![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শীত বেশ জেঁকে বসেছে এবার, দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড ছুঁয়েছে। এই হাড় কাঁপানো শীতে খোলা আকাশের নিচে বাঁচার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে চলে কিছু মানুষ। রঙিন কাঁচের আড়ালে ঝলমলে বর্নীল জীবন নয়, বরং শক্ত মাটির উপর কনক্রিটের বিছানাই ওদের সম্বল। পশমি কম্বলের আরামদায়ক উষ্ণতার প্রত্যাশা ওরা করে না, হাড় কাঁপানো তীব্র শীত আর হিম শীতল বাতাসের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে পাতলা পুরাতন কাপড় কিংবা চটের আচ্ছাদনে উষ্ণতা খুঁজে ফিরে এই সব অস্পৃশ্য মানুষ নামের জীব! সীমাহীন শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচাতে এদের দিকে দু’হাত বাড়াতে এগিয়ে আসে না কেউ, দেখায় না সামান্য সহানুভূতি! সারা শহর জুড়ে বিভিন্ন খোলা জায়গায়, পার্কে কিংবা বাসস্ট্যান্ডে গেলে দেখা যায় বাস্তব চিত্র। রাতের ঢাকার এই চিত্র বেশীর ভাগ মানুষের কাছেই থেকে যায় অজানা!
শীত রাতের কিছু দৃশ্যঃ
Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
১১-ই জানুয়ারীঃ
-তোমার নাম কি?
-আ-ক-লি-মা-আ
-এই শীতে রাস্তায় শুয়ে আছ, তোমার ঘর নেই?
করুণ দু’টি চোখ ভাষাহীন, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা আর কিছু বলতে পারছে না প্রচন্ড শীতে থর থর করে কাঁপতে থাকা মহিলা!
-তুমি তো শীতে ঠিকমত কথাই বলতে পারছ না, যাবে আমাদের সাথে!
-ক-ও-ই যা-য়া-মু ?
-আমাদের সাথে, আশ্রয় পাবে, খাবার পাবে;
-হ, যা-য়া-মু! চোখে-মুখে কৃতজ্ঞ দৃষ্টি!
রাত প্রায় বারোটা, গাবতলী বেড়িবাঁধে রাস্তার পাশে পাতলা একটি চাঁদরে ঢাকা এক মহিলা, শীতে থরথর করে কাঁপছিল। বয়স ছাব্বিস-সাতাশ হবে! মহিলাটিকে গাড়িতে তুলতে গিয়ে দেখা গেল ওর একটি পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত! ঠিকমত ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। লোকজন ধরাধরি করে মহিলাটিকে মাইক্রোতে তুলল।
মিরপুর-১, খোলা রাস্তার পাশে জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে ৫৫ বছরের বৃদ্ধ জব্বার আলী, বাড়ি- বগুড়া । গায়ে একটা পাতলা চাঁদর, শীতে কাঁপছে। খাবার ও আশ্রয়ের কথা বলতেই সাথে যেতে রাজি হয়ে গেল। লোকটিকে ধরে তোলা হল মাইক্রোতে।
১২-ই জানুয়ারীঃ
দারুসসালাম রোডে রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নীচে শীত বস্ত্রবিহীন শুয়ে আছে চৌদ্দ-পনের বছরের একটি মেয়ে! নাম- রুমা, কোত্থেকে আসছে জিজ্ঞেস করলে জানায় বরিশাল থেকে গ্রামের পরিচিত একজন নিয়ে এসে এখানে রেখে চলে গেছে, কয়েকদিন ধরে লোকজনের দেয়া খাবার খেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। আশ্রয়হীন মেয়েটিকে নিয়ে মাইক্রোতে তোলা হল।
উপরের দৃশ্যগুলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় তথা সমাজসেবা অধিদপ্তরের চলমান আশ্রয়হীন মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার অভিযানের অংশবিশেষ! প্রধানমন্ত্রীর আদেশে গত কয়েকদিন ধরে তাদের লোকজন কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আশ্রয়হীন শীতার্ত মানুষকে খোলা জায়গা থেকে তুলে এনে তাদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে খাবার ও গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করেছে। আমি যদিও তাদের অফিসের কেউ নই তবুও তাদের সাথে যাবার সুবাদে এই ঘটনাগুলো দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যা-ই বলি না কেন হয়েছিল!
সেদিন বাসায় কয়েকজন বন্ধুর সাথে চায়ের আড্ডায় গল্প ও আলাপচারিতায় একটু রাত হয়ে গিয়েছিল, ওদের মধ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকুরীরত দুজন বন্ধু উঠে জানালো রাতে বাহিরে যেতে হবে। জানতে পারলাম প্রধানমন্ত্রীর আদেশে শহরের আশ্রয়হীন শীতার্ত মানুষদের তুলে এনে ওদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে খাবার ও গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করতেই ওদের এই অভিযান। আমি ওদের সাথে যাব কিনা জিজ্ঞেস করতেই কেন জানি রাজি হয়ে গেলাম! ওদের সাথে বের হয়ে জানলাম সারা ঢাকা শহরে ওদের মোট সাতটি টিম এই কাজটি করছে। ভীষণ ভাল লাগলো ওদের এই কার্যক্রম দেখে! ওদের এলাকা আমিনবাজার-গাবতলী শ্যামলী থেকে শুরু করে মিরপুর-ক্যান্টনমেন্ট ও ভাষানটেক পর্যন্ত!
শুরুতেই ওরা গেল গাবতলী-আমিন বাজার এলাকায়। রাত বাড়ার সাথে সাথে মানুষের কষ্ট যেন বাড়তে থাকে, ব্যাপারাটি চোখে না দেখলে বোঝা সম্ভব না। বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাসমান মানুষ এসে বিছানা পাতে বাসস্ট্যান্ড কিংবা রাস্তার পাশের খোলা ফুটপাতে! প্রচন্ড ঠান্ডায় আমরা যেখানে কয়েক প্রস্ত জামা কাপড় পড়েও জমে যাবার অবস্থা সেখানে এই মানুষগুলো খোলা যায়গায় কিভাবে রাত কাটাবে! আশ্রয় ও খাবারের কথা শুনে অনেকে সাথে এল কিন্তু কিছু লোকের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিল-শীতে কষ্ট পেলেও এরা আবার সাথে আসতে রাজি হল না! গাবতলী, আমিন বাজার থেকে শুরু করে দারুসসালাম, শাহ আলী মাজার, ভাসানটেক – সমস্ত এলাকা ঘুরে ঘুরে খোলা জায়গা থেকে প্রায় ত্রিশ জনের মত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে এনে রাখা হল। যদিও এই কেন্দ্রটি ওরা পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেছে, তবুও এই ক্রান্তিকালীন সময়ে এটিকেই আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সম্ভাব্য যে সব জায়গায় ভাসমান মানুষের বসবাস সে রকম বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে খুঁজে আশ্রয়হীন মনুষদের এনে ওদের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে খাবার ও গরম কাপড়ের যে ব্যবস্থা করছে তাতে অবশ্যই তাদের সাধুবাদ জানানো প্রয়োজন। এই শীতের রাতে যারা এই কাজটি করছে তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। আমরা আশা করব ভবিশ্যতেও তারা এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে!
সেদিন ওদের সাথে না গেলে হয়ত আমার এই অভিজ্ঞতা হত না। প্রচন্ড শীতে মানুষের কি দুর্বিসহ কষ্ট! আমরা যারা ভদ্র সমাজে বাস করি তাদের অনেকের কাছেই এই মানুষগুলো হয়ত অস্পৃশ্য, মূল্যহীন- কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি এরাও রক্ত-মাংসের মানুষ, বেঁচে থাকার অধিকার এদেরও আছে। হয়ত উচুতলার মানুষদের মত কোর্মা-পোলাও কিংবা বিরিয়ানী এদের কাম্য না, কিন্তু পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য চারটা মোটা চালের ভাত আর এই হাড় কাঁপানো শীত থেকে বাঁচার জন্য ন্যূনতম আশ্রয়ও তো ওদের প্রাপ্য হতে পারত! এই ধরনের মানুষের সংখ্যা যে অগনিত তা কিন্তু না বরং একটু স্বচ্ছল মানুষেরা তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাহায্য একত্র করতে পারলে এই সামান্য সংখ্যক মানুষকে এই শীত থেকে রক্ষা করা তেমন কঠিন কিছু না, প্রয়োজন শুধু একটু স্বদিচ্ছার!
মানবতার জয় হো
©somewhere in net ltd.