নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়ি এবং লেখি

সৃষ্টিশীল আলিম

ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ

সৃষ্টিশীল আলিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

উত্তরাধুনিকতা ও কবি জফির সেতুর কবিতা (সমালোচনা) পর্ব – ৮

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:২৯



সাম্প্রতিক সময়ে সময়ের অখণ্ডতা নিয়ে বিতর্ক বেশ জমে ওঠেছে। প্রথাগতভাবে আমরা সাহিত্যের ক্ষেত্রে, শিল্পের ক্ষেত্রে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে, রাজনীতির ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সময়ের খণ্ডতা অনায়াসে ব্যবহার করে থাকি। আমাদের বুঝবার ও বুঝাবার সুবিধার স্বার্থে এমনটি করা হয়েছে। আসলে সময় কোন বস্তু নয় যে তার ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা আছে। বার্ধক্যকে যেমন বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না তেমনি সময়কেও চক্ষুগ্রাহ্যভাবে ধরা যায় না। সুখ যেমন বিমূর্ত একটি ধারণা তেমনি সময়ও মনুষ্যপ্রজাতির কাছে বহুল আলোচিত একটি ধারণা। পরিচয় আনয়নের জন্য যার পৃষ্ঠ জুড়ে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর বিবিধ সৃষ্টিশীলতা। মূলত সময়ের মাত্রা একটাই। সময় পেছন দিক থেকে সামনের দিকে যাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, সময় জিনিসটা প্রকৃতিতে নেই, আছে মানুষের চেতনায়। চেতনা যদি না থাকে তবে সময়ও নেই।



বহুল বিতর্কের অবসানকল্পে বলা যায়, যদি সময়ের অস্তিত্ব সত্যিই চেতনাতে আছে বলে মনে করা যায়, তাহলে সময়ের যে কোন জায়গাকে অর্থাৎ কালখণ্ডকে যে কোন একটি নাম দেয়াই যায়। কারণ সময় সেভাবে বিভাজিত হচ্ছে, যেভাবে সময়কে দেখা হচ্ছে। তাহলে সময়ের একটা বিভাজিত অংশকে কেউ উত্তরাধুনিক নাম দিতেই পারে যেমন একটি কালখণ্ডকে দেওয়া হয়েছিল আধুনিক নাম।



কালের ঘূর্ণাবর্তে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে। প্রকৃতিতে যেমন পরিবর্তন ঘটে তেমনি ঘটে সাহিত্যে। মূলত তা মানব মনে বিরূপ প্রভাবের কারণেই হয়ে থাকে। অবশ্য সভ্যতার উৎকর্ষতার কারণে মানব মনের গতিপ্রকৃতিতে বেশ প্রভাব পড়ে যা সত্যিকার অর্থেই চোখে পড়ার মত। আর সে ধারাবাহিকতায় মনের বিকাশের সাথে সাথে সাহিত্যের বিকাশও অসম্ভব কিছু নয়। প্রকৃতি ও পরিস্থতির পটপরিবর্তনের কারণে মানবমনে প্রগতিশীলতার ছোঁয়া লাগে এতো চন্দ্র সূর্যের মতই ধ্রুব সত্য। কাজেই নিজের পরিচয় কিংবা নিজের সৃষ্টিশীলতার পরিচয়ের ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিকরা বলতে পারে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আদিম যুগ-এগুলো সবই মনগড়া বিভাজন।



পঠনপাঠনের সুবিধা কিংবা পাণ্ডিত্যের কারণে একজন বা একদল সচেতন মানুষ সময়কে এভাবে ভাগ করেছেন। অর্থাৎ চৈতন্যকেই ভাগ করেছেন। তা যদি যুক্তি হয় তাহলে উত্তরাধুনিক নামক বিভাজনটাকে মেনে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে কোন বিভাজনেরই অর্থ নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না বিভাজনগুলির সঙ্গে সমাজ, মানুষ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থার যোগ স্থাপন করা যাচ্ছে। অর্থাৎ ঘটনা ঘটে সময়ের মধ্যে, ঘটনাহীন সংশয় বোধে বা চেতনায় আনা যায় না কিংবা আরও একটু এগিয়ে বলা যায়, ঘটনাই সময়ের ধারণার জন্ম দেয়, ঘটনাহীন সময় বলে কিছু নেই। এই কথাটা উত্তরাধুনিককেও মানতে হবে। তা না হলে তিনি আধুনিকতার ত্রুটি বা মানব-ইতিহাসের ব্যাখ্যার অক্ষমতা যেমন স্পষ্ট করতে পারবেন না তেমনি উত্তরাধুনিকতার শ্রেয়তা বা গ্রহণ যোগ্যতার ব্যাখ্যাও দিতে পারবেন না।



বিশ্বায়নের প্রভাবের কারণে যেমন ব্যক্তির উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধিত হয়, তেমনি এর প্রভাব পড়ে সাহিত্যে। উত্তরাধুনিককালের যে কয়টি বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল কবি জফির সেতুর ‘স্যানাটোরিয়াম’। এই কাব্যগ্রন্থের বিশ্লেষণে বলা যায় উত্তরাধুনিকতার পথে সদ্য হেঁটে চলা পথিক। অদূরেই যেন গন্তব্য। কাব্যটিতে তিনি নতুন স্টাইল তথা নতুন ধারাও সন্নিবেশ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির পথে মাইলফলক স্বরূপ হয়ে থাকবে।

শুদ্ধস্বর কর্তৃক তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘স্যানাটোরিয়াম’। এতে ৪২টি কবিতা স্থান দেওয়া হয়েছে। বইটি ২০০৮ সালে শুদ্ধস্বর কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে যৌনাঙ্গ, আদিম রস, ঈশ্বর, স্তন, হৃদয়, পুরাণ, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক কবিদের লেখালেখির মাত্রাও চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে যদি তা হয় আদিম রসের নগ্ন প্রকাশ! কবি জফির সেতুর ‘স্যানাটোরিয়াম’ কাব্যে একই নাম ও বিষয়বস্তু থাকলেও ভাব, ভাষা, শব্দ বুনন ও উপস্থাপনে রয়েছ ভিন্নতা। কিন্তু একই নামকরণ থাকা সত্ত্বেও এই বইটির বিষয়বস্তু, প্রকরণ ও উপস্থাপনের ভিন্নতা যে কোন পাঠকের দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে বলে আমি মনে করি। আর সেখানেই মূলত কবি জফির সেতুর নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার পরিচয় বহন করে।



‘বলাকা’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দু-একটি কবিতার নামকরণ করেছিলেন বটে আর বাকীগুলো নাম্বারিং করেছিলেন কিন্তু ভিন্নতা পাই কবি জফির সেতুর ‘স্যানাটোরিয়াম’ কাব্যগ্রন্থে। ‘স্যানাটরিয়াম’ কাব্যগ্রন্থে কবি জফির সেতু ৪২টি কবিতার মধ্যে কোন কবিতারই নামকরণ করেন নি। মূলত কবি জফির সেতুর দৃষ্টি ও প্রত্যয় ভিন্ন। তবুও বলা যায়- কবিতায় তিনি যে ছবি এঁকেছেন তা সমাজ সংকটেরই ছবি, মনুষ্য চরিত্রের ছবি তথা বাস্তবতার ছবি।



বাংলা কাব্যে যখন তথাকথিত উত্তরাধুনিক কবিদের কাব্যের ঝুমঝুমি চরমে ওঠেছে, তাদের কাব্যের বিচার বিশ্লেষণে যখন ‘উত্তরাধুনিকতা’ শব্দটির বিতর্ক চরমে উঠেছে তখন কবি জফির সেতু ভিন্নতার স্বাদ নিয়ে হৃদয়ের ব্যাসন-ভূষণ খুলে নাঙা হাওয়ায় যেন হৃদয়কে মেলে ধরলেন। তপ্ত রোদ্দুরে কৃষক যেমন গাছের নিচে শীতলতার আশ্রয় খুঁজে পায় তেমনি কবি জফির সেতুর ‘স্যানাটোরিয়াম’ কাব্যের শব্দগাঁথুনি ও সাবলিল উপস্থাপনে সচেতন পাঠকমাত্রই শীতলতার পরশ পাবে। কাব্যটির শব্দঝংকারের লালিত্যে গহন রাত্রির নির্জন আকাশের তলায় যেখানে সহজ শান্ত জীবনের আবেগমণ্ডিত গভীর সুরগুলো স্তম্ভিত হয়ে ওঠে পুনঃপুন।



মূলত সময়কে দিয়ে ব্যক্তির বিচার করা হলে তা প্রকৃতপক্ষে একতরফা এবং পক্ষপাতদোষে দুষ্ট বলেই গণ্য হবে। আর তাছাড়া আমাদের কাছে বিচার্য বিষয় ব্যক্তির সৃষ্টিকর্ম, ব্যক্তি নয়। যে আধুনিক আধুনিক কালে বসে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা লালন করে যাচ্ছেন , তাকে যেমন আধুনিক মানুষ বলা যাবে না, ঠিক একইভাবে উত্তরাধুনিককালের এমন মানুষকে উত্তরাধুনিকও বলা সম্ভব হবে না। প্লেটো বা এরিস্টটল অমুক সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই তাঁরা প্রাচীনকালের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন, এই মন্তব্যটা তাহলে ভুল। ব্যক্তির চিন্তাকেও তাহলে লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার দেওয়া যায় না। আমরা অতীতকে টেনে যেমন বর্তমানে আনতে পারি তেমনি, বর্তমানকে প্রসারিত করে তেমনি ভবিষ্যতে নিয়ে যেতে পারি। আমাদের এই ক্ষমতা আমাদের চৈতন্যের বটে, বাস্তবেরও এমন ক্ষমতা আছে কি না কে বলবে।



সময়ের ক্যানভাসে, পঞ্জিকার শিলালিপিতে, জীবনের হিসেব নিকেশ চলে বিরতিহীন। সে হিসেবের হালখাতা যেমন শিল্পের ক্ষেত্রে, ব্যসার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্র, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তেমনি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও নিকেশ করে চলে নিত্য। ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতার নিকেশ চলে অহর্নিশি। আর তার উপর যেন নির্ভরও করে সৃষ্টিশীলতার মর্যাদা। বর্তমানে দশক ধরে, শতক ধরে যে আধুনিকতার মান নির্মাণ হচ্ছে, সেটাও ভুল। যদি ভুল নাই-ই হতো, তাহলে এত শত বছর পর কেউ হোমার পড়ত না।



পণ্ডিতদের যুক্তিতর্কের সার অংশ হিসেবে বলা যায় আধুনিকতা শুধু একটি কালখণ্ড দিয়ে চিহ্নিত করা হয়নি, চিহ্নিত করা হয়েছে কিছু লক্ষণ দিয়ে, কিছু অর্জন দিয়ে। যেমন ইহজাগতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনষ্কতা, যুক্তিবাদিতা। মানুষ তার বিবর্তনের পথযাত্রায় যেসব অর্জন নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে, ইহজাগতিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদিতা ইত্যাদি হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে প্রধান। আধুনিকতাকে অস্বীকার করতে গেলে এসব অর্জনকেও অস্বীকার করা হয়। হয় স্বীকার করতে হয় অথবা বলতে হয় যে, এগুলোর চেয়ে উন্নততর বোধ উত্তরাধুনিকতা মানবজাতিকে উপহার দিয়েছে বা দিতে যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থেও তাই।

উত্তরাধুনিকতার ছাঁচে কবি জফির সেতুর ‘স্যানাটোরিয়াম’ মানব মনের গোপন মন্দিরের কবাট খুলে দিয়েছেন এরপর বৈশ্বিক জোয়ারে এক এক করে হৃদয়ের বস্ত্র খুলেছেন। এমনি চিত্র যেন তাঁর কাব্যে পাই-



“আমরা বন্ধুরা রতিযুদ্ধে বেপরোয়া ঈর্ষা আর প্রতিহিংসায় নির্বোধের এক-একটা বীভৎস হাসি এককালে আমাদের সকল মূঢ়তা ভেঙে অস্থির করে তুলেছিল ভেজাবগলের এক সুগণ্দি নারী বহুকাল আমরা নিতম্বের চর্বি ও কপটতাকে কাঠের চুল্লির ঘর্মক্ততায় প্রক্ষালন করতে দিয়েছি আত্মতৃপ্ত ভড়ঙে লতাগুল্মের ভেতর রুগণ সিংহীর কোমরের নিচে হেসেছি মুর্ছা গিয়েছি আবার প্রাচীন কমেডির মতো পানপাত্র হাতে পাগলাটে জাদুকরের মশকরাও লক্ষ করেছি”

উৎস: কবিতা নং: ২, পৃষ্ঠা: ৮



কবিতাতে বিরাম চিহ্নের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। সচেতন জ্ঞানেই হয়ত কবি বিরামচিহ্নের ভূমিকা থেকে তাঁর কবিতাকে মুক্তি দিয়েছেন। কবিতাকে মুক্তি দিয়েছেন সত্য কিন্তু পাঠকের যেন তাতে বারোটা বেজে তেরটার কাছাকাছি!



নিজস্ব স্টাইল করতে গিয়ে মূলত কবিতায় বাক্যের উপস্থাপনের সাথে গদ্য সৃষ্টির প্রথম দিকের বাক্যের বিশেষ একটা পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। যেহেতু কবিতা পড়া মাত্র আমাদের কোন না কোন জায়গায় থেমে থেমে পড়তেই হয় সেহেতু বিরামচিহ্নের প্রয়োগের আবশ্যকতা রয়েছে। যদিও বর্তমান কবিতাতে এর বহুল প্রয়োগ নেই তথাপিও একেবারেই যে নেই তা কিন্তু নয়। আর বিরাম চিহ্ণ না থাকলেই যে তা বিশেষ অর্থ বহন করবে তা কিন্তু নয়।



“বন্ধুকে বলতে পারো অনায়াসে বলতে পারো বন্ধুর মাকেও আমি পড়েছিলাম তুত রঙের জামা তা এমন আহামারি ছিল না কিন্তু ছিল তোমাদের কবরের মত মাঠভরতি মাঠভরতি জাহাজ আমি ছিটিয়ে ছিলাম কিছু বিষাদবীজ আর অদ্ভূত ঘাসসকল জন্মছিল ধূসররঙ মেয়েদের চোখের ভেতর তা আবার কান্নাও নয় ঠিক যে রকম আমরা প্রত্যাখ্যাত হয়ে উষ্ণ ব্রথেলে যাই কিংবা ফিরে আসি মধুর মাতৃগৃহে”



উৎস: কবিতা নং: ১, পৃষ্ঠা:৭



একটু সূক্ষ্মভাবে বিচার করলেই আমরা অনুধাবন করতে পারব যে সময় মানে হচ্ছে পরিবর্তন। আর পরিবর্তন মানেই কোন না কোন ঘটনা। বাস্তবতার মিশেলে প্রকৃতিতে যার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। অন্যভাবে উদাহরণ টেনে বলা যায় ঘুমের মধ্যে মানুষের কোন সময় নেই। কেননা যে ঘুমিয়ে, তার ক্ষেত্রে ঘুমের সময় কিছু ঘটে নি। অর্থাৎ তার জন্য ঘটনাও নেই। তবে স্বপ্ন থেকে একধরনের সময়ের বোধ জন্ম নিতে পারে। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী স্বপ্নকে কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী বলে মনে হতে পারে যে স্বপ্ন দেখেছে তার কাছে। বোধের এই গোলমাল অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। মোদ্দা কথা হচ্ছে, সময় মানে যেহেতু ঘটনা, সেহেতু ইতিহাস মানেও কিছু ঘটনার সমষ্টি।



বিতর্ক যতই জমে উঠুক না কেন উত্তরাধুনিকতাকে নাকচ করা প্রশ্নই ওঠে না। নাকচ করা মালিক বলে তো কেউ নেই। মূলত কথাটা নাকচ বা গ্রহণ করার নয়। চিন্তার সঙ্গে চিন্তা যোগ হচ্ছে- তার পরিপ্রেক্ষিতে থাকছে সমাজ মানুষ রাজনীতির ইতিহাস। আর চিন্তার ধরনই হচ্ছে কিছু দেয়, কিছু কেড়ে নেয়। একদিক থেকে সত্য অন্যদিক থেকে তা নয়। মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আধুনিকতা শক্ত পায় দাঁড়ালেও এই অভিযোগ তার বিরুদ্ধে অবশ্যই করা যায় যে আধুনিকতা অবলীলায় মেনে নিয়েছে উপনিশবেশবাদ আর জাতি-রাষ্ট্র।



ইতিহাসের আলোকে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠবে- গোটা উনিশ শতক আর বিশ শতকের অর্ধেক জুড়ে আফ্রিকা, এশিয়া আর লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে কোটি কোটি মানুষের পায় শেকল, বুকে পাষাণভার, মাথায় শোষণবুঝা চাপিয়ে দিয়ে মানুষকে জন্তুর পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছিল। আধুনিকতার তত্ত্ব তাতে আপত্তিকর কিছু দেখেনি। জাতিগর্ব, নৃতাত্ত্বিক শ্রেয়বোধের আবরণে সারা পৃথিবী কুক্ষিগত করার আয়োজন কত বীভৎস হতে পারে হিটলার তা দেখিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব ইতিহাসের পরতে পরতে আমরা এর স্পষ্ট নজির দেখতে পাই।

আধুনিকতার তত্ত্ব সেখানেও আপত্তিকর কিছু দেখেনি। উত্তরাধুনিকতাবাদীরা যখন পোস্ট কলোনিয়জিম তত্ত্বসূত্রে সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতির ব্যাখ্যায় প্রভূত হয়ে আধুনিক মানব সভ্যতা ও তথাকথিত মানব প্রজাতির ভেতরের এইসব অসহ নীরব হিংস্র হলাগলের দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তখন তা উড়িয়ে দিতে পারি না।



তবু বলব, উত্তরাধুনিকতাও এক প্রবল ঝোঁকে এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে যে আপত্তি না তুলে উপায় থাকছে না। এ তত্ত্ব কিছুই যেন দানা বাঁধতে চায় না, কল্যাণ-অকল্যাণ, সত্য-মিথ্যা, শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-বিজ্ঞান, ন্যায় অন্যায়, কোথাও যেন কোন একটা লক্ষ স্থির করা যায় না। মানব সভ্যতা, মানবপ্রগতি যেন বিশাল এক গলিতপ্রবাহ- মানুষকে যেন তার প্রবাহের মধ্যে ভেসে যেতেই হবে।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ, অপকর্ষ, ভালো-মন্দ বলে কিছু থাকছে না। কি শিল্প, কি সাহিত্য, চলে যাচ্ছে পাঠকের দিকে। ফলে উত্তরাধুনিকতার দিকে চেয়ে থাকলে শিল্প সাহিত্যের আলোচনা-পর্যালোচনা, সমালোচনা উৎকর্ষ-অপকর্ষের চিন্তাকেই বাদ দিতে হয়। বলতে হয় ‘পথের পাঁচালী’ নিছকই একটা ‘টেক্সট’। এই টেক্সটি আমি যতবারই পড়ে শেষ করেছি ততবারই ‘টেক্সটি’ পাল্টাচ্ছে। যখন একজন পাঠক দশবার ‘পথের পাঁচালী’ পড়ছে তখন দশটি ‘টেক্সট’ পাচ্ছে। এই দশটি টেক্সটের বাইরে পথের পাঁচালির আর কোন অস্তিত্ব থাকছে না, থাকছে শুধ ‘টেক্সট’। তাহলে ক্লাসিক বলতে কিছু থাকছে না। থাকছে না যুগোত্তীর্ণ বলেও কিছু।



দ্বিতীয় ব্যাপটা হচ্ছে, উত্তরাধুনিকরা বক্তব্য সৃষ্টি করার ব্যাপারে বেশ অনুদার। টীকা ভাষ্যের সিঁড়ি দিয়েও এঁদের কাছে পৌঁছানো কঠিন। অনেক সময় মনে হয়, এরা মানুষের খুব বড় মাপের মুক্তির কথা বলেন। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে ধরা পড়ে এই মুক্তি শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতায় নিয়ে পৌঁছুয়। মানুষ এবং মনুষ্যসৃষ্ট সব শিল্প সাহিত্য, সংস্কৃতিকে এঁরা এমন একটি জায়গায় নিয়ে যান, যেখানে এ সমস্ত প্রায় নিরর্থক।



এই তত্ত্বের সঙ্গ বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির ভীষণ মাখামাখি। গোটা পৃথিবী একটা বাজার। সেখানে পণ্য কার জন্য বা কাকে দেওয়া হবে কি হবে না, তা ভাবা হয় না। মানুষকে শুধু পণ্য সৃষ্টিকারী এবং পণ্যক্রেতা-এই দুইয়ের বাইরে অন্যকোনভাবে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে করা হয় না। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির সঙ্গে এই তত্ব সহযোগিতা করেই চলে। ফলে পণ্যসৃষ্টিকারী প্রথম বিশ্বই এই সব তত্ত্বের প্রণেতা। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের মানুষের জন্য তা মারাত্মক বিভ্রান্তি ডেকে আনতে পারে। আধুনিকতা বলে আমরা যাকে চিহ্নত করেছি, বাঙালি সংস্কৃতি ইউরোপীয় রেনেসাঁস থেকে যতটুকু সদর্থকতা গ্রহণ করেছিলো, সেটুকুও এখন মূল্যহীন হয়ে যেতে চায়। অর্থাৎ ইহজাগতিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদীতা- সবই বাতিল হয়ে যাচ্ছে। শেষ ফল দাঁড়াচ্ছে এক চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা।



তবে উত্তরাধুনিকতার তত্ত্ব উন্মীলন ঘটাতে পারে বহু চক্ষু। সেটা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে শিল্পে সাহিত্যে সৃজনশীলতা পেয়ে যেতে পারে অজস্র গতিমুখ। সহস্রচক্ষু শিল্পী অভিনব বয়নে মহার্ঘ সৃষ্টি তুলে দিতে পারেন আমাদের হাতে। তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিল্পীর নিজস্ব দিপ্তী না থাকলে কোন তত্বই তাকে সাহায্য করতে পারবে না।



উত্তর আধুনিকতা নিয়ে আমাদের সুস্থির বিশ্লেষণের চেয়ে আমাদের স্বভাবদোষে উন্মাদনা-উত্তজনাই বেশি চোখে পড়ে। নতুন দর্শন, নতুন চিন্তার হাওয়ায় আমরা উদ্বেলিত হই বেশি। নতুন প্রজন্মের তো কথাই নেই। ষাটের দশকের কথা মনে পড়ে। বিশের দশকের ইউরোপের সাহিত্যতত্ত্ব, শিল্পতত্ত্ব কি প্রবলভাবেই না আমাদের আন্দোলিত করেছিল। তখন ভেসে যাওয়াটাই ছিল আসল, স্থিতিলাভ নয়। এখন ধুলো সরিয়ে দেখা যাচ্ছে সোনা ছিল খুবই কম, পিতলই বেশি। আর সোনা যা ফলেছে, তা লেখকদের সৃজনশীলতার কারণেই। তত্ত্বের সাহায্যে নয়।





তথ্য সহযোগিতা:

1. উৎস: পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা, ভূমিকা- প্রভাত চৌধুরী

2. উত্তরাধুনিক কবিতা (সম্পাদনা)- অমিতাভ গুপ্ত

3. উত্তরাধুনিক চেতনার ভূমিকা- ঐ

4. পোস্টমর্ডান ভাবনা ও অন্যান্য –পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়

5. পোস্টমর্ডান ও উত্তরাধুনিক বাংলা কবিতা পরিচয় – নিতাই জানা

6. উত্তর আধুনিক কবিতা (সম্পাদনা) বীরেন্দ্র চক্রবর্তী

7. কবিতার অন্তর্যামী- খোন্দকার আশরাফ হোসেন।

8. কথা লেখা কথা- হাসান আজিজুল হক







(চলবে)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:৫৩

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: ভালো লিখেছেন। বুকমার্কড করে রাখলাম।

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:২৬

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো।

অনেক ভাল থাকুন। নিরন্তর শুভ কামনা। @কাল্পনিক_ভালোবাসা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.