![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
০১.
সর্বভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে বাম ও গণতান্ত্রিক-প্রধান দুই রাজনৈতিক ধারা বলে অনেকেই মনে কওে থাকেন।আদর্শগত বিপরীতমুখীতা থাকলেও এ দুটি ধারা বিভিন্ন সময়ে যুগপত আবার অনেক সময় কৌশলগত ও নীতিগত কারনে পৃথকভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। সেক্ষেত্রে ৬ষ্ঠ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কংগ্রেসে বামপন্থীদের উদ্দেশ্যে করা ঘােষণা উল্লেখ্য `demarcate themselves in the most clear-cut fashion, from all the petty-bourgeois groups and parties”১ ভারত-বাংলার বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যকার সম্পর্ক ও উত্তরণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে উভয় আন্দোলনের প্রাথমিক পরিচয় সামনে রাখা বাঞ্ছনীয়। দেশে দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান প্রধান পক্ষ রয়েছে। তারমধ্যে প্রায় সকল দেশেই দুটি পক্ষের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়: ডান ও বাম। ডান ও বাম আন্দোলনের উৎপত্তি নির্ণয়ে ‘পরিচয়’ পত্রিকা ‘আপাত হাস্যকর পশ্চাতপট’ বিষয়ক ধারণার জন্ম দিয়েছে। এ পশ্চাতপট তৈরি হয়েছে মূলত বিলেত ও ফরাসী পার্লামেন্টকে ঘিরে। বিলেত তথা ব্রিটেনের সংসদ অধিবেশনের সময় স্পীকারের ডানে সরকারী দল ও বামে বিরোধী দলের আসনের ব্যবস্থা আছে। একপর্যায়ে বাম পাশের সদস্যরা ও দল বামপন্থী হিসেবে পরিচিতি পায়। ফরাসী রাজনীতিতে ডান-বামের আবির্ভাব সে সময় হতেই। এরপর বাম-ডান রাজনীতি বিশ্বের অনেক দেশেই পরিচিতি লাভ করে। সাধারণত ক্ষমতার বাইরে থাকায় বামপন্থীরা রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রগতিশীল ও পরিবর্তনকামী হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। অবশ্য বিশ শতকের প্রথমদিকে মার্কসবাদী তত্ত্বের অনুসারীরা বামপন্থী বা ভিন্নমতাবলম্বী ডানপন্থী হিসেবে পরিচিতি পান।এ আন্দোলনের ধারা বিশ শতকেই ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে। অন্যদিকে ডানপন্থীদেরকে সাধারণত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশীদার বলা হয়। মূলত স্বাধীকার, সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, জনগণের মুক্তি প্রভৃতির প্রশ্নে গণতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালিত হয়ে থাকে। এ আন্দোলনের সারমর্ম সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের চোখে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে: `Democracy is the government of the people by the people and for the people'২ আধুনিক ভারতে ১৮৮৫ সালে ‘সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মূলত এ আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ও প্রত্যক্ষ সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসই সর্বভারতীয় রাজনীতির নিয়ন্তা হিসেবে কাজ করেছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিটিশ ভারতে এবং ভারত বিভাগোত্তর উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন উভয়ই যুগান্তকারী ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
০২.
মার্কস-এঙ্গেল এর তাত্ত্বিক মতবাদকে লেনিন বাস্তবে রুপ দিয়ে ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সংঘটিত করেন দুনিয়া কাঁপানো বলশেভিক বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এ বিপ্লবের অভিঘাতে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মত ভারতও আলোড়িত হয়। ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে বিপ্লবের রস সিঞ্চিত হয়। দানা বেঁধে উঠতে থাকে সমাজতান্ত্রিক-সাম্যবাদী ভাবাদর্শ। সাধারণভাবে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে দেখা হয় একমাত্র ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কেন্দ্রিক আন্দোলন-সংগ্রামকে। তাশখন্দে ১৯২০ সালে যার জন্ম, কানপুরে ১৯২৫ সালে তার প্রথম সম্মেলন। কিন্তু বাস্তবে রুশ বিপ্লবের পর থেকে এদেশে গড়ে ওঠে আরো বহু ছোট বড় কমিউনিস্ট গোষ্ঠী। কমিউনিস্ট তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সাথে তাদের সবারই ছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ। ছাত্র-যুব আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারায় অভিজ্ঞতার আলোকে গ্রহণ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। বিশেষ করে বাংলার জাতীয় বিপ্লববাদীদের একটি বড় অংশ ব্যক্তি সন্ত্রাসের কর্মপদ্ধতি ত্যাগ করে বরণ করেন কমিউনিস্ট মতাদর্শ। এমন বেশ কিছু গোষ্ঠী ও পার্টির কর্মীরা পরে যোগ দেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে। এভাবে বহু স্রোত মিলে তৈরি হলো একটি ধারা-একটি আন্দোলন, যাকে বামপন্থী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। অন্যদিকে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস আলোচিত সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক, নেতিবাচক ও বিতর্কিত নানা কর্মসূচী গ্রহণ করতে থাকে। কংগ্রেসকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্লাটফর্ম ধরলেও এর পরিচালিত কার্যাবলী সকল ক্ষেত্রে প্রগতিশীল ও পরিবর্তনকামী ছিল না। তার প্রধান কারণ ছিল সমকালের কংগ্রেসী মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশেরই সৃষ্টি। রুশ বিপ্লবের আগ পর্যন্ত এসব বাঙালী ভদ্রলোক শ্রেণী বাংলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে একক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তবে বিশ শতকের গোঁড়ার দিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, জাতীয় বিপ্লববাদী আন্দোলন, খেলাফত-অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতির বাতাবরনে জনসাধারণের ভেতরে রাজনৈতিক সচেতনতা কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়াই ঐ ভদ্রলোক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল হয়ে আসে। রাজনীতিতে আগমন করতে থাকে উদীয়মান ভদ্রলোক; যারা পূর্বসূরীদের মত অতটা আপোসকামী ছিলেন না, বরং অনেকক্ষেত্রে ছিলেন আপোসহীন। এভাবে কংগ্রেসের ভেতর জন্ম নেয় নরমপন্থী ও চরমপন্থী ভাবাদর্শ। দু গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে কংগ্রেসের নেতৃত্ব। কংগ্রেসের চরমপন্থীদের সাথে বামপন্থীদের একটা সাধারণ সম্পর্ক ছিল। কংগ্রেসের ভেতরে থেকে বামপন্থীরা কখনো সহযোগীতা, কখনো বা অসহযোগীতার নীতি গ্রহণ করেছে। আর এভাবে বাম ও গণতান্ত্রিক (যাকে আমরা মোটা দাগে ডান আন্দোলন বলছি) আন্দোলনের ভাবধারা ও গতিপ্রবাহ নানা জটিল সম্পর্কের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে।
০৩.১
জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় থেকে ১৯২৫ সালের ১ নভেম্বর সারা ভারতের মধ্যে প্রথম বাংলায় ‘ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজ্যান্ট পার্টি’ গঠিত হয়। কুতুবুদ্দীন আহমেদ, হেমন্তকুমার সরকার, কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও শামসুদ্দীন হুসেন ছিলেন প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। এর আগে অসংগঠিত এ পার্টির নাম ছিল ‘লেবার-পিজ্যান্ট স্বরাজ পার্টি অব দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শ্রমিক প্রজা স্বরাজ সম্প্রদায়। ১৯২৬ সালের ৬-৭ ফেব্রুয়ারি হেমন্তকুমারের আহবানে কৃঞ্চনগরে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মিলনীর দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে এ সংগঠনের নাম ‘পিজ্যান্টস এ্যান্ড ওয়ার্কার্স পাটি অব বেঙ্গল’ রাখা হয়। ১৯২৮ সালের ভাটপাড়ার সম্মেলনে আরেক দফা পরিবর্তন করে এটির নাম হয় ‘ ওয়ার্কার্স এ্যান্ড পিজ্যান্ট পার্টি অব বেঙ্গল’। বাংলার পরে বোম্বই, পাঞ্জাব প্রভৃতি প্রদেশে এ ধরণের পার্টি গড়ে ওঠে। বিভিন্নভাবে গড়ে ওঠা এসব ছোটখটো দলগুলোকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে সরদার মোহন সিং ১৯২৮ সালের ২১-২৪ ডিসেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে সর্বভারতীয় সম্মেলন আহবান করেন। তখন বঙ্গীয় শ্রমিক কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মোজাফফর আহমেদ। আলবার্ট হলের সম্মেলনের অব্যবহিত পরেই ৩০ ডিসেম্বর কলকাতায় বসে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন। এ অধিবেশনেই শ্রমিক কৃষক পার্টি ভারতের পূর্ণ ও আপোসহীন স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে এক অনন্য নজির স্থাপন করে। মনে করা হয় যে, এই বঙ্গীয় শ্রমিক কৃষক পার্টি পরবর্তীকালে বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার পথ অনেকটাই প্রশস্ত ও সুগম করেছিল।৩
০৩.২
১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ৬ষ্ঠ কংগ্রেস ভারতের বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যকার উল্লিখিত জটিল সম্পর্ককে আরো গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ১৭ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর অবধি অনুষ্ঠিত মস্কোর এ কংগ্রেসে গৃহীত হয় সুবিখ্যাত ‘থিসিস অন দ্য রেভ্যুলিউশন্যরি মুভমেন্ট ইন দ্য কলোনীজ এ্যান্ড সেমি কলোনীজ’, যা সংক্ষেপে কলোনীয়াল থিসিস নামে পরিচিত। এখানে বামপন্থীদের প্রতি কঠোর বার্তা দিয়ে ঘোষণা করা হয়-ÔThe basic tasks of the Indian communists consist in struggle against British imperialism for the emancipation of the country’৪ থিসিসে বলা হলো যে, ভারতীয় কমিউনিস্টদের প্রধান কাজ হলো স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসকামী কংগ্রেসের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়া--`The communist must unmask the national reformists of the Indian National Congress’৫ কমিউনিস্টদের কোনো পেটি বুর্জোয়া গ্রুপ বা পার্টির সাথেও কোনো রকম সম্পর্ক রাখা উচিত নয় বলেও থিসিসে ঘোষণা করা হয়। শ্রমিক ও কৃষক দলগুলোকেও তীব্র সমালোচনা করা হয়। শুধুমাত্র শ্রমিকদের নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার তাগিদ দেয়া হয়। বলা হয়- `The union of all communist groups and individual communists scattered throughout the country into a single, independent and centralized party represents the first task of Indian communists’৬ উল্লেখ্য যে, কমিনটার্ন৭ কৃষক শ্রমিক যৌথ দলের বিরোধীতা করলেও এমএন রয়, এসএন ঠাকুর, ক্লিমেন্স পাম দত্ত, রজনী পাম দত্ত, পেজ আর্নট প্রমুখ নেতারা ভিন্নমত পোষণ করেন এবং এ পার্টিকে সমর্থন করেন। তারা গণ আন্দোলন প্রসারে শ্রমিক কৃষক পার্টির ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রশংসা করেন।৮
০৩.৩
৬ষ্ঠ কমিনটার্নের কলোনীয়াল থিসিস কমিউনিস্টদের অতি বামপন্থী নীতি গ্রহণের দিকে ঠেলে দেয়। থিসিসের খবর ভারতে আসার পূর্বে কমিউনিস্টরা বিভিন্ন প্রদেশের শ্রমিক কৃষক পার্টিকে বিলুপ্ত করে সর্বভারতীয় শ্রমিক কৃষক পার্টি গঠনের চেষ্টা চালায়। কংগ্রেসের নেতৃত্ব বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে থাকলেও কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই বর্তমানে কাজ করে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের মুখোশ খুলে দিয়ে বিপ্লবী জনসাধারণকে কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে শ্রমিক কৃষক পার্টির দিকে টেনে আনার চেষ্টাও করা হয়। এ সিদ্ধান্তগুলো মানবেন্দ্রনাথ রায়, সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর প্রমুখ নেতারা সমর্থন করেন। কিন্তু উপনিবেশিক তত্ত্ব ভারতে পৌঁছানোর পর অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৩০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নতুন এক তত্ত্ব৯ গ্রহণ করে বাম সংকীর্ণতাকেই অধিকমাত্রায় প্রশ্রয় দেয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপর তীব্র আঘাত হেনে এ তত্ত্বে বলা হয়-`The complete independence of India by the violent overthrow of British rule’ আবার একইসাথে কংগ্রেসের সংস্কারবাদী গান্ধীবাদী নেতৃত্ত্বকে বিশেষ করে কংগ্রেসের বামপন্থী অংশকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলা হয়- ` the most harmful and dangerous obstacle to the victory of the Indian revolution is the agitation carried on by the left elements of the national congress led by Jawaharlal Nehru, Suvas Bose and others.’১০ এ সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বাম সংকীর্ণবাদী অবস্থান গ্রহণের ফলে জাতীয় আন্দোলনের মুল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য যে ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ গান্ধীর ডান্ডি অভিযান দেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কিন্তু কনিউনিস্ট পার্টি এ আন্দোলন থেকে নিজেদের বিরত রাখে। এমনকি পার্টি একে ‘বুর্জোয়া সংস্কারবাদী আন্দোলন’ বলে অভিহিত করে তার বিরোধিতাও করেছিল।এ প্রসঙ্গে বলা যায়- `The Indian communists turned their backs on the fertile field of Indian nationalism and isolated themselves from the wellspring of Indian political life.’১১ ফলে এমন পরিস্থিতি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে জাতীয় রাজনীতি থেকে পশ্চাতপদ করে তোলে। বিপরীতদিকে কংগ্রেসের বুর্জোয়া নেতারা আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠেন।
০৩.৪
বিশ শতকের বিশের দশকের শেষদিকে ইয়ং কমরেড লীগ গঠন এবং বিভিন্ন শ্রমিক ধর্মঘট বাংলার রাজনীতিতে এক ভিন্নমাত্রার সংযোজন করে। ১৯২৮ সালের শেষভাগে ফিলিপ স্প্রাট ও ধরণী গোস্বামীর নেতৃত্ত্বে গঠিত হয় ইয়ং কমরেড লীগ। এ সংগঠনের মুল উদ্দেশ্য ছিল যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ করে শ্রমিক পরিবারের যুব ও তরুণ শ্রমিকদের মধ্যে কমিউনিস্ট মতবাদের প্রচার ও প্রসার। কতগুলো কারণে এ লীগের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ: বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন, এর প্রভাবে বিপ্লববাদীদের একটি অংশ কর্তৃক সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ গ্রহণ করার মাধ্যমে গণবিপ্লবের পথ অবলম্বন, যুবরাজনীতির সংগঠিত সূত্রপাত এবং ১৯৩০ সালের কিশোরগঞ্জ জঙ্গী কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ত্ব প্রদান। অন্যদিকে ১৯২৮-১৯৩০ সালের মধ্যে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে কলকাতা ও হাওড়া জেলার বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘটের এক ব্যাপক প্রবাহ বয়ে যায়। শ্রমিকদের ভেতর সচেতনতা বৃদ্ধি ও আন্দোলন উপযোগী করে তুলতে এ পর্যায়ে ইয়ং কমরেড লীগ অনেকটা সফলতার পরিচয় দেয়।
০৩.৫
বিশ ও ত্রিশের দশকে কংগ্রেসের বিপরীতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠিত হতে চেষ্টা করে। ১৯২৮-১৯২৯ সালে বাংলায় কমিউনিস্টদের শক্তি ও প্রভাব সীমিত থাকলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শিশু কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সংগঠনের উপর প্রত্যক্ষ আঘাত হানতে থাকে। ‘মীরাট কমিউনিস্ট ষঢ়যন্ত্র মামলা:১৯২৯’ এর অধীনে ব্রিটিশ সরকার মোজাফফর আহমদ, শামসুল হুদা, স্প্রাট, ধরণী গোস্বামী, গোপাল বসাক সহ ৩২ জনকে গ্রেফতার করে। ১৯৩০ সালে সরকার `Bengal Criminal Law Amendment Act’ পাশ করে সারা বাংলায় নির্বিচারে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের নেতাকর্মীদের আটক করতে শুরু করে। এই রকম চরম প্রতিকুল অবস্থায় ১৯৩০ সালে কলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি অস্থায়ী কমিটি বা নিউক্লিয়াস সংগঠিত হয়। এর নামকরণ করা হয়-‘অস্থায়ী কলকাতা কমিটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অংশ’ যার প্রাথমিক ৫ জন সদস্য ছিলেন সুধাংশু কুমার অধিকারী, অবনী চৌধুরী, এ এম এ জামান, জগজ্জিত সরকার এবং নদীয়া জেলার একজন কৃষক। ১৯৩১ সালের গোড়ার দিকে গঠিত ‘কলকাতা কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিমই হলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ‘কলকাতা কমিটি’ ছাড়াও এসময় অনেক বামপন্থী ছোট ছোট দল গড়ে উঠে। †যমন নীহারেন্দু দত্ত মজুমদারের নেতৃত্তে¦ ‘বেঙ্গল লেবার পার্টি’, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্ত্বে ‘কমিউনিস্ট লীগ অব ইন্ডিয়া’, এম এন রয়ের ‘দ্য রেভুলিউশ্যনারী পার্টি অব দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ার্কিং ক্লাসেস’ ছাড়াও আইপিআরপি বা গণনায়ক পার্টি, সাম্যরাজ পার্টি, বাংলার কীর্তি কিষাণ পার্টি, কারখানা গ্রুপ, লাল নিশান গ্রুপ, যশোর খুলনা যুব সংঘ প্রভৃতি। এ সমস্ত দলগুলো কখনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, আবার কখনো কংগ্রেস ও গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। যেমন- ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অন্যান্য সমমনা ছোট দল নিয়ে গঠন করে ‘লীগ এগেইনস্ট গান্ধীজম’। তবে এসব দলের মধ্যে ব্যক্তিত্ত্বের সংঘাত ছিল সুস্পষ্ট যা এগুলোর ঐক্যের পথে প্রধান বাধা ছিল বলে মনে করা যায়। যাহোক ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত মূলত বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন শ্রমিক ঘর্মঘট পালনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন অগ্রসর হতে থাকে। তবে ১৯৩৫ সালে ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেকের ‘সিলভার জুবিলি’ অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বয়কট করতে দেশবাসীকে আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে বাম আন্দোলন জাতীয় পর্যায়ে কঠোর এবং দেশবাসীর স্বার্থে যুগোপযোগী ভূমিকা রাখার বার্তা দেয়।
০৩.৬
ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৩৫ সাল পট পরিবর্তনের বছর হিসেবে পরিচিত। এ বছরের গোড়ার দিকেই ভারতে খবর আসে কমিনটার্ন তার ৬ষ্ঠ কংগ্রেসের লাইন পরিবর্তন করতে যাচ্ছে। এসময় কংগ্রেসের গান্ধীবাদী নেতৃত্বের পাশাপাশি কংগ্রেস-সমাজতন্ত্রী দলের ও কংগ্রেসের বামপন্থী অংশের এমনকি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকেও তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়-`However, the communist party of India in the past commited a number of mistakes and incorrect actions as regards its participation in the anti-imperialist struggle.......the inability to link up the most active praricipation in the struggle against imperialism in the front ranks of the fighting masses with the exposure of national reformism, facilitated the growth of sectarian moods and tendencies, which even today are far from being overcome’১২ এখানে পরিবর্তনের ইংগিত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ১৯৩৫ সালের মে মাসে কমিনটার্নের পক্ষ থেকে বাম নেতা পিয়াট্রিজকি ভারতের অবস্থা পর্যালোচনা করে কমিউনিস্টদের উপদেশ দেন যে, তারা যেন কংগ্রেসে যোগ দিয়েই কংগ্রেসকেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করেন এবং গোপন কমিউনিস্ট কার্যক্রমের প্রকাশ্য মঞ্চ বা আবরণ হিসেবে কংগ্রেস কমিটিগুলোকে ব্যবহার করেন। এ সিদ্ধান্তে মতবিরোধ উপস্থিত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা হলো গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেয় নির্দেশ পালিত না হলে কমিনটার্নের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হতে হবে- এ রকম কঠোর অবস্থানে ভারতের কমিউনিস্টদের পরিবর্তিত লাইন গ্রহণে আপত্তির সমাপ্তি ঘটে। এভাবে ৭ম কমিনটার্ন হাজির হয় নতুন একগুচ্ছ দিক নির্দেশনা নিয়ে।
০৩.৭
১৯৩৫ সালের ৭ম কমিনটার্ন ভারদের রাজনৈতিক আন্দোলনের বাম ও গণতান্ত্রিক- এ দুই ধারাকে সমন্বয় সাধনের সুপারিশ করে। এ কমিনটার্নের আন্তর্জাতিক সাধারণ সম্পাদক জর্জি দিমিত্রভ তার সুবিখ্যাত ‘ইউনাইটেড ফ্রন্ট’ তত্ত্ব এ কংগ্রেসে পেশ করেন। এখানে পরিষ্কার করে বলা হয়- `In India communists must support, extend and participate in all anti-imperialist mass activities, not excluding those which are under national reformist leadership while maintaining their political and organizational independence, they must carry on active work inside the organizations which take part in the Indian National Congress, facilitating the process of crystallization of a national revolutionary wing among them, for the purpose of further developing the national liberation movement of the Indian peoples against British imperialism’১৩ বিভিন্ন দেশের কসিউনিস্ট পার্টির কাছে কমিনটার্নের সুস্পষ্ট নির্দেশ গেল-যুক্তফ্রন্টের লাইন গ্রহণ কর; গঠন কর ফ্যাসিবাদবিরোধী , সাম্রাজ্যাবাদ বিরোধী ব্যাপক যুক্তফ্রন্ট। এ তত্ত্বকে কেন্দ্র করে ১৯৩৫সালের ডিসেম্বরে সোমনাথ লাহিড়ী নাগপুরে কমিউনিস্টদের জরুরি মিটিং ডাকেন। এখানেই কংগ্রেসে প্রবেশ করে এবং কংগ্রেসকেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের মূল ও প্রকাশ্য মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে কাজ করার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। শুরু হয় ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক নতুন যুগের, নতুন অধ্যায়ের।
০৩.৮
‘দত্ত-ব্রাডলি থিসিস’ যুক্তফ্রন্ট তত্ত্বকে ভারতীয়করণে সাহায্য করে। ১৯৩৬ সালে গ্রেট ব্রিটেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য রজনী পাম দত্ত এবং বেন ব্রাডলির লেখা ‘দ্য এন্টি ইমপেরিয়ালিস্ট পিপলস্ ফ্রন্ট’ নামক প্রবন্ধই ‘দত্ত-ব্রাডলি থিসিস’ নামে পরিচিত। দিমিত্রভের যুক্তফ্রন্ট তত্ত্বের ভিত্তিতে কিভাবে ভারতে কমিউনিস্টরা ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল ফ্রন্ট‘ গড়ে তুলবেন সে আলোচনাই এ থিসিসের মূল বিষয়বস্ত। থিসিসে বল হলো- ভারতীয় কমিউনিস্টদের প্রধান কাজ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের ভিত্তিতে কংগ্রেসের ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সভা, যুব সংগঠন প্রভৃতি সমস্ত গণ সংগঠনের ঐক্যভিত্তিক ব্যাপক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা। সব দলের একক ন্যূনতম কর্মসূচী গ্রহণের কথা বলা হয়। কংগ্রেসের ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয়- `The National Congress can play a great and a foremost part in the work of realizing the anti-imperialist people’s front ...... may become the form of realization of hte anti-imperialist people’s front; for it is the reality that matters, not the name’১৪ এ থিসিস সম্পর্কে বলা হয়- `This meant an alliance with the Congress Socialist Party and penetration ( that is a united front from below ) of the Indian National Congress as a whole’১৫ ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি তে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর পক্ষ থেকে ‘ ফর দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ নামক রাজনৈতিক প্রস্তাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার উপর জোর দেয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই যুগান্তর- অনুশীলনের জাতীয় বিপ্লবী, বিভিন্ন বামপন্থী দল ও লেবার পার্টির সদস্যরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়। পরে অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে লেবার পার্টিকেই কমিউনিস্ট পার্টির প্লাটফর্ম বা লিগ্যাল কভার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ নীতি গ্রহণের ফলে কমিউনিস্ট পার্টির শক্তি বৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটতে লাগল। কিন্তু একইসাধে কংগ্রেস সম্পর্কে অহেতুক মোহের ও কমিউনিস্ট পার্টির পরবর্তীকালের বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণপত্থী বিচ্যুতির মূলও নিহিত এই থিসিসেই।
০৩.৯
যুক্তফ্রন্ট নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত নানামুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে। যেমন- ক) ব্রিটিশ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি এবং তার ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। খ) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পিত ফেডারেশনের বিরোধীতা । ১৯৩৫ সালের ব্রিটিশ প্রদত্ত ‘স্লেভ কনস্টিটিউশন’ বাতিলের দাবি তোলা । তাছাড়া এ সময় ‘সংবিধান পরিষদ’ গঠন করার দাবি জানানো হয়। গ) ভারতীয়দের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় এবং সকল প্রকার কালাকানুন বাতিলের লড়াই। ঘ) বিনা বিচারে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের এবং অন্তরীণ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ব্যাপক গণ আন্দোলন সংগঠন। ঙ) ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের বিপদ সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা এবং তীব্র ফ্যাসিবাদ বিরোধীতা। চ) ভারতের অন্যান্য স্থানের মত বাংলাতেও এসময় শ্রমিক আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে ১৬। বঙ্গীয় প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন এই পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট গড়ে ওঠে। যেমন-১৯৩৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ মে অবধি ৭৪ দিনব্যাপী দ্বিতীয় সারা বাংলা চটকল শ্রমিক ধর্মঘট প্রভৃতি। এযুগের সকল শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘটেই কমিউনিস্টদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ছ) বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সংগঠনী কমিটি ১৯৩৭ সালে বাঁকুড়ার প্রথম প্রাদেশিক সম্মেলনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভায় রুপ নেয়। কৃষক আন্দোলনে আসে নতুন জোয়ার। এখানেও কমিউনিস্টদের দেখা যায় অগ্রণী ভূমিকায়। জ) গবেষক গৌতম চ্যাটার্জী দেখিয়েছেন যে, ১৯৩৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা ছাত্র আন্দোলনেও নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করে। ছাত্র ধর্মঘট হয়ে ওঠে ছাত্র আন্দোলনের প্রধানতম অস্ত্র। এখানেও প্রথম সারিতে ছিল কমিউনিস্ট ছাত্র কর্মীরা। ঝ) ১৯৩৯ সালে সুভাস চন্দ্র বসুকে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে পুন:নির্বাচিত করার দাবি বামপন্থীরাই তুলেছিল। এ বছর কংগ্রেসের ত্রিপুরা সম্মেলনে সুভাস বসুর বিরুদ্ধে আনীত পন্থ প্রস্তাবের বিরোধীতা করেছিল তারা। তবে এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। বঙ্কিম মুখার্জী ও নীহারেন্দু মজুমদার বামপন্থী ঐক্যের উপর জোর দিয়ে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্ব কে তীব্রভাষায় আক্রমণ করেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির তরফে বাম সংকীর্ণতা ও ঐক্য বিরোধীতার অভিযোগ আনা হয়। দত্তের মনোভাব সম্পর্কে যোশী মন্তব্য করেন: ÔN. Dutta Mazumdar thought ....it was the most sectarian speech of the session....a more irresponsible and disruptive speech’১৭ বঙ্কিম সম্পর্কে যোশী বলেন ‘B. Mukherji speaks as a left factionalist and not as a serious Bolshevik who had to stand out as a unifier’১৮ অবশ্য পরে বসু কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করেন। তাতে বামপন্থীদের অনুমোদন ছিলনা। কারণ তখনও তারা ‘যুক্তফ্রন্ট’ রাজনীতির বাস্তব ও ব্যবহারিক প্রয়োগের দিক সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন।
০৩.১০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কংগ্রেস ও বামপন্থীদের ভূমিকা প্রথমদিকে এক ধারায় এবং শেষদিকে বিপরীত ধারায় প্রবাহিত হয়। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটেন। সাথে সাথে ঘোষণা করা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ ভারত ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। আর এ ঘোষণার ফলে ফুঁসে ওঠে ভারত। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জনগণ ও নেতৃবৃন্দ এর তীব্র বিরোধীতা করেন। বামপন্থীরা কংগ্রেসের ভেতরে থাকায় কংগ্রেসের যুদ্ধ বিরোধীতা দু পক্ষেরই সাধারণ মত বলে বিবেচিত হয়। অবশ্য আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধ ঘোষণার পূর্ব থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি আসন্ন যুদ্ধের বিরোধীতা করতে থাকে এবং ভাতেকে যুদ্ধে জড়িয়ে নেয়ার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অপচেষ্টা সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করতে থাকে। এর প্রমাণ স্বরুপ বলা যায়-‘But India’s determination to resist war must not be slackened.....and as long as there is a single congressman, as long as there are millions of our countrymen full of hatred against imperialism war-resistance must continue.’১৯ এমনকি কংগ্রেসের থেকেও তারা এগিয়ে থেকে যুদ্ধ বিরোধী প্রচারণা চালায়। একপর্যায়ে বামপন্থীরা শ্লোগান তোলে--`Convert imperialist war into a democratic war’পার্টির এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রস্তাবে লেনিনীয় পদ্ধতিতে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করার আহবান জানানো হয়।২০ এ প্রস্তাবে আরো শ্লোগান তোলা হয়- `Give proletarian impress to the national struggle’ প্রস্তাবে কংগ্রেসের আপসকামী ও দোদুল্যমান চরিত্রের তীব্র সমালোচনা করা হয়। যদিও দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস নেতৃব্ন্দৃ সাম্রজ্যবাদ বিরোধী গণ আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গোঁপন আপস রক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। তবুও পার্টি মনে করে সংগ্রামটা করতে হবে কংগ্রেসের ভেতর থেকেই, কংগ্রেসের বাইরে গিয়ে নয় বা কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে নয়, বরং কংগ্রেসকেই সামগ্রিকভারে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণ আন্দোলনের পথে টেনে আনতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের যুগে কমিউনিস্টদের মুলকাজ হলো দেশব্যাপী গণ আন্দোলনকে একটি বৈপ্লবিক চরিত্র প্রদান করা এবং সেটা করতে হবে কংগ্রেসের দধ্যে থেকেই। কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেস নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা করলেও রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কংগ্রেকে কোন সমালোচনা করেনি। বরং বারবার কংগ্রেসের বাজনৈতিক ঐক্যের উপর জোর দিয়েছে এবং কংগ্রেস ত্যাগীদের বিরুদ্ধে আত্রমণ শানিয়েছে। তাদের আহবান ছিল-গান্ধীবাদী অহিংসার সংস্কারবাদী চালচিত্র ভেঙ্গে দিতে হবে। কংগ্রেসকে কিছুতেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস করতে দেওয়া চলবে না। এসময় ‘ দ্য প্রলেতারিয়ান পাথ’ দলিলের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কথাও বিশেষ জোরের সাথে বলেছে। কিন্তু গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সশস্ত্র গণ অভ্যুত্থানের পথে পা বাড়াবে না একথা কমিউনিস্ট পার্টির অজানা ছিল না। অবশ্য এজন্য পার্টি কংগ্রেস নেতৃত্বকে সমলোচনাও করেছেন। এ সময় কমিউনিস্টদের মনোভাব ছিল যোশীর ভাষায়-`The result of our policy in this period meant that India had lost a great opportunity of sriking for Indian freedom and world peace.’২১ কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি একদিকে সশস্ত্র গণ অভ্যত্থান ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ডাক দিয়েছে, আবার একইসাথে কংগ্রেসের নেতৃত্বে সংগ্রামে অবিচল থেকেছে। এই দুই পরস্পর বিরোধী নীতি গ্রহণের ফলে প্রকৃত সহাবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপরেও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪১ সালের জুন মাস পর্যন্ত এমন এক জটিল ভূমিকায় বামপন্থীদের দেখা যায়।
০৩.১১
১৯৪১ সালের ২২ জুন ফ্যাসিস্ট জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে এ আক্রমণ পরিচালনা করায় সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদী মিত্র শক্তির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে অংশ নেয়। এর ফলে কমিউনিস্টদের বিবেচনায় যুদ্ধের চরিত্র পাল্টে যায়। এ সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে জনযুদ্ধ আখ্যায়িত করে। জনসাধারণের পার্টি আহবান জানায় ‘ÔMake the Idian people play the people’s role in the people’s war.’ বামপন্থীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশে দাঁড়ানোকে তাদের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে। একাজ করতে গিয়ে তারা স্বদেশের প্রবল জনমতের বিরুদ্ধে চলে যায়। পূর্বে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব থাকায় বিষয়টি ভারতীয় জনমানসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে তাদের দেশদ্রোহী, রাশিয়ার দালাল, সাম্রাজ্যবাদের চর ইত্যাদি বিশষণে ভূষিত করা হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে ১৯৪২ সালে ভারতের ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে পূর্বের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে বৈধ সংগঠন হিসেবে স্বিকৃতি দেয়। এ সময় জাতীয় কংগ্রেস শুরু করে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন। জনযুদ্ধ নীতির কারণে কংগ্রেসের সংগ্রামে বামপন্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারে নি। এতে তাদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। পাশাপাশি কংগ্রেস, সিএসপি, ফরোওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি প্রভৃতি দলগুলোর বিরাগভাজন হয়ে পড়ে।এমনকি এসব দলগুলো কমিউনিস্টদের উপর সহিংস হয়ে ওঠে। যেমন- পূর্ব বাংলায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে সোমেন চন্দ, ফনী চক্রবর্তী ও ভানু নিহত হন। ইতোমধ্যে সরকারের তীব্র দমন নীতির কারণে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন স্তব্ধ ও নি:শেষিত হয়ে যায়। কমিউনিস্টদের অপবাদ কিছুটা হলেও ঘোচে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা ও সেবাকর্ম পরিচালনার মধ্য দিয়ে।
০৩.১২
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে সাতচল্লিশ সাল পর্যন্ত ভারতের জাতীয় রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী কংগ্রেস ও বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সম্পর্ক নির্দেশ করে। অবশ্য এসময় বামপন্থীরা কিছুটা মুসলিম লীগকে সমর্থন দিতে থাকে। সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’র নেতৃস্থানীয়দের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হলে তা এদেশের মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে নি। গড়ে ওঠে ব্রিটিশ বিরোধী তীব্র মুক্তি আন্দোলন। এ সময় তীব্র ব্রিটিশ বিরোধীতা, বিক্ষোভ, জঙ্গী আচরণ ও জনমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে কমিউনিস্ট পার্টি অনেকটা সতেজ হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লীগও নিজেদেকে শক্তিশালী অবস্থানে তুলে আনতে সক্ষম হয়।উল্লেখ্য যে, এ সময় ব্রিটিশ সরকার চলমান বিক্ষোভ আন্দোলনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। ১৯৪৫ সালে ভারতের স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে লর্ড ওয়াভেল শিমলায় এক রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বমূলক সম্মেলন আহবান করেন। এ সম্মেলন ব্যর্থ হলে সরকার ভারতে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। নির্বাচনে কংগ্রেস অখন্ড ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ও মুসলিম লীগ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দু মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে প্রধান ইস্যু করে প্রতিদ্বন্দিতা করে। কমিউনিস্ট পার্টিও এতে অংশ নেয়। পার্টি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীতায় কংগ্রেস ও লীগের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নির্বাচনী লড়াইকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম হিসেবে প্রচার করে। পার্টি সব আসনে প্রার্থী না দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লীগ বা কংগ্রেস প্রার্থীদের সমর্থন দেয়। অবশ্য কোন দলই তাদের সমর্থন আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করে নি। ফলে কমিউনিস্ট প্রার্থীদের লড়াই ছিল কংগ্রেস-লীগ উভয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে সমগ্র ভারতে মাত্র ৮ জন কমিউনিস্ট সদস্য বিজয়ী হন। এ নির্বাচনে তাদের বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধী, ইসলাম বিদ্বেষী, সাম্রাজ্যবাদের দালাল ইত্যাদি প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল। বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। এ সময় কংগ্রেস ও লীগের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ আগস্ট থেকে মারাত্নক রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত হয়।সে সময়ে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই দাঙ্গার বিরুদ্ধে নীতিগত ভাবে সংঘবদ্ধ হয় এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষায় আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে। উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশদের ‘ ডিভাইড এ্যান্ড রুল পলিসি’ এবং তাদের দেশীয় দোসরদের চক্রান্তে সমগ্র ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তবে দাঙ্গাকালীন সময়ের আগ থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির পরিচালনায় বাংলার বিভিন্ন জায়গায় সামন্ত শোষণ বিরোধী তেভাগা, টংক ও নানকার নামক কৃষক প্রজা জঙ্গী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। শেষমেশ ব্রিটিশরা ভারত বিভক্তির সিদ্ধান্ত নেয় দ্বিজাতি তত্বের উপর ভিত্তি করে। মূলত: গান্ধী ও নেহরুর সাথে পরামর্শ করেই ভারত ভাগ করা হলো। মুসলিম লীগের সাথে নামে মাত্র যোগাযোগ রেখে এতবড় সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলো। ভারত বিভক্তির প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টিকে কোন মূল্যায়নই করা হয়নি। উল্লেখ্য যে, পার্টি পাকিস্থান আন্দোলনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। এক নির্বাচনী ইশতেহারে পার্টি ঘোষণা করে- কমিউনিস্ট পার্টিই একমাত্র পার্টি যে মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের দাবিকে ন্যায্য বলে মেনে নিয়েছে এবং মুসলিম লীগকে আহ্বান করছে কংগ্রেস-লীগ-কমিউনিস্ট মিলিত অভিযানের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের মূল লক্ষ্য সফল করতে। অন্যদিকে বসু-সোহরাওয়ার্দীর অবিভক্ত বাংলা গঠনের প্রয়াসকেও কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন দেয়। ফলে পার্টির ভূমিকা রাজনৈতিক নেতা ও জনগণের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। এ রকম পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
০৩.১৩
সাতচল্লিশ পরবর্তী ভারতের বিশেষত পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে বামপন্থীদের ভূমিকা এক ইতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি করে, যদিও তা বহুধারায় বিভক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানের নয়া উপনিবেশিক শাসন শোষণের প্রেক্ষাপটে বাঙালির অধিকার আদায় আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকে বামদের গুরুত্বপূর্ণ উপস্তিতি লক্ষ্য করা যায়। অকে ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাই ছিল নির্ণায়ক। পাকিস্তানি আমলের প্রথম দশকে বামদের ,মধ্যে বিভেদ কম থাকায় তারা নানা উপায়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংগঠনে যুক্ত থেকে বাঙালীর মধ্যে স্বাধিকারের ধ বোতৈরিতে পালন করে পথিকৃতের ভূমিকা। এ স্বাধিকারবোধ ক্রমে আন্দোলনের রুপ পরিগ্রহ করে ষাটের দশকে প্রথমে স্বাধিকার ও পরে স্বাধীনতার অভিমুখে বাঙালীকে ধাবিত করে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি বাম আন্দোলন বাঙালী মুক্তির অন্বেষায় গঠনমূলক রাজনীতির সূচনা করে। অবশ্য এ পর্যায়ে প্রথমে চীন-সোভিয়েত আন্তর্জাতিক মতাদর্শগত দ্বদ্বের প্রেক্ষাপটে বামদের বিভক্তি ও পরে তত্ত্ব আর থিসিসের দুর্বোধ্য সংঘাতে চীন বা পিকিংপন্থীদের বহুধা বিভক্তিতে বামপন্থীরা প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলেও স্বতন্ত্র বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ার সংগ্রামে তাদের অবস্থানিক গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
০৪.
ভারতে বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে (১৯২৮-১৯৩৫) কমিউনিস্ট পার্টির বাম সংকীর্ণতাবাদী অবস্থান গ্রহণ ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে অন্যান্য সকল দল সম্পর্কেই এক নেতিবাচক মনোভাব ছিল প্রধান দুটি ত্রুটি। তথাপি তাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার কোন ঘাটতি ছিলনা। আর এর পুরস্কার স্বরুপ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পার্টিকে নিষিদ্ধ করে । এ সময় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কে পার্টি প্রয়োজন মত ব্যবহার করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়কে (১৯৩৫-১৯৩৯) যুক্তফ্রন্টের যুগ বলা যেতে পারে। এ সময় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি স্বিকৃতি লাভ করে। কিন্তু সূত্রপাত ঘটল কংগ্রেস সম্পর্কে পার্টির অহেতুক মোহ ও অত্যধিক আস্থার। এই আস্থা-মোহের মাত্রাধিক্যের মধ্যেই নিহিত ছিল পরবর্তীকালের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হওয়া দক্ষিণপন্থী-সংস্কারবাদী বিচ্যুতির বীজ। তবে একথা সত্য যে, এ পর্যায়ে তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার পরিপূরক হিসেবে বামপন্থী ঐক্যভিত্তিক বিকল্প বামপন্থী নেতৃত্ব গড়ে তোলা সম্ভবপর হলো। তৃতীয় পর্যায়ে (১৯৩৯-১৯৪১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সাম্রাজ্যবাদী যুগে কংগ্রেস ব্যাপকভাবে ও কমিউনিস্ট পার্টি সীমিত শক্তি নিয়েও আন্তরিক ও সর্বোতভাবে যুদ্ধ প্রচেষ্টার বিরোধীতা করে। পার্টি ডাক দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য। ‘দ্য প্রলেতারিয়ান পাথ’ দলিলে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের তত্ত্ব দিয়েছে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গেল। জাতীয় সংগ্রাম কংগ্রেস, অন্যান্য বামপন্থী দল বা কসিউনিস্ট পার্টিও গড়ে তুলতে পারল না। এজন্য এরা সকলেই দায়ী। মূলত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের প্রতি অতিরিক্ত আস্থা এবং অন্যান্য বামপন্থীদের তীব্র সমালোচনা এবং সর্বোপরি জনসমর্থনের অভাবে গণ বিপ্লব সাধিত হয় নাই । পিসি যোশী এ সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করেছেন- ‘We had no illussions that a single party like ours could start a national struggle. All our attention was directed to create the general atmosphere in the country and those conditions among the sections of the people we led that might help the congress to take the lead.’২২ চতুর্থ পর্যায়ে (১৯৪১-১৯৪৫) কমিউনিস্ট পার্টি ‘জনযুদ্ধের নীতি’ গ্রহণ করে । ফলে কংগ্রেস সরকারের বিরোধীতা করলেও পার্টি প্রথমদিকে সরকারের বিরোধীতা ও পরে সহযোগীতা করতে থাকে। কমিউনিস্টদের এ দ্বৈত নীতির কারণে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। পঞ্চম পর্যায়ে (১৯৪৫-১৯৪৭) কমিউনিস্ট পার্টি রাজনীতিতে তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পার্টির ভরাডুবি এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নিবিদ্ধ করে । অন্যদিকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাদের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা এবং মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে পার্টি কিছুটা হলেও মানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়। শেষ পর্যায়ে (১৯৪৭-১৯৭১) বহুধা বিভক্ত হয়েও বামপন্থীরা বাংলার রাজনীতিতে বেশ প্রগতিশীল ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় বলে প্রতীয়মান হয়। উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা প্রতীয়মান হয় যে, উল্লিখিত সময়কালে বামপন্থীরা রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেনি। কিন্তু তারা এমন একটা অবস্থান তৈরি করে যে তাদের অগ্রাহ্য করার করা সম্ভব ছিলনা। যেমন- বামপন্থী শক্তির আদর্শিক ও সাংগাঠনিক অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও কৃষক শ্রমিক জঙ্গী গণ সংগ্রাম সংগঠনে ব্যাপক সাফল্যের পরিচয় দেয়। এ সকল সংগ্রাম অমিত বিপ্লবী সম্ভাবনা নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিমুল নাড়িয়ে দেয়। কেউ কেউ মনে করেন বামদের বিপ্লব ভীতি থেকেই ব্রিটিশরা তাদের পুঁজির স্বার্থেই ভারতীয় পুজিপতিদের প্রতিভূ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাতে তড়িঘড়ি করে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ব্রিটিশদের ক্ষমতা হস্তান্তরে বামপন্থীরা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করতে না পারলেও এ সময় পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির সাংগাঠনিক কাঠামো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। দেশভাগের প্রাক্কালে পূর্ব বাংলায় পার্টির সদস্য সংখ্যা ১২ হাজারে উন্নীত হয়। এরা অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ভূক্ত হওয়ায় দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। ১৯৪৭ সাল পরবর্তী সময়ে পূর্ব বাংলায় নতুন করে বামপন্থী আন্দোলন শুরু হলেও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম বিশেষত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীরা অনবদ্য অবদান রাখেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অনেকেই বাম আন্দোলনকে নেতিবাচক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘ এ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক ভারতের ডিসকোর্সে বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন দুটি ধারাই শক্তিশালী ও গণমুখী।
তথ্যসূত্র:
১. Chattapadhay, Gautam, Colonial Thesis, qouted. Communism and Bengal Freedom Movement, vol-1, PPH, New Delhi, 1970, p.119
২. H. B. Parkes, United States of America A History, New York, 1978, p.312
৩ . Adhikari, Gangadhar, Documents of the History of the Communist Party of India.
৪. International Press Correspondence- Inprecor., 8(88), 12 December 1928
৫. Colonial Thesis, People’s Publishing Home Ltd., Bombay, 1st Indian Edition, January 1948, p.55
৬. Ibid,p.48
৭. কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর আন্তর্জাতিক সম্মেলন বা কংগ্রেসই কমিনটার্ন
৮. Chattapadhay, Gautam, Communism and Bengal Freedom Movement, vol-1 (1917-1929), PPH, New Delhi, 1970, p.119-122
৯. ‘Draft platform of action of the communist party of India’
১০. Willianson, Horace, India and Communism, Calcutta, 1976, pp.320-321
১১. Overstrect and Windmiller, Communism in India, The Perrenial Press, Bombay, 1960, p.139
১২. International Press Correspondence- Inprecor., `Problems of the Anti-imperialist Struggle in India’, 9 March, 1905
১৩. Adhikari, Gangadhar (ed.), From Peace Front to People’s War, Second England Edition, PPH, Bombay, 1944, p.68
১৪. Dutta, R Palme & Bradley, Bev, The Anti-imperialist People’s Front, p.3
১৫. Overstreet, Gene D, & Windmiller, Marshal, Communism in India, The perennial Press, Bombay, 1960, p.161
১৬ . Sen, Sukomol, Working Class of India : History of Emergence and Movement.
১৭. Joshi, P.C., `Tripuri : National Front, vol-2, no.6, 19 March, 1939, p.97
১৮. Ibid, p.100
১৯. Editorial, India must Resist War : National Front, vol-2, 3 September, 1939, Bombay, p.466
২০. `Statement of the Polit-bureau on Communist Party of India Policy and Tasks in the Period of War’
২১. Joshi, P.C., Communist Reply to Congress Working Committee’s Charges, PPH, Bombay, December 1945, p.41
২২. Ibid, p.40
©somewhere in net ltd.