নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মোহাম্মদ হোসাইন এক আলোকিত মানুষ, নিভৃতচারী কবি। প্রাপ্ত বয়স্ক সমবয়সীরা যখন চাকুরী ও ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত মোহাম্মদ হোসাইন তখন কবিতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বন্ধুরা কেউ কেউ উৎসাহ দিলেন। আবার কেউ বা রসকিতা ছলে বলতে লাগলেন “পুরান পাগলের ভাত নেই, নতুন পাগলের আমদানি”! মোহাম্মদ হোসাইন এইসব বন্ধুদের কথা গুরুত্ব সহকারে শোনতেন, কিন্তু গুরুত্ব দিতেন না। কেননা, গুরুত্বহীন ব্যক্তিদের গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো এটা তিনি ভালো করেই জানতেন। এরপর শুরু হল একাগ্রচিত্তে সাহিত্য সাধনা। সাহিত্যের বিভিন্ন সভা সেমিনারে সক্রিয় অংশগ্রহণ। দেশি-বিদেশি কবিদের কবিতা পঠন-পাঠন। চুম্বকের প্রতি লোহার যেমন আকর্ষণ কবিতার প্রতিও মোহাম্মদ হোসাইনের তেমন আকর্ষণ। কবিতার প্রতি গভীর আগ্রহ ও ভালোবাসা থেকেই মূলত তাঁর কাব্য সাহিত্যে পদার্পণ।
দিনের পর দিন লিখতে থাকেন। একের পর এক ভরে উঠতে থাকে তাঁর কবিতার ডায়রি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল তিনি লেখাগুলো প্রকাশের কোন ব্যবস্থা করতেন না। পরবর্তীতে নিকটস্থ বন্ধুদের অনুরোধে পত্রিকায় লেখা পাঠানো শুরু হলো এবং তা পর্যায়ক্রমে ছাপাও শুরু হল। আঞ্চলিক পত্রিকা থেকে শুরু করে একেবারে জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতায় নিয়মিত ছাপা হতে থাক তাঁর কবিতা। সাহিত্যের ছোটকাগজেও তিনি নিয়মিত লিখতে থাকেন। এরপর বন্ধুদের পরামর্শক্রমে বই বের করার সিদ্ধান্তগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে নিজ উদ্যোগে বের করেন প্রথম কবিতার বই ‘ভালোবাসা নির্বাসনে গেছে’। এতে মোট ৫৬টি কবিতা আছে। উৎসর্গ করেছেন ফারজানা আরা খানম (জুম্মী) কে।
কবিতার নামকরণের মধ্যেই এক ধরনের বিরহের পূর্বাভাস মেলে। যদিও কবি মোহাম্মদ হোসাইন দুঃখবিলাসী নন তবুও দুঃখকে তিনি ভালোবাসেন, সঙ্গীনীর মতো করে কাছে রাখেন, ঠিক ছায়া যেমন মানুষের কাছে থাকে। ভালোবাসা নির্বাসনে গেছে’ কাব্যটির বিশ্লেষণে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যথা:
ক. নির্লিপ্ত ভালোবাসার কথন
খ. প্রেমের উন্মেষ
গ. সমকালীন বাস্তবতা
ঘ. রাজনীতি ও সমাজনীতি
ঙ. আত্মক্ষরণ
চ. দেশপ্রেম
ছ. বিশ্বাঙ্গনের অস্থির চিত্র
জ. প্রকৃতিপ্রেম
ঝ. আত্ম অস্থিরতা ছাপ
ঞ. বিবিধ
রাষ্ট্রযন্ত্রের আইনের মাধ্যমে দু’দেশের ভৌগলিক সীমারেখা আলাদা করা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। কিন্তু দু’দেশের মানুষের ভালবাসার টানকে পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই কখনো আলাদা করতে পারেনি। মোহাম্মদ হোসাইনের কবিতায় সে দিকটিই ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে কাব্যিক ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি। মূলত বিশেষ উৎসবে প্রতি বছরের এই দিনে ভালবাসা আর নাড়ীর টানে ছুটে আসে এই সীমান্ত এলাকায়। পেতে চায় মায়া, মমতা আর স্বজনদের সান্নিধ্য। দীর্ঘ দিনের জমা হয়ে থাকা অনেক ব্যথা-বেদনা আর আবেগে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এখানে এসে। কেউ বা একটু হেঁসে আবার কেউ হাও-মাও করে কেঁদে আপনজনকে বুকে টেনে ধরতে চাইলেও কাঁটা তারের বেড়া মনের আশা পূরণ করতে দেয় না। বাস্তবতার ঘ্রাণমাখা এমন আবেগঘন বর্ণনাই তাঁর কাব্যে ফুটে উঠেছে।
“এক শহরেই আছি
একই আকাশের নিচে বর্তমান
-------------------------------
শুধু মাঝখানে কাঁটাতার ঘিরেছে সীমান্তের প্রাচীর”।
উৎস: যেখানে কাঁটাতার ঘিরেছে সীমান্তের প্রাচীর, পৃষ্ঠা ৫
কালে কালে ভালোবাসা নিয়ে কতই না স্তুতি রচিত হয়েছে। তবু এর আবেদন শেষ হয় না। মূলত ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোন মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা। তবুও ভালোবাসাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করা যায়। আবেগধর্মী ভালোবাসা সাধারণত গভীর হয়, বিশেষ কারো সাথে নিজের সকল মানবীয় অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া, এমনকি শরীরের ব্যাপারটাও এই ধরনের ভালোবাসা থেকে পৃথক করা যায় না।
প্রকৃত অর্থে ভালোবাসার সংজ্ঞা বিতর্ক, অনুমান, এবং অর্ন্তদর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। অনেকেই ভালোবাসার মতো একটি সর্বজনীন ধারণাকে আবেগপ্রবণ ভালোবাসা, কল্পনাপ্রবণ ভালোবাসা কিংবা প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ভালোবাসা এসব ভাগে ভাগ করার পক্ষপাতী নন। তবে এসব ভালোবাসাকে শারীরিক আকর্ষণের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিন্যাস করা যেতে পারে।
আবার এটাও মনে রাখা উচিত যে, ভালোবাসার সাধারণ এবং বিপরীত ধারণার তুলনা করে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসাকে জটিলভাবে বিচার করা যায়। ধনাত্মক অনুভূতির কথা বিবেচনা করে ভালোবাসাকে ঘৃণার বিপরীতে স্থান দেওয়া যায়। ভালোবাসায় যৌনকামনা কিংবা শারীরিক লিপ্সা অপেক্ষাকৃত গৌণ বিষয়। এখানে মানবিক আবেগটাই বেশি গুরুত্ব বহন করে। কল্পনাবিলাসিতার একটি বিশেষ ক্ষেত্র হচ্ছে এই ভালোবাসা। ভালোবাসা সাধারণত শুধুমাত্র বন্ধুত্ব নয়। যদিও কিছু সম্পর্ককে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব বলেও অভিহিত করা যায়। তবুও কালে কালে ভালোবাসার প্রকৃত সংজ্ঞা নিয়ে জিজ্ঞাসার অন্ত নেই। কবির কবিতা-ই তার প্রমাণ রাখে।
তুমি সেদিন বলেছিলে-
“আচ্ছা ভালোবাসা কি রকম, তুমি কি জানো প্রাণ”!
উৎস: যেখানে অনন্ত অন্ধকার, পৃষ্ঠা ৬
একটি ছেলে আর একটি মেয়ের গল্প, তোমাকে-এক, তোমাকে-দুই, তুমি কবিতাগুলো অনেকটাই রোমান্টিকধর্মী। কবিতাগুলোতে ভাষার সরলীকরণও চোখে পড়ার মতো!
কবিতাটিতে একের পর এক প্রত্যাশার সমাহার ঘটেছে। উচ্চাশার সাথে প্রত্যাশার যুগপৎ সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়েছে। জীবনটা অনেক কঠিন, হাঁসি মুখে মেনে নিতে পারলে কিছুটা সহজ। নদী ভালবাসে সাগরকে, তাই স্রোত তার দিকেই বয়ে যায়। সাগর ভালবাসে আকাশকে, তাই জলীয় বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। আকাশ ভালবাসে মাটিকে, তাই বৃষ্টি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়। মাটি ভালবাসে উদ্ভিদকে, তাই গাছের প্রাণ সজীব হয়। আর গাছ ভালবাসে সৃষ্টির জীবকে, তাই গাছ সবাইকে অক্সিজেন দেয়। আর মানুষ মায়ের মতো ভালোবাসে স্বদেশকে, আর একারণেই স্বদেশের এত মূল্য!
“সর্বোপরি চাই সেই মানুষ
হৃদয়ে যার স্বদেশ দীপ্তিমান, জ্বলজ্বলে আকাশ!!”
উৎস: হৃদয়ে যার স্বদেশ দীপ্তিমান, পৃষ্ঠা ১১
সাতাশ বছর যে জীবনের সেরা একটি অধ্যায়, এ সময় যে জীবনকে স্বরূপে চেনা যায়, নতুন করে উপলব্ধি করা যায় ‘দুর্দান্ত সাতাশ বছর’ কবিতার মধ্য দিয়ে সে রকম চিন্তার স্ফুরণ ঘটেছে।
জীবন সময়ের মতোই গতিশীল। মূলত তাঁর কবিতায় গতিশীল মানুষের কর্মতৎপরতা আর মানবসমাজ ও সভ্যতাকেন্দ্রিক প্রাণিজগতের গতিশীল জীবন ও কর্মতৎপরতা পর্যবেক্ষণ করা যায়। কবির কবিতায় মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতির সবকিছুই যেন এক ধরনের ক্রিয়াশীল অভিব্যক্তি নিয়ে চলমান দেখা যায়। তিনি প্রকৃতিজগতের এই গতিশীলতাকে আবিষ্কার করেছিলেন প্রকৃতি-প্রদত্ত অন্তর্দৃষ্টি থেকে। তাঁর কবিতা থেকে-
“নিঃশব্দে পেরিয়ে যায় অলস দুপুর
বিছানা বালিশে গড়াগড়ি খায় মধ্যবিত্ত সুখ
পূবের জানালায় উঁকি দেয় কিশোরী বাতাস
দোলে ওঠে পর্দার অল্প বয়স”।
উৎস: অলস দুপুর, পৃষ্ঠা ১২
সাহিত্যকে আর্থিক দ্যোতনায় তরঙ্গায়িত করার জন্য উপমা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপমার ব্যবহারে বাক্য হয়ে উঠে প্রাণবস্তু। বাক্যের অর্থ শ্রুতি সুখকর হয়ে পাঠককে তুলনামূলক ভাব ঐশ্বর্য দান করে। কবির কবিতায় উপমাগুলোও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
“অন্ধকার শুয়ে থাকে কালো বেড়ালের মতো
প্রতিদিন বা’ পাশে আমার
---------------------------
নিজেও হয়ে যাই আঁধারের নিজস্ব নির্মাণ”।
উৎস: অন্ধকার, পৃষ্ঠা ১৩
ইচ্ছেগুলো, সে, আছে, দৈর্ঘ্যে নেই, প্রস্থেও নেই, দৃশ্যকল্প, নিজস্ব নির্মাণ, যেখানে কেউ নেই, প্রিয়তমা, যে তুমি একদিন, ভালোবাসার সুখ, তুমি আছো বলেই, যতো কষ্ট দাও, কাঁটা, ভালোবাসা এমনই, স্বপ্ন সেজেছে বর, তুমি ও আমি, ভুল ওষ্ঠে ভুল মানুষে, দেখা না দেখা, কবিতাগুলোতে রোমান্টিকতার সাথে নিজের অব্যক্ত কথনের নির্লিপ্ত সুর, আবেগঘন বেদনার ছবি, অত্যন্ত সুচারুরূপে ফুটে উঠেছে। ‘প্রশ্নে নেই উত্তরে আকাশ’ কবিতাতে কবি মানুষের নিজস্বতাকে, সৃষ্টিশীলতাকে, মানবীয় গুণাবলীকে উপমা আর অলংকরণে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ‘তিনটি মানুষ ও একটি ঘটনা’ কবিতায় তিনি বাস্তবতাকেই দর্পণের মতো করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
নারী কবিতায় তিনি নারীর স্বরূপকে প্রকৃতির মতোই দুর্বোধ্য জ্ঞান করেছেন। ‘যখন একা থাকি’ কবিতায় নিঃসঙ্গতার শোচনীয় দিকের পাশাপাশি চিন্তাশীল ও রোমান্টিক ভাবনার বিষয়ে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যের কথা তোলে ধরেছেন। গুচ্ছ কবিতা, দৃশ্যকল্প-১, দৃশ্যকল্প-২, দৃশ্যকল্প-৩ কবিতাত্রয়ে কবি জীবন জিজ্ঞাসায় প্রকৃতির স্বরূপকে উদঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। নাগরিক জীবনের গতিশীল ধারায় উঠন্তি যুবকের আলস্যের দিকটিও ফুটিয়ে তোলতে তিনি বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। শহর-জীবনের জটিলতাও তাঁর কাব্যে সুচারুরূপে ফোটে উঠেছে। উপমায় তিনি যে সিদ্ধহস্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
“ঝুলে আছে কুমারী চাঁদ আকাশের-খিলানে
হাসছে ক্রুর হাসি নাগরিক ল্যাম্পপোস্ট
কোন গোপন রহস্যের মঞ্চায়নে
উপচে পড়ছে যৌবনের মদ
----------------------
দেখো যাচ্ছে হেঁটে মধ্যরাতের কব ও কাঙাল
রাত্রি ও রমণী, বায়ু ও বসন্তকাল…”
উৎস: দৃশ্যকল্প-২, পৃষ্ঠা ২৫
‘একে ভুল বোঝো না’ কবিতায় জীবন সন্ধানী কবি জীবনের পরতে পরতে যে তমসা মিশ্রিত খাদ রয়েছে, অন্ধকারের ভয়াল থাবা রয়েছে এবং তা যে ছায়ার মতোই নিত্য সঙ্গী সে দিকটিই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফোটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। হ্যাঙ্গারে ঝুলন্ত চাঁদ, শেষ বিকেলের যাত্রা, রাতের কবিতা, দুঃস্বপ্নের রাত, দুঃস্বপ্নের হাড়-গোড় প্রভৃতি কবিতাগুলোতে জীবনে ছোঁয়া লাগা স্বপ্ন ও সুন্দরের কথা, প্রতিবন্ধকতার কথা, হতাশার কথা, উদ্যমের কথা সাবলীল ভাষায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
যেমন:
“আমি জলের ওপর জলযান খুঁজি
নিরেট অন্ধকার ভেদ করে সম্মুখে আগাই
উত্তাল ঢেউয়ের বুকে ঢেউ হয়ে নির্ভিক সাঁতরাই
---------------------------------------------
অসময়ে পেয়ে যাই কোন শেষ বিকেলের ট্রেন,
দাঁড়াবোনা আর…”
উৎস: শেষ বিকেলের ট্রেন, পৃষ্ঠা ২৯
শুদ্ধতম আধুনিক কবি শামসুর রাহমানকে উৎসর্গ করে তিনি যে কবিতা লিখেছেন তা সত্যিকার অর্থেই কাব্যকে প্রাণদান করেছে। তাছাড়া কবিতাটিতে ভাবের আতিশয্যও খেয়াল করার মতো, যদিও তা কবিতার পঠন-পাঠনে বিন্দুমাত্রও বিচ্যুতি ঘটায় না! ‘গালীবের হৃদয়’ কবিতায় কবি জীবন খেয়ায় কবির রূচি ও প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
জীবনের স্মরণীয় ঘটনার খণ্ডাংশ নিয়ে স্মৃতির আল্পনা আঁকতে কার না ভালো লাগে! তবে কবিই বা বসে থাকবে কেন? অনুসন্ধিৎসুর মতো জীবনের অর্থ খোঁজে বেরিয়েছেন। জীবন মানেই সুখের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো। বেঁচে থাকা মানেই দুঃখের সাথে সহবাস করা। ঘটনার পাশাপাশি সময়কেও ধরে রাখতে চেয়েছেন স্মৃতির আল্পনায়।
“ছিল শরতের অখণ্ড বিকেল।
হাওয়ায় ওড়ছিল রূপসীর ওড়নার পাড়,
-----------------------
ধ্রুপদী সেতার রবীশংকরের-
পার্শ্বের শোয়ানো যার চন্দ্রমগ্নরাত”।
উৎস: রবীশংকরের সেতার, পৃষ্ঠা 36
অঙ্গীকার কবিতায় তিনি মানব জীবন সংশ্লিষ্ট সবকিছুরই বিশুদ্ধতা কামনা করেছেন। জীবন মানে যুদ্ধ। জীবন মানে হাসি-কান্না। জীবন মানে পাগলামি করা। জীবন মানে বার বার আশাহত হয়েও আশায় বুক বাধা। জীবন মানে মেঘলা আকাশে ছবি আঁকা। জীবন মানে এক টুকরা হাসি। জীবন মানে ভোরের শিশির। জীবন মানে অনেক অনেক কিছু। জীবন মানে বেঁচে থাকা। জীবনের স্বরূপ অন্বেষণে কবির কবিতায় আমিত্ববোধ জেগে উঠেছে।
প্রকৃতি মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে, মানুষ প্রকৃতিকে ছাড়া বাঁচতে পারে না। আবার প্রকৃতি মানুষ থেকে কিছুই না নিয়েও বাঁচতে পারে, মানুষ পারে না। আবার প্রকৃতির মধ্যেও আছে এক রকম তারতম্য। তারপরেও চিরসত্য হলো বিশুদ্ধতার মধ্য দিয়েই সত্য ও সুন্দরে জয় হয়। কবির কবিতার মধ্যে সে দিকটিই তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
যেমন:
“আমাকে জল দাও বিশুদ্ধ জল
আমাকে মাটি দাও উর্বর মাটি
আমাকে সবুজ দাও বৃক্ষের সবুজ
আমাকে শোভা দাও প্রকৃতির শোভা”।
ডাক দিয়ে যায় হলুদ পাখি, নষ্ট চাঁদ, একটি অচল পদ্য কবিতাত্রয়ে ভিন্ন ছন্দ আনয়নের চেষ্টা করেছেন। মোট কথা ভালোবাসা নির্বাসনে গেছে কাব্যের এই তিনটি কবিতা ব্যতীত বাকী সবগুলো কবিতাই গদ্য ছন্দে লেখা। ‘গন্তব্য জানা নেই’ কবিতায় কবির মানস প্রেমিকাকে প্রকৃতির সাথে তুলনা করেছেন। তুলনা করেছেন ছায়ার সাথে, তুলনা করেছেন দুঃখিনী বর্ণমালার সাথে, আকাশের সাথে এমন কী অন্ধকারের সাথেও।
আশার মধ্যেই বাস করে হতাশা। মানুষ এ কথা জানে। তবুও সব সময় মনে রাখার চেষ্টা করে না। আশা জাগ্রত হলেই সুখ উঁকি দেয়। সুখ বাঁচিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি অনুভব করে মানুষ। যে কোনো ছলছুতোয় সে দুঃখকে ডেকে নিয়ে আসে। সত্যিই মানুষ বড়ই বিচিত্র প্রাণী। সুখের চেয়ে দুঃখের সাথে বাস করতে মানুষ বড় আরাম বোধ করে। কারণ অতি সুখে হাহাকার থাকে না। সন্দেহ, জ্বালা অথবা নিজেকে বঞ্চিত ভাবার যন্ত্রনা পাওয়া যায় না। কোনো এক মুহূর্ত অথবা কিছুদিন বুকে খুশির সূচিকর্ম সারাজীবন টাঙিয়ে রাখার নাম জীবন। প্রত্যাশা যেমন জীবনের অংশ তেমনি হতাশাও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হতাশার জয়ভেরি জাগ্রত থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশা নিয়ে মূলত মানুষ বেঁচে থাকে। এ হল মানুষের সহজাত প্রভৃতি। কবির নিম্নোক্ত কবিতাতে এমনি আশা-নিরাশা ও প্রত্যাশার যুগপৎ চিত্র সুচারুরূপে ফোটে উঠেছে।
“শীত শেষে যেমন ফিরে যায়
‘অতিথি পাখি’ তাদের নিজস্ব নিবাসে আবার
প্রতিটি বর্ষায়-ই যেমন ফিরে আসে
----------------------------------
তেমনি তুমিও একদিন আসবে ফিরে
নির্বাসন শেষে এই আমার আজন্ম
ক্ষরিত হৃদয়ে। আবার গজাবে সবুজ ঘাস
বিরাণ প্রান্তরে, ওঠবে ডেকে অজান্তেই
কোন প্রিয় পাখি’ বউ কথা কও’ বলে”।
উৎস: ভালোবাসা নির্বাসনে গেছে, পৃষ্ঠা ৪৬
বিশিষ্ট কবি নির্মলেন্দু গুণের স্বাক্ষর সম্বলিত শুভেচ্ছাবাণী কবিতার ফ্ল্যাপকে করেছে আরও মোহনীয়। কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে উপমার ব্যবহারে কবি যে প্রকৃত পক্ষেই খুব সিদ্ধহস্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথম কাব্যেই কবি ভাষার সরলীকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। যে কোন শ্রেণির সাহিত্যবোদ্ধা পাঠক কাব্য পাঠমাত্রই তা সহজেই বোধগম্য হবে বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর কাব্য অলংকরণের বিষয়টিও চোখে পড়ার মতো।
মোদ্দাকথা, কবি মোহাম্মদ হোসাইন তাঁর প্রথম কাব্য ‘ভালোবাসা নির্বাসনে গেছে’ নামকরণের ক্ষেতে যেমন শিল্পসফল তেমনি বাংলা সাহিত্যের জন্যও মাইলফলকস্বরূপ।
মুনশি আলিম
২২-০৮-২০১৫
ইমেইল: [email protected],
শিবগঞ্জ, সিলেট
©somewhere in net ltd.