![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবি খালেদ উদ-দীন ১৯৭৮ সালের ১০ মে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার সরুয়ালা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত কবি। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি কবিতা চর্চার সাথে জড়িত। বলা যায় কিশোর বয়সেই তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার অন্দর মহলে প্রবেশ করেন। যার নির্যাস আমরা দেখতে পাই তাঁর প্রথম কাব্য রঙিন মোড়কে সাদা কালো (২০০৮)-এ । তিনি অনুকরণে বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করেন না চৌর্যবৃত্তিতেও। তবে নিজেকে নব্বই দশকের কবি হিশেবে পরিচয় দিতে মোটেও দ্বিধাবোধ করেন না। তাঁর কবিতার মধ্যে মাটির ঘ্রাণ খোঁজে পাওয়া যায়। ভাষার সরলীকরণেও তিনি বেশ সিদ্ধহস্থ।
মূলত নব্বইয়ের দশকেই তাঁর উত্থান। কবি খালেদ উদ-দীনের প্রথম কাব্য রঙিন মোড়কে সাদা কালো (২০০৮)-বইটিতে তিনি ভাষার সরলীকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ নৈপুণ্যতা দেখিয়েছেন। এতে মোট মোট চল্লিশটি কবিতা রয়েছে। প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী হাজরা। বইটি ঢাকার স্বরব্যঞ্জন থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি উৎসর্গ করেছেন অগ্রজ সাদ উদ্দিন আহমদকে।
আমরা জানি যে, কোন ব্যক্তির একক প্রচেষ্টার কারণে দশকও পরিচিত হয়ে উঠতে পারে। আবার কোন দশকের মধ্যে না থেকেও কোন কোন ব্যক্তির সৃষ্টকর্ম দশকের উর্ধ্বের আলোচনায় আসতে পারে। যেমন নজরুলের কবিতাকে প্রকৃতপক্ষে কোন দশক দিয়েই নির্ণয় করা যায় না, পল্লি কবি জসীমউদদীনকে কোন দশকের ছাঁচেই ফেলা যাবে না। যারা তা করার চেষ্টা করেন তারা যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত খুঁজেন। কবি খালেদ উদ-দীন নবইয়ের দশকের কবি হিশেবে তাঁর বইয়ের ফ্ল্যাপিতে উল্লেখ করলেও মূলত তা অনেকটা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতোই ব্যাপার। মনে রাখতে হবে দশক মোটেও সাহিত্য বিচারের মাপকাঠি নয়!
কবি খালেদ উদ-দীন সাহিত্যের একজন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর শব্দ বুননের কৌশলে চমক রয়েছে। চুম্বক যেমন লোহা জাতীয় পদার্থকে আকর্ষণ করে তেমনি খালেদ উদ-দীনের কবিতাও পাঠককুলকে নিঃসন্দেহে কাছে টানে। দীর্ঘদিন থেকে তিনি সাহিত্য চর্চায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এক নজরে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মগুলো হল:
কাব্যগ্রন্থ:
রঙিন মোড়কে সাদা কালো ২০০৮
নীল সাগরের তীরে (যৌথ)
এই পদ্যের গাও গেরাম (যৌথ)
ভাঙ্গা ঘর নীরব সমুদ্র ২০০৯
জলপাতালে মিঠে রোদ ২০১৫
সম্পাদনা: বুনন
সহযোগী সম্পাদনা: বাউলা
তাঁর রঙিন মোড়কে সাদা কালো কাব্যটির বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
ক. প্রেম
খ. সমকালীন বাস্তবতা
গ. বৈশ্বিক রাজনীতি
ঘ. দেশীয় রাজনীতি
ঙ. মানবিকতা
চ. ধর্ম
ছ. বোধের উন্মেষ
জ. ইতিহাস ও ঐতিহ্যতা
ঝ. শ্রেণি বৈষম্য
ঞ. মানবতা
ট. দেশপ্রেম
ঠ. প্রকৃতিপ্রেম
ড. অস্থিরতা
ঢ. বিবিধ
সংস্কৃতির মধ্যেই আমরা বেঁচে থাকি, বেঁচে থাকতে চাই। তবে সুস্থ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আমরা যেমন সুস্থভাবে বেঁচে থাকি তেমনি অপসংস্কৃতির মধ্য দিয়েও চলে আমাদের আত্মার তথা অস্তিত্বের নিরন্তর পীড়ন। ভাইরাস যেমন খালি চোখে দেখা যায় না তেমনি অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশও সহসাই আমরা অনুভব করতে পারি না। এই সংস্কৃতিরই এক বিরাট শাখা, সৃষ্টিশীল শাখা কাব্যসাহিত্য। যেখানে মানুষ নির্মল হওয়ার, উদার হওয়ার, বিনয়ী হওয়ার, সুস্থ হওয়ার, ভালভাবে বেঁচে থাকার মন্ত্রনা পায়। একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ যেমন তাঁর আদর্শ দিয়ে সমাজের আমূল পরিবর্তন করতে পারে তেমনি একজন কবিও তাঁর কাব্যের মাধ্যমে সমাজের তথা রাষ্ট্রের মূল্যবোধ তথা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনয়ন করতে পারেন। কবি খালেদ উদ-দীনের কাব্য সে দিক থেকে বিবেচনার দাবি রাখে।
চমৎকার একটি কবিতা দিয়ে তিনি কাব্যটি শুরু করেছেন। একটি কাজ ভালোভাবে শুরু করলে নাকি তার অর্ধেক কাজ করা হয়ে যায়। কবি খালেদ উদ-দীনের কাব্যের সুচনা ও সজ্জা ভাব দেখলে নিঃসন্দেহে তার কাব্যটিকে গোছালো এবং সার্থক বলেই মনে হবে। কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন:
“পুরনো নির্মাণে জুড়ে আছে সিঁড়ি পথ
মরে যাওয়া মানুষের কষ্টগুলি পঁচা গন্ধ হয়ে ভাসে
চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া ঐশির শ্লোগানে
বিরান
হয়ে আছে
সকল ভালোবাসা”
অথচ; পবিত্র জল ঝর্ণায় গড়েছে সখ্যতা
উৎস: রঙিন মোড়কে সাদা কালো, পৃষ্ঠা ০৯
তাঁর কবিতার শরীর জুড়ে পশ্চাৎ সংস্কৃতির টান রয়েছে। বাস্তবতার সুঘ্রাণ রয়েছে। শব্দের গাঁথুনিতে নিজস্ব ঢঙ রয়েছে। তবে ব্যাকরণিক দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দাগযুক্ত বাক্যটিকে ত্রুটিমুক্ত বলা যায় না। বাক্যটিতে ‘সখ্যতা’ শব্দটি হয়ত অজ্ঞাতসারেই এসেছে। যা হওয়া উচিত ছিল সখ্য! কেননা, বাংলা ভাষায় সখ্যতা বলে কোন শব্দ নেই।
কাল নিরবধি। কালের ঘূর্ণাবর্তে পরবির্তিত প্রকৃতির চিত্রপট। বদলে যায় সমাজ-সভ্যতার প্রচ্ছদপট।সমঢের প্রবাহমানতার সাথে সাথে যেমন ব্যক্তির উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধিত হয়, তেমনি এর প্রভাব পড়ে সাহিত্যে।
''সময়ের খুব কাছে শুয়ে আছে। সভ্যতার সাদা লাশ
আকাশের মেঘ কিংবা রাতের গাঢ় অন্ধকার শেষ হয় তবুও
পুরনো রেলগাড়ির মতো ধুকতে থাকা বোধ হোঁচট খাচ্ছে বার বার''
উৎস: স্বপ্নভেলা, পৃষ্ঠা ১০
আমরা যতই সভ্য হইনা কেন আদিমতা যেন আমাদের এখনো পিছু ছাড়ছে না। সভ্যতা ও আদিমতা যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ!
“এখনো রক্তে মিশে আছে গুহা জীবনের নানাবিধ ভয়
আমরা সনাতনীর পূজারী! বড় বেশি ভালোবাসি সনাতনীরে”
উৎস: অথবা সনাতনী কবিতা, পৃষ্ঠা ১১
সকাল থেকে সন্ধ্যাবধি আমরা অলিখিতভাবে ধর্ম দ্বারাই কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হই। বায়ু সমুদ্রে ডুবেও যেমন আমরা ভুলে যাই বায়ুর অস্থিত্বের কথা তেমনি ধর্ম দ্বারা প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রতি হয়েও আমরা ভুলে যাই ধর্মের মূলমন্ত্রের কথা! সৃষ্টি বা নির্মাণ অর্থে মানুষ নিজেই যে ঈশ্বর-কবির কবিতা পাঠমাত্রই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
“ও মহান ঈশ্বর, তোমার গোপনে রেখে
দেখো, তোমার সামনে যন্ত্রনায় পুড়ে পুড়ে আঙ্গার
ডানায় ঢেউ তোলে ভাসে পূর্ব আর পশ্চিম পাড়ায়
ঈশ্বর,
ভেতরে ভেতরে প্রত্যেক মানুষই এক একজন ঈশ্বর”।
উৎস: ঈশ্বর, পৃষ্ঠা ১২
সাহিত্যের ক্ষেত্রে বড় মাপের সাহত্যিকদেরও অনুসরণ কিংবা অনুকরণ করার দৃষ্টান্ত ভুরিভুরি রয়েছে। তবে অনুকরণটা কেবল নিন্দনীয় নয়, অপরাধও বটে! তাঁর ‘আলালদীনের ভবিষ্যৎ’ কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত কাব্য: ‘অদ্ভুত আঁধার এক’কবিতার ভাবপুষ্ট বলে মনে হয়!
“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা,
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়ে”।
-‘অদ্ভুত আঁধার এক’
আলালদীন ভবিষ্যৎ দেখে
চোখের সামনে ভবিষ্যৎ চোখের আড়ালে ভবিষ্যৎ
আলালদীন দিব্যি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়
-----------------------------
এখানে অন্ধরা, এখানে ভবিষ্যৎ রচনা করে
এখানে বধিরের কিলিবিলি ভালোলাগে না
অন্ধ খোঁড়া আর বধিরেরা মিলে স্বাদের ভবিষ্যৎ সাজায় যতনে।“
উৎস: আলালদীনের ভবিষ্যৎ, পৃষ্ঠা ১৩
নব্বইয়ের শুরু থেকে কবিতায় মূলত দুটি দিক প্রবল হয়ে ওঠে। যা কবিতাকে পৃথক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। এই দুটি দিক হল-
১. স্টাইল ২. নন্দন শিল্প
প্রকৃতপক্ষে স্টাইলটা হল আপেক্ষিক। মূলত নন্দন শিল্পই স্থায়ী। কবিতাকে মহাকালে শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকিয়ে রাখতে পারে নন্দন শিল্প। কবি খালেদ উদ-দীনের কবিতাতে উর্পুক্ত দুটি লক্ষণই বিদ্যমান। তবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় দিক হল তাঁর কবিতার নন্দনশিল্প।
“বাগানের গাছগুলোর মতো ঝিমিয়ে যাবার আগে
বাগানের ফুলগুলোর মতো ঝড়ে পড়ার আগে চাই,
তুমি আর আমি মুখোমুখি দাঁড়াই
আমাদের মুখের দাগগুলো চিহ্নিত করি-
একে অপরের”
উৎস: সংস্কার, পৃষ্ঠা ১৫
কবি শব্দ বুননে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে উপমার ব্যবহারে অনেকটাই নাজুক! নিচের দাগ চিহ্নিত বাক্যটিই তার প্রমাণ রাখে।
“আকাশে শ্রাবণের ফর্সা চাঁদ
আমাদের বাড়ির পাশের ধানক্ষেত, সবুজ বাগান হয়ে যায়
কোলাহলহীন পথ পেরিয়ে আমরা হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করি
নিমিষেই মন থেকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেই সকল ভয়
চাঁদের আলো আর মুয়াজ্জিনের আজানের মাঝে কোন পার্থক্য নেই
---------------------------------------------
আর আমাদের ছুটে চলা সীমাহীন পথে অবিরাম”।
উৎস: শ্রাবণের চাঁদ, পৃষ্ঠা ১৬
একাধারে ক্রমব্যপ্তি অনুসারে মানুষের বিকাশের পর্যায়গুলো হলো- শিশু, কিশোর, তরুণ, পরিপূর্ণ যুবক এবং বৃদ্ধ। একেকটা পর্যায় থেকে উত্তরণে ব্যক্তির যেমন শারীরিক পরিবর্তন ঘটে তেমনি ঘটে মানসিক পরিবর্তন। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এর সাদৃশ্য রয়েছে বলে আমি মনে করি। একটি কবিতা হতে আরেকটি কবিতা ক্ষেত্রেও এ পার্থক্য পরিলক্ষ্যিত হয়। তার কবিতার শরীর জুড়ে যেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বিরাজ করছে।
“পৃথিবীর এপার ওপার জুড়ে বইছে যে বাতাস সে যেন মধ্য যুগের গভীর তমসার আর্তনাদ
সভ্যতার নির্মাণ কেবল প্রাসাদের রঙিন ইট
আর মানুষ খেকো দানবের ক্রম সংস্করণ”!
উৎস: একটি শ্মশান কাব্য, ১৮
বাস্তবতার চিত্র শব্দ-কুশলতায় কাব্যে তোলে আনতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার! সত্যকে প্রকাশ করতেও তিনি সব সময়ই অকুতোভয়। নিচের কবিতাদ্বয়ে তাঁর সত্য ও সুন্দর উচ্চারণের দৃঢ়তাই প্রকাশ পেয়েছে।
“এই সোনার বাংলা এখন তোমার আমার একেবারেই খেয়াল খুশি
বাহ জেনারেল; বাহ্! লাল নীল স্বপ্নে আমরাও আছি বেশ
যেন রোবট বিশ্বের মজাদার পাওয়ার প্র্যাকটিস চলছে ভীষণ
ক্ষমতার সাধ বনের বাঘও জানে; মাননীয় জানে আকাশেরও মেঘ।
আমার জন্যই তো সব, এখন দেখি তুমি আমার নও”।
উৎস: এলোমেলো, পৃষ্ঠা ১৯
“না; চেয়ারটা খালি নেই চেয়ারে বসে আছ তুমি
মূলত এবার তোমার দখলে ‘স্বপ্ন চেয়ার’ তাই”।
------------------------------
আহা চেয়ার!
চেয়ারটা এবারও খালি মিললো না।
উৎস: চেয়ার, ২১
কলম দিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন কাগজে আঁকাবাঁকা টান দিলেই যেমন তা চিত্রকর্ম হয়ে যায় না তেমনি যেমন খুশি কবিতায় শব্দ বসালেই তা কবিতা হয়ে যায় না। কবিতার পাঠে অন্তর্গত উপলিব্ধর বিষয়টা বোধহয় একটু বেশি জরুরি। আর এজন্য দরকার সচেতন একাগ্রতা। একসময় জীবনানন্দ দাশ কে দুর্বোধ্য কবি মনে করা হতো। অন্তত তাঁর সময়ে তাঁকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। এর একমাত্র কারণ জীবনানন্দকে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। তদ্রুপ বর্তমানে যারা আন্তরিকভাবে, সৎভাবে দায়িত্ব নিয়ে চর্চা করছেন তার সব হয়তো আমরা বুঝবো না। তাই বলে বিদ্রুপ করাটা সমর্থনযোগ্য নয়।
আজকের যুগ জটিলতায় কবি খালেদ উদ-দীনের কবিতা ফলোআপ হতে যদিও একটু বেশি সময় লাগছে তবুও এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন তাঁর কবিতাকেই মডেল হিসেবে দাঁড় করানো হবে।
“তোমাকে আটকে রেখেছে তোমারই সার্বভৌম রাজনীতি।
কী আশ্চর্য নিয়মের খেলা-
অস্ত্র আর ক্ষমতার দাপটে বিশ্বরের বিবেক, প্রভু
উল্টোপিঠে বাঁচার লড়াই, চেয়ে দেখো কি সুবিশাল।
পৃথিবীর চনো পথে চলো এবার দুজনে হাঁটি একসাথে
ভিসা মুক্ত পৃথিবী হোক; বাস্তবিক”।
উৎস: পৃথিবী আমার ভিসা মুক্ত পৃথিবী, ২৩
আমরা জানি, কবিতা কবিতা হয়ে ওঠে উপমার সুনিপুন ব্যবহারে। কবিতা উপমা থেকে যাপনের দৃশ্যবিস্তারে ধাবিত হওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ। একটু এদিক-সেদিক হলেই যেন তা নিজস্ব অক্ষ রেখা থেকে ছিটকে পড়ে। লক্ষ্য করার মত ঘটনা হল ষাটের দশকে বাংলা নন্দন কবিতার পর সত্তর আশিতে গিয়ে পাঠক বিভ্রান্ত হতে থাকে, নতুনত্বর খরায় ভুগতে শুরু করে। আবার আশির শেষদিক থেকে বাংলা কবিতা পুনরায় নন্দনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কবিতার শৈল্পিক বিনির্মানে নান্দিকতাও তখন ছিল চোখে পড়ার মত। চিত্রের ক্যানভাসে আল্পনা আঁকার মত নির্মাণের অযুত কলা কৌশলের চর্চাও বেড়ে যায়। তবে বিমূর্ততার জটিলতার ফাঁক-ফোঁকর থেকে আরো গভীরে প্রোথিত করে কবিতাকে। পরিবর্তনের পটভূমিকায় নব্বইয়ের এই প্রবণতা কবিতার স্বাভাবিক বিবর্তন থেকে কিছুটা সরে আসে। নন্দনের ব্যাপক ইলিউশন হাজির হয় কবিতায়। যা আমরা কবি খালেদ উদ-দীনের কবিতার মধ্যেও স্পষ্ট দেখতে পাই।
“সীমান্ত পুড়ছে বেরসিক দাবানলে-
আর আমাদের সুমনার পুড়েছে ঘর ও সংসার
জেনে রেখো, পৃথিবীর তামাম মানুষই এক একটি অগ্নিশিখা
সেই আগুনে পুড়েছে হিরোশিমা…
পুড়েছে মানবতা”
উৎস: আগুন আগুন আগুন, ২৭
পুতুল খেলা ও অলস প্রহর, আমাদে হিশেবি মানুষগুলো, প্রবহমান নদী, কবিতাত্রয়ে নিয়তির ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করা যায়। বাস্তবতার কষাঘাতে জীবনের উত্থান-পতনের স্মৃতিময় ক্ষণ কালের কপোল জুড়ে নির্লিপ্ততার ঢেঁকুর তোলে।
“বিশ্বে এখন উল্টো হাওয়া। উষ্ণ হাওয়ায় পুড়ছে সব। আমিও পুড়ে যাচ্ছি
তোমার দহনে চোখ রাঙানিতে অথবা ‘অনেক হয়েছে, আর না’ শুনে
শুনে আমার শ্রবণ যন্ত্র বিরান হয়ে যাচ্ছে। অথচ বিরান হচ্ছে না শুধু তোমার জমিন।
উৎস: সময় এখন তোমার পক্ষে, ২৮
খুব চেনা লাগে, খুব জানতে ইচ্ছে করে কবিতাদ্বয়ে স্মৃতি কাতরতা রয়েছে। তবে তাতে অনেকটাই শিল্পবোধের অপ্রতুল্যতা রয়েছে। নারীর স্বরূপ উন্মোচনে কবি অনেকটাই যেন দ্বিধাগ্রস্থ। মূলত লৌহ-কঠিন বাস্তবতাই কবির বিভ্রান্তির জন্য দায়ী।
“এদিকে না ওদিকে; ওদিকে না এদিকে
নারী; তুমি কোনদিকে?”
উৎস: নারী, পৃষ্ঠা ৩২
তাঁর কাব্যের শরীর জুড়ে যেন লেপ্টে রয়েছে রোমান্টিকতা। মাদকের মতোই এক অজ্ঞাত নেশা তার কাব্যকে কেবলি কাছে টানে। দ্রৌপদীর শাড়ির মতো খুলতে খুলতেও যেন শেষ হয় না তাঁর কাব্যের রোমান্টিকতার নির্যাস!
“আড়ালে মেঘনার ঢেউ রাশির মতোন ছলছল করে ওর শরীর
কী পরিপূর্ণতা…; ঠোঁটের পাতলা পাঁপড়িতে এক চিলতে হাসি
কুয়াশার জালে বন্দি যুবক ঐ নতুন সূর্যের আলোয় চমকে ওঠে
ইউবিন! ইউবিন!! ই-উ-বি-ন…!!!
প্রণাম!
সূর্যের আলোয় নয়, আমি তোমাতেই ভোর দেখেছি”
উৎস: ইউবিন, ৩৪
ভাষার সরলীকরণেও তিনি বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। সহজ কথাগুলো সহজভাবে বলা যায় না-এ কথাটি তিনি মানতে নারাজ। তিনি তার কাব্যে সহজ কথাটি সহজভাবেই বলার চেষ্টা করেছেন।
“শুধু একবার বলো ভালোবাসি
দেখবে শব্দেরা সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে
আর নির্মিত হবে পৃথিবীর অমর শিল্পকলা”।
উৎস: তুমি, পৃষ্ঠা ৩৫
প্রেম ও ফানুষ কবিতাদ্বয়ে কবিতা হয়ে উঠার আবহ আছে। রঙের বড়াই, পালাবদল কবিতাদ্বয়েও শব্দ-শিল্পের ঈষৎ প্রলেপ দেওয়া হয়েছে কিন্তু তা সত্যিকার অর্থেই স্বার্থক কবিতা হয়ে ওঠেনি। ‘মনে রাখো ইতা খতা’ কবিতাটি দিয়ে কাব্যটিকে ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে বরং কাব্যটিরই মর্যাদাই ক্ষুণ্ন হয়েছে!
কাব্যের নামকরণযুক্ত কবিতাটি সত্যিই শিল্পসার্থকতা লাভ করেছে। তা যেমন ভাষার সরলীকরণে, তেমনি ভাবের ব্যঞ্জনায়।
“আড়ালে সব কিছুই মনে হয় দস্তুর মতো
উত্তরাধুনিক বোধ খেলা করে করুণ হাহাকারে
এখানে কেবলি রাত হয়ে যায়
আঁদারের কালো রঙে আড়ালে লুকাই
শীতল শরীরে খেলা করে আরাম, হেঁটে যাই
আর ভেতরে ভেতরে ছাই হয়ে যাচ্ছে সকল বাস্তবিক”।
উৎস: রঙিন মোড়কে সাদা কালো, পৃষ্ঠা ৪৬
পৃথিবী বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। কবি প্রত্যাশা করছেন- দূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে সুদিন আসবে, শান্তির পসরাতে ভরে উঠবে পৃথিবীর কানন।
‘সুদিন আসবে, আর কিছুদিন পর সুদিন আসবে’
------------------------------------------------
একদিন সব বদলে যাবে; সব, এরকম নতুন দিনে
মায়ের কোলে শুয়ে ফেলে আসা দিনের গল্প শুনবো-
এমন দিনের বড় কঠিন প্রতীক্ষায় আমাদের কাটে প্রহর।
উৎস: একদিন সব বদলে যাবে, পৃষ্টা ৪৮
সময় নদীর স্রোতের মতোই তা বহমান। জলের জলত্বই যেমন তার ধর্ম, আগুনের অগ্নিত্বই যেমন তার ধর্ম ঠিক তেমনি গতিশীলতাই কালের ধর্ম। অখণ্ড সময় বা কালের সমষ্টিকেই আমরা বলি মহাকাল। এই মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে অনেক সৃষ্টিই ম্লান হয়ে যায়। হারিয়ে যায় কালের গর্ভে । আবার অনেক সৃষ্টিই টিকে থাকে। সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে হারিয়ে যায় ব্যক্তিসত্ত্বা কেবল টিকে থাকে ব্যক্তির সৃষ্টিশীল কর্ম। এই জন্ম এবং হারিয়ে যাওয়ার খেলা প্রাগৈতিহাসিক কাল ধরে চলে আসছে। ক্ষণ জীবনের অধিকারী হয়ে অনেকেই ঠাঁয় করে নিয়েছে ইতিহাসের সোনার পাতায়। নিজের সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে মহাকালের বিমূর্ত পাতায় ব্যক্তিমানসও বেঁচে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী। কবি খালেদ উদ-দীনের রঙিন মোড়কে সাদা কালো (২০০৮) কাব্যটিও বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে দীর্ঘদিন টিকে থাকবে এতে কোন সন্দেহ নেই; আর কাব্য টিকে থাকলে এই গুণী কবিও দীর্ঘদিন টিকে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
-------------------
মুনশি আলিম
২৯.০৭.২০১৫
জাফলং, সিলেট
©somewhere in net ltd.