ তাতে রোমাঞ্চ খুজে পায়। বিপদের মাত্রা যত বড়, রোমাঞ্চ তত বড়। বলা বাহুল্য আমিও তার ব্যতিক্রম নই।

***

গত এপ্রিলে নেপালে হচ্ছিল একের পর এক ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পের রেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল বাংলাদেশেও। কিন্তু একের পর এক ভ’মিকম্প হলেও আমি একবারও টের পাচ্ছিলাম না। টিভি টিকার কিংবা বন্ধু-শুভাকাক্ষ্ঙীদের ফোন পেয়ে জানতে পারছিলাম ভূমিকম্পের কথা। সারা দেশের সবাই টের পাচ্ছে আর আমিই টের পাচ্ছি না? এমন নয় যে এর আগে এক-আধ বার ভূকম্পনের অভিজ্ঞতা হয়নি। তার পরও এক হীনমন্ম্যতা নিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছিলাম। চামড়া কি গন্ডারের হয়ে গেল নাকি?

কেন টের পাচ্ছিনা ভূমিকম্প তা ভাবতে ভাবতে মনকে বোঝালাম ভূমির চেয়ে বড় কম্পন যাদের হৃদয়ে তারা ভূমিকম্পন টের পাবেন কিভাবে? মনকে এইসব বোধ দিয়ে হীনমন্ম্যতা কাটাবার চেষ্টা করলাম।

তবে দিন কয়েকের মধ্যেই এক ’রোমাঞ্চকর’ ভূকম্পনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সেই হীনমন্যতা কেটে গিয়েছিল পুরোটাই।

অফিসে কাজ করছিলাম। কে যেন বলল ভূমিকম্প হয় নাকি? সাথে সাথেই মাথায় একটা চক্কর। টেবিলের বোতলটার দিকে তাকালাম, মাথার চক্করের মতো চক্কর বোতলের পানিতেও। সিড়ি দিয়ে দেখাগেল হুড়মুড়িয়ে নামছে সবাই। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দোতলা থেকে নিজেকে আবিষ্কার করলাম রাস্তায়। দিলকুশার রাস্তায় শত শত লোক। যারা বিল্ডিং থেকে মাত্র বেড় হচ্ছে তাদের চোখে মুখে একটা আতঙ্ক। আর যারা খানিকটা আগে নেমে ফাকা মতন একটা যায়গা বেছে নিতে পেরেছেন তাদের মুখের আতঙ্ক কেটে গিয়ে হাতে উঠে এসেছে মুঠো ফোন--এই দৃশ্য ধারন করে রাখতে হবে এবং ফেইসবুকে শেয়ার করতে হবে। মানুষ আগে বিপদ-আপদ, দুর্ঘটনা থেকে বেচে প্রিয়জনকে খুঁজে ফিরতো বা নাম করত সৃষ্টিকর্তার। এখন প্রথমেই খোজে মুঠোফোন। ছবি তুলতে হবে, ভিডিও করতে হবে। শেয়ার করতে হবে ইন্টারনেটে।

যাই হোক হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসা সহকর্মীদের ভিড়ে দেখা গেল এমডি স্যারকেও। অবশেষে ভূমিকম্প টের পাওয়াতে এমনিতেই আমার মনটা চনমনে ছিল। তার উপর নিরাপদমত একটা যায়গায় ঠাই পাওয়ার পর ভালোমতো খেয়াল করে দেখলাম এমডি স্যারও ইতিউতি খুজছেন একটু আশ্রয়। আমার মনটা আরও ভালো হয়ে গেল। বয়স, অভিজ্ঞতা, কর্তত্ব-ক্ষমতা, অর্জন-বিসর্জন এবং অবশ্যই মাসিক বেতনে তিনি আমার মত অফিসারের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু আমি নিবিড় পুলকের সাথে আবিষ্কার করলাম--জীবনের মায়ার বেলায় এমডি স্যার এবং আমি একই শ্রেণির। এজন্যই বুঝি নায়ক মান্না মাঝে মাঝেই বলত--চৌধুরী সাহেব, আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তুু ছোটলোক নই...

***

সেদিনের সেই ভূমিকম্প নিয়ে আমার আতঙ্কের চেয়ে রোমাঞ্চই ছিল বেশী। কিন্তু আজ টের পেলাম ভূমি কাপতে থাকেল নিজেকে কতটা অসহায় লাগে। মানুষের সবচেয়ে অসহায় লাগে বোধহয় তখন যখন নিজের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এর পরই অসহায় যদি কিছু থেকে থাকে তা হলো পায়ের নিচের মাটির উপর ভরসা করতে না পারা।

আমার ঘুম মোটামুটি কুম্ভকর্ণের কাছাকাছি। চলন্ত বাসে-ট্রেনে ঘুমিয়ে থাকতে পারি, বালিশ ছাড়া ঘুমিয়ে থাকতে পারি যত্রতত্র, ঘুমিয়ে থাকতে পারি সাইত্রিশ ডিগ্রি তাপমাত্রার লোডশেডিং-এর রাতেও। একবার ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে ধরে বেধে রাস্তায় রেখে আসলেও ঘুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি অবিচল থাকব বলেই আমার বিশ্বাস।

সেই আমিই এক ঝাকুনিতেই ঘুম ভেঙ্গে বিছানা থেকে নেমে রীতিমতো রেডি। আরেক ঝাকুনি হতে হতেই সেই টালমাটাল অবস্থাতেও কোনমতে নিজেকে সামলে কী মনে করে কে জানে ঘুমন্ত ছেলেটাকে কোলে নিয়ে খালি পায়েই এক দৌড়। এক দৌড়ে দু-দুটো দরজা খুলে চার তলা থেকে নিচের কোলাপসিবল গেট পর্যন্ত পৌছে গেলাম। গেট পর্যন্ত পৌছে তারপর হুশ হলো--তারাহুড়োতে গেটের চাবিটাই নিয়ে আসা হয়নি। ততক্ষণে আরো অনেকের হুশ হচ্ছিল। তারা একে একে নেমে আসছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাদের একজন চাবিটাও মনে করে সাথে নিয়ে নামলেন। আমরা সবাই এই ডিসেম্বরের শীতের রাতে রাস্তায় নেমে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

আমি কেন দৌড় দিলাম তখনও হয়তো স্পষ্ট জানতাম না। আগুন লেগেছে, ডাকাত পড়েছে নাকি ভূমিকম্প ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই এটুকু বুঝেছি, পালাতে হবে। আর পালাবার সাধারণ সূত্রমতে এটুকু বুঝেছি পালাবার সময় সবচেয়ে মূল্যবান কোন কিছু সাথে নিয়ে পালাতে হয়। আমি ঘুমন্ত সন্তানকে কোলে নিয়ে দৌড় দিলাম। ঘরে স্ত্রী, ছোট বোন, পিতা-মাতাও ছিল। সন্তান ছাড়া বাকিরা সবাই স্বাবলম্বী, নিজেরাই দৌড়ে নামতে পারবে--এই কারনে, নাকি বাকিদের ওজন আমার পক্ষে কোলে করে বয়ে বেড়ানোর অনুপযোগী--এই কারণে, কেন আমি কেবল সন্তানকে নিয়ে দৌড় দিয়েছি আমি জানি না। আমি জানি না। অন্য কেউ জানে।

রাস্তায় নামতে নামতে ততক্ষণে দালানকোঠাগুলোকে পৌষের শীতে ক্ষাণিক কাঁপিয়ে দিয়েই ভূমির কম্পন ভূমির গভীরে চলে গেছে। তবুও একটা আফটার শকের আশঙ্কায় সবাই রাস্তায় দাড়িয়ে ছিলাম। তুরানকে কোলে করে দাড়িয়েছিলাম। কম্বলের ভেতর থেকে একটানে তুলে নিয়ে দৌড় দিয়েছিলাম। এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হবার পর দেখলাম কোলের মধ্যে থর থর করে কাঁপছে ছেলেটা। ওর জন্যএকটা গরম জামা দরকার। চারতলায় উঠব তুরানের গরম জামা নিয়ে আসার জন্য? যদি গরম কাপড় নিয়ে আমি নেমে আসার আগেই ঘটে যায় মূল ভূকম্পনের পরবর্তী ”আফটার শক?” সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে ভাবলাম সন্তানের জন্য ত্যাগ অগৌরবের কিছু হবার কথা নয়। গৌরবের জীবনের চেয়ে গৌরবের মৃত্যুও কিছু কম নয়।

একটা বিপদ আপদ মানুষকে তার আটপৌরে জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্যে হলেও হঠাৎ করেই অন্য একটা জীবনের সামনে দাড় করিয়ে দেয়। একজন গৃহীর মনে জাগে সন্যাস, একজন পাষান হয়ে ওঠে দয়ালু, একজন নাস্তিক হয়ে যায় গভীর বিশ্বাসী। আহার-নিদ্রা আর অপরাপর জৈবিক জীবনের আমার মধ্যেও হঠাৎ জাগ্রত হলো দর্শন--আমার কাছে সুযোগ থাকলে আমি অবশ্যই পিতা-মাতা, ছোট বোন, স্ত্রী-পুত্র সবাইকে নিয়েই আশ্রয় খুঁজবো। সুযোগ একটু কম থাকায় আমি কোলে কেবল সন্তানকে নিয়েই দৌড় দিয়েছি। আমার হাতে সুযোগ আরও কম থাকলে? কে জানে হয়তো একাই দৌড় দিতাম। হয়তো এটাই প্রকৃতির গোপনতম নিয়ম।

প্রতিদিন সকালেই মসজিদ থেকে নিয়মিত আহ্বান আসে--আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম, ঘুম হইতে প্রার্থনা উত্তম। এ আহ্বান আমাদের কানে পৌছায় না। আজ কেবল কানেই পৌছাল না রীতিমতো আমাদের অন্তরে গিয়েই পৌছালো। মসজিদে এত লোক হয়েছিল যে শোনা গেল এত মুসল্লী নিয়ে ফজরের নামাজ আদায়ের সৌভাগ্য একজন ইমামের খুব কমই হয়। ইতিবাচক ভাবে বললে বলা যায় ঠিকমতো একটা ধাক্কা হলে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গলে আমরা করার চেষ্টা করি আমাদের অসমাপ্ত কাজ।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমরা আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ধর্মীয়, সামাজিক জীবনে একটা ধাক্কার অপেক্ষাতেই থাকি।

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:২৫

মুদ্‌দাকির বলেছেন: সবারি প্রায় একই রকম অবস্থা

২| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:৪৬

পিচ্চি হুজুর বলেছেন: একটা বিপদ আপদ মানুষকে তার আটপৌরে জীবন থেকে ক্ষণিকের জন্যে হলেও হঠাৎ করেই অন্য একটা জীবনের সামনে দাড় করিয়ে দেয় - চরম সত্য কথা লিখছেন আপনি। মৃত্যু নামক বিপদও একসময় সবার সামনে আসবে, অন্য জীবনের সামনে তখনও সে আপনাকে দাড় করিয়ে দিবে কিন্তু তখন কিছুই করার থাকবে না। এই জন্যই বার্ধক্যে উপনীত হলে লোকজনের আমূল পরিবর্তন হয়, কারণ সে তার বাড়ির ভিতর থেকে বসে তার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা বিপদকে প্রতিদিন একটু একটু করে আগিয়ে আসতে দেখে। আগে বুইড়া লোকজন গুলারে গাইলাইতাম, ব্যাটারা সারাজীবন আকাম কইরা বেড়াইয়া এখন সাধু সাইজা বইসা আছে। এখন বুঝি আমাদের যৌবন সবচেয়ে বড় মরীচিকা, এই মরীচিকাই আমাদের প্রকৃত সত্যকে দেখতে দেয় না।

০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩৩

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: সত্যকথা।

৩| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:৫৩

মহা সমন্বয় বলেছেন: আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় যাদের ঘুম ভাঙ্গেনা তারা ভালোই থাকে।

আসলেই তাই। :)

০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩৪

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: আসলেই।

৪| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৫:৩৭

প্রতিচিকীর্ষু লৌকিক বলেছেন: সেদিনের ভূকম্পন সম্পর্কে আমার নিজের কোন অবিজ্ঞতা নেই। তার কারণ আমি দেশের বাইরে! আপনার ভূকম্পন এবং আত্মকথার বর্ণনায় বুঝা গেল যে মৃত্যু প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। যে কোন বিপদ মানুষকে নতুন অবিজ্ঞতার সামনে নিপাতিত করে।

০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩৫

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: কোথায় আছেন?

৫| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৪৮

মাঘের নীল আকাশ বলেছেন: অসাধারণ করে লিখেছেন ++++

০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩৬

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ।

৬| ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:১৯

সুমন কর বলেছেন: কেমন আছেন?

০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩৭

অনিরুদ্ধ রহমান বলেছেন: দেড় বছর পরে বলি--ভালো আছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.