নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়ি এবং লেখি

সৃষ্টিশীল আলিম

ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ

সৃষ্টিশীল আলিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

মো. ইর্শাদ আলী এক আলোকিত মানুষ, এক আলোকিত মুক্তিযোদ্ধা

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৮

সিরিজ - ১



সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার তোয়াকুল একটি অতি পরিচিত ইউনিয়ন। নানা কারণেই এই পরিচিতি। একদিকে যেমন প্রাকৃতিক শোভা অন্যদিকে তেমনি দেশের সেরা সন্তানদের তথা মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও অনেক বেশি। কালেরস্বাক্ষী বহনকারী চেঙ্গেরখাল ও পিয়াইন নদীর তীরে গড়ে উঠা ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল হলো তোয়াকুল ইউনিয়ন। কাল পরিক্রমায় আজ তোয়াকুল ইউনিয়ন শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার নিজস্ব স্বকীয়তায় আজও সমুজ্জ্বল। এই তোয়াকুল ইউনিয়নে রয়েছে ছোটবড় ২১টি গ্রাম। তন্মধ্যে জনসংখ্যাধিক্যের দিক দিয়ে পাইকরাজ গ্রাম সবার শীর্ষে।

মো. ইর্শাদ আলী ১৯৫৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাইকরাজ গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাহমুদ আলীর শিক্ষার দৌরাত্ম্য খুব একটা বেশি ছিল না। তবুও যা জানতেন তাতেই গ্রামে সম্মানীয় মুরব্বী হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিল। ব্যক্তি জীবনে মাহমুদ আলী যেমন সৎ ও নিষ্ঠাবান ছিলেন তেমনি প্রভাব লক্ষ করা যায় ইর্শাদ আলীর মধ্যেও। পিতা মাহমুদ আলীর তিন ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে ইর্শাদ আলী সবার বড়। ছোট ভাই নূর মিয়া ও বদরুল ইসলামের সাথে ছিল তাঁর গলায় গলায় ভাব। বয়সের যদিও অনেক ফাঁরাক ছিল তবুও তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার যেন এতটুকু কমতি ছিল না। দূর থেকে সহসা বুঝাই যেত না যে তাঁরা ভাই নাকি বন্ধু! বোনদের প্রতিও ছিল তাঁর অপরিসীম দরদ।

ব্যক্তিজীবনে ইর্শাদ আলী খুবই সরল প্রকৃতির মানুষ। সব ধরনের জটিলতা ও দুর্নীতি থেকে তিনি নিজেকে নিরন্তর দূরে রাখার চেষ্টা করেন। আর একারণেই হয়ত গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তাঁকে নির্লোভ এবং সৎ মানুষ বলেই জানে। বাবার ইচ্ছে অনুযায়ীই তিনি স্কুলে ভর্তি হন। যতদূর জানা যায় পড়াশোনাতে তিনি খুব একটা খারাপ ছিলেন না। বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের টুক-টাক কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্কুলে পড়াশোনার কাজও চালিয়ে নিতেন। এভাবেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পদার্পণ করেন।

পারিবারিক নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনা ছাড়েননি। নিজের অদম্য মনোবলের কারণেই তিনি শেষপর্যন্ত পড়াশোনাতে লেগে রইলেন। তিনি যখন নবম শ্রেণিতে পড়েন তখন দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা একে একে ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র অবস্থায় আস্তানা গড়ে তুলছে। হানাদার বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করতেই পুরো গ্রামের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের সাধারণ মানুষ যে যেভাবে সুযোগ পেল নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে লাগলো। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই যেন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। হানাদাররা গ্রামের অনেক যুবতীদের ধরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যেত। দিনের পর দিন তাদের শাররীক নির্যাতন করত। আর যুবকদের দেখামাত্রই নির্বিচারে গুলি করে মারত।

বয়সে ছোট হলেও দেশের খারাপ পরিস্থিতি সম্পর্কে তখন ভালোই আঁচ করতে পারতো ইর্শাদ। এই কিশোর বয়সেই মনে মনে পরিকল্পনা করলো দেশের হয়ে তিনি কিছু একটা করবেন। সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধে যাবেন। একদিকে মায়ের প্রতি টান অন্যদিকে দেশকে রক্ষা করা- তিনি যেন উভয় সংকটে পড়লেন। শেষপর্যন্ত নিজের মাতাকে ছেড়ে দেশ মাতাকে বাঁচানোর জন্য দৃঢ় সংকল্প নিলেন।

প্রথম যুদ্ধের সংবাদ:
প্রথম বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে তিনি যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন। তৎকালীন সময়ে টেলিভিশনের বহুল প্রচলন ছিল না বলে রেডিও-ই ছিল একমাত্র ভরসা! মুক্তিযুদ্ধে যে বিভিন অঞ্চল থেকে যুবক-যুবতীদের ট্রেইনিংয়ে নিচ্ছে এটা প্রথম তিনি রেডিওর মাধ্যমে শুনেন।


একদিন মিলিটারিদের হাতে:

পাকিস্তানী মিলিটারিরা তখন তোয়াকুল ইউনিয়নে প্রথম প্রবেশ করে। দল বেঁধে তারা গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ করতে থাকে। সেদিন তিনি কী কারণে যেন রাস্তাতেই ছিলেন। পাকিস্তানী প্লাটুন কমান্ডার রাইফেল তাক করে তাকে কাছে ডাকলো। তিনি অনেকটা দুরুদুরু বুক নিয়ে তাদের কাছে গেলেন। এই বুঝি বন্দুকের গুলিতে জীবন শেষ হয়ে যায়! কাছে যেতেই কমান্ডার জিজ্ঞেস করলেন- বাচ্চু, ইদারছে আইয়ে, তুম মুক্তিকা দেখতা হায়? – না স্যার। কমান্ডার যদি বাংলা ভাষা না বুঝে এজন্য তিনি মাথা দিয়ে না করলেন। তুম মেরা ক্যাপ রাখেগা।

সেদিন কিশোর ইর্শাদ আলী ভয়ে অনেকটাই জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে ক্যাপ রাখলেন এবং তাদের আস্তানা পর্যন্ত যেতে বাধ্য হলে। সেদিন তিনি পাকিস্তানীদের আস্তানা থেকে ফিরে এসেই সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি যুদ্ধে যাবেন।

যেভাবে ট্রেইনিংয়ের রাস্তা চিনলেন:

দেশের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপ হওয়া শুরু করলে তিনি নিজে নিজেই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান করতে থাকেন। কোথা থেকে ট্রেইনিং হয় বা কে ট্রেইনিং করান। বিশেষ করে পাকিস্তানী মিলিটারীরা যখন তাদের এলাকায় এসে যুবক বৃদ্ধ এবং নারীদের ওপর নির্যাতন আরম্ভ শুরু করলো এবং তাদের কারণে পুরো গ্রাম আতংকিত হওয়া শুরু করলো এমতাবস্থায় একদিন তিনি বাড়ির কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছাড়লেন। উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। বাড়ি ছাড়লেন ঠিক কিন্তু কোথায়, কীভাবে, কার সাথে থেকে যুদ্ধ করবেন কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। তবে মনে মনে খোঁজতে লাগলেন এইরকম মুক্তিযোদ্ধাদের। গ্রামের মানুষকে রক্ষা করতে, উপজেলাকে রক্ষা করতে সর্বোপরি দেশকে রক্ষার জন্য তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন।

তিনি ভালো করে খেয়াল করে দেখলেন বেশ কিছু মানুষ দলে দলে হাদারপাড় হয়ে বন-জঙ্গল ও সরো পথ ধরে আসাম-মেঘালয়ের দিকে যাচ্ছে। তিনি তাদের অনুসরণ করলেন। কী খাবেন, কোথায় থাকবেন, কিছুই ভাবলেন না। যুদ্ধে যেতে হবে এটাই তার শেষ কথা! যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তখন সারা উপজেলা জুড়ে ছিল পানিতে টইটম্বুর। হাদারপাড় গিয়ে রাত হয়ে গেল। তিনি এলোপাথারি হাঁটছিলেন। এমন সময় সেখানকার এক পূর্ব পরিচিত দর্জি তাকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বিস্তারিত বললো।

সব শুনে দর্জি তাকে রাতে থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা করে দিলেন। পরের দিন যেসব গোয়াইনঘাটের যুবক-যুবতীরা মেঘালয়মুখী রওয়া দিচ্ছিলেন তিনি তাদের সাথে রওয়ানা দিলেন।

প্রথম ট্রেইনিং:
তিনি প্রথম ট্রেইনিং গ্রহণ করেন ভারতের মেঘালয়ে সংলগ্ন পাহাড়ী এলাকার ভারতীয় ক্যাম্প। সেখানে গিয়ে তিনি তো অবাক। তার অনেক পরিচিত লোকও সেখানে ছিলেন। গোর্কা কমান্ডার তাদের প্রশিক্ষণ দিত। উল্লেখ্য যে, তিনি তিন দিনের মধ্যেই বেশ পরিপক্ক হয়ে উঠেছিলেন।

পলায়নরত সৈনিক:
ট্রেইনিংয়ের কয়েকদিনের মাথায় তাঁর এলাকার আলাউদ্দিন ও খলিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পলায়ন করেন। অবশ্য পরবর্তীতে ইর্শাদ আলী নিজে এসে গ্রামের অনেকের সহযোগিতায় বুঝিয়ে তাদের নিয়ে গেছে।

অস্ত্র:
২১ দিন ট্রেইনিংয়ের মধ্যে তাদের রাইফেল, এসেলার, এসএমজি, মেশিনগান প্রভৃতি অস্ত্র চালনা শিখানো হয়েছে।

ক্যাম্পের আয়তন:
মেঘালয়ের কয়েক একর জায়গা জুড়ে ছিল ক্যাম্প। সেখানে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা তাবু গেড়ে প্রশিক্ষণ নিত। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ামাত্রই তাদের শপথ পাঠ করিয়ে দেশমাতৃকা রক্ষার জন্য পূর্ব বাংলায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

অপারেশন :
তিনি সর্বমোট ১৪টা অপারেশনে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে অংশ গ্রহণ করেন। সবগুলো অপরেশনই ছিল সুনামগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায়। প্রথম অপারেশন ছিল বনগাঁও ও লতা গাঁও’র মাঝামাঝি গ্রামে। সে অপারেশনে মোট ৪৪ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে উল্লেখ্য যে, এই অপারেশনে এই ৪৪ জনেই জীবিত ছিলেন।

বিনোদন:
প্রশিক্ষণে বিনোদনের বিশেষ কোন সুযোগ ছিল না। তবে মাঝে মধ্যে রেডিওর গনজাগরণমূলক গান শোনাই ছিল তাদের প্রধান বিনোদন।

স্মরণীয় ঘটনা:

একদিন ফলোইন করা ও অস্ত্র মুছার সময় তিনি একটু তাড়াতাড়ি করায় কমান্ডার তাকে শাস্তি দিলেন। রাইফেল দিয়ে তাঁর বুকের মধ্যে রাইফেল দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এ শাস্তি তার প্রাপ্য নয়।

অহেতুক আঘাত করার করাণে তিনি মর্মাহত হলেন তিনি সিনিয়র শিখ কমান্ডারের কাছে অভিযোগ করলেন। তাঁর অভিযোগ শুনে শিখ কমান্ডার কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন দেশের জন্য এই অন্যায় শাস্তিটুকু মেনে নাও। এরপর তিনি তাঁর পিঠ চাপড়িয়ে সান্ত্বনা দিলেন। শিখ কমান্ডারের পিতৃসুলভ আচরণে ইর্শাদও তার দুঃখ ভুলে গেলেন। যুদ্ধে কমান্ডাররা তো শুধু কমান্ডারই নন, সৈনিকদের অভিভাবকও বটে!

প্রশিক্ষণের স্থান:
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইকুয়ান অঞ্চলে ট্রেইনিং করেছিলেন। সর্বমোট ২১ দিন ট্রেইনিং করার পর তাদেরকে শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়।

শাস্তি:
যারা যুদ্ধের সময় একটু অমনযোগী ছিল তাদের বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দিত। তবে এসব শাস্তির মধ্যে ট্রলিং ছিল অন্যতম।

সৈন্য সংখ্যা:

ট্রেইনিংয়ে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ অসংখ্য সৈন্য ছিল। সমস্ত মেঘালয় ও আসামরাজ্য জুড়ে যেন প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। ১০০ জন কিংবা ২০০ জন এভাবে দলে দলে তারা বিভক্ত হয়ে প্রশক্ষিণ নিত। থাকার জন্য আলাদা আলাদা তাবুও ছিল।

প্রশিক্ষণ শেষে কমান্ডার আব্দুল গফুরের নেতৃত্বে ২০০ জন সৈন্য দিয়ে ৫ নং সেক্টরে অর্থাৎ বালাট ক্যাম্পে প্রথম তাদের পাঠানো হয়। সহ কমান্ডার ছিলেন কুমিল্লার কামাল হোসেন, সাঈফ আলী। উদ্দেশ্য সুনামগঞ্জ অঞ্চলকে হানাদার মুক্ত করা।

খাদ্য:
ট্রেইনিংয়ের সময় সকাল ও দুপুরে তাদের পরোটার সাথে ডিম বা বিভিন ধরনের ভাজি দেওয়া হত। আর রাতের বেলায় দেওয়া হত ভাত। তবে প্রতিদিনই তাদের তরকারির মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল।

সর্বমোট সময়:
প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অপারেশনে অংশগ্রহণসহ মোট সাড়ে আটমাস তিনি যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকার মানুষের সাথে পরিচিতি ঘটেছে; অর্জন হয়েছে বিপুল অভিজ্ঞতা।

শপথ:
কোরআন এ বাইবেল ও গীতার মধ্যে হাত রেখে শপথ করানো হয়েছে।

কর্ণেল-কমান্ডার দ্বন্দ্ব:
যুদ্ধ শেষের দিকে যখন অস্ত্র জমা দেওয়ার সময় ঠিক তখনি সৈনিকদের পোশাক নিয়ে বেশ একটা দ্বন্দ চরমে উঠলো। কর্ণেল দত্তের সাথে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল গফুরের সাথে প্রকাশ্যেই দ্বন্দ হলো। দ্বন্দ্বের ফলে কমান্ডার কর্ণেল দত্তের কাছে অস্ত্র জমা দিতে অস্বীকার করে। পবের্তীতে সারা দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে যখন ঢাকায় অস্ত্র জমা দেওয়ার ঘোষণা হল তখন আব্দুল গফুর তার বাহিনীর সব সদস্য নিয়ে নিজ উদ্যোগে অস্ত্র জমা দিলেন।

যুদ্ধফেরত:
যুদ্ধ শেষে সব মুক্তিযোদ্ধার হাতে আইডি কার্ড তুলে দেন মেজর মোতালিব।


বাবার ও মায়ের অনুভূতি:
অনেক মা-বাবা যুদ্ধে তাদের সন্তানদের যেতে বারণ করলেও ইর্শাদ আলীর পিতামাতার ক্ষেত্রটা ছিল ভিন্ন। তারা তাকে যেতে কোন প্রকার বাঁধা দেননি। যদিও প্রথম দিকে পরিবারের কাউকে না বলেই ইর্শাদ প্রশিক্ষণে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশিক্ষণ ফেরত আলাউদ্দিন ও খলিলকে নেওয়ার সময় তার বাবা ও মা তাকে কোন প্রকার বাঁধা দেননি। বরং আশীর্বাদ করেছেন।

যুদ্ধ শেষ হলে যুদ্ধ ফেরত ছেলেকে আলিঙ্গন করে বাবা মাহমুদ আলী কেঁদে কেঁদে বলছিলেন- বাবা, তুমি আইছ, ছিন্তা খরিয়ো না, আল্লায় তোমরারে খাবাইবা। আমি খুব খুশ অইছি। দেশ স্বাধীন খরিয়া ফিড়িয়া আইছ এর তাকি আমার আর বেশি ফাওনার কিচ্চু নায়। আল্লায় তোমাতানরে হেফাজত খরবা। বাবা মাহমুদ আলীর মতো তার মা-জয়তারা বেগম ও আবেগাপ্লুত হয়ে বুকে জড়িয়ে আশীর্বাদ করলেন।

গেজেট নং: ২২২৯ মুক্তিবার্তা: ০৫০১১১০২০৯, ভারতীয় জাতীয় পত্রিকা: ২৭৬
ন্যাশনাল আইডি নং: ৯১১৪১৮৪৯৪৪৫৮৩
স্ত্রীর আইডি নং: ৯১১৪১৮৪৯৪৪৫৮৬

যাপিত জীবন:
বর্তমান সরকারের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা যে সম্মান ও সম্মানি পেয়ে আসছেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পিতার কাছ থেকে ইর্শাদ আলী ও তার ভাইয়ের যে সম্পত্তি পেয়েছে তা খুবই সামান্য। যদিও সে সম্পত্তিগুলো এখনো ভাগ ভাটোয়ারা হয়নি। ভাগ ভাটোয়ারা করলে তার ভাগে খুব একটা বেশি পড়বে না। তথাপিও তার কোন দুঃখ নেই। কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে ও সরকারের প্রদেয় সম্মানি নিয়ে মোটামোটিভাবে দিন কেটে যাচ্ছে।

তিনি বর্তমানে তোয়াকুল ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডারদের দায়িত্ব পালন করছেন।


একনজরে মাহমুদ আলীর পরিবার
স্ত্রী: জয়তারা বেগম
ছেলে: ৩জন :: মেয়ে: ৬ জন

ছেলে:
1. ইর্শাদ আলী- মোছা. ছলিমা বেগম-  ছেলে: ২ জন, মেয়ে ৬ জন

2. নূর মিয়া- স্ত্রী: দিলারা বেগম: সন্তান ছেলে: ৩ জন, মেয়ে: ২ জন
3. বদরুল ইসলাম- স্ত্রী চম্পারুন নেছা  ছেলে ৪ জন, মেয়ে ২ জন
মেয়ে: ৬ন

1. সাকুন নেছা: স্বামী মোবারক আলী
2. আনজুগণ নেছা- স্বামী কালা মিয়া
3. তৈয়বুন নেছা- স্বামী মৃত ইসমাইল আলী
4. আতাফুল নেছা- স্বামী : মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মছব্বির
5. জরিফুন নেছা: স্বামী: মুক্তিযোদ্ধা মো. আলাউদ্দিন
6. জাহানারা বেগম: স্বামী মো. লুৎফর রহমান

পারিবারিক নাতি-নাতনী, ভাতিজীদের ছবি





একনজরে ইর্শাদ আলীর পরিবার
স্ত্রী: মোছা. ছালিমা খাতুন

বড় থেকে ছোট
1. দিলোয়ার হোসেন - অবিবাহিত
2. জমিলা বেগম- স্বামী জালাল উদ্দিন সন্তান: ২ মেয়ে
3. রাশিয়া খানম- বিলাল আহমদ সন্তান: ২ মেয়ে
4. আলী হোসেন- স্ত্রী: মালিকী তানিয়া জান্নাত মিনু
5. সিসমা বেগম: বয়স ২০, পড়াশোনা: নবম শ্রেণি পর্যন্ত
6. তুলন বেগম: ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে
7. সুমি আকতার: নবম শ্রেণিতে পড়ে

পারিবারিক নাতি-নাতনী, ভাতিজীদের ছবি




বিয়ে:
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ইর্শাদ আলী ও তাঁর সঙ্গীরা যার যার বাড়িতে ফিরে যায়। বাবা মাহমুদ আলী তীর্থের কাকের মতো পুত্রের আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। ইর্শাদ সুস্থ সবল দেহে বাড়ি ফিরে আসাতে পুরো বাড়ি জুড়েই যেন আনন্দের বন্যা! তাদের খুশি আর দেখে কে! বোনেরা একত্রিত হয়ে কত রকমের পিঠা-পায়েস, কোর্মা-পোলাওয়ের ব্যবস্থা করলেন তার কোন ইয়ত্তা নেই। মায়ের আনন্দের কথা না হয় নাই বললাম। বাড়ির সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো এই ফিরে আসার সাথে সাথেই তাকে সংসারি করাবে, যাতে আর বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র না যায়। যে কথা সেই কাজ।
বাবা মাহমুদ আলী পাশ্ববর্তী গ্রাম জাঙ্গাইলের আব্দুল শুকুরের এক সহজসরল অষ্টাদশী কন্যা মোছা. ছালিমা খাতুনের সাথে বিয়ে দেন। গ্রামীন পরিবেশে বেশ ধুমধামের সাথেই তাদের বিয়ে হয়। উল্লেখ্য ছালিমা খাতুন অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন।

সমাজকর্মী ও শিক্ষানুরাগী:
নিজের অবস্থা যাই-ই থাকুক না কেন সমাজের উন্নয়নমূলক কোন কাজে সহযোগিতার জন্য তাঁর আন্তরিকতার যেন শেষ নেই। বিশেষ করে শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি প্রশংসনীয় অবদান রেখে চলছেন। তিনি মনে করেন- এলাকায় শিক্ষার হার খুবই কম। পুরো ইউনিয়নে শিক্ষারহার মাত্র ৩৪.২১%। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এ নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে এলাকা তথা ইউনিয়নকে মুক্তি দিতে চান। এজন্য শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মিটিংয়ে থেকে ও বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে এলাকার শিক্ষাবিস্তারে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে আসছেন। সত্যিই তিনি এক আলোকিত মানুষ, দেশের সেরা সন্তান।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রেম:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে ছাত্র শিক্ষক, চাকরীজীবী, বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন তোয়াকুল ইউনিয়নের পাইকরাজ গ্রামের মতো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ সরল মো. ইর্শাদ আলীও তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য স্থির সিদ্ধান্ত নেন। মূলত শেখ মুজিবের বক্তৃতাই তাকে দেশের প্রতি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বেশি উদ্বুদ্ধ করেছে।

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি:
ইর্শাদ আলী মনে করেন এ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করে মূলত জাতিকে সম্মানিত করেছে। যদিও সরকারের অনেক কাজই সরকারের কাছের অনেক মানুষদের চতুরতার কারণে, দুর্নীতির কারণে তৃণমূল মানুষেরা সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছে। তবে এখনো কোন কোন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। একটু খোঁজ নিলে এ তথ্য পাওয়া হয়ত দুষ্কর নয়। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ইর্শাদ আলীর প্রত্যাশা- এই সরকার জনগণবান্ধব। দেশের প্রতিটি মানুষই যাতে প্রাপ্য নাগরিক সুবিধা নিয়ে সুখে থাকে, সরকারের প্রতিটি ভালো কাজের সুফলই যাতে তৃণমূল মানুষের কাছে এসে পৌঁছায় সেদিকে সরকারের আরেকটু সুনজর দেওয়া উচিত।


---------------
মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট
০৫.০৯.২০১৫- ০৯.০৯.২০১৫


মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১৪

চাঁদগাজী বলেছেন:

ভালো, উনার প্রতি সন্মান রলো।

উনার জন্ম তারিখ ভুল দিয়েছেন।

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩৫

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: ঠিক করে দিয়েছি জনাব।


কেবলি ভালোবাসা।

২| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩৫

প্রামানিক বলেছেন: এই মুক্তিযোদ্ধাকে সহস্র ছালাম।

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩৭

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: একগুচ্ছ ভালোবাসা ও শুভ কামনা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.