নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। ইহা ক্ষুধা উদ্রেক করে!

হঠাৎ ধুমকেতু

আমি মহিউদ্দিন খালেদ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে ভালোবাসি। নিজের একটা চিন্তা জগত আছে। সেখানে চারপাশের অনেক কিছু নিয়ে অনেক নিঃশব্দ আলোচনা হয়! সেই আলোচনা গুলোর সাথে বৃহত্তর জগতের সংযোগ ঘটাতে ইচ্ছে করে!

হঠাৎ ধুমকেতু › বিস্তারিত পোস্টঃ

আঁহুশ দের সুষম জগত!

০৭ ই এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১২:১৩



অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হয়ে গেল। কিচেনে একটা ডেকচি তে বাসন ধোয়ার পানি, আরেকটা ডেকচিতে খাবার পানি ছিল। আমি ভুল করে বাসন ধোয়ার ডেকচির পানি ফিল্টারে ঢাললাম। স্ত্রী বলল, তোমার কি আক্কেল বলে কিছু নাই? ময়লা পানি কি মনে করে ফিল্টারে ঢাললা?

অফিসে সারাদিন খুব কাজের চাপ ছিল। বসের দেয়া ‘আক্কেলের খোঁটা’ বাধ্য হয়ে সহ্য করেছি। বাসায় এসেও আক্কেলের খোঁটা? আর সহ্য হল না। ধমাদ্দম লাথি!হাতের ডেকচিটা মেঝেতে ফেলে সেটার উপর ধমাদ্দম লাথি মারতে লাগলাম! আমার চার বছর বয়সী মেয়ে স্তব্ধ বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই ‘ফুটবলার’ বাবাকে সে আগে কখনো দেখেনি!

ঝগড়া পর্বের পরবর্তী ধাপ হচ্ছে গভীর মন খারাপ পর্ব। এই পর্বে দুটি একাকী মন ঘণ্টা দুয়েক নিঃশব্দ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে নিজেদের সেটল ডাউন করে। তারপর ভালোবাসার ‘নিঃশব্দ দেবদূত’ যেকোন একজনের মুখ দিয়ে কথা বলে উঠে- সরি ডিয়ার! তারপর শুধুই পুষ্পের ঘ্রাণ। শুধুই প্রজাপতির উড়াউড়ি!

গভীর মন খারাপ পর্বে সচরাচর বসার ঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে সোফার উপর চুপচাপ শুয়ে থাকি। আজকেও তাই করলাম। দু’চোখ বন্ধ করতেই আমার মনে হতে লাগল আমি একটা ভারবাহী পশু ছাড়া আর কিছু নই। সংসারের ভারী বোঝা টানার কারনে একটা পাশবিক মার্কেট ভ্যালু হয়ত আমার আছে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও কোন মানবিক আবেগ আমার জন্য অবশিষ্ট নাই। কি অন্তঃসার শূন্য জীবন! আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আত্নহত্যা করব। কোন এক রাত্রিবেলা অফিস থেকে বাসায় না ফিরে রেল লাইন ধরে সোজা চলে যাব নির্জন কোন স্থানে। একটা বিশাল ট্রেন ঝম ঝম শব্দে ছুটে এসে আমার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে চলে যাবে। আমার কথায় বা আচরনে কষ্ট পেয়ে এই পৃথিবীতে কাউকেই আর মন খারাপ করে বসে থাকতে হবে না।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সুবর্ন এক্সপ্রেসে আত্নহত্যা করব। ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে সবচেয়ে পাংচুয়াল ট্রেন সুবর্ন এক্সপ্রেস। রেল লাইনের উপর আমাকে দীর্ঘসময় খামোকাই বসে থাকতে হবে না। আমি কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম, অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে দুটো রেল লাইন। চারদিকে কোথাও কোন জনমানব নেই। আমি রেল লাইনের উপর দুপা ছড়িয়ে মাথা নিচু করে বসে আছি। স্টেশনে ঘন্টির শব্দ আর ট্রেনের ঝম ঝম শব্দ মিলে মিশে একাকার। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রতি আমার সমস্ত অভিমানের জবাব হয়ে আমার দিকে দ্রুত ধেয়ে আসছে সুবর্ন এক্সপ্রেস।

আমার কল্পিত মৃত্যু দৃশ্যের সাথে আমার মন অনেকটাই মিশে গিয়েছিল। কোন একটা মুহুর্তে আমার সত্যি সত্যি মনে হল ট্রেন টা আমার গায়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। ভারী অন্ধকারের আস্তরণ যেন একটার পর একটা আমার উপর খসে পড়ছে। সেই আস্তরণ গুলো মিলে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে বিশাল একটা কাল গোলক। সেই কাল গোলকের ভেতরকার ঘন কাল তরলের উপর আমি অসহায় ভাবে সাঁতার কাটছি। কাল গোলকের ভেতর নিজের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে না পারলেও আমি অনুভব করতে পারছিলাম আমি গোলকের দেয়াল থেকে ক্রমশ কেন্দ্রের দিকে সরে যাচ্ছি এবং কেন্দ্রে পৌছলে জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি জগত পার হয়ে আমি পুরাপুরি মৃত্যুর জগতে পৌঁছে যাব। সেই মুহুর্তে আমি উপলব্ধি করলাম মৃত্যুটা আসলে অত ভয়ঙ্কর কিছু নয়। এটা একটা ট্রানজিশন। একটা মাত্রিক পরিবর্তন। এতে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি প্রশান্ত মন নিয়েই মৃত্যু কেন্দ্রের দিকে এগোতে লাগলাম।

হঠাৎ করে মনে হল আমার পাশে কেউ আছে! এই ‘কেউ’ টার আমি কোন স্পর্শ পাচ্ছিনা, গন্ধ পাচ্ছিনা অথবা তার কোন আওয়াজ শুনছি না। কিন্তু সে আছে। যেন একটা নিঝুম নিস্তব্দ ছোট্ট আয়তন, তার আশেপাশে নিঃশব্দ তরঙ্গ ছড়িয়ে যাচ্ছে-আমি আছি! সেই নিঃশব্দ তরঙ্গটাই একসময় আমার ট্রানজিশন স্তরে থাকা মস্তিষ্ক কে বলল- আমি দ্রাহ্নুশ। তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?

দ্রাহ্নুশ। ছোট্ট একটা শব্দ। কিন্তু সেই ছোট্ট শব্দটা আমাকে আমার ক্ষুদ্র জীবনের এমন একটা অধ্যায় কে মনে করিয়ে দিল যে অধ্যায়টাকে আমি সবচেয়ে ভাল বাসতাম। আমার উনচল্লিশ বছরের জীবনটা যদি একটি আংটি হয় তাইলে আমার ‘চার কার্যকরি বছরে’র বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সেই আংটির লকেট। আমার মনে হল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল সাদা দালান গুলো বিষণ্ণ মুখ করে কাল মৃত্যু গোলকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এবং সেই বিল্ডিং গুলোর কেন্দ্রে আছে আমার নজরুল ইসলাম হল। নজরুল ইসলাম হলের পাশে বিশাল ইউক্যালিপ্টাস গাছ। সেই ইউক্যালিপ্টাস গাছের একটা পাতাও নড়ছেনা। বিষণ্ণ মনে মৃত্যু গোলকের কেন্দ্রের দিকে যেতে যেতে আমি আজ থেকে প্রায় সতের বছর আগেকার আমার নজরুল ইসলাম হলের একটা বর্ষাদিনের বিকেলে ফিরে গেলাম।

সাতান্নবুই সালের জুন মাসের একদিন। মাঝরাত থেকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সকালে নাস্তা করতে বেরিয়ে দেখি হলের উঠানে প্রায় হাঁটু পানি। আমার রুমে সিগারেট আর বিস্কুট ছিল। কাজেই হাঁটু পানিতে না নেমে আবার রুমে ফিরে আসলাম। ক্রিম বিস্কিট পাঁচ ছটা খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরালাম। আমার রুমমেট রা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে আমার চোখের সামনে দিয়ে ক্লাস করতে চলে গেল! ‘সামান্য বৃষ্টির কারনে ক্লাস না করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে রুমে বসে থাকা’, আমার এইসব পাগলামি এখন আর ওদের মনে প্রশ্ন তৈরি করেনা।

রুমের পুর্ব দিকের জানালা খোলা। রুমে একা হয়ে আমি বৃষ্টি পড়ার দৃশ্যে মনোনিবেশ করলাম। বৃষ্টি কি সমভাবে সবকিছুর উপর পড়ছে। ধনী হোক, গরিব হোক, সফল হোক, ব্যর্থ হোক যে কেউ চাইলেই বৃষ্টিতে ভিজতে পারে!

আমার হঠাৎ করে কদিন আগে পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটা হাড় জিরজিরে রুগ্ন শিশুর চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠল। শিশুটির দরিদ্র হতভাগ্য মা শিশুটির মুখে কোন খাবার তুলে দিতে পারছেনা। আমার মনে হল প্রকৃতিতে নিশ্চয় যত মানুষ আছে তত খাবার আছে। কিন্তু খাবারের সম বণ্টন না হবার কারনে অনেককে অমানবিক ক্ষুধার কষ্ট ভোগ করতে হয়। প্রকৃতি থেকে আমরা এখন যেভাবে খাবার পাই সেভাবে না পেয়ে অন্যভাবে পেলে এই সমস্যা হবার কথা না।

আমার অক্সিজেনের কথা মনে আসল। অক্সিজেন ভারী গ্যাস আকারে মানুষের নাগালের মধ্যে ভাসতে থাকে। প্রকৃতি এমন উচ্চতা পর্যন্ত পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যাবস্থা করেছে যেন প্রকৃতি আগে থেকেই জানত মানুষ একদিন বিমানে চড়ে আকাশে উড়বে। অক্সিজেন গ্যাস আকারে বায়ু মণ্ডলে ছড়িয়ে থাকার কারনে যে কেউ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন টুকু টেনে নিতে পারে। খাবারের বেলায় ও যদি ব্যাপারটা সেরকম হত!খাবারও কঠিন বা তরল না হয়ে গ্যাস আকারে বায়ুমন্ডলের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকত! আলাদা আলাদা স্বাদ অনুভব করার জন্য দেহাভ্যন্তরে যদি থাকত আলাদা আলাদা সেন্সরি অর্গান!

বিষয়টা কল্পনা করে আমি একধরনের কাল্পনিক সুখ পেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল অত্যাধিক খারাপ হতে থাকার কারনে তখন আমার জীবনে 'বাস্তব সুখ' বলতে গেলে ছিলই না। কাজেই এ ধরনের কাল্পনিক সুখগুলো তৈরি করেই আমি বেঁচে থাকতাম।

দুপুরে হলের ডায়নিং এ খাবার রান্না হবার সাথে সাথে খেয়ে নিয়ে রুমে এসে আবার কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু হু হু শীতল হাওয়া ঢুকছে খোলা জানালা দিয়ে।

শুয়ে শুয়ে কল্পনা করলাম, আমি পৃথিবীর ক্ষুধা সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি। এখন প্রকৃতিতে খাদ্য তৈরি হচ্ছে গ্যাস রূপে। সুর্য উঠার সাথে সাথে গ্যাস খাদ্য ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র বায়ু মণ্ডলে। অক্সিজেন যেভাবে টেনে নেয় ঠিক সেই ভাবে মানুষ তার প্রয়োজন অনুযায়ী টেনে নিচ্ছে গ্যাস খাদ্য। গ্যাস খাদ্যের প্রত্যেকটা উপাদানের আলাদা স্বাদ সনাক্ত করে মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট তৃপ্তির সঙ্কেত পাঠিয়ে দিচ্ছে দেহাভ্যন্তরের নির্দিষ্ট সেন্সরি অর্গান!

আমি বেশ উৎফুল্ল মনে সেই জগতের একেকটা দৃশ্য কল্পনা করে যাচ্ছিলাম। যেমন সেখানে কোন খাবার হোটেল নাই। সেখানে বিয়ে বাড়িতে শুধু গান বাজনা হয়! কেউ পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করলে বন্ধু বান্ধব সবাইকে সুন্দর গান গেয়ে শোনায়।

কল্পনায় ডুবে থাকা অবস্থায় হঠাৎ অনুভব করলাম আমার পাশে অশরীরী কেউ আছে! তাকে ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না, তার আওয়াজ পাওয়া যায়না। কিন্তু সে আছে! নিঃশব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে সে আমাকে বলল,

-তুমি অনেক বড় একটা সমস্যার সমাধান করেছ। তোমাদের জগতে এটার বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও আঁহুশ দের জগতে এটার বাস্তবায়ন সম্ভব!



আমার মনে হল পুরোটাই মনের ভুল। যার কথা শুনতে পাচ্ছি সে আসলে আমার মনেরই একটা অংশ। কিন্তু সেও যেন আমার ভাবনা বুঝতে পারল। আবার নিঃশব্দ তরঙ্গ পাঠাল,

- তোমার ভাবনা টা ত একটা ভাবনাই! আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে সেটা যাচাই করবে কিভাবে?



তার কথা(!) আমার কাছে সেই মুহুর্তে যুক্তিযুক্ত মনে হল। কাজেই নিঃশব্দ কথার জবাবে আমিও নিঃশব্দ ভাবে ভাবলাম,

- আঁহুশ আবার কি জিনিষ? হুশ নাই?? সমস্যাই বা কি আর সমাধান ই বা কি?



- তোমরা যেমন মানুষ, আমরা সেরকম আঁহুশ।সম্ভবত আমাদের জগত হচ্ছে তোমাদের জগতের বিভিন্ন শক্তি ক্ষেত্র গুলোর সংঘর্ষে তৈরি হওয়া একধরনের আবিষ্ট জগত।সম্ভবত বলছি কারন এই বিষয়ে আমরা সবাই একমত না। মতভেদ আছে। কিন্তু তোমাদের জগতের সাথে আমাদের জগতের অনেক মিল।



- পুরোটা না বুঝলেও শুনতে দারুণ লাগছে। কিন্তু তোমাদের সমস্যা কি?



- খাদ্য সমস্যা। আমাদের সেন্ট্রাল কমান্ড তোমাদের জগতের অনুকরণে খাদ্য তৈরি করে এখন সেই খাদ্য সবার মধ্যে সুষম ভাবে বণ্টন করতে পারছে না। কিছুকাল আগে খাদ্যের অভাবে দুশ সাইত্রিশ জন আঁহুশ অনাহারে মারা গেছে।



যদিও নিঃশব্দ তরঙ্গ, তারপর ও আমার মনে হল আমি যেন স্পষ্ট একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনলাম!সেই দীর্ঘশ্বাস শুনে এক অসঙ্গায়িত জগতের অচেনা কিছু প্রাণীর জন্য আমি তীব্র দুঃখও অনুভব করলাম। আমার মনে হল, সত্যি সত্যিই যদি আমি তাদের সমস্যা সমাধান করতে পারতাম! সেই ভাবনা মাথায় রেখেই মনে মনে ভাবলাম,

- আমি কিভাবে তোমাদের সমস্যার সমাধান করলাম সেটা ত বুঝতে পারছি না!



- অনেকদিন ধরেই আমাদের গবেষকরা এটা নিয়ে কাজ করছেন । খাদ্যের সুষম বণ্টনের জন্য সমাজ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়না। দিন দিন আঁহুশ বাড়ছে। খাদ্যের উৎপাদন ও বাড়ছে। আবার এদিকে অনাহারী আঁহুশের সংখ্যাও বাড়ছে। আমি সহ আরো কয়েকজন ছোট্ট একটা গবেষণা টিম এ কাজ করি। টিমের পরিচালক একদিন মিটিং এ বললেন, দেখ মহাবিশ্ব টা আমাদের আঁহুশদের জগতের চেয়ে অনেক বড়। আমদের মত অনেক বুদ্ধিমান প্রানিগোষ্ঠী এই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। আমাদের থেকে আটশ নেগ্রিং ( দূরত্বের একক। এক নেগ্রিং = ১৬০০ আলোক বর্ষ) দূরে সবুজ একটা গ্রহ, সম্ভবত আমরা যার আবিষ্ট গ্রহ। আমদের চেয়ে বেশি বিশ্লেষণ ক্ষমতা সম্পন্ন মস্তিষ্কের অধিকারী হয়েও তারা এখনো খুব মৌলিক কিছু সমস্যার ই সমাধান করতে পারেনি। আমরা তাদের মস্তিষ্কেও অনুসন্ধান চালিয়ে দেখতে পারি। তাদের মস্তিষ্কে অনুসন্ধান চালালে হয়ত এমন কিছু পেতে পারি যেটা তাদের সীমাবদ্ধতার কারনে তারা কাজে লাগাতে পারছে না। কিন্তু আমরা কাজে লাগাতে পারব।



- তোমরা কি তারপর পৃথিবীতে এসে মানুষের মস্তিষ্কে অনুসন্ধান চালানো শুরু করলে? কিভাবে করলে?



- পৃথিবীতে আসার ব্যাপারটা ঠিক না। আমি কিন্তু আমার যায়গায় থেকেই তোমার সাথে যোগাযোগ করেছি। কোন যন্ত্রের মাধ্যমে না করে সরাসরি তোমার মস্তিষ্কে যোগাযোগ করেছি। কাজেই তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমার পাশেই আছি।



- ভাল কথা। আমাদের সবার ত একটা নাম থাকে। যেমন ধর আমার নাম খালেদ। তোমাদের ও কি ওইরকম নাম আছে?



- হ্যাঁ আছে। আমার নাম দ্রাহ্নুশ!



- আচ্ছা দ্রাহ্নুশ তুমি কিভাবে আমার চিন্তাগুলো পড়তে পারছ এটা কি বলতে পার।



- সহজ করে বললে ব্যাপারটা এই রকম। তোমাদের ব্রেইন ফিল্ড গুলোকে আমরা আলাদা আলাদা নম্বর দিয়ে সনাক্ত করে রাখতে পারি। প্রত্যেকটা ফিল্ডের প্রত্যেকটা ‘বিভব পরিবর্তন’ রেকর্ড এবং বিশ্লেষণ করা হয় সাথে সাথেই। তোমাদের পৃথিবীর যে অংশে আমি তোমার খোঁজ পেয়েছি সেই অংশের ব্রেইন ফিল্ড গুলোর প্রকৃতির সাথে সংযুক্ত হবার ক্ষমতা খুব বেশি। আমার মনে হল এখানে আমাদের সমস্যার সমাধান পাবার একটা সম্ভাবনা আছে। কাজেই এই ফিল্ড গুলোর উপর আমি এবং অখলাশ ডিঁ আলাদা ভাবে নজর রাখছিলাম।



- অখলাশ ডিঁ?



- হ্যাঁ, অখলাশ ডিঁ আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় আঁহুশ। আঁহুশ দের সেরা গবেষক পুরস্কার ‘ ওরো ঠ্যাং’ এবার ওর পাবার কথা!



- আর তুমি?



- আমি ওর মত অত বেশি মেধাবী না। কিন্তু আমি অনেক বেশি পরিশ্রমী।



- তুমি কচ্ছপ আর অখলাশ ডিঁ খরগোশ! আমার মনে হচ্ছে তুমিই ওরো ঠ্যাং পাবে!



- কচ্ছপ?



- এটা আমাদের জগতের নিরীহ একটা প্রাণী। ওসব নিয়ে পরে কথা হবে। তুমি তোমার কথা বল।



- অখলাশ ডিঁ যে সময়ের ভেতরে দশটা ফিল্ড মনিটর শেষ করে সেই সময়ে আমি মাত্র সাত টা শেষ করতে পারি। কাজেই অখলাশ ডিঁ কিছুক্ষণ পর পর বিশ্রাম নেয় আর আমি নিরলস কাজ করে যাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে তোমার ব্রেন ফিল্ড টা যখন আমাদের নেট ওয়ার্কে আসে তখন আমি কাজ করছিলাম আর অখলাশ ডিঁ বিশ্রাম করছিল!



- খরগোশ ঘুমায়, কচ্ছপ দৌড়ায়!!



- তুমি এসব কি বলছ!



- বাদ দাও! তুমি তোমার কথা বল।



- তোমার ব্রেন ফিল্ড টা প্রথমেই আমার দৃষ্টি কাড়ল। দেখলাম যে মুহুর্তে কাছাকাছি ব্রেন ফিল্ড গুলোর বেশির ভাগ একধরনের কাজে ব্যস্ত তখন তোমার ব্রেন ফিল্ড আরেক ধরনের কাজে ব্যস্ত। খেয়াল করলাম তোমার ব্রেন ফিল্ড সুখানুভূতির জন্য তার চারপাশের জগতের উপর নির্ভর না করে নিজেই জগত তৈরি করে নেয়! তখুনি আমার মনে হল তোমার তৈরি কোন জগত আমাদের আঁহুশ দের জগতে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান হতে পারে। ‘মহা প্রকৃতি’ র ইচ্ছায় ঠিক সেই মুহুর্তে তুমি এমন একটা জগত তৈরি করলে যেটা আমাদের খাদ্য বণ্টন সমস্যার সবচেয়ে সুন্দর সমাধান!



- কিন্তু এতে করে ত তোমাদের সবগুলো আঁহুশ কে রি এঞ্জিনিয়ারিং করতে হবে! দেহের পরিপাক তন্ত্র বদলাতে হবে। প্রত্যেকটা কোষের গঠন পাল্টাতে হবে!



- আমি জানি। এক প্রজন্মে এটা সম্ভব না। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মে সম্ভব!



- কিভাবে সম্ভব?



- আমরা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ অকল্পনীয় রকম এগিয়ে গিয়েছি। নিষিক্ত ভ্রূণের বয়স দু’সপ্তাহ হবার আগে সেটাতে আমরা যেকোন ধরনের এঞ্জিনিয়ারিং করতে পারি!



- গ্যাসীয় খাদ্য উৎপাদন করবে কিভাবে?



- তোমাকে ত বলেছি আমরা আবিষ্ট জগত। সেটার মুল প্রোগ্রাম ও অনেকটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের সেন্ট্রাল কমান্ড এর কাছে উপযুক্ত জ্ঞান থাকলে সে আমাদের জগতের প্রকৃতির মুল প্রোগ্রামেও পরিবর্তন আনতে পারে।



- কিন্তু দুটা বিষয় একই সাথে হওয়া জরুরি। ধর জগতের প্রকৃতি পাল্টে গ্যাসীয় খাবার তৈরি হওয়া শুরু হল, এদিকে সেই খাদ্য গ্রহণের প্রজন্ম তৈরি হল না! তাইলে কিন্তু তোমরা এক ধাক্কায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!



- কিছুটা রিস্ক থাকবে। কিন্তু সেটা নেয়া ছাড়া আমাদের উপায় নাই!



- তুমি নিশ্চিত এই প্রকল্প তোমরা হাতে নিচ্ছই?



- আমি নিশ্চিত। আমার রিপোর্ট অলরেডি পৌঁছে গেছে এবং এপ্রোভড হয়ে গেছে!



- মাই গড। তোমরা ত দেখি সুপার অপটিক!!পুরা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে কতদিন লাগতে পারে?

- তোমাদের সময়ের হিসাবে সতের বছর সাঁইত্রিশ দিনের কাছাকাছি কিছু একটা।

ঠিক এই সময় আমার রুম মেট রুমে আসে এবং দ্রাহ্নুশের সমস্ত অস্তিত্ব আমার চেতনা থেকে সাময়িক ভাবে মুছে যায়। পরে আমি আমার বন্ধু শাখাওয়াত এর সাথে এই বিষয়ে কথা বলি এবং সাখাওয়াত একে পেটের অসুখ বলে সনাক্ত করে! সাখাওয়াত আমাকে বলে সকালে প্রায়শই পেট খালি থাকার আমার গ্যাস্ট্রিক। গ্যাস্ট্রিক থেকে ‘পেট গরম’। এবং পেট গরম অবস্থায় এসব উল্টা পুল্টা চোখের ধান্ধা, মনের ধান্ধা হয়। সে আমাকে বলে যে আসলে আমার পেটে অনেক গ্যাস জমা হয়ে আছে এবং সেই কারনেই এসব অদ্ভুদ গ্যাসীয় চিন্তা আমার মাথায় আসছে!

শুরুতে সাখাওয়াতের কথা অবিশ্বাস হলেও পরবর্তিতে আর কোনদিন দ্রাহ্নুশ এর সাথে যোগাযোগ না হওয়ায় আমার মনে ধীরে ধীরে সাখাওয়াতের কথাই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কিন্তু আজকে ঠিক সতের বছর পর আবার দ্রাহ্নুশ এর আগমন। তাছাড়া বিয়ের পর স্ত্রীর সযত্ন পরিচর্যায় গ্যাস্ট্রিক এর চিহ্ন মাত্র ও আর আমার পেটে নাই! কাজেই দ্রাহ্নুশ কে আর অবিশ্বাস করা গেল না। আমি দ্রাহ্নুশের উদ্যেশ্যে মনে মনে ভাবলাম,

-হ্যাঁ দ্রাহ্নুশ। আমি তোমাকে চিনেছি। তোমাদের জগতের ‘সুষম খাদ্য বণ্টন প্রকল্পে'র কি হল?



-প্রকল্প সফল! তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না! সুর্য উঠার সাথে সাথে পুরা বায়ু মণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে পুষ্টিকর সব গ্যাসীয় খাবার। আর দেব শিশুর মত অগণিত শিশুদের সবাই প্রান ভরে সেই খাবার খেতে খেতে গান গায়!



- এরা সব নতুন প্রজন্মের রি এঞ্জিনিয়ারড শিশু। তোমার কাছে আমার দুটা প্রশ্ন দ্রাহ্নুশ!



- বল খালেদ ডুমকিন! তোমার প্রশ্ন বল।



-ডুমকিন?



- সন্মান জনক উপাধি। আমাদের জগতে অতি সন্মানিত দের ডুমকিন উপাধি দেয়া হয়।



- আমি ত তোমাদের জগতের কেউ না।



-আমাদের জগতের কেউ না হয়েও তুমি আমাদের জগত কে বাঁচিয়েছ এবং একটা শ্রেণি বিভাজন হীন সমাজ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছ। কাজেই তুমি আমাদের ডুমকিন!!



- আমার প্রথম প্রশ্ন- তোমরা যারা প্রথম প্রজন্মের তারা ত আর গ্যাস খাদ্য খেতে পারছ না। তোমরা কিভাবে বেঁচে আছ?



- আমাদের সংখ্যা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ট্র্যাডিশনাল ফুড উৎপাদনের ব্যাবস্থা রাখা হয়েছে।



- আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন- গ্যাসীয় খাদ্যের বর্জ্য ও নিশ্চয় গ্যাসীয়। সেই বর্জ্য বায়ু মণ্ডলে নির্গত করার পর সেটা ত গ্যাসীয় খাদ্যের সাথে মিশে তাকে দুষিত করে ফেলবে!



- সেটা আমরা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম এবং নূতন জিনেটিক প্রোগ্রাম কোড লিখার সময় সেটা খেয়াল রেখেছিলাম। তোমাদের জগতে যেমন রাসায়নিক ধর্মের কারনে তেল আর জল মিশেনা সেরকম বর্জ্য গ্যাস আর খাদ্য গ্যাস ও কখনো মিশেনা। বর্জ্য গ্যাস যাতে ভুল করেও কেউ খেয়ে না ফেলে সেজন্য আমরা ‘অটো ফিল্টারে’র ব্যাবস্থা রেখেছি!



- তোমরা ত দেখি বিরাট ওস্তাদ!



- তুমি আসল ওস্তাদ ডুমকিন! তোমার জন্যই সবকিছু!



- বেশি প্রশংসা করোনা দ্রাহ্নুশ। তাইলে কিন্তু আমি গ্যাস নির্গমন করব! আর তুমি যেহেতু আগের প্রজন্মের কাজেই তোমার নিশ্চয় অটো ফিল্টার নাই!



- না আমার অটো ফিল্টার নাই! কিন্তু আসল কথাটাই ত তোমাকে বলিনি। আমি তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে এসেছি। আমাদের ডুমকিন কে সম্রাটের সন্মান দিয়ে আমরা আমাদের জগতে রাখতে চাই!



- সেখানে কি কি ফ্যাসিলিটিজ থাকবে?



- সমুদ্রের তীরে বিশাল একটা বাড়ি। একটা স্কাই শিপ এবং একটা সাবমেরিন তোমাকে দেয়া হবে। এছাড়াও আস্ত একটা অরণ্য তোমাকে দেয়া হবে যেখানে যখন তখন বন্য প্রাণীর ডাক শুনতে পাওয়া যায়!



-এসব তথ্য আমার মাথা থেকেইত পেয়েছ নিশ্চয়!



- অবশ্যই। এছাড়া ত কোন উৎস নাই!



- কিন্তু আমি যদি যেতে না চাই? আমি যদি আমার স্ত্রী সন্তান মা বাবা ভাইবোন বন্ধু বান্ধবের পরিচিত জগত ছেড়ে যেতে না চাই?

কিছুক্ষণ নিঃশব্দ তরঙ্গ আসা বন্ধ থাকল। মনে হল দ্রাহ্নুশ কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। কাল গোলকের ভেতর হঠাৎ বড় বড় ঢেউ উঠা আরম্ভ হল। আমার মনে হল আমি কাল গোলকের কেন্দ্র অর্থাৎ মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এবং আরো অদ্ভুদ ভাবে মনে হল এই মুহুর্তে দ্রাহ্নুশ হয়ত আমাকে বাঁচাতে পারবে। আমি ব্যাকুল ভাবে মনে মনে উচ্চারণ করলাম- দ্রাহ্নুশ, দ্রাহ্নুশ!

দ্রাহ্নুশের অস্তিত্ব আমি আবার অনুভব করলাম এবং কিছুটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা একটা নিঃশব্দ তরঙ্গ আবার আমার মস্তিষ্কে ধরা পড়ল,



- তোমার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমরা কিছুই করতে পারি না। তুমি চাইলে ফিরে যেতে পার। কিন্তু ডুমকিন, আমরা জানি যে এই জগতে তুমি অত্যন্ত সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন যাপন কর। দুদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে তোমার উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তুলনায় আমদের ওখানে তুমি বাকী যে ক’দিন বাঁচবে রাজার হালে থাকবে। তবে তোমাকে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি।



- আমরা কিসের কাছাকাছি চলে এসেছি?



- কেন্দ্রের! এই কাল গোলকের কেন্দ্রে পৌঁছালেই আমরা ট্রানফার টানেলের গ্রেভিটিতে আটকা পড়ব। তখন আর তুমি চাইলেও তোমার জগতে ফিরতে পারবে না!



- আমরা বলছ কেন? তুমি ত তোমার জগত থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করছ!



- এবার আমি সশরীরে এসেছি! কেন্দ্রে পৌছলেই তুমি আমাকে দেখতে পাবে! আরেকটা কথা!



- কি কথা!



- সেবারের উরোঠ্যাং কিন্তু আমিই পেয়েছিলাম। অখলাশ ডিঁ পায়নি। বলা বাহুল্য তোমার ব্রেন ফিল্ড আমি খুঁজে পাবার কারনেই সেবারে অখলাশ ডিঁ কে ডিঙ্গিয়ে এই সন্মান পেয়েছিলাম!



- কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পে দেখি সব জগতেই কচ্ছপ জিতে!



- কি বললা?



- বাদ দাও! আমি তোমার সাথে যাব না। আমার মেয়েটা মাত্র বর্ণমালা লিখতে শিখছে। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে আমি যখন ল্যাপ্টপ নিয়ে বসি আমার ছোট্ট মেয়েটা তখন বই খাতা নিয়ে আমার পাশে এসে বসে। আমার কাছে গাল এগিয়ে দিয়ে বলে, বাবা ফাপ্পা দাও! এগুলো ত তোমাদের ওখানে গেলে পাবে না!



- কিছু মনে করোনা! ওখানে গেলে তুমি ডুমকিন এর সন্মানিত এবং বিলাসী জীবন যাপন করবে। আর এখানে?



- এখানে গাধা অর্থাৎ ডাংকি’র জীবন। কিন্তু তোমাদের জগতের ডুমকীনের জীবন থেকে আমার জগতের ডাংকীর জীবন আমার কাছে শ্রেয় মনে হচ্ছে দ্রাহ্নুশ! আমি আমার জগতে ফিরে যেতে চাই।



আবার কিছুক্ষণ দ্রাহ্নুশের কোন সাড়া শব্দ নাই। এদিকে কাল গোলকের ঢেউ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে আমাকে আগে যেদিকে নিচ্ছিল সেদিকেই অর্থাৎ গোলকের কেন্দ্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে!



আমি অনেকক্ষণ ধরেই এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কাজেই এই প্রক্রিয়া কেন্দ্রিক সহজাত একটা অনুভূতি আমার তৈরি হয়েছে। আমার মনে কিছু প্রশ্ন আসল। আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবার সাথে দ্রাহ্নুসের সাফল্যের প্রশ্ন জড়িত। কাজেই মুখে(!) যাই বলুক, সে আমি না যেতে চাইলেও আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইতে পারে! মানুষ হোক বা আঁহুশ হোক, অযৌক্তিক ভাবে কাউকেই বিশ্বাস করা ঠিক না। আমি বেশ জোরালো ভাবে মনে মনে উচ্চারণ করলাম,

- আমি তোমার সাথে যেতে চাই আঁহুশ!



সাথে সাথে আঁহুশের সাড়া পাওয়া গেল!

- আমি জানতাম ডুমকিন তুমি তোমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবে! আমি জানতাম!



নিঃশব্দ শব্দ তরঙ্গের মধ্যেও যেন একধরনের আবেগ। একধরনের স্বস্থি!!

আমার মস্তিষ্ক খুব দ্রুত কাজ করা শুরু করল। আমাকে যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। আমাকে এই মুহুর্তে যা করতে হবে সেটা বর্ণনা করা খুব ই সহজ। বাস্তবে যথেষ্টই কঠিন।



আমার মস্তিষ্ক কে পুরো দুইটা ভাগে ভাগ করতে হবে। একটা ভাগ আমার বসার ঘরের সোফায় শুয়ে থাকা নশ্বর দেহ কে নিয়ন্ত্রণ করবে। আরেকভাগ এই অন্ধকার কাল গোলকের ভেতরে দ্রাহ্নুশের হাতে পরাজয় থেকে আমাকে রক্ষা করবে।

আমার নশ্বর দেহ দেহের সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্দ্রিয় চোখ বন্ধ রেখে বসার ঘরের সোফা হতে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ওদিকে আরেকটা অংশ কাল মৃত্যু গোলকের ভেতর দ্রাহ্নুশের সাথে কথা বলছে!

আমার বন্ধ চোখ নশ্বর দেহ দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে ডায়নিং রুমে রাখা পানির ফিল্টারের কাছে গেল। ডায়নিং টেবিল থেকে কাঁচের জগ টা তুলে নিল। তারপর সেটা দিয়ে ফিল্টারের নোংরা পানি সরাতে লাগল।

কাল গোলকের ভেতর আমার মস্তিষ্কের অংশবিশেষ কে দ্রাহ্নুশ বলল,



- একটা রিভার্স ফিল্ড টের পাচ্ছি ডুমকিন!



- আমার মস্তিষ্ক নিজেকে তোমাদের জগতের জন্য তৈরি করছে। তারই এফেক্ট হয়ত ওরোঠ্যাং!



- আমাদের জগতে তোমার অপরিসীম সন্মান ডুমকিন!



- ওহ তোমাদের সুন্দর মেয়েদের কথা ত কিছু বললে না ডুমকিন!



- তোমার যতজন ইচ্ছা সঙ্গে রাখতে পার! ডুমকিন দের এই সুবিধা আছে!



- আর ওরোঠ্যাং রা কয়জন রাখতে পারে?



- পাঁচজন। তবে পাঁচজন ই সুন্দরী!



- ওহ নো। তোমার কাউ কে যদি আমার পছন্দ হয়ে যায়?



-এই ধরনের কথাকে আমাদের জগতে ‘জোক’ বলে ডুমকিন!



- আগে তোমাদের জগতে গিয়ে পৌছাই। তারপর বুঝবে কত জোকে কত রিয়েলিটি!

আমার নশ্বর দেহ হাতড়ে হাতড়ে কিচেনে যায়। পরিষ্কার খাবার পানির ডেকচিটা হাতে তোলে নেয়। সেটা নিয়ে দেয়ালে কনুই ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে ফিল্টারের দিকে আগাতে থাকে! ফিল্টারে পানি ঢালার আগে বেড রুমে গিয়ে মিশিয়া(আমার স্ত্রী) কে ডেকে আনতে হবে। চোখ বন্ধ রাখার ব্যাপার টা তাকে একসেপ্ট করাতে হবে!

কাল গোলকের ভেতর দ্রাহ্নুশ আমার মস্তিষ্কের অংশ বিশেষ কে বলে,

-ডুমকিন! রিভার্স ফিল্ড মারাত্নক শক্তিশালী হয়ে উঠছে! কি হচ্ছে ডুমকিন!



- বুঝছনা কেন? তোমাদের জগতে যাবার পর অনেকগুলো সুন্দরী আঁহুশের সাথে আমাকে বাস করতে হবে। এজন্য আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ নিজেকে এনারজাইজ করতে ব্যস্ত! সেটাই হয়ত তোমার রিভার্স ফিল্ডের জন্য দায়ী!



- সেই একটা অংশকে ত আমি ধরতেই পারছিনা ডুমকিন!



- তোমাদের জগতের সুন্দরিদের গল্প বল ডুমকিন! তাদের গল্প খুব শুনতে ইচ্ছে করছে আমার।



- শোনা কেন ডুমকিন! কিছুক্ষণ পর ত তুমি তাদের দেখতে পাবে!



- তাইত, তাইত!

আমার নশ্বর দেহ মিশিয়ার কাছে যায়। মিশিয়ার পিঠে পরম মমতার হাত রাখে। মিশিয়া সে মমতার ভাষা বোঝে। তীব্র ভালবাসায় কেঁপে উঠে সে। সে উঠে দাঁড়িয়ে আমার বুকে মাথা রাখে। তারপর মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে-

- তোমার চোখ বন্ধ কেন ডিয়ার?



- আমি এখনো তোমার সাথে রাগ করে আছি। আমার পাপের প্রায়শ্চিত্য হিসেবে আমি ফিল্টারের নোংরা পানি ফেলে দিয়েছি! এখন ফিল্টারে পরিষ্কার খাবার পানি ঢালব। সেই পানি দেখে তুমি মিষ্টি করে হাসবে। তারপর আমি চোখ খুলব!

কাল গোলকে বড় বড় ঢেউয়ের দুলুনি টের পাচ্ছি! দ্রাহ্নুশের নিঃশব্দ তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে গেছে।



- ডুমকিন ডুমকিন! আমার মনে হচ্ছে সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে! আমি তোমার ‘লাইফ লাইনের’ যে বিন্দুতে তোমাকে ট্যাগ করে লাইন চ্যুত করেছিলাম মনে হচ্ছে কেউ সেই বিন্দুতে গিয়ে তোমাকে তোমার আগের লাইফ লাইনে নিয়ে যাচ্ছে!



- তোমার কথা মিথ্যে দ্রাহ্নুশ! তুমি আমাকে এই কাল গোলকের ভেতর ফেলে পালানোর ষড়যন্ত্র করছ!



- মিথ্যে নয়। তুমি টের পাচ্ছনা কাল গোলকের ভেতরকার ঢেউ এখন তোমাকে উল্টো দিকে ঠেলছে। তুমি ক্রমশ দেয়ালের দিকে সরে যাচ্ছ!



- আর তুমি?



- আমি কেন্দ্রের দিকেই যাচ্ছি! আমরা আলাদা ক্রমশ আলাদা হয়ে যাচ্ছি ডুমকিন!





আমার মস্তিষ্কের অংশবিশেষ সত্যি সত্যি বুঝতে পারল ঢেউ হঠাৎ করে উল্টো দিকে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। আমি সরে যাচ্ছি গোলকের দেয়ালের দিকে!

ফিল্টারে পরিষ্কার খাবার পানি ঢালা হয়েছে। মিষ্টি হাসি হাসবে কি! আমার স্ত্রী মিশিয়া নিজেও চোখ বুজে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে আছে। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! মিশিয়া হঠাৎ ফিস ফিস করে বলল,

আমরা কত সাধারণ মানুষ, তারপর ও আমরা কত সুখী!

কাল গোলকের দেয়ালের একদিকে একটা ফাটল তৈরি হচ্ছে। মুরগির বাচ্চা ডিম ফুটে বেরোবার সময় ডিমের খোসায় যেরকম হয় সে রকম।

ভাঙ্গা ভাঙ্গা একটা শব্দ তরঙ্গ অতি কষ্টে আমার মস্তিষ্কের অংশ বিশেষে পৌছাল,

-ডুমকিন। তোমার বুদ্ধিমত্তার ধারেও আমি যেতে পারবনা জানতাম। তুমি একেবারে গোড়া থেকে আমার লেজ কেটে দিয়েছ। তোমাকে নিয়ে যেতে পারলে আমার জগতে আমার বিরাট সন্মান হত। তোমাদের জগতে নীল আর্ম স্ট্রং যেরকম। সেজন্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে। পরাজিত হয়ে অবশ্য তোমার প্রতি সন্মান টা আরো বেড়ে গেল। তোমাকে নিতে না পারলেও তোমার মস্তিষ্কের স্মৃতি থেকে একটা অবয়ব আমি এঁকে নিয়েছি। সেটাই সবাইকে দেখাব। বিদায় ডুমকিন!

কাল গোলকের ফাটল চিরে বের হয়ে আমার মস্তিষ্কের বিচ্ছিন্ন দুটা অংশকে এক করে আমার স্ত্রীর দিকে তীব্র ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকানোর জন্য চোখ খুলতে খুলতে অচেনা জগতের অচেনা একজন আঁহুশ দ্রাহ্নুশের জন্য আমার বুক টা হা হা করে উঠল!



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.