নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঘুম
ভিত্রিখেল এবং আসামপাড়া পাশাপাশি দুটি গ্রাম । আয়তন এবং লোকসংখ্যার দিক দিয়ে ভিত্রিখেল বড় । এই দুই গ্রামের মধ্যভাগে আছে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ । যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ আর সবুজ । এই মাঠে এক টুকরো জমি আছে সিরাজের,তাও আবার তার নিজের নয়; উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার কাছ থেকে পাওয়া। এই জমি চাষ করে সিরাজের সম্পুর্ণ সংসার চলে না । তাই সে অন্যের জমি বর্গা নিয়েও চাষ করে । সকাল বেলা প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা... করেও সে তার ধানী জমি দেখতে এসেছে । ভাগ্য বিড়ম্বিত এসব লোকেদের বেঁচে থাকার জন্য রোদ বৃষ্টিকে আগ্রাহ্য করেও চলতে হয়।
খানিক ক্ষণ জমির চারদিক ঘুরে ফিরে দেখল ছাদেক । বেশ সতেজ এবং খু্ব দ্রুত বেড়েও উঠেছে ধানগুলো । সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কী যেন ভাবল । বিড়বিড় করে নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে । কি যে সে দুর্বোধ্য ভাষা! কেবল যে তা করে হয়ত সেই ভাল জানে ; অন্যে নয় । ফসলের জমি দেখে তৃপ্ত মনে পুনরায় সে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় । ততক্ষণে হালকা কুয়াশা এবং শীতের তীব্রতা অনেকটাই কেটে গেছে। ছাদেক যেতে যেতে পরিকল্পনা করে - বাড়ি ফেরার আগে ফজলুর সাথে একটু দেখা করে যাওয়াই ভাল । নিজ বাড়ির পথ থেকে ফজলুর বাড়ির পথে পা বাড়াতেই পেছন দিকে থেকে ডাক পড়ল -চাচা...চাচা...ও...চাচা?
-ঐ রকম চ্যাচামেচি করতাছত ক্যান? কী অইছে?
- চাচা! চাচা!(দম নিয়ে)
- ক্ কী অইছে?
- চাচি যেন কেমন করতাছে চোখ বড় করে আর জানি কেমুন অইয়া যায় ;
- কী কস তুই ? আমি তো ভালই রাইখ্যা আইলাম।
- জলদি আহো;নইলে ... বাকীটুকু অজানা শঙ্কায় আর বলতে পারলো না।
- হু, চল।
খুব দ্রুত বাড়ি ফিরে ছাদেক । প্রতিবেশীরা এসে ঘরে ভিড় জমিয়েছে । কেউ কেউ কানাকানি করতেছে যে ওকে ভূতে ধরছে’। আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে অন্যজন বলছে- আরে না ওরে পিশাচে ধরছে;দেহস না কেমনে খিঁচুনি দিতাছে আর চোখও কেমুন বড় বড় করতাছে?
ছাদেককে দেখে তার শাশুড়ি কাঁদো কাঁদো স্বরে- বাজান, আমার এই পুয়াতি মাইয়াডারে বাচাঁও। তাড়াতাড়ি ফকির ডাইকা নিয়া আহ । বলতে বলতে চোখের পানি মুছতে থাকে আচল দিয়ে । অবলা নারীদের প্রধান অস্ত্রই তো চোখের পানি ।
- ফকির আনুম না গনি মুনসির কাছে নিমু?
ছাদেকের ষোল বছর বয়সী শ্যালক মিজান প্রতিবাদ করে বলে- না,না,আপারে সদর হাসপাতালে নিয়া চলেন । মিজানকে থামিয়ে তার মা বলে, - তুই থাম! সব রোগ ডাক্তাররা বালা করবার পারে না; ওর উপরি বাতাস লাগছে, ... ভূতে ধরছে; দেহস না কেমুন করতাছে? আহারে! তাড়াতাড়ি যাও বাজান । আবেগ জড়িত কণ্ঠে আহবান করতে থাকে ছাদেকের শাশুড়ি। উপস্থিত সবাই সমস্বরে বলে উঠল - হ্ হ্ ফকির আনাই ভাল অইবো;
মিজান গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে । সংসারিক ঝামেলার কারণে আর অর্থনৈতিক টানাপোড়নে তাকে অষ্টম শ্রেণিতেই ইস্তফা দিতে হয়েছে । প্রায় বছর সাতেক হবে পড়াশুনাতে ইস্তফা দিয়েছে । এরই মাঝে সে বিয়েও করেছে । যাকে বিয়ে করেছে তার নাম নিপা । দেখতে খুবই রূপবতী,ছিমছাম দেহ । হাসলে তার দু’গালে টোল পড়ে । মক্তবে পড়াশুনা করেছে । স্কুলের গণ্ডিতে তার আর যাওয়া হয়ে উঠে নি । বয়সে মিজানের চেয়ে বছর দুয়েকের মত ছোট হবে । সর্ম্পকে খালাত বোন । সাত মাস হয় নিপা একটি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে । কন্যা সন্তান প্রসব করায় মিজান নিপার প্রতি অসন্তুট;কেননা সে মনে মনে পু্ত্র সন্তানের প্রত্যাশা করেছিল । এ নিয়ে মাঝে মধ্যেই সে নিপাকে বকা ঝকা করে । নিপা অবশ্য ভুলেও এর প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। একে তো তার বাবার অর্থিক অবস্থা খুব খারাপ অপরদিকে তার শিক্ষাগত যোগ্যতাও কম । ফলে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয় । নিপার নানি সবকিছু শুনে নিপাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে বলে- সইযযো করগো বইন,সইযো কর । মাইয়্যা অইয়া জন্মাইছত,সোয়ামির ঐ রকম ইকটু-আধটু কতা তো হুনন নাগবই । নিপা নানির কথায় শুধু নিঃশব্দে চোখের পানি মুছে । অভাগীদের যে ঐ একটিই অস্ত্র ! কয়েকদিন আগেও মিজান নিপাকে অহেতুক ঘটনার কেন্দ্র করে বেশ মারধরও করেছিল । সেদিন চোখের পানি আচল দিয়ে মুছতে মুছতে নিপা তার নানিকে বলেছিলো - নানি গো! মাইয়্যা অইছি বইল্ল্যা কি আমরা মানুষ না? এই রকম কইরা আর কতকাল বিনা দোষে মাইর খাইয়া যাইমু? নানি সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলে - চুপ কর বইন, চুপ কর;এই রকম কইরা কওন ও পাপ । ধৈর্য ধর বইন,সব ঠিক অইয়া যাইব । দেড় বছরের সংসার জীবনে নিপা যতটুকু না ভালবাসা পেয়েছে তার চেয়ে বেশি নির্যাতিত এবং নিগৃহীত হয়েছে । ছাদেকের বউয়ের এই মুমূর্ষু অবস্থা দেখার জন্য নিপাও এসেছে । সে কোন কথা বলছে না। শুধু নীরব দর্শকের মত সবকিছুই দেখে যাচ্ছে । আসার পথে তার নানিকে ফিসফিস করে বলছিল - আপারে সদর হাসপাতালে নেওয়নই ভাল, কি কও নানি?
- চুপ কর! যার বউ হেই বুঝবো; তর অত বেশি বুইঝযা লাভ নাই।
নানির সেই ধমকিস্বরে কথা শুনার পর থেকেই সে চুপ হয়ে গেছে । হয়ত সে কথা বললেও তা কেউ শুনতো না ! বয়সে ছোট বলে অবজ্ঞা করা হত ! যেমন করা হল মিজানের বেলায় । সেও সদর হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তাব করেছিল । কিন্তু তার কথা কেউ মূল্যায়ন করে নি । ছাদেক দ্রুত আনোয়ার ফকিরের বাড়ির দিকে রওনা দিল । এই বিপদের দিনে মিজানকেও কিছু একটা করতে হবে- তা ভেবে সে গেল গণি মুনশির বাড়ির দিকে । আনোয়ার ফকিরের বাড়ি বেশি দূরে নয় । মিনিট বিশেকের মধ্যে আনোয়ার ফকিরকে সঙ্গে নিয়ে ছাদেক বাড়ি ফিরলো । বাড়ির আত্মীয় স্বজন তখন অনেকেই কান্না কাটি করছিলো। আনোয়ার ফকিরকে দেখতে পেয়ে সে মাত্রা আরো বেড়ে গেল । আনোয়ার ফকির সবাইকে শান্ত হয়ে একটু দূরে সরে যেতে নির্দেশ দেয়। এর পর শুরু হয় তার তুকিতাকি। দুটি আধা ফুটের মত কাঠের টুকরা বাহির করে ঝাড়-ফুক দিতে থাকে । নাহ্! কিছুতেই কমছে না । বরং ক্রমে ক্রমে আরো অবনতি হচ্ছে । কিন্তু ফকির সাহেব তা বুঝেও যেন বুঝলেন না । কেননা তিনি হেরে যাওয়ার মত ফকির নন । উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তার এই পীরালী সূত্র ভুল হতে পারে না । প্রচণ্ড রকম অন্ধবিশ্বাস তার মধ্যে কাজ করতে থাকে । একটু পর কাঠের টুকরা দুটির মধ্যে ছাদেকের স্ত্রীর বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুল সজোরে চাপ দিয়ে বলছে - ক্ যাইবি কিনা ? ক্ অ ..............? আরো জোরে চাপ দিতে থাকে ।
ছাদেকের স্ত্রী প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে । তার চিৎকারে আকাশ ভারী হয় উঠে । কষ্টের সবোর্চ্চ সীমায় পৌঁছলে মানুষের যে অবস্থা হয় তেমনি অবস্থা আর কি! পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হচ্ছে কিন্তু কেউ কিছুই বলছে না । শুধু নীরব দর্শকের মতই ফলাফলের অপেক্ষায় আছে । কেবল ছাদেকের শাশুড়িই তার মেয়ে মর্জিনাকে প্রবোধ দেওয়ার ছলে বলে- কান্দিস না মা! সব বালা অইয়া যাইবো । মর্জিনার চিৎকারে ছাদেক বিচলিত হতে থাকে । কিন্তু বংশ পরম্পরায় পীরদের প্রতি তার যে একধরনের বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে তার উপরো সে অবিশ্বাস করতে পারছে না । বিশ্বাসগুলো মাঝে মাঝেই যে ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে তা সে ভাবতে পারে না। চিন্তার পরিধি খুবই ছোট । গ্রামীন অশিক্ষা কুশিক্ষা আর নানাবিধ হাজারো কুসংস্কারের মধ্য দিয়েই সে বেড়ে উঠেছে। সভ্যতার আলো বাতাস,আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন একটা লাগেনি বললেই চলে । এরই মধ্যে গণি মুনশিকে নিয়ে এসেছে মিজান । সবার দৃষ্টি তখন গণি মুনশির দিকে । কিছুটা হলেও তখন আশার সুবাতাস বইতে শুরু করলো তাদের মধ্যে । কেবল আনোয়ার ফকিরই কেবল গণি মুনশির আগমনকে সুনজরে দেখলো না । কিন্তু সে গোপন হিংসা আপাদত গোপনেই রেখে দিল।
মুনশি - আসসালামুআলেকুম, ফকির সাপ!
- ওলেকুম ছালাম
- রোগীর কি অবস্থা?
- (কাছে এসে ফিসফিস করে) বেশি ভাল না; (ব্যাঙ্গ স্বরে)দেহেন আপনি কিছু করবার পারেন নি!
মুনশি এক গ্লাস পানি এনে বিড়বিড় করে যেন কি পড়লো তারপর গ্লাস ভর্তি পানি ছাদেকের স্ত্রীর সমস্ত শরীরে ছিটিয়ে দিল। হঠাৎ পানির ছিটা পেয়ে মর্জিনা একটু নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করে । তখন সবারই মনে হতে লাগলো এই বুঝি মর্জনা ভাল হতে চলছে ! নিজেও বিড়বিড় করে কি পড়ে যেন ছাদেকের স্ত্রীকে ঝাড়-ফুক দিতে লাগলো । এদিকে ফকির আনোয়ারও থেমে নেই । কেরামতিতে হেরে গেলে যে চলবে না! যদিও তাদের মধ্য স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল । যৌথভাবে চলতে লাগলো তাদের চিকিৎসা । আনোয়ার ফকির একটি মোটা খালি বোতল আনলো। গণি মুনশি তখন ঝাড়-ফুক বাদ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো । আনোয়ার ফকিরের কেরামতিতে যদিও সে একটু বিব্রতবোধ করছে তথাপিও সামগ্রিক স্বার্থে সে নীরব ভূমিকা পালন করছে । অবস্থা দেখে মনে হবে যেন চোরে চোরে মাসতুতু ভাই! ফকির সাহেব তখন রোগীর সামনে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে খানিক ক্ষণ কি যেন বিড়বিড় করলো। তারপর খোলা বোতলের মুখে ছিপি লাগাতে লাগাতে বলল - বহুত ক্ষণ পরে তরে আটকাইছি ! অহন যাইবি কই?
মুনশিসহ সবাই তখন একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল । উত্তরীয় ফুরফুরে বাতাস বইতে শুরু করেছে । আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের ভেলা এক অন্যরকম সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে । এটা যেন শুভ লক্ষণ ! তাদের সবার চোখেই কৌতূহল, অপার বিষ্ময়! ফলাফল কি হয়!
ফকির সাহেব ঘুরে ঘুরে বোতল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে থাকে - হে নষ্ট পিশাচ! ক্ অহন কেমুন করবি ? অহন কেমনে বাইরাবি?
গ্রামের লোকেরা এইসব ঘটনা প্রায়ই দেখে অভ্যস্ত । ছাদেকের স্ত্রীর তখন আবারো খিঁচুনি উঠে । শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে সে হাত পা ছোড়ার চেষ্টা করে । কর্কশভাবে দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে । এখনই বুঝি সব দাঁত ভেঙে যাবে । যাতে দাঁত ভেঙে না যায় এজন্য মর্জিনার মা মর্জিনার মুখে ছোট চামুচ ঢুকিয়ে রাখলো । ফলে সে চিৎকার করতে গিয়েও করতে পারলো না । মুখের কিনারা দিয়ে সাদা ফেনা বের হচ্ছে । একটু পর চামুচ তুলে ফেললে গগণ বিদারী চিৎকার দিতে থাকলো মর্জিনা । তার চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে । বেশ কয়েক জন মহিলা ও পুরুষ তার হাত পা ধরে রেখেছে । আরেকবার জোরে চিৎকার দিয়ে চোখ দুটি বড় বড় করলো । দাঁতে দাঁত লাগলো । ক্ষাণিক ক্ষণ পর তার উত্তেজিত শরীর ধীরে ধরী শীতল হয়ে এল।চোখ দুটিও ধীরে ধীরে ছোট হয়ে এলো। গভীরভাবে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল । ফকির সাহেবের বক্তৃতায় সবাই মুগ্ধ । সবাই ভাবল ছাদেকের স্ত্রী ভাল হয়ে গেছে । ছাদেক তার স্ত্রী থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফকির সাহেবের কর্মকাণ্ড মুগ্ধ হয়ে দেখছিল । এক প্রকার ঐশী অগাধ বিশ্বাস তার চোখ মুখ জুড়ে খেলা করছিল ।
বোতলে আবদ্ধ পিশাচকে উদ্দেশ্য করে বেশ কিছুক্ষণ চলতে থাকে তার শ্রাব্য অশ্রাব্য গালিগালাজ । সে গালি বোধ করি সভ্য সমাজের কোন ভদ্রলোক কখনো শুনেন নাই। বেশ সময় পর ছাদেকের শাশুড়ি তার মেয়েকে ডাকছে - মা মর্জিনা ! ওঠো, ওঠো মা, ওঠো........! মর্জিনার কোন অনুভূতি নাই । ফকির ইশারা করে তাকে ঘুম থেকে তোলার । ফকিরের ইশারা পেয়ে ব্যগ্র হয়ে সে মর্জিনার শরীরে ধাক্কা দিয়ে পুনরায় বলল - উঠ্ মা, উঠ্ । কোন স্পন্দন নেই বলে সে হতবাগীর মত আশের মানুষজনের দিকে তাকায় । তার বুক ফেটে কান্না চলে আসে । চিৎকার করে সবাইকে বলে - তোমরা মর্জিনারে ঘুম থিইকা তুলো । মর্জিনার গভীর ঘুম । এরপর অনেকেই চেষ্টা করেছে মর্জিনার ঘুম ভাঙ্গাতে কিন্তু কেউ পারে নি । অনন্ত ঘুমের দেশে চলে গেল মর্জিনা ।
©somewhere in net ltd.