![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পাঁচ তলা উঁচু মিউজিক ক্লাবটার দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে বিরবির করে বলছি, “দেখা হয়নি চক্ষু মিলিয়া”। ইউরোপ এসেছি তাও দু’বছরের বেশিই হবে। কিন্তু কখনও ক্লাব-ফ্লাবের ধারের কাছেও যায়নি। সাচ্চা ঈমানদার বলে কথা! কিন্তু এতগুলো পয়সা খরচ করে প্যাকেজ ট্যুরে প্রাগ, চেক-রিপাব্লিকে আসা। সাথে এই পাঁচ তালা উঁচু ইউরোপের সবচেয়ে বড় ক্লাবটিতে ফ্রি প্রবেশের সুযোগ! মিস করা কি ঠিক হবে? দ্বিধার মাঝে পড়ে গেলাম। একদিকে ঈমান, আর এক দিকে দুনিয়াদারি। মনের অজান্তেই গাইতে থাকলাম, “বাহির বলে দূরে থাকুক, ভেতর বলে আসুক না!” কথায় আছে,“ উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, সেই অধম যে চলে তফাতে”। আমি উত্তম হতে চাই, নইলে নিশ্চিন্তে অধমের সাথে চলব কিভাবে?
ডিসিশন নিলাম, একতলা থেকে পাঁচ তলা পুরটাই দেখব, অধম জানব। কিন্তু আমার এই মিশন ইম্পসিবল টু তে জাম্প করার আগেই মহা বিপত্তিতে পরলাম! এক স্বর্ণ কেশী রমণী রুপালী রঙ এর ট্রে ধরে ক্লাবের মুখে দাঁড়িয়ে। ট্রের উপর ছোট ছোট গ্লাসে থরে থরে “আবসিন্থ” সাজানো। একজন একজন করে ঢুকছে, আর এক পেগ করে গিলছে। আমরা ট্যুরিস্ট, গ্রুপ ধরে স্পেশাল অফারে এসেছি, তাই ক্লাব কর্তৃপক্ষের এই বিশেষ ব্যবস্থা। এটা কিন্তু ফ্রি ফ্রি দিচ্ছে। ক্লাবটিতে ঢুকতে হলে আমাকেও ফ্রি ফ্রি আবসিন্থ খেয়েই ঢুকতে হবে। বিয়ারি খাইনা, সেখানে “আবসিন্থ”! পার্থক্যটা আমার জন্য অত্যাধিক বেশিই হয়ে গেল। এতগুলা মানুষের সামনে “আবসিন্থ” না খায়াও চরম প্রেস্টিজের বেপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”কি করি, কি করি” ভাবতে ভাবতে পকেট থেকে মেন্টরসটা বের করে মুখে পুরে লাইনে দাঁড়ালাম। ধিরে ধিরে লাইনটা ছোট হচ্ছে, আর আমি একটু একটু করে এগুচ্ছি। বুক দুরুদুরু করছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এইত আর কয়েক মুহূর্ত পরেই আমার টার্ন। কিছু একটা করতেই হবে। নয়ত বিপদে পড়ে যাব। মেন্টরসের বদলতে চট করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ঠিক করলাম আবসিন্থ মুখে নিব, কিন্তু গিলবনা। এবার আমার টার্ন। বেশ ভাব নিয়েই স্বর্ণ কেশী রমণীর হাত থেকে ছোট্ট গ্লাসটা নিলাম, একটানে পুরোটা মুখে চালান করলাম। মুহূর্তে একটা ১০০০ মেগা ওয়াটের ইলেকট্রিক শক খেলাম। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি। মুখ, গলা, বুক সবই জ্বলছে, যেন এসিড খেয়েছি। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে হামাগুরি দিতে দিতে ক্লাবে গিয়ে ঢুকলাম। মুখের ভেতর তখনও আবসিন্থ আমাকে ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে! না পারি সইতে, না পারি গিলতে! আশেপাশে তাকিয়ে একটু আড়াল খুজে মুখ থেকে ঝাঁঝাল পদার্থটা ওয়াক থু করে হাতের তালুতে ফেললাম। এরপর হাত দুটো ঘোষে সরষে তেলের মত শরীরে মেখে নিলাম। শরীর থেকে অ্যালকোহলের গন্ধ বের হচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন আমিও আবসিন্থ খেয়েছি। এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। ভাজ্ঞিস গ্লাসটার সাইজ ছোট ছিল। বড় গ্লাস হলে কি যে হত!
এবার ক্লাবটা ঘুরে দেখার পালা। প্রতিটা তলাতেই মিউজিক, পাব আর ড্যান্স ফ্লোর। একতলাতে স্লো মিউজিক চলছে, হালকা বিট। মুলত বয়স্ক মানুষদের জন্য। দোতলার বিট টা আরেকটু বেশি। তার পরের তলাগুলোতে বিট আরও আরও বেশি, আর পঞ্চম তলাতে হেব্বি বিটে হার্ড রক, ডেথ মেটাল বাজছে! তার মানে পঞ্চম তলাটাই আমাকে বেশি স্যুট করে। সোজা পঞ্চম তলাতে চলে গেলাম। ওই তলায় পা রাখতেই আবারও ১০০০০ মেগা ওয়াটের আরেকটি ইলেকট্রিক শক খেলাম। এবারের শকটা অবশ্য ভিসুয়াল এফেক্ট এর কারণে। ছোট্ট একটা স্টেজ, তাতে একটি মাত্র স্টেইনলেস স্টিলের রড। স্বর্ণকেশী এক আপামণি বহু কষ্টে শরীরে কয়েকটি ফিতা জড়িয়ে রডটি ধরে বিকট অঙ্গ ভঙ্গি
করছে। মেডিকেল সাইন্স অনুসারে শরীরে হাড়-গোড় থাকলে এরকম অঙ্গ ভঙ্গি করা খুবই দুরহ ব্যাপার। সে কিভাবে কাজটি করছে আমার জানা নেই। আরও অবাক হয়ে আবিস্কার করলাম এই ফ্লোরে আমি ছাড়া বাকিরাও আপা মনির মত শরীরে ঢেউ তুলছে, যেন “জল তরঙ্গে ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি ঢেউ খেলিয়া যায়”। তাহলে কি শুধু আমি ছাড়া বাকিদের শরীরে হাড়-গোড় নেই? হতেই পারেনা! আমিও হেব্বি বিটে ঝাকি দিয়ে দিয়ে সবার মত হাত-পা নাড়তে শুরু করলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই শরীরের অভ্যন্তরে কটকট আওয়াজ টের পেলাম। ইনজুরির সম্ভাবনা জাগলে গা বাচিয়ে ড্যান্স দেবার আপ্রাণ চেষ্টা চালালাম। কিন্তু হায়, ওদের মত করে এক বিন্দুও নাচতে পারলাম না! মুন ওয়াক, ব্রেক ড্যান্স, বেলি ড্যান্স কত কিছুই না ট্রাই করেছি! নিজেকে কাকের গায়ে ময়ূরের পেখম লাগানো একটি অচিন পাখি মনে হচ্ছিল। বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। এই ফ্লোর আমার জন্যে নয়। একটু স্লো বিট দরকার। সুতরাং, চতুর্থ তলায় যেতে হবে। এবার নিশ্চয়ই তাল মিলিয়ে ডিস্কো দিতে পারব।
কিন্তু হোওয়াই মি?? সব কিছু কেন আমার সাথেই হয়? চারতলায় ঢোকার মুহূর্তেই স্বর্ণকেশী আরেকটি আপু গগন বিদারী শব্দ তুলে এক দলা বমি আমার বা’পাটার ঠিক সামনে ফেলল। মুহূর্তেই বমির দুর্বিষহ উটকো গন্ধে আমার নাড়ি-ভুঁড়ি উল্টে আসার উপক্রম। এখন আমারই বমি পাচ্ছে! স্বর্ণকেশী আপুর নৃত্যের দৃশ্য যতটা সুন্দর, মাতাল হয়ে মুখ ভরে বমি করার দৃশ্য ততটাই ভয়াবহ! দ্বিতীয়বার যেন এ দৃশ্য দেখতে না হয়, দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরলাম। পথে বাঁধা পরলে সেই পথে এগুতে নেই, অমঙ্গল হয়। তাই চারতলার দিকে আর পা-ই বারালাম না।
তিন তলার উদ্দেশ্যে রাওনা দিলাম। তিন তোলায় ঢোকার মুখেই ডানপাশে ছোট্ট একটা স্টেজ। অপেক্ষাকৃত অধিক কাপড় পরিহিত দু’জন নর-নাড়ি স্ট্যাচু অব লিবার্টির মত দাঁড়িয়ে আছে। নড়া-চড়াও করেনা, চোখের পাতাও পরেনা। এটা সত্যি সত্যি মানুষ, না পুতুল ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। নাহ, তাও তো বুঝিনা! শেষে আঙ্গুল দিয়ে ছেলেটার গায়ে একটু গুতা দিলাম। ওমা! নড়ে দেখি! তার মানে মানুষ। এদের শুধু স্ট্যাচু অব লিবার্টির মত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এটাই এদের কাজ। কথা বলার পারমিশন নাই, তাই এতক্ষণ কিছু বলেনি কিংবা বলতে পারেনি। কিন্তু আঙ্গুল দিয়ে গুঁতো দেয়াতে সে খানিকটা বিরক্ত হয়েছে। দৃশ্যটা ৬’৫’’ উচ্চতার পাহাড়সম গার্ডের চোখ এড়ালোনা। ঝাড়ি দিয়ে আমাকে নিচে পাঠিয়ে দিল। কত্ত বড় অপমান, আমি একজন অনারেবল টুরিস্ট, আমার কি মান-সম্মান নেই? রাগ করে দোতলাতেও আর গেলাম না।
ডাইরেক্ট একতলা। বুড়ো-বুড়িদের ফ্লোর। হাল্কা বিটে কাউনট্রি মিউজিক বাজছে। ভালই লাগছে। যাক, এইবার দেখিয়ে দিব ড্যান্স কাকে বলে! কিন্তু যত গরজে, তত বর্ষে না! বুড়োদের সাথেও তাল মিলিয়ে নাচতে পারলাম না। এরা কি মানুষ? এরা কি দিয়ে তৈরিরে ভাই? এই বয়সেও কিভাবে এই মু্ভসগুলো দেয়? হয়ত সারা জীবন নেচে এসেছে, তাই এরা অভ্যস্ত। আর আমি জীবনেও নাচিনাই, তাই আমি বিদ্ধস্থ! মনটা ভেঙ্গে গেল। নাচ আমাকে দিয়ে হবেনা। নাচার মুডটাই অফ হয়ে গেছে। একটু প্রশান্তির আশায় একটা কোক কিনে ড্যান্স ফ্লরের এক কোনায় “তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে” হয়ে বুড়োদের নাচ দেখচি। তাতেও কি শান্তি আছে? এক মাতাল বুড়ো হাতে কোকের বোতল দেখে বলল, “You are drinking coke in a pub! Shame on you. At least have a bier. ” মেজাজটা বেশম্ভব রকমের খারাপ হয়ে গেল। আমি কোক খাই না বিশ খাই, তাতে তোর কি? এবার রাগ প্রশমনের জন্যে একটা
সেভেন-আপ কিনলাম। ঝকঝকে একটা গ্লাসে সেভের-আপ ঢেলে কোকের সাথে মিশিয়ে মদের কালার বানালাম। ক্রিস্টাল ক্লিয়ার গ্লাসটা দেখে মদের গ্লাসি মনে হচ্ছিল। নে বাবা, গ্লাস ভরে মদ খাচ্ছি। এবার একটু শান্তিতে থাকতে দে। একের পর এক হার্ট ব্রেকিং ঘটনাতে বিমর্ষ হয়ে ভোঁদড়ের মত মুখ নিয়ে কোনায় রাখা এক বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। আশপাশে তাকিয়ে দেখি আমার বাংলাদেশী বন্ধুরাও আমার মত বিমর্ষ হয়ে ভোঁদড়ের মত মুখ নিয়ে বসে আছে। কারও মুখে টু-শব্দটিও নেই। কথা না বললেও আমরা সবাই জানি আমাদের মনের অবস্থা। আমরা সবাই কালচারাল শক খেয়ে বসে আছি...
**************************************************
লেখাটি জার্মানি থেকে প্রকাশিত জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিন থেকে নেয়া
---------------------------------------------------------------------------
"জার্মান প্রবাসে - সেপ্টেম্বর ২০১৪" - কালচারাল শক
ডাউনলোডঃ http://goo.gl/myvMlM (৭.৭ মেগাবাইট)
-------------------------------------------------------------------------
২| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:২৫
সোহানী বলেছেন: f দারুন লিখা। সহজভাবে নাইট ক্লাবের চিত্র তুলে ধরেছে.... যদিও কোন নাইট ক্লাবের অভিঙ্গতা নেই............
২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৭
ক্যপ্রিসিয়াস বলেছেন: আহারে , নেক্টটাইম আসলে অবশ্যই যাবেন। জীবনে সব কিছুরই অভিঘতা থাকা ভাল। আর হ্যা আগে থেকে বুদ্ধি করে কোকের বোতল সাথে নিতে ভুইলেন না। কাজে দিবে। ভাল থাকবেন।
৩| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:০২
বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: জটিল! জটিল!! জটিল!!! ব্যাপক বিনুদিত হইলাম ভ্রাতা।
২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৭
ক্যপ্রিসিয়াস বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই, ইহা কিন্তু একটি সত্য ঘটনা।
৪| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৬
কলমের কালি শেষ বলেছেন:
চমৎকার অভিজ্ঞতার চমৎকার লেখনী প্রকাশ । মজা বেফক ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৩১
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: আমরা সবাই কালচারাল শক খেয়ে বসে আছি... এইটা ভাল বলছেন
+++