নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পড়ি এবং লেখি

সৃষ্টিশীল আলিম

ক্ষুদে সাহিত্যিক, সৃষ্টির নেশায় উন্মুখ

সৃষ্টিশীল আলিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

সবুজিমা বাংলাদেশ : দেশেপ্রেমের নিটোল মাহাত্ম্য গাঁথা

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৩৬





একটি বই একটি স্বপ্ন, একটি ভালো বই স্বপ্নের সুতিকাগার। একটি বই একটি সীমানারেখা টেনে দেয়। পরের বইয়ে তা অতিক্রমের চেষ্টা থাকে। একজন গুণী লেখক, পরিশ্রমী লেখক সর্বদাই নিজেকে যুগোপযোগী রাখার চেষ্টা করেন। সাহিত্যকে যিনি সাধনা হিসেবে নিয়েছেন, জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন নিঃসন্দেহে তিনি নমস্য। মহাকাল এরকম নিরলস আর পরিশ্রমী সৃষ্টিশীলদের সৃষ্টিকর্মই তার মহাখাতার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় খোদাই করে রাখে। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যকে যিনি জীবনের ধ্যানজ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি হলেন সব্যসাচী আবুল ফতেহ ফাত্তাহ। ২০১০ সালে জ্ঞানালোক প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে তাঁর সবুজিমা বাংলাদেশ শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ। গোলাপের কাছে গিয়ে যেমন সৌরভ খুঁজার প্রয়োজন হয় না তেমনি সব্যসাচী আবুল ফতেহ ফাত্তাহ’র ছড়ার কাছে গেলেও ছন্দ খুঁজার প্রয়োজন হয় না। ভাব আর ছন্দের দুলুনি পাঠককে নিয়ে চলে দূর থেকে দূরান্তরে।

সবুজিমা বাংলাদেশ ছড়াগ্রন্থটি মোট চার ফর্মার। এতে রয়েছে মোট ৩৮টি ছড়া। বেশিরভাগ ছড়াগুলোতেই লেপটে রয়েছে দেশপ্রেমের উজ্জিবনীশক্তি। ছড়াগ্রন্থটির শুরু হয়েছে দেপ্রেমমূলক ছাড়া দিয়ে। শুরুটা ঠিক এরকম—
নল-খাগড়ার সবুজ বনে
ডাকছে ডাহুক-টিয়ে
মনটি আমার হাতছানি দেয়
শিরীষতলায় গিয়ে।

ছড়াকার যেমন সময়সচেতন তেমনি সমাজসচেতনও। সমাজের নানাপ্রান্ত থেকেই তিনি রসদ সংগ্রহ করেছেন তার ছড়ায়। আসলে তিনি শিশুকে একান্ত শিশু করেই রাখতে চেয়েছেন। ছোটোদের শুধু স্বপ্ন দেখাতে গিয়েই তিনি ছড়ায় ঘুরে ফিরে এনেছেন শিশুরঞ্জনি ছবি। আদি ছড়ার অকৃত্রিম রসকে সম্বল করে তিনি এগিয়ে নিয়েছেন তাঁর লেখাগুলোকে। শিশুদের বিনোদনের পাশাপাশি কৌতূহলের মাত্রাকেও তিনি বিশেষ কৌশলে বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
কদম ফুলে গন্ধ ঠাসা
কদম ডালে কাকের বাসা।
কাকের বাসায় কোকিল ছানা
সত্যি কি তার এই ঠিকানা?

আগুন ছুঁয়েছে, ঘুমাও পুতুল সোনার খাটে প্রভৃতি ছড়ায় সুজনচরিত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। সামাজিক ত্রুটিবিচুতি ও সমকালীন বাস্তবতা তাঁর ছড়ায় বিশেষ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। রম্যরস সৃষ্টিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রাচীন বৌদ্ধ চর্যাকারদের দোহা’য় সাহিত্যরূপের আড়ালে যত গূঢ় সাধনতত্ত্বই থাকুক না কেন, এর উপস্থাপিত সাহিত্যরূপের চিত্রণে সমকালীন চিত্রকল্প বা আবহকে অস্বীকার করা যায়নি কিছুতেই। কিংবা কৃষিজীবী সমাজের জনভাষ্যে মিশে থাকা আমাদের লোকভাষ্যকারদের লোকায়ত বচনগুলোও যদি খেয়াল করা যায়, এর ব্যত্যয় ঘটে না। আবুল ফতেহ ফাত্তাহ’র ছড়াতেও তেমনি লোকজ উপাদান আমাদের চিরপরিচিত বলয়ের কথাই স্মরণ করে দেয়। বিশেষ করে সমকালীন বাস্তবতা তাঁর ছড়ায় এনেছে ভিন্নধর্মী দ্যোতনা।

আঁধারের সম্রাট
বিদ্যুৎ বিভ্রাট।
আশে-পাশে আলো জ্বলে
ঘরে নেই বিদ্যুৎ
এলো কোন কালভূত?
এই আসে এই যায়
নেই তার স্বস্তি
আশা আর নিরাশায়
থাকে গ্রাম-বস্তি।

তাঁর অনেক ছড়াতেই রয়েছে নাটকীয় ভঙ্গিমা। শিশুদের উপযোগী শব্দচয়নেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। একটি ছড়াগ্রন্থ নানা ভাবের ছড়ায় ঋদ্ধ তাকে। কোনো কোনোটি আবার প্রেমের ছড়া, হাসির ছড়া, বিয়ের ছড়া, বিপ্লবের ছড়া, বিদ্রোহের ছড়া, বয়স্ক ছড়া, শিশুতোষ ছড়া, ননসেন্স ছড়া, দেশপ্রেমের ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া ইত্যাদি। বড়োদের মতো শিশুরা ভিন্ন ভিন্ন রস্বাদনে আগ্রহী থাকে। বিশেষ করে নাটকীয় ভঙ্গিমায় কোনো ছড়া হলে তো কথাই নেই!

তোমার সাথে রাগ করেছি
মুখ করেছি ভার
তোমার অমন দুষ্টুমিতে
দোষটি বলো কার?
দোষ দেব না, দোষ দেব না
বলছি কথা শোনো
ছড়ার ছবি রঙ তুলিটা
এত প্রিয় কেন?

ছড়া শিশুমনে ভাবের দ্যোতনা সৃষ্টি করে। বৃদ্ধিবৃত্তিক হতে সাহায্য করে। কৌতূহলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বিনোদনের ভাবাবেগে শিশুমনকে সজিব করে তোলে। ছড়াকে নিছক হিসেবে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। মোটাদাগে ছড়া হলো সাহিত্যের বিশেষ জায়গা—যেখানে ছোটোবড়ো সকলেই অবগান করতে পারে। ১৩০১ বঙ্গাব্দে লোকসাহিত্য রচনায় ছেলেভুলানো ছড়া—১ পর্বে রবীন্দ্রনাথ বলেন :
আমি ছড়াকে মেঘের সহিত তুলনা করিয়াছি। উভয়েই পরিবর্তনশীল, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, বায়ুস্রোতে যদৃচ্ছ ভাসমান। দেখিয়া মনে হয় নিরর্থক। ছড়াও কলাবিচারে শাস্ত্রের বাহির, মেঘবিজ্ঞানও শাস্ত্র নিয়মের মধ্যে ভাল করিয়া ধরা দেয় নাই। অথচ জড় জগতে এবং মানব জগতে এই দুই উচ্ছৃঙ্খল অদ্ভুত পদার্থ চিরকাল মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিয়া আসিতেছে।

অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বলতে চাচ্ছেন যে ছড়া কোনো নির্দিষ্ট নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ নয়। সত্যি কি তাই ? একই রচনায় রবীন্দ্রনাথ আরো বলেন : ‘তাহারা মানবমনে আপনি জন্মিয়াছে। ইহার মধ্যে ভাবের পর¯পর সম্বন্ধ নাই, কতকগুলি অসংলগ্ন ছবি নিতান্ত সামান্য প্রসঙ্গসূত্র অবলম্বন করিয়া উপস্থিত হইয়াছে। গাম্ভীর্য নয়, অর্থের মারপ্যাঁচ নয়, সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণ।

রবি ঠাকুরের শেষোক্ত বাক্যটি ছড়া নির্ণয়ের জন্য এখনও বিশেষ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। ছড়াতে সুরময় ধ্বনি না থাকলে তা প্রাণের গভীরে দ্যোতনা সৃষ্টি করে না। শরীর-মনকে দোলায়িত করে না। আর এসব দিক মাথায় রেখেই আবুল ফতেহ ফাত্তাহ রচনা করেছেন নিটোল ছড়া। তাঁর যেকোনো ছড়াপাঠমাত্রই পাঠক এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবে।

ফুলপাখি ফুল পাখি
রিয়া করে ডাকাডাকি
এসো আমার হাতে
খেলব তোদের সাথে।

ছড়া লোকসাহিত্যের প্রাণ। ‘লোকসাহিত্য’ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সুকুমার সেন তাঁর বিচিত্র সাহিত্য গ্রন্থে বলেন :
লোকসাহিত্যের যে শাখাটি অন্তপুরের আঙিনায় স্নিগ্ধছায়া বিস্তার করেছে তা ঘুমপাড়ানি ও ছেলেভুলানো ছড়া। এই ছড়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সর্বদেশের সর্বকালের আদিম কবিতার বীজ, বাণীর প্রথম অঙ্কুর। আদি মানবজননীর কণ্ঠের অর্থহীন ছড়ার টানা সুর ছন্দের জন্ম দিয়েছে। ছেলেভুলানো ছড়া কবিতাই। তবে তার নির্মাণরীতি সাধারণ কবিতার থেকে আলাদা। সাধারণ কবিতা লেখবার সময় কবির কল্পনা বিচরণ করে ভাব থেকে রূপে, রস থেকে ভাষায়। ছড়া কবিতায় লেখকের কল্পনা যায় রূপ থেকে ভাবে, ভাষা থেকে রসে, এবং তাতে রূপের ও ভাবের মধ্যে, ভাষা ও রসের সঙ্গে কোন রীতিসিদ্ধ যোগাযোগ বা সঙ্গতি আবশ্যিক নয়।

একজন ছড়াকারকে এমন অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হলেও ছড়াকাররা ভাষা ও রসের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার চেষ্টা করেন। এ প্রচেষ্টা সব্যসাচী আবুল ফতেহ ফাত্তাহ’র ছড়ায়ও বিদ্যমান।

সবুজিমা বাংলাদেশ
আকাশ জুড়ে দিচ্ছে ডাক
এলো বুঝি কালবৈশাখ
গাছে গাছে নতুন পাতা
গাইছে সবাই মধুর গাথা।

ছড়া যে আর্টলেস আর্ট—এর মধ্যে কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন নেই। নির্মাণশৈলীতে বুদ্ধিবৃত্তি দরকার নেই। প্রয়োজন কেবল শিশু হৃদয়ের এলোমেলোমি। তাই ছড়ার আঙ্গিকের মধ্যেই ছড়া ভিন্ন হয়ে উঠবে পদ্য ও কবিতার চেয়ে। অথবা ছড়া এমন একটি বিষয় ধারণ করবে যা কবিতার উপযোগী নয়। ছড়া নিরন্তর পরীক্ষামূলক। বিষয় ও আঙ্গিকগত বৈচিত্র্যের মাধ্যমে ছড়া ধারণ করে তার মহত্ত্বকে।

চাঁদেরকণা আলোর হাসি
আমার চাঁদের হাঁট
দুঃখ-সুখের এই আসরে
নিচ্ছি সবাই পাঠ।

কবিতার ঘনীভূত সংঘটনের পাশাপাশি ছড়ার অবস্থান একেবারেই বিপরীতমুখী। গতি ও আঙ্গিকগত বৈচিত্র্য ছড়ার কাঠামোর মধ্যে ছড়িয়ে দেয় শিশু হৃদয়ের চপলতা। ছড়া সর্বাংশ ছড়া হয়ে ওঠে শিশুহৃদয়ের সম্পন্নতায়। মানুষের হৃদয়ে যতদিন শিশুহৃদয় সক্রিয় থাকবে ততদিন ছড়া সার্থকভাবে রচিত হবে। ছড়া ছেলেমানুষী আচরণ করবে। ছড়া খোলামেলা অন্তরঙ্গ।

চিন্তামণি চিন্তা তোমার
হবে অবসান
শিমুলবাঁকে নায়ের মাঝি
ধরবে যখন গান।

ছড়া শিশুহৃদয়ের স্পন্দন। ছড়া স্বেচ্ছাসেবী, বিশৃঙ্খল। ছড়া ছুটির দিনের নীলাকাশ। ছড়া আনন্দময়, ফুর্তিময় অনুভূতি। ছড়া সেই সলাজ কিশোরী—যার বয়স কোনো দিন বাড়বে না। বিষয়, আঙ্গিক, উপস্থাপনার ঢঙে নিত্যপরিবর্তন আসতেই থাকবে। ছড়া মুক্ত আকাশের মতো নির্মল বলেই এর মধ্যে চলতে থাকবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ছড়ার চরিত্র ঠিক থাকবে। ছড়া শিশুতোষ দুষ্টুমি। ভারি দার্শনিক তত্ত্বকেও সহজ দৃষ্টিতে যে দেখতে পায়—তিনিই সৃষ্টি করতে পারেন খাঁটি ছড়া। আবুল ফতেহ ফাত্তাহ’র সবুজিমা বাংলাদেশ ছড়াগ্রন্থের চিত্তকর্ষক ছড়াগুলোও প্রমাণ করে তিনি একজন নিষ্ঠাবান দক্ষ ছড়াকার। কর্মযজ্ঞের বৈচিত্র্য ও উপযোগের মূল্যায়নের ভার মহাকালের ওপরই রইল।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:০৫

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: লেখক ও আপনার জন্য শুভ কামনা।

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৪০

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: আপনার প্রতিও রইল ভালোবাসা ও শুভকামনা।

২| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:০৮

ভাবুক কবি বলেছেন: শুভ কামনা রইল

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৪২

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: ভালোবাসা জানবেন।

৩| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৪

শামচুল হক বলেছেন: বইয়ের সফলতা কামনা করি।

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৪৩

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা।

৪| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:২৯

সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:
উনি যদি সিলেটের ফাত্তাহ স্যার হয়ে থাকেন, তাহলে আমি উনার ক্লাস করেছি।

অপূর্ব তাঁর বাচনভঙ্গি।

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৩৯

সৃষ্টিশীল আলিম বলেছেন: হ্যাঁ, তিনি সিলেটেরই ফাত্তাহ স্যার।


আপনার প্রতি রইল ভালোবাসা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.