নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছবি: আগামেমনন
নাটক মূলত সমাজেরই দর্পণ। সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোই মূলত রঙ্গ-ব্যাঙ্গের মাধ্যমে নাটকে ফুটিয়ে তোলা হয়। গ্রিক সাহিত্যগুলো বেশিরভাগই কালজয়ী। বিশেষ করে নাট্যসাহিত্য। গ্রিকের তথা বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকারদের মধ্যে এস্কাইলাস অন্যতম প্রধান সফল একজন নাট্যকার। এস্কাইলাস কম করে হলেও নব্বইটির মতো নাটক রচনা করেন। কিন্তু নানাবিধ যুদ্ধবিগ্রহ ও যত্নের অভাবে তাঁর অনেক সৃষ্টিই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
বর্তমানে তাঁর রচিত সাতটি নাটকের সন্ধান মেলে। তবে এগুলোর মধ্যে আমরা তিনটি ত্রয়ী নাট্যকর্মের সন্ধান পাই। যথা: আগামেমনন, কোয়েফোরি ও উইমেনিদেস। অর্থাৎ আগামেমনন, তর্পণ বাহকেরা এবং দয়ালুরা এই তিনটি নাটক মিলে ‘অরেস্ট্রিয়া ত্রয়ী’ রচিত।
মূলত নাট্যকার এস্কাইলাসের সময়ে একটি দীর্ঘ কাহিনিকে তিনটি ভাগে ভাগ করে তিনটি নাটক পৃথকভাবে রচনা করার রীতি ছিলো। এই তিন অংশবিশিষ্ট নাটকের নাম ‘ট্রিলজি’। এস্কাইলাসের অধিকাংশ রচনাই ট্রিলজিভুক্ত। এই ত্রয়ী নাট্যকর্মের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘আগামেমনন’।
তিনি তার এ নাটককে সার্থক করার জন্য স্বদেশীয় পটভূমি এবং সংলাপকে যুগোপযুগী করে অতিগুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেছেন। ঐতিহাসিক দিক বিচারে গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলোতে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক রীতিনীতিসমূহ প্রতিফলিত হয়েছে। নাট্যকার এস্কাইলাস তাঁর ‘আগামেমনন’ নাটকে এ ধারণাটিকে আরো বেগবান করে নতুন রূপে উপস্থাপন করেছেন।
নাটক মূলত ক্রিয়াশীলতার সৃজনভূমি। এই চিন্তা এস্কাইলাস পূর্বাপর বজায় রেখেছেন। দীর্ঘ বর্ণনার ভার কখনোই নাটকটিকে আক্রান্ত করেনি। একটি দৃশ্য থেকে অপর দৃশ্যে নাট্যকার চলে গেছেন অনায়াসে দ্রুততার সঙ্গে।
গ্রিসে মূলত উৎসবের সময় মঞ্চে অভিনয় করা হয়। এটি অবশ্য এস্কাইলাসের কিছুটা পূর্ব থেকেই চালু ছিলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক দিন একনাগাড়ে সে অভিনয় চলত। প্রত্যেক দিন কয়েকটি করে নাটক মঞ্চস্থ করা হতো। থিয়েটারে অভিনয় করত শুধু পুরুষরা, নারী চরিত্রের ভূমিকাতেও তারাই অভিনয় করত। অভিনেতারা মুখে চরিত্রোপযোগী মুখোশ পরে নিতো ।
কত রকমের মুখোশ! ছেলে বা মেয়ের মুখোশ, কিংবা ক্রোধ বা প্রার্থনার ভাবপ্রকাশ, অথবা আনন্দ বা হতাশা বোঝানোর জন্য সেভাবে আঁকা কোনো মুখোশ। নাটক চলাকালে প্রয়োজন অনুযায়ী তারা মুখোশ বদলে ফেলত। ঝকঝকে রঙে রঞ্জিত মুখোশ, এমনকি বিশাল মঞ্চের পেছন সারির লোকেরাও ভালোভাবে দেখতে পেত। সব অভিনেতারাই লম্বা বা প্রমাণ সাইজের ছিলো না। ফলে খাটো অভিনেতারা একটু উঁচু হওয়ার জন্য পায়ের তলায় ছোটো কাঠ লাগাতো।
ইতিহাস বলে যে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৪ সালে প্রথম নাটক অভিনীত হয়। নাটক হিসেবে এই প্রথম অভিনয়কে গ্রহণ করবার কারণ হচ্ছে সমস্বর বা কোরাসের নেতা কোরাসের সঙ্গে কণ্ঠ যুক্ত করেও অন্য একজন লোকের সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত হয়েছিল। এভাবে সংলাপ এবং সমস্বরের মধ্যে ঘটনাক্রমের বিবৃতি নিয়ে নাটকের সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু এটাকেও আমরা পুরোপুরি নাটক বলি না। প্রথম স্বার্থক নাটক তৈরি হয় এস্কাইলাসের সময়। অ্যারিস্টটল বলেছেন “এস্কাইলাস সর্বপ্রথম দ্বিতীয় একটি চরিত্রে নাটকে এলেন; তিনি কোরাসের গুরুত্ব কমিয়ে সংলাপের গুরুত্ব বাড়ালেন”।
ছবি: আগামেমনন মুখোশ
মঞ্চাভিনয়ের ক্ষেত্রে আগেও যেমন কোরাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো এখনো আছে। নাটক অনুযায়ী কোরাসের অভিনেতাদের কখনও তরুণী, কখনও পারসিক অমাত্য, আবার কখনো ব্যাঙ বা পাখির সাজে সজ্জিত হতে হয়। নাট্যকার এস্কাইলাস তাঁর ‘আগামেমনন’ নাটকে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত কোরাস দলের ভূমিকাকে খুবই অর্থবহ করে তুলেছেন। অবশ্য এতে কোরাস দলের সদস্যদের পোশাক-পরিচ্ছদ, শৈল্পিক ইঙ্গিতসহ স্বাতন্ত্র্য ভূমিকার উপস্থাপন রয়েছে।
নাটকের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পুরাণভিত্তিক এক ধরনের নাটককে বলা হতো ‘ত্রাগোদিয়া’। শব্দটির মূল অর্থ ‘ছাগলের গান’। প্রাচীনকালে যখন অভিনেতারা ‘ছাগচর্ম’ পরিধান করে অভিনয় করত, সেই তখন থেকে এ শব্দটি চালু হয়েছিল। ট্র্যাজেডির চরিত্রাবলি সাধারণত দেবতা কিংবা পুরাণকথিত বীর। বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে সংঘাত, তাদের কীর্তি, দুঃখ ও যন্ত্রণা এবং বিনাশ দেখানো হয় ট্র্যাজেডিতে। সেদিক বিবেচনায় এস্কাইলাসের ‘আগামেমনন’ একটি সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক।
গ্রিক ট্র্যাজেডি নাটক বিশ্বসাহিত্যের একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে ‘নিয়তির’ বিশেষ ভূমিকা বিদ্যমান। মানুষ দৈবের কাছে কতটা অসহায়, দৈবের দুর্বিপাকে মানুষ কীভাবে চরমহতভাগ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয় এবং বেঁচে থেকে মৃত্যুময় যন্ত্রণা ভোগ করে তা-ই নানা বৈচিত্র্যে গ্রিক ট্র্যাজেডিতে শিল্পরূপ লাভ করেছে।
এই নিয়তি অতীতে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কোনো মানুষের দ্বারা সংঘটিত কোনো অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তাকে গ্রাস করে। যাকে গ্রিক ট্র্যাজেডিতে বলা হয়েছে ‘নেমেসিস’। অর্থাৎ মানুষ কোনোভাবেই ‘নেমেসিস’-কে এড়াতে পারে না; এই বিশ্বাসই গ্রিক ট্র্যাজেডির মর্মবাণী। সাধারণভাবে হত্যা, মৃত্যু, ভাগ্য বিপর্যয়, ভ্রান্তি এইসব উপাদানেই প্রাচীন ট্র্যাজেডি সার্থকতা লাভ করেছে। তবে এতে মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বার স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা অস্বীকৃত। এদিক বিবেচনায় নাট্যকার এস্কাইলাস মোটেও ব্যতিক্রম নন। তাঁর ‘আগামেমনন’ নাটকেও আমরা এমনই চিত্র অবলোকন করতে পারি।
বিশ্বসাহিত্যের সব শক্তিশালী নাট্যকারগণ ও নাট্যবোদ্ধাগণ অকপটে স্বীকার করে নেন যে, ট্র্যাজেডির প্রথম বিখ্যাত লেখক এথেনীয় নাট্যকার এস্কাইলাস। তার রচিত ট্র্যাজেডির মধ্যে ‘আগামেমনন’ অন্যতম প্রধান।
গ্রিক ট্র্যাজেডিগুলোর ক্ষেত্রে একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয় আর তা হলো ট্র্যাজেডিকর্মের মূল চরিত্রটির দুর্ভোগের মূলে তার নিজের কোনো দোষ কাজ করে না; সেখানে নির্দোষ চরিত্রটি পারিপার্শ্বিক কিংবা দৈব কোনো চাপের মুখোমুখি হয়ে নিদারুণভাবে নিষ্পেষিত হয়। সর্বশেষে ঘটনার ঘনঘটায় জড়িয়ে প্রাণ বিসর্জন দেয়।
ট্র্যাজেডি নাটকে নায়ক কিংবা নায়িকা মুখ্য। করুণ রস পরিবেশনই ট্র্যাজেডির ধর্ম। এখানে রসই ট্র্যাজেডির প্রধান ধর্ম। ট্র্যাজেডির ধর্ম হলো কোনো জটিল ও গুরুতর ঘটনার আশ্রয়ে বিশেষ ধরনের রসসঞ্চার যা আমাদের অনুভূতিকে অভূতপূর্ব আবহে আলোড়িত করবে। তবে ট্র্যাজেডি নাটকের মূলে রয়েছে ব্যক্তি-আত্মার দ্বন্দ্ব-বিক্ষুদ্ধ তীব্র যন্ত্রণা আর হাহাকার।
স্বার্থক ট্র্যাজেডি জৈব ঐক্যবিশিষ্ট হবে অর্থাৎ এর একটি একক অটুট আকার থাকবে। সেইসঙ্গে, এর ভাষা হবে সাংস্কৃতিক গুণসম্পন্ন। দ্বন্দ্বপূর্ণ কাহিনির এতে বিশেষ ভূমিকা থাকলেও গঠনগত দিক থেকে এতে নাট্য বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য। সর্বোপরি তা একদিকে দর্শকের মনে করুণা ও ভয়ের সঞ্চার করবে; আবার অপরদিকে এক ধরনের প্রশান্তিও জাগাবে।
কেননা, নাটকে শত-বিপর্যয় সত্ত্বেও নায়কের যে সুদৃঢ় মহিমান্বিত অবস্থান রূপায়িত হবে তা দর্শককে বিস্ময়ঘন আনন্দ প্রদান করবে; একইসঙ্গে যে বিপর্যয় দর্শক দেখবেন তা তাঁকে এই বলে স্বস্তি দেবে যে, অন্তত দর্শকের নিজের জীবনে তা ঘটেনি। এতে দর্শকের ভাবাবেগের মোক্ষম বা বিশেষ প্রবৃত্তির পরিশোধন ঘটবে।
তবে উল্লেখ্য যে, গ্রিক ট্র্যাজেডিতে নারীদের গৌণ বা অপ্রধান চরিত্র হিসেবেই গণ্য করা হতো। যদিও নাট্যকার এস্কাইলাস অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তাঁর ‘আগামেমনন’ নাটকে শক্তিশালী নারী চরিত্র হিসেবে তিনটি চরিত্র ক্লাইটেমেনেস্ট্রা, হেলেন এবং ক্যাসেন্ড্রাকে রূপায়িত করেছেন নিজের মতো করে। নির্মাণ কৌশলও তাঁর অত্যন্ত চমকপ্রদ। নাটকের মূল কাহিনিটি ঠিক এরকম-
সে অনেকদিন আগের কথা। রাজা অ্যাট্রিউসের মহাবাহুস্বরূপ ছিলো দুই পুত্র। আগামেমনন ও মেনেলাউস। দুজনেই গ্রিক বীর। এদের মধ্যে আগামেমনন আর্গসের রাজা। আর্গস রাজ্যটি ৮,২৭৮ স্কোয়ার মাইল আয়তন বিশিষ্ট; যা দক্ষিণ গ্রিসের একটি সুবৃহৎ উপদ্বীপে অবস্থিত। আগামেমনন’র স্ত্রী ক্লাইটেমেনেস্ট্রা। তাদের ছিল চারজন ছেলেমেয়ে। ছেলের নাম অরেস্টেস এবং মেয়েদের নাম যথাক্রমে, ইফেজেনিয়া, ইলেকক্ট্রা এবং ক্রাইসোথেমিস ।
গ্রিক উপকথায় ক্লাইটেমেনেস্ট্রা ‘Femme fatale’ হিসেবে চিহ্নিত । এই ফরাসি শব্দ গুচ্ছের মানে ‘ভয়ঙ্কর রমণী!’ কেননা, ক্লাইটেমেনেস্ট্রা তার স্বামী আগামেমননকে হত্যা করে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন ।
ছবি: ক্লাইটেমেনেস্ট্রা
এরপাশেই ‘স্পার্টা’ নামে আরেকটি রাজ্য ছিলো। আর এ রাজ্যের রাজা ছিলেন মেনেলাউস। মেনেলাউসের স্ত্রী জগৎবিখ্যাত সুন্দরী হেলেন। ক্লাইটেমেনেস্ট্রার পিতা টিন্ডারিউস ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। অ্যাট্রিউসের পুরো পরিবারই ছিলো সে প্রভাবে প্রভাবিত।
ছবি: ক্যাসান্দ্রা
মেনেলাউস তার সুন্দরী স্ত্রী হেলেনের জন্য যেমন গর্ব করতো তেমনি গর্ব করতো স্পার্টাবাসী তথা গ্রিকবাসী। একদা ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিস স্পার্টার রূপসী হেলেনকে দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়ে যান। সেই থেকেই হেলেনকে পাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। যুবরাজ প্যারিস ছিলো খুবই চতুর। বিভিন্ন ছলাকলার মধ্য দিয়ে রানি হেলেনকে সে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ট্রয়ের রাজা প্রায়ামের ভর্ৎসনা সত্ত্বেও যুবরাজ প্যারিস হেলেনকে ফিরিয়ে দেয়নি। এরপরই শুরু হয় কাহিনির মূল ঘনঘটা।
রানি হেলেনকে অপহরণের পর স্পার্টার রাজা মেনেলাউস খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি স্ত্রীর শোকে জর্জরিত হয়ে ট্রয় নগরী সমূলে ধ্বংসের উদ্যোগ নিলেন। তারপাশে এসে দাঁড়ালেন আর্গসের রাজা আগামেমনন। তিনি ট্রয় যুদ্ধে অংশ নিতে চাইলেন।
রাজা অ্যাট্রিউস তার দুই ছেলেসহ গ্রিসের অনেক সৈন্যসামন্ত দিয়ে সুন্দরী হেলেনকে উদ্ধারের জন্য পাঠালেন। এ সময় সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন রাজা আগামেমনন। দুটি ঈগল কতৃর্ক আসন্ন প্রসবা একটি খরগোশকে হত্যার কারণে গ্রিক রাজ্যের প্রতি কুমারি দেবি আর্টেমিস ছিলো খুবই অসন্তুষ্ট। ফলে দেবির রোষের কবলে পড়লো পুরো গ্রিকবাসী। গ্রিকের রাজপুরোহিত ও বিখ্যাত জ্যোতিষী হিসেবে খ্যাতনামা ছিলেন ক্যালচাস। তিনি ভবিষ্যৎ গণনা করতে পারতেন। যুদ্ধের শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, এ যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলবে এবং যুদ্ধে গ্রিকরা বিজয়ী হলেও সে যুদ্ধের বিজয় হবে অনেকটাই ম্লান। কেননা, এ বিজয় ছিনিয়ে আনতে অসংখ্য গ্রিক সৈন্যকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।
জ্যোতিষী ক্যালচাসের কথা প্রথমে কেউ বিশ্বাস করলো না। রাজা আগামেমনও তার কথাকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিলেন। যুদ্ধের সাজে গ্রিকরা প্রস্তুতি গ্রহণ করলে রাজা আগামেমনন দেবতা জিউসের শুভদৃষ্টি প্রত্যাশা করলেন।
জিউস সন্তুষ্ট হয়ে আগামেমনন ও মেনেলাউসের ভেতরে সঞ্চারিত করলেন প্রতিশোধ গ্রহণের অগ্নিশিখা। মূলত দেবতা জিউসের ইঙ্গিতের কারণেই গ্রিক আর ট্রয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো।
ছবি: ট্রয় যুদ্ধ
রাজা আগামেমনন তার অনুজ মেনেলাউসসহ অসংখ্য সৈন্যসামন্ত নিয়ে ট্রয় আক্রমণ করার জন্য সমুদ্রপথে ছুটলেন। যুদ্ধজাহাজগুলো ছিলো রণসাজে সজ্জিত। জাহাজ কিছুদূর গিয়েই আগামেমনন ও তাদের সঙ্গী-সাথিরা বিপদের সম্মুখীন হলেন। বাতাস অনুকূলে ছিলো না বলে জাহাজ ছাড়া যাচ্ছে না।
ছবি: তৎকালীন জাহাজ ১
ছবি: তৎকালীন জাহাজ ২
এভাবে যতই দিন পেরুতে থাকলো ততই তাদের খাবার ফুরিয়ে যেতে লাগলো। আগামেমননসহ সকল সৈন্যরা অস্থির হয়ে উঠলো। সবাই বন্দরে উৎকন্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে। কী করা যায়।
রাজপুরোহিত তথা জ্যোতিষীর কাছে সকলেই এলো। চলমান সংকট নিরসনের জন্য পরামর্শ চাইলো। জ্যোতিষী রাজাকে বললেন, কুমারি দেবি আর্টেমিসের রোষের কারণেই এমনটি হয়েছে। দেবিকে সন্তুষ্টির জন্য আপনার বড় কন্যা ইফেজেনিয়াকে বলি দিতে হবে। ঠিক তখনই দৈববাণী শোনা গেলো-“দেবি আর্টেমিস-এর উদ্দেশ্যে আগামেমনন কন্যা ইফেজেনিয়াকে বলি দিতে হবে”।
ছবি: দেবি আর্টেমিস
রাজা আগামেমনন কথাটি শুনামাত্রই চমকে উঠলেন। নিজের ভেতর তার ক্ষরণ শুরু হলো। কিন্তু জাতীয় দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য নিজের কন্যাকে তিনি খুব বড় করে দেখলেন না। পিতৃহৃদয়কে জাতীয় হৃদয়ের কাছে হার মানতে হলো।
ছবি: দেবি আর্টেমিস
ছবি: কুমারী দেবি আর্টেমিস
নিজের কন্যাকে বলি দিতে পৃথিবীর কোনো মা-ই চাইবে না- একথা আগামেমনন ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি একটু কৌশল অবলম্বন করলেন। স্ত্রী ক্লাইটেমেনেস্ট্রার কাছে বড়ো কন্যা ইফেজেনিয়াকে বিয়ের কথা বলে নিয়ে এলেন। ওকে ট্রয়ে নিয়ে গিয়ে একিলিসের সঙ্গে বিয়ে দিবে। বীর যোদ্ধা একিলিস!
জাতীয় স্বার্থের জন্য নিজের কন্যাকে দেবি আর্টেমিসের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বলি দিলেন।
ছবি: ইফেজেনিয়া ও অন্যান্য ...
এরপর জাহাজ সচল হয়। দীর্ঘ দশ বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর গ্রিকরা ট্রয়নগরী ভস্মীভূত করে। সূর্যকে যেমন ক্ষণস্থায়ী মেঘপূঞ্জ দিয়ে আড়াল করে রাখা যায় না, তেমনি সত্যকেও বেশি দিন আড়াল করে রাখা যায় না। রাজা আগামেমননও তার কন্যার বলির কথা স্বীয় স্ত্রীর কাছে বেশিদিন গোপন রাখতে পারেননি।
রাজা আগামেমননের স্ত্রী যখন জানতে পারলো তার স্বামী কন্যাকে বলি দিয়েছে; তখনই তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। কন্যা হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি রাজা আগামেমননের চাচাত ভাই এজিসথাসের সাথে হাত মিলালেন। পরবর্তীতে তিনি তার সাথে অনৈতিক কর্ম তথা প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। ক্লাইটেমেনেস্ট্রার গর্ভে একটি মেয়ের জন্ম হলো। সেই মেয়ের নাম রাখা হলো এরিগোনে।
অরেস্টেস তখন ছোটো। মায়ের অনৈতিক জীবন ইলেকক্ট্রার মনে বিষাদময় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তবে আরেক কন্যা ক্রাইসোথেমিস এর মনে মায়ের পরকীয়ায় কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়াই হয়নি বলেই মনে হলো।
রাজা আগামেমনন যুবরাজ প্যারিসকে পরাজিত করে রানি হেলেনকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন। সঙ্গে ট্রয় রাজকন্যা ক্যাসান্দ্রা ।
ছবি: ক্যাসানোর মন্দির থেকে এজাস্ত ক্যাসান্দ্রাকে টেনে হিচড়ে বের করে।
সে ট্রয়ের রাজা প্রিয়ামের কন্যা। যুদ্ধজয়ের পুরস্কার হিসেবে ক্যাসান্দ্রাকে লাভ করেছেন আগামেমনন। ক্লাইটেমেনেস্ট্রা স্বামীকে স্বাগত জানালো। যদিও রানি ক্লাইটেমেনেস্ট্রা কন্যা হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আগে থেকেই ওত পেতেছিলো। আগামেমনন প্রাসাদে ঢুকলেন। স্নান করতে গেলেন। কাসান্ড্রা রথে অপেক্ষা করছিলো ।
বলা হয় ট্রয়ের নারী পুরোহিত ক্যাসান্দ্রা দৈববশে আগামেমনন হত্যাদৃশ্যটি অবলোকন করে। ক্যাসান্দ্রা ভবিষ্যৎ গণনা করতে জানতো। সে মূলত দেবতা অ্যাপোলোর প্রেমিকা ছিলো। দেবতা অ্যাপোলোই তাকে ভবিষ্যৎ গণনা করা শিখিয়েছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে অ্যাপোলোর সন্তান ধারণে সে অক্ষমতা প্রকাশ করলে দেবতা খুবই ক্রোদ্ধ হন। এবং কৌশল অবলম্বন করে ক্যাসান্দ্রাকে একটিবার চুমু দেওয়ার অনুরোধ করে। ক্যাসান্দ্রা শীতল হয়। চুমু দেওয়ার সময়ই দেবতা অ্যাপোলো তার মুখে লালার সাথে অভিশাপ দিয়ে বিদায় নেয়। সেই থেকে ক্যাসান্দ্রা ভবিষ্যৎ গণনা করলেও কেউ তার কথায় বিশ্বাস করতো না। দেবতা অ্যাপোলোর অভিশাপের কারণেই ক্যাসান্দ্রাকে নির্মম নিয়তির দিকে এগোতে হয়েছিলো।
ক্লাইটেমেনেস্ট্রা অপেক্ষা করছে। স্নানঘর থেকে আগামেমনন বেরিয়ে এলেন। ক্লাইটেমেনেস্ট্রা এক টুকরো কাপড় দিয়ে স্বামীর গলায় ফাঁস ... এরপর উপর্যপুরি ছুড়িকাঘাত করলেন। রাজকন্যা ক্যাসান্দ্রাও ক্লাইটেমেনেস্ট্রার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। একই অস্ত্র দিয়ে ক্যাসান্দ্রাকেও হত্যা করা হলো। পরবর্তীতে তার দুই সন্তানকেও হত্যা করা হয়েছিলো। এজিসথাস দুটি হত্যার সময়ই খুব কাছাকাছি ছিলেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ হত্যার নেপথ্যে তার হাত ছিলো।
ছবি: ক্লাইটেমেনেস্ট্রা কর্তৃক আগামেমননকে হত্যার দৃশ্য
ছবি: দেয়ালে ক্লাইটেমেনেস্ট্রার হত্যার ছবি।
কোরাস দলের প্রধানকে রানি বললেন এখন থেকে সে ও তার প্রেমিক এজিসথাস আর্গস রাজ্য শাসন করবে। কিন্তু কোরাস দলের নেতা তাদের দুজনকেই অস্বীকার করলেন। এজিসথাসের ভর্ৎসনা সত্ত্বেও কোরাস নেতা বলেন, আগামেমননের পুত্র অরেস্ট স্বদেশে ফিরে তোমাদের দুজনকেই হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।
মাকে ঘাতকের ভূমিকায় দেখে ইলেকট্রার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। অরেসটেস তখন নাবালক। অরেস্টসকে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এথেন্স পাঠিয়ে দিলো। যাই হোক। আগামেমনন এর মৃত্যুর পর এজিসথাস হলো আর্গসের রাজা। আর ক্লাইটেমেনেস্ট্রা রানি। এভাবেই আট বছর কেটে গেলো।
এথেন্স থেকে আর্গস ফিরল যুবক অরেস্টেস। সে শোকার্ত হৃদয়ে পিতার সমাধিতে গেলো। কে যেনো ছায়াচ্ছন্ন করিডোরে দাঁড়িয়ে। অজ্ঞাত কৌতূহলেই সে ছায়ার সাথে কথা বলে চললো। সে ছায়াটি হলো ইলেকট্রা। সে ইলেকট্রাই অরেস্টকে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কানে মন্ত্র দিতে থাকে।
ছবি: ইলেকট্রা
তারপর ইলেকট্রার প্ররোচনায় অরেস্টেস তার মাকে আর মায়ের প্রেমিক এজিসথাসকে খুন করে। ক্লাইটেমেনেসস্ট্রা অবশ্য ছেলের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলো। কিছু সময়ের জন্য হলেও অরেস্টেস থমকে গিয়েছিলো। পরে তার বন্ধু পাইলেদেসে দেবতা জিউস ও অ্যাপোলোর নির্দেশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এরপর অরেস্ট তার কাজে ইস্পাতসম কঠিন হয়ে যায়।
ছবি: অরেস্টেস কর্তৃক ক্লাইটেমেনেস্ট্রাকে হত্যার দৃশ্য
আর্গসের রাজপ্রাসাদ আবার রক্তাক্ত হলো। যে রক্তপাতের সূত্রপাত করেছিলেন দৈবে বিশ্বাসী আগামেমনন। দেবি আর্টেমিসকে খুশি করতে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আপন কন্যা ইফেজেনিয়াকে উৎসর্গ করেছিলেন।
অরেস্টিস মাতা ও মাতার প্রণয়ীকে হত্যা করে। কিন্তু মাতৃহত্যা মহাপাপ। তাই ফিউরিয়া- প্রাচীন দেবিরা তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তাড়িয়ে বেড়ায়। বিপদাপন্ন হয়ে অরিস্টিস ডেলফির মন্দির প্রবেশ করে অ্যাপোলোর আশ্রয় প্রার্থনা করে। তার পিছনে পিছনে ফিউরিয়াদের ছুটে আসতে দেখে এই মন্দিরের নারী পুরোহিত ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। দেবতা অ্যাপোলোকে ফিউরিয়া বলে- সে মাতৃহত্যা করেছে সে মহাপাপী। অ্যাপোলে বলে- সে পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। অতএব সে নির্দোষ। ফিউরিয়া ক্রোধে বলে- আপনি খুনীর পক্ষ নিয়েছেন। অ্যাপোলো চরম ক্রোধে বলে- তোমরাও খুনীর পক্ষ নিয়েছো। যাওযে দেশ বর্বরা রয়েছে সে দেশে যাও। ক্লাইটেমেনেস্ট্রা খুন করেছে সে বিচার যদি না হয় তবে অরেস্টেসেরও বিচার হবে না। যাও। অরেস্টেস এথেন্সে ফিরে যাবে। আমি তাকে সহযোগিতা করবো।
ছবি: ইলেকট্রা ও অন্যান্য
অরেস্টেস ভীত দেখে অ্যাপোলো তাকে পুনরায় জানিয়ে দেয় যে, সে নিজ ইচ্ছায় এ হত্যা করেনি। সে দেবতাদের আজ্ঞা পালনার্থে এ হত্যা করেছে। এথেন্সে এথেনীয় দেবির মন্দিরে তোমার বিশেষ প্রক্রিয়া মুক্তি মিলবে। যাও। অরেস্টেস এথেনীয় মন্দিরে চলে যায়।
এথেনীয় মন্দিরে ফিউরিরা বলে- অরেস্টস মাতৃহত্যা করেছে সে খুনী। অরেস্টেসের পক্ষে দেবতা অ্যাপোলো বলে-সে পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। সে নির্দোষ। মহা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে দেখে দেবি এথেন্সে একটি বিশেষ আদালত গঠন করে। যাতে বারোজন নাগরিক নিয়ে একটি জুরিবোর্ড গঠন করা হয়। নতুন বিচার শুরু হলে দেবতা অ্যাপোলো পুনরায় অরেস্টেসের পক্ষে পিতৃহত্যার অভিযোগ এনে বলে- সন্তান পিতাকে নয়, মাতাকে হত্যা করতে পারে এবং অরেস্টিস তারই নির্দেশে প্রকারান্তরে দেবতা জিউসের আদেশে মার্তৃহত্যা করেছে।
ছবি: দেবতা জিউস
ছবি: ক্লাইটেমেনেস্ট্রার হত্যার দৃশ্য
ফিউরিরা আদালতে মাতৃহত্যার অভিযোগ করে। তাদের মতে, স্বামী-স্ত্রী জ্ঞাতি নয়। এর জবাবে অ্যাপোলো বলের বক্তব্য: ছেলেও মায়ের জ্ঞাতি নয়, মা হলো শুধু দাই- যে গর্ভে শুধু পুরুষের বীর্য ধারণ করে।
ছবি: দেবতা অ্যাপলো
বিচারে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ছয়টি ভোট পক্ষে ও ছয়টি ভোট বিপক্ষে এথনা দেবির বিশেষ ভোটে অরেস্টিস মুক্তি পায়। ক্ষমার মাহাত্ম্যে বিচার শেষ হয়।
বিচারে ফিউরিরা ক্ষুব্ধ হলে এথনা দেবি তাদেরসন্তুষ্ট করার জন্য নতুন মন্দির গড়ে তোলার জন্য প্রতিশ্রুতি দেন। সেই সাথে তারাই পরবর্তীতে এথেন্সের সব হত্যার শাস্তি দিতে পারবে বলে আশ্বাস দেন। এতে করে সকল ফিউরিরা খুশি হলো। তখন তাদের নামান্তর হলো- Eumendies বা Kindly Ones বা দয়ালুরা।
একুশ শতকে অবশ্য ক্লাইটেমনেসস্ট্রার প্রতিশোধপরায়ন আচরনের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। স্বামীর ওপর তীব্র ঘৃনা থেকেই ক্লাইটেমনেসস্ট্রা পরকীয়া ও রক্তপাতের পথ বেছে নিয়েছিলেন। কেননা, ক্লাইটেমনেসস্ট্রা বলেছেন, “To give birth is a dreadful thing; despite suffering badly one cannot bring oneself to hate those she has born.”
আগামেমনন’ নাটকে কোরাস দলের ভূমিকা ছিলো খুবই উজ্জ্বল এবং প্রাজ্ঞময়। নিম্নোক্ত উক্তিগুলো তারই প্রমাণ বহন করে।
1. "Things are now as they are; they will be fulfilled in what is fated; neither burnt sacrifice nor libation of offerings without fire will soothe intense anger away."
2. "Apollo there! Healer indeed, I call on you, lest [Artemis] make contrary winds for the Danaans, long delays that keep the ships from sailing, in her urge for a se...
3. "Ares who traffics in the gold of bodies and holds his scale in the battle of the spears, sends back to their kin from Troy heavy dust burnt in the fire, which brings hard tears; and in p...
4. "With the fire's good news rumour has gone swiftly through the city; whether it is true, who knows? – or whether it is really a falsehood from god? Who is so childish or struck so...
5. "Menelaus and Agamemnon's] loud and ringing cry was of war, from anger, like vultures which in extreme anguish for their young wheel and spiral high above their nests … On high ...
6. "Ten years it is since the great plaintiff against Priam, lord Menelaus with Agamemnon, honoured by Zeus with their double throne and double scepter, the sturdy yoke-pair of the Atreidae ...
নাটকের মূল কাহিনি শুরু হয়েছে রাতের শেষ প্রহরে আর্গসের প্রহরীর পাহারাকর্মের মধ্য দিয়ে। শক্তিশালী চরিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে আগামেমনন, ক্লাইটেমেনেস্ট্রা, ক্যাসান্দ্রা, এজিসথাস, জনৈক প্রহরী, কোরাস দল, ক্যালচাস, ইফেজেনিয়াস, অ্যাট্রিউস, দেবি আর্টেমিস, দেবতা অ্যাপোলো প্রমুখ।
গ্রিক নাটকগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ করা যায় চরিত্রসমূহের কার্যকলাপে। তারা প্রায় ক্ষেত্রেই নিজের পরিবার-পরিজন বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিক বিষয়টিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আর এ ক্ষেত্রে তারা যেকোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত থাকে। দৈব নির্দেশে সেটা সামাজিক দৃষ্টিতে কিংবা পারিবারিক দৃষ্টিতে অনৈতিক হলেও। আগামেমন নিজেও তার সেনাবহিনীকে রক্ষা করার জন্য নিজের পরিবারকেও অবহেলা করেছেন।
আগামেমনন নিজ কন্যাকে বলি দেওয়ার কারণে নিজে ‘খল’ হিসেবে চিহ্নিত হলেও মূলত তিনি তা করেছেন জাতীয় স্বার্থের কারণে। ফলে আগামেমননের এ ঘৃণ্য কর্মটি নাটকে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়। কিন্তু প্রকৃত বিচারে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য তার এ কর্মটি মোটেও চরম ঘৃণ্য নয়। বরং তিনি দূরদর্শী সেনানায়কের মতো সময়োপযোগী কাজটিই করেছেন। বৃহৎ স্বার্থের জন্য ক্ষু্দ্র স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। অবশ্য তার মধ্যে একটু উচ্চ বিলাসিতাও ছিলো। ট্রয়যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসার উদগ্র বাসনা আর উচ্চভিলাষই তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
নাট্যকার এস্কাইলাস ‘আগামেমনন’ চরিত্রটিকে মনের মাধুরি মিশিয়ে যেমন বিচক্ষণ করে তুলেছেন তেমনি জটিল থেকে জটিলতরও করে তুলেছেন। সূক্ষ্মদৃষ্টিতে দেখলে এ চরিত্রটির মধ্যে নিঃসন্দেহে অতিমানবীয় গুণাবলি লক্ষ করা যাবে। বিশেষ করে তার কথোপকথনগুলোতে নাট্যকার কালজয়ী কিছু বাণী ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যা দার্শনিক পদবাচ্য হিসেবে নাটকে বিবেচিত। নিম্নোক্ত উক্তিগুলো তারই প্রমাণ রাখে-
1. “Wisdom comes through suffering.
Trouble, with its memories of pain,
Drips in our hearts as we try to sleep,
So men against their will
Learn to practice moderation.
Favours come to us from gods.”
2. “My will is mine...I shall not make it soft for you.”
3. “Zeus, first cause, prime mover; for what thing without Zeus is done among mortals?”
4. “They sent forth men to battle, But no such men return; And home, to claim their welcome, Come ashes in an urn”
5. “There is no avoidance in delay.”
6. “Rumours voiced by women come to nothing.”
7. “She looked just like a painting dying to speak.”
8. “In visions of the night, like dropping rain,
descend the many memories of pain”
9. “I know the stars by heart,
the armies of the night, and there in the lead the ones that bring us snow or the crops of summer, bring us all we have--
our great blazing kings of the sky, I know them, when they rise and when the fall . . .”
10. “And there they ring the walls, the young, the lithe. The handsome hold the graves they won in Troy; the enemy earth rides over those who conquered.”
11. “For many men value appearances more than reality—thus they violate what’s right. Everyone’s prepared to sigh over some suffering man, though no sorrow really eats their hearts, or they can pretend to join another person’s happiness forcing their faces into smiling masks. But a good man discerns true character— he’s not fooled by eyes feigning loyalty, favouring him with watered-down respect.”
12. “Bastions of wealth
are no deference for the man
who treads the grand altar of Justice
down and out of sight.”
13. “For Ares, lord of strife,
Who doth the swaying scales of battle hold,
War’s money-changer, giving dust for gold,
Sends back, to hearts that held them dear,
Scant ash of warriors, wept with many a tear,
Light to the hand, but heavy to the soul;
Yea, fills the light urn full
With what survived the flame—
Death’s dusty measure of a hero’s frame!”
14. “At home there tarries like a lurking snake,
Biding its time, a wrath unreconciled,
A wily watcher, passionate to slake,
In blood, resentment for a murdered child.”
15. “Every medicine is vain.”
16. “Let me attain no envied wealth, let me not plunder cities, neither be taken in turn, and face life in the power of another.”
17. “For many among men are they who set high the show of honor, yet break justice.”
18. “Old men are always young enough to learn, with profit.”
19. “Death is a softer thing by far than tyranny.”
20. “We should know what is true before we break our rage.”
21. “By the sword you did your work, and by the sword you die.”
― Aeschylus, Agamemnon, (showing 1-23 of 23)
প্রাচীন গ্রিসে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্র ছিলো ভিন্ন। একজন বর্হিজগতের অন্যজন গৃহাঙ্গনের। নাট্যকার এস্কাইলাস তাঁর ‘আগামেমনন’ নাটকে ক্লাইটেমেনেস্ট্রা চরিত্রকে দীপ্ত পৌরুষের আলোকিত বলয়ে নির্ভীক চিত্ত ও সাহসীরূপে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। অন্যদিকে আগামেমনন পৌরুষের সীমা অতিক্রম করে অতিমানব হতে চান।
‘আগামেমনন’ নাটকে হেলেন, ক্লাইটেমেনেস্ট্রা, ক্যাসান্দ্রা তিনজনই পূর্ণযৌবনা রমণী। রমণীর প্রতি পুরুষের স্বাভাবিক যে প্রাকৃতিক আকর্ষণ তা নাট্যকার এখানে নিপুনভাবে পরিস্ফুট করেছেন। স্বামী-স্ত্রীর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপারটিও সহজ-সরল ভাষায় বেশ রসঘন করে ফুটিয়ে তুলেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজিত অঞ্চল হতে ধৃত বন্দিনীদের ভোগ করে সেনানায়কগণ।
রানি ক্লাইটেমেনেস্ট্রার অভিযোগ, তার স্বামী আগামেমনন বহু বন্দিনী রমণীর সাথে শয্যায় গিয়েছে। ফলে তার মধ্যেও একধরনের যৌন প্রতিশোধ স্পৃহা ক্রিয়া করে। সে তার স্বামীর চাচাত ভাই এজিসথাসের সাথে শয্যায় গিয়ে আগামেমননের দাম্পত্য শয্যাকে কলুষিত করে। হেলেন স্বামীগৃহ ত্যাগ করে ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিসের শয্যায় গিয়েছে।
গ্রিক পুরাণ অবলম্বনে এ নাটকে দেখানো হয়েছে বেদনা আর উল্লাসের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। নাট্যকার এখানে জীবনের বেদনাকে পরিশোধিত না করে মানব কী করে এই অপার বেদনার সমুদ্র অতিক্রম করে তারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মহান ট্যাজেডির এটাই আসল রূপ; যেখানে চরম সর্বনাশ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি মানব সত্তার অপর এক মহিমা কীর্তিত হয়।
এস্কাইলাসের নাটকে আমরা যেসব মানব চরিত্রের সাক্ষাৎ লাভ করি, তারা কোনো সাধারণ মানুষ নন। অপরূপ মহিমায় তারা মহিমান্বিত। প্রচণ্ড ধ্বংশ আর বিপর্যয়ের মাঝে তাদেরকে আমরা স্থির থাকতে দেখি। পুরো জাতির পাপপুণ্য, শুভা-অশুভ, মঙ্গল-অমঙ্গল বিষয়ে জাতির যে ধ্যান-ধারণা সেসবই আমরা প্রত্যক্ষ করি তাঁর নাটকে। মানুষের জীবনের অতল গহ্বরে ডুব দিয়ে এস্কাইলাস তুলে আনেন জীবনের বেদনা ও গ্লানির রূপটি। নাটকীয়তায়, কাব্যিক সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ ট্র্যাজেডির প্রথম সূচনাকারী হিসেবে এস্কাইলাস বিশ্বসাহিত্যে নন্দিত।
ভালো মানের গল্প পঠনপাঠন করলে আমরা যেমন অপার আনন্দ নিয়ে সহসাই তার গভীরে প্রবেশ করি, কোনোরূপ আলস্য আমাদের ভেতর কাজ করে না; তেমনি এস্কাইলাসের এ নাটকটিতেও কাহিনির ঘনঘটা এভাবে সাজানো হয়েছে। পাঠককে মুহূর্তেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাহিনির গভীর থেকে গভীরে নিয়ে যাবে। আনমনেই পাঠক জটিল থেকে জটিলতর অনুভূতি আস্বাদন করতে পারবে। নিঃসন্দেহে পাঠকের হৃদয় দলিত-মথিত হবে। অনুভূতির সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে উচ্ছ্বাস বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবে। আর একজন সফল নাট্যকারের এখানেই চরম সার্থকতা।
‘আগামেমনন’ কাহিনি বিন্যাসে এস্কিলাস প্রতীকের যেমন ব্যঞ্জনা এনেছেন তেমনি এনেছেন আলোর ব্যঞ্জনা। সমস্ত নাটকটি মনে হবে আলোয় উজ্জ্বল।
তাঁর প্রথম নাটক ‘আগামেমনন’-এ তিনি সজ্জা ও দৃশ্যসজ্জার ক্ষেত্রে বিশেষ বূমিকা রেখেছেন। তাঁর ত্রয়ী নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয় নাটকে তিনি সর্বপ্রথম দৃশ্যপটের ব্যবহার করেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই নাটকের স্রষ্টা। সৃজনশূলতার ছোঁয়া তাঁর নাটকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। এ বিষয়ে বিখ্যাত সমালোচক এডিথ হ্যামিলটনের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য: He not only invented drama, he raised it to a height which has only once been equalled, and in the glory of that two fold achievement he stands alone.
-The Greek Way
আগামেমনন নাটকে রয়েছে দীর্ঘ কবিতা। এইসব কবিতায় ট্রয়ের যুদ্ধের অথবা মেনিলাসের জাহাজডুবির বর্ণনা পড়তে বা শুনতে ভারি মনোমুগ্ধকর। কিন্তু এগুলো শ্রব্যকাব্যের অন্তর্ভুক্ত হলেই ভালো হয়। দৃশ্য নাটকে এগুলো খুব একটা মানানসই নয়। সেদিক থেকে ‘তর্পণ বাহকেরা’ শুরু থেকে শেষ অবধি নাটক। এমনকি কোনো কোনো দৃশ্যে নাটকীয়তার চরম উৎকর্ষও ঘটেছে। আর এ কারণেই বলা যায় তর্পণ বাহকেরা নাটক হিসেবে আগামেমননের চাইতে নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্ট। তবে উল্লেক্য যে, আগামেমনন নাটকের বাক্যগুণ তর্পণ বাহকেরা নাটকে নেই বললেই চলে।
চরিত্রের দিক থেকে যদি আমরা তুলনা করি তাহলে দেখতে পাই ‘আগামেমনন’ নাটকে ক্লাইটেমেনেস্ট্রা ও আগামেমনন পরিপূর্ন বিকশিত চরিত্র। কিন্তু সেই তুলনায় তর্ফণ বাহকেরায় অরেস্টিস বা ইলেকট্রা ঠিক ক্লাইেটেমেনেস্ট্রা বা আগামেমননের মতো পূর্ণঙ্গ চরিত্র নয়।
তাঁর নাটকে আমরা কমেডির ছোঁয়াও পাই। তিনি যে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে নাটকে ভালো কমেডি সংযোজনও করতে পারেন তা দেখে এখনো নাট্যবোদ্ধারা অবাক হয়ে যান। তাঁর সম্পর্কে সক্রেটিসের একটি মন্তব্য খুবই উল্লেখযোগ্য। তা হলো, “যিনি ভালো ট্র্যাজেডি লিখতে জানেন, তিনি ভালো কমেডিও লিখতে পারেন”।
‘অরেস্ট্রিয়া’ ত্রয়ী নাটকের সর্বশেষ নাটক ‘দয়ালুরা’য় নাট্যকার বিচারককে পারিবারিক জীবনের সংকীর্ণ বৃত্ত থেকে নাগরিক জীবনের বৃহত্তর পরিধিতে নিয়ে এসেছেন। তাঁর শেষ নাটক ‘দয়ালুরা’ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিক্যাত সমালোচক গিলবার্ট মারে বলেছেন:
In the Eumendies, it is true; Aeschylus definitely glorifies the Areopagus at a time when Ephialtes and pericles was removing most of its jurisdiction.
- Literature of Ancient Greece.
‘দয়ালুরা’ নাটকের শেষ পর্যায়ে আমরা দেখি নাট্যকার নবীন ও প্রবীণ দেবতাদের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে নাটকে নতুনত্ব আনয়ন করেছেন। এতে করে এথন্সবাসীর মতো আড়াই হাজার বছর পরে আমাদের কাছেও মনে হয় এই নাটকের পরিশেষে অন্ধকার আর রক্তের অভিশাপ থেকে আলো আর শক্তির পথে আমাদের ক্রমাগত যাত্রা। সকল বৈরিতার শেষে আমাদের উত্তরণ ঘটবে এক অনাবিল শান্তির রাজ্যে।
এককথায় বলা যায়, অরেস্টিয়া এস্কাইলাসের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। তাঁর জীবনগত অভিজ্ঞতায় এই নাটকটি ঋদ্ধ। গ্রিক দর্শনের কাছেই যে নাটকটি শুধু ঋদ্ধ হয়েছে তাই নয়, আধুনিক কালেও ইংরেজ কবি সুইনবার্ন নাটকটির প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন: The greatest acvievement of human mind. তাঁর উক্তিতেই সে উচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস মেলে। তাঁর ত্রয়ী নাটকের প্রত্যেকটিই যেনো বৃহৎ নাটকের এক একটি অঙ্ক।
এস্কাইলাস এমনই একজন নাট্যকার যিনি তার প্রত্যেক নাটকের মাধ্যমেই পাঠক ও দর্শককে অনুভূতির বৃষ্টিতে ভিজানোর ক্ষমতা রাখেন। ‘আগামেমনন’র ত্রয়ী খণ্ডে মূলত তৎকালীন গ্রিসের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতিগত আবহকেই সুচারুরূপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিশ্ব নাট্যসাহিত্যে তাঁর এই ট্র্যাজেডি নাটকটি সত্যিকার অর্থেই একটি মাইলফলকস্বরূপ।
------------------------------
মুনশি আলিম
২৪.০৯.২০১৬ -০৭.০৯.২০১৬
শিবগঞ্জ, সিলেট
তথ্যসূত্র ও ছবি: ইন্টারনেট
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৪
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: গ্রিক পুরাণ অবলম্বনে এ নাটকে দেখানো হয়েছে বেদনা আর উল্লাসের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। নাট্যকার এখানে জীবনের বেদনাকে পরিশোধিত না করে মানব কী করে এই অপার বেদনার সমুদ্র অতিক্রম করে তারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মহান ট্যাজেডির এটাই আসল রূপ; যেখানে চরম সর্বনাশ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি মানব সত্তার অপর এক মহিমা কীর্তিত হয়।
এস্কাইলাসের নাটকে আমরা যেসব মানব চরিত্রের সাক্ষাৎ লাভ করি, তারা কোনো সাধারণ মানুষ নন। অপরূপ মহিমায় তারা মহিমান্বিত। প্রচণ্ড ধ্বংশ আর বিপর্যয়ের মাঝে তাদেরকে আমরা স্থির থাকতে দেখি। পুরো জাতির পাপপুণ্য, শুভা-অশুভ, মঙ্গল-অমঙ্গল বিষয়ে জাতির যে ধ্যান-ধারণা সেসবই আমরা প্রত্যক্ষ করি তাঁর নাটকে। মানুষের জীবনের অতল গহ্বরে ডুব দিয়ে এস্কাইলাস তুলে আনেন জীবনের বেদনা ও গ্লানির রূপটি।
অনেক ভাল লাগল। দারুন গবেষনা আর বিশ্লেষন
+++++++++++++