নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বদমেজাজী মন্দ লোক (www.meetmamun.com)

ডি মুন

এস এম মামুনুর রহমান - www.meetmamun.com

ডি মুন › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রিয় কবিতার ভেলাঃ জীবনানন্দ দাশ (সংগ্রহে রাখুন; এবং মাঝে মাঝে পড়ুন)

১৪ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৮



কখনো একটি কবিতাও পড়েননি এমন মানুষ আমাদের এই সংবেদনশীল মরমী দেশে পাওয়া যাবে না। এখানে কবিতা মানুষের হৃদয়ের কথা বলে। প্রকৃতির কথা বলে। বলে প্রেম-বিরহের চিরপুরাতন কথা নিত্যনতুন আঙ্গিকে। বলে জীবন সংগ্রামের কথা। যুদ্ধের অথবা শান্তির কথা। প্রতিবাদের কথা কিংবা সহনশীলতার কথা। বাঙালি জীবনের সব ক্ষেত্র, সব অনুভূতি, সব কল্পনা কবিতায় এসে বিচিত্রতা লাভ করে। জীবন পায়। নেচে ওঠে। আমাদের মনকে আন্দোলিত করে। তাই কবিতা হৃদয়বান মানুষের কাছে এক আরাধ্য ধন। একে বাদ দিয়ে থাকা যায় না। জীবনের কোনো না কোনো সময় আমাদেরকে কবিতার কাছে ফিরে আসতেই হয়।





বাংলা ভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ভাষা। আর এই মধুর ভাষার মধ্য দিয়ে আমাদের যেসব কবিরা তাদের মনের ভাবকে মধুরতরভাবে সঞ্চারিত করেছেন পাঠকের দৃষ্টির সীমানায়; তেমনই সব কবিদের কবিতা নিয়ে “প্রিয় কবিতার ভেলা’’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে পোস্ট দেওয়ার চেষ্টা থাকবে।



আমাদের আজকের কবি- রূপসী বাংলার কবি, মহত্তম কবি, নির্জনতার কবি, অচরিতার্থ প্রেমের কবি – জীবনানন্দ দাশ।





জীবনানন্দ দাশঃ সংক্ষিপ্ত জীবনীপঞ্জি



জন্মঃ ১৮৯৯ সাল(৬ই ফাল্গুন, ১৩০৫ সন); বরিশাল শহরে জন্ম। পিতাঃ সত্যানন্দ দাশ, মাতাঃ কুসুমকুমারী দাশ।



শিক্ষাঃ প্রথমে বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলে ও ব্রজমোহন কলেজে, পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে ১৯২১ সালে এম. এ. ।



বিবাহঃ ১৯৩০ সালে শ্রীমতী লাবণ্য গুপ্তকে বিবাহ করেন। দু’টি সন্তান। ১৯৩১ সালে কন্যা শ্রীমতী মঞ্জুশ্রী এবং ১৯৩৮ সালে পুত্র শ্রী সমরানন্দের জন্ম হয়।



কর্মঃ অধ্যাপনার কাজে কর্মজীবনের শুরু ও সমাপ্তি। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনায় নিযুক্ত ছিলেন। অধ্যাপনাঃ সিটি কলেজ, কলকাতা (১৯২২ - ২৮); রামযশ কলেজ, দিল্লী (১৯৩০ – ৩১); ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল (১৯৩৫ – ৪৮); খড়গপুর কলেজ (১৯৫১ -৫২); বাড়িষা কলেজ (১৯৫৩); হাওড়া গার্লস কলেজ (১৯৫৩ -৫৪)।



গ্রন্থঃ ঝরা পালক, ১৯২৮। ধূসর পাণ্ডুলিপি, ১৯৩৬। বনলতা সেন, ১৯৪২। মহাপৃথিবী, ১৯৪৪। সাতটি তারার তিমির, ১৯৪৮। জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ১৯৫৪। কবিতার কথা(প্রবন্ধ), ১৯৫৬। রূপসী বাংলা, ১৯৫৭। বেলা অবেলা কালবেলা, ১৯৬১। আলো পৃথিবী, ১৩৮৮ সন। জীবনানন্দ দাশের গল্প, ১৩৭৯সন। মাল্যবান,(উপন্যাস) ১৯৭৩।



মৃত্যুঃ ১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত এবং ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে মৃত্যু।





কাব্যগন্থঃ বনলতা সেন







বনলতা সেন



হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে

সিংহল সমুদ্র থেকে আরো দূর অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি। বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি। আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।



চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য। অতিদূর সমুদ্রের'পর

হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা,

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,

তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে। বলেছে সে "এতোদিন কোথায় ছিলেন?"

পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে চাওয়া নাটোরের বনলতা সেন।



সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে। ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।

পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।

সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী। ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন।

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।





অন্ধকার





গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছলচ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার ;

তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া

গুটিয়ে নিয়েছে যেন

কীর্তিনাশার দিকে।



ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম--পউষের রাতে--

কোনোদিন আর জাগবো না জেনে

কোনোদিন জাগবো না আমি --কোনোদিন জাগবো না আর--

হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,

তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও স্বপ্ন নও,

হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে,

রয়েছে যে অগাধ ঘুম

সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,

তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও--

জানো না কি চাঁদ,

নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,

জানো না কি নিশীথ,

আমি অনেক দিন--

অনেক অনেক দিন

অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে

হঠাৎ ভোরের আলোর মুর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব'লে

বুঝতে পেরেছি আবার,

ভয় পেয়েছি,

পেয়েছি অসীম দুনির্বার বেদনা;

দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে

মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য

আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;

আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়--বেদনায়--আক্রোশে ভরে গিয়েছে;

সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে

উৎসব শুরু করেছে।

হায়, উৎসব!

হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে

আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,

অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে

থাকতে চেয়েছি।

কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি।

হে নর, হে নারী,

তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;

আমি অন্য কোন নক্ষত্রের জীব নই!

যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গীত, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,

সেখানেই সূর্য , পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,

শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে,

শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর;

এইসব ভয়াবহ আরতি!

গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;

আমাকে কেন জাগাতে চাও?

হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া

আমাকে জাগাতে চাও কেন।

অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর ;

তাকিয়ে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে

অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে

কীর্তিনাশার দিকে ।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো--ধীরে--পউষের রাতে

কোনোদিন জাগাবো না জেনে--

কোনদিন জাগবো না আমি -- কোনদিন আর ।







কুড়ি বছর পরে





আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয়

আবার বছর কুড়ি পরে-

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে

কার্তিকের মাসে-

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী

নরম নরম শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে !



অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,

ব্যস্ততা নাই আর,

হাঁসের নীড়ের থেকে খড়

পাখির নীড় থেকে খড়

ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল !

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-

তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !

হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে

সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

শিরীষের অথবা জামের

ঝাউয়ের-আমেরঃ

কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !



জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার !

তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেচা নামে-

বাবলার গলির অন্ধকারে

অশথের জানালার ফাকে

কোথায় লুকায় আপনাকে !

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-

সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-

কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !





আমি যদি হতাম



আমি যদি হতাম বনহংস;

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে

ছিপছিপে শরের ভিতর

এক নিরালা নীড়ে;



তাহ’লে আজ এই ফাল্পুনের রাতে

ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে

আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে

আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-

তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-

নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,

শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে

সোনার ডিমের মতো

ফাল্গুনের চাঁদ।

হয়তো গুলির শব্দঃ

আমাদের তির্যক গতিস্রোত,

আমাদের পাখায় পিস্‌টনের উল্লাস,

আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!



হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ

আমাদের স্তব্ধতা,

আমাদের শান্তি।

আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:

থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;

আমি যদি বনহংস হতাম,

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে।







হায় চিল



হায় চিল, সোনালী ডানার চিল,এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !

তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে ।

পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে ;

আবার তাহারে কেন ডেকে আনো ? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে

বেদনা জাগাতে ভালোবাসে !

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !







মিতভাষণ



তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন।

মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে

ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো

আমাদের নিয়ে যায় ডেকে

শান্তির সঙ্ঘের দিকে — ধর্মে — নির্বাণে;

তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।



অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষ’য়ে অন্ধকারে

দেখেছি মণিকা-আলো হাতে নিয়ে তুমি

সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু

দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি:

যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে

তার স্নিগ্ধ মানতীসৌরভে।



মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;

বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা;

ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প-স্বপ্নের

উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা।

তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো;

এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।





অঘ্রাণ প্রান্তরে



‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর’ পরে-

বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে

শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;- অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;

সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে

হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার

মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার

ছড়িয়ে পড়েছে জলে; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে

হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে-কুয়াশার প্রান্তরের পথে

দু-একটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে

লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;

আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন লেগে আছে বহতা পাখায়

ঐ সব পাখিদের ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়োমাখা ক্লান্ত জামের শাখায়;

নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতো নীরবতা

ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরে বুকে আজ …… হেঁটে চলি….. আজ কোনো কথা

নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল

পড়ে আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শড়ির ভিতরে,

সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেঁধে গিয়ে নড়ে-চড়ে;

পতঙ্গ পালক্‌ জল-চারি দিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ;

আলোয়ার মতো ওই ধানগুলো নড়ে শূন্যে কী রকম অবাধ আকাশ

হয়ে যায়; সময়ও অপার-তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা

ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন;-কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা

সরিয়ে মেয়েটি তাঁর আঁচলের চোরাকাঁটা বেছে

প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে সরে গেছে

যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে-তাই-ই ঠিক;-ওখানে সিগ্ধ হয় সব।

অপ্রেমে বা প্রেমে নয়- নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব।





কমলালেবু



একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব

আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?

আবার যেন ফিরে আসি

কোনো এক শীতের রাতে

একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে

কোমো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।





সুচেতনা



সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ

বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;

সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে

নির্জনতা আছে।

এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা

সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।

কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;

তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।



আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রের ঘুরে প্রাণ

পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো

ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,

দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত

ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে;

পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।



কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে

দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;

সেই শস্য অগণণ মানুষের শব;

শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়

আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরও প্রাণ

মূক করে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।



সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে — এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;

সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ:

এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;–

প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ

আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে

গড়ে দেব আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।



মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,

না এলেই ভালো হত অনুভব করে;

এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি

শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;

দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়–

শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।





নগ্ন নির্জন হাত



আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :

আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।

যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে

অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি,

সেই নারীর মতো

ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে।

মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা

সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।

ভারতসমুদ্রের তীরে

কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে

অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে

আজ নেই, কোন এক নগরী ছিল একদিন,

কোন এক প্রাসাদ ছিল;

মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ;

পারস্য গালিচা, কাশ্মিরি শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,

আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা;

আর তুমি নারী -

এই সব ছিল সেই জগতে একদিন।

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল,

অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল,

মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিল অনেক;

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল;

অনেক কমলা রঙের রোদ;

আর তুমি ছিলে;

তোমার মুখের্ রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না,

খুঁজি না।

ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,

অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,

লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,

অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পান্ডুলিপি,

রামধনু রঙের কাচের জানালা,

ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়

কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের

ক্ষণিক আভাস -

আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।

পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,

রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!

তোমার নগ্ন নির্জন হাত;

তোমার নগ্ন নির্জন হাত।





পথহাঁটা



কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে

অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;

তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:



সারারাত গ্যাস লাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে।

কেউ ভুল করে নাকো-ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাঁদ সব

চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে।



একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;

তখন অনেক রাত-তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা

নির্জনে ঘিরেছে এসে;-মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব



আর কিছু দেখেছি কি: একরাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা?

চোখ নিচে নেমে যায়-চূরুট নীরবে জ্বলে-বাতাসে অনেক ধূলো খড়;

চোখ বুজে একপাশে সরে যাই-গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা



উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর

কেন যেন; আজো আমি জানি নাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।







কাব্যগ্রন্থঃ ধূসর পাণ্ডুলিপি





মেঠো চাঁদ



মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে

আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে

পোড়ো জমি- খড়- নাড়া- মাঠের ফাটল,

শিশিরের জল।

মেঠো চাঁদ- কাস্তের মত বাঁকা, চোখা-

চেয়ে আছে; এমনি সে তাকায়েছে কতো রাত- নাই লেখা-জোখা।

মেঠো চাঁদ বলেঃ

'আকাশের তলে

খেতে-খেতে লাঙ্গলের ধার

মুছে গেছে- ফসল- কাটার

সময় আসিয়া গেছে, চ'লে গেছে কবে!

শস্য ফলিয়া গেছে- তুমি কেন তবে

রয়েছো দাঁড়ায়ে

একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে

নড়-নাড়া- পোড়া জমি- মাঠের ফাটল,

শিশিরের জল!'......

আমি তারে বলিঃ

'ফসল গিয়াছে ঢের ফলি,

শস্য গিয়েছে ঝ'রে কতো-

বড়ো হ'য়ে গেছো তুমি এই বুড়ী পৃথিবীর মতো!

খেতে-খেতে লাঙ্গলের ধার

মুছে গেছে কতোবার- কতোবার ফসল-কাটার

সময় আসিয়া গেছে, চ'লে গেছে কবে!

শস্য ফলিয়া গেছে- তুমি কেন তবে

রয়েছো দাঁড়ায়ে

একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে

পোড়ো জমি- খড়-নাড়া-মাঠের ফাটল,

শিশিরের জল!'







জীবন







চারি দিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর —

নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান!

ফসল উঠিছে ফলে — রসে রসে ভরিছে শিকড়;

লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ।

সে কোন প্রথম ভোরে পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান

অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে জীবনের বেগে!

আমার দেহের গন্ধ পাই তার শরীরের ঘ্রাণ —

সিন্ধুর ফেনার গন্ধ আমার শরীরে আছে লেগে!

পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে — তার সাথে সেও আছে জেগে!







নক্ষত্রের আলো জ্বেলে পরিস্কার আকাশের পর

কখন এসেছে রাত্রি! — পশ্চিমের সাগরের জলে

তার শব্দ; উত্তর সমুদ্র তার, দক্ষিণ সাগর

তাহার পায়ের শব্দে — তাহার পায়ের কোলাহলে

ভরে ওঠে; এসেছে সে আকাশের নক্ষত্রের তলে

প্রথম যে এসেছিল, তারই মতো — তাহার মতন

চোখ তার, তাহার মতন চুল, বুকের আঁচলে

প্রথম মেয়ের মতো — পৃথিবীর নদী মঠ বন

আবার পেয়েছে তারে — সমুদ্রের পারে রাত্রি এসেছে এখন!







সে এসেছে — আকাশের শেষ আলো পশ্চিমের মেঘে

সন্ধ্যার গহ্বর খুঁজে পালায়েছে! — রক্তে রক্তে লাল

হয়ে গেছে বুক তার আহত চিতার মতো বেগে

পালায়ে গিয়েছে রোদ — সরে গেছে আলোর বৈকাল!

চলে গেছে জীবনের আজ এক — আর এক কাল

আসিত না যদি আর আলো লয়ে — রৌদ্র সঙ্গে লয়ে!

এই রাত্রি নক্ষত্র সমুদ্র লয়ে এমন বিশাল

আকাশের বুক থেকে পড়িত না যদি আর ক্ষ’য়ে

রয়ে যেত — যে গান শুনি নি আর তাহার স্মৃতির মতো হয়ে!







যে পাতা সবুজ ছিল, তবুও হলুদ হতে হয় —

শীতের হাড়ের হাত আজও তারে যায় নাই ছুঁয়ে —

যে মুখ যুবার ছিল, তবু যার হয়ে যায় ক্ষয়,

হেমন্ত রাতের আগে ঝরে যায় — পড়ে যায় নুয়ে —

পৃথিবীর এই ব্যথা বিহ্বলতা অন্ধকারে ধুয়ে

পূর্ব সাগরের ঢেউয়ে জলে জলে, পশ্চিম সাগরে

তোমার বিনুনি খুলে — হেঁট হয়ে — পা তোমার থুয়ে —

তোমার নক্ষত্র জ্বেলে — তোমার জলের স্বরে স্বরে

রয়ে যেতে যদি তুমি আকাশের নিচে — নীল পৃথিবীর ‘পরে!







ভোরের সূর্যের আলো পৃথিবীর গুহায় যেমন

মেঘের মতন চুল — অন্ধকার চোখের আস্বাদ

একবার পেতে চায় — যে জন রয় না — যেই জন

চলে যায়, তারে পেতে আমাদের বুজে যেই সাধ —

যে ভালোবেসেছে শুধু, হয়ে গেছে হৃদয় অবাধ

বাতাসের মতো যার — তাহার বুকের গান শুনে

মনে যেই ইচ্ছা জাগে — কোনোদিন দেখে নাই চাঁদ

যেই রাত্রি — নেমে আসে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রেরে শুনে

যেই রাত্রি, আমি তার চোখে চোখ, চুলে তার চুল নেব বুনে!







তুমি রয়ে যাবে তবু, অপেক্ষায় রয় না সময়

কোনোদিন; কোনোদিন রবে না সে পথ থেকে স’রে!

সকলেই পথ চলে — সকলেই ক্লান্ত তবু হয় —

তবুও দুজন কই বসে থাকে হাতে হাত ধরে!

তবুও দুজন কই কে কাহারে রাখে কোলে করে!

মুখে রক্ত ওঠে — তবু কমে কই বুকের সাহস!

যেতে হবে — কে এসে চুলের ঝুটি টেনে লয় জোরে!

শরীরের আগে কবে ঝরে যায় হৃদয়ের রস!

তবু, চলে — মৃত্যুর ঠোঁটের মতো দেহ যায় হয় নি অবশ!







হলদে পাতার মতো আমাদের পথে ওড়াউড়ি! —

কবরের থেকে শুধু আকাঙক্ষার ভূত লয়ে খেলা!

আমরাও ছায়া হয়ে ভূত হয়ে করি ঘোরাঘুরি!

মনের নদীর পার নেমে আসে তাই সন্ধ্যাবেলা

সন্ধ্যার অনেক আগে! — দুপুরেই হয়েছি একেলা!

আমরাও চরি — ফিরি কবরের ভূতের মতন!

বিকালবেলার আগে ভেঙে গেছে বিকালের মেলা —

শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন!

হেমন্ত আসে নি মাঠে — হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন!







শীত রাত ঢের দূরে — অস্থি তবু কেঁপে ওঠে শীতে!

শাদা হাতুদুটো শাদা হাড় হয়ে মৃত্যুর খবর

একবার মনে আনে — চোখ বুজে তবু কি ভুলিতে

পারি এই দিনগুলো! — আমাদের রক্তের ভিতর

বরফের মতো শীত — আগুনের মতো তবু জ্বর!

যেই গতি — সেই শক্তি পৃথিবীর অন্তরে পঞ্জরে —

সবুজ ফলায়ে যায় পৃথিবীর বুকের উপর —

তেমনি স্ফুলিঙ্গ এক আমাদের বুকে কাজ করে!

শস্যের কীটের আগে আমাদের হৃদয়ের শস্য তবু মরে!







যতদিন রয়ে যাই এই শক্তি রয়ে যায় সাথে —

বিকালের দিকে যেই ঝড় আসে তাহার মতন!

যে ফসল নষ্ট হবে তারই ক্ষেত উড়াতে ফুরাতে

আমাদের বুকে এসে এই শক্তি করে আয়োজন!

নতুন বীজের গন্ধে ভরে দেয় আমাদের মন

এই শক্তি — একদিন হয়তো বা ফলিবে ফসল! —

এরই জোরে একদিন হয়তো বা হৃদয়ের বন

আহ্লাদে ফেলিবে ভরে অলক্ষিত আকাশের তল!

দুরন্ত চিতার মতো গতি তার — বিদ্যুতের মতো সে চঞ্চল!





১০

অঙ্গারের মতো তেজ কাজ করে অন্তরের তলে —

যখন আকাঙক্ষা এক বাতাসের মতো বয়ে আসে,

এই শক্তি আগুনের মতো তার জিভ তুলে জ্বলে!

ভস্মের মতন তাই হয়ে যায় হৃদয় ফ্যাকাশে!

জীবন ধোঁয়ার মতো, জীবন ছায়ার মতো ভাসে;

যে অঙ্গার জ্বলে জ্বলে নিভে যাবে, হয়ে যাবে ছাই —

সাপের মতন বিষ লয়ে সেই আগুনের ফাঁসে

জীবন পুড়িয়া যায় — আমরাও ঝরে পুড়ে যাই!

আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলিবার মতো শক্তি — তবু শক্তি চাই।





১১

জানো তুমি? শিখেছ কি আমাদের ব্যর্থতার কথা? —

হে ক্ষমতা, বুকে তুমি কাজ কর তোমার মতন! —

তুমি আছ — রবে তুমি — এর বেশি কোনো নিশ্চয়তা

তুমি এসে দিয়েছ কি? — ওগো মন, মানুষের মন —

হে ক্ষমতা, বিদ্যুতের মতো তুমি সুন্দর — ভীষণ!

মেঘের ঘোড়ার পরে আকাশের শিকারীর মতো —

সিন্ধুর সাপের মতো লক্ষ ঢেউয়ে তোল আলোড়ন!

চমৎকৃত কর — শরীরের তুমি করেছ আহত! —

যতই জেগেছ — দেহ আমাদের ছিঁড়ে যেতে চেয়েছে যে তত!





১২

তবু তুমি শীত রাতে আড়ষ্ট সাপের মতো শুয়ে

হৃদয়ের অন্ধকারে পড়ে থাক — কুন্ডলী পাকায়ে! —

অপেক্ষায় বসে থাকি — স্ফুলিঙ্গের মতো যাবে ছুঁয়ে

কে তোমারে! — ব্যাধের পায়ের পাড়া দিয়ে যাবে গায়ে

কে তোমারে! কোন অশ্রু, কোন্‌ পীড়া হতাশার ঘায়ে

কখন জাগিয়া ওঠো — স্থির হয়ে বসে আছি তাই।

শীত রাত বাড়ে আরো — নক্ষত্রেরা যেতেছে হারায়ে —

ছাইয়ে যে আগুন ছিল সেই সবও হয়ে যায় ছাই!

তবুও আরেকবার সব ভস্মে অন্তরের আগুন ধরাই।





১৩

অশান্ত হাওয়ার বুকে তবু আমি বনের মতন

জীবনেরে ছেড়ে দিছি! — পাতা আর পল্লবের মতো

জীবন উঠেছে বেজে শব্দে — স্বরে; যতবার মন

ছিঁড়ে গেছে, হয়েছে দেহের মতো হৃদয় আহত

যতবার — উড়ে গেছে শাখা, পাতা পড়ে গেছে যত —

পৃথিবীর বন হয়ে — ঝড়ের গতির মতো হয়ে,

বিদ্যুতের মতো হয়ে আকাশের মেঘে ইতস্তত;

একবার মৃত্যু লয়ে — একবার জীবনের লয়ে

ঘূর্ণির মতন বয়ে যে বাতাসে ছেঁড়ে — তার মতো গেছি বয়ে!





১৪

কোথায় রয়েছে আলো আঁধারের বীণার আস্বাদ!

ছিন্ন রুগ্ন ঘুমন্তের চোখে এক সুস্থ স্বপ্ন হয়ে

জীবন দিয়েছে দেখা — আকাশের মতন অবাধ

পরিচ্ছন্ন পৃথিবীতে, সিন্ধুর হাওয়ার মতো বয়ে

জীবন দিয়েছে দেখা — জেগে উঠে সেই ইচ্ছা লয়ে

আড়ষ্ট তারার মতো চমকায়ে গেছি শীতে — মেঘে!

ঘুমায়ে যা দেখি নাই, জেগে উঠে তার ব্যথা সয়ে

নির্জন হতেছে ঢেউ হৃদয়ের রক্তের আবেগে!

— যে আলো নিভিয়া গেছে তাহার ধোঁয়ার মতো প্রাণ আছে জেগে।





১৫

নক্ষত্র জেনেছে কবে অই অর্থ মৃঙ্খলার ভাষা!

বীণার তারের মতো উঠিতেছে বাজিয়া আকাশে

তাদের গতির ছন্দ — অবিরত শক্তির পিপাসা

তাহাদের, তবু সব তৃপ্ত হয়ে পূর্ণ হয়ে আসে!

আমাদের কাল চলে ইশারায় — আভাসে আভাসে!

আরম্ভ হয় না কিছু — সমস্তের তবু শেষ হয় —

কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে

তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়!

যা হয়েছে শেষ হয় শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয়!





১৬

সমস্ত পৃথিবীর ভরে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস

দোলা দিয়ে গেল কবে! বাসি পাতা ভুতের মতন

উড়ে আসে! — কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস —

যক্ষ্মার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন! —

জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ!

মরণ — সে ভালো এই অন্ধকার সমুদ্রের পাশে!

বাঁচিয়া থাকিতে যারা হিঁচড়ায় — করে প্রাণপণ —

এই নক্ষত্রের তলে একবার তারা যদি আসে —

রাত্রিরে দেখিয়া যায় একবার সমুদ্রের পারের আকাশে! —





১৭

মৃত্যুরেও তবে তারা হয়তো ফেলিবে বেসে ভালো!

সব সাধ জেনেছে যে সেও চায় এই নিশ্চয়তা!

সকল মাটির গন্ধ আর সব নক্ষত্রের আলো

যে পেয়েছে — সকল মানুষ আর দেবতার কথা

যে জেনেছে — আর এক ক্ষুধা তবু — এক বিহ্বলতা

তাহারও জানিতে হয়! এইমতো অন্ধকারে এসে! —

জেগে জেগে যা জেনেছ — জেনেছ তা — জেগে জেনেছ তা —

নতুন জানিবে কিছু হয়তো বা ঘুমের চোখে সে!

সব ভালোবাসা যার বোঝা হল — দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে!





১৮

কিংবা এই জীবনের একবার ভালোবেসে দেখি!

পৃথিবীর পথে নয় — এইখানে — এইখানে বসে —

মানুষ চেয়েছে কিবা? পেয়েছে কি? কিছু পেয়েছে কি!

হয়তো পায় নি কিছু — যা পেয়েছে, তাও গেছে খসে

অবহেলা করে করে কিংবা তার নক্ষত্রের দোষে —

ধ্যানের সময় আসে তারপর — স্বপ্নের সময়!

শরীর ছিঁড়িয়া গেছে — হৃদয় পড়িয়া গেছে ধসে!

অন্ধকার কথা কয় — আকাশের তারা কথা কয়

তারপর, সব গতি থেমে যায় — মুছে যায় শক্তির বিস্ময়!





১৯

কেউ আর ডাকিবে না — এইখানে এই নিশ্চয়তা!

তোমার দু — চোখ কেউ দেখে থাকে যদি পৃথিবীতে

কেউ যদি শুনে থাকে কবে তুমি কী কয়েছ কথা,

তোমার সহিত কেউ থেকে থাকে যদি সেই শীতে —

সেই পৃথিবীর শীতে — আসিবে কি তোমারে চিনিতে

এইখানে সে আবার! — উঠানে পাতার ভিড়ে বসে,

কিংবা ঘরে হয়তো দেয়ালে আলো জ্বেলে দিতে দিতে —

যখন হঠাৎ নিভে যাবে তার হাতের আলো সে —

অসুস্থ পাতার মতো দুলে তার মন থেকে পড়ে যাব খসে!





২০

কিংবা কেউ কোনোদিন দেখে নাই — চেনে নি আমারে!

সকালবেলার আলো ছিল যার সন্ধ্যার মতন —

চকিত ভূতের মতো নদী আর পাহাড়ের ধারে

ইশারায় ভূত ডেকে জীবনের সব আয়োজন

আরম্ভ সে করেছিল! কোনোদিন কোনো লোকজন

তার কাছে আসে নাই — আকাঙক্ষার কবরের পরে

পুবের হাওয়ার মতো এসেছে সে হঠাৎ কখন! —

বীজ বুনে গেছে চাষা — সে বাতাস বীজ নষ্ট করে!

ঘুমের চোখের পরে নেমে আসে অশ্রু আর অনিদ্রার স্বরে!





২১

যেমন বৃষ্টির পরে ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ এসে

আবার আকাশ ঢাকে — মাঠে মাঠে অধীর বাতাস

ফোঁপায় শিশুর মতো — একবার চাঁদ ওঠে ভেসে

দূরে — কাছে দেখা যায় পৃথিবীর ধান ক্ষেত ঘাস,

আবার সন্ধ্যার রঙে ভরে ওঠে সকল আকাশ —

মড়ার চোখের রঙে সকল পৃথিবী থাকে ভরে!

যে মরে যেতেছে তার হৃদয়ের সব শেষ শ্বাস

সকল আকাশ আর পৃথিবীর থেকে পড়ে ঝ’রে!

জীবনে চলেছি আমি সে পৃথিবী আকাশের পথ ধরে ধরে!





২২

রাত্রির ফুলের মতো — ঘুমন্তের হৃদয়ের মতো

অন্তর ঘুমায়ে গেছে — ঘুমায়েছে মৃত্যুর মতন!

সারাদিন বুকে ক্ষুধা লয়ে চিতা হয়েছে আহত —

তারপর, অন্ধকার গুহা এই ছায়াভরা বন

পেয়েছে সে! অশান্ত হাওয়ার মতো মানুষের মন

বুজে গেছে — রাত্রি আর নক্ষত্রের মাঝখানে এসে!

মৃত্যুর শান্তির স্বাদ এই খানে দিতেছে জীবন

জীবনের এইখানে একবার দেখি ভালোবেসে!

শুনে দেখি — কোন্‌ কথা কয় রাত্রি, কোন্‌ কথা নক্ষত্র বলে সে!





২৩

পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভরে —

শস্য ফলে গেছে মাঠে — কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা;

নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ করে

নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা

মৃত্যুর মতন তার জীবনের বেদনার ভাষা —

আবার জানায়ে যায়! কবরের ভূতের মতন

পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা — হতাশা —

বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!

মড়ার — কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!





২৪

হলুদ পাতার মতো — আলোয়ার বাষ্পের মতন,

ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেড়া মেঘ আকাশের ধারে,

আলোর মাছির মতো — রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন

একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে —

ঢেউ ভেঙে ঝরে যায় — মরে যায় — কে ফেরাতে পারে!

তবুও ইশারা করে ফাল্গুন রাতের গন্ধে বয়ে

মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আঁধারে

জীবন ডাকিতে আসে — হয় নাই — গিয়েছে যা হয়ে,

মৃত্যুরেও ডাক তুমি সেই ব্যথা — আকাঙক্ষার অস্থিরতা লয়ে!





২৫

মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো — প্রিয়ার মতন!

চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ;

রোগীর জরের মতো পৃথিবীর পথের জীবন;

অসুস্থ চোখের পরে অনিদ্রার মতন অসুখ;

তাই আমি প্রিয়তম প্রিয়া বলে জড়ায়েছি বুক —

ছায়ার মতন আমি হয়েছি তোমার পাশে গিয়া!

যে — ধূপ নিভিয়া যায় তার ধোঁয়া আঁধারে মিশুক —

যে ধোঁয়া মিলায়ে যায় তারে তুমি বুকে তুলে নিয়া

ঘুমানো গন্ধের মতো স্বপ্ন হয়ে তার ঠোটে চুমো দিয়ো, প্রিয়া!





২৬

মৃত্যুকে ডেকেছি আমি প্রিয়ের অনেক নাম ধরে।

যে বালক কোনোদিন জানে নাই গহ্বরের ভয়,

পুবের হাওয়ার মতো ভূত হয়ে মন তার ঘোরে! —

নদীর ধারে সে ভূত একদিন দেখেছে নিশ্চয়!

পায়ের তলের পাতা — পাপড়ির মতো মনে হয়

জীবনেরে খসে ক্ষয়ে গিয়েছে যে, তাহার মতন

জীবন পড়িয়া থাকে — তার বিছানায় খেদ — ক্ষয় —

পাহাড় নদীর পারে হাওয়া হয়ে ভূত হয়ে মন

চকিত পাতার শব্দে বাতাসের বুকে তারে করে অম্বেষণ।





২৭

জীবন, আমার চোখে মুখ তুমি দেখেছ তোমার —

একটি পাতার মতো অন্ধকারে পাতা — ঝরা — গাছে —

একটি বোঁটার মতো যে ফুল ঝরিয়া গেছে তার —

একাকী তারার মতো, সব তারা আকাশের কাছে

যখন মুছিয়া গেছে — পৃথিবীতে আলো আসিয়াছে —

যে ভালোবেসেছে, তার হৃদয়ের ব্যথার মতন —

কাল যাহা থাকিবে না — আজই যাহা স্মৃতি হয়ে আছে —

দিন রাত্রি — আমাদের পৃথিবীর জীবন তেমন!

সন্ধ্যার মেঘের মতো মুহুর্তের রঙ লয়ে মুহুর্তে নূতন!





২৮

আশঙ্কা ইচ্ছার পিছে বিদ্যুতের মতো কেঁপে ওঠে!

বীণার তারের মতো কেঁপে কেঁপে ছিঁড়ে যায় প্রাণ!

অসংখ্য পাতার মতো লুটে তারা পথে পথে ছোটে —

যখন ঝড়ের মতো জীবনের এসেছে আহ্বান!

অধীর ঢেউয়ের মতো — অশান্ত হাওয়ার মতো গান

কোন্‌দিকে ভেসে যায়! — উড়ে যায় কয় কোন্‌ কথা! —

ভোরের আলোয় আজ শিশিরের বুকে যেই ঘ্রাণ,

রহিবে না কাল তার কোনো স্বাদ — কোনো নিশ্চয়তা!

পান্ডুর পাতার রঙ গালে, তবু রক্তে তার রবে অসুস্থতা!





২৯

যেখানে আসে নি চাষা কোনোদিন কাস্তে হাতে লয়ে,

জীবনের বীজ কেউ বোনে নাই যেইখানে এসে,

নিরাশার মতো ফেঁপে চোখ বুজে পলাতক হয়ে

প্রেমের মৃত্যুর চোখে সেইখানে দেখিয়াছি শেষে!

তোমার চোখের পরে তাহার মুখেরে ভালোবেসে

এখানে এসেছি আমি — আর একবার কেঁপে উঠে

অনেক ইচ্ছার বেগে — শান্তির মতন অবশেষে

সব ঢেউ ভেঙে নিয়ে ফেনার ফুলের মতো ফুটে,

ঘুমাব বালির পরে — জীবনের দিকে আর যাব নাকো ছুটে!





৩০

নির্জন রাত্রির মতো শিশিরের গুহার ভিতরে —

পৃথিবীর ভিতরের গহ্বরের মতন নিঃসাড়

রব আমি — অনেক গতির পর — আকাঙক্ষার পরে

যেমন থামিতে হয়, বুজে যেতে হয় একবার —

পৃথিবীর পারে থেকে কবরের মৃত্যুর ওপার

যেমন নিস্তব্ধ শান্ত নিমীলিত শূন্য মনে হয় —

তেমন আস্বাদ এক কিংবা সেই স্বাদহীনতার

সাথে একবার হবে মুখোমুখি সব পরিচয়!

শীতের নদীর বুকের মৃত জোনাকির মুখ তবু সব নয়!





৩১

আবার পিপাসা সব ভূত হয়ে পৃথিবীর মাঠে —

অথবা গ্রহের পরে — ছায়া হয়ে, ভূত হয়ে ভাসে! —

যেমন শীতের রাতে দেখা যায় জোছনা ধোঁয়াটে,

ফ্যাকাশে পাতার পরে দাঁড়ায়েছে উঠানের ঘাসে —

যেমন হঠাৎ দুটো কালো পাখা চাঁদের আকাশে

অনেক গভীর রাতে চমকের মতো মনে হয়;

কার পাখা? — কোন্‌ পাখি? পাখি সে কি! অথচ সে আসে! —

তখন অনেক রাতে কবরের মুখ কথা কয়!

ঘুমন্ত তখন ঘুমে, জাগিতে হতেছে যার সে জাগিয়া রয়!





৩২

বনের পাতার মতো কুয়াশায় হলুদ না হতে

হেমন্ত আসার আগে হিম হয়ে পড়ে গেছি ঝরে! —

তোমার বুকের পরে মুখ আমি চেয়েছি লুকোতে;

তোমার দুইটি চোখ প্রিয়ার চোখের মতো করে

দেখিতে চেয়েছি, মৃত্যু পথ থেকে ঢের দুরে সরে

প্রেমের মতন হয়ে! — তুমি হবে শান্তির মতন!

তারপর সরে যাব — তারপর তুমি যাবে মরে —

অধীর বাতাস লয়ে কাঁপুক না পৃথিবীর বন! —

মৃত্যুর মতন তবু বুজে যাক — ঘুমাক মৃত্যুর মতো মন।





৩৩

নির্জন পাতার মতো আলেয়ার বাষ্পের মতন,

ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেড়া মেঘে আকাশের ধারে,

আলোর মাছির মতো — রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন

একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে —

ঢেউ ভেঙে ঝরে যায় — মরে যায় — কে ফেরাতে পারে!

তবুও ইশারা ক’রে ফাল্গুনরাতের গন্ধে বয়ে

মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আঁধারে

জীবন ডাকিতে আসে — হয় নাই — গিয়েছে যা হয়ে —

মৃত্যুরেও ডাক তুমি সেই স্মৃতি — আকাঙক্ষার অস্থিরতা লয়ে!





৩৪

পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাসাতে গেছে ভ’রে —

শস্য ফলে গেছে মাঠে — কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা;

নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ করে

নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা —

মৃত্যুর মতন তার জীবনের বেদনার ভাষা —

আবার জানায়ে যায় — কবরের ভূতের মতন

পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা — হতাশা —

বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন!

মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন!





মৃত্যুর আগে



আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,

দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল

কুয়াশার কবেকার পাড়াগার মেয়েদের মতো যেন হায়

তারা সব আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল

জোনাকিতে ভরে, গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে

চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;



আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীতরাত্রিটিরে ভালো,

খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধ রাতে ডানার সঞ্চার;

পুরোনা পেঁচার ঘ্রাণ — অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!

বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ — মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার

গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে ডালে ডাকিয়াছে বক;

আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;



আমরা দেখেছি যারা বুনো হাঁস শিকারীর গুলির আঘাত

এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জোছনার ভিতরে,

আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের পরে হাত,

সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;

শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ

আমরা পেয়েছি যারা ঘুরে — ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস;



দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ

হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,

ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,

চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু — বেলা

নির্জন মাছের চোখে — পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে

পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ — মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;



মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,

বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে,

নমর জলের গন্ধ দিয়ে নদী বারবার তীরটিরে মাখে,

খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জোছনার উঠানে পড়িয়াছে;

বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ — বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;

নীলাভ নোনার বুকে ঘর রস গাঢ় আকাঙক্ষায় নেমে আসে;



আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল

পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে;

যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;

পথে পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর পরে

আমরা দেখেছি যারা শুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ,

প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ;



আমরা বুঝেছি যারা বহু দিন মাস ঋতু শেষ হলে পর

পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা

কয়ে গেছে আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর

আরো এক আলো আছে: দেহে তার বিকাল বেলার ধুসরতা:

চোখের — দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির;

পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;



আমরা মৃত্যুর আগে কী বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,

সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে

ধূসর মৃত্যুর মুখ — একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল — সোনা ছিল যাহা

নিরুত্তর শান্তি পায় — যেন কোন্‌ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।

কী বুঝিতে চাই আর? রৌদ্র নিভে গেলে পাখিপাখলির ডাক

শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখি নি কি উড়ে গেছে কাক।





বোধ



আলো — অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে

স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!

স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়,

হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!

আমি তারে পারি না এড়াতে

সে আমার হাত রাখে হাতে;

সব কাছ তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়,

সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়

শূন্য মনে হয়,

শূন্য মনে হয়!



সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!

কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে

সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা

কে বলিতে পারে আর! — কোন নিশ্চয়তা

কে জানিতে পারে আর? — শরীরের স্বাদ

কে বুঝিতে চায় আর? — প্রাণের আহ্লাদ

সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!

সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর

স্বাদ কই! — ফসলের আকাঙ্খায় থেকে,

শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,

শরীরে জলের গন্ধ মেখে,

উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে

চাষার মতন প্রাণ পেয়ে

কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর পরে?

স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়,কোন এক বোধ কাজ করে

মাথার ভিতরে।



পথ চলে পারে — পারাপারে

উপেক্ষা করিতে চাই তারে:

মড়ার খুলির মতো ধরে

আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে

তবু সে মাথার চারি পাশে!

তবু সে চোখের চারি পাশে!

তবু সে বুকের চারি পাশে!

আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে!



আমি থামি —

সেও থেমে যায়;



সকল লোকের মাঝে বসে

আমার নিজের মুদ্রাদোষে

আমি একা হতেছি আলাদা?

আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আমার পথেই শুধু বাধা?

জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে

সন্তানের মতো হয়ে —

সন্তানের জন্ম দিতে দিতে

যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়

কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়

যাহাদের ; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে

জন্ম দেবে — জন্ম দেবে বলে;

তাদের হৃদয় আর মাথার মতন

আমার হৃদয় না কি? — তাহাদের মন

আমার মনের মতো না কি?

–তবু কেন এমন একাকী?

তবু আমি এমন একাকী!



হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল?

বালতিতে টানি নি কি জল?

কাস্তে হাতে কতবার যাই নি কি মাঠে?

মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে

ঘুরিয়াছি;

পুকুরের পানা শ্যালা — আঁশটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে

গিয়েছে জড়ায়ে;

–এই সব স্বাদ

–এ সব পেয়েছি আমি — বাতাসের মতন অবাধ

বয়েছে জীবন,

নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন

একদিন;

এই সব সাধ

জানিয়াছি একদিন — অবাধ — অগাধ;

চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে —

ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,

অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,

ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;



আমার সে ভালোবাসিয়াছে,

আসিয়াছে কাছে,

উপেক্ষা সে করেছে আমারে,

ঘৃণা করে চলে গেছে — যখন ডেকেছি বারেবারে

ভালোবেসে তারে;

তবুও সাধনা ছিল একদিন — এই ভালোবাসা;

আমি তার উপেক্ষার ভাষা

আমি তার ঘৃণার আক্রোশ

অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র — নক্ষত্রের দোষ

আমার প্রেমের পথে বারবার দিয়ে গেছে বাধা

আমি তা ভুলিয়া গেছি;

তবু এই ভালোবাসা — ধুলো আর কাদা।



মাথার ভিতরে

স্বপ্ন নয় — প্রেম নয় — কোনো এক বোধ কাজ করে।

আমি সব দেবতারে ছেড়ে

আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,

বলি আমি এই হৃদয়েরে;

সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?

অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?

কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ

পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ

মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!

মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!

শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!



এই বোধ — শুধু এই স্বাদ

পায় সে কি অগাধ — অগাধ!

পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ

চায় না সে? করেছে শপথ

দেখিবে সে মানুষের মুখ?

দেখিবে সে মানুষীর মুখ?

দেখিবে সে শিশুদের মুখ?

চোখে কালোশিরার অসুখ,

কানে যেই বধিরতা আছে,

যেই কুঁজ — গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে

নষ্ট শসা — পঁচা চালকুমড়ার ছাঁচে,

যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে

— সেই সব।





নির্জন স্বাক্ষর



তুমি তা জানো না কিছু, -- না জানিলে,

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;

যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে--

পথের পাতার মতন তুমিও তখন

আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে?

অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন

সেদিন তোমার!

তোমার এ জীবনের ধার

ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?

আমার বুকের 'পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,

তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;

শুধু তার স্বাদ

তোমারে কি শান্তি দেবে?

আমি ঝরে যাবো-- তবু জীবন অগাধ

তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর 'পরে,

--আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক'রে!



রয়েছি সবুজ মাঠে – ঘাসে -

আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে -আকাশে।

জীবনের রঙ তবু ফলানো কি হয়

এই সব ছুঁয়ে ছেনে’; সে এক বিস্ময়

পৃথিবীতে নাই তাহা- আকাশেও নাই তার স্থল,

চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল!

রাতে রাতে হেঁটে হেঁটে নক্ষত্রের সনে

তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষের মনে

কোনো এক মানুষের তরে

যে জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে--

নক্ষত্রের চেয়ে আরো এক নিঃশব্দ আসনে

কোনো এক মানুষের তরে কোনো এক মানুষের মনে।



একবার কথা কয়ে দেশ আর দিকের দেবতা

বোবা হয়ে পড়ে থাকে -ভুলে যায় কথা;

যে-আগুন উঠেছিল তাদের চোখের তলে জ্ব’লে

নিভে যায়-ডুবে যায়- তারা যায় স্খ’লে।

নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে – চ’লে আসে নতুন সময় --

পুরনো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয়

নতুনেরা আসিতেছে ব’লে;

আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ'লে

কোন এক মানুষীর তরে

যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে।

আমি সেই পুরোহিত--সেই পুরোহিত

যে নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত

লাগিতেছে- আমার শরীরে--

যেই তারা জেগে আছে,তার দিকে ফিরে

তুমি আছ জেগে--

যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে

জেগে আছো,

জানিয়াছ তুমি এক নিশ্চয়তা--হয়েছ নিশ্চয়।

হয়ে যায় আকাশের তলে কত আলো-আগুনের ক্ষয়;

কতবার বর্তমান হয়ে গেছে ব্যথিত অতীত -

তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত।

যে নক্ষত্র ঝ’রে যায় তার।

যে পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস-আকাশ তোমার

জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছ- তবুও মৃত্যুর ব্যাথা দিতে

পার তুমি;

তোমার আকাশ তুমি উষ্ণ হয়ে আছোঁ- তবু-

বাহিরের আকাশের শীতে--

নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়

নক্ষত্রের মতন হৃদয়

পড়িতেছে ঝ'রে--

ক্লান্ত হয়ে- শিশিরের মতো শব্দ ক’রে।

জানো নাকো তুমি তার স্বাদ--

তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ,

জীবন অগাধ।



হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন,

পথের পাতার মতন তুমিও তখন

আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন

সেদিন তোমার!

তোমার আকাশ- আলো - জীবনের ধার

ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?

আমার বুকের 'পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল

তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ

তোমারে কি শান্তি দেবে।

আমি চলে যাবো-- তবু জীবন অগাধ

তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর 'পরে;

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক'রে।





অবসরের গান





০১.

শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে

অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে

মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার — চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,

তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,

দেহের স্বাদের কথা কয় –

বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়!

চারি দিকে এখন সকাল –

রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল!

মাঠের ঘাসের পরে শৈশবের ঘ্রাণ –

পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান!



চারি দিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,

তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!

প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে

পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!

শরীর এলায়ে আসে এই খানে ফলন্ত ধানের মতো করে

যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধ’রে

আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর,

চারি দিকে ছায়া — রোদ — ক্ষুদ — কুঁড়া — কার্তিকের ভিড়:

চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এই খানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,

পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপাশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ!

আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই — নুয়ে আছে নদীর এপারে

বিয়োবার দেরি না — রূপ ঝরে পড়ে তার –

শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে!



আজও তবুও ফুরায় নি বৎসরের নতুন বয়স,

মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ, ভাড়ারের রস!



মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়

সকালবেলা রৌদ্রে; কুঁড়েমির আজিকে সময়।



গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন্‌ ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া!

তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া;

ভুলে গিয়ে রাজ্য — জয় — সাম্রাজ্যের কথা

অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা;

ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব –

মাঠের নিস্তেজ রোদের নাচ হবে –

শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।



হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে

কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;

ফলন্ত ধানের গন্ধে — রঙে তার — স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের সকলের দেহ;

রাগ কেহ করিবে না — আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।

আমাদের অবসর বেশি নয — ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়

আমাদের সকলের আগে শেষ হয়

দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ — অবসাদ –

আমাদের ডেকে লয় — তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা — অবসন্ন হাত।



তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে — রোদ গেছে পড়ে,

এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধরে;

তখন গিয়েছে থেমে অই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড়

হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির

বিছানার পর;

মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর!

তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল,

চলে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের দল!



০২.

পুরনো পেঁচারা সব কোটারের থেকে

এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে

মাঠের মুখের পরে

সবুজ ধানের নিচে — মাটির ভিতরে

ইঁদুরেরা চলে গেছে — আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা;

শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা!



ফলন্ত মঠের’ পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান,

প্রেম আর পিপাসার গান

আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন!

ফসল — ধানের ফলে যাহাদের মন

ভরে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা করে গেছে –

পৃথিবীর সব সিংহাসন –

আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড় –

যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড়

মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নীচে পৃথিবীর তলে

কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে

ফুরায় নি তাদের সময়;

পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তারা করে নাই ভয়!

প্রণয়ীর মতো তারা ছেড়ে নি হৃদয়

ছড়া বেঁধে শহরের মেয়েদের নামে!

চাষাদের মতো তারা ক্লান্ত হয়ে কপালের ঘামে

কাটায় নি — কাটায় কি কাল।

অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল

কোনো এক সম্রাটের সাথে

মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে!

যোদ্ধা — জয়ী — বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে –

পাশাপাশি –

জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি!



অনেক রাতের আগে এসে তারা চলে গেছে — তাদের দিনের আলো

হয়েছে আঁধার,

সেই সব গেঁয়ো কবি — পাড়াগাঁর ভাঁড়

আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর?

তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল;

অনেক দিনের গন্ধে ভরা ঐ ইদুরের জানে তাহা — জানে তাহ

নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল!

সে সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে

তাহাদের নাম ধরে যায় ডেকে ডেকে।

মাটির নিচের থেকে তারা

মৃতের মাথার স্বপ্নে নড়ে উঠে জানায় কী অদ্ভুত ইশারা!



আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে –

আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে।

সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে, পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে

শহর — বন্দর — বস্তি — কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে

আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে;

শরীরের অবসাদ — হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে।



শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভিজা পথ ধরে

আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই মরে

দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন;

অগাধ ধানের রসে আমাদের মন

আমরা ভরিতে চাই গেয়ো কবি — পাড়াগার ভাঁড়ের মতন!



– জমি উপড়ায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা

নতুন লাঙল তার পড়ে আছে — পুরনো পিপাসা

জেগে আছে মাঠের উপরে;

সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা অই আমাদের তরে!

হেমন্তের ধান ওঠে ফলে –

দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে।

আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ

অবসর আছে তার — অবোধের মতন আহ্লাদ

আমাদের শেষ হবে যখন সে চলে যাবে পশ্চিমের পানে –

এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে!



০৩.

ফুরোনো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার;

পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নাই — কোনো কৃষকের মতো দরকার নাই

দূরে মাঠে গিয়ে আর!

রোধ — অবরোধ — ক্লেশ — কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময় –

জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে

কোথায় নতুন করে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়!

আমার চোখের পাশে আনিয়ো না সৈন্যদের মশালের আগুনের রঙ

দামামা থামায়ে ফেল — পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক

রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ!



এখানে নাহিকো কাজ — উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকো ভাবনা;

এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা।

অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়,

পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়!

সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে

গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে,

এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন –

জেগে থেকে ঘুমবার সাধ ভালোবেসে।



এখানে চকিত হতে হবে নাকো — ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়;

উদ্যমের ব্যথা নাই — এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়!

এই খানে কাজ এসে জমে নাকো হাতে,

মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে!

এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর –

রাখিবে না চোখ আর নয়নের পর;

ভালোবাসা আসিবে না –

জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর!



অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়

পৃথিবীর মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়;

সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে,

গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে,

এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার

সাধ ভালোবেসে!





ক্যাম্পে



এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;

সারারাত দখিনা বাতাসে

আকাশের চাঁদের আলোয়

এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি –

কাহারে সে ডাকে!



কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,

আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,

এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে

ঘুম আর আসে নাকো

বসন্তের রাতে।



চারি পাশে বনের বিস্ময়,

চৈত্রের বাতাস,

জোছনার শরীরের স্বাদ যেন্‌!

ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে;

কোথাও অনেক বনে — যেইখানে জোছনা আর নাই

পুরুষহিরণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;

তাহারা পেতেছে টের

আসিতেছে তার দিকে।

আজ এই বিস্ময়ের রাতে

তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;

তাহাদের হৃদয়ের বোন

বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে

জোছনায় –

পিপাসার সন্ত্বনায় — অঘ্রাণে — আস্বাদে!

কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন!

মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই,

সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু;

কেবন পিপাসা আছে,

রোমহর্ষ আছে।



মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়!

লালসা — আকাঙক্ষা — সাধ — প্রেম স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে

আজ এই বসন্তের রাতে;

এই খানে আমার নক্‌টার্ন –|



একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,

সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে

দাঁতের — নখের কথা ভূলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই

সুন্দরী গাছের নীচে — জোছনায়!

মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে

হরিণেরা আসিতেছে।



– তাদের পেতেছি আমি টের

অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়,

ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জোছনায়।

ঘুমাতে পারি না আর;

শুয়ে শুয়ে থেকে

বন্দুকের শব্দ শুনি;

চাঁদের আলোয় ঘাইহরিণি আবার ডাকে;

এইখানে পড়ে থেকে একা একা

আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জমে ওঠে

বন্দুকের শব্দ শুনে শুনে

হরিণীর ডাক শুনে শুনে।



কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া;

সকালে — আলোয় তারে দেখা যাবে –

পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা পড়ে আছে।

মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তারে এই সব।



আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাব,

মাংস খাওয়া হল তবু শেষ?

কেন শেষ হবে?

কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে

তাদের মতন নই আমিও কি?

কোনো এক বসন্তের রাতে

জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে

আমারেও ডাকে নি কি কেউ এসে জোছনায় — দখিনা বাতাসে

অই ঘাইহরিণীর মতো?



আমার হৃদয় — এক পুরুষহরিণ –

পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে

চিতার চোখের ভয় — চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে

তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?

আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো

যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে

এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিল নাকি

জীবনের বিস্ময়ের রাতে

কোনো এক বসন্তের রাতে?



তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে!

মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমারও পড়ে থাকি;

বিয়োগের — বিয়োগের — মরণের মুখে এসে পড়ে সব

ঐ মৃত মৃগদের মতো –

প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা মৃত্যু পাই;

পাই না কি?

দোনলার শব্দ শুনি।

ঘাইমৃগী ডেকে যায়,

আমার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো

একা একা শুয়ে থেকে;

বন্দুকের শব্দ তবু চুপে চুপে ভুলে যেতে হয়।

ক্যম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে;

যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়

হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে

তাহারাও তোমার মতন –

ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদের ও হৃদয়

কথা ভেবে — কথা ভেবে — ভেবে।



এই ব্যথা এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে –

কোথাও ফড়িঙে — কীটে, মানুষের বুকের ভিতরে,

আমাদের সবের জীবনে।

বসন্তের জোছনায় অই মৃত মৃগদের মতো

আমরা সবাই।







কয়েকটি লাইন



কেউ যাহা জানে নাই কোনো এক বাণী –

আমি বহে আনি;

একদিন শুনেছ যে সুর –

ফুরায়েছে পুরনো তা — কোনো এক নতুন কিছুর

আছে প্রয়োজন,

তাই আমি আসিয়াছি, আমার মতন

আর নাই কেউ!

সৃষ্টির সিন্ধুর বুকে আমি এক ঢেউ

আজিকার: শেষ মুহুর্তের

আমি এক — সকলের পায়ের শব্দের

সুর গেছে অন্ধকারে থেমে;

তারপর আসিয়াছি নেমে

আমি;

আমার পায়ের শব্দ শোনো –

নতুন এ, আর সব হারানো — পুরনো।

উৎসবের কথা আমি কহি নাকো,

পড়ি নাকো দুর্দশার গান,

কে কবির প্রাণ

উৎসাহে উঠেছে শুধু ভরে –

সেই কবি — সেও যাবে সরে;

যে কবি পেয়েছে শুধু যন্ত্রণার বিষ

শুধু জেনেছে বিষাদ,

মাটির আর রক্তের কর্কশ স্বাদ,

যে বুঝেছে, প্রলাপের ঘোরে

যে বকেছে — সেও যাবে সরে;

একে একে সবই

ডুবে যাবে — উৎসবের কবি,

তবু বলিতে কি পারো

যাতনা পাবে না কেউ আরো?

যেইদিন তুমি যাবে চ’লে

পৃথিবী গাবে কি গান তোমার বইয়ের পাতা খুলে?

কিংবা যদি গায় — পৃথিবী যাবে কি তবু ভুলে

একদিন যেই ব্যথা ছিল সত্য তার?

আনন্দের আবর্তনে আজিকে আবার

সেদিনের পুরানো আঘাত

ভুলিবে সে? ব্যথা যারা সয়ে গেছে রাত্রি — দিন

তাহাদের আর্ত ডান হাত

ঘুম ভেঙে জানাবে নিষেধ;

সব ক্লেশ আনন্দের ভেদ

ভুল মনে হবে;

সৃষ্টির বুকের পরে ব্যথা লেগে রবে,

শয়তানের সুন্দর কপালে

পাপের ছাপের মতো সেইদিনও! –

মাঝরাতে মোম যারা জ্বালে,

রোগা পায়ে করে পায়চারি,

দেয়ালে যাদের ছায়া পড়ে সারি সারি

সৃষ্টির দেয়ালে –

আহ্লাদ কি পায় নাই তারা কোনোকালে?

যেই উড়ো উৎসাহের উৎসবের রব

ভেসে আসে — তাই শুনে জাগে নি উৎসব?

তবে কেন বিহ্বলের গান

গায় তারা! — বলে কেন, আমাদের প্রাণ

পথের আহত

মাছিদের মতো!



উৎসবের কথা আমি কহি নাকো,

পড়ি নাকো ব্যর্থতার গান;

শুনি শুধু সৃষ্টির আহ্বান –

তাই আসি,

নানা কাজ তার

আমরা মিটায়ে যাই –

জাগিবার কাল আছে — দরকার আছে ঘুমাবার;

এই সচ্ছলতা

আমাদের;আকাশ কহিছে কোন্‌ কথা

নক্ষত্রের কানে?

আনন্দের? দুর্দশার? পড়ি নাকো। সৃষ্টির আহ্বানে

আসিয়াছি।

সময়সিন্ধুর মতো:

তুমিও আমার মতো সমুদ্রের পানে, জানি, রয়েছ তাকায়ে,

ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে গায়ে

ঘুম ভেঙে যায় বার বার

তোমার — আমার!

জানি না তো কোন্‌ কথা কও তুমি ফেনার কাপড়ে বুক ঢেকে,

ওপারের থেকে;

সমুদ্রের কানে

কোন্‌ কথা কই আমি এই পারে — সে কি কিছু জানে?

আমিও তোমার মতো রাতের সিন্ধুর দিকে রয়েছি তাকায়ে,

ঢেউয়ের হোঁচট লাগে গায়ে

ঘুম ভেঙে যায় বার বার

তোমার আমার!



কোথাও রয়েছ, জানি, তোমারে তবুও আমি ফেলেছি হারায়ে;

পথ চলি — ঢেউ ভেজে পায়ে;

রাতের বাতাস ভেসে আসে,

আকাশে আকাশে

নক্ষত্রের পরে

এই হাওয়া যেন হা হা করে!

হু হু করে ওঠে অন্ধকার!

কোন্‌ রাত্রি — আঁধারের পার

আজ সে খুঁজিছে!

কত রাত ঝরে গেছে — নিচে — তারও নিচে

কোন্‌ রাত — কোন্‌ অন্ধকার

একবার এসেছিল — আসিবে না আর।

তুমি এই রাতের বাতাস,

বাতাসের সিন্ধু — ঢেউ,

তোমার মতন কেউ

নাই আর!

অন্ধকার — নিঃসাড়তার

মাঝখানে

তুমি আনো প্রাণে

সমুদ্রের ভাষা

রুধিবে পিপাসা

যেতেছে জাগায়ে

ছেঁড়া দেহে — ব্যথিত মনের ঘায়ে

ঝরিতেছ জলের মতন –

রাতের বাতাস তুমি — বাতাসে সিন্ধু — ঢেউ,

তোমার মতন কেউ

নাই আর!



গান গায়, যেখানে সাগর তার জলের উল্লাসে,

সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে,

যেখানে সমস্ত রাত ভ’রে,

নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে

যেই খানে,

পৃথিবীর কানে

শস্য গায় গান,

সোনার মতন ধান

ফ’লে ওঠে যেইখানে –

একদিন — হয়তো — কে জানে

তুমি আর আমি

ঠান্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপে থামি

সেইখানে বর পড়ে!

যেখানে সমস্ত রাত্রি রক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে,

সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে,

গান গায় সিন্ধু তার জলের উল্লাসে।



ঘুমাতে চাও কি তুমি?

অন্ধকারে ঘুমাতে কি চাই? –

ঢেউয়ের গানের শব্দ

সেখানে ফেনার গন্ধ নাই?

কেহ নাই — আঙুলের হাতের পরশ

সেইখানে নাই আর –

রূপ যেই স্বপ্ন আনে, স্বপ্নে বুকে জাগায় যে রস

সেইখানে নাই তাহা কিছু;

ঢেউয়ের গানের শব্দ

যেখানে ফেনার গন্ধ নাই –

ঘুমাতে চাও কি তুমি?

সেই অন্ধকারে আমি ঘুমাতে কি চাই!

তোমারে পাব কি আমি কোনোদিন? — নক্ষত্রের তলে

অনেক চলার পথ — সমুদ্রের জলে

গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর — বাজে –

ফুরাবে এ — সব, তবু…. তুমি যেই কাজে

ব্যস্ত আজ — ফুরাবে না জানি;

একদিন তবু তুমি তোমার আঁচলকানি

টেনে লবে; যেটুকু করার ছিল সেইদিন হয়ে গেছে শেষ,

আমার এ সমুদ্রের দেশ

হয়তো হয়েছে স্তব্ধ সেইদিন, — আমার এ নক্ষেত্রের রাত

হয়তো সরিয়া গেছে — তবু তুমি আসিবে হঠাৎ

গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর সমুদ্রের জলে,

অনেক চলার পথ নক্ষত্রের তলে!



আমার নিকট থেকে

তোমারে নিয়েছে কেটে কখন সময়!

চাঁদ জেগে রয়

তারা ভরা আকাশের তলে,

জীবন সবুজ হয়ে ফলে,

শিশিরের শব্দে গান গায়

অন্ধকার, আবেগ জানায়

রাতের বাতাস!

মাটি ধুলো কাজ করে — মাঠে মাঠে ঘাস

নিবিড় — গভীর হয়ে ফলে!

তারা ভরা আকাশের তলে

চাঁদ তার আকাঙ্খার স্থল খুঁজে লয় –

আমার নিকট থেকে তোমারে নিয়েছে কেটে যদিও সময়।

একদিন দিয়েছিলে যেই ভালোবাসা,

ভুলে গেছ আজ তার ভাষা!

জানি আমি, তাই

আমিও ভুলিয়া যেতে চাই

একদিন পেয়েছি যে ভালোবাসা

তার স্মৃতি আর তার ভাষা;

পৃথিবীতে যত ক্লান্তি আছে,

একবার কাছে এসে আসিতে চায় না আর কাছে

যে — মুহুর্তে;

একবার হয়ে গেছে, তাই যাহা গিয়েছে ফুরায়ে

একবার হেঁটেছে যে, তাই যার পায়ে

চলিবার শক্তি আর নাই;

সব চেয়ে শীত, তৃপ্ত তাই।

কেন আমি গান গাই?

কেন এই ভাষা

বলি আমি! এমন পিপাসা

বার বার কেন জাগে!

পড়ে আছে যতটা সময়

এমনি তো হয়।





পরস্পর



মনে পড়ে গেল এক রূপকথা ঢের আগেকার,

কহিলাম, শোনো তবে —

শুনিতে লাগিল সবে,

শুনিল কুমার;

কহিলাম, দেখেছি সে চোখ বুজে আছে,

ঘুমানো সে এক মেয়ে — নিঃসাড় পুরীতে এক পাহাড়ের কাছে:

সেইখানে আর নাই কেহ —

এক ঘরে পালঙ্কের ‘পরে শুধু একখানা দেহ

পড়ে আছে — পৃথিবীর পথে পথে রূপ খুঁজে খুঁজে

তারপর — তারে আমি দেখেছি গো — সেও চোখ বুজে

পড়ে ছিল — মসৃণ হাড়ের মতো শাদা হাতদুটি

বুকের উপরে তার রয়েছিল উঠি!

আসিবে না গতি যেন কোনোদিন তাহার দু — পায়ে,

পাথরের মতো শাদা গায়ে

এর যেন কোনোদিন ছিল না হৃদয় —

কিংবা ছিল — আমার জন্য তা নয়!

আমি গিয়ে তাই তারে পারি নি জাগাতে,

পাষাণের মতো হাত পাষাণের হাতে

রয়েছে আড়ষ্ট হয়ে লেগে;

তবুও, হয়তো তবু উঠিবে সে জেগে

তুমি যদি হাত দুটি ধরো গিয়ে তার!

ফুরালাম রূপকথা, শুনিল কুমার।

তারপর, কহিল কুমার,

আমিও দেখেছি তারে — বসন্তসেনার

মতো সেইজন নয়, কিংবা হবে তাই —

ঘুমন্ত দেশের সেও বসন্তসেনাই!



মনে পড়ে,শোনো,মনে পড়ে

নবমী ঝরিয়া গেছে নদীর শিয়রে —

(পদ্ম — ভাগীরথী — মেঘনা — কোন্‌ নদী যে সে –

সে সব জানি কি আমি! — হয়তো বা তোমাদের দেশ

সেই নদী আজ আর নাই,

আমি তবু তার পারে আজও তো দাড়াই!)

সেদিন তারার আলো — আর নিবু-নিবু জোছনায়

পথ দেখে, যেইখানে নদী ভেসে যায়

কান দিয়ে তার শব্দ শুনে,

দাড়ায়েছিলাম গিয়ে মাঘরাতে, কিংবা ফাল্গুনে।

দেশ ছেড়ে শীত যায় চলে

সে সময়, প্রথম দখিনে এসে পড়িতেছে বলে

রাতারাতি ঘুম ফেঁসে যায়,

আমারও চোখের ঘুম খসেছিল হায় —

বসন্তের দেশে

জীবনের — যৌবনের! — আমি জেগে, ঘুমন্ত শুয়ে সে!

জমানো ফেনার মতো দেখা গেল তারে

নদীর কিনারে!

হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতন

শুয়ে আছে — শুয়ে আছে — শাদা হাতে ধব্‌ধবে স্তন

রেখেছে সে ঢেকে!

বাকিটুকু — থাক্‌ — আহা, একজনে দেখে শুধু — দেখে না অনেকে

এই ছবি!

দিনের আলোয় তার মুছে যায় সবই! —

আজও তবু খুঁজি

কোথায় ঘুমন্ত তুমি চোখ আছ বুজি!

কুমারের শেষ হলে পরে —

আর — এক দেশের এক রূপকথা বলিল আর — একজন,

কহিল সে উত্তর — সাগরে

আর নাই কেউ! —

জোছনা আর সাগরের ঢেউ

উচুনিচু পাথরের পরে

হাতে হাত ধরে

সেইখানে; কখন জেগেছে তারা — তারপর ঘুমাল কখন!

ফেনার মতন তারা ঠান্ডা — শাদা

আর তারা ঢেউয়ের মতন

জড়ায়ে জড়ায়ে যায় সাগরের জলে!

ঢেউয়ের মতন তারা ঢলে।

সেই জলমেয়েদের স্তন

ঠান্ডা, শাদা, বরফের কুঁচির মতন!

তাহাদের মুখ চোখ ভিজে,

ফেনার শেমিজে

তাহাদের শরীর পিছল!

কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল

চাঁদের বুকের থেকে ঝরে

উত্তর সাগরে!

পায়ে — চলা পথ ছেড়ে ভাসে তারা সাগরের গায়ে —

কাঁকরের রক্ত কই তাহাদের পায়ে!

রূপার মতন চুল তাহাদের ঝিক্‌মিক্‌ করে

উত্তর সাগরে

বরফের কুঁচির মতন

সেই জলমেয়েদের স্তন

মুখ বুক ভিজে

ফেনার শেমিজে

শরীর পিছল!

কাচের গুড়ির মতো শিশিরের জল

চাদের বুকের থেকে ঝরে

উত্তর সাগরে!

উত্তর সাগরে!



সবাই থামিলে পরে মনে হল — এক দিন আমি যাব চলে

কল্পনার গল্প সব বলে;

তারপর, শীত — হেমন্তের শেষে বসন্তের দিন

আবার তো এসে যাবে;

এক কবি — তন্ময়, শৌখিন,

আবার তো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে!

আমরা সাধিয়া গেছি যার কথা — পরীর মতন এক ঘুমোনো মেয়ে সে

হীরের ছুরির

মতো গায়ে

আরো ধার লবে সে শানায়ে!

সেইদিনও তার কাছে হয়তো রবে না আর কেউ —

মেঘের মতন চুল — তার সে চুলের ঢেউ

এমনি পড়িয়া রবে পাল্‌ঙ্েকর পর —

ধূপের ধোঁয়ার মতো ধলা সেই পুরীর ভিতর।

চার পাশে তার

রাজ — যুবরাজ — জেতা — যোদ্ধাদের হাড়

গড়েছে পাহাড়!

এ রূপকার এই রূপসীর ছবি

তুমি দেখিবে এসে,

তুমিও দেখিবে এসে কবি!

পাথরের হাতে তার রাখিবে তো হাত —

শরীরে ননীর ছবি ছুয়ে দেখো চোখা ছুরি — ধারালো হাতির দাঁত!

হাড়েরই কাঠামো শুধু — তার মাঝে কোনোদিন হৃদয় মমতা

ছিল কই! — তবু, সে কি জেগে যাবে? কবে সে কি কথা

তোমার রক্তের তাপ পেয়ে? —

আমার কথায় এই মেয়ে, এই মেয়ে!

কে যেন উঠিল ব’লে, তোমরা তো বলো রূপকথা —

তেপান্তরে গল্প সব, ওর কিছু আছে নিশ্চয়তা!

হয়তো অমনি হবে, দেখি নিকো তাহা;

কিন্তু, শোনো — স্বপ্ন নয় — আমাদেরই দেশে কবে, আহা! —

যেখানে মায়াবী নাই — জাদু নাই কোনো —

এ দেশের — গাল নয়, গল্প নয়, দু — একটা শাদা কথা শোনো!

সেও এক রোদে লাল দিন,

রোদে লাল — সবজির গানে গানে সহজ স্বাধীন

একদিন, সেই একদিন!

ঘুম ভেঙে গিয়েছিল চোখে,

ছেড়া করবীর মতো মেঘের আলোকে

চেয়ে দেখি রূপসী কে পড়ে আছে খাটের উপরে!

মায়াবীর ঘরে

ঘুমন্ত কন্যার কথা শুনেছি অনেক আমি, দেখিলাম তবু চেয়ে চেয়ে

এ ঘুমোনো মেয়ে

পৃথিবীর মানুষের দেশের মতন;

রূপ ঝরে যায় — তবু করে যারা সৌন্দর্যের মিছা আয়োজন —

যে যৌবন ছিড়ে ফেঁড়ে যায়,

যারা ভয় পায়

আয়নায় তার ছবি দেখে! —

শরীরের ঘুণ রাখে ঢেকে

ব্যর্থতা লুকায়ে রাখে বুকে,

দিন যায় যাহাদের অসাধে, অসুখে! —

দেখিতেছিলাম সেই সুন্দরীর মুখ,

চোখে ঠোঁটে অসুবিধা — ভিতরে অসুখ!

কে যেন নিতেছে তারে খেয়ে! —

এ ঘুমোনো মেয়ে

পৃথিবীর ফোপরার মতো করে এরে লয়ে শুষে

দেবতা গর্ন্ধব নাগ পশু মানুষ!..

সবাই উঠিল বলে — ঠিক — ঠিক — ঠিক!

আবার বলিল সেই সৌন্দর্য তান্ত্রিক,

আমায় বলেছে সে কী শোনো —

আর একজন এই —

পরী নয়, মানুষও সে হয় নি এখনও;

বলেছে সে, কাল সাঁঝরাতে

আবার তোমার সাথে

দেখা হবে? — আসিবে তো? — তুমি আসিবে তো!

দেখা যদি পেত!

নিকটে বসায়ে

কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে —

কী কথা বলিতে গিয়ে থেমে যেত শেষে

ফিক্‌ করে হেসে!

তবু আরো কথা

বলিতে আসিতে — তবু, সব প্রগল্‌ভতা

থেকে যেত!

খোঁপা বেঁধে, ফের খোঁপা ফেলিত খসায়ে —

সরে যেত, দেয়ালের গায়ে

রহিত দাঁড়ায়ে!

রাত ঢের — বাড়িবে আরো কি

এই রাত! — বেড়ে যায়, তবু, চোখোচোখি

হয় নাই দেখা

আমাদের দুজনার! দুইজন, একা! —

বারবার চোখ তবু কেন ওর ভরে আসে জলে!

কেন বা এমন করে বলে,

কাল সাঁঝরাতে

আমার তোমার সাথে

দেখা হবে? — আসিবে তো? তুমি আসিবে তো! —

আমি না কাঁদিতে কাঁদে.. দেখা যদি পেত!..

দেখা দিয়ে বলিলাম, কে গো তুমি? — বলিল সে তোমার বকুল,

মনে আছে? — এগুলো কী? বাসি চাঁপাফুল?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে’, — ভালোবাসো?’ — হাসি পেল — হাসি!

ফুলগুলো বাসি নয়, আমি শুধু বাসি!’

আচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ফেলে

নিবানো মাটির বাতি জ্বেলে

চলে এল কাছে —

জটার মতন খোঁপা অন্ধকারে খসিয়া গিয়াছে —

আজও এত চুল!

চেয়ে দেখি — দুটো হাত, ক — খানা আঙুল

একবার চুপে তুলে ধরি;

চোখদুটো চুন — চুন — মুখ খড়ি — খড়ি!

থুত্‌নিতে হাত দিয়ে তবু চেয়ে দেখি —

সব বাসি, সব বাসি — একবারে মেকি!





১৩৩৩



তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌ দিকে জানি নি তা — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন

চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে

কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে!

কত দেহ এল, গেল, হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে

দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে

নক্ষত্রের তলে

বসে আছি — সমুদ্রের জলে

দেহ ধুয়ে নিয়া

তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে — ফলে গেছে কতবার,

ঝরে গেছে তৃণ!



*

আমারে চাও না তুমি আজ আর, জানি;

তোমার শরীর ছানি

মিটায় পিপাসা

কে সে আজ! — তোমার রক্তের ভালোবাসা

দিয়েছ কাহারে!

কে বা সেই! — আমি এই সমুদ্রের পারে

বসে আছি একা আজ — ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে

আজ আর প্রশ্ন নাই — মাঝরাতে ঘুম লেগে আছে

চক্ষে তার — এলোমেলো রয়েছে আকাশ!

উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা! — তারই তলে পৃথিবীর ঘাস

ফলে ওঠে — পৃথিবীর তৃণ

ঝড়ে পড়ে — পৃথিবীর রাত্রি আর দিন

কেটে যায়!

উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা — তারই তলে হায়!



*

জানি আমি — আমি যাব চলে

তোমার অনেক আগে;

তারপর, সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন —

আকাশে আকাশে যাবে জ্বলে

নক্ষত্র অনেক রাত আরো,

নক্ষত্র অনেক রাত আরো,

(যদিও তোমারও

রাত্রি আর দিন শেষ হবে

একদিন কবে!)

আমি চলে যাব, তবু, সমুদ্রের ভাষা

রয়ে যাবে — তোমার পিপাসা

ফুরাবে না পৃথিবীর ধুলো মাটি তৃণ

রহিবে তোমার তরে — রাত্রি আর দিন

রয়ে যাবে রয়ে যাবে তোমার শরীর,

আর এই পৃথিবীর মানুষের ভিড়।



*

আমারে খুজিয়াছিলে তুমি একদিন —

কখন হারায়ে যাই — এই ভয়ে নয়ন মলিন

করেছিলে তুমি! —

জানি আমি; তবু, এই পৃথিবীর ফসলের ভূমি

আকাশের তারার মতন

ফলিয়া ওঠে না রোজ — দেহ ঝরে — ঝরে যায় মন

তার আগে!

এই বর্তমান — তার দু — পায়ের দাগে

মুছে যায় পৃথিবীর পর,

একদিন হয়েছে যা তার রেখা, ধূলার অক্ষর!

আমারে হারায়ে আজ চোখ ম্লান করিবে না তুমি —

জানি আমি; পৃথিবীর ফসলের ভূমি

আকাশের তারার মতন

ফলিয়া ওঠে না রোজ —

দেহ ঝরে, তার আগে আমাদের ঝরে যায় মন!



*

আমার পায়ের তলে ঝরে যায় তৃণ —

তার আগে এই রাত্রি — দিন

পড়িতেছে ঝরে!

এই রাত্রি, এই দিন রেখেছিলে ভরে

তোমার পায়ের শব্দে, শুনেছি তা আমি!

কখন গিয়েছে তবু থামি

সেই শব্দে! — গেছ তুমি চলে

সেই দিন সেই রাত্রি ফুরায়েছে বলে!

আমার পায়ের তলে ঝরে নাই তৃণ —

তবু সেই রাত্রি আর দিন

পড়ে গেল ঝ’রে।

সেই রাত্রি — সেই দিন — তোমার পায়ের শব্দে রেখেছিলে ভরে!



*

জানি আমি, খুঁজিবে না আজিকে আমারে

তুমি আর; নক্ষত্রের পারে

যদি আমি চলে যাই,

পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই

যদি আমি —

আমারে খুঁজিতে তবু আসিবে না আজ;

তোমার পায়ের শব্দ গেল কবে থামি

আমার এ নক্ষত্রের তলে! —

জানি তবু, নদীর জলের মতো পা তোমার চলে —

তোমার শরীর আজ ঝরে

রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোনো এক ঢেউয়ের উপরে!

যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই

যদি আমি চলে যাই

নক্ষত্রের পারে —

জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!



*

তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে!

নক্ষত্র সরিয়া যায়, তবু যদি তোমার দু — পায়ে

হারায়ে ফেলিতে পথ — চলার পিপাসা! —

একবারে ভালোবেসে — যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি সেই ভালোবাসা।

আমার এখানে এসে যেতে যদি থামি! —

কিন্তু তুমি চলে গেছ, তবু কেন আমি

রয়েছি দাঁড়ায়ে!

নক্ষত্র সরিয়া যায় — তবু কেন আমার এ পায়ে

হারায়ে ফেলেছি পথ চলার পিপাসা!

একবার ভালোবেসে কেন আমি ভালোবাসি সেই ভালোবাসা!



*

চলিতে চাহিয়াছিলে তুমি একদিন

আমার এ পথে — কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন।

জানি আমি, আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই।

তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি! — তাই আস নাই

আমার এখানে তুমি আর!

একদিন কত কথা বলেছিলে, তবু বলিবার

সেইদিনও ছিল না তো কিছু — তবু বলিবার

আমার এ পথে তুমি এসেছিলে — বলেছিলে কত কথা —

কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন;

আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই;

তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি — তাই আস নাই!



*

তোমার দু চোখ দিয়ে একদিন কতবার চেয়েছ আমারে।

আলো অন্ধকারে

তোমার পায়ের শব্দ কতবার শুনিয়াছি আমি!

নিকটে নিকটে আমি ছিলাম তোমার তবু সেইদিন —

আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি

এই দূর সমুদ্রের জলে!

যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!

সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে

বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে

সমুদ্রের জলে,

নক্ষত্রের তলে!

রাত্রে, অন্ধকারে!

তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,

আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!



*

তোমার শরীর —

তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর, মানুষের ভিড়

রাত্রি আর দিন।

তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন

চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে

কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে

কত দেহ এল, গেল — হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে

দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে

নক্ষত্রের তলে

বসে আছি — সমুদ্রের জলে

দেহ ধুয়ে নিয়া

তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!





কাব্যগ্রন্থঃ রূপসী বাংলা





বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি



বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ

খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে

চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে

ভোরের দোয়েলপাখি — চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ

জাম — বট — কাঠালের — হিজলের — অশখের করে আছে চুপ;

ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;

মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে

এমনই হিজল — বট — তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ



দেখেছিল; বেহুলার একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে –

কৃষ্ণা দ্বাদশীর জোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চরায় –

সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,

শ্যামার নরম গান শুনেছিলো — একদিন অমরায় গিয়ে

ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিলো ইন্দ্রের সভায়

বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়।





ভেবে ভেবে ব্যথা পাব



ভেবে ভেবে ব্যথা পাব: মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকিতাম বেঁচে

দেখিতাম সেই লক্ষ্মীপেঁচাটির মুখ যারে কোনোদিন ভালো করে দেখি নাই আমি –

এমনি লাজুক পাখি, — ধূসর ডানা কি তার কুয়াশার ঢেউয়ে ওঠে নেচে;

যখন সাতটি তারা ফুটে ওঠে অন্ধকারে গাবের নিবিড় বুকে আসে সে কি নামি?



শিউলির বাবলার আঁধার গলির ফাঁকে জোনাকির কুহকের আলো

করে না কি? ঝিঁঝিঁর সবুজ মাংসে ছোটো — ছোঁটো ছেলেমেয়ে বউদের প্রাণ

ভুলে যায়; অন্ধকার খুঁজে তারে আকন্দবনের ভিড়ে কোথায় হারালো

মাকাল লতার তলে শিশিরের নীল জলে কেউ তার জানে না সন্ধ্যান।



আর সেই সোনালি চিলের ডানা — ডানা তার আজো কি মাঠের কুয়াশায়

ভেসে আসে; — সেই ন্যাড়া অশ্বত্থের পানে আজও চ’লে যায় সন্ধ্যা

সোনার মত হলে?

ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?

আশ্চর্য বিষ্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধাকার বিছানার কোলে।





যতদিন বেঁচে আছি



যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে

অপরাজিতার মতো নীল হয়ে-আরো নীল-আরো নীল হয়ে

আমি যে দেখিতে চাই;- সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায়ে লয়ে

কোথায় ভোরের বক মাছরাঙা উড়ে যায় আশ্বিনের মাসে,

আমি যে দেখিতে চাই;- আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে,

পৃথিবীর পথ ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে সয়ে

ধানসিড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব বয়ে,

যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,



যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি পরে কোনো এক সুন্দরীর শব

চন্দন চিতায় চড়ে-আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা;

যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ-সবচেয়ে ঘাঢ় বিষন্নতা;

যেখানে শুকায় পদ্মা-বহুদিন বিশালক্ষ্মী যেখানে নীরব;

যেইখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিকমালার

কাঁকন বাজিত, আহা, কোনোদিন বাজিবে কি আর!



যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে



যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে – দূর কুয়াশায়

চ’লে যাবো, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর

ভিক্ষা ক’রে লয়ে যাবে;- সেদিন দু’দও এই বাংলার তীর —

এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কি ভাবিব, হায়;-

সেদিন র’বে না কোনো ক্ষোভ মনে –এই সোঁদা ঘাসের ধুলায়

জীবন যে কাটিয়াছে বাংলায় – চারিদিকে বাঙালীর ভিড়

বহুদিন কীর্তন ভাসান গান রুপকথা যাত্রা পাঁচালীর

নরম নিবিড় ছন্দে যারা আজো শ্রাবণের জীবণের জীবন গোঙায়,



আমারে দিয়াছে তৃপ্তি; কোনো দিন রুপহীন প্রবাসের পথে

বাংলার মুখ ভুলে খাঁচার ভিতরে নষ্ট শুকের মতন

কাটাইনি দিন মাস,বেহুলার লহনার মধুর জগতে

তাদের পায়ের ধুলো – মাখা পথে বিকায়ে দিয়েছি আমি মন

বাঙালি নারীর কাছে – চাল- ধোয়া স্নিগ্ধ হাত, ধান – মাখা চুল,

হাতে তার শাড়িটির কস্তা পাড়; – ডাঁশা আম কামরাঙা কুল।



সন্ধ্যা হয়



সন্ধ্যা হয় — চারিদিকে মৃদু নীরবতা

কুটা মুখে নিয়ে এক শালিখ যেতেছে উড়ে চুপে;

গোরুর গাড়িটি যায় মেঠো পথ বেড়ে ধীরে ধীরে;

আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে;



পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;

পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;

পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু;জনার মনে;

আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।





হায় পাখি একদিন কালীদহে ছিল না কি



হায় পাখি, একদিন কালীদহে ছিল না কি – দহের বাতাসে

আষাঢ়ের দু’পহরে কলরব কর নি কি এই বাংলায়!

আজ সারাদিন এই বাদলের কোলাহলে মেঘের ছায়ায়

চাঁদ সদাগর: তার মধুকর ডিঙাটির কথা মনে আসে,

কালীদহে কবে তারা পড়েছিলো একদিন ঝড়ের আকাশে,-

সেদিনো অসংখ্য পাখি উড়েছিলো না কি কালো বাতাসের গায়,

আজ সারাদিন এই বাদলের জলে ধলেশ্বরীর চরায়

গাংশালিখের ঝাঁক, মনে হয়, যেন সেই কালীদহে ভাসে;



এই সব পাখিগুলো কিছুতেই আজিকার নয় যেন-নয়-

এ নদীও ধলেশ্বরী নয় যেন-এ আকাশ নয় আজিকার:

ফণীমনসার বনে মনসা রয়েছে নাকি? আছে; মনে হয়,

এ নদী কি কালীদহ নয়? আহা, ঐ ঘাটে এলানো খোঁপার

সনকার মুখ আমি দেখি না কি? বিষন্ন মলিন ক্লান- কি যে

সত্য সব; তোমার এ স্বপ্ন সত্য, মনসা বলিয়া গেল নিজে।





হৃদয়ে প্রেমের দিন



হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় — চিতা শুধু পড়ে থাকে তার,

আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা আছে আজো তাই শালিধান

রূপশালি ধান তাহা… রূপ, প্রেম… এই ভাবি… খোসার মতন নষ্ট ম্লান

একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে, — যখন সবুজ অন্ধকার,

নরম রাত্রির দেশ নদীর জলের গন্ধ কোন এক নবীনাগতার

মুখখানা নিয়ে আসে — মনে হয় কোনোদিন পৃথিবীতে প্রেমের আহ্বান

এমন গভীর করে পেয়েছি কি? প্রেম যে নক্ষত্র আর নক্ষত্রের গান,

প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের গাঢ় নীল অমাবস্যায় –



চলে যায় আকাশের সেই দূর নক্ষত্রের লাল নীল শিখার সন্ধানে,

প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ, — আর তুমি স্বাতীর মতন

রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে, — তাই প্রেম ধুলায় কাঁটায় যেইখানে

মৃত হয়ে পড়ে ছিল পৃথিবীর শূণ্য পথে সে গভীর শিহরণ,

তুমি সখী, ডুবে যাবে মুহূর্তেই রোমহর্ষে — অনিবার অরুণের ম্লানে

জানি আমি; প্রেম যে তবুও প্রেম; স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রবে, বাঁচিতে সে জানে।





এইসব ভাল লাগে



(এই সব ভালো লাগে) : জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে

আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়,—আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল –

এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল

পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে,

পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে

ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে অই টসটসে ভিজে জামরুল,

নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল; –

পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসে



কবেকার মৃত কাক: পৃথিবীর পথে আজ নাই সে তো আর;

তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে

মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায়;

তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায়;

পৃথিবীও নাই আর; দাঁড়কাক একা — একা সারারাত জাগে;

কি বা হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।

নিমপেঁচা তবু হাঁকে : ‘পাবে নাকো কোনোদিন, পাবে নাকো

কোনোদিন, পাবে নাকো কোনোদিন আর।’



আবার আসিব ফিরে



আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়

হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,

হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।

হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়

সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।

আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে

জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।



হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।

হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।

হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।

রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে

ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে

দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।



কাব্যগ্রন্থঃ মহাপৃথিবী







আট বছর আগের একদিন



শোনা গেলো লাশকাটা ঘরে

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হলো তার সাধ।



বধূ শুয়ে ছিলো পাশে - শিশুটিও ছিলো;

প্রেম ছিলো, আশা ছিলো - জোৎস্নায়, - তবু সে দেখিল

কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।



এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি !

রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি

আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার;

কোনোদিন জাগিবে না আর।



'কোনোদিন জাগিবে না আর

জানিবার গাঢ় বেদনার

অবিরাম - অবিরাম ভার

সহিবে না আর - '

এই কথা বলেছিলো তারে

চাঁদ ডুবে চলে গেলে - অদ্ভুত আঁধারে

যেন তার জানালার ধারে

উটের গ্রীবার মতো কোনো-এক নিস্তব্ধতা এসে।



তবুও তো প্যাঁচা জাগে;

গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে

আরেকটি প্রভাতের ইশারায় - অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।



টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে

চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;

মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।



রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;

সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।



ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন - যেন কোন বিকীর্ণ জীবন

অধিকার করে আছে ইহাদের মন;

দূরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ

মরণের সাথে লড়িয়াছে;

চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে

এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা - একা;

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের - মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

এই জেনে।



অশ্বথের শাখা

করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে

করেনি কি মাখামাখি?

থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে

বলেনি কি : 'বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?

চমৎকার! -

ধরা যাক দু -একটা ইঁদুর এবার!'

জানায়নি প্যাঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?



জীবনের এই স্বাদ - সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের -

তোমার অসহ্য বোধ হলো;

মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো

মর্গে - গুমোটে

থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!



শোনো

তবু এ মৃতের গল্প; - কোনো

নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;

বিবাহিত জীবনের সাধ

কোথাও রাখে নি কোন খাদ,

সময়ের উর্ধ্বতনে উঠে এসে বধূ

মধু - আর মননের মধু

দিয়েছে জানিতে;

হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে

এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের'পরে।



জানি - তবু জানি

নারীর হৃদয় - প্রেম - শিশু - গৃহ - নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় -

আরো এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে;

ক্লান্ত - ক্লান্ত করে;

লাশকাটা ঘরে

সেই ক্লান্তি নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।



তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,

থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বথের ডালে বসে এসে,

চোখ পালটায়ে কয় : 'বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?

চমৎকার !

ধরা যাক দু - একটা ইঁদুর এবার -'



হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার?

আমিও তোমার মতো বুড়ো হব - বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব

কালীদহে বেনো জলে পার;

আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।





বলিল অশ্বত্থ সেই



বলিল অশ্বত্থ ধীরে: ‘কোন দিকে যাবে বলো-

তোমরা কোথায় যেতে চাও?

এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে:

ম্লান খোড়ো ঘরগুলো-আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;

এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের

তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের!

বোঁচকা বেঁধেছ ঢের,-ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও;

আবার কোথায় যেতে চাও?



‘পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নিকো-এই-তো সেদিন

তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয়

-আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!-

এখানে মাঠের পারে জমি কিনে খোড়ো ঘর তুলে

এই দেশে এই পথে এই সব ঘাস ধান নিম জামরুলে

জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাঙ্খা বেদনার শুধেছিল ঋণ;

দাঁড়ায়ে-দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যে,-মনে হয় যেন সেই দিন!



‘এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?

সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ?

আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?

তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাঙ্খার ঘর!..

যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর

যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর

ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর’

-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।





ইহাদেরি কানে



একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে – একবার বেদনার পানে

অনেক কবিতা লিখে চলে গেলো যুবকের দল;

পৃথিবীর পথে-পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে

শুনিল আধেক কথা – এই সব বধির নিশ্চল

সোনার পিত্তল মূর্তি: তবু, আহা, ইহাদেরি কানে

অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেলো যুবকের দল:

একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে – একবার বেদনার পানে।





ফুটপাথে



অনেক রাত হয়েছে-অনেক গভীর রাত হয়েছে;

কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে-ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে-

কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো

এই যে ট্র্যামের লাইন ছড়িয়ে আছে

পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ করে হাঁটছি আমি।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে- কেমন যেন ঠাণ্ডা বাতাস;

কোন্‌ দূর সবুজ ঘাসের দেশ নদী জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার,-

তারা কোথায় তারা কি হারিয়ে গেছে?

পায়ের তলে লিকলিকে ট্রামের লাইন,-মাথার উপরে অসংখ্য জটিল তারের জাল





শাসন করছে আমাকে।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে- কেমন যেন ঠাণ্ডা বাতাস;

এই ঠাণ্ডা বাতাসের মুখে এই কলকাতার শহরে এই গভীর রাতে

কোনো নীল শিরার বাসাকে কাঁপতে দেখবে না তুমি;

জলপাইয়ের পল্লবে ঘুম ভেঙে গেল বলে কোনো ঘুঘু তার,

কোমল নীলাভ ভাঙা ঘুমের আস্বাদ তোমাকে জানাতে আসবে না।

হলুদ পেঁপের পাতাকে একটা আচমকা পাখি ব’লে ভুল হবে না তোমার,

সৃষ্টিকে গহন কুয়াশা বলে বুঝতে পেলে চোখ নিবিড় হয়ে উঠবে না তোমার

প্যাচাঁ তার ধূসর পাখা আমলকির ডালে ঘসবে না এখানে,

আমলকির শাখা থেকে নীল শিশির ঝ’রে পড়বে না,

তার সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মতো খসিয়ে আনবে না এখানে,

রাত্রিকে নীলাভতম করে তুলবে না!

সবুজ ঘাসের ভিতর অসংখ্য দেয়ালি পোকা ম’রে রয়েছে

দেখতে পাবে না তুমি এখানে,

পৃথিবীকে মৃত সবুজ সুন্দর কোমল একটি দেয়ালি পোকার মতো

মনে হবে না তোমার,

জীবনকে মৃত সবুজ সুন্দর শীতল একটা দেয়ালি পোকার মতো

মনে হবে না;

প্যাঁচার সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মতো খসিয়ে আনবে না এখানে,

শিশিরের সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মতো খসিয়ে আনবে না,

সৃষ্টিকে গহন কুয়াশা বলে বুঝতে পেলে চোখ

নিবিড় হয়ে উঠবে না তোমার।





নিরালোক



একবার নক্ষত্রের দিকে চাই — একবার প্রান্তরের দিকে

আমি অনিমিখে।

ধানের ক্ষেতের গন্ধ মুছে গেছে কবে

জীবনের থেকে যেন; প্রান্তরের মতন নীরবে

বিচ্ছিন্ন খড়ের বোঝা বুকে নিয়ে ঘুম পায় তার;

নক্ষত্রেরা বাতি জ্বেলে জ্বেলে — জ্বেলে — ‘নিভে গেলে — নিভে গেলে?’

বলে তারে জাগায় আবার;



জাগায় আবার।

বিক্ষত খড়ের বোঝা বুকে নিয়ে — বুকে নিয়ে ঘুম পায় তার,

ঘুম পায় তার।



অনেক নক্ষত্রে ভরে গেছে এই সন্ধ্যার আকাশ — এই রাতের আকাশ;

এইখানে ফাল্গুনের ছায়া-মাখা ঘাসে শুয়ে আছি;

এখন মরণ ভালো — শরীরে লাগিয়া রবে এই সব ঘাস;

অনেক নক্ষত্র রবে চিরকাল যেন কাছাকাছি।



কে যেন উঠিল হেঁচে–হামিদের মরখুটে কানা ঘোড়া বুঝি!

সারা দিন গাড়ি টানা হল ঢের — ছুটি পেয়ে জ্যোৎস্নায় নিজ মনে

খেয়ে যায় ঘাস;

যেন কোনো ব্যথা নাই? পৃথিবীতে — আমি কেন তবে মৃত্যু খুঁজি?

‘কেন মৃত্যু খোঁজো তুমি?’ চাপা ঠোঁটে বলে দূর কৌতুকী আকাশ।



ঝাউফুলে ঘাস ভরে — এখানে ঝাউয়ের নিচে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে;

কাশ আর চোরকাঁটা ছেড়ে দিয়ে ফড়িং চলিয়া গেছে ঘরে।

সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে কোন্‌ ঘরে যাব!

কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই — চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে

শান্তি আমি পাব?

রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে যাব?



‘তোমারই নিজের ঘরে চলে যাও’ — বলিল নক্ষত্র চুপে হেসে–

‘অথবা ঘাসের ’পরে শুয়ে থাকো আমার মুখের রূপ ঠায় ভালোবেসে;

অথবা তাকায়ে দ্যাখো গরুর গাড়িটি ধীরে চ'লে যায় অন্ধকারে

সোনালি খড়ের বোঝা বুকে;

পিছে তার সাপের খোলস, নালা খলখল অন্ধকার — শান্তি তার

রয়েছে সমুখে;

চলে যায় চুপে চুপে সোনালি খড়ের বোঝা বুকে–

যদিও মরেছে ঢের গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ, –তবু তার মৃত্যু নাই মুখে।’





ফিরে এসো



ফিরে এসো সমুদ্রের ধারে

ফিরে এসো প্রান্তরের পথে;

যেইখানে ট্রেন এসে থামে

আম নিম ঝাউয়ের জগতে

ফিরে এসো; একদিন নীল ডিম করেছ বুনন

আজও তারা শিশিরে নীরব;

পাখির ঝর্ণা হয়ে কবে

আমারে করিবে অনুভব!





কাব্যগ্রন্থঃ সাতটি তারার তিমির



কবিতা



আমাদের হাড়ে এক নির্ধূম আনন্দ আছে জেনে

পঙ্কিল সময়স্রোতে চলিতেছে ভেসে;

তা না হ'লে সকলি হারায়ে যেতো ক্ষমাহীন রক্তের- নিরুদ্দেশে।

হে আকাশ, একদিন ছিলে তুমি প্রভাতের তটিনীর;

তারপর হ'য়ে গেছ দূর মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের।

ভোরবেলা পাখিদের গানে তাই ভ্রান্তি নেই,

নেই কোনো নিস্ফলতা আলোকের পতঙ্গের প্রাণে।

বানরী ছাগল নিয়ে যে- ভিক্ষুক প্রতারিত রাজপথে ফেরে-

আঁজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্ধকারে-

খুঁজে পায় জিজ্ঞাসার মানে।



চামচিকা যার হয় নিরালোকে ওপারের বায়ুসন্তরণে;

প্রান্তরের অমরতা জেগে ওঠে একরাশ প্রাদেশিক ঘাসের উন্মেষে;

জীর্ণতম সমাধির ভাঙ্গা ইঁট অসম্ভব পরগাছা ঘেঁষে

সবুজ সোনালিচোখ ঝিঁঝিঁ-দম্পতির ক্ষুধা করে আবিষ্কার

একটি বাদুড় দূর স্বোপার্জিত জ্যোৎস্নার মনীষায় ডেকে নিয়ে যায়

যাহাদের যতদূর চক্রবাল আছে লভিবার।

হে আকাশ, হে আকাশ,

একদিন ছিলে তুনি মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের মতো;

তারপর হ'য়ে গেছ প্রভাতের নদীটির মতো প্রতিভার!





আকাশলীনা



সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি,

বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;

ফিরে এসো সুরঞ্জনা :

নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;



ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;

ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;

দূর থেকে দূরে - আরও দূরে

যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।



কী কথা তাহার সাথে? - তার সাথে!

আকাশের আড়ালে আকাশে

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।



সুরঞ্জনা,

তোমার হৃদয় আজ ঘাস :

বাতাসের ওপারে বাতাস -

আকাশের ওপারে আকাশ।





ঘোড়া



আমরা যাইনি মরে আজও - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় :

মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে ;

প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন - এখনও ঘাসের লোভে চরে

পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর 'পরে ।



আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে একভিড় রাত্রির হাওয়ায় ;

বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে ;

চায়ের পেয়ালা ক'টা বেড়ালছানার মতো - ঘুমে - ঘেয়ো

কুকুরের অস্পষ্ট কবলে

হিম হয়ে নড়ে গেল ও - পাশের পাইস্ - রেস্তরাঁতে,

প্যারাফিন - লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে ।

সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে ;

এইসব নিওলিথ - স্তব্ধ তার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে ।





সমারূঢ়



'বরং নিজেই তুমি লিখোনাকো একটি কবিতা-'

বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর;

বুঝিলাম সে তো কবি নয়- সে যে আরূঢ় ভণিতা

পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের পর

ব'সে আছে সিংহাসনে-কবি নয়- অজর অক্ষর

অধ্যাপক, দাঁত নেই- চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি;

বেতন হাজার টাকা মাসে- আর হাজার দেড়েক

পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি

যদিও সে সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক

চেয়েছিলো-হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি ।





যেই সব শেয়ালেরা



যেই সব শেয়ালেরা জন্ম- জন্ম শিকারের তরে,

দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভিতরে

নীরবে প্রবেশ করে,- বার হয়- চেয়ে দেখে বরফের রাশি

জ্যোৎস্নায় প’ড়ে আছে;- উঠিতে পারিত যদি সহসা প্রকাশি

সেই সব হৃদযন্ত্র মানবের মতো আত্মায়ঃ

তা’হলে তাদের মনে যেই এক বিদীর্ণ বিস্ময়

জন্ম নিতো;- সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পারে

আমারও নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে।





নাবিক



কোথাও তরণী আজ চ’লে গেছে আকাশ-রেখায়- তবে- এই কথা ভেবে

নিদ্রায় আসক্ত হতে গিয়ে তবু বেদনায় জেগে ওঠে পরাস্ত নাবিক;

সূর্য যেন পরম্পরাক্রমে আরো- অই দিকে- সৈকতের পিছে

বন্দরের কোলাহল- পাম সারি; তবু তার পরে স্বাভাবিক



স্বর্গীয় পাখির ডিম সূর্য যেন সোনালি চুলের ধর্মযাজিকার চোখে;

গো-ধূম-ক্ষেতের ভিড়ে সাধারণ কৃষকের খেলার বিষয়;

তবু তার পরে কোনো অন্ধকার ঘর থেকে অভিভূত নৃমুণ্ডের ভিড়

বল্লমের মতো দীর্ঘ রশ্মির ভিতরে নিরাশ্রয়-



আশ্চর্য সোনার দিকে চেয়ে থাকে; নিরন্তর দ্রুত উন্মীলনে

জীবাণুরা উড়ে যায়- চেয়ে দ্যাখে- কোনো এক বিস্ময়ের দেশে।

হে নাবিক, হে নাবিক, কোথায় তোমার যাত্রা সূর্যকে লক্ষ্য ক’রে শুধু?

বেবিলন, নিনেভ, মিশর, চীন, উরের আরশি থেকে ফেঁসে



অন্য এক সমুদ্রের দিকে তুমি চ’লে যাও- দুপুর দেলায়;

বৈশালীর থেকে বায়ু- গেৎসিমানি- আলেকজান্দ্রিয়ার

মোমের আলোকগুলো রয়েছে পেছনে প’ড়ে অমায়িক সংকেতের মতো;

তারাও সৈকত। তবু তৃপ্তি নেই। আরো দূর চক্রবাল হৃদয়ে পাবার



প্রায়োজন র’য়ে গেছে- যতদিন স্ফটিক-পাখনা মেলে বোলতার ভিড়

উড়ে যায় রাঙা রৌদ্রে; এরোপ্লেনের চেয়ে প্রমিতিতে নিটোল সারস

নীলিমাকে খুলে ফেলে যতদিন; ভুলের বুনুনি থেকে আপনাকে মানব-

হৃদয়;

উজ্জ্বল সময়-ঘড়ি- নাবিক- অনন্ত নীর অগ্রসর হয়।







রাত্রি



হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কূষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল;

অথবা সে-হাইড্র্যান্ট হয়তো না গিয়েছিলো ফেঁসে।

এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে।

একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে



অস্থির পেট্রল ঝেঁড়ে; সতত সতর্ক থেকে তবু

কেউ যেন ভয়াবহভাবে প'ড়ে গেছে জলে।

তিনটি রিক্‌শ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাসল্যাম্পে

মায়াবীর মতো জাদুবলে।



আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে- হঠকারিতায়

মাইল-মাইল পথ হেঁটে- দেয়ালের পাশে

দাঁড়ালাম বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে- টেরিটি বাজারে;

চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে।



মদির আলোর তাপ চুমো খায় গালে।

কেরোসিন কাঠ, গালা, গুনচট, চামড়ার ঘ্রাণ

ডাইনামোর গুঞ্জনের সাথে মিশে গিয়ে

ধনুকের ছিলা রাখে টান।



টান রাখে মৃত ও জাগ্রত পৃথিবীকে।

টান রাখে জীবনের ধনুকের ছিলা।

শ্লোক আওড়ায়ে গেছে মৈত্রেয়ী কবে;

রাজ্য জয় ক'রে গেছে অমর আত্তিলা।



নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে

গান গায় আধো জেগে ইহুদী রমণী;

পিতৃলোক হেসে ভাবে, কাকে বলে গান-

আর কাকে, সোনা, তেল, কাগজের খনি।



ফিরিঙ্গি যুবক ক'টি চ'লে যায় ছিমছাম।

থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে;

হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিষ্কার ক'রে

বূড়ো এক গরিলার মতন বিশ্বাসে।



নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়

লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।

তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব অতিবৈতনিক,

বস্তুর কাপড় পরে লজ্জাবশত।





দীপ্তি



তোমার নিকট থেকে

যত দূর দেশে

আমি চলে যাই

তত ভালো।

সময় কেবলই নিজ নিয়মের মতো- তবু কেউ

সময়স্রোতের 'পরে সাঁকো

বেঁধে দিতে চায়;

ভেঙ্গে যায়;

যত ভাঙ্গে তত ভালো।

যত স্রোত বয়ে যায়

সময়ের

সময়ের মতন নদীর

জলসিঁড়ি, নীপার, ওডার, রাইন, রেবা, কাবেরীর

তুমি তত বহে যাও,

আমি তত বহে চলি,

তবুও কেহই কারু নয়।

আমরা জীবন তবু।

তোমার জীবন নিয়ে তুমি

সূর্যের রশ্মির মতো অগণন চলে

রৌদ্রের বেলার মতো শরীরের রঙ্গে

খরতর নদী হয়ে গেলে

হয়ে যেতে।

তবু মানুষী হয়ে

পুরুষের সন্ধান পেয়েছ;

পুরুষের চেয়ে বড় জীবনের হয়তো বা।





আমিও জীবন তবু-

ক্বচিৎ তোমার কথা ভেবে

তোমার সে শরীরের থেকে ঢের দূরে চলে গিয়ে

কোথাও বিকেলবেলা নগরীর উৎসারণে উচল সিঁড়ির

উপরে রৌদ্রের রঙ জ্বলে ওঠে- দেখে

বুদ্ধের চেয়েও আরো দীন সুষমার সুজাতার

মৃত বৎসরে বাঁচায়েছে

কেউ যেন;

মনে হয়,

দেখা যায়।



কেউ নেই-স্তব্ধতায়; তবুও হৃদয়ে দীপ্তি আছে



দিন শেষ হয় নি এখনও।

জীবনের দিন- কাজ

শেষ হতে আজও ঢের দেরি।

অন্ন নেই। হ্রৃদয়বিহীনভাবে আজ

মৈত্রেয়ী ভূমার চেয়ে অন্নলোভাতুর।

রক্তের সমুদ্র চারি দিকে;

কলকাতা থেকে দূর

গ্রিসের অলিভ বন

অন্ধকার।

অগণন লোক মরে যায়;

এম্পিডোক্লেসের মৃত্যু নয়-

সেই মৃত্যু ব্যসনের মতো মনে হয়।

এ ছাড়া কোথাও কোনো পাখি

বসন্তের অন্য কোনো সাড়া নেই

তবু এক দীপ্তি রয়ে গেছে।



কাব্যগ্রন্থঃ বেলা অবেলা কালবেলা



মাঘসংক্রান্তির রাতে



হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে

তোমার পবিত্র অগ্নি জ্বলে।

অমাময়ী নিশি যদি সৃজনের শেষ কথা হয়,

আর তার প্রতিবিম্ব হয় যদি মানব-হৃদয়,

তবুও আমার জ্যোতি সৃষ্টির নিবিড় মনোবলে

জ্ব’লে ওঠে সময়ের আকাশের পৃথিবীর মনে;

বুঝেছি ভোরের বেলা রোদে নীলিমায়,

আঁধার অরব রাতে অগণন জ্যোতিষ্ক শিখায়;

মহাবিশ্ব একদিন তমিস্রার মতো হ’য়ে গেলে,

মুখে যা বলোনি, নারি, মনে যা ভেবেছো তার প্রতি

লক্ষ্য রেখে অন্ধকার শক্তি অগ্নি সুবর্ণের মতো

দেহ হবে মন হবে-তুমি হবে সে-সবের জ্যোতি!





আমাকে একটি কথা দাও



আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো

সহজ মহৎ বিশাল,

গভীর; - সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে

মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,

আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।

সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:

সেই দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন

সেই উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে

অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।





তোমাকে



মাঠের ভিড়ে গাছের ফাঁকে দিনের রৌদ্রে অই;

কুলবধুর বহিরাশ্রয়িতার মতন অনেক উড়ে

হিজল গাছে জামের বনে হলুদপাখির মতো

রূপসাগরের পার থেকে কি পাখনা বাড়িয়ে

বাস্তবিকই রৌদ্র এখন? সত্যিকারের পাখি?

কে যে কোথায় কার হৃদয়ে কখন আঘাত ক’রে।

রৌদ্রবরণ দেখেছিলাম কঠিন সময়-পরিক্রমার পথে-

নারীর,-তবু ভেবেছিলাম বহিঃপ্রকৃতির।

আজকে সে-সব মীনকেতনের সাড়ার মতো, তবু

অন্ধকারের মহাসনাতনের থেকে চেয়ে

আশ্বিনের এই শীত স্বাভাবিক ভোরের বেলা হ’লে

বলেঃ ‘আমি রোদ কি ধূলো পাখি না সেই নারী?’

পাতা পাথর মৃত্যু কাজের ভূকন্দরের থেকে আমি শুনি;

নদী শিশির পাখি বাতাস কথা ব;লে ফুরিয়ে গেলে পরে

শান্ত পরিচ্ছন্নতা এক এই পৃথিবীর প্রাণে

সফল হ’তে গিয়েও তবু বিষণ্নতার মতো।

যদিও পথ আছে-তবু কোলাহলে শূন্য আলিঙ্গনে

নায়ক সাধক রাষ্ট্র সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে;

প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো-

কী বিরাট অবক্ষয়ের মানব-সাগরে।

তবুও তোমায় জেনেছি, নারী, ইতিহাসের শেষে এসেঃ মানবপ্রতিভার

রূঢ়তা ও নিষ্ফলতার অধম অন্ধকারে।

মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালোবেসে

বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।





সূর্য নক্ষত্র নারী



তোমার নিকট থেকে সর্বদাই বিদায়ের কথা ছিলো

সব চেয়ে আগে; জানি আমি।

সে-দিনও তোমার সাথে মুখ-চেনা হয় নাই।

তুমি যে এ-পৃথিবীতে র’য়ে গেছো।

আমাকে বলেনি কেউ।

কোথাও জলকে ঘিরে পৃথিবীর অফুরান জল

র’য়ে গেছে;-

যে যার নিজের কাজে আছে, এই অনুভবে চ’লে

শিয়রে নিয়ত স্ফীত সুর্যকে চেনে তারা;

আকাশের সপ্রতিভ নক্ষত্রকে চিনে উদীচীর

কোনো জল কী ক’রে অপর জল চিনে নেবে অন্য নির্ঝরের?

তবুও জীবন ছুঁ’য়ে গেলে তুমি;-

আমার চোখের থেকে নিমেষ নিহত

সূর্যকে সরায়ে দিয়ে।



স’রে যেতো; তবুও আয়ুর দিন ফুরোবার আগে।

নব-নব সূর্যকে কে নারীর বদলে

ছেড়ে দেয়; কেন দেব? সকল প্রতীতি উৎসবের

চেয়ে তবু বড়ো

স্থিরতর প্রিয় তুমি;- নিঃসূর্য নির্জন

ক’রে দিতে এলে।

মিলন ও বিদায়ের প্রয়োজনে আমি যদি মিলিত হতাম

তোমার উৎসের সাথে, তবে আমি অন্য সব প্রেমিকের মতো

বিরাট পৃথিবী আর সুবিশাল সময়কে সেবা ক’রে আত্মস্থ হতাম।

তুমি তা জানো না, তবু, আমি জানি, একবার তোমাকে দেখেছি;-

পিছনের পটভূমিকায় সময়ের

শেষনাগ ছিলো, নেই;- বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা

নিভে যায়;- মানুষ অপ্রিজ্ঞাত সে-আমায়; তবুও তাদের একজন

গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়!

আহা, তাকে অন্ধকার অনন্তের মতো আমি জেনে নিয়ে, তবু,

অল্পায়ু রঙিন রৌদ্রে মানবের ইতিহাসে কে না জেনে কোথায় চলেছি!







কাব্যগ্রন্থঃ ঝরা পালক



অস্তচাঁদে



ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!

-অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে যবে কালো নদী-ঢেউয়ের কলসী,

নিঝ্ঝুম বিছানার পরে

মেঘবৌ’র খোঁপাখসা জোছনাফুল চুপে চুপে ঝরে,-

চেয়ে থাকি চোখ তুলে’-যেন মোর পলাতকা প্রিয়া

মেঘের ঘোমটা তুলে’ প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!

সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে’ ফিরে’ ফিরে’

মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে!

দুশ্চর দেউলে কোন্-কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে,

দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে,

কোথা পিরামিড তলে, ঈসিসের বেদিকার মূলে,

কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,

কোন্ মনভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর মনে

আমারে দেখেছে জোছনা-চোর চোখে-অলস নয়নে!

আমারে দেখেছে সে যে আসরীয় সম্রাটের বেশে

প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে-

হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি

কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!

ভোরগেলাসের সুরা-তহুরা, ক’রেছি মোরা চুপে চুপে পান,

চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!

পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা,

নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!

নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ-

চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!

সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া

কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া

লভেছিনু উল্লাস-উতরোল!-আজ পড়ে মনে

সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের, রাতের নির্জনে!



আমি ছিনু ‘ক্রবেদুর’ কোন্ দূর ‘প্রভেন্স্’-প্রান্তরে!

-দেউলিয়া পায়দল্-অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে

সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি!

আঙুরতলায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি

ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;

মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা!

-’অলিভ’ পাতার ফাঁকে চুন চোখে চেয়েছিল চাঁদ,

মিলননিশার শেষে-বৃশ্চিক, গোক্ষুরাফণা, বিষের বিস্বাদ!



স্পেইনের ‘সিয়েরা’য় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী-

নির্মম-কৃতান্ত-কাল-তবু কী যে কাতর, বিরহী!

কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!

অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!

তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি,

নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি।

চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!

ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে

কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু-উড়ু ডানা!

-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!



বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,

গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!

‘ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে’ এমনই রূপালি রাতে

কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!

অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!-

মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!

তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,

তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!

তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু,

জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!

মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা, জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,

বুকের আগুনে খুন চড়ে-মুখ চুন হয়ে যায় একেলা বসি!





পতিতা



আগার তাহার বিভীষিকাভরা, জীবন মরণময়!

সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে – সে যে ব্যাধি, সে যে ক্ষয়;

প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগারে

রচিয়াছে সে যে, দিনের আলোয় রুদ্ধ ক’রেছে দ্বার!

সূর্যকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর,

কালনাগিনীর ফনার মতন নাচে সে বুকের পর!

চক্ষে তাহার কালকুট ঝরে, বিষপঙ্কিল শ্বাস,

সারাটি জীবন মরীচিকা তার প্রহসন-পরিহাস!

ছোঁয়াচে তাহার ম্লান হয়ে যায় শশীতারকার শিখা,

আলোকের পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা!

সে যে মন্বন্তর, মৃত্যুর দূত, অপঘাত, মহামারী-

মানুষ তবু সে, তার চেয়ে বড় – সে যে নারী, সে যে নারী!



মরীচিকার পিছে



ধূম্র তপ্ত আঁধির কুয়াশা তরবারি দিয়ে চিরে

সুন্দর দূর মরীচিকাতটে ছলনামায়ার তীরে

ছুটে যায় দুটি আঁখি!

-কত দূর হায় বাকি!

উধাও অশ্ব বগ্লাবিহীন অগাধ মরুভূ ঘিরে

পথে পথে তার বাধা জমে যায়-তবু সে আসে না ফিরে!



দূরে-দূরে আরো দূরে-আরো দূরে,

অসীম মরুর পারাবার-পারে আকাশ সীমানা জুড়ে

ভাসিয়াছে মরুতৃষা!

-হিয়া হারায়েছে দিশা!

কে যেন ডাকিছে আকুল অলস উদাস বাঁশির সুরে

কোন্‌ দিগন্তে নির্জন কোন্‌ মৌন মায়াবী-পুরে!



কোন্‌-এক সুনীল দরিয়া সেথায় উত্থলিছে অনিবার!

-কান পেতে একা শুনেছে সে তার অপরূপ ঝঙ্কার,

ছোটে অঞ্জলি পেতে,

তৃষার নেশায় মেতে,

উষর ধূসর মরুর মাঝারে এমন খেয়াল কার!

খুলিয়া দিয়াছে মাতাল ঝর্ণা না জানি কে দিলদার!



কে যেন রেখেছে সবুজ ঘাসের কোমল গালিচা পাতি!

যত খুন যত খারাবীর ঘোরে পরান আছিল মাতি,

নিমেষে গিয়েছে ভেঙে

স্বপন-আবেশে রেঙে

আঁখিদুটি তার জৌলস্‌ রাঙা হ’য়ে গেছে রাতারাতি!

কোন্‌ যেন এক জিন্‌-সর্দার সেজেছে তাহার সাথী।



কোন্‌ যেন পরী চেয়ে আছে দুটি চঞ্চল চোখ তুলে!

পাগলা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়না যেতেছে দুলে!

গেঁথে গোলাপের মালা

তাকায়ে রয়েছে বালা,

বিলায়ে দিয়েছে রাঙা নার্গিস্‌ কালো পশমিনা চুলে!

বসেছে বালিকা খর্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে।



ছুটিছে ক্লিষ্ট ক্লান্ত অশ্ব কশাঘাত জর্জর,

চারি দিকে তার বালুর পাথার-মরুর হাওয়ার ঝড়;

নাহি শ্রান্তির লেশ,

সুদুর নিরুদ্দেশ-

অসীম কুহক পাতিয়া রেখেছে তাহার বুকের পর!

পথের তালাসে পাগল সোয়ার হারায়ে ফেলেছে ঘর!



আঁখির পলকে পাহাড়ের পারে কোথা সে ছুটিয়া যায়!

চকিত আকাশ পায় না তাহার নাগাল খুঁজিয়া হায়!

ঝড়ের বাতাস মিছে

ছুটছে তাহার পিছে!

মরুভূর প্রেত চকমিয়া তার চক্ষের পানে চায়-

সুরার তালাসে চুমুক দিল কে গরলের পেয়ালায়!





অন্যান্য কবিতা



ভিখিরি



একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়,

একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,

একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো–

তবে আমি হেঁটে চ’লে যাবো মানে মানে।

–ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত।

আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত;

তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত।



একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে,

একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা,

একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো

তাহলে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা।

বলে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ।

ভিড়ের ভিতরে তবু — হ্যারিসন রোডে — আরো গভীর অসুখ,

এক পৃথিবীর ভুল; ভিখিরীর ভুলে : এক পৃথিবীর ভুলচুক।





অদ্ভুত আঁধার এক



অদ্ভুত আঁধার এক আসিয়াছে পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়

মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।









উৎসঃ



১। জীবনানন্দ দাশের কাব্য সম্ভার [রণেশ দাশ গুপ্ত সম্পাদিত ]

২। শ্রেষ্ঠ জীবনানন্দ [আব্দুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত]

৩।অন্তর্জাল











উৎসর্গঃ কান্ডারি অথর্ব - কে এবং তাদেরকে যারা কবিতা ভালোবাসেন।

মন্তব্য ২৯ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (২৯) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:১০

ডি মুন বলেছেন: এখানে শুধুমাত্র আমি যেসব কবিতাগুলো ভালোবাসি এবং যেগুলো খুব বিখ্যাত সেগুলোকেই পোস্ট করেছি।

আপনাদের প্রিয় কবিতা বাদ পড়ে গেলে কমেন্টে যুক্ত করে দিতে পারেন।

২| ১৪ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:১৭

লাইলী আরজুমান খানম লায়লা বলেছেন: সরাসরি প্রিয়তে নিয়ে গেলাম ------ আন্তরিক সাধুবাদ জানাচ্ছি শেয়ার করার জন্য

১৪ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩২

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ১৪ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:৩৬

প্রবাসী পাঠক বলেছেন: সরাসরি প্রিয়তে।

১৪ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩২

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

৪| ১৪ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:৩৭

মামুন রশিদ বলেছেন: নিঃসন্দেহে অসাধারণ কাজ করেছেন । তবে নির্জন স্বাক্ষরের পর থেকে আর কোন কবিতা দেখা যাচ্ছে না । আর সামুতে মনে হয় কন্টেন্ট লিমিট আছে, ওটা ক্রস করলেই লেখা কালো হয়ে যায় । তাই কবিতাগুলো নিজের ওয়ার্ডপ্রেস ব্লগে প্রকাশ করে পোস্টে লিংক দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যায় ।


চমৎকার পোস্টে প্রথম ভালোলাগা ।

১৪ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩১

ডি মুন বলেছেন: আমি অবশ্য সবই দেখতে পাচ্ছি। শেষ কবিতাটার নাম '' অদ্ভুত আঁধার এক'' ।


পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ মামুন ভাই।

৫| ১৪ ই জুন, ২০১৪ রাত ৮:৩৪

মিনুল বলেছেন: সুন্দর পোস্ট। প্রিয়তে.......

১৪ ই জুন, ২০১৪ রাত ১০:০২

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

৬| ১৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ৯:৩০

মোঃ ইসহাক খান বলেছেন: সুন্দর পোস্ট। অনেকগুলো কবিতা মন ছুঁয়ে যাবার মত।

নিসর্গের কবিকে শ্রদ্ধা।

১৫ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১:১১

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

৭| ১৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:৫২

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:


হায় ! হায় !! করছিস কি ভাই !!!

পোস্ট প্রিয়তে নিয়া গেলাম এর বেশি কিছু বলার নাই। :) :) :)

১৫ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১:১১

ডি মুন বলেছেন: :) :)

৮| ১৫ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:০১

বৃতি বলেছেন: চমৎকার পোস্টে অনেক ভালো লাগা :)

১৫ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১:১১

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

৯| ১৫ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১:১৪

ৎঁৎঁৎঁ বলেছেন: অসাধারণ পোস্ট ডি মুন! প্রিয় কবির এতো কবিতা একসাথে- অবশ্যই পোস্ট প্রিয়তে!

১৫ ই জুন, ২০১৪ রাত ৮:১৮

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

১০| ১৫ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৯

হাসান মাহবুব বলেছেন: +++++

১৫ ই জুন, ২০১৪ রাত ৮:১৯

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

১১| ১৬ ই জুন, ২০১৪ রাত ৩:১২

আসোয়াদ লোদি বলেছেন: আমার প্রিয় কবি । অবশ্যই ভাল পোষ্ট । তবে শেষের দিকে অন্ধকার দেখে দিশা হারানোর অবস্থা ।

১৯ শে জুন, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৭

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

১২| ০২ রা জুলাই, ২০১৪ রাত ১০:৩৫

মহানন্দ মোহন বলেছেন: তোকে আমি আমার বুকের অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা করি. ...

০২ রা জুলাই, ২০১৪ রাত ১১:১১

ডি মুন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ বন্ধু। ভালো থাকা হোক প্রতিটিদিন।

১৩| ০৫ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৪১

আশরাফুল ইসলাম দূর্জয় বলেছেন:
প্রিয় তে নিলাম।

০৫ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৩০

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ কবিতাপ্রেমী

ভালো থাকা হোক সবসময়।

১৪| ১২ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:২৫

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: প্রিয় কবি এবং কবিতা নিয়ে অসাধারন পোস্ট।

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:০৬

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

১৫| ০৮ ই মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৫

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ মুল্যবান কর্মটির জন্য । প্রিয়তে গেল ।
শুভেচ্ছা রইল ।

০৯ ই মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৫:১১

ডি মুন বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.