নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দাদা ভাই

দাদাভাই এর ব্লগ

দাদাভাই এর ব্লগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বুদ্ধিজীবি হত্যা নিয়ে একজন ভুক্তভোগির একটি বর্ণনা

২৩ শে আগস্ট, ২০০৯ বিকাল ৫:৩৮

শহীদুল্লাহ কায়সারের হত্যাকান্ড নিয়ে পান্না কায়সারের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়েছিল দিনের শেষে পত্রিকায়।

সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরলাম আপনাদের জন্য.......



শহীদুল্লাহ কায়সারের হত্যাকারীকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেই শনাক্ত করেছিলাম -পান্না কায়সার[/sb]



এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভয়াল সেই ঘটনা। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাত। বাসায় ছোট্ট শিশু শমীকে তখন দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। বাসায় মুখোশপরা একদল ঘাতকের হানা। হাত টেনে ধরেও স্বামীকে রাখতে পারেনি। বর্তমান জামায়াত নেতা খালেক মজুমদারসহ ঘাতকরা ওকে ধরে নিয়ে যায়। পরে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাকে আমার স্বামী হত্যাকারী হিসেবে শনাক্ত করেছিলাম। বিচারককে বলেছিলাম, খুনের বদলে খুন। আইনে হত্যাকারীর বিচার হবে না। আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীকে নিজের হাতে খুন করতে চেয়েছিলাম- বলেছেন পান্না কায়সার। শুধু বিশেষ দিন বা ঘটনা বলে কথা নয়-শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারকে প্রতিনিয়তই মনে পড়ে। তার স্মৃতি আমার মনের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে। এই শক্তি আমাকে অনেকখানি সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর ও ২৫ মার্চ রাতের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িত। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাত। কায়েৎটুলীর বাড়িতে ছিলাম আমরা। সেদিনও ছিল সবকিছু অন্ধকার। বাড়িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও আত্মীয়স্বজন আশ্রয় নিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় শহীদুল্লাহ কায়সার ও আমার চাচাশশুর শাহরিয়ার কবিরের বাবা মিলে সোফায় বসে ভয়েস অব আমেরিকা শুনছিলেন। তখন আমি শমীকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। এমন সময় দরজায় ঠক ঠক শব্দ। আমার দেবর এসে শহীদুল্লাহ কায়সারকে বললো, বড়দা দরজায় শব্দ শোনা যাচ্ছে। দরজা খোলার জন্য বলছে। আমি দরজা খুলতে নিষেধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। শহীদুল্লাহ কায়সার তখন বললো- খুলে দাও। মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে। এদিকে ও আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুললো। বুঝতে পারলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা দেয়ার জন্যই আলমারি খুলেছে। সব অন্ধকার তখন। মোমবাতি নিয়েই ঘরে ও বারান্দায় হাঁটছে। ইতিমধ্যে দরজা খোলা হয়ে গেছে। আমরা নিচ থেকে কোনো শব্দই শুনতে পাচ্ছিলাম না। শহীদুল্লাহ কায়সার বলছিল- কি ব্যাপার কে এলো? কোনো শব্দই তো আর শোনা যাচ্ছে না। তখন ও ভাবলো, কোনো আত্মীয় হয়তো এসেছে। এ কথা বলতে বলতেই নিচতলা থেকে ওরা উপরের দিকে উঠছে। সিঁড়িতে ঠক ঠক শব্দ। উপরে উঠতেই আমাদের বসার ঘর। মোমবাতি জ্বলছিল। ঘরে ঢুকেই ঘাতকরা জিজ্ঞেস করলো, এখানে শহীদুল্লাহ কায়সার কে? ওরা শহীদুল্লাহ কায়সারকে চিনতো না। ঘাতকদের সবাই ছিল মুখোশধারী। তখন সে নিজেই নিজের পরিচয় দিলো। আমি শহীদুল্লাহ কায়সার। সেদিন সে পরিচয় গোপন করেনি। শহীদুল্লাহ কায়সার পরিচয় দেয়ার পরই তার হাত ধরে হেঁচকা একটা টান দিলো। টান দিতেই দুধের শিশু শমীকে আমি ছুড়ে ফেলে দিলাম। ও ছিটকে পড়ে গেলো। দুধের বোতলটাও ছিটকে পড়ে যায়। তখন ওর বয়স দেড় বছরের কম। ঘাতকরা কায়সারকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি ওর পেছন পেছন আরেকটি হাত ধরে টানছিলাম। কিন্তু তাকে টেনে ধরে রাখতে পারছিলাম না। ওরা যখন বারান্দায় ওকে টান দিয়ে নিয়ে গেলো তখন আমি বারান্দার সুইচটা অন করে দিলাম। বারান্দাটা আলো হয়ে গেলো। পাশের রুমেই আমার ননদ ছিল। গর্ভবতী অবস্থায় পাশের রুম থেকে সে অনেক কষ্টে বারান্দায় আসে। মুখোশ পরা এক ঘাতকের মুখের কাপড় টান দিয়ে খুলে ফেলে সে। চিৎকার করে বলে, আমার বড়দাকে তোরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস। এই বলে ও বড়দাকে জড়িয়ে ধরে। আমার ননদকে ওরা ছিটকে ফেলে দেয়। আলোতে আমরা ঘাতককে চিনে ফেললাম। ঘাতকরা সময় নষ্ট না করে শহীদুল্লাহ কায়সারকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে যায়। তখন ওর হাতে আমার হাত ধরা ছিল। টানতে টানতে একপর্যায়ে ওর হাত থেকে আমার হাতটা ছুটে যায়। চলে যাওয়ার সময় একটা কথাই বললো সে- ‘ভালো থেকো, সন্তানদের আমার মতো করে মানুষ করো’। বিড়বিড় করে আর কি বলছিল বুঝতে পারিনি। ওরা কিছু বলতেও দিচ্ছিল না। তাকে বাসা থেকে বের করার পর আমি ও আমার ননদ অজ্ঞান হয়ে গেলাম। পুরো ঘটনাতেই নিচের তলার লোকদের কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। ঘাতকরা ঘরের ভেতরে ঢুকেই তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তাই নিচতলা ছিল একেবারেই নীরব। ১৬ ডিসেম্বর কারফিউ নেই। বিজয়ের আনন্দ আমরা ভোগ করতে পারলাম না। ১৬ ডিসেম্বর আমার দেবর বলে, শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে জেলে যাবে। তখন আমার ধারণা হলো, তাকে আগেও অনেকবার জেলে নেয়া হয়েছে। তাকে হয়তো জেলে আটকে রেখেছে। দেবর জাকারিয়া হাবিব আমাকে জহুর হোসেন চৌধুরীর বাসায় নিয়ে যায়। তিনি আমাকে অনেক কিছু বোঝান। শক্ত হয়ে বাস্তবতাকে মোকাবেলার কথা বলেন। আমার দেবর ও আমি রিকশা নিয়ে যাচ্ছি। রায়েরবাজারে গিয়ে রিকশা থামলো। আমি এর আগে সেখানে যাইনি। সেখানে অসংখ্য মানুষ। দেবরকে বললাম, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছো? সবাই স্বজন হারানোর শোকে কাঁদছে। আমি শক্ত হলাম। আরেকটু সামনে এগুতেই দেখি অসংখ্য লাশ। আমি স্বামীর লাশ শনাক্ত করার চেষ্টা করি। নিজেই একটা একটা করে লাশ উল্টে উল্টে দেখি। কতোগুলো লাশ এভাবে দেখবো আমি! শহীদুল্লাহ কায়সারের লাশ পেলাম না। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে আসি। ১৮ জানুয়ারি শহীদুল্লাহ কায়সারের ছোট ভাই জহির রায়হান ঢাকায় আসে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একদিন নিচতলায় প্রচণ্ড হৈচৈ শোনা যাচ্ছিল। অনেক লোক জমা। শাহরিয়ার কবির আমাকে নিচে আসার জন্য ডাক দিলো। গিয়ে দেখি, খাবার ঘরে একজন লোকের হাত পেছনে বাঁধা। পা বাঁধা চেয়ারের সঙ্গে। ওকে দেখেই বাঘের মতো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। এই আমার স্বামীর হত্যাকারী বলে গলা টিপে ধরি। টেনে শার্ট ছিঁড়ে ফেলি। যার মুখোশ খুলে ফেলেছিল আমার ননদ, এই লোকটা ছিলো সে। কিন্তু তার মনে আমি কোনো ভয় দেখিনি। সে এখনো বেঁচে আছে। জামায়াতের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। ঘাতক খালেক মজুমদারকে থানায় দেই। থানায় ডায়রি করা হয়। ১৯২৭ সালের দিকে শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যার বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। কোর্টে দাঁড়িয়ে আমি আমার ননদসহ আত্মীয়স্বজন খালেক মজুমদারকে শনাক্ত করলাম। বিচারককে বলছিলাম, আমি ওকে শাস্তি দেবো। আদালতে উত্তেজিত হওয়ায় আমাকে সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর শুনলাম তার ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। আসামি আদালতে খুনের কথা স্বীকার করেনি। সে শহীদুল্লাহ কায়সারকে অন্যদের হাতে তুলে দেয়ার কথা বলেছে। হত্যার প্রমাণ না হওয়ায় তার ফাঁসি হয়নি। জেলে বসেও সে আমাদের হুমকি দিয়েছে। রায়ে আমরা খুশি ছিলাম না। কিন্তু বাংলাদেশে একজন মাত্র রাজাকারের শাস্তি হয়েছিল মাত্র। বিচারের নামে প্রহসন হয়েছিল সেদিন।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে আগস্ট, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৪৬

আকাশ_পাগলা বলেছেন: বিচারের নামে প্রহসন হয়েছিল সেদিন


মৃতের বউ আর বোন যেখানে সাক্ষী দেয়, কত বড় গর্দভ হলে বিচারক আসামীকে ফাঁসী দেয় না??? এগুলা কী পাকিস্তান থেকে পড়ে পাশ করছিল??


কষ্ট লাগল খুব।

২৪ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ৮:১০

দাদাভাই এর ব্লগ বলেছেন: হয়তো তাই।

নাহয় মানসিকভাবে পাকিস্তানী ছিল

২| ২৮ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:১১

লালসালু বলেছেন: দেশের এই সব কুলাঙ্গারদের যতদিন বিচার হবে না ততদিন দেশে খুন খারাবু বেড়েই চলবে। একটি প্রশ্নঃ পান্না কায়সার (আমার বাড়ী ওনাদের পাশের গ্রামে কুমিল্লার বরুড়া থানার পয়ালগাছা গ্রাম) যখন ক্ষমতাসীন দলের এমপি ছিলেন তখন এদের বিচার করেননি কেন? এখন খুনি মাওলানা মান্নানের পুত্ররা আওয়ামীলীগের দালাল (ইনকিলাব পড়ে দেখেন) গত ইলেকশনে নমিনেশন চেয়েছিলেন। তাকে আওয়ামীলীগ এত প্রশ্রয় দিচ্ছে কেন?

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৩৬

দাদাভাই এর ব্লগ বলেছেন: এটাই বড় প্রশ্ন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.