নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়ি এবং লেখি

সৃষ্টিশীল আলিম

ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ

সৃষ্টিশীল আলিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প \'অভিমান\'

০৭ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:১১









এক.

- মাগিগো গরু ছাগলের নিগা ক্ষেত করন যাইবো না দেকতাছি! খানকি বেটিগো গরু-বাছুর আবার আইলে বাইন্দা খোয়ারে দিবি, বুজলি?
মিনারার কথা শুনে মাথা নাড়ে আলেকজান।
-বুজছত তো?
আবারও মাথা নাড়ে আলেকজান। সব কথারই উত্তর দিতে হয় না, কিছু কিছু কথার উত্তর বাচনভঙ্গিতে দেওয়াই শ্রেয়, তাতে যেমন কথোপকথনের মধ্যে বৈচিত্র্যতা আসে তেমনি একঘেয়েমি ভাবও দূর হয়। মিনারা তাহের মোল্লার প্রতিবেশী। তার রি রি করা বাজখাই গলার স্বর সে প্রায় প্রতিদিনই শোনে। মিনারা একবার কথা শুরু করলে যেন আর থামতেই চায় না। মধ্যবয়সী হলেও তার চেহারার মধ্যে এখনো উঠন্তি যুবতীদের উজ্জ্বলতার ছাপ রয়েছে। স্বামী ইরফান যুদ্ধে শহিদ হওয়ার পর পাঁচ সন্তান-সন্ততি নিয়ে বেশ একটা কায়-ক্লেশেই দিনাতিপাত করে। ইরফান ছিল তাহের মোল্লার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা দুজনে একই সেক্টরে কাজ করেছে।

একবার সুনামগঞ্জ সদরের পাশে ব্রিজ ভাঙ্গার এক অপারেশনে তাহের-কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিল। মিলিটারিদের সাথে তখন সেকি যুদ্ধ! গুলির শব্দে যেন আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠছিল। ধূলিবালি আর ধোঁয়াতেও প্রায় ছেয়ে যাচ্ছিল আকাশ। সাধারণ মানুষজন তখন ভয়ে দুরুদুরু কাঁপত। বিশেষ করে ছেলে-বুড়োরা নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বের হতে চাইত না। কেননা, বের হলে ফিরে আসার নিশ্চয়তা থাকতো না। তখন সাধারণ মানুষজন যেন অনেকটা কীটপতঙ্গের মতোই ছিল অসহায়। এলোপাথারি গুলির শব্দ। হঠাৎ একটা গুলি...!
তাহের উহ্! করে উঠলো। এগিয়ে এল ইরফান। ভালো করে তাকিয়ে দেখে তাহেরের বাম পা এফোড় ওফোড় করে একটি গুলি বেরিয়ে গেছে। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ইরফান কাছে আসতে চাইল কিন্তু তাহের তাকে কাছে আসতে বারণ করে দিলেন। বললেন- আমি নিজেকে সামলে নিতে পারবো। আমার অনুপস্থিতি যেন আমার সেক্টরের কোন যোদ্ধা বোঝতে না পারে।

কমান্ডারের আদেশ বলে কথা! না মানলেই যে নয়। কিন্তু তার মনটা পড়ে রইল তাহেরের কাছে। কেননা, তাহেরের কাছে সে অনেকভাবেই ঋণী। কী দেয় নি তাহের! টাকা-পয়সা তো আছেই, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে শরীরের পোশাক পর্যন্তও দিয়েছে। নিজের রক্তের ভাইও আজকাল নিজের ভাইয়ের প্রতি এমন দরদ দেখায় না! মুহূর্তেই নানা স্মৃতি তাকে কুড়ে কুড়ে খাওয়া শুরু করলো। শেষপর্যন্ত সে আর নিজের মনকে মানাতে পারলো না। হামাগুড়ি দিয়ে তাহেরের কাছে চলে এল। তাহেরের শত ভৎর্সনা সত্ত্বেও নিজের কোমরের গামছা দিয়ে তার পা বেঁধে দিল। তাহেরের শরীর ক্রমেই শীতল হয়ে আসছে। রক্ত সরিয়ে গামছা বেঁধে দেওয়ার সময় ইরফানের মনের অজান্তেই দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল তাহেরের পায়ে।

ইরফানের মমতায় তাহেরও নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ঢুকরে কেঁদে উঠলো। দুহাত দিয়ে ইরফানকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। পরক্ষণেই ইরফানের কপালে চুমু খেয়ে বললো- ভাই, ভাই আমার; আমার শরীর নাড়াতে পারছি না। আজ তোমাকেই হাল ধরতে হবে। আমার জন্য ভেবো না। সামনে যাও। আমার দিব্যি রইল। নিজের প্রতি খেয়াল রেখো।

ইরফান চোখ মুছতে মুছতে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে গেল। চারিদিকে প্রচণ্ড গুলির শব্দ। কান বন্ধ হয়ে আসার মতো শব্দ। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল ইরফান। হঠাৎ একটি গুলি এসে বিদ্ধ করলো ইরফানকে। ঠিক যেখানটায় তাহের চুমু খেয়েছিল।

কেবল একবার ‘ভাই’ বলে চিৎকার হলো। এরপর শশ্মানের মতোই চারিদিকে নীরবতা নেমে এল। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের কারণে তাহের আগেই জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিল। ফলে ইরফানের শেষ চিৎকার শুনতে পায় নি। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলো সে ক্যাম্পে। জ্ঞান ফিরতেই সে জিজ্ঞেস করলো- ইরফান কোথায়? সহযোদ্ধা আইনুল অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রইল। কেউ কোন কথা বলছে না দেখে তাহেরের মনটা ছ্যাৎ করে উঠলো। জোর গলায় বললো- তোমরা কথা বলছো না কেন? ইরফান কোথায়? আইনুল ক্ষীণস্বরে বললো- স্যার আপনি অসুস্থ, আগে সুস্থ হোন সব বলবো। -আমি সুস্থ, আমাকে বলো ইরফান কোথায়?

আইনুল একটু সরে গিয়ে ইরফানের রক্তে রঞ্জিত জামাগুলো নিয়ে এল।
-স্যার,
-বলো।
-স্যার, আপনি শক্ত হোন। সব বলছি।
- তুমি বলো। ব্রীজের ঐ অপারেশনে ইরফান ভাই প্রচণ্ড দুঃসাহসিকতার সাথে আপনার দায়িত্ব পালন করছিল। অপারেশনটাতে আমরা যখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনি একটি গুলি এসে ইরফান ভাইয়ের ঠিক কপালের মাঝখানটায় এসে লাগে! আইনুলের কণ্ঠ ধরে আসে। আর কিছু বলতে চেয়েও আর বলতে পারে না। হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠে। পোশাকে চুমু খেয়ে বলে- এই তো আমাদের ইরফান ভাই! এই তো আমাদের ইরফান ভাই!! এই তো আমাদের ইরফান ভাই!!!

আজ বিছানায় শুয়ে হঠাৎ করেই মনে হল বন্ধু ইরফানের কথা। মুক্তিযুদ্ধে তার মহান আত্মত্যাগের কথা। বয়সের ভাড়ে তাহের অনেকটাই নুয়ে পড়েছে। আগে ক্রাশে ভর দিয়ে হাঁটতে পারতো। কিন্তু ইদানিং শরীর বেশি দুর্বল হওয়ায় সে একেবারেই বিছানাতে থেকে উঠতে পারে না। তিন ছেলে-মেয়ের ছোট সংসার। আগে তার স্ত্রী রিনা বেগমই তার শ্মশ্রুষা করতো। বছর দুয়েক হলো তার স্ত্রী প্রয়াত হয়েছে। ফলে তাহের আগের মতো সেবা-শ্মশ্রুষা না পেতে পেতে দিনকে দিন আরও রুগ্ন হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে এখন সে বিছানা থেকে উঠতেই পারে না। নিজের দেহের ওপর তার নিজের নির্ভরতাও খুব কম। কথা বললেও এখন বেশ জড়িয়ে যায়। সবগুলো কথাও বুঝা যায় না। বিদেশি ভাষায় অজ্ঞ লোকদের যেমন বিদেশি ভাষা বুঝতে কষ্ট হয় তেমনি আরকি!

বিছানাতে পড়ায় কয়েকদিনের মধ্যেই ছেলে তারেক এবং ছেলের বউ তানহা মহা বিরক্ত হয়ে উঠলো। কর্মশক্তি ক্ষীণ হওয়ায় সহসা তাহের যেন হয়ে উঠেছে আপাঙক্তেয়! ঠিক অনেকটা শস্যক্ষেতের আগাছার মতো! তারেক তার স্ত্রী তানহার সাথে বুদ্ধি করে - দু একের মধ্যেই দলিল দস্তাবেজ ঠিক করে ফেলতে হবে। কেননা, যে কোন দিনই এখন তিনি বিদায় নিতে পারেন। যে কথা সেই কাজ। ঠিক করলো দুইদিন পরেই দলিলে তাহেরের স্বাক্ষর নেওয়া হবে।


দুই.


পরের দিন। তানহার বান্ধী উর্মিলার জন্মদিন। জন্মদিনে উপলক্ষ্যে তারা সপরিবারে নিমন্ত্রিত। দুপুর হতে না হতেই তারা রওয়ানা হয়ে গেল। এদিকে বাসায় শুধু ছোট্ট একটি কাজের মেয়ে। রান্নার কাজ দ্রুত শেষ করতে গিয়ে হঠাৎ তার হাত পুড়ে যায়। ফলে সে রান্নার কাজ অসমাপ্ত রেখেই বিদায় নেয়।

বিকেল বেলা। তাহেরে খুব তেষ্টা পেল। গলা যেন ক্রমশই শুকিয়ে আসছে। মুখ দিয়ে একবার গুংগুং করলো। প্রচণ্ড ক্ষুধায় এর চেয়ে বেশি জোরে সে আর শব্দ করতে পারছে না। কেউ সহযোগিতা না করায় বিছানাতেই সে পায়খানা করেছে। লুঙ্গিতে ভরে তা ধীরে ধীরে তার শরীরেও লেপ্টে গেল। গু’য়ের গন্ধে কোথা থেকে যেন কালো মাছিরা দৌড়ে এল। চিনির গন্ধ পেলে যেমন পিঁপড়েরা দৌড়ে আসে ঠিক তেমনি গু’য়ের গন্ধ পেলেও কালো মাছিরা!

বিছানার পাশেই ছিল টেবিল। সে টেবিলে রাখা ছিল পানির গ্লাস। তাহের শরীর নাড়তে খুব চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। হাত দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করলো। যৌবনে যুদ্ধের ময়দানে কতভাবেই না হামাগুড়ি দিতে হয়েছে। আজ যেন শেষ যুদ্ধ! পানির জন্য হামাগুড়ি দিতে দিতে টেবিলের কাছে যায়। টেবিলে ধাক্কা লেগে গ্লাসটি হঠাৎ পাকা মেঝতে পড়ে সাথে সাথেই চৌচির হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত তাহেরও তার শরীরের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে পারলো না। মেঝতে পড়ে গেল। আর মেঝতে পড়তেই গ্লাসের ভাঙ্গা অংশ তাহেরর একেবারে মাথার পিছনে বিদ্ধ হল। ঠিক যেভাবে গুলিবিদ্ধ হয়।

এদিকে জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিশেষ পার্টিতে আনন্দ করতে করতে রাত বেশি হয়ে যায়। ফলে উর্মি তাদের আসতে দেয় নি। পরের দিন বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। বৈদ্যুতিক বাতির সুইচ অন করাই ছিল।দুদিন ধরেই ফ্যান ও বাতি বন্ধ করা হয়নি। বিদ্যুৎ চলে গেলেই কেবল বন্ধ হয়।

দলিল হাতে প্রথমেই তাহেরের রুমে প্রবেশ করলো তারেক। পিছনে তার স্ত্রী তানহা। রুমে প্রবেশ করতেই তারেকের চোখ যেন কপালে উঠার মতো অবস্থা হয়ে গেল। একি অবস্থা! বাবা তুমি নিচে কেন? এত রক্ত কেন?

গু’য়ের গন্ধে এমনিতেই কালো মাছিগুলোর ভীড়ও ছিল দেখার মতো। তার উপরে বমির উৎকট গন্ধ! তানহা বমির ভাব করতে করতে বাইরে বেরিয়ে গেল। বড়ই বিচিত্র মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি! মানুষের কান্না দেখলে যেমন কান্না পায় ঠিক তেমনি বমি দেখলেও বমি পায়। নাক চেপে কাছে যায় তারেক। মাথার দিকে ভালো করে খেয়াল করে। মাথা থেকে যেন ঝর্ণার মতো করে রক্তের নহরা বয়ে গেছে। খাটের নিচে ছুপছুপ রক্তে ভরে গেছে। তার মনের ভিতর অজানা শঙ্কায় হু হু করে উঠলো। তারেক চিৎকার করে ডাকছে- বাবা! বাবা! কথা বলো!
তাহের নিষ্পলক। সে চাহনির ভাঁজে ভাঁজে বোবা অভিমান ঠিকরে বেরিয়ে আসছে! অদূরেই বিদ্যুতের আলোয় চকচক করছে রক্তস্নাত চূর্ণবিচূর্ণ গ্লাস ভাঙ্গার টুকরো।

-------------------
০৭.০৭.২০১৫
মুনশি আলিম
পূর্ব শিবগঞ্জ, সিলেট




মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:০৩

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: দুর্দান্ত গল্প! এখনো আমাদের দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধারা কতো কষ্টেই না আছে, ভাবতে কষ্ট লাগে ।

০৭ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:১৮

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: ধন্য হলাম। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা।

:) :D

২| ০৭ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:০৩

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: দুর্দান্ত গল্প! এখনো আমাদের দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধারা কতো কষ্টেই না আছে, ভাবতে কষ্ট লাগে ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.