নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বুনোগান

বুনোগান › বিস্তারিত পোস্টঃ

চিন্তার স্বাধীনতা

০২ রা মে, ২০২৩ দুপুর ১:৪৬


ছবিঃ ইন্টারনেট
মানুষ চিন্তাশীল জীব। প্রতিটি মানুষই চিন্তা করতে সক্ষম। সে চিন্তা করে নিজেকে নিয়ে, পরিবারকে নিয়ে, জীবিকা নিয়ে, সমাজ নিয়ে, ধর্ম নিয়ে, নিজের সম্প্রদায় নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে ইত্যাদি। চিন্তা থেকেই তার জীবন দর্শন গড়ে উঠে। এটা মনে হতে পারে চিন্তা একান্ত ব্যক্তিগত। সে স্বাধীনভাবে যা ইচ্ছা চিন্তা করতে পারে। চিন্তা ক্ষেত্রে সে স্বাধীন।

কিন্তু আসলেই কি স্বাধীন? প্রতিটি মানুষেরই স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা অবশ্যই আছে। কিন্তু স্বাধীনভাবে চিন্তা করেন খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ।

মানুষ চিন্তা করার উপাদান খুঁজে পায় সমাজ ও পরিবেশ থেকে। চিন্তা করার প্রথম ও শক্তিশালী মাধ্যম হোল ভাষা। শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর পরিবারের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয় ভাষার মাধ্যমে। সে দেখা ও ভাষা শুনার মাধ্যমে মা, বাবা, দাদা, বুবু ও পরিবারের অন্যান্যদের চিনতে ও শব্দগুলোর অর্থ বুঝতে পারে। সে আরও চিনতে পারে বিভিন্ন খাদ্য ও তাদের নামের অর্থ। তার চিন্তার জগত এই পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সে তার পরিবার থেকে পাওয়া ভাষার মাধ্যমেই চিন্তা করে ও নিজের চিন্তা প্রকাশ করে। সে যে কয়টা শব্দ শিখেছে তার বাইরে চিন্তা করার ক্ষমতা তার থাকে না। আরও বড় হলে তার চিন্তার জগতে পরিবারের জীবন দর্শন, ধর্ম, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি সঞ্চারিত হয়। এভাবে কৈশোরেই তার চিন্তার জগতের একটা ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। চিন্তার এই জগতের বাইরে যাওয়ার আর প্রয়োজন পরে না। তার জীবনকে চালিয়ে নেয়ার জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় পথ সে পরিবার/সমাজ থেকে পেয়ে যায়।

সে যখন আরও বৃহত্তর সমাজের সাথে পরিচিত হয়, তখন সে একই ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে ভিন্ন জীবন দর্শন, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির দেখা পায়। সে দেখতে পায় তার ধর্মের বাইরে অন্য ধর্মের মানুষও রয়েছে। তাদের ঈশ্বর ভিন্ন। তাদের বিশ্বাস ভিন্ন। তাদের সংস্কৃতিও কিছুটা ভিন্ন। তাদের কমিউনিটি ভিন্ন। একই ভাষায় কথা বললেও শব্দের ব্যবহার ভিন্ন রকম। জাতি, বর্ণ, ভাষা এক হলেও ধর্মের কারণে চিন্তার গঠন ও দর্শন ভিন্ন। এই প্রথম কিশোরটি অন্য এক চিন্তার জগতের দেখা পায়। কিন্তু সেই ভিন্ন চিন্তার জগতের গভীরে সে যেতে চায় না। সে তার নিজস্ব চিন্তা জগতকে প্রসারিত করতে চায় না। সে তার সম্প্রদায়-গত চিন্তার জগতেই অবরুদ্ধ থাকে। সে যাচাই ছাড়াই মনে করে তার সম্প্রদায়ের চিন্তার দর্শনই একমাত্র সত্য এবং সর্ব শ্রেষ্ঠ। সে নিজের সম্প্রদায়ের প্রচারণার শিকার হয়ে পরে। পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, সম্প্রদায়-গত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিতভাবে প্রচারণার মাধ্যমে তাকে কমিউনাল করে তোলা হয়। এভাবে সে তার নিজস্ব চিন্তার স্বাধীনতা হাড়িয়ে ফেলে।

সমাজে শ্রেণী অবস্থানের কারণেও চিন্তার জগত ভিন্ন হয়। একজন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান তার সমাজের ধ্যান ধারণা নিয়েই বেড়ে উঠে। সে মনে করে সমাজের সকল সুবিধা পাওয়ার ক্ষমতা তার আছে। নিম্নবিত্ত মানুষেরা তার খেদমতে নিয়োজিত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। নিম্নবিত্ত মানুষেরা সমাজে তাদের অবস্থানকেও স্বাভাবিক মনে করে। সে সব সময় উচ্চবিত্তের সামনে নতজানু থাকে। তার চিন্তার জগত সাম্যতার ধারণায় অগ্রসর হয় না। মধ্যবিত্তের চিন্তার জগত এই দুইয়ের টানা পোড়নে উঠানামা করে।

মানুষের চিন্তা জগত তার লিঙ্গিয় অবস্থানেও আবদ্ধ থাকে। পরিবার, সমাজ, সম্প্রদায় ঠিক করে দেয় সমাজে তার লিঙ্গিয় ভূমিকা কি হবে। সে নারী হলে সমাজে তার ভূমিকা এক রকম আর পুরুষ হলে আর এক রকম। আর ট্রেন্স-জেন্ডার হলে সমাজ তো তাকে গ্রহণই করতে চায় না। সমাজ যে লিঙ্গিয় চিন্তার জগত নির্ধারণ করে দিয়েছে নারী পুরুষ উভয়েই সেই চিন্তার জগতে আবদ্ধ।

অর্থাৎ মানুষের নিজস্ব চিন্তা তার স্ব স্ব অবস্থানে আবদ্ধ থাকে। সে যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, সে সেই শিক্ষাকে গ্রহণ করে পেশাগত উপযোগিতা থেকে। সে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হউক বা দর্শন শিক্ষায় শিক্ষিত হউক সে শিক্ষার ততটুকুই গ্রহণ করে যতটুকু তার সম্প্রদায়-গত জ্ঞানের অনুমোদন থাকে। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য চিন্তার জগতকে প্রসারিত করা হলেও একজন শিক্ষিত লোকের সম্প্রদায়-গত চিন্তা জগতের ভিতকে নাড়াতে ব্যর্থ হয়। মানুষ যে তার নিজস্ব চিন্তার স্বাধীনতাকে হারিয়েছে এই চিন্তা শক্তিও তার থাকে না।

মানুষের চিন্তার জগত প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর একটি হোল রাজনৈতিক প্রচার। আদিকাল থেকেই রাজা বাদশারা তাদের ক্ষমতার বৈধতা দেয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে আসছিল। তারা প্রচার করেছিল যে তাদের ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। জনগণের মধ্যে রাজার শক্তিমত্তা ও মহিমা সব সময় প্রচার করা হত। ফলে জনগণের চিন্তা জগত সেভাবেই গঠিত হয়ে যায়। রাজার ক্ষমতার বৈধতাকে তারা আর অস্বীকার করতে পারে না। বর্তমান যুগের রাষ্ট্রও জাতীয়তাবাদের প্রচারণা দ্বারা নিজেকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে যায়। তারা একটা পতাকা তৈরি করে। তাদের একটা জাতীয় সঙ্গীত রয়েছে। প্রতিটি স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের এই পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে হয় এবং দেশের জন্য শপথ গ্রহণ করতে হয়। ফলে শিশু কিশোর বয়সেই তাদের চিন্তা জগতে দেশাত্মবোধ তৈরি হয়ে যায়। এই দেশাত্মবোধের ফলে রাষ্ট্রের ভিতরে বিভিন্ন সম্প্রদায়, জাতি, শ্রেণী ও বর্ণের মানুষ দেশের প্রতি অনুগত ও ঐক্যবদ্ধ থাকে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রচার করা হয় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। প্রতি পাঁচ বছরে একবার তারা তাদের এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। রাষ্ট্রে থাকে একাধিক রাজনৈতিক দল। তারাও তাদের সপক্ষে প্রচার চালায়। এভাবে জনগণের চিন্তার জগত বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পরে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে আর একটি শক্তিশালী প্রচার প্রচারণা রয়েছে। সেটা হোল পণ্যের প্রচার। এইসব প্রচারে দেখানো হয় সফল মানুষ/পরিবার তারাই যাদের রয়েছে বাড়ী, গাড়ি। যাদের বাড়ীতে রয়েছে টিভি, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশন সহ সকল ধরণের পণ্যের সমাহার। তাদের পরনে রয়েছে ফ্যাশনেবল পরিধেয়। সাধারণ মানুষের চিন্তা জগতে সুখের সংজ্ঞা হিসেবে বিজ্ঞাপন,নাটক, সিনেমায় প্রচারিত সফল মানুষদের চিত্র ফুটে উঠে। তারা সেই সুখের মরীচিকার পিছনে আজীবন ছুটতে থাকে। তাদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান হোল পণ্য ক্রয় করা এবং আরও পণ্য ক্রয় করা।

মানুষের চিন্তার জগত কেন এইসব প্রচারণার জগতে সীমাবদ্ধ থাকে? তার করণ হোল বিবর্তন এভাবেই তৈরি করেছে। অন্যান্য প্রাইমেটদের মত সাধারণ মানুষেরা মূলত অনুসারী। হাতীর দলে আলফা হাতী শূর উঁচিয়ে দূরের কোন জলাধারের অনুসন্ধান করে সেদিকে এগিয়ে যায়। দলের অন্যান্যরা তাকে অনুসরণ করে মাত্র। সকল হাতীরই অনুসন্ধানের ক্ষমতা থাকলেও তারা সেই ক্ষমতা কাজে লাগায় না। মানুষের মধ্যেও অনুসন্ধানী মানুষ রয়েছে যারা সংখ্যায় অল্প। তারা তাদের স্বাধীন চিন্তা শক্তি প্রয়োগ করে বিভিন্ন বিষয়ের অনুসন্ধান করছেন। কেউ রাজনীতিতে, কেউ দর্শনে, কেই বিজ্ঞানে, কেউ মাইথলজিতে, কেউ গণিতে ইত্যাদি। তারা তাদের অনুসন্ধানের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সাধারণ মানুষের চিন্তা জগত সেটার অনুসারী হয়ে পড়ছে। কারণ অনুসন্ধানের জন্য যে সাধনার প্রয়োজন সাধারণ মানুষ সে কষ্টটুকু না করে সরাসরি ফল ভোগ করতে চায়। আবার বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অনুসন্ধান করেছে অনেক মানুষ, তাদের সম্মিলিত জ্ঞান ধারণ করা কোন একজন মানুষের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। এর জন্য যে সমন্বিত জ্ঞান চর্চার প্রয়োজন পরে সেটাও কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চর্চা করা হয় না।

ফলে মানুষের চিন্তা জগত বিভিন্ন উৎস থেকে যা শুনে এবং দেখে তাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। উৎসগুলোর মধ্যে সম্প্রদায়-গত উৎস সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী। এই উৎসের সাথে সাংঘর্ষিক কোন চিন্তা তারা গ্রহণ করতে চায় না।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মে, ২০২৩ বিকাল ৪:২৩

নিবর্হণ নির্ঘোষ বলেছেন: আপনার এই লিখাটি দারুণ চিন্তাশীল একটা লিখা হয়েছে । যদিও আপনি বিবর্তনবাদের দিক থেকে আপনার লিখাকে সাজিয়েছেন , তবুও আপনার লিখার একটা আলাদা আবেদন রয়েছে !

আচ্ছা , আমার মনে হয় মানুষের এই যে চিন্তার স্বাধীনতার মধ্যেও সীমাবদ্ধতা তার কারণ মানুষ শান্তি প্রিয় এবং সে তার সামাজিক বলয়কে ভাঙতে চায় না । একটা মানুষ যখন একা থাকে তখন সে হয়ে দাঁড়ায় বেপরোয়া তার চিন্তার প্রতি সে অত্যধিক আদর্শবাদী হয়ে পড়ে আর যখন সে পরিবার গঠন করে তখন সে আর তেমন বাঁধন হারা হতে পারে না আর এখানেই চিন্তার সীমাবদ্ধতা তৈরী হয় । তখন সে আসলেই পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে কারণ সে চায় না এমন কিছু তার দ্বারা হোক যার কারণে তার পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হোক এবং তার পরিবারের ওপর কোন ঝামেলা হোক !


মানুষ সমাজবদ্ধ হবার পর সে অনেক বেশি অনুকরণশীল হয়ে পড়েছে কারণ মানুষ আসলে সবার সাথে মিলে মিশে এক হয়ে থাকতে চায় আর এখানে তাকে সবদিক থেকে একতা দেখাতে হয় আর এর মধ্যে সে তার নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে । এই দিকটাও আমি মনে করি স্বাধীন চিন্তার অন্তরায় !!


আপনাকে ধন্যবাদ এমন চিন্তাশীল কিছু লিখবার জন্য । এমন লিখা আরও চাই !

০২ রা মে, ২০২৩ বিকাল ৫:৫০

বুনোগান বলেছেন: আপনি ঠিকই ধরেছেন, শান্তি বজায় রাখার জন্য মানুষ অনেক সময় তার ভিন্ন চিন্তা প্রকাশ করে না। এর অর্থ এই যে সে যে সমাজের মানুষের সাথে বাস করে তারা তাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের জগতেই থাকতে চায় এবং শুধু তাই নয় তারা তাদের সমাজের কোন সদস্যকে কোন ভিন্ন চিন্তা প্রকাশ করতে দিতেও চায় না। চিন্তার প্রসারতা এখানে অচল।

২| ০২ রা মে, ২০২৩ রাত ৯:২৭

কামাল১৮ বলেছেন: জ্ঞান কি মানুষের মধ্যে সহজাত।নাকি বস্তু জগত থেকে মানুষ জ্ঞান আবরণ করে?
ধর্ম মানুষের জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে দেয়।জ্ঞানের বিকাশের জন্য প্রয়োজন মুক্ত ভাবে চিন্তা করা।

০৩ রা মে, ২০২৩ সকাল ৮:৫৯

বুনোগান বলেছেন: অবশ্যই বস্তু জগত থেকেই মানুষ সঠিক জ্ঞান লাভ করে। দার্শনিকরা সেই জ্ঞানের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে যুক্তি তর্ক দিয়ে সেই ব্যাখ্যা খন্ডন, সংযোজন, পরিবর্তন কারা যায়। কিন্তু ধর্মীয় ব্যখ্যা অনড়। সে তার ব্যাখ্যার বাইরে কোন যুক্তি গ্রহণ করে না। তাই আপনার কথাই সঠিক, ধর্ম তার অনুসারীদের জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে রাখে।

৩| ০৩ রা মে, ২০২৩ বিকাল ৩:১৬

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা।

০৪ ঠা মে, ২০২৩ সকাল ৮:৪২

বুনোগান বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.