নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিকেল বেলা। সূর্য অনেকটাই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। তেজক্রীয়তা নেই বললেই চলে। দূর আকাশের গায়ে ঈষৎ বাতাসের প্রাবল্যে সাদা মেঘের ভেলাগুলো একস্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বায়ুর ঈষৎ উন্মনা প্রবাহ যেন সাদা মেঘের ভেলার সাথে গভীর মিতালি গড়েছে। পাখ-পাখালির কিচির মিচির ক্রমশই বাড়ছে। অদূরেই পিচ ঢালা রাস্তা। পথিকের তেমন একটা আনাগোনা নেই। শিশির জানালার পানে তাকিয়ে দূরের আকাশ দেখছিল আর কী যেন ভাবছিল। এমন মায়ামুগ্ধ নীরব ক্ষণে হঠাৎ করেই দুজন লোক শিশিরের নিকট এল। একজন খোঁড়া অপরজন বোবা। খোঁড়া লোকটার ক্রাচের শব্দে তার ভাবনার বিঘ্ন ঘটল। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই খোড়া লোকটি আদাব দিয়ে সাহায্য চাইল। সাহায্য চাওয়ার সঙ্গে শরীক হল বোবা লোকটাও। কী যে সে দুর্বোধ্য ভাষা!
খোঁড়া লোকটির বয়স আনুমানিক ৩৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে হবে। বোবা লোকটার বয়স তার মুখের অবয়বে তেমন বুঝা গেল না। পঁচিশও হতে পারে কিংবা ত্রিশও। শিশির কৌতূহলবশত সহানুভূতি প্রকাশের ছলে খোঁড়া লোকটাকে জিজ্ঞেস করল- কী নাম আপনার?
-শঙ্খ ঘোষ
-ওনার?
-শাওন
-খুব সুন্দর নাম তো।
- কী যে কন স্যার! আমরা অইলাম গিয়া পতিবন্দী মানুষ; আমাগো নামের সুন্দরই কী আর অসুন্দরেই বা কী আহে যায়?
শিশির নীরব। সত্যিই তো, শঙ্খ ঠিকই বলেছে।
মনে মনে শিশির শঙ্খের কথাকে সমর্থন দেয়। বাস্তবতায়ও এর স্পষ্ট নজির মিলে। প্রতিবন্দীদের নাম যতই সুন্দর হোক তা নিয়ে যেমন সমাজের সামর্থবান পূর্ণাঙ্গ মানুষজন মাথা ঘামায় না, তেমনি তাদের অবহেলিত জীবন-জীবিকা সম্পর্কেও অবগত হতে খুব কম সংখ্যক মানুষই আগ্রহবোধ করে। অসহায়ের মত তাদের দিনের পর দিন অতিবাহিত করতে হয়। ব্যস্ত পৃথিবীর ব্যস্ত মানুষ হৃদ্যতাভরে তাদের হয়ত দুদণ্ড সময় দেওয়ারও অবকাশ হয় না। কঠিন বাস্তবতায় চলতে গিয়ে এই শুশ্রী পৃথিবীটাকেই এখন স্বার্থপর বলে মনে হয়। আর স্বার্থপর পৃথিবীর গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে পৃথিবীর পড়ে পৃথিবীর কর্মব্যস্ত ও সৌখিন মানুষগুলো আরও বেশি স্বার্থান্বেষী হয়ে ওঠেছে। কারও উপকারে না আসলে যেন আবর্জনার মতই হয়ে ওঠে পরিত্যক্ত। প্রতিটা মুহূর্তে তাদের শুধু অবহেলা আর করুণাই জুটে। প্রতিবন্ধীদের না জুটে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, না জুটে একটু ভালবাসা!
খানিক পর চঞ্চলচিত্তে শিশির আবারও প্রশ্ন করে, - কোথায় থাকেন?
-স্যার, আমাগো কী আর বাড়ি ঘর আছে? যেইহানে রাইত সেইহানেই কাইত।
শিশির মুচকি হেসে দরদ ভরা কণ্ঠে আবারও প্রশ্ন করে,- বিয়ে-শাদি করেছেন?
-স্যার,কী যে কন; নিজের পেটই পালবার পারি না আবার বিয়া! আর লেংড়া খোঁড়াগোর কাছে কেউ কি মাইয়্যা বিয়ে দেয়?
শঙ্খের কথায় শিশির নিজের মনে যেন নিজেই হোঁচট খেল। অতঃপর আর কোন কথা না বাড়িয়ে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের করে দেয়। শঙ্খ টাকা নেওয়ার সময় শিশির হাত ইশারা দিয়ে গৃহকর্তা আবুল হোসেনকে দেখিয়ে দেয়। আবুল হোসেনও তাদের প্রতিবন্দী অবস্থা দেখে বেশ কিছু টাকা সাহায্য করেন। শঙ্খ ও শাওন সাহায্য পেয়ে হাত করজোর করে কপালে তুলে জগৎ ঈশ্বরের নিকট কী যেন বিরবির করে প্রার্থনা করল। তাপর পুনরায় আদাব দিয়ে বিদায় নিল।
এরপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। শিশির ও তার বন্ধু খোকন রিক্সা করে বিআইডিসি থেকে শাহপরাণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। রিক্সা এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে হালকা কুয়াশাকে মনে হল রাস্তার দুধারের সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আযানের ধ্বনি সেই সাথে উলুধ্বনিও বাতাসে ভেসে আসছে। পশ্চিমাকাশে ঈষৎ লালিমা ক্রমেই ম্লান হওয়ার পথে। দূর আকাশের প্রান্ত ঘেঁষে কোন কোন পাখি নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। বিশ্বরোডের কিনারে দিয়ে কোন কোন পথিক বাজার-খরচ নিয়ে আপন ঘরের পানে হেঁটে চলছে। পাখিরাও আপন মনে কিচির মিচির করছে। বিশ্বরোডের উপর দিয়ে কর্কশ শব্দ করে অনবরতই ট্রাক চলছে। ট্রাকের কর্কশ শব্দের জন্য সে কিচিরমিচির অনেক সময়ই কর্ণগোচর হয় না।
ক্রমেই আঁধার বাড়ছে। হঠাৎ করেই শিশিরের চোখ পড়ল রাস্তার অদূরে মনোরম সাইনবোর্ড গ্রীনহিলের উপর। ছোট টিলার উপর খুব মনোরম একটি বাসা। বাসার চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সেই সাথে রয়েছে চোখ ধাঁধানো কিছু বিদেশি ফুলও। সাইনবোর্ডটি বাসার ঠিক সামনে টাঙ্গানো।
আবছা আঁধার। দুইজন লোক আলাপ-চারিতায় গ্রীনহিল ভবনের রাস্তা ধরে বেরিয়ে আসছে। শিশির স্মরণ করতে লাগলো এদের কোথায় যেন দেখেছে। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। কিন্তু তারা তো খোঁড়া ও বোবা ছিল! এ দুজন লোকই তো দিব্যি হাঁটতে হাঁটতে আর কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। শিশির ভাল করে চেনার চেষ্টা করে। হ্যাঁ ওরাই তো!
শঙ্খের ক্রাচ কাঁধে, শাওনটাও দিব্যি কথা বলে যাচ্ছে। বিষ্ময়ের ঘোরে অজান্তেই শিশিরের মুখ থেকে বেরিয়ে এল- এটা ঠিক না, এটা অন্যায়। রিক্সা ধীর গতিতে এগিয়ে চলল।
১৫ জুলাই, ২০০৮
বি আই ডি সি, শাহপরাণ, সিলেট
বি দ্র: গল্পটি 'দৈনিক সিলেটের ডাক' পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ২০ জুলাই ২০০৮ ।
২৭ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৩৮
সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: বেঁচে থাকার তাগিদে এরকম অনেকেই তো করছে। কী আর করা!
কষ্ট স্বীকার করে গল্পটি পড়ার জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বর্ষণমুখর সন্ধ্যার সবটুকু ভাললাগা গ্রহণ করুন।
শুভ কামনা সতত।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১৫
নাভিদ কায়সার রায়ান বলেছেন: ইস! শালারা এমন বাটপারি করলো!