নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়ি এবং লেখি

সৃষ্টিশীল আলিম

ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ

সৃষ্টিশীল আলিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

উত্তরাধুনিকতা ও কবি জফির সেতুর কবিতা: পর্ব - ৯

২২ শে জুন, ২০১৫ রাত ১১:৩৬



কাব্য: ডুমুরের গোপন ইশারা

ডুমুরের গোপন ইশারা- কাব্যবিশ্লেষণ

জগদ্বিখ্যাত নেপোলিয়ান বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে শিক্ষিত একজন মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত একটি জাতি দেব”। কবি জফির সেতুর ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ পড়ে আজ কেন যেন নেপোলিয়নের সেই বিখ্যাত উক্তিটি সংশোধন করে বলতে ইচ্চে করছে- “তোমরা ডুমুরের গোপন ইশারা’র মতো ভাল একটি কবিতার বই দাও, আমি তোমাদের কাব্যজগৎকেই বদলে দেব”! ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ নিঃসন্দেহে কবি জফির সেতুর অন্যতম শেষ্ঠ কাব্য। তাঁর সামগ্রিক কাব্যবিচারে এটা বললে বললে বেশি অত্যুক্তি হবে না যে, উত্তরাধুনিক কাব্যযাত্রায় যারা এগিয়ে আছেন চিরতরুণ কবি জফির সেতু তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম।


২০১৪ সালে সিলেটের চৈতন্য থেকে প্রকাশিত হয় ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ কাব্যটি। দুই ফর্মার বই। এটি কবির ১০তম বই। কলেবরে ছোট হলে কী হবে কথাসাহিত্যের মতোই এটিও অনেকটা চুম্বকের মতো পাঠককুলকে ধরে রাখে। না পড়লে আমার কথার সত্যতা হয়ত অনুমান করা যাবে কিন্তু প্রমাণ করা যাবে না!

তাঁর প্রথম বই ‘বহুবর্ণ রক্তবীজ (২০০৪) থেকে ১০তম বই ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ (২০১৪) বইটির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। অনেকটা আকাশ পাতাল তফাত! এই পার্থক্যের মূল হেতু যেমন ভাষার সরলীকরণে, প্রকরণে তেমনি বিষয়বস্তুতেও। তাঁর প্রকাশিত কাব্যের তালিকা নিম্নরূপ:

বহুবর্ণ রক্তবীজ (২০০৪)
সহস্র ভোল্টের বাঘ (২০০৬)
স্যানাটোরিয়াম (২০০৮)
তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১)
সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২)
জাতক ও দণ্ডকারণ্য(২০১৩)
সুতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা (২০১৪)
Turtle Has No Wings (2014)
ময়ূর উজানে ভাসো (২০১৪)
ডুমুরের গোপন ইশারা (২০১৪)
প্রস্তরলিখিত (২০১৫)
ইয়েস, ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস (২০১৫)


‘ডুমুর’ শব্দটি বিশেষ্য। সাধারণ অর্থে আমরা বুঝি সুপরিচিত গাছ ও ফল। কিন্তু ব্যবহারিক অর্থে আমরা এর ভিন্নতা দেখি। ‘ডুমুরের ফুল’ বলতে বোঝায় ‘অদৃশ্য বস্তু’। মূলত ডুমুরের ফলের মধ্যেই ফুল থাকে তাই ফুল দেখা যায় না। প্রকৃত অর্থে ‘ডুমুর’ শব্দটি শুনলেই আমরা কেন যেন একপ্রকার মিষ্টিরিয়াস তথা রহস্যময়তার গন্ধ পাই।



প্রকৃতপক্ষে, ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ কাব্যের মধ্যে রহস্যময়তার লেশও নেই। বরং জোছনালোকিত চন্দ্রের মতোই উজ্জ্বল। শরৎকাশে রাতের গায়ে ফুটে থাকা অসংখ্য উজ্জ্বল তারকারাজির মতোই তার কাব্যের শব্দমালা। কাব্যের পংক্তিগুলো আনমনেই টেনে নিয়ে যায় দূর থেকে দূরান্তরে।

‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ কাব্যে মূলত কবি সময়কেই ধরতে চেয়েছেন। উত্তরাধুনিক কবিতাগুলো এখন মিথ নির্ভর হয়ে উঠছে। নাদুসনুদুস ছোট বাচ্চাদের দেখলেই যেমন কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে, তেমনি কবি জফির সেতুর ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ কাব্যের ক্রমধাপে সাজানো পুক্তিগুলোকে মনের কোঠরে আগলে রাখতে ইচ্ছে করে। প্রকরণে অভিনব একটি বই। আগেই বলেছি যে, প্রধান কবিরা অন্যকারো নির্দেশিত পথে হাঁটেন না, তাঁরা নিজের পথ নিজেই সৃষ্টি করে নেন। কবি জফির সেতু হচ্ছেন তেমনই একজন প্রধান কবি। কবিতার ক্ষেত্রে নিজেই নতুন প্রকরণ সৃষ্টি করেছেন তথা সাহিত্যের নতুন মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন।

প্রশ্ন জাগতে পারে- শুধু প্রকরণ সৃষ্টি করার মাঝেই কি সার্থকতা? উত্তর অবশ্যই না; যদি না সে প্রকরণ সার্থক রূপ লাভ করে। বাংলা কাব্যগগণের প্রথম বিদ্রোহী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজে ছন্দ জানতেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল- তিনি জেনেই প্রথম ছন্দ ভেঙ্গেছেন। ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যটিই তার প্রমাণ রাখে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, যারা ভাঙ্গতে জানে, তারা গড়তেও জানে। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, “ যারা গড়তে জানে তারা কাদামাটি টিপে বাদরও গড়তে পারেন আবার শিবও গড়তে পারেন”। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন তার অমর মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের মাধ্যমে তা প্রমাণ করেছেন তেমনি প্রমাণ করেছেন একালের তরুণ কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য চিরতরুণ কবি জফির সেতু। গতানুগতিক ধারাতে যে তিনি লিখেন না, তা তাঁর কাব্যপাঠেই বুঝা যায়।

‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ কাব্যটির প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, তা মিথ বা পুরাণ নির্ভর। এতে দুটি পর্ব রয়েছে। আর দুই পর্বেই রয়েছে মিথের শক্তিশালী দুই চরিত্রের কাব্যিক ট্র্যাজিক পরিণতি। তিনি প্রথম পর্বটি নিয়েছেন [বাইবেল, আদি (২১:১০-১৪), অনুবাদ: অরবিন্দ দে] থেকে। আর দ্বিতীয় পর্বটি নিয়েছেন [শ্রীমদ্ভগবদগীতা, একাদশ অদ্যায় (৩১-৩৩), অন্বয়ানুগামী অনুবাদ: রাজশেখর বসু] থেকে।

কবি একদিকে যেমন সময়কে ধরতে চেয়েছেন অন্যদিকে তেমনি মিথের দুই ট্র্যাজিক চরিত্রকে ভেঙ্গেছেন। মূলত কাব্যের কথামালার সংক্ষিপ্ত পৃথিবীতে সংবেদনশীল কবির অনুভূতি ও উপলব্ধিতে সময়ই হয়ে উঠেছে মিথ, নিয়তিনির্দিষ্ট ভাগ্যাহত ট্র্যাজেডির নায়ক। এককথায় বলা যায়- তাঁর বিনির্মিত চরিত্রদ্বয় যেন তার মানবতা লাঞ্ছিত রক্তাক্ত স্বগতোক্তি। মূলত বৃহৎজীবনের সঙ্গে, পুরাণের সঙ্গে যেন সময়ের মেলবন্ধনকেই তিনি সুচারুরূপে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন।

মানুষ সমাজে বাস করে বলেই তাকে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাস করতে হয়। তবু সব সীমাবদ্ধতাকে যেন তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে উপযুক্ত শব্দ নির্বাচনের মাধ্যমেই ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ কাব্যকে সার্থক করে তুলেছেন। অর্থাৎ শব্দ নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি মোটেও দ্বিধাগ্রস্থ নন। যে শব্দটা বেশি উপযুক্ত মনে করেছেন সে শব্দকেই তিনি গ্রহণ করেছেন।
ভদ্রসমাজে অনুচ্চারিত অনেক শব্দকেই তিনি অকপটে উচ্চারণ করেছেন তাঁর কাব্যে। বিশেষ করে যৌনঘেঁষা শব্দগুলোকে তিনি অহরই তাঁর এ কাব্যে যত্রযত্র ব্যবহার করেছেন। ঐ যে বললাম- আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেকেরই যেমন সম অধিকার থাকে তেমনি তিনি মনে করেন কবির কাছেও সব শব্দ সমান। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আর এই কারণেই হয়ত যৌনঘেঁষা শব্দগুলোর বিচরণই তাঁর কাব্যে একটু বেশি মিলে।

স্বভাবসুলভভাবে আমরা রং চা পান করি। কিন্তু কোন চা’য়ে যদি লিকার একটু বেশিই কড়া হয় তবে তা কিন্তু অনেক সময়ই পান করার অযোগ্য হয়ে পড়ে! কবি জফির সেতুর ক্ষেত্রেও বলা যায়, অতিমাত্রায় ঐসব শব্দগুলো কাব্যের পেয়ালায় একটু যেন বেশি কড়া লিকারের মতোই! আপাত দৃষ্টিতে বুঝা না গেলেও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ঠিকই বুঝা যায়।

শুধু সমকালীন সাহিত্যিকরা নন, কোন কালের সাহিত্যিকরাই কোনভাবেই অত্যধিক যৌনঘেঁষা সাহিত্যকে ভালোভাবে গ্রহণ করেন নি। বিশেষ করে তথাকথিত ভদ্রসমাজের পাঠক এবং লেখক বলে যারা স্বীকৃত! আর এক শ্রেণির সমালোচক তো রয়েছেনই যারা - কীভাবে তা চটি বইয়ের আওয়াতায় এনে অনায়াসেই তা অপাঠ্য ঘোষণা করা যায় সে ধান্ধাতেই ব্যস্ত! উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- সাইয়েদ জামিলের বর্তমান পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যাপারটি। তার প্রতিটি কবিতাতেই যেন যৌন সুড়সুড়ি রয়েছে। অর্থাৎ তার কবিতা পাঠ মাত্রই যৌনতার বাতাসে যেন শরীর সিক্ত হয়ে উঠে। ফলে কোন সাহিত্য আসরে বসে তার কবিতা আবৃত্তি করাই যেন ভীষণ মুশকিলের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যদিও বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন, “সাহিত্যে অশ্লীলতা বলতে কিছু নেই”। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হল- আমার কাছেই যদি সেরা উপায় থাকে তাহলে আমি অন্যের পরামর্শ নেব কেন? অর্থাৎ অশ্লীল শব্দ পরিহার করে যদি আমি সত্যিকারের সেরা সাহিত্য নির্মাণ করতে পারি তবে মোহিতলালের কথা মানবো কেন? অন্যান্যরাও বা কেন মানবে?

একসময় বাংলাদেশে সাহিত্য নির্ভর সিনেমা নির্মাণ করা হতো আর তা পরিবারের সকলে বসেই উপভোগ করা যেত কিন্তু কালের স্রোতে সে সমস্ত সাহিত্য নির্ভর সিনেমা যেমন এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে ঠিক তেমনি দৈন্যদশা যেন কবিতার ক্ষেত্রে! কবির কবিতা যদি ভদ্রমহলে পাঠ না-ই করা যায় তবে বঙ্কিমের ভাষায় বলতে হয়- তবে কবিতা বৃথা হইল!

এ তো গেল একদিক। অন্যদিকও আছে আর সে কৃতিত্বের জন্য এ বিষগুলোও অনায়াসেই ম্লান হয়ে যায়। কাব্যের মধ্যে কথার মায়াজাল সৃষ্টি করতে কবি জফির সেতু খুবই সিদ্ধহস্থ। কাব্যপাঠ মাত্রেই তা অনুধাবণ করা যায়। ভাষার সরলীকরণও চোখে পড়ার মতো। যেমন:

দেখো এই ছোট্ট হাত দুটো আর তীব্র আঙুলগুলো
আমার হিজল ফুল রং আকাঙ্ক্ষার মেঘ
অজাচার ভেবে ফিরিয়ে দিয়োনা আমাকে।


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ০৭

একসময় বলা হত উপমাই হচ্ছে কবিত্ব। একদৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তা একেবারেই নিছক বলে মনে হয় না। পড়ামাত্রই কবিতা যদি হৃদয়কে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে স্পর্শ না করে তবে তা সত্যিকার অর্থেই কবিতার মর্যাদা পায় না। কবি জফির সেতু উপমার প্রয়োগে যেন সিদ্ধহস্থ। যেমন:

আমার চিকন ঠোঁটদুটো ঘনঘন শিহরিত হচ্ছে
পাকা গমের রঙে পুরুষ্টু হয়ে আছে, আর নানাবর্ণ
তুমি স্পর্শ করো, দেখবে অন্ধকার ঠিকরে বেরুচ্ছে আলো
আমার ঠোঁটের প্রান্তে জেব্রার দীর্ঘ সারি


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ০৮

কাব্যপাঠে কখনো কখনো মনে হবে দুনিয়ার সব রোমান্টিতাই যেন তাঁর কাব্যের পঙক্তির ভাঁজে ভাঁজে। পাঠ মাত্রই তা যেন ভিজিয়ে দেয় হৃদয়ের গোপন দহলিজ।





এসো, আরও একটা জন্ম চোখে চোখ রেখে কাটিয়ে দিই
...............................................................
আমার শরীর তো তোমারও শরীর
----------------------------------
তোমার চোখের ভেতরে এক টলটলে পৃথিবী
ওতে গান গাইছে ঘোটকস্বরূপ ব্রহ্মের বীজকোষ


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ০৯


কবি জফির সেতু এ কাব্যে মূলত রক্তপিপাসু সময়কেই ধরতে চেয়েছেন পৌরাণিক ট্র্যাজিক চরিত্রকে আশ্রয় করে। কথার মালা গাঁথতে গাঁথতে তাঁর কাব্য ক্রমশই হয়ে উঠেছে বৈশ্বিকমানের। তাঁর চিন্তার ব্যাকরণ অনায়াসেই ছুঁয়ে যায় বিশ্বপরিমণ্ডলের নগ্ন ক্যানভাস। শাসকের স্বরূপ উন্মোচনেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। যেমন:

তোমার লোমশ হাত বেয়ে যে- বোমা ফেটেছিল হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে
যে-আগুন জ্বলেছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে
সে-হাত আমি চিনি;
সে হাতের স্পর্শ আমার স্তনে লেগে আছে
আমার দেহবৃন্তে যে-রক্তিম দাগ
নখের আঁচড়
সে-ই আজ কৃষ্ণবর্ণ তমাল, আসলে শ্রীকৃষ্ণ


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ১১

ফলের দোকানদাররা যেমন ক্রেতাদের মুগ্ধ করতে ফলগুলোকে সুসজ্জিত করে রাখে তেমনি চিত্র দেখি চিরতরুণ কবি জফির সেতুর কাব্যে। কথার মালাকে তিনি সাজিয়েছেন মনের মতো করে। কবির কথার গাঁথুনি যে কোন পাঠকের হৃদয়কেই অনায়াসে ছুঁয়ে দিবে। যেমন:

দেখো আমার জামার ভেতরে বুড়ো লোকটা
যার চুলের গোছায় জ্বলত নক্ষত্র আর সমুদ্রের ফেনাপুঞ্জ
এখন সে শুধুই এক কঙ্কাল


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ১৪

কবিতার ভিতর তিনি সানন্দে ইতিহাসকে টেনেছেন। ইতিহাসের ভিতরের ইতিহাসকেও যেন তিনি টানতে বাদ রাখেননি। সভ্যতার উৎকর্ষের দাঁড়প্রান্তে থেকে ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে তিনি চলে গেছেন প্রাগৈতিহাসিক মুহূর্তে। নভোচারীদের মতো বিচরণ করেছেন যত্রতত্র। যেমন:

দেখো আমাকে , আমার শতচ্ছিন্ন দেহ
আসলে আমি লক্ষ বছরের জীবাশ্ম
নিজের কঙ্কালের চেয়ে প্রাচীন


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ১৭

‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ কাব্যটির দ্বিতীয় পর্বটি তিনি শুরু করেছেন প্রশ্ন দিয়ে। কিন্তু এরপরেই দেখি সম্মোহনী লাইন! যেমন:

কী আছে তোমার চোখে?
...........................
তোমার চোখদুটি তখনও ব্যাকুল সন্ধ্যা
পৃথিবীর অন্ধকার কোণে গুঞ্জরনরত বৃক্ষ হয়ে জ্বলে
আর মৌমাছির পাখনার পেরেকে বিদ্ধ নিজেকে
কেবলি অচেনা মনে হয়।


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ২১

তুচ্ছ জিনিসকেও যেমন কালজয়ী কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসে অত্যন্ত দরদ দিয়ে শ্রেষ্ঠমানের করে ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনি দেখি কবি জফির সেতুর কাব্যে।

থুতু থেকে জন্ম নিয়েছি তোমারই আকাঙ্ক্ষায়;
আমার সারা গায়ে মূঢ় অধঃপাত
----------------------------
আমার আত্মার ভাষা মিশে যায় রাতের নৈশব্দ্যে
আমি দেখি তারামাছ খেলা করে উজ্জ্বল সৈকতে


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ২২


তাঁর কাব্যের দুটি পর্বের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তই পুরাণের এবং ইতিহাসের গন্ধ মেলে। অন্নদাশঙ্করের কথাসাহিত্যে যেমন আধ্যাত্মিকতার ঘ্রাণ মেলে, বিশ্ববিখ্যাত লেখক এডগার এলানপোর লেখায় যেমন রহস্যময়তার গন্ধ মেলে, ওয়ার্ডওয়ার্থের কাব্যে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঘ্রাণ মেলে, কীটসের কাব্যে যেমন প্রকৃতির রূপ রস গন্ধের প্রাধান্য মেলে, বায়রনের কাব্যে যেমন বিদ্রোহীর ঘ্রাণ মেলে, কোলরিজ কাব্যে যেমন অতি রোমান্টিকতার ঘ্রাণ মেলে, মার্বেলের কাব্যে যেমন অতিকাল্পনিক শরীরের গন্ধ মেলে, মার্কিন কবি রবাট ফ্রস্টের কাব্যে যেমন চরম বাস্তবতার ঘ্রাণ মেলে, ওয়াল হুইট ম্যানের কবিতায় যেমন সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিকতার ঘ্রাণ মেলে, বাংলাদেশে পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের কাব্যের পরতে পরতে যেমন পল্লির গন্ধ মেলে, শামসুর রাহমানের কাব্যের শরীর জুড়ে যেমন শহুরে ঘ্রাণ মেলে, সমরসেনের কাব্যে যেমন নাগরিকতার ঘ্রাণ মেলে, শঙ্খঘোষের কাব্যে যেমন জীবন জটিলতার ঘ্রাণ মেলে তেমনি কবির এ কাব্যপাঠেও ইতিহাস ও পুরাণের গন্ধ মেলে। কেবল চোখ-কান খোলা রেখে পঠন-পাঠন করলেই অনায়াসেই সে ঘ্রাণ নেওয়া যাবে।

কিন্তু আমার অন্ধ ভবিষ্যৎ স্লিপিং পিলের মতো কাঁপতে থাকে
----------------------------------------------
সত্যিকার ঈভ শুয়ে আছে স্বর্গের উদ্যানে
কিন্তু তোমার শরীরে উঠে এল সাপ, শুঁকে নিল কিছু
তার মসৃণ পেটের চিহ্ণ তোমাকে খুঁজছে


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ২৪

সময়ের সাথে পুরাণ কিংবা পুরাণের সাথে সময়- উভয়ই যেন তাঁর কাব্যে অভিন্ন প্রাণ। মূলত সংবেদনশীল কবির অনুভূতি ও উপলব্ধিতে সময়ই হয়ে উঠেছে মিথ।

তোমার অভিমানী লাল ঠোঁট, যিশুর গোপন বাগান
আর মনে পড়ছে চাবুকের রক্ত
আর মনে পড়ছে ঈশ্বরের চোখ
সুতরাং তোমার নগ্ন পেটে আমি সূর্য এঁকে দিতে পারি
আর তোমার কান্নাভেজা চোখে যবগাছের চারা
রোপন করে দিতে পারি।


উৎস: ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’: পৃষ্ঠা: ২৯

সর্বোপরি বলা যায়, সব ঝিনুকেই যেমন মুক্তা থাকে না, তেমনি সব কাব্যের মধ্যেও ইতিহাস, পুরাণ ও সময়কে সত্যিকার অর্থে খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা তা পারে তাঁরা সত্যিকার অর্থেই কালজয়ী স্রষ্টা। এজন্যই হয়ত জীবনানন্দ দাশ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। অসংখ্য কালো গরুর মধ্যে যেমন শাদা গরুটি অনায়াসেই চিহ্নিত করা যায় তেমনি হাজার কাব্যের মধ্যেও কবি জফির সেতুর এ কাব্যটি প্রকরণ ও গুণগত মানের কারণে নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম, বাংলা কাব্যের জন্য মাইলফলক তো বটেই।

মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট
২২.০৬.২০১৫
ইমেইল: [email protected]


মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.