নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দামাল ছেলে ৭১

দামাল ছেলে ৭১ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শান্তির দূত সু চির দেশে অশান্তির আগুন

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৫৩

রাখাইন রাজ্যের উত্তরাংশে দরিদ্র ও হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে। মিয়ানমারের পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর ছোড়া বুলেটে মারা যাচ্ছে ছেলে, বুড়ো, শিশু, নারীসহ অসংখ্য রোহিঙ্গা। একাত্তরের বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের মতো ধর্ষণ করছে নারীদের। সর্বস্ব খোয়ানো রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের দিকে। দুর্গম পাহাড়ি পথ বেয়ে হেঁটে বহু কষ্টে কোনো কোনো দল ঢুকছে বাংলাদেশে। দুর্দশা বাড়াতে মিয়ানমারের সীমান্তে বর্মি সেনারা স্থলমাইন পুঁতেছে, সেই মাইনের বিস্ফোরণে অনেক হতভাগ্য রোহিঙ্গা জীবন দিচ্ছে—অঙ্গহানি ঘটছে। এ কারণে অনেকে স্থলপথ বাদ দিয়ে নদী ও সমুদ্রপথে নৌকায় ঢোকার চেষ্টা করছে বাংলাদেশে। সেখানেও নতুন দুর্ভাগ্য এসে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে নাফ নদে এবং বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবি হয়েছে। একের পর এক লাশ ভেসে আসছে বাংলাদেশের উপকূলে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ ও সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

এই গণহত্যা বন্ধ এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে আর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া কথিত গণতন্ত্রের নেত্রী মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির কাছে মানবতা রক্ষার জন্য চিঠি পাঠাচ্ছেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। রাখাইন রাজ্যে এই মানবিক বিপর্যয়ের পর দীর্ঘদিন মৌনব্রত পালন করায় এরই মধ্যে বিশ্বের নানা প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম সমালোচনা করছে সু চির। শেষ পর্যন্ত মুখ খুলেছেন সু চি। আর অমন এক কঠিন বাস্তবতায় বিশ্ববিবেককে হতবাক করে দিয়েছেন এই নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়িনী। রাজনৈতিক কৌশল ব্যবহার করে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের নাগরিকদের রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। ’ রোহিঙ্গাদের তো নাগরিকত্ব দেওয়াই হয়নি। সুতরাং তাদের দায় কী! পরে সমালোচনার মুখে একটু সংশোধন করে বলেছেন, নাগরিক এবং বসবাসকারী অন্যদেরও...। এরপর এই নেত্রী মানবতার পক্ষে কী দায়িত্ব পালন করবেন, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছেন তিনি নিজেই। সম্প্রতি তাঁর এক মন্তব্য আলোড়ন তুলেছে। গত ৯ সেপ্টেম্বরের কালের কণ্ঠ এই মন্তব্যের আলোকে তাদের লিড নিউজের শিরোনাম করেছে ‘অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে সু চির মিথ্যাচার’।
এখানেই আমাদের দুর্ভাগ্য, ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও রাজনীতি এতটা অমানবিক, অসংস্কৃত আর নির্লজ্জ হয়ে পড়ছে যে এ থেকে বের হওয়ার পথ পাওয়া যাচ্ছে না। আমার এক ছাত্র, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নিবেদিতকর্মী, বর্তমান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলছিল। বলল, ‘স্যার, এই সংকটে আমাদের দেশে রাজনৈতিক দল-নির্বিশেষে সবার এক সুরে প্রতিবাদ করা উচিত। আমরা সরাসরি শরণার্থী সংকটে পড়েছি। বিশ্ববিবেককে নাড়া দিতে আমাদেরই দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে হবে। অথচ দেখুন, এই সময়েও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দল। নেতারা বক্তৃতা ও বিবৃতিতে কাজের কাজ না করে সরকারের ছিদ্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা কেন বুঝতে পারেন না, এই সংকটে এমন সব বস্তাপচা বক্তব্য মানুষ পছন্দ করছে না। হয়তো বুঝতে পারছেন; কিন্তু পরোয়া করছেন না। কারণ দেখছেন, তাঁদের বক্তব্য আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। তাঁরা বিএনপি নেতাদের অপ্রয়োজনীয় নিন্দা গায়ে মেখে নিরলস জবাব দিয়ে যাচ্ছেন। এমন সংকটের সময় এসব নিম্নমানের ঝগড়াঝাঁটি কি মানুষ পছন্দ করছে?’

এঁদের দোষ দিয়ে লাভ কী! সু চিও কি এর ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন? এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে, উপগ্রহ প্রযুক্তি এবং আকাশচিত্র গ্রহণের বিশ্বে তিনি যেন শামুকের খোলসের ভেতর থেকে সামরিক জান্তার সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, রোহিঙ্গারাই পালানোর সময় নিজেদের বাড়িঘর নিজেরা আগুনে পুড়িয়েছে। ওরা যে কেন পালাল, সে প্রশ্নের অবশ্য কোনো উত্তর দেননি।

আমি দুঃখিত! আবার প্রাসঙ্গিকতার কারণে বিএনপির কথা এসে গেল। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর খালেদা জিয়া দলের হাল ধরে একদিন বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণের পর এক তত্ত্ব নিয়ে এলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন মেজর জিয়া। ’ প্রথমে ভেবেছিলাম রেডিও-টেলিভিশনে যেমন ঘোষক ঘোষণা পাঠ করেন, তেমন ভাব প্রকাশ করতে চাচ্ছেন। পরে দেখলাম—না, পূর্ব বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘ রাজনীতি ও আন্দোলনের গতিধারায় কোনো ভূমিকা না থাকা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অনেক মেজরের মতো একজন অচেনা মেজর হঠাৎ ১৯৭১ সালে ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের মাত্র ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটারে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন, আর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল! খুবই হাস্যকর লাগছিল আমার। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে জানি, যখন মানুষ লিখনপদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেনি, সেই লাখো বছর আগের মানুষের ইতিহাস নানা তথ্য ও বস্তুসংস্কৃতি বিচার করে ইতিহাসবিদ রচনা করেন। আর এই আধুনিক সময়ে মানুষের হাতে তো তথ্যভাণ্ডারের অভাব নেই। ফলে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার সময় আসবে (ইতিহাসের শাসন মতে, দুই প্রজন্মের পর—অর্থাৎ ৫০ বছর পর) তখন এসব রাজনীতিক কিভাবে ইতিহাসের কাঠগড়ায় নিন্দিত হবেন, তা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

সু চির মিথ্যাচারের ধরনটিও অনেকটা বিএনপির মতোই। সব বাস্তব সত্য ও তথ্য সারা বিশ্বের হাতে থাকলেও সু চি কেমন করে বলতে পারছেন, রোহিঙ্গা নিপীড়ন মিথ্যাচার। নিপীড়নের ভুয়া ছবি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। ভাগ্য বিড়ম্বিত অসহায় দরিদ্র রোহিঙ্গাদের ঢালাওভাবে সন্ত্রাসী বলছেন। আর নিজেদের গ্রাম নিজেরা জ্বালানোর মতো এমন ভয়ংকর কৌতুকও তিনি করতে পারলেন অবলীলায়।

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে সু চির দর্শন আমাদের অবাক করবে না। সু চির বাবা গণতন্ত্রপন্থী খ্যাতিমান নেতা অং সানের রোহিঙ্গাবিরোধী নীতি কি ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে? রোহিঙ্গা সমস্যা অনেক পুরনো। সে প্রসঙ্গে এই পরিসরে আলোচনায় যাব না। তবে এটুকু না বললেই নয় যে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানকালে একটি সুযোগ এসেছিল এ সমস্যা সমাধানের। কিন্তু বার্মার জাতীয়তাবাদী নেতাদের স্বার্থবাদী, রক্ষণশীল ও নৃতাত্ত্বিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী মানসিকতার কারণে তা হয়নি। ব্রিটিশ শাসকরা তাঁদের উপনিবেশবাদী দর্শনের কারণে উপনিবেশ গুটিয়ে স্বদেশে ফেরার আগে সে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের অভিমত সঙ্গে নিয়ে ফয়সালা করে দিয়ে যান। যেমন ভারত-পাকিস্তান দুটি দেশের জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন। এই মধ্যস্থতা বার্মায়ও হয়েছিল। সু চির বাবা অং সান তখন বড় নেতা। ভবিষ্যতে বার্মা কিভাবে চলবে তার জন্য অং সান ও অন্য জাতীয়তাবাদী নেতারা ১৯৪৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে স্বাধীন ইউনিয়ন গঠন করেন। এখানে বার্মার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের ডাকা হলেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি আরাকানের রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের। এভাবে রোহিঙ্গাদের ইউনিয়নের বাইরে রাখা হয়। একুশ শতকে এসেও এই অমানবিক মানসিকতা থেকে সু চি বেরিয়ে আসতে পারেননি।

মিয়ানমারের সামরিক ও সু চির মতো বেসামরিক নেতাদের প্রচারণা আছে—রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাঙালি এবং তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী। এ কারণেই তাঁরা তাদের তাড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছেন। উচ্চশিক্ষিত রাজনীতিবিদ সু চির অভিবাসনের সংজ্ঞা জানা নেই, তা মানা যায় না। পর্তুগালে প্রতিবেশী অনেক স্প্যানিশ অভিবাসী আছে, যারা কালক্রমে পর্তুগালের নাগরিক। একইভাবে কর্ডোভা ও গ্রানাডায় বসবাসকারী এককালের মরক্কোবাসীর প্রজন্ম এখন স্পেনের নাগরিক। ঠিক তেমনি ইউরোপজুড়েই প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নাগরিকত্বের রূপান্তর স্বাভাবিক ঘটনা। শুধু ইউরোপ কেন, সারা পৃথিবীতেও তা-ই।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলার অনেক হিন্দু ভারতে চলে গিয়ে ভারতের নাগরিক হয়েছে, আবার ভারতের অনেক মুসলমান পূর্ব বাংলায় এসে প্রথমে পাকিস্তানের নাগরিক, এখন বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদের অভিবাসনের ইতিহাস তো আরো অনেক প্রাচীন। সাত-আটের শতকে আরব বণিকরা বার্মায় এসে বাণিজ্যের পাশাপাশি মুসলিম সমাজের পত্তন করেছিলেন। ষোলো শতকে বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগেও আরাকানে মুসলিম সমাজ সম্প্রসারিত হয়। সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে আরাকান রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত রোসাং রাজত্বের সঙ্গে বাংলার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। রোসাং রাজসভায় বাঙালি কবিদের কদর ছিল। দৌলত কাজী, আলাওল, মাগন ঠাকুর—এসব কবির কথা তো ইতিহাস স্মরণে রেখেছে। এসব সূত্রে অনেক বাঙালি আরাকানে স্থায়ী হয়। ফলে তাদের আধুনিক বার্মা ও সাম্প্রতিক মিয়ানমারের নাগরিকত্বের বাইরে থাকার তো কোনো কারণ নেই।

সু চির পূর্বপুরুষ কি মিয়ানমারে মঙ্গোলিয়া থেকে আসা অভিবাসী নন! অন্তত সু চি এবং এ সময়ের বার্মিজদের দৈহিক নৃতত্ত্ব তো তা-ই বলে। বাংলা-মিয়ানমার—এ অঞ্চলগুলোর আদি অধিবাসী নৃতত্ত্বের ভাষায় অস্ট্রিক বা অস্ট্রলয়েড; যাদের সঙ্গে অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের দেহবৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায়—মঙ্গোলীয় রক্তধারার সঙ্গে নয়। সুতরাং কোনো গোষ্ঠী একেবারেই একটি ভূখণ্ডের প্রকৃত মাটির সন্তান—এ বিতর্ক নিরর্থক।

মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী ও বর্ণবাদীদের দ্বারা বাংলাদেশের দিকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন নতুন ঘটনা নয়। এই বিতাড়ন শুরু হয় ১৭৮৪ থেকে। এরপর ধারাবাহিকভাবে কোনো একটি কারণ তৈরি করে বিতাড়ন করে ১৯৪২, ১৯৭৮, ১৯৯২ এবং সাম্প্রতিক সময়ে। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এর আগেই ছড়িয়ে পড়েছে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। এবারও তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। এরই মধ্যে দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে আমাদের ভূখণ্ডে। ফলে এর প্রতিক্রিয়ায় একটি বড় রকমের মানবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ সময় সংকীর্ণ রাজনৈতিক ঝগড়া থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলকে সম্পৃক্ত করতে হবে। মিয়ানমার যাদের বন্ধু বানাতে চায়, এই ইস্যুতে তাদেরও জাগিয়ে তুলতে হবে। বড় রকম আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া মিয়ানমারের নীতি পরিবর্তন করা সহজ হবে না। Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.