![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
খালেদ উদ-দীন এক নিভৃতচারী কবি। যে কবিরা নিজের প্রচার ও প্রসার নিয়ে উদাসীন থাকে কবি খালেদ উদ-দীন তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতির রূপ-রস গন্ধ মেখে তিনি তাঁর কাব্য কাননকে সাজিয়েছেন একেবারে নিজের মতো করে। কবি খালেদ উদ-দীন হৃদয় রাঙাতে রঙ্গের কৌটো নিয়ে ঘুরেন। নিজেকে মনে করেন প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতি যেন যুগ জনমের বন্ধু!
এদেশের মাটি ও মানুষের গন্ধ তাঁর কবিতার শরীর জুড়ে লেপ্টে রয়েছে। সৃষ্টির জগতে তিনি আপোসহীন এক শব্দসৈনিক। কবিতায় নতুনত্ব আনয়নের জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট। তাঁর প্রথম কাব্য থেকে দ্বিতীয় কাব্যটি রূপ-রস-গন্ধ-অলংকার ও প্রকরণের দিক থেকে যেমন আলাদা তেমনি বিষয়বস্তুর দিক থেকেও নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় তাঁর তৃতীয় কাব্য ‘জলপাতালে মিঠে রোদ’- এ। প্রকরণ যদি কবিতা বিচারের মাপকাঠি হয় তবে নিঃসন্দেহে কবি খালেদ উদ-দীনের ‘জলপাতালে মিঠে রোদ’ কাব্যটি প্রশংসার দাবি রাখে।
শব্দ সৈনিক হিশেবে কবি খালেদ উদ-দীন ইতোমধ্যেই বেশ নাম কুড়িয়েছনে। দেশর প্রথতিযশা সব সাহিত্যের ছোটকাগজ ও জাতীয় দৈনিকে তাঁর কবিতা শুধু স্থানই পায়নি ভূয়সী প্রশংসিতও হয়েছে। কাজেই কবি খালেদ উদ-দীন যে সাহিত্যের একজন নিবেদিত প্রাণ এবং যশস্বী কবি এ কথা বললে বেশি একটা অত্যুক্তি হবে না।
বাঙ্গালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কাব্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “... কবিতা হচ্ছে শব্দ শব্দে বিয়ে দেয়া’’। বিয়ের মাধ্যমে যেমন নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, নতুন বন্ধনের সৃষ্টি হয় তেমনি সুচারু রূপে শব্দ বুননের মাধ্যমেও ভালো কবিতার জন্ম হয়।
তাঁর শব্দ বুননের কৌশলে চমক রয়েছে। চুম্বক যেমন লোহা জাতীয় পদার্থকে আকর্ষণ করে তেমনি খালেদ উদ-দীনের কবিতাও পাঠককুলকে নিঃসন্দেহে কাছে টানে। দীর্ঘদিন থেকে তিনি সাহিত্য চর্চায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এক নজরে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মগুলো হল:
কাব্যগ্রন্থ:
রঙিন মোড়কে সাদা কালো ২০০৮
নীল সাগরের তীরে (যৌথ)
এই পদ্যের গাও গেরাম (যৌথ)
ভাঙ্গা ঘর নীরব সমুদ্র ২০০৯
জলপাতালে মিঠে রোদ ২০১৫
সম্পাদনা: বুনন
সহযোগী সম্পাদনা: বাউলা
তাঁর রঙিন মোড়কে সাদা কালো কাব্যটির বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
ক. সম্পর্কের টানাপোড়েন
খ. বৈশ্বিক রাজনীতি
গ. সমকালীন বাস্তবতা
ঘ. দেশীয় রাজনীতি
ঙ. সামাজিক বিচ্যুতি
চ. অস্থিরতা
ছ. বোধের উন্মেষ
জ. ইতিহাসের ছায়াপাত
ঝ. শ্রেণি বৈষম্য সপষ্টতা
ঞ. মানবতার জয়গান
ট. দেশপ্রেমের উন্মেষ
ঠ. প্রকৃতিপ্রেমের ছোঁয়া
ড. রোমান্টিকতা
ঢ. বিবিধ
কবি খালেদ উদ-দীনের তৃতীয় কাব্য ‘জলপাতালে মিঠে রোদ’ ২০১৫ সালে চৈতন্য থেকে প্রকাশিত। তিন ফর্মার এই বইটিতে মোট চল্লিশটি কবিতা রয়েছে। প্রচ্ছদ করেছেন তৌহিন হাসান। স্বত্ব: ফাতেহা বেগম। খুচরা মূল্য: ৮০ টাকা। উৎসর্গ করেছেন তাপস চক্রবর্তী, শিউল মঞ্জুর, নাদিয়া প্রমুখকে।
জগৎ বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদার একটি কাব্য ছিল প্রশ্নে ভরপুর। অর্থাৎ একের পর এক প্রশ্ন জুড়ে দিয়ে বিস্ময়কর কবিতা লিখেছেন তিনি। প্রশ্নে প্রশ্নেও যে কবিতা হয় পাবলো নেরুদার সে কাব্য না পড়লে বুঝা যাবে না। পাবলো নেরুদার মতো কবি খালেদ উদ-দীনও তাঁর তৃতীয় কাব্য ‘জলপাতালে মিঠে রোদ’-এ প্রকরণ ও ভাবে আমূল পরিবর্তন আনয়নের চেষ্টা করেছন। প্রতিটি কবিতা-ই পাঁচ পংক্তির মাধ্যমে শেষ করার চেষ্টা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে কাব্যের এই নতুন প্রকরণ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। অপসংস্কৃতির প্রভাবে আমরা প্রতিনিয়তই প্রভাবান্নিত হচ্ছি। কতকটা জ্ঞাতসারে আবার কতকটা অজ্ঞাতসারে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের কালো থাবাও কোন অংশে কম দায়ী নয়। বিশ্বায়নের কালো থাবায় মানুষে মানুষে বাড়ছে সম্পর্কের টানাপোড়েন; অবিশ্বাস, হিংসা- এমনকি প্রতিহিংসার লেলিহান শিখাতেও আমরা সহসাই দগ্ধ হয়ে চলছি।
এ প্রভাব শুধু গ্রামে নয়, শহরেও দেখা দিয়েছে। যদিও গ্রামের থেকে শহরেই এ প্রভাব আগে পড়ে তথাপিও সভ্যতা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে শহুরে মানুষদের ভূমিকাকেই মুখ্য হিশেবে দেখা হয়ে থাকে।
কবি খালেদ উদ-দীন শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি এঁকেছেন। জীবন যেমন হয় ঠিক তেমনি। সম্পর্কের টানাপোড়েন ও অবিশ্বাসের এক জীবন্ত চিত্র তিনি তাঁর কাব্যের প্রথম কবিতাতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলেছেন। যেমন:
“শহুরে মধ্যবিত্তে হৃদয় জমা রাখা নিরাপদ নয়
এখানে নিত্য রঙ বদলায়, বাহারি রঙের ভিড়ে।
উপাসনালয়ে ঝুকছে তরুণ, ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে
সুপারম্যানের স্বপ্নে বিভোর নিরাপদ আগামী।
জ্ঞাত সত্যে পানকৌড়ি উড়ে যায় দিগন্তে …”
উৎস: টানাপোড়েন, পৃষ্ঠা ০৯
ছায়া যেমন ব্যক্তির পিছু ছাড়ে না, তেমনি বর্জন চিহ্নও যেন কবি খালেদ উদ-দীনের পিছু ছাড়েনি। ছায়ার মতোই যেন কবিতার শরীর জুড়ে লেপ্টে রয়েছে। শরীরে অলংকার পরিধান করলে একরকমের সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়, আর না পড়লে আরেক ধরনের সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। তবে স্বাভাবিক মাত্রায় অলংকার পরিধান করলেই মূল সৌন্দর্যের তেমন একটা হেরফের হয় না। অতিরিক্ত করতে গেলেই যেমন সৌন্দর্যের হানি ঘটে তেমনি কাব্যের ক্ষেত্রেও একই চিহ্নগুলো বার বার ব্যহারে কাব্যের সৌন্দর্য ক্ষুণ্ন হয়। অবশ্য এটা কে ধরনের মুদ্রাদোষও বলা যায় কিংবা বাহুল্যদোষ! নিচের কবিতাদ্বয় নিঃসন্দেহে তার প্রমাণ বহন করে।
“বিশ্বময় সবই দেখেন জনাব বানকি মুন।
এমনকি সুশাসনের অভাব দেখলে তাঁর প্রাণে রক্তক্ষরণ হয়
আরাম কেদরায় বসে তিনি তাকিয়ে থাকেন; আফসোস করেন
ছুটে বেড়ান, এদেশ ওদেশ-আহা শান্তি…
জনাব বান কি মুন, ইশারার ভাষা ভালো বুঝেন?”
উৎস: নিরাপদ শান্তি, পৃষ্ঠা: ১২
“উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পূর্বে আসুন আলোচনায় বসি
আলো আর অন্ধকারের তফাৎ সকলেরই জানা
ফুলে আর অন্ধকারের তফাৎ সকলেরই জানা
ফুলে ফেপে ওঠা বুদবুদে আলোচিত হয় জমা খরচ…
না মানুষের কোন বাড়ি থাকে না, ছিলও না কোন-কালে”
উৎস: ঠিকানা, পৃষ্ঠা ১৮
আধুনিক অনেক কবিরা ভাবের গভীরে যেতে যেতে অনেক সময়ই শব্দ দিয়ে জট পাকিয়ে ফেলেন। এ দিক থেকে কবি খালেদ উদ-দীন নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচয় প্রবন্ধে বলেছেন, “শরতের রংটি প্রাণের রং। অর্থাৎ তাহা কাঁচা, বড়ো নরম। রোদ্রটি কচি। সোনা, সবুজ কচি, নীলটি তাজা”। কবি খালেদ উদ-দীনের কবিতার মধ্যেও যেন শরতের সেই সতেজতার সুঘ্রাণ মেলে।
“সূচিকর্মে এমন তৎপর তুমি, তুফান ওঠে শব্দঝড়ে
শব্দের আড়ালে তুমি কী লুকাও? বসন্ত দিন!
একদা চৈতালী হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছো স্বর্ণগন্ধ্যা ভোর
এখন গোধূলি আলো ঝেড়ে ফেল ঘাম এ কামের তৃষ্ণা!
সেলাইদিদিমণি, তোমার সূচিকর্মে এখন নেমেছে সন্ধ্যা-আঁধার!”
উৎস: সূচিকণ্যা, পৃষ্ঠা ১১
“এমন রঙে রঙিন রঙ্গময় ভুবনে
স্বপ্নে কোন রঙ থাকে না; স্বপ্ন হয় সাদাকালো
তোমাকে আলোতে দেখি, আঁধারেও দেখি
তফাৎ খুঁজে পাই না
যত গভীরে যাই রঙ নাই, মিছেমিছি খেলা”
উৎস: সাদাকালো, পৃষ্ঠা ১৩
কবি খালেদ উদ-দীন স্বপ্ন সম্পর্কিত ওপরে যে কবিতাটি লিখেছেন তাতে আমি কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করছি। আমার ধারণা- স্বপ্ন সম্পর্কিত তথ্যে তাঁর জানার মধ্যে হয়ত কোন ফাঁকি ছিল না, তবে অনেক ফাঁক ছিল। এ সম্পর্কে একটু অল্প-বিস্তর ব্যাখ্যা করছি।
আমরা অনেকেই জানি যে স্বপ্ন সাদা-কালো। কিন্তু মূলত স্বপ্ন আসলে সাদাকালো নয়। বিখ্যাত উইকিপিডিয়া সাইটের মতে, মাত্র ১২% লোক সাদাকালো স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ১৯১৫ থেকে ১৯৫০ এর মধ্যে পাওয়া গবেষণার বেশির ভাগ ফলাফলে লেখা হয়েছে "বেশির ভাগ স্বপ্ন সাদাকালো" কিন্তু ১৯৬০ সালে এসে গবেষণার ফলাফল পরিবর্তন হতে থাকে! বর্তমানে ২৫ বছর বয়েসের নিচের লোকদের মাত্র ৪.৪ % সাদাকালো স্বপ্ন দেখেন!!
স্বপ্ন নিয়ে এই গবেষণায় একটা মজার ফলাফল বের হয়েছে যা হলো স্বপ্নের রং পরিবর্তনে রঙিন টিভি এবং সিনেমা বড়ো ভুমিকা রেখেছে!!! তাহলে মানুষ আজো কেন বিশ্বাস করে স্বপ্ন সাদাকালো? এবং যারা রং দেখেন তারাও বইয়ের মত জ্ঞানী ভাষায় ঘোষণা দেন "স্বপ্ন সাদাকালো, রংটা মনের কল্পনা"।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের মিসির আলীর একটা বইয়ে পড়েছিলাম, এক ছেলে স্বপ্নে রং এর কথা বলায় মিসির আলি বুঝতে পারলেন যে, ছেলেটা মিথ্যা কথা বলছে!!! এভাবেই লেখক পত্রিকা, গবেষকদের বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে মানুষের মনে এই ভুল ধারণাটি পাকা পোক্ত হচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? বাস্তব তো ভিন্ন!!
এটা খুবই সুস্পষ্ট যে, স্বপ্নের যেসব জায়গায় রংটা প্রাসঙ্গিক সে সব জায়গায় আপনি রং দেখবেন। যেমন স্বপ্নে যদি আপনি শাড়ি কিনতে যান অবশ্যই আপনি শাড়ির বিভিন্ন রং দেখবেন! বাস্তবে আমরা সাত রংয়ের পৃথিবীতে থাকি। বাইরে থেকে ঘুরে এসে কি আপনার মনে থাকে যে আজকে মানুষের গায়ে আপনি কত রংয়ের জামা দেখেছেন?? না মনে থাকে না, কিন্তু রংটা যেখানে প্রাসঙ্গিক সেখানে মনে থাকে যেমন: নীল স্কার্ট পড়া একটা সুন্দরী মেয়ে দেখলেন, বাসায় এসে কিন্তু আপনার নীল স্কার্ট এর ব্যাপারটা মনে থাকবে!!
মনে রাখতে হবে যে, স্বপ্নেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটে। অবশ্য স্বপ্নের ঘটনা মনে রাখাই কষ্টকর। সেখানে অপ্রাসঙ্গিক রং মনে থাকার কথা না! কদিন আগে শিশুসাহিত্যিক জসীম আল ফাহিম বলেছেন যে, তিনি স্বপ্নে সর্ষে ক্ষেতের মাঝে দৌড়েছেন!! এখানে তার রং মনে থাকার কথা, কারণ স্বপ্নটার বিষয়ই ছিলো হলুদ ক্ষেত!! তাই স্বপ্নে রংয়ের তথ্য পাওয়া না গেলে রং হয়তো দেখবেন না, কিন্তু এর মানে এই না যে স্বপ্ন "সাদাকালো"!!!
স্বপ্নের রং নিয়ে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত পত্রিকা ‘টেলিগ্রাফ’ ২০০৮ সালের ১৭ অক্টোবর একটা ফিচার করেছিল। সেখানে একটা মজার কথা ছিলো "আপনি কি সাদাকালো স্বপ্ন দেখেন- তাহলে নিশ্চিত আপনার বয়স ৫৫'র উপর এবং আপনি একটা সাদাকালো টিভি দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছেন"!
আধুনিক কালের গবেষনায় দেখা গেছে টিভি এবং টিভির অনুষ্ঠান বাচ্চাদের স্বপ্নে প্রভাব ফেলে! গবেষণায় বলা হয়েছে ২৫ বছরের নিচে প্রায় সবারই স্বপ্ন রঙিন এবং এই যুগের ৫৫ বছরের বেশি বয়েসীদের স্বপ্ন সাদাকালো!!! সবচেয়ে মজার ফলাফলটি ছিলো, সাদাকালো টিভি আবিষ্কার হওয়ার আগে যেসব গবেষণা করা হয়েছিলো সেখানেও রঙ্গীন স্বপ্ন দেখা মানুষ ছিলো!! পরবর্তীতে সাদাকালো স্বপ্ন বেড়ে যায়। বর্তমানে প্রায় সমগ্র মানুষদের মধ্যে ৮৩% মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখেন।
কাজেই বলা যায় কবি খালেদ উদ-দীনের উপর্যুক্ত কবিতাটি বিজ্ঞান নির্ভর নয়।
মানুষ জন্মগতভাবেই স্মৃতিকাতর। কালের স্রোতে মানুষকে অনেক মূল্যবান জিনিসই হারাতে হয়। স্মৃতিবিঁধূর কবি সময়ের কোলঘেঁষে অতীত রোমন্থন করেছেন। যেখানে নিজের অনেক মূলব্যান সম্পদের স্পর্শ ছিল।
“প্রায়ই হঠাৎ আঁতকে উঠি; অজানা আতঙ্কে
ভেতরে ভেতরে ফুলে ফেপে ওঠা বুদবুদে
ফেলে আসা সময়ের প্রতিধ্বনি-
অবিকল মুষলধারে বৃষ্টির মতো ঝড়ে…
তুমি আড়ালে থেকেও কেমন যেন মুখোমুখি হও”।
উৎস: আজানা আতঙ্ক, পৃষ্ঠা: ১৫
কবি খালেদ উদ-দীনের ‘বোধ’ কবিতাটি চোখে পড়া মাত্রই মনে পড়ে গেল পঞ্চপাণ্ডব কবিদের অন্যতম জীবনান্দ দাশের কথা! অবশ্য তিনি ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যে ‘বোধ’ নামে যে কবিতা লিখেছিলেন তা ছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সমালোচনার জবাবে লিখেছিলেন। যদিও তাঁর কবিতার প্রেক্ষাপট ভিন্ন তথাপিও আধুনিক তরুণ কবিদের উচিত তাঁদের কবিতায় স্বাতন্ত্র্যতাবোধ আনয়ন। সৃষ্টিশীল তরুণ কবি সাহিত্যিকদের উচিত জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক প্রতিষ্ঠিত কবিদের ব্যবহৃত শব্দ ও তাঁদের কবিতার নামকরণ থেকে হুবহু নামকরণ বা শব্দ গ্রহণ না করা। কেউ যদি করেন তবে বুঝতে হবে সেক্ষেত্রে কবি বা লেখকের দীনতাই রয়েছে কিংবা তাঁর সৃষ্টিশীলতায় নিঃসন্দেহে ঘাটতি রয়েছে।
“জীবন যাপনের শেষ অঙ্কে দোলে ওঠে বোধ
ঐশি শ্লোগানে খেলা করে যায় মধ্যযুগ
রাষ্ট্রযন্ত্র কেমন নির্বার, বড় বেশি প্রাগৈতিহাসিক
শিল্প প্রযুক্তির হাস্যকর টেকে কৃত্রিম বিনয়ে।
হ্যাঁ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে তার নাম হবে ক্রুসেড”।
উৎস: বোধ, পৃষ্ঠা ১৬
কবি খালেদ উদ-দীন সমকালীন চিন্তাধারার কবি। সমকালে ঘটে যাওয়া কোন কিছুই যেন তাঁর চোখ এড়ায় না। বিশেষ করে সামাজিক বিচ্যুতিগুলো তাঁকে খুবই পীড়া দেয়। আর সে কারণে এইসব বিচ্যুতিগুলো অত্যন্ত সুনিপুনভাবে তার কবিতায় তোলে ধরেছেন। কাব্য পাঠমাত্রই আমার কথার সত্যতা উপলব্ধি করা সম্ভব। যেমন:
“সময় এখন চলে এলো হাতের নাগালে
হরহামেশা ধরা পড়েছে নতুন অস্ত্রের চালান
বাজার খুব চাঙ্গা; ধুকছে দেশীয় শিল্প
চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে যায়, আশায় আশায়
স্বপ্ন, তুমি জোসনা রাতের ঝিনুক হয়েই খেলা করো”।
উৎস: বিশ্বায়ন, পৃষ্ঠা ১৭
কবি ব্যক্তিগতভাবে কোন প্রকার শৃঙ্খলে বিশ্বাস করেন না। তিনি কল্পনা করেন বৈষম্যহীন অখণ্ডিত পৃথিবীর। জন্মগতভাবে প্রত্যেকটা মানুষের অধিকার যেমন সমান থাকে তেমনি তাদের বেড়ে উঠার অধিকারও সমান। কবি মনে করেন প্রকৃতির বিচারে আমাদের প্রত্যেকের অধিকারই সমান। কেবল আমাদের সৃষ্ট নিয়মের কারণেই আমরা নিয়ত বিভাজিত হচ্ছি। তিনি এ বিভাজন থেকে মুক্তির আহ্বান করেছেন।
“পাখিদের কোন ভৌগলিক সীমারেখা নাই
খোলা আকাশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত সবই অপার
কখনো আকাশ সীমা লঙ্ঘনে অভিযোগ তুলেন বিশ্বসম্প্রদায়
ডানাহীন মানুষ পেরোতে পারেনা শুধু সীমান্ত প্রাচীর।
ভিসা ছাড়া সীমান্ত হই পারাপার, মিশে যাই আকাশের সীমানায়”।
উৎস: ভৌগলিক সীমারেখা, পৃষ্ঠা ২০
মূলত প্রথা আমাদের নিকট দোলনার মতো হাজির হয় এবং সমাধির মতো অপসারিত হয়। প্রথা থেকে আমরা বেরুতে চাইলেও সহসাই পারি না। কেননা, দীর্ঘদিন থেকে গড়ে উঠা প্রথা একদিনে যেমন বাতিল করা সম্ভব নয়, তেমনি অট্ট হাসিতেও তা উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। সত্যিকার ভালোবাসায় বেড়ে উঠলে কোন প্রকার সামাজিক শৃঙ্খল বা প্রথারই দরকার পড়ে না। বরং হৃদয়ের বন্ধন কেবলি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়।
“গৃহপালিতের জন্য খাঁচা লাগে না, কেবল পোষ মানাতে হয়
আপ্যায়নে একটু খাতির করলে পেছনে ছাড়ে না
শোকেও ভাগ বসাত চায়, শুয়ে থাকে কবরের পাশে।
অনেক শখের খাঁচায় সাধের ময়না শুধু ছটফট করে
বেয়ারা অবুঝ বুঝে না শিকল, কখন পালাবে হায়!”
উৎস: খাঁচা, পৃষ্ঠা ২২
চাওয়ার সাথে পাওয়ার সম্পর্ক ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। মুদ্রার এপিঠের সাতে যেমন ওপিঠের সম্পর্ক জড়িত তেমনি আর কি! আমাদের একান্ত দুঃখগুলো, নিভৃতের কথাগুলো নিয়ত পোড়ায়। আমরা আবেগে মথিত হই, আবার তা থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করি। উপায় হিশেবে গ্রহণ করি বাদ্যযন্ত্রের করুণ সুর। কবির কবিতাতেই সে স্বর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
“একতারার সুর ওঠে না, কেবল ঝংকার তোলে।
একটু সদয় হও
এখানে সকল সকল দীর্ঘশ্বাস, শূন্যতে মিলায়”।
উৎস: সংশয়, পৃষ্ঠা: ২৩
ইদানিং জনপদেও কেমন নির্জনতা খেলা করে
চোরাবালিতে হারিয়ে যায় গোপন বৈঠক
জলমগ্ন হাওরে সন্ধ্যাতারা ঝিলমিল করে কুপিতে ফুরিয়ে যায় প্রতীক্ষার দীর্ঘ প্রহর।
এবার নিলাম হবে ভালোবাসা, সন্ধ্যা হাটে।
উৎস: আগুন সন্ধ্যা, পৃষ্ঠা:২৪
কবি কবি খালেদ উদ-দীন সময় সচেতন, রোমান্টিক, কৌশলী এবং যারপর নাই বিচক্ষণ কবি। মনের অব্যক্ত কথাকে তিনি আয়নার মতো করে তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তোলেছেন। বৈষ্ণব কবিতাগুলো পড়লে যেমন মনে হয়- এ হচ্ছে আমাদের কথা, হাজার বছরের বাঙ্গালির কথা- তেমনি কবি খালেদ উদ-দীনের কবিতাতেও যেন সেরকমই আবেদন ফুটে ওঠেছে।
“প্রতিবিম্ব উল্টো হলেও বড় বেশি আপন মনে হয়
জোসনা রাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দে কেউ কেঁপে ওঠে না
মেষ রাখাল চলছে… সেও কৌশলী হতে জানে…
সালিশে বিবাদ মীমাংসা হয়, থেকে যায় ক্ষত।
আমাকে তুমি কখনো কৌশলী হতে বলো না”।
উৎস: আয়না, পৃষ্ঠা ২৫
রোমান্টিক কবি শরীরী আবেদনে কাতর। এটা খুবই স্পষ্ট যে, আমরা কখনোই পুরোপুরি রোমান্টিক নই, রোমান্টিক থাকতে পারি না; হয়ে উঠি শাররীক! অন্ধ জৈবিক তাড়না আমাদের রোমান্টিক থাকতে দেয় না। কবির কবিতাতেও সে রূপ স্পষ্ট।
“পৌষের সকালে মিঠে রোদ কড়ানাড়ে সূর্যমুখী বিশাল মুখে হা করে থাকে
প্রতীক্ষায় আছে নকশী কাঁথা, মিহি শিলাই
আমার প্রাণ যে সয়না… কোথায় রইলা তুমি…
শীতের তীব্রতা খুব, আমার উষ্ণতা চাই”।
উৎস: মিঠে রোদ, পৃষ্ঠা ২৮
আধুনিক কবিদের বিচ্ছিন্ন চিন্তার ছায়াপাতও যেন তাকে অজ্ঞাতসারেই পেয়ে বসেছে। কবিতায় জীবনের জয়গান রয়েছে, তবে তা নির্দিষ্ট কোন সারমর্ম প্রকাশ করে না। যেমন:
“কাব্য ফ্যাশনে বিভোর ইদানিং মহাজন
বহুতল ইমারতের ঠান্ডা ঘরে শরাব মূর্ছনায়
বাহারি রঙে হাই তুলে সকল মেদ
ক্যামেরা প্রস্তুত, লাইভ চলছে লাইভ…
ক্লান্ত দিনের শেষে উড়ে যায় শঙ্খচীল, উড়ে যায়…”
উৎস: কাব্যবাজার, পৃষ্ঠা ৩১
উপমার ব্যবহারে কবি যেন সদ্য কিশোর! ব্যবহারের আকুতি প্রবল। তবে চেষ্টাতে কোন প্রকার ত্রুটি করতে তিনি নারাজ। নিচের কবিতাদ্বয় যেন তারই প্রমাণ বহন করে। যেমন:
“বুকে তৃষ্ণারেখে চলে গেছে ভোরের পাখি…
তুমি ভেবে রেখ, আমি যদি বলেই ফেলি, তুমি কী বলবে…”
উৎস: ঘূর্ণি হাওয়া, পৃষ্ঠা ৩২
“এই নাও একটা ফুল; এই নাও আরেকটা
আবার হাত বাড়াও, এই কয়েকটা নাও
এখন তোমার হাতে অনেক ফুল
মালা গাঁথবে নিশ্চয়!
কার গলাতে পড়াবে মালা, দেখবে তুমি কার”।
উৎস: মালা, পৃষ্ঠা ৩৩
যার চাওয়ার মাধ্যে কোন খাঁদ থাকে না সে নাকি কখনো হারে না! কবি এমনই চিন্তায় নিজেকে নিমগ্ন করে কল্পনার মহারথে চড়ে পাড়ি দিতে চাচ্ছেন অনন্তের পথে। হেথা শুধু থাকবে প্রিয়জন আর প্রিয়জন।
“আমার যতসব অপূর্ণতা মিশে যায় জলে, জলসাগরে।
বারুদ বিস্ফোরিত হবার আগেই এসো ভালোবাসি”।
উৎস: হৃদ তুফান, পৃষ্ঠা ৩৪
ভোরের কুয়াশা, তারপরও ফিরে এসো, দ্বিধা, সনাতন পাঠ, ইশারা কবিতাগুলো রোমান্টিকধর্মী। তবে তাতে যেন অনেকটাই ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ চাচারা যেমন বাবার মতোই কিন্তু বাবা না, তেমনি তার এইসব কবিতাগুলোও রোমান্টিকধর্মী কিন্তু পুরোপুরি রোমান্টিক নয়!
উৎস: নীল দুঃখ, পৃষ্ঠা ৪১
জীবনের হিশাব বড়ই জটিল। সুকুমার বড়ুয়ার ‘জীবনের হিসাব’ পড়লে হয়ত কিছুটা অনুমান করা যায় তবে জীন বৈচিত্র্যতা সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। তবুও জীবন চলে জীবনেরই মতো। আর আমরাও যেন সে স্রোতের টানেই নিয়ত ভেসে চলেছি অজানার পথে। হেথা নিয়ত মুখোমুখি হচ্ছি নতুন কিছুর-যা আমাদের ভাবিয়ে তোলছে, আবেগতাড়িত করছে, নতুন আশায় উজ্জিবিত করছে।
“ভোরে যখন কমলার কোয়ার মতো সূর্য উঠবে
আর একটা প্রহসনের মুখোমুখি হব
নিলাম হবে হাড়, পাজর কিংবা বেলুন
নগরে সালিস বসবে, ফয়াসালা হবে একুরিয়ামটা কার।
ল্যামপোস্টের আলোয় ঝাঁপ দেয় আলোপোকা…”
উৎস: আলোপোকা, পৃষ্ঠা ৪৪
সময় সচেতন কবি সময়ের চিত্রকেই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলেছেন তাঁর কবিতায়। এখন এমন একটা সময়ে আমাদের বাস, এমন একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমাদের বাস- যেখান আমরা সহসাই আমাদের নিজস্বতাকে হারিয়ে ফেলছি; অথচ অনুধাবনও করতে পারছি না! বাজনার ভীড়ে যেমন গান হারিয়ে যাচ্ছে তেমনি পণ্যের আড়ালেও আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের নিজস্বতা।
“এভাবে তাকিয়ে আছো যে, শরম লাগে না?
রাজ্যের সবাই দেখছে, একটু চোখ নামাও!
বাহারি ঢঙে হরেক রঙে এমন মুদ্রা তুলেছো,
আর এতো জীবন্ত যে, চোখ ফেরানো যায় না।
পণ্যের আড়ালে তুমি হারিয়ে যাও কোন সে অনন্তে…”
উৎস: বিলবোর্ড, পৃষ্ঠা ৪৫
জলপাতালে কাব্যের সর্বশেষ কবিতাটিতে কবি নিজেই নিজের অবস্থানকে ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন, যদিও তা অনেকটাই প্রশ্ন সাপেক্ষ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কবিতাটিতে কবি উদ্দেশ্যকারীর ভূয়সী প্রশংসায় মেতে উঠেছেন। কবিমনের অন্তরঙ্গতার কারণেই অত্যন্ত সাবলীভাবে সে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবিতাটিতে।
তোমার কাব্যে শব্দশিল্পের দ্যোতনায় হকচকিয়ে যাই
ভাষাজ্ঞানের অপরিপক্কতায় নিজেকে নিয়ে বিব্রত হই
তোমার লেখা প্রতিটি কবিতা খুব আগ্রহ নিয়ে বারবার পড়ি
বুঝতে চেষ্টা করি, কবিতার কোথাও আমি আছি কী না
কবিতার প্রতিটি অক্ষর পলকহীন তাকিয়ে থাকে।
উৎস: নাদিয়া, পৃষ্ঠা ৪৮
খালেদ উদ-দীন চিন্তাশীল কবি। তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে গভীর চিন্তার সুঘ্রাণ মেলে। তবে অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, কবি যে জায়গায় রয়েছে বা যে অবস্থানে রয়েছেন সে জায়গা অত্যন্ত নাজুক! নিজেকে এ নাজুক অবস্থান থেকে উত্রণ করতে হবে। তাকে অবশ্যই আরও কঠোর পরিশ্রম করে শ্র্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। নতুবা মহাকাল কাউকে ক্ষমা করে না, সে স্বজনপ্রীতিও জানে না, কেবল শ্রেষ্ট কর্মটিকেই সে টিকিয়ে রাখে তার সোনার খাতার সোনার পাতায়।
কবির অন্যান্য কাব্য থেকে ‘জলপাতালে মিঠে রোদ’ কাব্যের ভাব, ভাষা, অলংকরণ, উপমা, অনুপ্রেক্ষা, উচ্ছ্বাস, সর্বোপরি প্রকরণে উৎকর্ষ রয়েছে। রয়েছে পূর্ণতার ছোঁয়া। তবু কিছুটা দুর্বলতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রকরণ যদি সাহিত্য বিচারের মাপকাঠি হয় তবে কবি খালেদ উদ-দীনের কাব্য নিঃসন্দেহে মহাকালের মাপকাঠিতে টিকবে বলে আমার বিশ্বাস। তাছাড়া শিল্পের ছোঁয়া না হয় নাই বা বললাম! ভাষার সরলীকরণের কারণেও তিনি পাঠক হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছবেন বলে আমার বিশ্বাস। সমকালীন সাহিত্য বিচারে তাঁর ‘জলপাতালে মিঠে রোদ’ নিঃসন্দেহে বাংলা কাব্য সাহিত্যের জন্য মাইলফলক স্বরূপ।
------------------------------
প্রস্তুতের সময়: ০৪.০৮.২০১৫- ০৮.০৮.২০১৫
মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট
ইমেইল: [email protected],
©somewhere in net ltd.