নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কানন ব্রত পাল ১৯৩৫ সালের ১৪ আগস্ট জকিগঞ্জের মঙ্গলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা অশ্চিনী মোহন পাল। মাতা শুভাষিণী বালা পাল। ৬ ভাই ২ বোনসহ মোট ১০ জনের সংসার। পরিবারে এমনিতেই একটু টানাপোড়েন ছিল। তবুও কোনমতে চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করলো। অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিল। এর প্রভাব পড়তে শুরু করলো শহরে ও গ্রামে। হঠাৎ দেশের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার মতোই শাররীক অসুস্থ হয়ে পড়লেন তার বাবা অশ্চিনী মোহন পাল। নানাদিক থেকে ডাক্তার বদ্যি দেখানো হলো। কিন্তু কোন কিছু্তেই কাজ হলো না। ক্রমেই অবনতি হতে লাগলো। এক সময় জাগতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ অপূর্ণ রেখেই তাকে ভবলীলা সাঙ্গ করতে হলো।
কানন ব্রত পাল ছোটবেলাতেই তিনি ছিলেন খুব দুরন্ত প্রকৃতির, সাহসী প্রকৃতির। দেশের ও গ্রামের অস্থির পরিস্থিতি ক্রমাগতই তাকে তাকে ভাবিয়ে তুলে। তিনি স্থির করেন দেশের হয়ে যুদ্ধ করবেন। যারা অন্যায়ভাবে গ্রামের সাধারণ জনতাকে নির্যাতন নিপীড়ন করছেন, দেশের মানুষকে হত্যা করছে তিনি তাদের বিরুদ্ধে মনে মনে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। কিছু একটা করতেই হবে। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। যে কথা সেই কাজ। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন।
গেজেট নং: ০৫০১০৪০১৮০
মুক্তিবার্তা:
শিক্ষা:
পারিবারিক কারণে ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে তার পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে তিনি লেখাপড়ায় ক্ষান্ত দেন।
মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ:
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন জকিগঞ্জে প্রবেশ করল তখন সমস্ত জকিগঞ্জে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। প্রায়শই দুঃসংবাদ আসতে থাকে বিভিন্ন গ্রামের যুবকদের নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলছে, যুবতী নারীদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করছে। তাদের হাত থেকে ছেলে-বুড়ো কেউ-ই রেহায় পাচ্ছে না। তার পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কের বাইরে নয়। অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে কানন ব্রত পাল ও তার বড় ভাই অমিয় ভূষণ পাল সাহস করে নিজ বাড়িতে থেকে গেলেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভারতের ‘দলছড়া শরণার্থী শিবির’-এ পাঠিয়ে দিলেন। জকিগঞ্জের বিভিন্ন গ্রাম থেকে যখন দলে দলে ছেলে-বুড়ো-যুবক-যুবতী অধিকাংশ মানুষই যখন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দলছড়া শরণার্থী শিবিরে যাচ্ছে তখন কেউ কেউ আবার চুপিসারে মুক্তিযুদ্ধেও যোগদান করার জন্য যাচ্ছে। বিশেষ করে তার প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেই তিনি প্রথম খবর শোনেন।
যারা প্রেরণা যোগাতেন:
শহর থেকে কলেজের প্রফেসর, ছাত্রনেতারা গ্রামে এসে গ্রামের কিশোর-যুবকদের সুসংগঠিত করে তাদেরকে দেশের হয়ে কাজ করার জন্য নিরলসভাবে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য ধীরে ধীরে তাদের মনকে চাঙ্গা করতে থাকেন। পরবর্তীতে সময়সুযোগ বুঝে মানসিক ও শাররীকভাবে প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলামাত্রই সে ও তার ভাই কাজলেন্দু পাল যুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা:
পরিবারের সকলেই যখন দলছড়া শরণার্থী শিবিরে চলে গেল তার পরের দিনই তার এলাকার স্থানীয় চেয়ারম্যান ডাক্তার আব্দুর রহিম তাদের বাড়ি জোর করে নিলামে তুলে। বিশেষ করে জিয়াপুর ও মঙ্গলপুর এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারবর্গ যা ছিল ক্রম পর্যায়ে তাদের প্রত্যেকের বাড়িই নিলামে তুলল। চেয়ারম্যান তার অনুসারীদের নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় এসেছিল বলে কোনভাবেই নিলাম থেকে নিজেদের বাড়িকে রক্ষা করতে পারেনি তারা দুভাই। তাদের বাড়িতে ছিল মোট চল্লিশ বান টিন ও কাঠের বেড়া। টিন ও কাঠের বেড়ার মূল্য হিসেব করে তাদের বাড়ির নিলাম উঠল ৭০০ টাকা। নিলামের পর অশ্রুভেজা অবস্থায় অনেকটা রিক্তহস্তেই তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
আশ্রয়:
রাজাকারদের অত্যাচারে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃশ হয়ে তার বড় ভাই চলে গেল দলছড়া শরণার্থী শিবিরে আর সে আশ্রয় নিল তার বোনের বাড়িতে। তার বোনের বাড়ি করিমগঞ্জের কাছাকাছি শেরালিপুরগ্রামে। বোনের বাড়িতে মাত্র দুদিন থাকার পরই তার বোন-জামাই নরেশচন্দ্র পালের আচরণে একটু বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে।
বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরে পরের দিনই বোনের বাড়ি ত্যাগ করেন। কানন বাড়ি ত্যাগ করায় জামাই নরেশচন্দ্র পালও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
মুক্তিযোদ্ধে নাম লেখা:
শরণার্থী শিবিরের পাশেই ছিল আওয়ামীলীগের অফিস। তিনি দলছড়া বাজারে ঢুকলেন- উদ্দেশ্য পাশ্ববর্তী আওয়ামীলীগের অফিসে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখানো। বাজারে যেতেই তার দেখা হয়ে গেল অনুজ কাজলেন্দু পালের সাথে। কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেই কাননব্রত পাল বললেন- মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাতে যাচ্ছেন। অনুজ কাজলেন্দুও বেঁকে বসলেন তিনিও যাবেন। দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এমতাবস্থায় সে কোনভাবেই বড় ভাই কাননব্রত পালকে একা যেতে দিতে নারাজ। কানন তার অনুজকে অনেক করে বোঝাল কিন্তু কোনভাবেই কাজলেন্দুকে দমাতে পারেননি। অনেকটা বাধ্য হয়েই তাকে সঙ্গে নিলেন এবং আওয়ামীলীগের অফিসে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করালেন।
মায়ের অনুভূতি:
ছোটবেলাতেই তারা তাদের পিতাকে হারিয়েছিল বলে মা-ই তাদের একমাত্র ভালাবাসা ও নির্ভরতার আশ্রয়স্থল। তবুও তারা দুজনে মায়ের কাছে কথাটি প্রথমে গোপন রাখলো। কিন্তু মা শুভাষিনী বালা পাল কোনভাবে খবর পেয়েছিলেন যে, তারা দুভাই-ই যুদ্ধে নাম লিখিয়ে এসেছে। এ নিয়ে মায়ের সাথে কিছুটা বাকবিতণ্ডাও হয়। মায়ের আবদার একই বাড়ি থেকে দুজন নয়, যে কোন একজন যাও।
কাননব্রত মাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললেন- তোমাকে দেখার জন্য তবে কাজলেন্দুই রইল। আমি-ই যাব। যখন তারা কথা বলছিল ঠিক সে মুহূর্তেই তাদের বাড়ির বাহিরে একটি গাড়ি এসে থামলো। বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক তাদের ঘরে প্রবেশ করল। এদের কমান্ডার বলল- কাননব্রত কে? কানন বলল- আমি। কমান্ডার বললেন- যাও নিজের পোশাক নিয়ে গাড়িতে উঠ। কাজলেন্দু কে? কাজলেন্দু নিজ থেকেই বললো আমি। কমান্ডার তাকেও বললেন গাড়িতে উঠতে। অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা শুভাষিনী বালা পাল তাদের আশীর্বাদ করে বিদায় দিলেন।
যেখানে নিয়ে গেল:
ট্রাকভর্তি নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথমে ভারতের পানিভরার ইয়ত ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে তাদের মেডিকেল করা হল। মেডিকেলে তাদের সাথের আটজনের মধ্যে একমাত্র কাননব্রত পালই টিকলেন। কাজলেন্দুও আনফিট হয়ে গেলেন।
তার গায়ে ছলং ছিল। এই অজুহাত দেখিয়ে তাকে বাদ দেওয়া হয়। পরে তার বড় ভাই কাননব্রত পাল মেডিকেল অফিসারকে বুঝিয়ে বলেন যে, তাদের আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। তাছাড়া দুভাই পাশাপাশি থাকলে নিজেদের মনোবলও শক্ত থাকবে। কানব্রত পালের অনুরোধে পরবর্তী সময়ে তাকে ফিট ঘোষণা করা হল। মেডিকেল শেষ হলে তাদের প্রত্যেককে কাছার অঞ্চলের লোহারমল ট্রেইনিং সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মোট কোম্পানি:
কাছারে ৭, ৮, ৯ নামের মোট তিনটি কোম্পানি ছিল। তিনি ছিলেন ৯ কোম্পানিতে। প্রতি কোম্পানিতে প্রশিক্ষণার্থী সংখ্যা ছিল প্রায় ১১০ জন। এই কোম্পানিগুলো আবার বিভিন্ন প্লাটুনে বিভক্ত ছিল। তবে সাধারণত তিনটি প্লাটুন নিয়ে একটি কোম্পানি গঠিত হত। প্রতি প্লাটুনে ৩৩/৩৪ জন করে সৈন্য থাকত।
প্লাটুন ইন্সট্রাকটর:
অতুল চন্দ্র দাস প্লাটুন ইন্সট্রাকটরের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি মূলত ভারতীয় নাগরিক। যদিও জন্ম আসাম প্রদেশে তবুও তার প্রধান ভাষা হিন্দি। বাংলাতে তিনি খুব একটা দক্ষ ছিলেন না। তবে একজন আদর্শ ইন্সট্রাকটর হিসেবে যেসব গুণ থাকা দরকার তার সবগুলোই তার মধ্যে ছিল।
ট্রেইনিংয়ের মোট সময়:
তারা মোট ৩০ দিন ট্রেইনিং গ্রহণ করেন। ১৮ মাসের ট্রেইনিংয়ের মূল নির্যাস তাদের ৩০ দিনেই রপ্ত করতে হয়েছে। ফলে তাদের ওপর অনেকটাই ধকল গেছে। মূলত তাদের ট্রেইনিং ছিল গেরিলা ট্রেইনিং।
ট্রেইনিং চলাকালীন খাদ্য:
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বমোট দুইবেলা খানি দেওয়া হত। সকাল বারোটায় চা এর সাথে রুটি আর বিকেল ৬টায় ভাতের সাথে বিভিন্ন ধরনের সবজি, মাছ অথবা মাংস।
বিনোদন:
টেইনিংয়ে বিশেষ কোন বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল না। কঠোর পরিশ্রমই ছিল তাদের ব্রত। তবু প্রায়শ রাতের বেলা ইন্সট্রাকটর প্লাটুনের সবাইকে নিয়ে গানের আয়োজন করতেন। তবে সে গানগুলোর মধ্যে গণজাগরণমূলক গানগুলোই মুখ্য ছিল।
প্রথম অপারেশন:
প্রশিক্ষণ শেষে তাদের পুরো কোম্পানিকেই প্রথমে জালালপুর এবং পরে মাছিমপুর হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সাব কমান্ডার ছিলেন সাদিকুর রহমান কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন সি আর দত্ত। ট্রেইনিং শেষে তার প্রথম অপারেশন ছিল কানাইঘাটের থামার কারাবাল্লায়। মুখ্য উদ্দেশ্য পাকিস্তানীদের ব্যাংকার দখল ও কানাইঘাটকে হানাদারমুক্ত করা। সে অভিযানে কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন মাসুক আহমদ চৌধুরী। সেখানে তাদের আগমনের বার্তা পেয়েই পাক হানাদারবহিনীর সদস্যরা পালিয়ে যায়। অনেকটা বিনাযুদ্ধেই তারা কারাবাল্লার ব্যাংকার দখল করে ফেলে।
জালালপুরের স্মরণীয় ঘটনা:
সেদিন রাতে কানন ও তার সাথের অনেকেই তাবুতে ছিলেন। মৌলভীবাজারের বাবুল নাথ নামের এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার সাথে তার বেশ ভাব ছিল। বাবুল নাথ সদ্য বিবাহিত। তার স্ত্রী পত্র লিখেছে। পত্রের সারাংশ হল- তোমার বাবা ও ভাইয়ের অত্যাচারে বাড়িতে থাকতে পারছি না, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। বাবুল নিজে পত্র পড়তে পারে না বলে কাননকে দিয়ে পত্র পাঠ করালেন ও এর যথোপযুক্ত উত্তর লিখালেন। কানন বাবুল নাথকে ধৈর্য ধরতে বললেন। তিনি এও বললেন যে, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের আরও শক্ত হতে হবে, নতুবা দেশ স্বাধীন হবে কীভাবে? এভাবে দীর্ঘক্ষণ তাকে বোঝালেন।
রাত বারোটার পর কাননের নাইট ডিউটি শুরু হলো। বাংকার পাহারা দিচ্ছিলেন। প্লাটুনের দুতিনজন ডিউটিরত সৈনিক ছাড়া বাকী সবাই তখন ঘুমাচ্ছিলেন। রাত প্রায় তিনটার দিকে এক লোক চুপিচুপি তাবু ক্রস করছিল। তিনি মনে করলেন স্থানীয় রাজাকার কিংবা শত্রুপক্ষের কোন লোক হবে। অসীম সাহসিকতা নিয়ে তিনি নিয়মমত উচ্চস্বরে বললেন- হুল্ড! স্টপ! কোন রেসপনস না পেয়ে তিনি আবারও বললেন। এভাবে তিনিবার বলার পরও যখন সে লোকের কোন রেসপন্স পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি ব্যাংকার সেভ করার জন্য গুলি করলেন। গুলিটা লোকটির পাকস্থলী ভেদ করে গেল বলে মনে হল।
গুলির শব্দে পুরো প্লাটুনের সবাই জেগে উঠলো। কমান্ডার সাদিকুর রহমান দৌড়ে এলেন। কে গুলি করেছে বলতেই কানন সবিস্তারে সব ঘটনা খুলে বলল। লাশ দেখতে গিয়ে সবাই খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। এ যে মুক্তিযোদ্ধা বাবুল নাথের লাশ!
হয়ত রাত্রে তাবু থেকে পালিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, হয়ত মনে করেছিলেন সবাই জেগে উঠার আগেই তিনি আবার বাংকারে ফিরে আসবেন। কিন্তু এ আসাই যে তার শেষ আসা হবে তা কি কেউ জানতো!
মুক্তিযোদ্ধা বাবুলনাথকে গুলি করে মেরে ফেলায় কমান্ডার সাদিকুর রহমান কাননের ওপর খুব চটে গেলেন। কয়েকজন সেন্ট্রিকে বললেন তাকে পিঠ মোড়া করে বেঁধে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখ। সেন্ট্রিরা তাই করলো। রাত অব্দি তাকে গাছের সাথে পিঠ মোড়া করে বেঁধে রাখা হল।
কাননের ভাই কাজলেন্দু ছুটে এলেন। ভাইকে ছাড়াতে কমান্ডারের নিকট আকুল কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন। আকাশে মেঘ জমলো, বৃষ্টি হল কিন্তু সাদিকুর রহমানের মন গলল না। নিরুপায় হয়ে কাজলেন্দু দূরে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
পরের দিন জকিগঞ্জের নোমান ডাকাত নামের এক লোক সে ক্যাম্পে এসে খবর পেল যে, তাদের এলাকার কানকে পিঠমোড়া করে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। অবশ্য তার কারণও আছে। কাননের চাচা এসপি একাবার নোমানের একটি মামলা জিতিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে এসপি তাকে বলেছিল যাতে সে তাদের ভাতিজাদের খোঁজখবর রাখে।
নোমান সেন্ট্রিদের ছেড়ে দিতে বললেন। সেন্ট্রিরা তাদের অপারগতার কথা স্বীকার করলেন। নোমান সেন্ট্রিদের প্রত্যেককেই মেরে ফেলার হুমকি দিলেন। সেই সাথে চিৎকার করে বললেন- কাননের কিছু হলে এ ক্যাম্পের কেউ আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না এমন কি তোদের কমান্ডার সাদিক ও না!
এই বলেই সে চলে গেল ভারতীয় মেজর কুমার চানের কাছে। তিনি রাগ করে বললেন-
হাম জালালপুর মে জায়েগা!
-কিউ?
আবি লোক তোমারা সাদি ভাই বান্দেগা
এরপর সে মেজরকে বিস্তারিত খোলে বলল। মেজর কুমার চান কমান্ডার সাদিকের ওপর খুব ক্ষেপে গেলেন। সাথে সাথেই তিনি গাড়ি নিয়ে আসলেন। নোমানকে বিশ্বাস করার কিছু কারণও ছিল। সে ডাকাত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় অসমসাহসীকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বহুবার তিনি সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ফলে সকলেই তাকে বিশ্বাস করতো। একবার তো দুজন পাকিস্তানীকে ধরে কথার জাদুতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে আসলেন। তারপর তাদের পাকড়াও করে মাছিমপুর হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেদিন থেকেই বিভিন্ন ক্যাম্পে নোমানের খুব সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।
কমান্ডার সাদিকুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা কাননকে বেঁধে রেখে খুব অন্যায় করেছে। মেজর তিনি সেন্ট্রিদের তার বাঁধন খোলে দিতে বললেন। শাস্তি স্বরূপ সাদিকুর রহমান সাদিককে সেদিন রাতেই আগরতলাতে বদলি করে দিলেন।
মুক্ত হওয়ার পর ২য় অপারেশন:
সলামের টিলা কারাবাল্লায় মোট এক প্লাটুন সৈনিক ছিল। রাতে দেওয়াল টপকিয়ে ব্রীজ দখলে যেতে হবে। কিন্তু গভীর অন্ধকার থাকায় তিনি দেওয়াল টপকাতে গিয়ে পিছলে পড়ে টিলা থেকে গড়িয়ে একেবারে নিচে পড়ে যান। সে যাত্রায় তিনি মাছিমপুর হেডকোয়াটারে গিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেন।
কারাবাল্লায় পুনরায় অপারেশন:
সেদিন মোট তেত্রিশ জন সৈনিক ছিল। সম্মুখ যুদ্ধ হচ্ছে। চারদিকে গুলি ও মর্টারের প্রচণ্ড শব্দ। হঠাৎ করে একটি মর্টারের শেলের কিছু অংশ এসে কাননের উরুতে এসে পড়লে সে সেখানেই মুমূর্ষু হয়ে পড়ে। আবারও তাকে মাছিমপুর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে সুচিকিৎসা করা হয়।
পরবর্তী অভিযান:
জকিগঞ্জ, থানায় এবং ইউনিয়নে। জকিগঞ্জে ১ দিন ছিলেন, থানার অপারেশনে ছিলেন দশদিন, ইউনিয়নের অপারেশনেও আনুমানিক দশদিনের মতো ছিলেন।
কানাইঘাটের লক্ষ্মীপাশা গ্রামের স্মরণীয় ঘটনা :
তিনি সর্বমোট ৬ মাস যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করেন। একবার তারা কানাইঘাটের লক্ষ্মীপাশার এক ব্রীজ দখল করার অপারেশনে বের হয়। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট গিয়াস উদ্দিন। তিনি মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন বেশ অমায়িক। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ছিলেন নির্মল ভট্টাচার্য। তিনিও যেমন সৎ সাহসী ছিলেন তেমনি ছিলেন ধর্মপরায়ণ। সেদিনের সে অপারেশনে তাদের অভিযানে অংশ নেওয়া মোট ২৭০ জনের মধ্যে চার জন শহীদ হন। এই চারজনই ছিল কানন ব্রত পালের খুব কাছের মানুষ। তবে বড়লেখার নীলমণি সরকার ও কানাইঘাটের অলিউর রহমানের সাথেই তার বেশি সখ্য ছিল।
এই অভিযানে দুইজন রাজাকারসহ তাদের ১৯ জন হানাদার বাহিনী মারা যায়। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নির্মল ভট্টাচার্য নীলমণি সরকারের লাশ দাহ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। পাশ্ববর্তী লোভাছড়া চাবাগানের কুলিদের সহযোগিতা নিয়ে তিনি দাহের কাজটি সম্পন্ন করেন।
শপথ:
মৌখিকভাবে সব সৈন্যদের শপথ করানো হয়।
পোস্টিং:
দীর্ঘ একমাস ট্রেইনিং শেষ করে তাদের ভারতের জালালপুর পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মূলত বৃহত্তর সিলেট তখন ৪টি সাব সেক্টরে বিভক্ত ছিল। যথা:
1. জালালপুর,
2. কৈলাশপুর
3. মহিসাশন
4.
এই চারটি সাব সেক্টরের মধ্যে জালালপুর ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে পুরো তিন কোম্পানিই চলে আসে। তিন কোম্পানি মিলে হয় উইং। অর্থাৎ জালালপুরে এক উইং ছিল। এক উইংয়ে ৯০০ এর অধিক সৈনিক থাকত।
সাবসেক্টর কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডার:
প্রত্যেকটি সাব সেক্টরের জন্য ছিল আলাদা আলাদা সাব সেক্টর কমান্ডার। জালালপুরের সাবসেক্টর কমান্ডারের নাম সাদিকুর রহমান সাদি। তিনি মূলত হবিগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করতেন চিত্তরঞ্জন দত্ত।
স্থানীয় রাজাকার:
এসময়ে উল্লেখযোগ্য স্থানীয় রাজাকার ছিল মকবুল। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি বলে দেওয়া ও সুন্দরী মেয়েদের পাকিস্তানী ক্যাম্পে চালান করাই ছিল তার মূল কাজ।
মোট অপারেশন:
তিনি মোট ৬টি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। সবগুলোই কানাইঘাট থানার চতুল, দরবস্ত, পিপিঅল, খাদিম, কারাবাল্লায় হয়েছে। সব অপারেশনেই তারা সফল হয়েছেন। অপারেশন চলাকালীন সময় তাদের খাদ্যের যোগান দিত সাধারণ জনগণ।
অস্ত্র জমা:
ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে সিলেট জামিয়া স্কুলে তাদের কোম্পানিসহ সিলেটের সকলেই অস্ত্র জমা দিয়েছেন। জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নেওয়া হয়।
পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ:
১৫ ডিসেম্বর তারা সকলেই এমসি কলেজে আত্মসমর্পণ করে। মোট ৬১২৪ জন পাকিস্তানী সেনা ইন্ডিয়ান যৌথবাহিনীর প্রধান অরারা সিংহের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
এক নজরে অশ্চিনী মোহন পালের পরিবারবর্গ:
স্ত্রী: সুভাষিণী বালা পাল
সন্তান: ছেলে ৬ জন মেয়ে ২ জন
অমিয় ভূষণ পাল (৬ ছেলে ২ মেয়ে)
স্ত্রী: প্রতিভাবোণী পাল
অজিত বন্ধু পাল (২ ছেলে ৩ মেয়ে)
স্ত্রী: রিনা বালা পাল
ফটিক চন্দ্র পাল (১ ছেলে ১ মেয়ে)
স্ত্রী: গৌড়ি রানি পাল
কৈল্যান ব্রত পাল (২ ছেলে ৩ মেয়ে)
স্ত্রী: অলি রানি পাল
মুক্তিযোদ্ধা কাননব্রত পাল (৫ ছেলে ২ মেয়ে)
স্ত্রী: রিতা রাণী পাল
কাজলেন্দু পাল (৪ ছেলে ১ মেয়ে)
স্ত্রী: মিঠুরাণী পাল
মেয়ে:
আশা রাণী পাল
স্বামী: মৃত নরেশচন্দ্র পাল
আনন্দ রাণী পাল
স্বামী: মৃত সুসেন্দ্র পাল
যুদ্ধের বিভাগ:
যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকরা তিনটি বিভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। যেমন:
1. এমএফ বাহিনী: আনছার, মোজাহিদ, পুলিশদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত।
2. এফএফ বাহিনী: ফ্রিডম ফাইটার বা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত।
3. বেঙ্গল রেজিমেন্ট: নিয়মিত ট্রেইনিংপ্রাপ্ত বাহিনী নিয়ে এই রেজিমেন্ট গঠিত।
বিয়ে:
১৯৭৪ সালে তিনি বিরশ্রী ইউনিয়নের বরচালিয়া গ্রামের বিভা রাণী পালকে পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করেন। উল্লেখ্যযে, স্ত্রী বিভা রাণী পাল পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন।
4.
এক নজরে কাননব্রত পালের পরিবারবর্গ:
স্ত্রী: বিভা রাণী পাল
সন্তান: ছেলে ৫ জন, মেয়ে ২ জন
লুপন কুমার পাল ১ মেয়ে
স্ত্রী: আঁখি রাণী পাল
বিপ্লব কুমার পাল ১ ছেলে ১ মেয়ে
স্ত্রী: কাকলী রাণী পাল
নারায়ণ কুমার পাল ১ মেয়ে
স্ত্রী: সুমী রাণী পাল
সুমন কুমার পাল ২৬
সাজন কুমার পাল ২৫
মেয়ে:
রিপ্তা রাণী পাল ১ ছেলে, ২ মেয়ে
স্বামী: ডাক্তার অঞ্জন কুমার পাল
ববিতা রাণী পাল
স্বামী: সন্তোষ কুমার পাল
যাপিত জীবন:
স্বাধীনতার আগেই তাদের বাড়িঘর সর্বস্ব হারাতে হয়েছিল। দেশ স্বাদীন হওয়ার পর আবারও তারা কাজকর্ম করতে থাকে। ধীরে ধীরে টাকা সঞ্চয় করে ছোটখাট ব্যবসা করতে থাকে। এখন কাননের সব ভাই বোনেরাই পৃথকভাবে বসবাস করছে। তার নিজের বলতে কালিগঞ্জ বাজারে একটি মিষ্টির দোকান রয়েছে। সে দোকানের আয়ের ওপর নির্ভর করে পুরো পরিবারকে চলতে হয়।
অসুস্থ:
মর্টার শেলের একটু অংশ তার উরুতে পড়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে তার পায়ের মধ্য নানা ধরনের পার্শপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সে পাশ্বপ্রতিক্রিয়ার রেশ এখনোও সে বয়ে বেড়াচ্ছে। নিজের চিকিৎসাবাবদ-ই তাকে অনেক টাকা খরচ করতে হয় তার উপর সংসারের বোঝা!
প্রত্যাশা:
বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদরে জন্য অনেক কিছুই করেছেন এটা কৃতজ্ঞচিত্ত তিনি স্বীকার করেন। তবুও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে চিকিৎসা করালে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার আরও বেশি উপকৃত হবে। এবং সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিও সরকারের আরও বেশি সুবিচার করা হবে বলে তিনি মনে করেন।
---------------
মুনশি আলিম
জাফলং, সিলেট
১৫.০৯.২০১৫- ১৭.০৯.২০১৫
©somewhere in net ltd.
১| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:১৫
প্রামানিক বলেছেন: মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শুভেচ্ছা রইল।