নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দামাল ছেলে ৭১

দামাল ছেলে ৭১ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিজয়ীর বেশে ঢাকায়

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:০৭

আখাউড়া যুদ্ধের যুদ্ধ পরিকল্পনার নথি, অপারেশন ম্যাপ, যুদ্ধ শুরুর সংকেত এবং কোডসহ সবকিছুই আমি স্বহস্তে ২৭ নভেম্বর ১৯৭১ রাতে ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড সেন্টার থেকে গ্রহণ করি। এটা করি আমার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার (তৎকালীন মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী) এবং ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সফিউল্লাহর নির্দেশে।

আমার মতো কনিষ্ঠ অফিসারের কাছে এমন একটি দলিল প্রদান এবং এ কাজে আমার ওপর ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেডের আস্থা স্থাপন ছিল একাধারে ভাগ্য ও শল্গাঘার বিষয়। এর সঙ্গে একটি দায়িত্ব জড়িয়েছিল, ছিল জীবনের চূড়ান্ত ঝুঁকি। আমার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার জেনারেল মঈনুল চৌধুরী একই কথা বলেছিলেন ২৮ নভেম্বর রাতে। জানা গেল, আমাদের অপারেশনের নাম 'অপারেশন নাট ক্র্যাক'। ২৯ নভেম্বর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি নিয়ে আখাউড়া সীমান্তে হাজির হই। কথা ছিল পরিকল্পনামতো আমি প্রথমে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করার পর অন্যরা আমাকে অনুসরণ করবে। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আমরা আখাউড়া সীমান্তে জড়ো হয়েছি। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড ফায়ারিং শুরু হলো, বেশিরভাগই 'এয়ার বার্স্ট' শেল। ছিটকে পড়লাম একটা গর্তের মধ্যে। আমাদের বেশ কয়েকজন হতাহত হলো।

আক্রমণের সময় বা এইচ-আওয়ার ছিল ১ ডিসেম্বর ভোর ১টায়। এর বেশ আগে আমি আমার গন্তব্যে পেঁৗছে যেতে সক্ষম হলাম। অবস্থান গ্রহণ করলাম শত্রু বূ্যহের চার-পাঁচশ' মিটারের মধ্যে_ দ্রুত হাতে খোঁড়া হলো ফক্সহোল। একটু পরেই (পৌনে ১টায়) পেঁৗছলেন আমার কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (প্রয়াত জেনারেল অব.)।

রাত ১টা বাজতেই আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো পাকিস্তানি সেনাদের বাঙ্কার ও রক্ষণ বূ্যহগুলো গোলার আঘাতে চুরমার করার জন্য ওয়্যারলেসে সংকেত পাঠালাম ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী ও আমাদের মুজিব ব্যাটারিকে। চরম উত্তেজনার মধ্যে 'ধামাকা' সংকেতটি উচ্চারণের পরপরই শুরু হলো প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ। এর সঙ্গেই শুরু হলো পূর্বাঞ্চলে পরিচালিত শক্তিশালী যুদ্ধ 'অপারেশন নাট ক্র্যাক'। বিরামহীন ভারী গোলাবর্ষণের শব্দে আজমপুর রেলস্টেশন এবং আশপাশের জনপদগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ওই সময় কিছু গোলা আখাউড়া রেলস্টেশনকেও আঘাত করেছিল। মিত্রবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল শত্রু বূ্যহগুলো চুরমার করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের রি-ইনফোর্সমেন্টের সাহস ও শক্তিটুকু নিঃশেষ করে দেওয়া। আমার প্রতি নির্দেশ ছিল পুনরায় 'ধামাকা' শব্দটি উচ্চারণের পরই গোলাবর্ষণ বন্ধ হবে। আমি অনেকটা ইচ্ছা করেই প্রায় তিন ঘণ্টা পর বন্ধুদের পুনরায় সংকেত পাঠালাম 'ধামাকা...'। ততক্ষণে শত্রুবাহিনীর অনেকগুলো বাঙ্কারই চুরমার হয়ে গেছে।

যা হোক, গোলাবর্ষণ বন্ধ হওয়ার পরপরই হালকা মেশিনগান, গ্রেনেড ও রকেট লঞ্চার নিয়ে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর রক্ষণ বূ্যহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। শুরু হলো রকেট লঞ্চার দিয়ে কংক্রিট বাঙ্কার ধ্বংস এবং বাঙ্কারে বাঙ্কারে ক্লোজ কমব্যাট। ওই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও তীব্রতা জেনারেল ভন রোমেলের অ্যাটাক গ্রন্থ তথা বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ নিকট যুদ্ধের কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিল।

ওই সময় চার্লি কোম্পানির কমান্ডার লে. ইব্রাহিম (পরে জেনারেল) আমার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেন আজমপুরের উত্তরে প্রায় শুকনো একটি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত পুরনো জেটি এলাকায়। ওদিকে আজমপুর রেলস্টেশনের কাছে অবস্থান নেয় ব্রাভো কোম্পানি। ওই কোম্পানি ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত কমান্ড করেন লে. বদি।

ভোর ৫টার দিকে আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে নিজেদের সুসংগঠিত করে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হানতে শুরু করলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, তাদের বেশ কিছু কংক্রিট বাঙ্কার অক্ষতই রয়ে গেছে। ঘন কুয়াশার মধ্যে সেখান থেকে তারা আমাদের দিকে গোলাগুলি বর্ষণ করে চলেছে। এক সময় আজমপুর রেলস্টেশন থেকে কিছু পাকিস্তানি সেনা পূর্ব দিকে নেমে এসে আমাদের ওপর প্রচণ্ড পাল্টা আঘাত শুরু করল।

এক সময় তাদের সুতীব্র আক্রমণের মুখে কুয়াশার মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে আমার কোম্পানি কমান্ডার (আলফা কোম্পানি) অধিকাংশ পল্গাটুন নিয়ে আমার দু'পাশ থেকে পিছু হটে গেলেন। ইচ্ছাকৃত বা অন্য কোনো ত্রুটির জন্য নয়, নেহাতই ভুল বোঝাবুঝির জন্য। আমি মাত্র তিন-চারজন সৈন্য নিয়ে একটি গাছের আড়াল থেকে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করে যাচ্ছিলাম। এমন সময় সুবেদার সুলতান আমার পেছন থেকে এসে এই বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলার খবর দিল। আমি তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করলাম এবং পিছু হটতে অসম্মতি জানালাম। শেষ পর্যন্ত এক রকম জোর করেই সুবেদার সুলতান আমাকে পেছনে টেনে নিয়ে গেল। এ অবস্থায় লে. ইব্রাহিমও পেছনে হটে গেলেন।

এই উইথড্রলের পর ১ তারিখ সকাল ৮টা-৯টার দিকে বিমর্ষ ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও অন্যদের দেখলাম কর্নেল সফিউল্লাহ (পরে জেনারেল) ও মেজর মঈনের কাছে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন। এরপর আমরা নিজেদের সংগঠিত করে পুনরায় নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে গেলাম এবং বিকেল ৩টার মধ্যেই শত্রুদের এরপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হলাম।

এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে আমি ক্যাপ্টেন (বর্তমানে অব. জেনারেল) মতিনকে দেখলাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে। অসম সাহসিকতার সঙ্গে তিনি কেবল পূর্বদিকে ধেয়ে আসা পাকিস্তানিদের প্রতিহতই করেননি, উপরন্তু পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে আজমপুর স্টেশনের লাগোয়া উত্তরে অবস্থান নিলেন। তার সঙ্গে ছিল তিন নম্বর সেক্টরের মুজাহিদ মিশ্রিত দুই কোম্পানি সেনা। ওই যুদ্ধে লে. ইব্রাহিমের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। অগ্রসরমান পাকিস্তানি সেনাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে আমরা সন্ধ্যার মধ্যেই আজমপুর স্টেশনের উত্তর দিকটা মুক্ত করে ফেললাম। ব্রাভো কোম্পানি কমান্ডার লে. বদিউজ্জামানও তার অবস্থান থেকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বিকেলের পর আমাদের সম্মিলিত আক্রমণে আজমপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণ দিকের কিছু অংশও শত্রুমুক্ত হয়ে গেল। তবে ওই এলাকায় অসংখ্য মাইন পোঁতা থাকায় এবং পাকিস্তানিদের কয়েকটি কংক্রিট বাঙ্কার অক্ষত থাকায় আমরা এগোতে পারছিলাম না।

২ তারিখ ভোর থেকে আবার আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের সম্মুখীন হলাম। আকস্মিক আক্রমণে আজমপুর স্টেশনের দখলকৃত স্থানটুকুও তাদের হাতে চলে গেল।

রেলস্টেশনের দক্ষিণে পাকিস্তানিদের বাঙ্কারগুলোতে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল এবং আমাদের প্রাথমিক আক্রমণের পরেও তাদের কেউ কেউ সেখানে লুকিয়ে ছিল। যার ফলে ২ তারিখ রাতে প্রচণ্ড যুদ্ধের পরও আমরা ওই এলাকা কব্জা করতে পারলাম না। এর মধ্যে বিরামহীনভাবে চলছিল পাকিস্তানি আর্টিলারি গোলাবর্ষণ এবং দিনের বেলায় বিমান হামলা।

তিন তারিখ ও চার তারিখে যুদ্ধ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। পাকিস্তানি কামান ও বিমান হামলা ভারতীয় আর্টিলারির সহায়তাকে অনেকটা গৌণ করে তোলে। তবুও এর মধ্যে আমরা এক ইঞ্চিও পিছু হটিনি। বৃষ্টির মতো গোলাগুলি উপেক্ষা করে আমাদের সেনারা অসম্ভব মরিয়া হয়ে পাকিস্তানি বাঙ্কারগুলোর মধ্যে ঢুকে আক্রমণ চালায়। কোনো কোনো স্থানে যুদ্ধটা হাতাহাতি পর্যায়েও হয়েছিল। এতে ৪ ডিসেম্বর বেশ কিছু অসম সাহসী যোদ্ধা বিজয় ছিনিয়ে আনতে শাহাদত বরণ করেন। ওই দিন শহীদ হলেন ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার লে. বদিউজ্জামান।

এ সময়ই বেলোনিয়া অপারেশন থেকে ফিরে লে. সেলিম যোগ দিলেন ব্রাভো কোম্পানিতে। অসম সাহসিকতার সঙ্গে লড়লেন তিনি। এই স্থানের যুদ্ধটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভয়ঙ্করতম যুদ্ধগুলোর মতোই একটি। বীরত্বের শ্রেষ্ঠ ছবি হতে পারত এসব ঘটনাকে উপজীব্য করে। এরপর এটা সত্য যে, এ যুদ্ধে বীরত্বের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ভারতের সীমানা অতিক্রম করেননি এবং যুদ্ধে বাঁশ পাতার মতো কেঁপেছেন তিনিই হয়েছেন বীরবিক্রম। অন্যরা যথাযথভাবে নলখাগড়া বলে বিবেচিত হয়েছে। তারপরও মুক্ত দেশ ও বিজয়ের চেয়ে মূল্যবান আর কী হতে পারে!

এরপর সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ৯ তারিখে আশুগঞ্জের কাছে একটি ভয়াবহ যুদ্ধের সম্মুখীন হলাম। আমাদের ডানে দশ বিহার রেজিমেন্ট পাকিস্তানিদের সঙ্গে লড়ছে, আর এই ফাঁকে আমরা ডিঙি নিয়ে মেঘনা অতিক্রম করে ভৈরবে পেঁৗছলাম। ভৈরবে আবার দলছুট পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষ। সেখানে আমাদের বাহিনীর একটি অংশ পাকিস্তানিদের মোকাবেলা করে তাদের যখন ব্যস্ত ও পদানত করছে, তখন আমরা খণ্ড খণ্ড প্রতিরোধ ভেঙে মুড়াপাড়ায় পেঁৗছলাম। ডেমরা পেঁৗছলাম ১৩ ডিসেম্বর। ১৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বেঙ্গলের আলফা কোম্পানির এক পল্গাটুন সেনা নিয়ে আমি নিজে আক্রমণ চালাই বাড্ডা ও গুলশানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। তখন কাউলুন রেস্তোরাঁর কর্মী আনিস ও আরও দু'জন আমাদের গাইড হিসেবে কাজ করেছিল। ১৫ তারিখ রাতে আবার একই স্থানে আক্রমণ চালিয়ে আরও ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলাম। জেনারেল (তৎকালীন মেজর) মঈন নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে পেছনে ফিরিয়ে নিলেন। শেষ রাতে নিজের বাঙ্কারে খড়ের মাঝে গা এলিয়ে স্বপ্ন দেখলাম বিজয়ী বেশে দেশে ফিরছি। সত্যি সত্যি ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে হেঁটে মার্চ করে ঢাকায় প্রবেশ করলাম। ঢাকা স্টেডিয়ামে রাতে উড়িয়ে দিলাম বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.