নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বারবারিয়ান কিং

বাল

বারবারিয়ান কিং › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বপ্নহীন ঘুম

১০ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১০:৪৪

রাতের অন্ধকার কালো লেকটাকে যেন খেয়ে ফেলেছে ।
লেকটার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শাহরিয়ার । হাতে একটুকরো জ্বলন্ত আগুন ।
একা একা এখানে সিগারেট খাচ্ছে – ব্যাপারটা অস্বাভাবিক । শাহরিয়ার মোটেও রাত সাড়ে এগারটার সময় বাইরে ঘুরে বেড়িয়ে সিগারেট খাওয়ার মত ছেলে না ।
আজকের ব্যাপারটা ব্যতিক্রম ।
হৃদির আজ বিয়ে ।
আরও ঠিক করে বলতে গেলে এতক্ষণে হৃদির বিয়ে হয়ে গেছে । বাসরঘরেও ঢুকে গেছে খুব সম্ভব ।
শাহরিয়ার সিরিয়াস টাইপ ছেলে ।
পড়াশোনা আর হৃদি – এই দুটো ছাড়া আর কিছু বোঝে না ও । ওকে সাড়ে এগারটাতে বাইরে দেখাটা সেজন্যই একটা অবাক করা বিষয় ।
পেছন থেকে কোন শব্দ না করে এসে দাঁড়ায় আরেকজন ।
‘দোস্ত – এত রাতে এখানে আসতে বললি যে ?’ জানতে চায় শাহরিয়ারের ভার্সিটি-ফ্রেন্ড রিয়াজ ।
‘কথা ছিল ।’ একটু করে বলে শাহরিয়ার ।
‘কি হয়েছে ?’ একটু উদ্বিগ্ন হয় যেন রিয়াজ ।
‘হৃদির বিয়ে হয়ে গেছে ।’ মাথা ঝুঁকে যায় শাহরিয়ারের – এই কথা বলার সাথে সাথে ।
উদাস শাহরিয়ার কিছু বোঝার আগেই রিয়াজ ওর পেছন থেকে একটা চিকণ তার পেঁচিয়ে ধরে শাহরিয়ারের গলাতে ।
হতভম্ভ ছেলেটার চোখদুটো বড় বড় হয়ে যায় – কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করতে থাকে ও ।
তারপর হাতদুটো আর বাতাসে ছোঁড়া হয় না শাহরিয়ারের । ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে মানুষটা ।

লাফ দিয়ে বিছানাতে উঠে বসে রুহান ।
জামা ভিজে গেছে ঘামে । এরকম ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখার পর ঘামে ভিজে যাওয়ার জন্য নিজের শরীরটাকে দোষ দিতে পারে না ও ।
স্বপ্নে কারও খারাপ দেখলে বাস্তবেও তার কিছু হয়েছে – এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নয় রুহান ।
তবুও শাহরিয়ার অথবা রিয়াজকে ফোন দেয়ার জন্য ওর ভেতরটা আকুপাকু করতে থাকে !
ঘড়ি দেখেই বুঝতে পারে – স্বপ্নকে পাত্তা দেয়ার চেয়েও বড় কাজ আছে ।
সাড়ে নয়টা বাজে । আর মাত্র বিশ মিনিট পরই ক্লাস আছে । ভার্সিটি গেলেই দুইজনের সাথেই দেখা হচ্ছে । স্বপ্নটার কথা বলে বেশ মজা নেওয়া যাবে ওদের সাথে । রিয়াজ শাহরিয়ারকে খুন করে ফেলছে – ভাবতেই হাসি উঠে যায় এখন রুহানের ।
রিয়াজের মত নিরীহ ছেলে দুটো হয় না ।
স্বপ্নের রেশ কেটে গেছে ।
বুলেটের মত গতি নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকে ও বের হওয়ার জন্য । আজ মনে হচ্ছে ক্লাস মিস হয়েই যাবে !
দমকা হাওয়ার মত ক্লাসে ঢুকতে না ঢুকতেই স্যারকেও করিডোরের অন্যপাশ থেকে আসতে দেখা যায় । ইনি আজ তিন মিনিট লেট । নাহলে আজ আর রুহানের ক্লাস করা লাগত না ।
রুহানের চোখ খোঁজে শাহরিয়ারকে ।
নেই তো ক্লাসে ! এমনকী রিয়াজও নেই ।
‘দুই শালাই ক্লাস বাংক মেরেছে’ – মনে মনে ভাবে রুহান । আবার একটা অজানা আশংকাও যে ওকে দোলা দেয় না – এমনটাও না ।
এই সময় হেলেদুলে রিয়াজকে আসতে দেখা যায় ।
‘আসতে পারি ?’ বিনীত ছেলেটা বলে । ও ওরকমই । আপাদমস্তক ভদ্র একটা ছেলে ।
স্যার মাথা ঝাঁকান ।
নিজেই লেট করে ফেলায় হয়ত আজ সময়ানুবর্তীতা নিয়ে লেকচার বের হয় না উনার মুখ থেকে ।
সুড় সুড় করে ক্লাসে ঢুকে রুহানের পাশে বসে পড়ে ও ।
‘দেরী ক্যান ?’ ফিস ফিস করে জানতে চায় রুহান ।
‘আরে ব্যাটা – ল্যাব রিপোর্ট লেখতে গিয়ে রাত হয়ে গেল । উঠতে হয়েছে দেরী ।’ একই ভাবে জবাব দেয় রিয়াজ ।
পকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে ।
বিরক্ত হয়ে বের করে একবার রুহান । সাব্বিরের নাম্বার দেখা যাচ্ছে স্ক্রিণে । এই ছেলে রেগুলার প্রেমে পড়ে । এবং ছ্যাকাও সেই হারেই খায় ।
কিন্তু এই ছেলে শাহরিয়ারের রুমমেট । ফোনটা স্যারের নজর এড়িয়ে রিসিভ করার পেছনে আর কোন যুক্তি ছিল না রুহানের ।
দাঁড়ি-কমা ছাড়াই কথা বলে যায় সাব্বির । গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায় রুহানে – সাব্বিরের কন্ঠে নিখাদ আতংক আর তীব্র বিস্ময় !
‘রুহান – কই তুই ! শাহরিয়ারকে খুন করেছে কেউ । প্লিজ দোস্ত, নদীর ধারে আয় একটু ।’
স্যার অথবা ক্লাসরুমের কারও দিকে একটি বারও না তাকিয়ে বেরিয়ে এসেছে রুহান ।
ছুটছে রীতিমত ।
*
শাহরিয়ারের মৃতদেহটা পড়ে আছে খোলা আকাশের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে ।
পাশ দিয়ে বয়ে চলা পদ্মা নদীটা যেন এদিকে দৃষ্টিও দেয় না । বয়ে চলেছে নির্বিকারভাবে ।
ভার্সিটির সবচেয়ে কাছের বন্ধুর লাশের পাশে দাঁড়িয়েও রুহানের শরীর শিহরে উঠছে শুধু বেদনা আর তীব্র ক্রোধে নয় ।
একই সাথে আতংক, বিহ্বলতা, বিশ্বাসঘাতকতার অনুভূতি ছেয়ে ধরেছে ওকে ।
শাহরিয়ারের গলার চারপাশে বসে গেছে একটা দাগ ।
সরু কিছু দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে ওকে ।
ঠিক কালকের স্বপ্নের মত ।
স্বপ্নে যেটাকে লেক ভেবেছিল সেটা দেখা যাচ্ছে লেক নয় । নদী !
পুলিশের লোকজন চলে এসেছে ।
ঠেলে রুহানকে সরিয়ে দেয় ওরা । এই লাশটা এখন ওদের জিম্মাতেই থাকবে ।
সেদিকে চুপচাপ শুধু তাকিয়ে দেখে রুহান ।
আরও ভয়ানক একটা চিন্তা ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলে ।
খুনীকে ও চেনে !
সদা ভদ্রবেশী রিয়াজ – ভার্সিটিজীবনে ওর আরেকজন কাছের বন্ধু ।
রিয়াজই খুন করেছে শাহরিয়ারকে !

নিজের মেসের দিকে ফিরে যাচ্ছে রুহান ধীরে ধীরে ।
হিসেব মিলছে না ওর । যেভাবে গতকাল স্বপ্নটা দেখেছে সেভাবেই সবচেয়ে কাছের বন্ধুটা খুন হয়ে গেছে ।
যেই পরিবেশে দেখেছে সেই পরিবেশেই ।
তাহলে খুনীর ব্যাপারটা কেন ভুল হবে ? অথচ রিয়াজের মত শান্ত ছেলেই হয় না ।
রিয়াজ শাহরিয়ারকে টোকা মারবে – এমনটাও সম্ভব নয় । তাছাড়া একটু আগে রিয়াজের চোখে পানি দেখেছে রুহান – স্বচক্ষে ।
মায়াকান্না ?
পুলিশ শাহরিয়ারের লাশ নিয়ে গেছে । ওর বাসায় খবর দিয়েছে সাব্বির । শাহরিয়ারের বাবা আসছেন আজ বিকেলেই । পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেল !
রিয়াজ চাচ্ছিল রুহানের সাথে কিছুক্ষণ থাকতে । কিন্তু রাজি হয় নি রুহান । একা থাকতে চেয়েছে একটু ।
রিয়াজের দিকে তাকালেই ওর অনুভূতি হচ্ছে বিষধর কোন সাপের দিকে তাকাচ্ছে !
ও কি সন্দেহ করছে রিয়াজকে ? অথচ, একটা স্বপ্ন বই তো নয় ।
নিজেকে এবার বোঝায় রুহান – কাকতলীয় ঘটনা ছাড়া আর কিছুই না ।
বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছিল ও – সেটার কিছু অংশ মিলে যাওয়ায় লেককে নদী বানিয়ে হলেও সেটাকে মিলিয়ে নিচ্ছে এখন শাহরিয়ারের মার্ডারের সাথে । এ কেবলই ছেলেমানুষী ।
হতে পারে প্রিয় বন্ধুটি মারা গেছে – কিন্তু তাই বলে ওর উচিত না আরেকজন বন্ধুকে কেবলমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে দোষী ভাবা । সেই সন্দেহের জন্মও যখন একটা স্বপ্ন থেকে !
বরং ওর উচিত দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে নিজ হাতে শাস্তি দেওয়া ।
দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে রুহানের ।
শাহরিয়ারের হত্যাকারীকে ও খুঁজে বের করবেই ।
ফোন বের করে কল দেয় সাব্বিরকে ।
*
‘জানিস না মানে ? শাহরিয়ারের সাথে কার কার ঝামেলা ছিল সেটা সবার আগে তোর জানার কথা, সাব্বির । তুই ওর রুমমেট ছিলি ।’ কড়া গলাতেই বলে রুহান ।
‘পুলিশও তাই ভাবছে । কিন্তু শাহরিয়ারের মত ভালো ছেলে হয় – তুই-ই বল ? ওকে মেরে ফেলতে চাবে – এটা তো অনেক পরের কথা – এত মানুষের উপকার ও করেছে, বেশিরভাগ স্টুডেন্টের মাঝেই ওর প্রতি কৃতজ্ঞতা কাজ করে ।’
সাব্বিরের রুমে বসে আছে রুহান । পাশের বেডটাই শাহরিয়ারের ছিল ।
ড্যান ব্রাউনের ‘ইনফার্নো’ বইটা দেখা যাচ্ছে টেবিলে । রুহানই দিয়েছিল ওকে পড়তে ।
জোর করে ওখান থেকে চোখ সরায় ও । ছেলেটার অকালমৃত্যু কোনমতেই মেনে নেয়ার মত নয় ।
তবে সাব্বিরের কথায় যুক্তি আছে ।
ভার্সিটির ছেলেপুলে থেকে রাস্তার ফকির – এমন কেউ নেই যার উপকার করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিল না ছেলেটা । সেই শাহরিয়ারকে এভাবে মেরে ফেলবে এটা কারও পক্ষেই সম্ভব নয় ।
তবুও একটা সম্ভাবনার কথা ভাবে রুহান ।
‘বেশিরভাগ স্টুডেন্ট তো ওর প্রতি কৃতজ্ঞ – সেটা আমিও জানি । আর সেটাই চোখে পড়ে । বেশিরভাগ স্টুডেন্টের ব্যাপারটা চোখে পড়াই স্বাভাবিক । কিন্তু আমি বলতে চাইছি – সংখ্যালঘু কিছু মানুষ থাকতে পারে – ওর প্রতি জীঘাংসা জমিয়ে রেখেছিল এতদিন ? অন্তত একজন !’
‘তা থাকতে পারে ।’ একমত হয় সাব্বির । নাক টানে । কিছুটা সামলে নিয়েছে ও শাহরিয়ারের মৃত্যুর ব্যাপারটা ।
‘আমাদের শাহরিয়ারের প্রতিটা পরিচিত মানুষের ব্যাপাররে খোঁজ নিতে হবে, সাব্বির । কেউ না কেউ বের হবেই – কাওকে পাওয়া যাবেই যার মোটিভ ছিল শাহরিয়ারকে মেরে ফেলার পেছনে ।’
‘হুঁ ।’ মাথা দোলায় শুধু সাব্বির ।
চুপচাপ বসে থাকে ওরা কিছুক্ষণ ।
ওদের মাঝে সবচেয়ে ব্রাইট ছেলেটা নির্মমভাবে খুন হয়ে গেছে – এই সত্য মেনে নেওয়া ওদের জন্য এখনও কঠিন ।
রুহানের এখনই সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে ।
‘শাহরিয়ার কত কত রিপোর্ট লেখতে আমাকে সাহায্য করেছে দোস্ত ।’ গলা ধরে আসে সাব্বিরের, ‘কত রাত জেগে আমার ড্রইং-এ হেল্প করেছে ...’
‘শাহরিয়ার আমার যে কোন সমস্যা শুনলেই একেবারে আমার রুমে চলে আসত । সর্ট আউট না করে যেত না সেই ঝামেলার ব্যাপারে ।’ মৃদু গলায় বলে রুহানও ।
হঠাৎই মাথায় আসে ওর প্রশ্নটা ।
‘শাহরিয়ার গতকাল এত রাতে নদীর ধারে কি করছিল, সাব্বির ? বের হয়েছিল কেন ও ? এটা তোর জানার কথা । রুমমেট মানুষ তোরা ।’
‘ও খুব ডিপ্রেসড ছিল । একটু একা থাকার কথা বলে বের হয়ে যায় কাল রাতে ।’ জানায় সাব্বির ।
‘কি নিয়ে ?’ দম বন্ধ করে জানতে চায় রুহান ।
‘হৃদি । হৃদির বিয়ে ছিল গতকাল ।’
সাব্বিরের কথা শুনে হৃৎপিন্ডটা গলার কাছে উঠে আসতে চায় রুহানের !

প্রতিটা ক্লু মিলে যাচ্ছে ।
স্বপ্নে যা দেখেছে তার সাথে বাস্তবে একটুও অমিল নেই ।
এখন আর অলৌকিক ব্যাপারে অবিশ্বাস করতে পারে না রুহান । কিছু ব্যাপার হয়ত থাকে পৃথিবীতে – যেগুলো ব্যখ্যার অতীত ।
আরও একটা ব্যাপারে অবিশ্বাস নেই আর কোন ।
শাহরিয়ারের খুনী আর কেউ নয় – রিয়াজ ।
*
প্রচন্ড ধাক্কায় প্রায় উড়ে যায় রিয়াজ – পেছনের আমগাছটার সাথে ধাক্কা খায় বেশ জোরেই ।
একেবারে হতভম্ভ হয়ে গেছে ছেলেটা । ওই অবস্থাতেই ওর কলার ধরে রুহান ওকে আবারও তুলে আনে – এবারের ধাক্কাটা সহ্য করতে না পেরে ছিটকে মাটিতে পড়ে যায় রিয়াজ ।
‘হারামজাদা – নিজের বন্ধুকে মেরে ফেললি ? একটা বার মনে পড়ে নি তখন কত ঝামেলায় তোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ওই শাহরিয়ার ?’
‘কি যা তা বলছিস দোস্ত ... তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে ।’ কোনমতে বলে উঠে দাঁড়ায় রিয়াজ ।
‘তুই কি ভেবেছিস – সবার চোখের আড়ালে নিয়ে শাহরিয়ারকে খুন করতে পেরেছিস ? না – একজন সাক্ষী ছিল । একজন সাক্ষী ছিল, যে তোর আর শাহরিয়ারের ব্যাপারটা দেখেছে ।’
শেষ চালটা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে রুহান । রিয়াজের নিজের মুখ থেকে শোনা স্বীকারোক্তি ছাড়া ওর পক্ষে সম্ভব নয় শতভাগ নিশ্চিত হওয়া ।
‘কে দেখবে ? কোথায় দেখবে ?’ অবাক হয়ে জানতে চায় রিয়াজ ।
‘শাহরিয়ারকে যখন খুন করতে গিয়েছিলি নদীর ধারে । আর লুকিয়ে লাভ নেই রিয়াজ । স্বীকার করে ফেল । আমাকে কারণটা বল – শাহরিয়ারের মত একটা ছেলেকে মেরে ফেলতে পারলি কিভাবে তুই !’
‘বাড়াবাড়ি হচ্ছে, রুহান । শাহরিয়ারের ঘটনাতে আমিও আপসেট অনেক । কিন্তু তুই যেটা করছিস সেটা পাগলামী ।’
এখন রিয়াজ নিজেকে বাঁচাতে অ্যাটাকিং কথা বলছে ।
ঝট করে আসল প্রসঙ্গে চলে আসে রুহান ।
‘শাহরিয়ার ওখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল । তোকে ডাক দিয়েছিল । তুই গিয়েছিলি যখন তখনই ও তোকে বলে হৃদির বিয়ের ব্যাপারে । পরক্ষণেই ওর গলাতে তার পেঁচিয়ে ধরেছিলি তুই – একটা বারও সুযোগ দিস নি ওকে বেঁচে ফেরার !’
প্রচন্ড ক্রোধে রুহানের চোখের মনিদুটো ধিকি ধিকি জ্বলে ওঠে ।
‘শাট আপ !’ চেঁচিয়ে ওঠে এবার রিয়াজ । ‘ফালতু কথা বলার একটা লিমিট থাকে,রুহান ! আমার রুমমেটকে প্রশ্ন করে দেখিস আমি কাল রাতে বাইরে ছিলাম না কোথাও ! তোর আজাইরা সাক্ষীকে বল আমাকে যেন ফাঁসানোর চেষ্টা না করে । সত্যকে লুকোতে পারবে না কেউ ।’
রাগে লাল হয়ে থাকা রিয়াজের মুখটার দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলার কোন চিহ্ন দেখে না রুহান ।
একটু আশাভঙ্গ আর অনেকখানি অবাক হয় ও । রিয়াজের ব্যাপারটা স্বপ্নদৃষ্ট কিছু হতে পারে তবে এর তাৎপর্য রুহান জানে ।
যেতে গিয়েও ফিরে আসে রিয়াজ ।
‘আরেকটা কথা – হৃদি নিয়ে আমার ব্যাপারে লাগিয়েছে তোকে তোর সাক্ষী তাই না ? কে ছিল তোর এই সাক্ষী বল দেখি ?’
নিরুত্তর থাকে রুহান ।
রিয়াজের ব্যাপারে আর সন্দেহ করতে পারছে না । এত বড় আপের অভিনেতা রিয়াজ নয় । ও সত্যই বলছে ।
কিন্তু রুহান সত্য বলতে পারবে না । স্বপ্নের ব্যাপারে বললে ওকে পাগল ঠাউরাবে রিয়াজ – এটা নিশ্চিত ।
নাহলে ওকেই ভেবে বসবে শাহরিয়ারের খুনী । চুপ থাকা ছাড়া গতি নেই ।
‘তোকে নাম বললে কি করবি ? ওকেও গিয়ে খুন করে আসবি ?’ রিয়াজের মুখ থামানোর জন্য ওকে আরও একটু ক্ষেপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রুহান ।
‘শোন – তোর কান বেশ ভালোই ভারী করা হয়েছে বুঝতে পারছি । স্বাভাবিক । বেশ বুঝতে পারছি কার কাজ ছিল এটা । নিশ্চয় সাব্বির তোকে বলেছে কথাগুলো ?’
নতুন কিছুর গন্ধ পেতেই কান খাড়া হয়ে যায় রুহানের ।
‘সাব্বির কেন বলবে তোর নামে উলটা পালটা ? ওর কি লাভ এতে ?’ আরেকটু তাল দেয় ও রিয়াজের কথার দিকেই । বাকিটুকু শোনা লাগবে ।
‘কারণ – হৃদি আর শাহরিয়ারের মাঝে ওই হারামজাদাই ঢুকে গিয়েছিল একবার । সেই ব্যাপারে শাহরিয়ারকে ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম আমিই । কাজেই আমার ওপর ঝাল তো থাকবেই ।’
‘বলিস কি ? ’ আর কিছু বলতে পারে না রুহান ।
এই সাব্বিরের সাথেই কি না ও শাহরিয়ারের শত্রু খুঁজছিল !
বাঘের ঘরেই যদি ঘোগ বাসা বাঁধে তাহলে আর কি বলার আছে । তবে সাব্বির ছেলেটার রাগ থাকতে পারে শাহরিয়ারের ওপর – তবে খুন করার মত চরিত্র ওকেও মনে হয় না রুহানের । রিয়াজ ওকে পালটা ধোঁকাও দিতে পারে ।
অবশ্য রিয়াজ আর সাব্বিরের গঠন প্রায় এক । স্বপ্নে দেখার সময় ও রিয়াজই ভেবে দেখছিল । যেহেতু কাছের বন্ধু । তবে সাব্বিরকেও ওই জায়গাতে ফিট করা যায় অনায়াসেই ।
‘সাব্বিরের এই ব্যাপারটা আমি ছাড়া কেউই জানে না । তোকে খুলেই বলি দাঁড়া ।’
রুমমেট সাব্বিরের সাথে হৃদির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল শাহরিয়ার । বন্ধুত্বের চেয়ে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক আর কিছু নেই – এটাই শাহরিয়ারের বিশ্বাস । কিন্তু সাব্বিরের অনুভূতি বাঁকা হয়ে ঘুরে যাচ্ছিল হৃদির দিকে । অন্যরকম ভাবে অনুভব করা শুরু করে সাব্বির । শাহরিয়ার জানত না কিছুই । সাব্বির শুধু জানিয়েছিল রিয়াজকে ।
আর শাহরিয়ারকে জানিয়েছে রিয়াজ ।
তারপর সবকিছু কন্ট্রোলে ফিরিয়ে আনতে শাহরিয়ারের বেশি বেগ পেতে হয় নি অবশ্য ।
ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে অবশ্য ।
সম্ভাব্য খুনীর কাতারে সাব্বিরকে আর না ধরে পারছে না রুহান ।
রিয়াজকে সরি-টরি বলে প্রায় ছুটে চলে ও ।
সাব্বিরের মেসে পৌঁছে ওদের রুমের দরজাতে বড় একটা তালা ঝুলতে দেখে রুহান ।
পগার পার হয়ে গেছে সাব্বির ।

প্রাণপনে ছুটছে সাব্বির ।
পেছনে দ্বিগুন গতিতে এগিয়ে আসছে মৃত্যুদূত ।
আরও জোরে ছুটতে চায় সাব্বির – কিন্তু ফুসফুস ওকে সমর্থন দেয় না মোটেও ।
ছোট ছোট লতায় পা বেঁধে আছড়ে পড়ে একবার ও । তারপর আবার উঠে দাঁড়ায় – হেরে গেলে চলবে না ওর ।
কোনমতে রাস্তাতে ফিরে যেতে পারলেই বাঁচে এখন ।
শাহরিয়ারের খুনের পরই ওর সাবধান হওয়া উচিত ছিল । রিয়াজও হৃদিকে ভালোবাসত – অজানা নয় সাব্বিরের ।
তবুও গাধার মত রাত সাড়ে এগারটায় কোন যুক্তিতে ও রিয়াজের সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছিল – জানে না ও ।
রাতের নদী শান্ত ।
তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল রিয়াজ । ওর পাশে গিয়ে জানতে চায় সাব্বির শুধু, ‘শাহরিয়ারের ব্যাপারে তোর মন খারাপ, না রে ? আমারও ।’
রিয়াজ মৃদু হেসে ফিরে তাকায় । ওর হাসিতে পৈশাচিক একটা আভা ।
‘শাহরিয়ারকে আমি আমার ভালোবাসাকে দিয়ে দিয়েছিলাম – সাব্বির । আমাকে হৃদি পছন্দ করত । নিজের ভালোবাসা বন্ধুকে উৎসর্গ করেছিলাম আমি ।’
‘আমি জানতাম না দোস্ত ।’ ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল সাব্বির, ‘সেই হৃদিরও বিয়ে হয়ে গেল । খুবই দুঃখজনক রে ।’
একেবারেই হঠাৎ হাত চালায় রিয়াজ, ‘হারামজাদা ! নিজে সব ঝামেলা বাঁধিয়ে এখন জানা অজানা দেখাচ্ছিস ? হৃদির হুট করে বিয়ে হয়ে গেল কেন সেটা তোর চেয়ে ভালো কে জানে ?’
নিজের নাক চেপে ধরে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সাব্বির । মুখ থামে না রিয়াজের, ‘হৃদির জন্য একেবারে পাগল হয়ে উঠেছিলি । নিজের বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড – তার দিকে নজর দিয়েছিলি শালা !’
‘হৃদির বিয়ের ব্যাপারে আমার কি করার ছিল ?’ বিড় বিড় করে জানতে চায় সাব্বির ।
‘হৃদির বাবার কাছে নোংরা ওই চিঠিগুলো কে পাঠিয়েছিল ? তোকে কেটে কুত্তা দিয়ে খাওয়ানো উচিত হারামজাদা !’
চুপ হয়ে যায় সাব্বির এবার । রিয়াজ চিঠির কথা জানল কিভাবে ?
‘যত দ্রুত সম্ভব নিজের মেয়েকে রক্ষা করতে বিয়ে দিয়ে দিলেন হৃদির বাবা । ভার্সিটির মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে শাহরিয়ার – ও কি করতে পারল ঠেকাতে বল ? আমার নিজের ভালোবাসাটা বন্ধুর জন্য ছেড়ে দিলাম তুই সেটার মর্যাদা রাখতে দিলি না !’
সাব্বিরের গলা এবার শুকিয়ে যায় ।
রিয়াজের হাতে একটা চকচকে ছুরি বেরিয়ে এসেছে !
ঘুরে দাঁড়িয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে প্রাণটা হাতে করে ছুট লাগায় সাব্বির ।
এগিয়ে আসছে পদশব্দ ।
প্রায় দশ মিনিট ধরে ছুটছে ওরা । এই পোড়া শহরে রাত দশটার পরই চারপাশ নির্জন হয়ে যায় – একটা মানুষ চোখে পড়ে না সাব্বিরের ।
সামনের হাঁটু সমান উচ্চতার প্রাচীরটা চোখেই পড়েনি ওর অন্ধকারে ।
হাঁটুর সামান্য নিচে ধাক্কা লাগতেই বাতাসে ভেসে যায় সাব্বির । মুখ থুবড়ে পড়ে – তাজা ঘাসের গন্ধ পায় নাকে ।
পেছন থেকে ওর চুল মুঠি করে ধরে কেউ ।
একটা হাত ওর গলার নিচে চলে আসে নিমেষেই – কচ করে শব্দটা ওর নিজের গলা কাটার – শুনেও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না সাব্বির !
পরমুহূর্তেই অসীম যন্ত্রণার চাদরে ঢাকা পড়ে যায় ছেলেটা ।
নিস্ফল হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ির মাঝে ঘড় ঘড় শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা যেন আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে !
*
গড়িয়ে বিছানা থেকে পড়ে গেছে রুহান ।
ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছে ।
হাত ঘড়িটা দেখে । সকাল দশটা বাজে ।
আরেকটা দুঃস্বপ্ন !
দ্রুত সাব্বিরের নম্বরে ডায়াল করে ও । ফোন বেজেই চলে । ধরে না কেউ ।
ঘুম ভাঙ্গার কারণটা হঠাৎই বোঝে ও । দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে ।
দরজাটা আস্তে করে খুলতেই রিয়াজের পরিচিত মুখটা দেখতে পায় ও ।
একটা উদভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকায় রিয়াজ ।
এক পা পিছিয়ে যায় রুহান । এই ছেলে ভয়ানক জিনিস । চোখ ঘুরিয়ে ঘরে আত্মরক্ষার মত কিছু খোঁজে ও ।
সেরকম কিছু নেই তো ! নিজেকে বেশ অনিরাপদ মনে হয় রুহানের ।
রিয়াজের পেছনে ঘরটায় ঢুকে পড়েন একজন পুলিশ অফিসার ।
হাতের হাতকড়াটা রুহানের দিকে বাড়িয়ে দেন তিনি, ‘ঝামেলা চাই না আমরা, ছেলে ।’
‘কি হচ্ছে, রিয়াজ ?’ ফিস ফিস করে জানতে চায় রুহান ।
সবাই চুপ করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে ।
নিজের ফুলহাতা শার্টের হাতের দিকে নজর পড়ে রুহানের ।
রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে ওখানে !

হাত মুখ ধুয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে রুহান ।
আশেপাশে বেশ কয়েকজন মানুষ । সাদা ইউনিফর্ম পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
নিজের দিকে তাকায় ও । একই ইউনিফর্ম ওর গায়েও ।
ওর পাশ দিয়ে যেতে যেতে আৎকে ওঠে একটা ছেলে, ‘নিজের দুই বন্ধুকে খুন করেছ তুমি ! জানি ! দূরে থাকবে আমার থেকে ! বোঝা গেছে ?’
আরও কি কি জানি বলে ছেলেটা । বোঝা যায় না ঠিক । অনেকে এদিকে ফিরে তাকায় । আরও দূরে সরে যায় ওরা রুহানের কাছ থেকে ।
এখানে সবাই রুহানকে এড়িয়ে চলে। এটা একটা স্বস্তি ।
পাগল মানুষ ছাড়া কেউ তো থাকে না এখানে । পাগলাগারদের এসব বদ্ধ পাগল থেকে দূরে থাকাতেই স্বস্তিবোধ করার কথা যেকোন মানুষের ।
‘এমনকী আমার মত খুনী পাগলেরও !’ বিড় বিড় করে বলে রুহান ।
ড. মারুফ হায়দারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে ওকে এখন । প্রতি সপ্তাহের এই সময়টা ওর জন্য ড. মারুফের ভিজিটিং আওয়ার ।
কঠোর মুখে তাকিয়ে থাকা গার্ডের দিকে এগিয়ে যায় ও ।
সতর্কদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ওকে ডক্টরের রুমের দিকে নিয়ে যেতে থাকে গার্ড ।
এই ওয়ার্ডটা প্রায় সুস্থ পাগলদের জন্য । এরা মোটামুটি নিরাপদ এখন । কাজেই একটু ঘোরাঘুরির সময় পায় ওরা । হাতে পায়ে বেড়ী নিয়েও বসে থাকতে হয়েছে ওকে কয়েক মাস । সেইসব দুঃসহ স্মৃতি ভোলার নয় ।
সামনের ভারী দরজাটা খুলে গার্ড ওকে নিয়ে বের হয়ে আবারও আটকে দেয় ।
এখন রুহান সুস্থ মানুষের দুনিয়ায় ।
ডক্টরের রুমটা বেশি দূরে নয় এখান থেকে ।
*
‘সুখবর আছে তোমার, রুহান ।’ হাসিমুখে ওর দিকে এগিয়ে আসেন ডক্টর মারুফ ।
চুপ করে তাকিয়ে থাকে রুহান । ওর জীবন একরকম ধ্বংস হয়েই গেছে । আর কোন সুখবর দিতে চান ডক্টর ওকে ?
‘তুমি আজকেই ছাড়া পাচ্ছ এখান থেকে ।’ ডক্টরের মুখ থেকে বের হওয়া এই বাক্যটা বের হওয়ার পরও বিশ্বাস করতে পারে না রুহান !
‘স্যার !’
‘হুম, তোমার কন্ডিশন দেখে আমি একমাস আগেই নিশ্চিত ছিলাম সম্পূর্ণ সেরে গেছে তোমার মানসিক সমস্যা । তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটা মাস পর্যবেক্ষণ করতেই হল । তবে আজ আর কোন বাধা নেই, রুহান । তুমি আজই বাড়ি ফিরে যেতে পারবে !’
আনন্দে লাফ দিয়ে সিলিং স্পর্শ করার ইচ্ছে হয় রুহানের ।
মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়ার জন্য ওর ফুসফুস পাগল হয়ে আছে গত দেড় বছর ধরেই ।
হাত তুলে টেবিলের ওপর রাখে ও । কিছু প্রশ্নের জবাব জানা দরকার ।
‘আমার রোগের ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন প্লিজ ? বেশ আইডিয়া আছে । তবে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল ।’
‘তোমার রোগটা খুবই রেয়ার কেইস, রুহান । নিজের দুটো কনশাস ছিল তোমার । একটা স্বাভাবিক তুমি – অপরটা ভয়ানক । ওই দ্বিতীয় ধরণের সত্ত্বাটা যখন অ্যাকটিভ থাকে – সজ্ঞানেই তুমি অনেক কাজ করতে পারো – সাবকনশাস-কনশাস মাইন্ডে । কিন্তু প্রথম সত্ত্বা তোমার সেসব কাজকে কেবল ঘুমের মাধ্যমেই প্রেজেন্ট করে ।’
‘এটুকু আমি বুঝেছি, স্যার । এর মানে – শাহরিয়ার আর সাব্বিরের...’ চুপ হয়ে যায় রুহান । নিজের বন্ধু দুইজনকে নিজেই খুন করে ফেলার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয় ।
‘হুম । ওদের হত্যা করেছিলে তুমি । এটা মেনে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে রুহান । তবে স্বাভাবিক তুমি এই কাজটা করনি । ওটা তোমার একটা রোগের আউটপুট । তবে এটাকে নিজের মাঝে চাপা দেয়াই ভালো । আজই শেষ খোলাখুলি আলাপ করে নাও আমার সাথে । প্রশ্ন রাখতে নেই । পরে খোঁচাবে ।’
‘বলছিলাম, ওদের খুন করে আমি আবারও ফিরে আসতাম আমার রুমে । বেঘোরে ঘুমাতাম । এটাই হয়েছিল, তাই নয় কি ?’ নিশ্চিত হতে চায় রুহান ।
‘বেঘোরে নয় শুধু । স্বপ্নহীন সেই ঘুম । যেটা বাস্তব জীবনে করে এসেছ সেটাকেই স্বপ্ন হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করত তোমার মস্তিষ্ক – ঘুম ভাঙ্গার পরই ।’
‘নিজের করা কাজগুলোতে রিয়াজকে দেখতাম কেন ?’ জানতে চায় রুহান ।
‘কারণ, নিজেকে রক্ষা করতে একটা খোলস দরকার ছিল তোমার মস্তিষ্কের । রিয়াজকেই সেই খোলস বানিয়েছিল তোমার অজান্তেই ।’
চুপ হয়ে গিয়ে মাথা দোলায় রুহান । মুখ বেদনায় নীল হয়ে আছে ।
‘আমার জীবনের ব্যাপারে সব বলেছি আপনাকে – শাহরিয়ারকে আমার সাবকনশাস-কনশাস মাইন্ড কেন খুন করল বলতে পারবেন ? নিজের সাইকোলজিও আমি বুঝতে পারছি না, স্যার । এই প্রশ্নটা আমাকে সারা জীবন খোঁচাবে । তবে আপনি পারবেন এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে ।’
কিছুক্ষণ ভাবেন ড. মারুফ, তারপর তাকান গোল্ডরীমের চশমার ভেতর দিয়ে ।
‘শাহরিয়ারকে তুমি উপহার দিয়েছিলে নিজের ভালোবাসা হৃদিকে, রুহান । হৃদিকে তুমি ওর দিকে ডাইভার্ট করে দিয়েছিলে হৃদির আর শাহরিয়ারের সুখের কথা ভেবেই । শাহরিয়ার ছেলেটা ভালো ছিল । তোমার বন্ধু ছিল । এটাও একটা জোর কারণ তোমার স্যাক্রিফাইসের । কিন্তু যখন শাহরিয়ার হৃদিকে নিজের করে নিতে পারে নি – সব ক্রোধ তোমার গিয়ে পড়ে শাহরিয়ারের ওপর ।’
মাথা দোলায় রুহান, ‘আপনার ব্যাখ্যায় যুক্তি আছে । সেজন্যই রিয়াজের মুখে সেদিন সাব্বিরের দুষ্কর্মের কথা শুনে ইমিডিয়েট অ্যাকশানে যায় আমার সাবকনশাস-কনশাস মাইন্ড । রিয়াজের সাথে সেদিন কথা না বললে আজ বেঁচে থাকত সাব্বির !’
মাথা নামায় রুহান ।
রিয়াজের প্রসঙ্গে মন খারাপ হয়ে যায় ড. মারুফের । তবুও স্বান্তনা দেন তিনি রুহানকে । ছেলেটার ওপর অনেক ধকল গেছে এমনিতেই ।
‘ভুল ভাবছ তুমি, রুহান । রিয়াজকে স্বপ্নের মত করে তোমার ব্রেইন তোমার কনশাস মাইন্ডকে উপস্থাপন না করলে হয়ত আরও খুন করত তোমার ওই সত্ত্বা । কারণ, ওই একটা ব্যাপারেই আসল তুমি রিয়াজকে সন্দেহ করে চার্জ কর ওকে । সেখান থেকেই তোমার প্রতি সন্দেহ জন্মে রিয়াজের ।’
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে ঘরটা ।
তারপর উঠে দাঁড়ান ড. মারুফ ।
‘তোমার সুস্থতা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে, রুহান । ভয়ানক এই স্মৃতি ভুলে যেতে পারবে তুমি – বিশ্বাস রাখতে পারো আমার কথায় । ব্যাস্ততায় ডুবিয়ে ফেল নিজেকে । আর -’ একটু বিরতি দেন তিনি, ‘-মুক্ত জীবন উপভোগ কর ।’
‘আমার সুস্থতার ব্যাপারে আমিও বেশ নিশ্চিত হয়ে উঠেছিলাম, স্যার ।’ হাসিমুখে বলে রুহান, ‘তিনদিন আগে সকালে উঠে মনে হচ্ছিল স্বপ্নে দেখলাম রিয়াজকে ছাদ থেকে ফেলে দিচ্ছি । অথচ আর কোন অঘটন ঘটানো আমাকে দিয়ে সম্ভব তো নয় । আমি এই অ্যাসাইলামেই ছিলাম । কাজেই এমন কিছু আমি করি নি । অর্থাৎ স্বপ্নগুলো এখন কেবলই স্বপ্ন । কি বলেন, স্যার?’
ড. মারুফ রুহানের হাসির সাথে যোগ দেন না ।
তাঁর চোখে একটা বিহ্বল দৃষ্টি ।
‘রিয়াজ তিনদিন আগে ওদের বাসার ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে, রুহান ।’ ফিস ফিস করে বলেন তিনি, ‘তুমি মাত্র বের হতে যাচ্ছিলে – তোমাকে খবরটা দিয়ে ভড়কে দিতে চাই নি ।’
নিজের প্রতি তীব্র একটা আতংক চারপাশ থেকে রুহানের অস্তিত্বকে গ্রাস করে ।
ঘোলা চোখে ও চেয়ে থাকে ড. মারুফ হায়দারের দিকে ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.