নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেই কাজ তো খই ভাজ

বসে আছি পথ চেয়ে....

চিররঞ্জন সরকার

চিররঞ্জন সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

দৌড় দৌড় দৌড়

১১ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ৯:০৬



উসাইন বোল্ট, কার্ল লুইস কিংবা বেন জনসনের দৌড় নয়, আমাদের জীবন কাটে অন্য এক দৌড়ের মধ্যে। এর নাম জীবনের দৌড়। এ দৌড়ে ক্লান্তিহীন আমরা লড়েই চলেছি। যদিও এর কোনো স্বীকৃতি নেই। আমরা সবাই কম-বেশি দৌড়ে অভ্যস্ত। জন্মগ্রহণের পর প্রথম কয়েকটা বছর কোলে-দোলনায় ট্যাঁ ট্যাঁ। তারপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে আরো কিছুদিন। তারপর শুধু দৌড় আর দৌড়। কবর কিংবা চিতায় না যাওয়া পর্যন্ত কিংবা প্যারালাইজড হয়ে চিৎ হয়ে না পড়া পর্যন্ত দৌড় চলতেই থাকে। সে দিক থেকে আমরা প্রত্যেকেই একেকজন ছোট-খাটো উসাইন বোল্ট।

যদি বলি দৌড়ানোর জন্য মানুষের জন্ম হয়েছে- তাহলে ভুল বলা হবে না। পা-হীন ব্যক্তিও গড়িয়ে গড়িয়ে অথবা কৃত্রিম কাঠের পা-লাগানো ব্যক্তিও লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ায়। মানুষ নানা কারণে দৌড়ায়। কুকুর বা ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে, ডাকাতের ভয়ে, উত্তেজিত জনতার ধাওয়া খেয়ে, প্রতিপক্ষের তা-বে ভীত হয়ে, পুলিশের প্যাদানি এড়াতে কিংবা নিদেন পক্ষে আপন স্ত্রীর রুদ্রমূর্তি দেখে কিংবা স্বামীর অসুর আচরণের মুখে। জীবনে একবারও দৌড়ায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ছোটকালে যখন স্কুলে স্বাস্থ্যবিভাগের লোকজন সাদা অ্যাপ্রোন পড়ে টিকা দিতে আসতো তখন আমরা সেই টিকা-বিভীষিকা থেকে রেহাই পেতে দল বেঁধে মাইলের পর মাইল দৌড়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতাম। সেই দৌড়ের স্মৃতি আছো অম্লান।

আগে এলাকায় এলাকায় স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ঈদ ইত্যাদি বিশেষ দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে নানা রকম প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। এর মধ্যে একটা ‘অনিবার্য’ আইটেম ছিলো দৌড় প্রতিযোগিতা। সে সব প্রতিযোগিতায় আমরা অনেকেই অংশগ্রহণ করেছি। সে সব প্রতিযোগিতার মর্মবাণী ছিল-বিজয়ী হওয়া নয়, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাটাই বড় কথা। সেই মর্মবাণী আমাদের জীবন চলার পথে পাথেয় হয়ে রয়েছে। আমরা জীবনের নানা ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছি, এখনও করছি। সাফল্য খুব একটা আসেনি। তাতে কী? অংশগ্রহণই যে বড় কথা!

ছোটকালে উল্টো দৌড় বলে এক রকম দৌড় প্রতিযোগিতা ছিলো। সেখানে উল্টে দিকে দৌড়ানো হতো; ব্যাপারটা খুবই আমোদজনক, ইন্টারেস্টিং (একই সাথে বেশ প্রতীকীও। আমাদের রাজনীতিকরা যেন সব সময় এই প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী। দেশটাকে উল্টেদিকে পৌছে দিতে তাদের জুড়ি নেই)। এ দৌড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিৎপটাৎ হয়ে পড়ে যেতো প্রতিযোগিরা। অনেক সময় পুরস্কার দেবার মতও কাউকে পাওয়া যেতো না। এর জন্য উদ্যোক্তারা এ প্রতিযোগিতাটাকেই গুরুত্ব দিতেন বেশি।

আমরা যারা জীবনের মধ্য গগণে বা পড়ন্ত বেলায় অবস্থান করছি, তারা অনেকেই এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে রয়েছি। যেন বুনো ষাঁড় বা পাগলা কুকুর তাড়া করছে। সবাই দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হযে ছুটছি। শুধুই ছুটছি। এ ছুটে চলা সাধারণ অর্জনের জন্য। অসাধারণের জন্যও। শিক্ষা, চাকরি, প্রতিষ্ঠা সব কিছুর জন্য দৌড়। প্রবল বেগে ছুটে চলা। সাধারণ শিক্ষায় আস্থা নেই, দ্রুত ভাল শিক্ষার জন্য তাই ইংরেজি মিডিয়াম। কষ্ট করে পরিশ্রম করে বড়লোক হবার ইচ্ছা নেই, তাই ডাকাতি, লুটপাট করে দুই-নম্বরী পথে রাতারাতি বড়লোক হবার ইচ্ছা। পাঁচ বছর বিরোধী দল হিসেবে বসে থাকা প্রাণে সয় না। তাই হরতাল, অবরোধ, মানি নাÑ করে ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতারোহণের সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়ায় মন ভরে নাÑতাইতো উত্তরপাড়া, রাতের অন্ধকার, ষড়যন্ত্র, আঁতাত। বাবা-মা কবে বিয়ে দেয় সেই ভরসায় বসে না থেকে সময়ের আগেই ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ বলে হুট করে কারুর সথে সেঁটে যাওয়া। এভাবে ঘন্টায় একশ’,দুশ’, তিনশ’ কিলোমিটার বেগে বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাপনের গতি। এটা গতি, অগ্রগতি, প্রগতি না-কি অধোগতি সেটা আল্লাহ মালুম।

এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের সমাজটা দ্রুত বদলাচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে তত পরিবর্তনের গতি বাড়ছে। আর পরিবর্তনের নিয়মে তার ছন্দও বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে নিয়ম-কানুন-মূল্যবোধ-সংস্কৃতি সব কিছু। মহাভারতের উপদেশমূলক গল্পের নির্যাসÑ যে বসে থাকে তার ভাগ্যও বসে থাকে, যে শুয়ে পরে তার ভাগ্যও শুয়ে পড়ে, যে এগিয়ে চলে তার ভাগ্যও এগিয়ে চলে-অতএব এগিয়ে চলো! দৌড়াও।

এই দৌড়ের উন্মাদনায় আমাদের আর হুশ নেই। জীবন পালটে গেছে। জীবিকা বদলে গেছে। লেখাপড়া হচ্ছে এখন বোগাস! ছাত্র রাজনীতি হয়েছে পেশা। কলম নয় পিস্তল-বন্দুক-কাটা। অধ্যয়ন নয় হল দখল, পাহারা, চাঁদা-টেন্ডার ভাগবাটোঁয়ারা। হাতে বই নয়- মোবাইল, অটোমেটিক অস্ত্র, গাড়ির হুইল। পুষ্টিকর খাদ্য নয়Ñ হুইস্কি-মদ-গাঁজা-ইয়াবাই পরম পুষ্টি। শিক্ষকরাও এখন রঙ-বাজ। লাল-নীল-সাদা দলে বিভক্ত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবই আছে; নেই ক্লাস, প্রকৃত জ্ঞান চর্চা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন। আছে বক্তৃতা স্লোগান, উত্তেজনাÑ‘যে কোন মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশংকা।’ সমুদ্রের চরের মত অল্প কিছু ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। আমলা-মন্ত্রী-ব্যবসায়ীদের সন্তানরা সেখানে লেখাপড়া করে। তারপর সোজা বিদেশে। এরা উপরে উঠবে হু হু করে। আলাদা সমাজ তৈরি হবে। এরা কন্ট্রোল করবে আর্থনীতি। তৈরি করবে রাজনীতি-কৃষ্টি-কালচার। যে কালচার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠবে টিভি পর্দায়, জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের কলামে।

এখন চটজলদির যুগ। সিঁড়ি নয় লিফ্ট। লন্ড্রির বাইরে আজকাল লেখা থাকে-এক ঘন্টায় আড়ং ধোলাই ও ডেলিভারি। সমস্ত অফিস কম্পিাউটারাইজ। মিনিটে চেক ক্লিয়ার। ম্যারেজ রেজিষ্ট্রির অফিসে পাঁচ মিনিটে বিয়ে। সাত মাসেই সিজারিয়ান বেবী। এক মিনিটে কালার ফটো। ইনস্ট্যান্ড কফি, ফাস্ট ফুড। হিট অ্যান্ড রান। ধরো আর মারোর যুগ। ঝোঁপে-ঝাড়ে আবডালে এখন আর অভিসারে যেতে হয় না। রিকশাতেই দ্রুত ‘শরীর চর্চা’ পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া হয়। ঢাকা শহরে এখন হুট-তোলা রিকশার দিকে তাকানো যায়না। আমরা ব্যাকডেটেডরা লজ্জা পাই। এখন গাইড বইয়ের নাম দেয়া হয়Ñ‘টাচ অ্যান্ড পাশ’ । সবাই এখন ‘মেইড-ইজি’ খোঁজে। সব কিছু যত দ্রুত সম্ভব শেখা-বোঝা-গেলা যায় ততই মঙ্গল।

আমাদের চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। সবাই ছুটছে, সবাই ফাস্ট হতে চায়। শুধু চলা, ছুটে চলা। এখনকার সিনেমা বড় জোর দেড় ঘন্টার। এক-দুই মিনিটের ভিডিও ক্লিপিংস জনপ্রিয় হচ্ছে। টেস্ট ক্রিকেটে মানুষের আগ্রহ কম। ওয়ানডেও এখন দর্শক টানতে পারে না। টি-টুয়েন্টিতে দর্শকের উপচে পড়া ভিড়।

দৌড়, দৌড় এবং দৌড় দিয়ে আমাদের যে জীবন সাজানো হয়েছে সেখানে রয়েছেÑমোবাইল-ইন্টারনেট, থ্রিজি, বিজ্ঞাপন-মিডিয়া-কম্পিউটার-স্যাটেলাইট ইত্যাদি। এ যেন শহুরে মেয়ের রূপ। বাইরে বর্ণের বাহার আছে, কিন্তু ভেতরে সৌন্দর্যের প্রলেপ নেই। মেকআপটুকু বাদ দিলে রক্তশূন্য ‘বাইলা’ মাছ। এ রূপের তেজ নেই, মমতা নেই, লাবণ্য নেই উস্কানিটুকু ছাড়া।

এই ‘ভারচুয়াল’ ছায়া-জীবনে আমরা সেকেলেরাও দৌড়ের মধ্য দিয়েই চলছি। অথচ জায়গা মতো পৌঁছতে পারছি না। আরো জোরে আরো জোরে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পেছনের জনের ল্যাং খেয়ে ধরাশায়ী হতে হচ্ছে। তখন মওকা খুঁজছি আমার সামনের জনকে ল্যাং মারার!

সমৃদ্ধি, অর্থ, খ্যাতি, যশ, ক্ষমতা, রূপসী স্ত্রী, নধর সন্তান সব কিছুর জন্য রুদ্ধশ্বাসে আমরা দৌড়ে চলছি। যেন এ দৌড়ের শুরু আছে, শেষ নেই। জীবনের এ পর্বে এসে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে বলতে ইচ্ছে করে-

‘যাহা চাই তাহা পাই না, যা পাই/হারাই কপাল দোষে।/মুঠো করে যত চেপে ধরি এই/জীবনটাকে,/পথের ধুলায় ছিটাইয়ে যায়/হাতের ফাঁকে।/চাই ধন জন স্বাস্থ্য শান্তি,/অভাবে পাই-/রুগণ পত্নী, মুর্খ পুত্র/ গোঁয়ার ভাই’ (যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত)!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.