নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক.
আয়েশি অপরাহ্ণ। তবু মনে হল পৃথিবীর কোল জুড়ে খা খা রোদ্দুর। দূর আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে যেন শাদা মেঘের ভেলাগুলো মুচকি হাসছে। গুমোট নির্জনতা ছেয়ে ফেলেছে পুরো মাছিমপুর। উত্তরীয় বাতাস বইছে। হঠাৎই নির্জনতা ভেঙ্গে রাস্তার পাশ থেকে ভেসে আসে অশ্রাব্য গালিসমগ্র!
-মাগির গরের মাগি! ছিনাল! খানকি কোহানকার! তর পোলায় আমার মাইয়ারে মারলো ক্যান? নিজের মতো পুলাডারে খবিছ বানাইছত...।
- তুই মাগি, তুই খানকি বেটি! তর চৌদ্দগুষ্ঠী... তর পোলায় আমার কইলজার টুকরা সোনার পোলার লগে লাগলো ক্যান?
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গালিগুলো শুনতে ছিলেন তাহের। প্রথম প্রথম তার কাছে এসব গালি খুব খারাপ লাগত কিন্তু এখন এসব গালি তার কাছে তেমন একটা আবেদন সৃষ্টি করে না। কেননা দুদিন অন্তর অন্তরই এ মহল্লায় এইরকম শ্রাব্য-অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজের মহরা চলে! অর্থাৎ গিঞ্জিমারা পরিবেশ থাকায় প্রায়শই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ফলে ওসব ঘটনা তার কাছে নিত্য ডাল-ভাতের মতোই মনে হয়!
মহল্লার একেবারে শেষের দিকে তার বাড়ি। তাহের কমান্ডারের বাড়ি বললে এলাকার ছোট-বড় সকলে এক নামে চিনে। কমান্ডার মানে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার। লোকটা দেখতে অনেকটাই খর্বাকায়। ছিপছিপে গড়ন। বয়সের ভাড়ে প্রায় অনেকটাই নুয়ে পড়েছেন। ভালো করে হাঁটতেও পারেন না। ক্রাশে ভর দিয়ে হাটেন। যুদ্ধের সময় বা পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর অনেকবারই সে ডাক্তারের সরণাপন্ন হয়েছিল কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। বাধ্য হয়েই তাকে বাম পা অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয়েছিল। সেই থেকে এখনও তিনি ক্রাশে ভর করে হাঁটেন। কিন্তু কে বলবে- যৌবনে এই লোকটারই যে ছিল অমিত তেজ!
টিনসেড ঘরের ভিতর ৪টি রুম। তারই এক অপরিচ্ছন্ন রুমে তাহের থাকেন। সন্তানাদি বলতে দুই ছেলে। একজন দেশের বাইরে আরেকজন দেশেই কৃষি কাজকর্ম করে দিনাতিপাত করে। অবশ্য বড় ছেলে তানিম বছর পাঁচেক হল খান বাড়ির মেয়ে মালেকাকে বিয়ে করেছে। বছর খানেক যেতে না যেতেই তাদের ঘর উজ্জ্বল করে এক ফুটফুটে ছেলের জন্ম হল। দেখতে রাজপুত্তুরের মতো বলে আহলাদ করে নামও রাখলো রাজা! মালেকা এখন তার নিজের ছেলে রাজাকে নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করে।
বছর চারেক হল তাহেরের স্ত্রী রেণু বেগম মারা গেছেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি অনেকটাই মুষড়ে পড়েছিলেন। কেননা, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার স্ত্রীর মতো করে আর কেউ-ই তার যত্ন নিবে না। হলোও তাই। রেণু বেগম মারা যাওয়ার বছর খানেক যেতে না যেতেই তাহেরের ওপর শুরু হয়েছে মালেকার অবহেলা। তারই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। তারেকের ভাগ্য ভালো যে সরকারের কাছ থেকে এখনো কিছু ভাতা পাচ্ছেন। আর সে কারণেই বুঝি রক্ষে!
ছোট ছেলে তীবরীজ তাহেরকে খুবই ভালোবাসে। বিদেশ থেকে প্রায়ই সে তাহেরের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা পাঠায়। খোঁজ-খবর নেয়। যতবারই তার ছোট ছেলে তীবরীজ বিদেশ থেকে ফোন করেছে ততবারই সে হাসি মুখে কথা বলেছে। হাজার কষ্ট হলেও ছেলে এবং ছেলের বউয়ের অবহেলার লেশও তার মুখ থেকে কখনো ফুটে ওঠেনি। বিদেশ থেকে আসা টাকার সবটাই চলে যায় মালেকার হাতে। শুধু কি বিদেশ থেকে আসা টাকা! তার নিজের মুক্তিযোদ্ধার ভাতাও তুলে দিতে হয় মালেকার হাতে।
দুই.
ক’দিন হলো তাহেরের শরীরটা বেশ ভালো যাচ্ছে না। শরীরে জ্বর জ্বর অনুভব হচ্ছে। বিশেষ করে গত কয়েকদিন আগে পাকা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। মাথায় আঘাতের চেয়ে ডান পায়ের আঘাতই সে বেশি পেয়েছিল। বেশ খানিকা কেটে গিয়েছিল। যা এখনো ভালো হয়নি। সেই ক্ষতাক্ততা নিয়েই সে আজ ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। বড় ছেলেকে বলতে বলতেও তার আর ঔষধ কিনে দেওয়ার সময় হয়ে ওঠে না। আর মালেকা বেগমের তো সময়ই নেই! কাজেই অনেকটা বাধ্য হয়েই সে বের হয়েছিল। ডাক্তারের বাড়ি প্রায় আধঘণ্টার পথ। আজ সে পথ পাড়ি দিতে হল প্রায় দুই ঘণ্টায়। একে তো রিক্সা এমনিতেই কম তার উপর আবার ধর্মঘট! হায়রে! বিপদ যেন তার পিছু ছাড়ছেই না।
বাড়িতে এসেই সে খুব ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। শরীর জুড়ে তাপের পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছে। দেখতে দেখতেই তা মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। প্রচণ্ড জ্বরে তাহের কাঁপছে। কেবল একবার মুখফুটে অস্ফুট স্বরে বলল- বৌ একগ্লাস পানি খাওয়াইবার পারবা? খুব পানি ঠিলাস(পিপাসা) লাগছে।
পাশের রুমে বসেই মালেকা উচ্চশব্দে ডিশ চ্যানেল দেখছিল। ভারতীয় সিরিয়াল। সিরিয়ালে সে এতই মগ্ন হয়েছে যে বুড়ো তাহেরের কথা শুনে সে যারপর নাই বিরক্তই হল। তবুও বিরক্তিস্বরে সান্ত্বনার আশ্বাস দিয়ে বলল- আইচ্চা। কিন্তু এরপর যেন মালেকার আর কোন খবরই নেই!
ভারতীয় সিরিয়ালগুলো যেন কেমন- ঠিক ছাগলের সংখ্যাধিক বাচ্চা প্রসবের মতো! অর্থাৎ একের পর এক যেন বিয়োতেই থাকে! মালেকা দেশিয় চ্যানেলগুলো খুব কমই দেখে। চিন্তার পুরো বলয় জুড়ে যেন হিন্দি চ্যানেলের ভূত আঁকড়ে রয়েছে। ভারতীয় সিরিয়ালে অভিনেত্রীদের অভিনয়ের প্রতি যতটুকু না তার মোহ তার চেয়ে দ্বিগুণ মোহ তাদের পোশাকের প্রতি, অলংকারের প্রতি! পাখি ড্রেস, কিরণমালা ড্রেস... যত প্রকারের ড্রেসই বাংলাদেশে আসুক না কেন তার কিন্তু পোশাকগুলো চাই-ই চাই।
তানিম মালেকার কাছে অনেকটাই নাজেহাল। তার অবশ্য কারণও আছে। বিয়ের সময় মালেকার বাবার কাছ থেকে যৌতুকস্বরূপ মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছিল। অবশ এ টাকা তাদের চাচা মোদাব্বের হোসেনের কারণেই নেওয়া! যদিও এ টাকার প্রতি তাহের কিংবা তানিমের লোভ ছিল না এবং পরবর্তীতে তার বেশির ভাগ অংশই মালেকার চিকিৎসাবাবদ ব্যয় হয়েছে তথাপিও এ যৌতুক! এর দায়ভার তানিমের উপরই বর্তায়। আর সেকারণেই বোধকরি মালেকার মন জয় করতে তাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। তানিম মিতভাষী। ফুটফুটে ছেলে জন্ম দেওয়ার পর থেকেই মালেকার প্রতি তার ভালোবাসার পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। সবক্ষেত্রেই মালেকার কথাকে প্রাধান্য দেয়। প্রাধান্য দিতে দিতে এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, অনেকটা বাধ্য হয়েই মালেকার অন্যায় আবদারের কথা শুনতে হয়!
নিজস্ব সংস্কৃতির সংজ্ঞা মালেকার জানা নেই, সুতরাং লালনের তো প্রশ্নই ওঠে না। সিরিয়ালটি শেষ হতে হতে প্রায় পৌনে একঘণ্টা লেগে গেল। এর মধ্যে সে একবারের জন্যও ওঠেনি। সিরিয়াল শেষ হলে হঠাৎ তার মনে হল শ্বশুরের পানির কথা। গ্লাস হাতে নিতেই মালেকার ছোট বোনের ফোন। সেকি আলাপ! যেন ফুরোতেই চায় না। আরও প্রায় আধঘণ্টার মতো চলে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাজু চিৎকার করছে। মালেকার বুঝতে বাকী নেই যে তার ক্ষিদে পেয়েছে। ফলে সে ছেলের খাবার তৈরির জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল।
তিন
এদিকে সকাল থেকেই তীবরীজ চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু কোনভাবেই তার বাবা তাহেরের মোবাইলে সংযোগ দিতে পারছে না। ‘বিশ্ব বাবা দিবস’ থাকায় খুব ভোর থেকেই সে চেষ্টা করে যাচ্ছে তাহেরের সাথে কথা বলার। “কতদিন হয় বাবার সাথে কথা হয় না!” গত পরশু দিন কথা বলেছে। কিন্তু আজকেই তার মনে হল- তা যেন অনেক দিন! ‘বাবা দিবসে’ তাহেরেকে কে উপহার দেওয়ার জন্যই সে নতুন পাঞ্জাবি কিনেছে, পাজামা কিনেছে, ঘড়ি কিনেছে জায়নামাজ, সুগন্ধি আরও কত কী! কিন্তু শতবার চেষ্টা করেও মোবাইলে সংযোগ দিতে ব্যর্থ হল। মনে মনে তাহেরের উপর তার ভারি রাগ হলো। ভাবীরটাতেও যতবার চেষ্টা করেছে ততবারই এনগেজড মেরেছে। হায়রে! অভাগা যেদিকে যায় সাগরও শুকায়ে যায়। তার কেবলি মনে হতে লাগলো -বিধি বাম! তবুও হাল ছাড়েনি, এখন না হোক, রাতে তো বলা যাবে- নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।
রাত সাতটার দিকে তীবরীজ আবারও কল দেয়। তাহেরের নাম্বার বন্ধ। তীবরীজ চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। মালেকের মোবাইলে কল দেয়। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বলে- বাবার সাথে কথা বলব, একটু নিয়ে যান তো। মালেকা কথা বলতে বলতে শ্বশুরের রুমে নিয়ে যায়। তীবরীজকে শুনিয়ে বেশ আবেগাপ্লুত কণ্ঠে শ্বশুরকে ডাকছে- বাজান, বাজান, ছোট ভাইয়ে কল দিছে। এই নেন। বলেই সে মোবাইলটি শ্বশুরের হাতে দেয়। হাতটি বিছানা থেকে বাহিরের দিকে প্রসারিত করা ছিল। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তাহের। তার চোখের দৃষ্টিতে মিশে আছে নানা অপ্রাপ্তির অভিমান! মুখের ডানপাশ দিয়ে শাদা ফেনা বের হচ্ছে। সহসাই তাহেরের হাত থেকে মেঝতে পড়ে যায় মোবাইলটি। পড়তেই দু-টুকরা হয়ে গেল!
মালেকা রাগে ফুসতে থাকে। ধরাজ গলায় বলে- হালার বুইড়া, মরেও না, আমারে শান্তিও দেয় না। খালি অনিষ্ট করে, মাইনষের কত আর কুলায়!!! এমনো শত ভৎর্সনা মুখে এনে গজরাতে হজরাতে চলে গেল। রাত নয়টার দিকে তানিম জিজ্ঞেস করলো - বাবা খাইচে?- না, বুড়াডায় কোন কিছু খায়ও না, মরেও না, আজকে আমার মোবাইলডা ভাইঙ্গা ফালাইছে। জানে কত্ত কুলায়, কও? তানিম কী যেন একটু ভাবলো তারপর বলল- কও কী! বাজানে মোবাইল ভাঙ্গছে?
- হ, আমি কী তোমার লগে মিছা কতা কই? যাও তোমার পরানের বাজানরে জিগাওগা! কেন মোবাইল ভাঙ্গলো?
তাহেরের উপর তানিমের কেন যেন রাগ হতে লাগলো। মাস দুয়েক হলো তাকে নতুন মোবাইল দেওয়া হয়েছে। কম দামী মোবাইল বিধায়ই হয়ত পছন্দ হয়নি, কিন্তু তাই বলে মালেকার দামী মোবাইল ভাঙ্গতে হবে কেন? তার রাগের মাত্রা ক্রশই বাড়তে থাকে। তবুও ভাতের প্লেট নিয়ে তাহেরের রুমে প্রবেশ করে।
তাহেরের দিকে তাকিয়ে বলছে- বাজান খাও। তাহের ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। কোন প্রতিউত্তর নেই। বিছানার পাশে ছোট টেবিলে খাবার রেখে দেয়। চলে যেতে যেতে বলে- বাজান খাইয়া নিও। হঠাৎই তার মনে হল- বাবা শত রাগ থাকলেও তো কথা বলে, কিন্তু আজ বললো না কেন? সহসাই সে ফিরে আসে, তাহেরের কাছে যায়। চোখের দিকে তাকায়। অভিমান মাখা ভারী নিষ্পলক চোখ! তানিম আঁতকে ওঠে। বাবার চোখের পলক পড়ছে না কেন? ভালো করে খেয়াল করার চেষ্টা করছে। সত্যিই তো চোখের পাতা তো পড়ছে না! মুখের মধ্যেও শাদা ফেনা! দ্রুত তাহেরের হাত ধরে। সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন। তানিম জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে- বাজান, বাজান গো...
চারদিকে ঘন অন্ধকার, থমথমে পরিবেশ। পশ্চিমাকাশে মেঘের ভীরে একফালি কাটা চাঁদ গোপন দুঃখ নিয়ে ক্রমে ক্রমে ম্লান হয়ে গেল মহাকাশের গহীন থেকে গহীনে।
-------------
মুনশি আলিম
৩০.০৬.২০১৫
জাফলং, সিলেট
ইমেইল: [email protected]
©somewhere in net ltd.