নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক.
আলুথালু গ্রামে বাস করতো গুলু নামের এক গাঢ় ব্যাঙ। সে ছিল বনিয়াদি বংশের সন্তান। যেমন ছিল দেখতে সুন্দর তেমনি ছিল উদার। সৌখিনতার ক্ষেত্রেও তার জুড়ি মেলা ভার! বাজারে নতুন নতুন পোশাক আসলে তার আগে কেউ কিনতে পারতো না। তবে তার একটি বিশেষ গুণ ছিল সে কখনো বিদেশি পোশাক পড়তো না। সে প্রায়ই তার সমমনা বন্ধুদের বলতো- দেশি পণ্য কিনে হোন ধন্য। তার বন্ধুরা তাকে বলতো -তুই, এখনো সেকেলেই রয়ে গেলি! গুলু কিন্তু বন্ধুদের কথায় মোটেও পাত্তা দিত না।
তার খুব কাছের বন্ধুর নাম হচ্ছে পিংলু । চিন্তা-চেতনায় সে ছিল আপাদমস্তক পশ্চিমা সংস্কৃতির। তার কারণও আছে। তার দাদা চিংলু দীর্ঘদিন প্রবাস যাপন করেছে। দুহাতে প্রচুর টাকাও ইনকাম করেছে। অনেক সম্পত্তি নিয়ে দেশে ফেরার পাশাপাশি সে আরেক সর্বনাশা জিনিস নিয়েও দেশে আসে। আর তা হল বিদেশি অসংস্কৃতি। তাদের এলাকায় যৌতুক প্রথা ছিল না। সর্বপ্রথম তিনিই যৌতুক নিয়ে বিয়ের প্রচলন শুরু করলেন। ধীরে ধীরে এ রীতি সমস্ত গ্রাম অতঃপর অন্যান্য গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়লো। আকথা, কুকথা যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তেমনি এ রীতিটিও একসময় সমস্ত ব্যাঙরাজ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো।
পিংলুর বড় ভাই বিংলুর বিয়েতে যাওয়ার সময় দাদা চিংলু হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে তাদের পারিবারিক অবস্থা অবনতির দিকে যেতে থাকে। এর নেপথ্যে আরেকটি কারণ হলো তার বাবার স্বেচ্ছাচারিতা ও অমিতব্যয়িতা। ফলে দ্রুতই তারা দরিদ্য হতে লাগলো।
এদিকে দেখতে দেখতেই পিংলুর বোন মিংলু বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেল। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে, কিন্তু সব জায়গা থেকেই পাত্ররা মোটা অংকের যৌতুক চায়। মোটা অংকের যৌতুকও সংগ্রহ করতে পারে না, মিংলুর বিয়েও দিতে পারে না। পিংলুর বাবার চিন্তার যেন শেষ নেই। চিন্তা করতে করতে অচিরেই তার মাথার সব চুল পড়ে একেবারে টাকলু হয়ে গেল।
দুই.
বর্ষার সময় হঠাৎ একদিন নৌকা করে করে গুলু তাদের বাড়িতে এল। তখন তাদের পারিবারিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। অভাব অনটনের কারণে অর্ধহারে-অনাহারে তাদের পরিবারের সবাই যেন কঙ্কালসার হয়ে পড়েছে। মিংলুর চেহারাতেও আগের মতো সেই লাবণ্যতা নেই। গুলুকে দেখে পিংলুর বাবা তেমন একটু খুশি হলেন না। বরং আচার-আচরণে এমন একটা ভাব করলেন যাতে খুব দ্রুতই গুলু বিদায় নেয়।
গুলু ছিল খুব চালাক এবং জ্ঞানী। সে পিংলুর বাড়ির সবাইকে একসাথে ডাকলেন। উদ্দেশ্য সবার সাথে মিটিং করা। গুলুর সাথে মিটিং? পিংলু তো হেসেই বাঁচে না। রসিকতা করে বলে- তুই ব্যাটা সেকেলের মানুষ; তুই মিটিংয়ের কী বুঝিস? গুলু কেবল ম্লান হেসে বলল- মিটিংয়ে সবাই উপস্থিত থাকলে পরিবারের তথা সমস্ত এলাকারই মঙ্গল হবে। লাভের কথা শুনে পিংলু ক্ষণিকের জন্য থামলো। মাথা নিচু করে কী যেন ভেবলো। তারপর বলল- বেশ, তাই হবে।
সন্ধ্যার সময় পিংলুর বাড়ির ছোটবড় সবাই বাংলা ঘরে এসে হাজির হলো। গুলু মিটিং শুরু হওয়ার আগে একটু আড়চোখে মিংলুর দিকে তাকাল। মিংলুর গোলালুর মতো সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে সে যেন কী ভাবলো। কিন্তু এর কিছুই প্রকাশ করলো না।
গুলু বলতে থাকে- আপনারা কী জানেন- আপনাদের এই বিদেশি পোশাক পরিচ্ছদের কারণেই আপনাদের ব্যবসার বারোটা বেজেছে? আপনারা কী জানেন- এই পোশাক পরিচ্ছদের কারণেই আপনাদের পরিবারের মেয়ে মিংলুর যৌতুকের ডিমান্ড কয়েক লাখের নিচে নামে না? এ তো গেল একদিক। আর দিকও আছে। এলাকার সাধারণ মানুষ মনে করে আপনারা আচার-আচরণে, পোশাক-পরিচ্ছদে স্বগোত্রের হলেও স্ববর্ণের নন। না আদর্শগত দিক থেকে, সততার দিক থেকে। ফলে ভিতরে ভিতরে কেউই আপনাদের সাথে আত্মীয়তা করতে চায় না। মিংলুর জিন্সপ্যান্ট পরা ও উগ্র চলাফেরাকে এলাকার কেউই ভালো চোখে দেখে না।
মনে রাখবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনারা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত এলাকার মানুষও আপনাদের সহজভাবে মেনে নেবে না। আমার কথায় আপনার হয়ত রাগ করতে পারেন। আমাকে চরম ঘৃণাও করতে পারেন, আবার এও বলতে পারেন, ছোট হয়ে জ্ঞান দিচ্ছি! কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য আমার দায়বোধ থেকেই আমি আপনাদের বলছি। আপনারা যদি পরিবারের সবাই মনে মনে স্থির করেন দেশীয় সংস্কৃতি লালন করবেন তাহলে আমি আপনাদের এক ম্যাজিক প্রজাপতি দিব। মনকে পরিশুদ্ধ করে এটার নিকট যে কোন ধরনের সহযোগিতা চাইলে আশা করি এটা করবে। তবে হ্যাঁ, অবহেলা করে এটাকে ফেলে দিলেও কিংবা নির্যাতন করলে কিন্তু চরম খেসারত দিতে হবে। বলেই সে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পিংলুর হাতে প্রজাপতি ধরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
পিংলুর তো হাসিই পেল। উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলল- পুরান পাগলের ভাত নেই, নতুর পাগলের আমদানি! প্রজাপতি নাকি সহযোগিতা করে!!! হায়রে পাগল!!! বলেই সে প্রজাপতির ডানার একটি অংশ ছিড়ে ফেলল। ডানা ছিড়া মাত্রই সবচেয়ে ছোট শিশু চিৎকার করে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যেই তার সমস্ত শরীরে বসন্ত ফুটে ওঠলো। পিংলু তবুও ভয় পেল না। এরপর যখন অপর ডানার কিছু অংশ ছিড়ে ফেলল- তখন মিংলুর সমস্ত শরীরে বসন্ত দেখা দিল। এতে করেও তার বিশ্বাস হচ্ছিল। সে পুনরায় আরেকটু অংশ ছিড়তেই তার সমস্ত শরীরে বসন্ত রোগ দেখা দিল। শরীর জুড়ে সে কী যন্ত্রনা! এই অভাবের দিনে ভালো ডাক্তার কীভাবে দেখাবে? ঔষধইবা কোথায় পাবে? টাকা পয়সার যা অভাব!
পিংলুর বাবা অনেকটা ভয় পেয়ে গেল। এরপর যদি সত্যি সত্যি আরেকটু ছিড়ে তবে বোধহয় এবার তার পালা! অনেকটা ভয়েই সে চিৎকার করে ওঠলো। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন- পিংলু থাম। আর না বাবা! সত্যিই আমাদের আচরণগত ত্রুটি আছে। আমরা পোশাকে আশাকে উরনচণ্ডি বলেই আমাদের দোকানে কোন কাস্টমার আসে না।, আমাদের উগ্র আচরণের কারণেই এলাকার মানুষ আমাদের সাথে ভালো করে কথা বলে না। নতুন করে কেউ ব্যবসা করতে চায় না। এমনকি চরম বিপদের সময়ও আমাদের কেউ কোন কিছু ধার দেয় না।
কথাটি বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি । মিংলু বললেন- বাবা, এখন থেকে তুমি যা বলবে আমরা তাই করবো। চোখের পানি মুছতে মুছতে পিংলুর বাবা বললো- মা, মারে! আয়, আজ থেকে এই প্রজাপতির কথাই শুনি। দেখি আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় কিনা! পিংলুরও তখন ভুল ভাঙ্গলো।
পরিবারের সবাই মিলে তখন প্রজাপতির কাছে বলল- আমাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে চাই। সাহায্য করুন। প্রজাপতি ক্ষীণ গলায় বলল- সবার আগে আপনাদের পোশাক পরিবর্তন করুন। দেশীয় পোশাক পরে আগামীকাল থেকে দোকানে যান, দেখবেন দুএকদিনের মধ্যেই আপনার দোকানের বিক্রি ১০০ গুণ বেড়ে যাবে।
তিন
পরের দিন। যে কথা সেই কাজ। পোশাক পরিবর্তন করে দেশীয় পোশাক পরে দোকানে গেল। দেশীয় পোশাকে পিংলু ও তার বাবাকে দোকানে যেতে দেখে এলাকার মানুষের মধ্যে সহসাই শোরগোল পড়ে গেল। তাদের এই পরিবর্তন দেখে একে একে অনেকেই তাদের দোকানে আসতে থাকে। কেউ দেখতে আসে, কেউ আগ বাড়িয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে আসে। কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের ব্যবসার প্রচুর উন্নতি দেখা দিল। ছয় মাসের মধ্যেই তারা এক দোকান থেকে কয়েক দোকানের মালিক হয়ে গেল। তাদের পরিবারে আর কোন দুঃখ রইল না। কেবল একটাই আক্ষেপ ভালো ঘর থেকে মিংলুর বিয়ে আসে না। সবাই মিলে আবারও প্রজাপতিকে বলল কিছু একটা উপায় বের করতে। প্রজাপতি হেসে বলল- ওর বর তো আগে থেকেই ঠিক।
-আগে থেকে ঠিক মানে?
- মানে খুব সোজা। আপনার বাড়ির উত্তর দিকে এক সবুজ রঙের গাড়ি আছে। কয়েক হাড়ি মিষ্টি নিয়ে ঐ গাড়িতে চড়ে সবাই রওয়ানা দেন। গাড়িটি যেখানে গিয়ে থামবে, সেটাই হলো মিংলুর শ্বশুর বাড়ি। প্রথমে যাদের সাথে দেখা হবে তারা হবে মিংলুর শ্বশুর-শাশুড়ি। পরে যার সাথে দেখা হবে সেই হবে মিংলুর বর! মনে রাখবেন, বিশ্বাস না করলে মিংলুকে আর কোনদিনও বিয়ে দিতে পারবেন না। পিংলু প্রথমে পাত্তা দিতে চাইলো না। কিন্তু শেষটায় তার বাবার পীড়াপীড়ির কারণেই সে রাজি হয়ে গেল।
সবুজ গাড়িটি চলছে। একগ্রাম, দুইগ্রাম তিনগ্রাম, কিন্তু পথ যেন আর ফুরোতেই চায় না। তিনরাত তিনদিন চলার পর গাড়িটি বিরাট এক সবুজ বাড়ির সামনে এসে থামলো। প্রকাণ্ড বাড়ি দেখে তাদের ভালোই লাগলো। বহুতল ভবন। এমন সুন্দর বাড়ি যেন কয়েক তল্লাটেই নেই। এবার বর পছন্দ হলেই হয়! পিংলু ও তার বাবা মিষ্টির হাড়ি নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই বাড়ির ভিতর থেকে গুলুর বাবা ও মা এগিয়ে এসে বললো- আসুন বেয়াই সাহেব, আসুন।
কী তাজ্জব! সব কিছুই যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। প্রজাপতির কথা সবই যে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। কী করে তারা চিনলো? তাদের বিস্ময়ের যেন আর শেষ নেই। একটু পর গুলো বেরিয়ে আসলো। গুলোকে দেখে পিংলুর বাবা তো অবাক! সে কী! তুমি? এ বাড়ি তোমার? মানে তোমাদের? গুলু ক্ষীণস্বরে বলল- জী।
হঠাৎ পিংলুর বাবা গুলুর হাত ধরে বলল- বাবা, আজকে আমার পরিবারের যা উন্নতি হয়েছে সবই তোমার জন্য। ... তোমার আপত্তি না থাকলে মিংলুকে তোমার হাতেই তুলে দিতে চাই। গুলু কেবল মৃদু স্বরে বলল- বেশ, আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই হবে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিয়ের আয়োজন করা হল। সবুজ গাড়ির মধ্যে পিংলুর বাড়ির ছোট বড় সবাই এসেছে। একে একে সবাইকে বাড়ির ভিতর নিয়ে আসা হলো। চারদিকে দেশীয় ব্যাঙীয় সঙ্গীত শুরু হয়ে গেল। দেশীয় পিঁপড়া ঢুলীদের খবর দেওয়া হল। মুহূর্তের মধ্যেই তারা এসে হাজির। দেশীয় নৃত্ব্য শুরু হল, সেই সাথে দেশীয় খাবার। সাতদিন রাতরাত ধরে গুলুর বিয়ের উৎসব চলল।
অতঃপর গুলু ও মিংলু সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।
----------------------------
১১.০৫.২০১৫
মুনশি আলিম
টিলাগড়, সিলেট
২| ২০ শে মে, ২০১৫ রাত ৮:০৪
সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা জানবেন। শুভ কামনা সতত।
©somewhere in net ltd.
১| ২০ শে মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৬
বালক বন্ধু বলেছেন: ভাল লাগল।
বিশেষ করে গল্পে গল্পে ছোটদের দেশকে, দেশের পণ্যকে ভালবাসতে শেখাচ্ছেন। চালিয়ে যান। আশা করি একদিন বড় লেখক হয়ে উঠবেন।