নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক.
সে অনেকদিন আগের কথা। আলিমপুর গ্রামে বাস করতো এক ইঁদুর ও এক কুনোব্যাঙ। তাদের মধ্যে ছিল বেশ ভাব। একে অপরের বিপদে সর্বস্ব নিয়ে হাজির হতো। কুনুব্যাঙের মূল নাম ছিল ইটন। সে এক মজার ইতিহাস। ইটনের যখন জন্ম হলো তখন তার নানা, নানি, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি, খালু-খালা সবাই এসে উপস্থিত। সবাই খুইব করে ধরল ইটনের দাদুকে। ইটনের দাদু ছিল সাত তল্লাটের মধ্যে সবচেয়ে চতুর এবং রসিক মানুষ। সবাই তার দিকেই তাকিয়ে রইল।
বিটন একটু ভাব নিয়ে বলল- ওর নাম হল- ঐ পর্যন্ত বলেই থেমে গেলেন। নাম আর বলেন না। সবাই বলতে থাকে- বলেন না! সবার পীড়পীড়িতে বলেই ফেলল। ওর নাম হল - দোলা। দোলা!!! বিটনের বউ চেচিয়ে বলল- এটা কোন নাম হলো? বিটন তখন ভ্রু কুচকে নামের ব্যাখ্যা করা শুরু করল। এটা মানব নাম, তবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং মজার। সবাই বলল- কীভাবে?
বিটন তখন বলতে থাকে- ও যখন বড় হবে। স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে তখন তার ছোট যারা আছে তারা তো আর তাকে নাম ধরে ডাকার সাহস পাবে না, তারা তখন তাকে ডাকবে- দুলা ভাই!!! কথাটি শেষ হতেই বিটন পরিবারে হাসির রুল পড়ে গেল। বিটনের ছেলে কিন্তু নাছোর বান্দা। কেউ তার ছেলের নাম নিয়ে পরবর্তীতে টিজ করুক এটা সে কোনভাবেই চায় না। এইকারণে সে বলল- ওটা না হয় তার ডাকনাম হল- আমাদের সম্প্রদায় মেনে তো একটা মূল নাম থাকা চাই নাকি? তখন উপস্থিত সবাই বলল- হ্যাঁ, তাই তো! তখন বিটনই তার নতুন নাম রাখলো-ইটন। সেই থেকে সার্টিফিকেটে তার নাম ইটন।
ইটনের সাথে যে ইঁদুরের ভাব তার নাম পংচি। সব ইঁদুরগুলোর নামের সাথেই সাধারণত চি থাকে। বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে নামের আগে যেমন মোহাম্মদ থাকে, হিন্দুদের নামের আগে যেমন শ্রী থাকে তেমনি আরকি! অর্থাৎ ইঁদুরে মূল নাম হল পং। আর সম্প্রদায়গত নাম হল চি। এই দুই মিলেই নাম হয়েছে পংচি।
এই পংচির সাথে ছিল ইটনের খুব ভাব। তারা দুজনে একই এলাকাতে থাকত। ইটন প্রায়ই পংচিকে মোবাইলে দাওয়াত করে আনত। ব্যাঙরা সাধারণত কলাপাতা দিয়ে মোবাইল বানায়। সে মোবাইল গুলো দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি অদ্ভুত। মজার বিষয় হলো এই মোবাইলগুলো চালাতে কোন ধরনের ব্যাটারি লাগে না। ব্যাঙরাজ্যের বিজ্ঞানী জিমিজিমি ব্যাটারিবিহীন মোবাইল আবিষ্কার করে তো এখন প্রায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছেন। বিশ্ব ব্যাঙসংঘ থেকেও তাকে বেশ দামি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। খ্যাতির বিরম্বনায় এখন সে অনেকটাই অতিষ্ঠ!
যাইহোক, ইঁদুরেরা সাধারণত এই প্রজাতির মোবাইল ব্যবহার করে না। কিন্তু কেউ দিলে তারা আবার না করতে পারে না। পংচির জন্মদিনে ইটন কলাপাতার একটি এন্ড্রয়েড মোবাইল উপহার দিয়েছিল। সেই থেকে তাদের বন্ধুত্বটা আরো বেড়ে গিয়েছে।
পংচির বড় ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে ইটনকে একবার দাওয়াত করে আনলো। তারা যে বাসায় থাকত সে বাসার মালিক ছিল খুবই খারাপ। ইঁদুরদের একটু শব্দ পেলেই লাঠি নিয়ে তেড়ে আসত। ধরতে পারলে তার আর রক্ষে থাকতো না। পংচির বাসায় যেতে ইটনের সাতমাস সাতদিন লেগে গেল।
দুই
বাড়িতে বিয়ের উৎসব চলছে। কত জাতের রান্না! মাটনচি, পোলাওচি, কোর্মাচি, লাচ্চিচি, পিঠাচি, ফুলুদাচি, সন্দেশচি, হালিমচি, পুলিপিঠাচি আরও কত জাতের যে খাবার তার ইয়ত্ত্বা নেই! ইটন তো মহাখুশি। এইরকম খাবার সে আগে কখনো খায়নি। কিন্তু সমস্যা হলো বেশি খেলেই তার আবার বদ হজম হয়ে যায়। মানে পাতলা পায়খানাটাই তার একটু বেশি হয়! বন্ধুর বাড়িতে এসে তাই সে খুউব করে ভাবছে। ভাবলেই আর কী! এতো ভালো খাবার না খেলেই যে নয়! লোভ সামলাতে না পেরে সে খেতই লাগলো। ফলে যা হবার তাই হলো।
ইঁদুরেরা সাধারণ মরাপাতা দিয়ে টয়লেট বানায়। বিশাল আকারের চোঙায় পানিভর্তি করে শৌচের কাজ চালায়। ইটনের তো টয়লেটে লেফট রাইট করতে করতে শরীরের অবস্থা একেবারে প্রায় কাহিল হয়ে পড়েলো। ২০০ বারের মতো টয়লেটের কাজ সেরে বাহিরে আসতেই দেখলো বাসার মালিক দলবলসহ কী যেন পরামর্শ করছে। কাছে যেতেই শুনলো- পংচিদের সমুলে মারার পাঁয়তারা করছে।
ইটন বন্ধু পংচিকে সব খুলে বললো। পংচি প্রথমে বিশ্বাস করলো না। তারপর ঠিকই যখন দেখলো ছোট বাটিতে লাললাল কী যেন মাখা আছে তখনই সে একটু অনুমান করল। একটু পর যখন দেখল অনেকগুলো মাছি বাটির চারপাশে মরে পরে আছে তখনই তার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হল। অবস্থা খারাপ দেখে পংচির পরিবারের সবাই মিলে জরুরি বৈঠক বসলো। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আজ রাতেই তারা এ বাসা ছেড়ে দেবে। আপাদত পংচির নানা বাড়িতে গিয়ে উঠবে। পংচির নানা বাড়ি হল ইটনের এলাকায়। যে কথা সেই কাজ।
সবার জীবন রক্ষা করার জন্য ইটনকে পংচিদের পরিবারের সবাই খুব ধন্যবাদ দিল। বিশেষ করে পংচির মা তো তাকে খুউব করে আদরও করলো। সেই সাথে স্নেহভরাট কণ্ঠে বলল- তুমি আমার আরেক ছেলে। ছেলে কথাটি শুনতেই আনন্দে ইটনের চোখে পানি এসে গেল। তার কারণও আছে। গেল বছর মালবাহি গাড়ির সাথে আকস্মিক দুর্ঘটনায় তার মায়ের অকাল মৃত্যু হয়েছে। সেই থেকে কেউ তাকে ছেলে বললেই সে আহ্লাদে গলে পড়ে।
তারা টিটিংটিটিং নামের দ্রুতযানে চড়ে সাতমাস সাত দিনের মাথায় ইটনের এলাকায় গিয়ে পৌঁছলো। পংচির নানাবাড়িতে যেতে হলে কাঠের সাঁকো পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। একে একে সবাই সাঁকো পাড়ি দিলেও পংচি শ্লিপ কেটে পানিতে পড়ে গেল। পংচির চিৎকার আর দেখে কে! সে কী চিৎকার! তার পরিবারে সবাই দেখছে কিন্তু কেউ কিছুই করার সাহস পাচ্ছে না। খুব ক্ষুরধারা স্রোত। একবার পড়লে আর বেঁচে উঠার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সবাই শুধু কিনারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। বিষয়টি দেখে ইটনের খুবই খারাপ লাগতে লাগলো।
সবচাইতে আশ্চর্য বিষয় হলো পংচির পরিবারের কেউই সাঁতার জানে না। আর এই কারণেই কেউ সাহস করে পানিতে নামছে না। পংচি স্রোতে প্রায় তলিয়েই যাচ্ছে। এমন সময় ইটন পানিতে লাফ দিয়ে পড়ে গেল। অনেক কষ্ট করে পংচির কাছে গেল। পংচিকে বলল- আমার পিঠে ওঠ। পংচি শিশুর মতো তাই করলো। কয়েক ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ইটন নদীর কিনারে পৌঁছল। কিন্তু ততক্ষণে স্রোত তাদের আরেক এলাকায় নিয়ে এসেছে। কিনারে উঠেই পংচি ইটনকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আনন্দাশ্রু ছেড়ে বলল- আমরা একে অপরের জন্ম জন্মের বন্ধু। সেই থেকে ইঁদুর ও কুনোব্যাঙদের মধ্যে এখনো বন্ধুত্ব রয়েছে।
----------------------------
১০.০৫.২০১৫
মুনশি আলিম
টিলাগড়, সিলেট
©somewhere in net ltd.