নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানব ধর্মের চেয়ে কোন বড় ধর্ম নাই এই জগত সংসারে।

মোঃ শিলন রেজা

আমার নাম মুহাম্মদ শাহিদ শিলন রেহমান। আমি মেহেরপুর জেলার পিরোজপুর গ্রামে আমার ছোট বেলা কাটিয়েছি। আমি এইচএসসি পাশ করি ঢাকা মোহাম্মদ পুরের বাবর রোডের ছোট্ট একটা বেসরকারি কলেজে থেকে। কলেজ টার নাম হল, ঢাকা এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল কলেজ। পরে আমি একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

মোঃ শিলন রেজা › বিস্তারিত পোস্টঃ

রেকটি মর্মান্তিক প্রেমের ট্র্যাজেডি

০১ লা এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:৩৮

ডায়রির জবানবন্দী

শিলন রেজা

২৪ শে মার্চ বুধবার ২০১০ খ্রিস্টাব্দ। সেদিন ঢাকা এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল কলেজ এর শেষ পিরিয়ডের ফিজিক্স ক্লাস চলছিল। স্যার ছিলেন রুহুল আমিন। উনি ছিলেন এডিনবার্গের সব থেকে আন্তরিক একজন শিক্ষক। এডিনবার্গ কলেজ টা বেশি বড় ছিল না। আমাদের সায়েন্স বিভাগে মাত্র ৭ জন ছাত্র-ছাত্রি ছিল। এজন্য সারেরা খুব আন্তরিকতার সাথে ক্লাস নিতেন। এই কলেজ টা মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের ২০/৩ ব্লকে অবস্থিত। আমার পাশেই ছিল সাখাওয়াত। খুবই আদর্শবাদী। সবার উপকারে শে আগে গিয়ে হাজির হতো। ওর একটা বোন আছে বাসায়। তার ইমিডিয়েট সিনিয়র। নাম তৃষ্ণা। সাখাওয়াত এর একটা সমস্যা হল হাতের লেখা। এত বিশ্রি যে দেখলে মনে হবে অয়ান অথবা টুয়ে পড়ুয়া ছেলে। আমাদের বিভাগের একমাত্র মেয়ে সোনিয়া। ওর অবশ্য আরও দু-পাচ টা নাম রয়েছে। সব শেষে জেনে ছিলাম ওর আরেক টা নাম দেশা। খুবই সুন্দর নাম। সোনিয়া মেয়েটির চেহারার গড়ন যতটা না ভালো মানুষিক বোঝাপড়াটা সবাইকে মুগ্ধ করে রাখতো।

সোনিয়া আমার পাশের সিত তাতে বসত সবসময়। সেদিন আমি বসেছিলাম সবার পিছনে। মন টা কেন জানি ভালো লাগছিলো না। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে থেকেই সোনিয়া আমাকে ডাকল অনেক বার। শিলন প্লিজ এখানে আসো। আমার পাশে বস। ওর কথা বলার স্টাইল টাতে মাঝে মাঝে মেজাজ বেজাই খারাপ হতো। তবে বলতাম না। কারণ শিক্ষকেরা বলে সতর্ক করেছেন যেন, কোন অবস্থাতেই সোনিয়া কে আমরা কষ্ট না দেই, কারণ আমাদের একটি মাত্র বান্ধবি। যদি কলেজ বদল করে চলে যায়! তখন কি আমাদের ভালো লাগবে। ক্লাসে মেয়ে বান্ধবি না থাকলে ক্লাস করা মুশকিল। এজন্যই আমরা সোনিয়ার সব বিষয় গুলো কে সমর্থন করতাম।

কিন্তু ঐদিন আমার কি হয়েছিল ওর কোন কথা তে আমি সাড়া দিলাম না।

এবার সোনিয়া নিজে থেকে উঠে আসলো, কি ব্যাপার ডাকছি শুনছো না? মন খারাপ নাকি। ইত্যাদি ইত্যাদি।

না না, তেমন কিছু না। আমি জবাব দিলাম।

কিছু তো একটা অবশ্যই হয়েছে, তুমি তো মন খারাপ করার ছেলে না! তুমি সব সময় ক্লাস মাতিয়ে রাখো। আজ কি হল। তোমার কথা না বলা ক্লাস তাকে খুব বেরস করে রেখেছে। প্লিজ কি হয়েছে আমাকে বল।

তখন আমি বললাম আজ ২৪ শে মার্চ তুমি জানো আমি আগামিকাল স্বাধিনতা দিবস। আর এটা ভালো করেই জানো আমি প্রতি স্বাধিনতা দিবস গ্রামে যায়, সেখানে আমি অনেক মজা করতে পারি। তাছাড়া আমাদের কলেজ তো কোন উদ্যোগ কখনও নেই না।

সোনিয়া এবার একটু মুখ ভেংচি মেরে বলল, তো কি হয়েছে?

না ঐ যে আমার এক বড় ভাইয়ার কথা বলেছিলাম না? তাকে কদিন থেকে ফোন দিয়েই যাচ্ছি কিন্তু কোন সংযোগ পাচ্ছি না। তার সিম অফ দেখাচ্ছে।

এবার সোনিয়ার ঝটপট উত্তর, হয়তো সিম চ্যাঞ্জ করেছে।

মনে মনে ভাবলাম হতে পারে কিন্তু আমাকে সিমের নাম্বার কেন দেইনি? নিজেকে এমন হাজারো প্রশ্ন করলাম। এর উত্তর পেতে আমাকে অবশ্য অপেক্ষা করতে হয়নি। উত্তর জানাই ছিল, কি করে দেবে, আমার আগের মোবাইল টা তো হারিয়ে গেছিলো। সিম উঠাতে পারি নাই এফএনএফ নাম্বার না জানার কারণে। যাই হোক ক্লাস শেষ করে আমাদের কলেজেরই টিচার ফাহমিদা মাডামের বাসায় প্রাইভেট আছে। আমি আর শোভন রওনা দিলাম।

এবার একটু শোভনের ব্যাপারে বলি, আমার গ্রামের বাড়ি আর ওর বাড়ি খু কাছাকাছি। শোভন প্রথমে আমাদের সাথে পিরোজপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একসাথেই পড়ত। ক্লাস নাইনে উঠার পর ও চলে যায় পিরজপুরেরই আরেক টা স্কুল যাদুখালি স্কুল অ্যান্ড কলেজ এ। তারপর এসএসসি পাশের পর আবার ওর সাথেই ঢাকা তে আমার আসা। শোভন একটু রাশ ভারি ধরনের ছেলে। একটু মোটা। তার মধ্যে কিছু গুন অবশ্য প্রশংসনীয়, যেমন নামাজ পড়া, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা নিজেকে।

ম্যাডামের কাছে পড়া শেষ করে আসার সময় বললাম, ম্যাডাম পরশু দিন তো ২৬ শে মার্চ, কলেজ ছুটি, তাই ভাবছিলাম একটু গ্রামে যাবো। একবারে চারদিন পড়ে আসবো।

ম্যাডাম কতগুলো উপদেশ মুলক কথা বললেন, সামনে পরিক্ষা, এখন গ্রামে যাওয়া কম করো। গ্রামে গেলে তো সব ভুলে যাও।

অনেক অনুরোধ করার পর বলল, ঠিক আছে।

পরেরদিন চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহন করে রওনা দিলাম। গাড়ির মধ্যে অসখ্য বার শামিম ভাইরে ফোন দিলাম। ফোনটা আমি নতুন কিনেছিলাম। আমি একটা তিউশনি করতাম। সেই তিউশনির সপ্তম বারের টাকা থেকে কিনেছিলাম।

ভেবেছিলাম ফোন কেনার পর সর্বপ্রথম শামিম ভাইয়ের সাথে ঘণ্টা খানেক কথা বলব। কিন্তু ফোন কেনা পাচ দিন আজ। কেনার দিন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু একই কথা বারবার ফিরে আসছে, আপনার ডায়েল কৃত নাম্বার টি এখন বন্ধ আছে। ভইচ এসএমএস পাঠাতে উক্ত নাম্বারের আগে নয়, নয় যোগ করে ডায়েল করুন। যতবারই কথাগুলো শুনছি ততবারই মন টা ভিশন খারাপ হয়ে উঠছে।

এক সময় মনে মনে খুব অভিমান এসে ভর করলো আমাকে। আরও ভাবলাম বাসাই ফিরে আগে শামিম ভায়ের স্টুডিও তে গিয়ে অনেক বকা দিবো।। সে হয়ত বলবে খুব ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দে ভাই আমার। আর কখনও এমন হবে না।

এভাবে ভাবতে ভাবতেই যখন আমঝুপি পৌছালাম তখন বিকেল সাড়ে তিনটা বাজে। এখান থেকে আলগা মন বা করিমন করে যেতে হয় পিরোজপুর বাজার। আমি দেরি না করে একটি করিমন গারি করে রওনা দিলাম। সাড়ে চারটার সময় বাড়ি পৌছা লাম।পৌছানর পরই আমাদের বাসার উঠানে বড়ই গাছের নিচে আমাদের নতুন বাই-সাইকেল টা চোখে পড়ল। ব্যাগ রেখে সাইকেলে উঠে বললাম, আম্মা আমি আসছি।

সোজা চলে আসলাম শামিমের স্টুডিও তে। স্টুডিও টা উপরের দোতলাতে। নিচের মার্কেটে শামিম ভাইয়ের টেইলারস এর দোকান। পাশে দিপু ভাইয়ের বস্ত্রালয় ডানপাশে জিয়া মামার টেইলারস।

শামীমের নিচের দোকানের সাথে দাঁড়ালাম সাইকেলে বসা অবস্থায়, উপরের দিকে তাকিয়ে শামিম ভাই শামিম ভাই বলে অনেকবার ডাকলাম কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। এবার নিচের দোকানের দিকে নজর আটকে গেলো। দেখলাম সেখানে শামিম ভাইয়ের টেইলারসের দোকানের আমুল পরিবর্তন হয়েছে।

আগের মত চাকচিক্যতা আর পরিচ্ছন্নতাও নাই। দোকান তালা দেওয়া। শামিম ভাইয়ের মেশিন টা দেখলাম দিপু ভাইয়ের দোকানের ডানপাশে। যেটা এখন শামিমের বাবা জুলফিকার আলি চালায়। আমার মন টা অচেনা ব্যথায় কুকিয়ে উঠল মনে হলো।

হটাৎ পাশে এসে দাঁড়ালেন জিয়া মামা। পাশের দোকানের মালিক। সম্পর্কে মামা লাগতো তাই মামা বলে ডাকতাম। আমার হাত টা ধরে নিয়ে গেলেন শামিম ভাইয়ের দোতলার স্টুডিও তে। তারপর আমাকে মনে করিয়ে দিলেন শামিম এর অতীত কথা গুলো। বলল তুমি তো সবই জানতে কি ভাবে ভুলে গেলে শামিমের এসব কথা গুলো কে।

আমার নিজেকে এতো অপরাধী মনী হচ্ছিল যে একটা বছর পার হয়ে গেলো আমি শামিমের কথা ভুলে গেছি। আসলে ফোন হারিয়ে যাবার পর ফোন কিনতে আমার ৭ থেকে ৮ মাস সময় লেগে গিয়েছিলো। তাছাড়া পরিক্ষার চাপ সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছে।

এবার স্টুডিও টি ভালো করে লক্ষ্য করলাম, শামিমের স্নৃতি গুলো কে হাতড়াতে লাগলাম। দোকানের চেহারাটা পুরো বদলে গেছে। খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছিল। পারলাম না চোখ টাকে সামলাতে। অশ্রু বের হয়ে আসলো।

শামিমের শেষ দিনটি ছিল ২৬ শে মার্চ। স্বাধিনতা দিবস এর রাত সাড়ে ৯ টার দিকে মারা যায় শামিম। তাঁর মৃত্যুর পুরো টা সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। বিষের যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মারা যায় ঐদিন। এর মাঝে একটা বছর কিভাবে যে পার হয়ে গেলো, আমি ভুলে গেছি। যাকে আমি এতোটা ভালবাসতাম, তাকে এখন কি না আমি ভুল বুঝতে বুঝতে ঢাকা থেকে পাড়ি দিয়েছিলাম। এই ভেবে যে বাড়িতে পৌঁছানোর পর আগে শামিম ভাই কে বকা দিবো। ছিঃ ছিঃ ধিক্কার আমার নিজেকে।

এইসব ভাবতে ভাবতে আমার ঘাড়ে কার যেন স্পর্শ অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখলাম, আমার স্কুল জীবনের বন্ধু ইমরান আমার পাশে দাড়িয়ে। আমাকে হাত ধরে উঠায়ে বলল, চল বাসার দিকে যায়।

ইমরান আমাকে বাসায় এনে খাওয়ালো। তারপর আমি নিজের বাসায় চলে আসলাম। শুয়ে ছিলাম খুব একাকি। কাউকে ভালো লাগছিলো না। আজকে আরও তিব্র ভাবে শামিম ভাইকে মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল শামিম ও আমার অতীত জীবনের কাটানো সময় গুলো কে।

তখন আমি ক্লাস নাইনের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। আমার গ্রামের দুইটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে পিরোজপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় একটি। এই বিদ্যালয়ের প্রতি ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রি অনেক। এজন্য এটার আলাদা একটা সুনাম আছে। আমি ছিলাম ক্লাসের ফার্স্ট বয়। তাই সবাই আমাকে খুব ভালবাসত আবার খুবই মান্য করতো। সকলে আমার সাথে মিশতে চাইতো, এবং কথা বলতো। আমি কোন কথা বললে সেটা সবাই মানার জন্য আপ্রান চেষ্টা করতো।

আমাদের স্কুলেরই ছাত্রি ফিরোজা বলে একটা মেয়ে পড়ে যাকে শামিম ভাই খুব পছন্দ করতো। মেয়েটা ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাড়ি পিরোজপুর শিশুপাড়া। আর বেশি তখন জানতাম না। তবে এইটুকু জেনেছিলাম বন্ধু দের কাছ থেকে যে ফিরোজা অনেক বড়লোকের মেয়ে এবং বাবা ডেয়ারিং টাইপ এর। এমনি পিরোজপুর শিশুপাড়ার লোকজন একটু সন্ত্রাসী টাইপের। অল্পকথাতেই মারমারিতে অভ্যস্থ্য।

শামিম আমাদের পারিবারিক ভাবে অনেক ঘনিষ্ঠ কিন্তু শামিমের সাথে আমার সেই অর্থে কোন যোগাযোগ ছিল না। যোগাযোগ টা শামিম নিজে থেকেই করেছিলো।

প্রথম কথাটা বলি পিরোজপুর আনসার ভিডিপি ক্লাবে গানের অনুষ্ঠানে। আমি, শোভন, ইমরান, তুহিন দাড়িয়ে ছিলাম আর গান শুনছিলাম। হটাত করে শামিমের উপস্থিতি। ওরা সবাই শামিমের সাথে আগে থেকেই পরিচিত। সব রকম ইয়ার্কি ঠাট্টা ওরা করছিল। আমি একেবারেই কোন কথা বলছিলাম না। আমি অবশ্য একটু লাজুক স্বভাবের। কথা তখন খুব কম বলতাম। নিজে থেকে কখনও আগ বাড়িয়ে কারো সাথে কথা বলতে পারতাম না।

শামিমের সাথে অবশ্য পুরো গ্রামের যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত সবার সখ্যতা। এমন কি আমার স্কুলের আমার সকল বন্ধু-বান্ধবি সবাই ওর সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা করে। সবাই ওর দোকান থেকে জামা কাপড় তৈরি করে এবং ওর স্টুডিওর সুবাদে সবাই ওর কাছে ঈদে কোরবানিতে ছবি উঠাই। সেজন্য শামিমের সাথে সবার সখ্যতা। স্কুল ছুটির আগে পরে ওর দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওর সাথে কথা বলে। দোকানে শামিম বস্তে বললে বসে। শামিমের মাঝে মিশুকতা টা বেশি। তাছাড়া ওর সব থেকে বড় গুন ও খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। ইতিমধ্যে আমাদের স্কুলের নবিনবরন বিদায় অনুষ্ঠানে ও গান গেয়ে সবার মনে গেথে গেছে। অসখ্য মেয়ে ওর জন্য পাগল ছিল।

আমার সাথে দুরত্ব টা রয়েই গেছিলো। কারণ আমি অন্য রাস্তা দিয়ে আমার সবথেকে প্রিয় বান্ধবি রিতার সাথে আসতাম। সাড়া রাস্তা আমরা দুজন কথা বলতে বলতে আসতাম। এজন্য শামিমের সাথে দেখা হতো না। তাই ঘনিষ্ঠতাও বাড়েনি। বাসাতে এসে ইমরানের সাথে বেশি ঘুরতাম। সময় কাটানোর জায়গা টা ছিল আমাদের ভৈরব নদীর চরটা। ওখানে দুবলা ঘাসে বসে আমি ও ইমরান বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতাম। এজন্য শামিমের মুখোমুখি কখনও হয়নি। সেজন্য তাঁর সাথে আমার এতো দুরত্ব।

যাইহউক শামিম নিজে থেকেই এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিরে শিলন কেমন আছিস?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আর বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাত মেলালাম। এবার শামিম আমার সাথে কথার ফুলঝরি ফুটাতে লাগলো। অনেকক্ষণ আমার সাথে কথা বলল ঐদিন।

হটাতই মঞ্চ থেকে ডাক এলো, এবার আপনাদের গান পরিবেশন করবেন, এইগ্রামেরই ছেলে, সুমিস্টি কণ্ঠের অধিকারি শিল্পী মোঃ শামিম রেজা।

আমি কিছুটা অবাক হলাম। আমি জানতাম শামিম টুকটাক গান করে কিন্তু এতো বড় বড় শিল্পিদের মাঝে গান গাইবে বুঝিনি। ঐ মঞ্চে সেদিন গান গেয়েছিলেন, শোভনের ছোটো চাচি, আমাদের গ্রামের গুরু শিল্পী ফিদু বিশ্বাস। হিরন সহ ঢাকা কুষ্টিয়া জেলার অনেক নামি দামি শিল্পী।

ওর প্রতি বাজে ধারণাটা তলে পড়ে গেলো। মঞ্চে উঠে শামিম ঐদিন গেয়েছিল পরপর দুইটি গান, যার প্রথমটি লালনগীতিঃ “কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়”

দ্বিতীয় টা হলোঃ “তোমার নীল নীল নীল চোখে, নীল সাগরে, নিলাঞ্জনা কে আমি খুজে পেয়েছি”।

দ্বিতীয় গানটি আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগলো। শামিমের কণ্ঠ টা খুবই সুন্দর ছিল। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। আমি গানের প্রতি আগে থেকেই খুব দুর্বল ছিলাম। স্কুলে আমি সাথি নামের মেয়েটার কাছ থেকে শুধু গান শুনতাম। রিতার কাছে শুনতে চাইলে ও তেমন শুনাতে পারতো না। এইখান টাই রিতার ঘাটতি ছিল। তবে মাঝে মাঝে অনেক অনুরোধ করার পর আস্তে আস্তে গাইতও।

পরেরদিন আমার স্কুল বন্ধ ছিল, আমি আমার বাড়ির পাশে রাস্তায় দাড়িয়ে ছিলাম। পাড়ার ছেলেদের সাথে কথা বলছিলাম। হটাতই শামিম হাজির। আমাকে কোন প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই আমার কয়েকটা ছবি উঠাল। ক্যামেরার ফ্লাশে কিছুটা হচকচিয়ে গেলাম। আমি ছবি উঠার বিরোধী ছিলাম।

জিজ্ঞাসা করলো নাস্তা করেছি কিনা।

আমি না বললাম।

এবার আমার হাত টা শক্ত করে ধরে আমার বাসার দিকে ঢোকার জন্য টান দিলো।

বাসাতে ঢোকার সাথে সাথে আব্বা বলল, শামিম, বাপ কেমন আছো?

বুঝলাম আমার ফ্যামিলির কাছে শামিম ভালোই পরিচিত। আম্মা কে বলল, চাচি আমি শিলন কে নিয়ে যাচ্ছি। ওর কি আজ কোন কাজ আছে?

আম্মা কিছুটা খুশি হল মনে হয়, বলল, না বাবা ওর আজকে কোন কাজ নাই, সাথে করে নিয়ে যাও তো বাবা। ও একেবারে কথাও যেতে চাইনা।

আমি বাড়ি থেকে কোথাও তততা যায়না। বাড়িতে বসে বসে শুধু পরি। আসলে বিজ্ঞান বিভাগ নেওয়াতে সেইভাবে কারো সাথে আদ্দা দিতে পারি না। পড়া মুখস্ত করতেই সারাদিন চলে যায়। বিকেলের দিকে শুধু ইমরানের সাথে একটু নদীর চরে ঘুরি।

আমার কোন ইচ্ছাই ছিল না তাঁর সাথে যাবার, তবুও আম্মা বলাতে শামিমের সাথে গেলাম।

পিরোজপুর মন্দির পার হয়ে এসে একটা হোটেলে ঢুকল আমাকে নিয়ে। দুইটা করে পরটা খাবার পর চা পান করে বের হয়ে আসলাম। প্রথম আসলাম শামিমের স্টুডিওর দোকানে। ও আমাকে পাশে বসিয়ে বিভিন্ন রকম কথা ও গল্প বলতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে আমাকে গানও শুনালো। ওর গাওয়া প্রতিটা গান আমার কাছে খুব ভালো লাগতো। আমি গানের মধ্যে ঢুকে যেতাম।

আমার আগে স্কুল ছুটি হবার পরে আমি আর রিতা মাদ্রাসার রাস্তা ধরে আসতাম বলে শামিমের সাথে আমার দেখা হতো না। শামিম আমাকে কিছুদিন এইভাবে ডেকে এনে বিভিন্ন কথা বলল, গান শুনাতো। আমার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলত। রাজনীতি, অর্থনীতি, দেশ, বিদেশ, ধর্ম, ফিল্ম সব বিষয়ে কথা হতো। আমাকে প্রতিদিন তাঁর দোকানে ডাকতো। বিভিন্ন জনা কে দিয়ে খবর পাঠাতো। আমি একদিন না গেলে আমাকে ডাকতে চলে আসতো। আমার সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা তে তাঁর সহায়তা থাকা চাই চাইই।

শামিম আমাকে বলত তুই মাদ্রাসার রাস্তা ধরে না এসে মন্দিরের রাস্তা ধরে আসবি। তাহলে তোর সাথে দুপুর বেলা একা একা অনেক কথা বলা যাবে। দুজনার মাঝে সকল ধরনের কথা হতো।

এভাবে আমিও তাঁর সাথে কথা বলতে ভালো লাগতো। সে আমার প্রতিটা কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে শুনত। সকল সমস্যার সমাধানের জন্য পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করতো।

এমনও দিন গেছে যে স্কুল ছুটির পর বইখাতা নিয়ে ওর সাথে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে খেয়াল নাই।

ওর একদিন খুব মন খারাপ ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, শামিম ভাআই কি হয়েছে, মন খারাপ কেন?

অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পর মুখ খুললো, জানিস শিলন আমি তোদের স্কুলের একটা মেয়ে কে অনেক অনেক ভালবাসি। তাকে ছাড়া আমার জীবনে মনে হয় কোন কিছুই নেই। তাকে ছাড়া বাচতে ইচ্ছে করে না।

আমার মনে এবার শংকাধ্বনি বেজে উঠলো। মনের মধ্যে কি যেন বারবার ভয় ধরাচ্ছিল। কারণ আমার স্কুলে তো আমারও দুর্বল হওয়ার মানুষ আছে। তাছাড়া শামিম ভাই বেছে বেছে আমাকে এতো একান্তে ডেকে প্রশ্ন টি করছে, সে কি তাহলে আমার প্রিয় বান্ধবী যাকে আমি বেশি সময় দেয় যেটা পুরো স্কুল ও গ্রামবাসী পর্যন্ত জানে। আমাদের দুজনার অবাধে চলার ধরণ দেখে সবাই আগে থেকেই বলে আমাদের ব্যাপারে অনেক কথা। তাঁর প্রতি অবশ্য আমার কোন দুরবলতা নেই কিন্তু রিতা অন্য জনার সাথে কথা বলবে এটা আমি যেমন সহ্য করতে পারিনা তেমনি রিতাও সহ্য করতে পারেনা আমি যদি অন্য কোন মেয়ের সাথে কথা বলি।

সেদিন কার মত আমি কোন কথা না বলেই চলে আসি। সারারাত ভাবলাম শামীম ভাই কী সত্যিই আমার বান্ধবি রিতা কে পছন্দ করে। তাহলে তো আমি বড় রকম একটা কষ্ট পাবো। নাকি অন্য কারো কথা বলবে। কিন্তু অন্য কোন মেয়ের সাথে তো আমার কোন ঘনিষ্ঠতা নাই। আমি স্কুলে যাই ওর সাথে, সারাদিন স্কুলে সময় কাটাই ওর সাথে। আবার ফিরেও আসি রিতার সাথে।

ওর আর আমার ঘনিষ্ঠতা দেখে স্কুলের অন্য কোন মেয়ে আমাকে ডাকতেও ভয় পাই। কেউ যদি আমাকে ডাকে তবে রিতা তাকে আচ্ছা মত বকা দেয়, সেই ভয়ে ওইসব মেয়েরা আমার সাথে কথা বলতে ভয় পায়। এইসব ভাবতে ভাবতেই রাত ভোর হয়ে গেলো।

উঠে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষে শামিম ভাইয়ের স্টুডিও তে গেলাম। দেখি শামিম ভাই তাঁর স্টুডিওর পাশের যে ছাদ টা আছে তাতে বসে আছে। কী যেন ভাবছে, ওর মনটা আগের মতই বিচ্ছেদে ভরা। ভেবেছিলাম আমি জানতে চাইবো ওর ভালবাসার মানুষ টি কে। তাঁর নাম কী?

শামীমের গোমড়া মুখ টা খুবই বিশ্রী লাগে। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি শুনবোই যা বলবে অথবা যার নাম। আমি শামিম ভাইয়ের এই মুখটা দেখতে চাই না। তাঁর হাসি মুখ টা আমি দেখতে চাই সবসময়।

একবার ভাবি তো আরেকবার পিছায় যদি রিতার নামটা বলে তাহলে আমি মানতে পারবো না।

সেদিন স্কুল থেকে টিফিনে আমি আর রিতা পালিয়ে আসলাম মাদ্রাসার রাস্তা দিয়ে। মাদ্রাসাতে বসে বসে অনেকক্ষণ গল্প করার পর রিতা বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আমি বাড়িতে বইখাতা রেখে চলে আসলাম শামিমের দোকানে।

শামিমের মন সেই আগের মতই খারাপ। আমি পাশের কাটিং টেবিলে বসলাম। শামিম একমনে মেশিনে কাজ করেই যাচ্ছিলো। একবার আমার দিকে তাকালও না। কিন্তু প্রথমেই আমাকে ও দেখেছে যে আমি এসেছি। অন্যদিন আমি আসার সাথে সাথে হাজারো কথা বলতে শুরু করত। আমি খেয়েছি কিনা জিজ্ঞাসা করতো। দোকান থেকে কেক এনে আমাকে খাওয়াতও। আমিও বসেছিলাম যে কিভাবে ও থাকে কথা না বলে।

হটাত একটা অসহায় ফকির এসে ভিক্ষা চাইলো।

আমাকে অবাক করে দ্দিয়ে শামিম তাকে বলল, ভিক্ষা হবে না, যান তো!

এই কথা টা ওর মুখ থেকে আমি প্রথম শুনলাম। ওর সাথে পরিচয় হবার পর থেকে আমি দেখে এসেছি প্রতিদিনই দু-তিন জন কে ভিক্ষা দিতে। তবে এক টাকা দুই টাকা নই, একেক জন কে বিশ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত দান করতে। কখনও কাউকে ফেরাতো না। এমন কি আমাদের গ্রামে কিছু অত্যন্ত গরীব লোকজন ছিল। যাদের আয়-রোজগার নাই, কেবল মাত্র সরকারি ভাতাতে চলে। শামিম তাদের যথেষ্ট ভাবে সহযোগিতা করতো। তাদের যেকোনো প্রয়োজনে শামিম এগিয়ে যেতো সবার আগে। সেকারনে শামিম কে আমার অনেক ভালো লাগতো।

ও খুজে খুঁজে এমন দশটা পরিবারকে পালাক্রমে সাহায্য করতো প্রতিমাসে। যাতে তাদের সংসারে অভাব কিছুটা কমে যায়। এমন কি আরও তিনটি পরিবার ছিল যাদের সদস্যদের লেখাপড়া করানোর সামর্থ্য ছিল না বলে শামিম তাদের কে লেখাপড়ার খরচ দিতো।

এতো সদ্গুনের মানুষটি আজ কে এমন ব্যবহার করছে দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো। ফকির টাকে ডেকে আমি আমার বইয়ের মাঝে রাখা ৫০ টাকার নোট টা ধরিয়ে দিলাম।

ফকির টা যেতে যাবে এই মুহূর্তে শামিম নেমে গিয়ে ফকির টাকে বলল, টাকা টা ফিরত দেন, আমি আপনাকে অন্য টাকা দিচ্ছি বলে উনার সাথে আমার দেওয়া টাকাটা ফেরত নিল এবং উনাকে ১০০ টাকা বের করে দিলো। এবার ফকির টা চলে গেলো।

শামিম ভাই এসে আমার হাত থেকে ডায়রি টা নিয়ে তাঁর মধ্যে রেখে আবার আমার সাথে ধরিয়ে দিলো। আবার সেই আগের মত নিশ্চুপ। কোন কথা নাই।

আমি আবার বললাম কি ব্যাপার আমার দেওয়া টাকা টা ফেরত আনলেন কেন? ওটা তো আমি দিয়েছিলাম। আমার যাতে সওয়াব হয়। ফকির কে দিতে আমার কি ইচ্ছে করে না?

এবার আমার দিকে তাকাল, ফকির কে দেওয়ার অনেক সময় আছে। তুই কি ইনকাম করিস যে ফকির কে এতো করে টাকা দিবি। এটুকু বলে থামলেন তো থামলেন আর কোন কথা বললেন না।

আমি এবার টেবিল থেকে নেমে মেশিনে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড়ালাম। মেশিনের হুইল টা হাত দিয়ে ধরে জোর করে বন্ধ করে দিলাম, কি ব্যপার আমার সাথে কি কথা বলবেন না? আমি কি চলে যাবো?

আবারো কোন কথা বলল না, এবার আমি বললাম আমি আসলাম আপনার সাথে আপনার ভালবাসার মেয়েটা কে টা জানার জন্য। আর আপনি আমাকে সময় দিচ্ছেন না।কি বলবেন না? মেয়েটা কে?

এবার মেশিন বন্ধ করে আমার চোখের দিকে তাকাল। আমার চোখ কিছুটা ঝাপসা ছিল, শীতের সময়ও আমার কপালে ছিল ঘাম, গাল টা লাল হয়ে আছে, হাত-পা কাঁপছিল।

তারপরও আমি ভাবছিলাম, আমার সামান্যতম বিসর্জনে যদি মানুষটি তাঁর সৎগুনগুলো কে আরও বিস্তারিত করতে পারে, তাহলে হয়তো সমাজের অনেক বড় উপকারটি হয়ে যাবে।

আমার মনে হচ্ছিল যে আমি তাঁকে যে মনে মনে সাহায্য করতে চাইনি টা হয়তো শামিম জেনে আমার সাথে কথা বলছে না। এজন্যই মন খারাপ করে বসে আছে।

এবার সে হেসে ফেলল, তুই সত্যিই শুনবি, তাহলে উপরে চল।

উপরে আসার পর আমাকে বলল, ফিরোজা কে চিনিস কিনা তুই?

না তো ফিরোজা বলে তো কাউকে চিনি না। আমি অনেকক্ষণ ভেবে উত্তর দিলাম।

মাঝে মাঝে রিতার সাথে স্কুলে যায়। শামিম বলল।

আমি এবার চিনতে পারলাম হাল্কা করে, তবে নিশ্চিত না। তাই আমি বললাম, আমি মনে হয় তাঁকে চিনি না। আমি আপনাকে আগামি কাল কে জানায়।

ঠিক আছে কাল কে গিয়ে ভালো করে চিনে আসবি, পারলে একটু কথা বলে আসবি।

পরেরদিন স্কুলে গিয়ে রিতা কে ডাকলাম, স্কুলের ছাঁদে গিয়ে রিতা কে বললাম, তুই আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি?

হ্যাঁ বল কি কাজ ? অবশ্যই করব।

তুই ফিরোজা কে চিনিস? ঐ যে তোদের বাড়ির পাশে নাকি বাড়ি। আমি বললাম।

হ্যাঁ চিনি। তাই কি হয়েছে? তাঁর সাথে তোর কিসের প্রয়োজন? রিতা একটু রাগান্বিত স্বরে বলল।

আমি তাঁর দিকে সেভাবে নজর দিলাম না, বললাম তোকে ব্লা যাবে না। তুই শুধু তাঁর সাথে আমার কথা বলিয়ে দিবি?

এবার কিছুক্ষন কি যেন ভাবল, তারপর বলল, কিন্তু ওর ফ্যামিলির লোকজন তো ভালো না। ওরা একটু সন্ত্রাসী টাইপের। ওদের চিন্তা মাথায় থেকে ঝেড়ে ফেল, নাহলে কিন্তু তোর আর পড়াশোনা করে বড় হতে পারা লাগবে না। প্লিজ তুই ওর সাথে কথা বলতে যাস না। ওর বাবা কে সবাই ভয় পায়। এইসব আরও হাজার খানেক নেগেটিভ কথা শুনালো

আমি শুধু শুনলাম কোন কথায় বললাম না। ফিরে এসে শামিম ভাই কে বললাম, হ্যাঁ চিনতে পারছি, তবে একটা শংকার বিষয় হচ্ছে ফিরোজার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড খুব খারাপ। ওরা সমাজে সবার শংকার কারণ।

সেটা আমি ম্যানেজ করে নেবো, তোকে চিন্তা করা লাগবে না। তুই শুধু ফিরোজা কে একটু অনুরোধ করবি তাহলেই হবে।

আমি এবার সরাসরি বললাম, কিন্তু আমি কেন? তাছাড়া ও আমার কথা কেনই বা মানবে?

শামিম এবার আমার ডানহাত টা ধরল, তুই বললেই হবে, কারণ সব ছাত্রছাত্রীরা তোর প্রসংশা করে, তোর কথা সবাই মান্য করে, সেটা আমি ভালো করেই জানি। তুই প্লিজ আমার জন্য এইটুকু কর।

কি করে বুঝলেন? তাছাড়া আমার মনে হয় এসব ক্ষেত্রে নিজেকে বলাই ব্যাটার। আমি এইয়ুকু বলে থামলাম।

তুই জানিস, ওর পিছনে আমি প্রায় ছয় মাস ঘুরতেছি। আমি এর আগে চারজন কে দিয়ে অফার করেছি। ও সবাই কে নিষেধ করে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস তোর কথাতে কাজ হবে।

আমি এবার একটু জ্ঞান দেওয়ার মত করে বললাম, ও যতক্ষণ এতো জনার কথা মানেনি, তাহলে নিশ্চয় হয়তো অন্য কাউকে ভালবাসে।

শামিম বলল, আমি সবসময় ওর খোজ রাখি। অন্য কারো সাথে যদি ওর সম্পর্ক থাকতো তাহলে আমি অবশ্যই জানতে পারতাম। তাছাড়া ও ফিরোজা আমার পাঠানো সবাই কে বলেছে যে ওর কোন সম্পর্ক নাই। এজন্যই আমি ওকে চাচ্ছি। প্লিজ ভাই আমার আমার জন্য এইটুকু করবি না বল?

আমি এবার বললাম, ঠিক আছে, মেয়েটা কেমন স্বভাবের আমি একটু পর্যবেক্ষণ করি, তারপরে সময় মত জানেলেই হলো।

শামিম এবার আর কোন কথা বলল না, নীরব থাকলো, বুঝলাম ও ফিরোজা কে অনেক বেশি ভালোবাসে।

সেদিন ছিলো ৯ই ফেব্রুয়ারি, আমি প্রথম ফিরোজার সাথে কথা বলি। সাথে রিতা ছিল। রিতার সহয়তাই আমি ওর মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমি, রিতা কে বলেছিলাম ওকে ছুটির পর বাড়িতে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিতে, যাতে আমি কথা বলতে পারি।

রিতা প্রথমে আমার অপর খুব রেগে গিয়ে ছিল, আর কান্নাও করেছিলো অন্য কিছু ভেবে।

আমি পর ওর ভুল ভাঙালাম, তখন ও খুশি হয়ে আমাকে সহয়তা করার প্রতিঙ্গা করলো। কিন্তু রিতা বারবার সাবধান করেছিলো যে ফিরোজা মেয়ে হিসাবে ততটা ভালো না। ওর থেকে দূরে থাকাই শামিম ভাইয়ের জন্য ভালো হবে। তাছাড়া ফিরোজা এবং শামিম ভাইয়ের পরিবারের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে।

আমি বললাম, শামিম ভাই কে আমি এব্যাপারে অনেক বলেছি, কিন্তু কোন কথা কানে তোলেনি। কারণ শামিম ফিরোজা কে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসে।

সেদিন আমি, রিতা এবং ফিরোজা মাদ্রাসার রাস্তা ধরে আসার সময় ফিরোজা কে বলেছিলাম যে তুমি কাউকে কি পছন্দ করো কিনা?

ওর উত্তর দেওয়ার দেওয়ার প্রসঙ্গ টা আমার ও রিতা কারই ভালো লাগেনি। রিতা তো রেগেই যাচ্ছিলো তবুও আমি ওর হাতে চিমটিয়ে ওকে শান্ত হতে বললাম। ওর অনেক দোষ ছিল যেটা ওর সাথে সামান্য কথাতেই বুজতেছিলাম। তারপরেও আমি ওর ভালো কোন দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি বারেবারে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। ওর পিছনে আমি তিন দিন সময় দিলাম ওকে ভালো করে জানার জন্য।

ওর সাথে সময় দেওয়ার জন্য রিতা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। রিতা আমার সাথে কথা না বললে আবার আমার কোন কিছুই ভালো লাগতো না। আবার দেখি রিতা শুধু কান্নাকাটি করে।

এভাবে আরও একটা দিন চলে যায়, ফিরোজার পিছনে আমি চারদিন ব্যয় করি। কিন্তু কোন রকম সন্তুষ্টি কর কোন কিছুই পেলাম না। মনে মনে খুবই হতাশ হলাম। একবার ভাবলামও যে শামিম ভাই কে এই রকম ভুল পথে যেতে আমি দেব না। অবশ্যই আমাকে ওকে ফেরানো লাগবেই।

ফিরোজা অহংকারিতাই পরিপুষ্ট। আসলে স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে। বাবা মোঃ হামজাদ বিশ্বাস থাকেন দক্ষিণ আফ্রিকাতে। অনেক টাকা বেতন পান। দাদু আকু বিশ্বাস। চাচারাও সমাজের প্রভাবশালী লোক। সমাজের লোকজন তাদের দেখে ভয় করে। অল্প কিছুতেই মারামারিতে জড়িয়ে পরাটা ওদের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালবাসা যে তাদের মধ্যে অনুপস্থিত টা সহজেই বোধগম্য।

আমার কোন দিকটাই ভালো লাগলো না। ফ্যামিলির লোকজনের অল্প কথা কাটাকাটিতে খুনখারাবি আমাকে ভবিষ্যতের অশুভ ঘটনাকে ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

১৩ই ফেব্রুয়ারী, আমি ও ইমরান আমাদের বাড়ির পাশের ভৈরবের বাঁধের সিঁড়িতে বসে আছি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। হটাত শামিম ভাই হাজির। আমাকে এবং ইমরান কে বলল, চল আমার স্টুডিও তে বসে বসে গল্প করবো। তিন জনা একসাথে রওনা দিলাম। শোভন দের বাসার কাছে আসতেই ইমরানের ডাক পড়লো, ইমরানের বড় বাবা মান্নান বিশ্বাসের থেকে। ইমরান চলে গেলেয়ামি এবং শামিম ভাই স্টুডিও তে আসলাম।

কী বুঝলি এই কয়দিনে? শামিম ভাই আমাকে খুব আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করলো।

ভালো কিছুতো দেখলাম না, তাছাড়া মেয়ে খুব একটা ভালো স্বভাবের না। আপনি বরং ওর কথা বাদ দেন। তাছাড়া কতো মেয়েকে আমি দেখেছি যারা আপনার জন্য পাগল। ঐ যে চুয়াডাঙ্গার মেয়েটি কি যেন নাম, ঐ ঐ শ্যামলী, তাঁর চেহারা কত সুন্দর, বরং আপনি তাঁকে ভালবাসেন। মেয়েটা অনেক ভালো আমি খোজ নিয়ে দেখেছি।

ধুইইইত, বাদ দে, শ্যামলী আমার বন্ধু। সারাজীবন বন্ধু হিসাবে রাখতে চাই ওকে। শামিম বলে থামল।

কিন্তু শ্যামলী তো আপনাকে খুব ভালোবাসে এবং আপনাকে পেতেও চাই আপন করে। আমার সাথে কথা হয়েছে।

কিন্তু আমি তো ফিরোজা কে ভালোবাসি। তাঁর দৃঢ় কণ্ঠের জবাব। আর আমার এও বিশ্বাস ফিরোজাও একদিন না একদিন আমাকে ভালবাসতে শুরু করবে।

আল্লাহ্‌ আপানার আশা যেন পূরণ করেন। আমি মনে মনে এই দোয়া করলাম।

শামিম আবার কাকুতিধরা হাত আমার হাত দুতিকে একসাথে করে বলল, কাল কি দিবস বল দেখি।

ভালোবাসা দিবস সেটা আমি জানি। কিন্তু ওসব নিয়ে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। আমার ভালবাসার প্রতি কোন দুর্বলতা নেই।

তোর আগ্রহ থাকার দরকার নাই। তুই শুধু শেষ বারের মত আমার একটা কাজ করে দিবি কিনা বল তো?

ফিরোজা কে কি কিছু বলা লাগবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

হ্যাঁ বলা লাগবে, তবে ওভাবে বললে কোন কাজ হবে না। ওকে ভালো ভাবে বলতে হবে বুঝলি? কালকের দিনটি ভালবাসার কথা বলার জন্য বেস্ট। আমি ভেবেছি ওকে একটা সুন্দর দেখে ডায়রি গিফট করবো। ডায়রির প্রথম কয়েকটা পেজের মধ্যে আআমি আমার মনের কথা গুলো ভালো করে লিখব। যাতে বোঝাতে পারি আমি তাঁকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি।

সেতো ঠিক আছে, কিন্তু মেয়েটিকে আমার একদম পছন্দ হয়না। ওকে চেইঞ্জ করা যায় না? আমি শেষ বারের মত চেষ্টা করে দেখলাম।

তোর পছন্দ হওয়া লাগবে না। তুই কি প্রেম করবি নাকি যে তোকে পছন্দ করতেই হবে? তুই শুধু আমার জন্য এই শেষ কাজটি করে দে। এখন বল ডায়রি তে কি লিখা যায় এমন?

আমি এবার বললাম কিন্তু ডায়রি কয়?

কেনা লাগবে, শামিম বলল। চল ইমরানের দোকানে যায়। তখন আমার বন্ধু ইমরানের কসমেটিক্স এর দোকান টি পিরোজপুর মন্দির ঘর থেকে ৫০ গজ উত্তরে ছিল। যেটা এখন অবশ্য কমরপুর শিফট করেছে।

যাই হউক কথা বলতে বলতে ইমরানের দোকানে চলে আসলাম, সুন্দর দেখে একটা ডায়রি নিলাম এবং গিফট পেপার এবং পানি টেপ নিলাম।

১৩ই ফেব্রুয়ারী রাত সাড়ে বারোটার সময় আমার অনেক বড় অনিচ্ছা স্বত্তেও ঐদিন সেই ডায়রির প্রথম পাতাটি এভাবে লিখেছিলাম শামিম ভাইয়ের হয়ে।

ফিরোজা,

তোমাকে খুব “প্রিয় ফিরোজা” বলে লিখতে ইচ্ছে করছিলো। তবে পারলাম না এজন্য যে তুমি এখনও অনুমতি দাওনি। তবে তোমার অগোচরে ঠিকই আমি তোমাকে প্রিয়, জান, জানু, আরও কতো নামে ডাকি, তুমি হয়ত সেগুলো জাননা।

জানিনা তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো কিনা? তবে শুধু এতোটুকু বলবো, আমি তোমাকে আমার নিজের জীবনের চেয়েও হাজার গুন বেশি ভালোবাসি। আর আগামিতে ভালবাসবো। আজ বিশ্বভালবাসা দিবস, এইদিনের মহারথ অনেক শুনেছি। প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। তোমার ভালোবাসা আমার চারপাশ ঘিরে থাকে। আমার প্রতিটি ভোর হয় তোমাকে ঘিরে, প্রতিটি সকাল হয় তোমাকে ভেবে। আমার জীবনে সূর্যের উদয়-অস্ত সব কিছু ঘটে তোমাকে ভেবে ভেবে। তোমাকে না পেলে হয়ত আমার বেচে থাকাটায় অর্থহীন হবে।

শিলন কে দিয়ে ডায়রি আর ভালবাসার গোলাপ পাঠালাম, গ্রহণ করো। অন্তত শিলনের কথাটা রাখো। আমাকে ফিরিয়ে দিওনা।

ইতি

তোমার ভালোবাসা প্রত্যাশী

শামিম রেজা



তারপর গিফট পেপার দিয়ে মুড়ে দিলাম। ঐদিন রাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায় পরের দিন উঠতেও দেরি হলো। পরদিন অর্থাৎ ১৪ই ফেব্রুয়ারি সকাল সকাল শামিম আমাকে ডাকতে আসলো।

আজকে শামিম ফজরের নামাজ পড়েছে কিন্তু আমি পড়িনি। মাথায় টুপি ছিল ওর তাই আমি সহাস্যে বললাম, মানুষের প্রয়োজন যখন তীব্র হয় তখনি আল্লাহর স্বরানাপন্ন হয়। এটা ঠিক না। প্রতিদিনই নামাজ পড়া উচিত প্রত্যেক মানুষের।

হয়েছে হয়েছে আর হুজুরি করা লাগবে না। তাছাড়া মানুষ প্রয়োজনে আল্লাহ্‌ কে স্বরন করবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে তোকে একটা কথা আমি দিতে পারি, সেটা হল ফিরোজা যদি আমাকে ভালোবাসে তবে আমি পাচ ওয়াক্ত নামাজ পরবো।

ইনশা-আল্লাহ বলুন। আমি আবারো জ্ঞান দিলাম।

শামিম এবার জোরে ইনশা-আল্লাহ বলে উঠল। নে নে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যা। আর শোন যেভাবে বলার দরকার ঠিক সেভাবেই বলবি। ওকে।

আমি বললাম কিন্তু কামারের দোকানে ওয়াজ করে কি কোন লাভ হবে?

শামিম বলল, মাঝে মাঝে কাজ করে কারো কথাতে, এজনই তো তোকে দিয়ে বলানো। শোন নেগেটিভ চিন্তা করিস না। তাছাড়া এটাই তো আমার শেষ প্রচেষ্টা নয়। আমি যতদিন বাঁচবো, আর যতদিন ও আমাকে ভালো না বাসবে ততদিন চেষ্টা করেই যাবো।

বাব্বাহ! ইতনা পেয়ার কাহাছে আয়া মেরা ব্রো ? বলে আমি থামলাম।

ওসব পরে বলব, আগে দ্রুত যা, না হলে আবার অন্য কারো ভালোবাসা গ্রহণ করে ফেলবে।

স্কুলে পৌছাতেই রিতা আমাকে মাঠের মাঝ দাড় করাল, একটা বকুল ফুলের মালা আমার গলাতে দিলো। মুখে আরও কয়েকটা কথা বলেছিল। ফিরোজা ও শামিমের ব্যাপারটা মাথায় গিজগিজ করছিলো বলে একটা কথাও মাথায় ঢুকল না।

আমি শুধু রিতা কে বলেছিলাম, চল না টিউবওয়েল এর কাছে যায়।

ও কিছু টা খুশিই হয়েছিল, কেন খুশি হয়েছিল টা বুঝতে পারিনি। রিতা এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলো। আমরা দুজন টিউবওয়েলের কাছে এলাম। ওকে রেখে আমি ছেলেদের বাথরুমের পাশের কাঁঠাল গাছটার নিচে এসে অনুসন্ধানি চোখে দাঁড়ালাম। খুজতেছিলাম ফিরোজা কে।

এবার রিতা আমার পাশে এসে দাঁড়াল, কিরে আমাকে টিউবওয়েলের কাছে ডেকে এনে একা রেখে চলে আসলি? তুই তো অনেক...

কথা শেষ না করতেই আমার হাতের বইয়ের মাঝে রাখা ডায়রি গিফট পেপার দিয়ে মোড়ানো ছিল সেটা দেখে ফেলল। জানিনা খুশি হয়েছিল কি ভেবে। তবে আমি এবার রিতার দিকে তাকালাম, ওর গাল লাল হয়ে গেছে।

আমার একটা উপকার করবি। আমি অনুমতি চাইলাম।

কি ব্যাপার কোন কিছু চাওয়ার জন্য আজ আমার অনুমতি চাচ্ছিস। অন্যদিন যে আমার সাথে জোর করে নিস, আজ কি এমন উপকার। যার জন্য অনুমতি দরকার? রিতা বলে থামল।

আমি বললাম, ফিরোজা মানে ঐযে ক্লাস সেভেনে পড়ে তোদের বাড়ির পাশে বাড়ি। ও কি আজ স্কুলে এসেছে জানিস?

মুখটা কেমন যে ভার হয়ে গেলো। তবে মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে যাচ্ছে। ও এবার বলল, কেন? ওকে কি প্রয়োজন। আমাকে কি বলা যাবে না?

আমি বললাম, না তোকে বলাআ যাবে না, ও এসেছে কিনা শুধু তাই বল।

ফিরোজা আর আমি একসাথেই এসেছি। ফিরোজা স্কুলের পিছনের বাগানে আছে। কিন্তু কি বিষয় আমি শুনবো? আমাকে বলতেই হবে।

আমি আবারো বললাম, না এখন বলা যাবে না। তবে কাজ হলে অবশ্যই তোকে সবার আগে বলব।

রিতা আমার হাত ধরে জোরে টানাটানি করছিলো আর বলছিল, বলবি না মানে! তোকে বলতেই হবে। আমি শুনবো যে, এবং এই মুহূর্তে শুনবো। এমন ভাবে টানাটানি করছিলো যে একসময় আমার হাত থেকে বইগুলো সব পড়ে গেলো। ডায়রি টা পড়লো ওর সামনে গিয়ে।

ডায়রির ওপরে লাভ সিম্বলের মাঝে সুন্দর করে ফিরোজা লেখা নামটা ও কিছুসময়ের জন্য দেখার পর ওর ব্যবহার চেইঞ্জ হয়ে গেলো। চোখ দুটি ছলছল করছিল। আমি তেমন একটা আমলে নিলাম না। বইখাতা গুলো গুছাতে থাকলাম। রিতা ডায়রিটা আমার হাতে দিয়ে দ্রুত চলে গেলো।

কিছু বলল না রিতা এবং আমিও কিছুই বুঝলাম না। আসলে তখন আমার মাথায় একটা টেনশন কাজ করছিলো। তাই রিতার রাগ করার বিষয় নিয়ে কিছু ভাবলাম না।

কিছুক্ষণ পরেই আমি লক্ষ্য করলাম যে ফিরোজা নিজেই হাজির হলো আমার সামনে। পড়ে অবশ্য ফিরোজা আমাকে বলেছিল যে আমি নাকি ওকে ডাকছি। আমি মনে মনে রিতাকে একটা ধন্যবাদ জানালাম।

ফিরোজা আমার কাছে আসলো সাথে ছিল ওর কিছু ক্লাসমেট। আমি ফিরোজা কে বললাম, ফিরোজা আমি কি তোমার সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারি?

হ্যাঁ অবশ্যই ভাইয়া বলুন কি বলবেন? ফিরোজা বলল।

এখানে না, তোমাকে একা একা বলব। আমি বলে থামলাম।

ফিরোজা ওর বান্ধবি গুলো কে ওখান থেকে যেতে বলল।

ওর বান্ধবি গুলো চলে গেলে বলল, হ্যাঁ ভাইয়া বলুন কি বলবেন?

আমি এবার খুব আস্তে করে বললাম, ডায়রিটা ধরো, বাসায় গিয়ে পড়বে। এই এই গোলাপ টা রাখো। এখন আসি আস্ল কথায় মনোযোগ দিয়ে শোন।

শামিম যে তোমাকে খুব ভালোবাসে তুমি কী টা জানো? আর একটা কথা শামিম খুব ভালো ছেলে। ও তোমাকে অনেক সুখে রাখবে। ওকে তুমি ভুল বুঝ না। একনিশ্বাসে বলে থামলাম।

ফিরোজা কিছু একটা বলতে চাইছিল, আমি তাঁর দিকে না তাকিয়েই বললাম, তুমি জানো খারাপ ছেলেদের সাথে অন্তত শিলন মিশবে না। ওর মাঝে অনেক গুন আছে। ও স্বাবলম্বী তোমার সকল চাহিদা অবশ্যই পূরণ করবে।

এতক্ষণ আমি অন্য দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলাম তাই ফিরোজার চোখের দিকে তাকানো হয়নি। এবার আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের লাভা উদ্গিরন হচ্ছে।

এবার ফিরোজা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনি, আপনি ওর হয়ে দালালি করতে এসেছেন। আচ্ছা একটা কথা বলেন তো ওই কুত্তাটার দালাল কতজন আছে? শোনেন আপনি অনেক ভালো ছেলে এটা গোটা গ্রামের ছেলে মেয়েরা জানে। সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করে। আপনার কথা মান্য করে। শিক্ষকেরা আপনাকে খুব ভালোবাসে। আপনার সব কথার মুল্য দেয় বলে যে আমি আপনার কথা মেনে চলব তেমন টি ভাবা কিন্তু আপনার জন্য বোকামি করা হবে। আপনি এই স্কুলের সবার আকাঙ্ক্ষিত ছাত্র বলে আমি আপনাকে বেশি অপমান করলাম না। অন্য কেউ হলে আমি এই দালালি করার জন্য জুটা পেটা করতাম। তবে আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি যদি ওই কুত্তাটার বিষয়ে আমাকে দ্বিতীয় বার কেউ এসে কোন কথা বলী তবে কিন্তু আমি আপনাদের কাউকে ছারব না। আমার বাইরের রূপটা দেখেছেন, ভিতরের রূপটা এখনও দেখেন নি। যান সামনে থেকে। আরও অনেক গুলো বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়েছিল যেটা অবর্ণনীয়।

আমি প্রচণ্ড অপমানে নিজেকে খুব ছোটো মনে হচ্ছিল। চোখ ছিটকে জ্বল আসতে চাচ্ছিল। তবে একটা কথাও আমি বলতে পারিরনি। শুধু ভাবছিলাম এই গালি-ঝড় কখন থামবে। এজন্য নীরবে সব সহ্য করতেছিলাম। জানি এই মেয়ে বড়দের সম্মান করতে জানেনা। ওইদিন ক্লাস না করেই বাড়ি চলে এসেছিলাম। রিতার মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করলাম না।

শামিম কে এসে কথা গুলো জানালাম। শামিম কিছুক্ষণ দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাদতে থাকলো। কতক্ষণ কেদেছিল জানিনা তবে আমার কানে আসরের আজান ভেসে আসলো।

এবার শামিম এসে দরজা খুলল একটু খানি হাসি মুখে। শামিমের অসীম ধৈর্য শক্তি। আমার নিজেকে ছোটো লাগছিল শামিম ভাইয়ের কাছে এই ভেবে যে আমি শামিমের জন্য কিছুই করতে পারলাম না।

আমার ঘাড়ে শামিমের হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম, চিন্তা করিস না, এখন বাড়ি যা। আমিও বাড়ি যায়।

বাড়ি আসার পর একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। এভাবে ঘণ্টা খানেক ঘুমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম কিন্তু ঘুমাতে পারছিলাম না। হটাত রিতা ও ওর মামাতো বোন রুমি আমার বাড়িতে আসছে দেখতে পেলাম। বাড়ি থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলাম। লজ্জায় নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করলাম, ব্যর্থ হলাম।

রিতা এসেই আমার হাত টা শক্ত করে ধরল, সরি রে আমি তোকে ভুল বুঝে ছিলাম। আমাকে ক্ষমা কর প্লিজ। আমি ফিরোজার এক বান্ধবির কাছ থেকে সব শুনেছি। ফিরোজা কে আমি অনেক বোকা দিয়েছি তোকে অপমান করার জন্য। ওর সাথে স্কুলে আমার একটা বিরাট ঝগড়া করেছি। তুই তো চলে এসেছিলস তুই কিছুই জানিস না। এমন কি মোনাজাত স্যারও ফিরোজা কে অনেক বোকা দিয়েছে তোকে অমনভাবে অপমান করার জন্য।

তবে শামিমের উদ্দেশ্যে একটি কথা তোকে বলতে চাই, যেহেতু ফিরোজা শামিম কে ভালবাসতে চাচ্ছে না সেহেতু শামিমের উচিৎ হবে ওদিকে বেশি পা না বাড়ানো। তাছাড়া আবারো বলি মেয়েটা খুব একটা ভালো না এবং ওদের ফ্যামিলির লোকজন খুব খারাপ। ওরা শুনলে শামিম কে দিনে দুপুরে কুপিয়ে মেরে ফেলবে।

এবার রুমি বলে উঠলো দেশে কি মেয়ে মানুষের আকাল পড়েছে যে ওকেই শামিমের ভালবাসতে হবে। আমাদের ক্লাসের সাথি শামিম কে খুব ভালোবাসে। তার সাথে প্রেম করতে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া রিতা যেটা বলল, আমিও সেটাই বলব যে এই দিকে আর বেশি হাটা উচিৎ হবে না।

আমি এবার বললাম; তুই কি মনে করিস আমি এই কথাগুলো ওকে বলিনি। ওকে আমি অসংখ্য বার বলেছি। ও কি উত্তর দিয়েছে জানিস, ও বলেছে; ওর ভালোবাসা দিয়ে ফিরোজার পরিবারের সবাই কে সমাজে ভালো মানুষ করে ছাড়বে।

রুমি এবার বলল, তবে তোর উচিৎ হবে ওসব ব্যপার থেকে তোর নিজেকে দূরে রাখা। তাছাড়া এই ব্যাপার টা নিয়ে আজকে তোকে ফিরোজার মত একটা থার্ড ক্লাস মেয়ে তোকে অতগুলো অপমান করলো।

আমি বললাম, ঠিক আছে।

রিতা বলল, যদি আজ তুই আগে থেকে ওকে ঐ কথা গুলো না বলতি তবে আমি ওকে স্কুলেই মেরে ফেলতাম। এতো বড় সাহস ও তোকে অপমান করেছে।

আমি আবারো বললাম, ঠিক আছে ঠিক আছে। তোরা ওর সাথে আর ঝগড়া করিস না।

সেদিন থেকে ফিরোজার ছায়া আমি মাড়াতে নারাজ। এভাবেই আমার একদিন এসএসসি পরীক্ষা চলে আসলো। বাড়ির বাইরে তেমন কোথাও একটা যায়না। মন লাগিয়ে পড়াশোনা করলাম। পরিক্ষার মধ্যে ঐ বিষয়ে শামিমের সাথে কোন কথা বলিনি।

এসএসসি পাশ করার পর আমি আর শোভন ঢাকার একটি কলেজে ভর্তি হলাম। এবার বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগের জন্য মোবাইল পেলাম। শামিমের সাথে আমার আবার আগের মতই কথা হতে লাগলো। শামিম প্রতিদিন গড়ে ৫/৬ ফোন করে খোঁজ নিতো। আমি ফিরোজার ব্যাপার টা চেপে যেতাম। মনে মনে অল্প অল্প খুশিই হতাম এই ভেবে যে শামিম হয়ত ঐ অহংকারী মেয়েটার কথা ভুলে গেছে।

আমার খুশির কারণ ছিল এটা ভেবে যে, শামিম ফিরোজার পিছনে দৌড়ানো বাদ দিয়েছে। ঐ মেয়েকে নিয়ে শামিম জীবনেও সুখি হতে পারবে না। ওই মেয়ে কাউকে সম্মান দেখাতে পারেনা। আবার আমিও ওকে বলতাম না, পাছে যদি ফিরোজার কথা ভেবে আবার সামান্য কষ্ট পাই। এজন্যই তাঁকে আমি মনে করিয়ে দেয়নি কখনও।

কিন্তু এখন শামিম কে অনেক খুশি খুশি লাগছিলো। আমি ভাবলাম যাক ফিরোজার ভুত মাথা থেকে গেছে। আসলে মেয়েটা একটা কুফা। কী বেয়াদব মেয়ে রে বাবা! স্কুলের বড় ভাইদের সন্মান করে কথা না বলুক অপমান করা কি উচিদ। আমি নিশ্চিন্ত হলাম ফিরোজার ভুত তাহলে নামছে। আমিও নিজে নিজে ভাবলাম ফিরোজার ব্যাপারে ওকে জিজ্ঞাসা করে আর মনে করিয়া দেবো না। যত ভুলে যেতে পারবে ততই ভালো।

এভাবে দুতিন দিন কথা বলার ফাকেই আমাকে এবার জিজ্ঞাসা করলো, কিরে ফিরোজার ব্যাপার তো একবারও জিজ্ঞাসা করলিনা? তোর ভাবির কথা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি?

আমার মেজাজে ১৮০ ডিগ্রী তে উঠে গেল, যা-তা ভাষায় আমিও গালি শুরু করলাম। ও একটা অহংকারী মেয়ে ও জীবনেও কারো ভালোবাসা পাবেনা। আমাকে থামিয়ে দিয়ে শামিম বলল, চুপ, ও লাইনে আছে সব শুনতেছে।

আমি একটানে বলেই যাচ্ছি শুনুক। শোনানোর জন্যই তো বলা।

হটাত অপর পাশ থেকে মেয়ের কণ্ঠ আমার সংবিৎ ফিরে আসলো, ভাইয়া আমাকে ক্ষমা করবেন না? ফিরোজার প্রশ্ন।

আমি তখনি লাইন টি কাটার জন্য এক সেকেন্ডও দেরি করি নাই। মনে মনে ভীষণ সংশয় জমা হতে থাকে। গভীর ভাবতে থাকি যে সত্যিই কী এখন ফিরোজা শামিম কে ভালবাসতে শুরু করেছে নাকি আবার কোন চক্রান্ত করেছে। ওকে তো আমার এক বিন্দুও বিশ্বাস হয়না। অনেক কিছু ভাবলাম, এই ভালবাসার অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে। কোন সমাধানে আমি আসতে পারলাম না। তবে মনে একটা আক্রোশ ভর করে, এই মেয়ের হাত থেকে শামিম ভাই কে বাঁচানো যাবেতো।

সেইদিন সন্ধ্যার খানিক টা আগে মোহাম্মদপুর বাবার রোডের ২১/২ নারী উদ্যোগ কেন্দ্রের ছাত্র হোস্টেলের ছাঁদে বসে ছিলাম। পাশে ছিল আমাদের বিভাগেরই সিনিয়র ভাই তুহিন বালা। যার বাড়ি গোপালগঞ্জ। হটাত শামিম ভাই আমাকে ফোন করলো, কিরে তখন ওভাবে কেটে দিলি কেন? তোর ভাবি কি ভাববে বলত দেখিনি?

যা মনে করার করবে। আমি বললাম একটু রাগের ভাষাতে। তবে আমি ওর সাথে কথা বলতে পারবো না। আর ওর বিষয়ে আমার সাথে কখন আলোচনা করবেন না।

ও...... বুঝেছি, তোর রাগ এখনও পড়েনি তাইতো। তবে তুই কি জানিস ওইদিন তোকে অপমান করার পর থেকে ও অনেকের কাছে বকা শুনেছে। প্রত্যেক শিক্ষকেরা নাকি ওকে বকা দিয়েছে। ও ভীষণ অনুতপ্ত। তোর কাছে ক্ষমা প্রার্থী। ওর বলাতেই তো তোর সাথে তখন কনফারেন্স করেছিলাম। ও খুব লজ্জিত। তুই ওকে ক্ষমা করে দে প্লিজ। ও খুব ভালো মেয়েরে। তুই তো বলেছিস কেউ ক্ষমা চাইলে তাঁকে যেকোনো মুল্যে ক্ষমা করা উচিৎ, সে যত বড়ই অপরাধ করুক না কেন। ও তোর ক্ষমা পাওয়ার আশায় আছে। ও আসলেই খুব ভালো মেয়ে। তুই একবার কথা বলে দেখ না?

আমি মনে মনে বললাম, ভালো না খারাপ সেটা আমি প্রথম দিনেই বুঝেছি।

কিরে আস্তে আস্তে কি বলিস? শামিম প্রশ্ন করল।

শোনেন আমার বিশ্বাস ওই মেয়ে আপনার সাথে অভিনয় করছে। আমি জোর দিয়েই বললাম।

শামিম বলল, বলিস কি, তোর মাথা ঠিক আছে তো?

আমি বললাম, আমার মাথা ঠিকই আছে তবে আপনার মাথা পুরটাই ওই বেটি খাইছে।

সম্মান দিয়ে কথা বল। ফিরোজা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তার হাজারটা প্রমাণ ইতিমধ্যে সে আমাকে দিয়েছে। তুই ওকে নিয়ে আর এভাবে সন্দেহ করিস না। শামিম আমাকে ইঙ্গিত দিয়ে বলল।

আমি এবার একটু নরম গলায় বললাম, কিন্তু এটা সম্ভব হল কি করে?

শামিম এবার বলল, তোদের স্কুলের সুমন কে চিনিস কিনা। যে ফিরোজাদের সাথেই পড়ে। ঐ যে রেজাউল করিম রিপন আছে না, তার ছোটো ভাই। তার মাধ্যমে এই গেলো ১৪ই ফেব্রুয়ারী তে বলিয়েছিলাম। সুমন তো ওকে রাজি করিয়ে ফেলেছে।

আমি এবার বুঝলাম ব্যাপারটা কতটা খারাপের দিকে এগুচ্ছে। ঐ ব্যাটা সুমন তো জীবনেও ভালো ভাবে কোন মানুষের উপকার করতে জানে না। ছেলেটি অনেক খারাপ। সুমন আগে অন্য একটা স্কুলে পড়তো, সেখান থেকে অনৈতিক কাজ করার জন্য সেখান থেকে বহিস্কার করেছে। তাছাড়া প্রথম দিন এসেই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। রিতা কে ভালবাসার প্রস্তাব দিয়েছিল। রিতা অবশ্য সাথে সাথেই অনেক কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। পরে রিতার সাথে ঘোরার জন্য আমাকে ওর বন্ধুদের দিয়ে একবার পথ আটকায়ে ছিল। সেবার রিতা এসে ওকে কসে গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলেছিল যে, শিলনের কোন সামান্য ক্ষতি করলে কিন্তু খবর আছে।

তারপরে আবার রিতার চাচাতো ভাই বাবু এবং চুটুক ভাইকে আমার ও রিতার নামে অনেক কুরুচি পূর্ণ কথা প্রচার করেছিল। যেটা পুরগ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছিল ঐ সুমন। এজন্য একবার বাবু ভাইয়ের সাথে আমার একবার কথা কাটাকাটি হয়েচ্ছিল। সেবারও রিতার হস্তক্ষেপে বিষয় টি সমাধান করে হয়। এইসব কারণে রিতার কাছ থেকে আমি নিজেই দুরত্ব বাড়িয়ে ফেলি। আমার পরিবার ও রিতার পরিবারের ব্যাপক ফারাক আমাদের বন্ধুত্বে দুরত্ব বাড়ায়। অবশ্য ওর ফ্যামিলির লোকজন আমাকে খুব ভালোবাসতো। রিতার বাবা বাবলু বিশ্বাস আমাকে খুব স্নেহ করতো। এইজন্য কোন রকম নেগেটিভ কথা যাতে কেউ বের করতে না পারে সেজন্য আমি ঢাকাতে চলে আসি। তাছাড়া রিতা শেষের দিকে এসে আমার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা করতে লাগলো, যেটা সমাজের কিছু লোক অন্য ভাবে দেখতে লাগলো। আমিও ভাবলাম মানুষের মুখের কথা বন্ধ করতে হলে অবশ্যই আমার গ্রামে থাকা চলবে না।

আমার জীবন থেকে রিতার দুরত্ব সৃষ্টির মুলে কিন্তু সুমন ছিল। বড় একটা ক্ষতি শামিমের করে ফেলবে এটা বুঝতে বাকি রইল না। আমিও মনে মনে পণ করলাম, আসল ঘটনা কী আমাকে জানতেই হবে। সুমন ও ফিরোজা দুজনের কেউই ভালো না। এর সত্যিটা কি আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য আবার আমাকে বাড়িতে যাওয়া লাগবে।

কিন্তু এর মধ্যে তো আমার কোন ছুটি নেই। তার উপরে আবার আমি সাইন্স নিয়ে পড়ি। চার টা সাবজেক্টের টিউশন নেওয়া লাগে। কিভাবে কিভাবে, আমি ভাবতে লাগলাম। আমাকে যে করেই হউক ছুটি ম্যানেজ করা লাগবে। শামিম ভাই কে ওই ডাইনি এবং শয়তান ছেলেটার হাত থেকে রক্ষা করতেই হবে।

এভাবে আরও সপ্তাহ খানেক পার হয়ে গেলো। এরমধ্যে প্রতিদিনই শামিম ভাইয়ের সাথে ৪/৫ বার কথা হয়। তার প্রতিটি কথাতেই ফিরোজা কে নিয়ে। আজ এই করলাম, কাল ঐ করলাম, ফিরোজা এটা বলল, সেটা করল, সেটা বলল; ইত্যাদি ইত্যাদি।

মাঝে মাঝে আমাকে সাথে নিয়ে ফিরোজার সাথে কনফারেন্স করে কথা বলতে চেয়েছে। প্রতিবারেই আমি কোন না কোন অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছি।

কিন্তু কয়েকদিন পর একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসলো, অপর পাশ থেকে একটি মেয়ে কণ্ঠে বলল, আমি কি শিলন ভাইয়ার সাথে একটু কথা বলতে পারি?

আমি বুঝতে পারলাম এটা ফিরোজা, কেটে দিতে চাইলেও ভাবলাম এটা অভদ্রতা হবে, বিধায় বললাম, হ্যাঁ বলে পারেন। তবে এক মিনিটের বেশি নয়। আমি এখন প্রাইভেটে আছি।

ঠিক আছে তাহলে আমি বরং রাত্রে ফোন দেই তখন আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলব।

বুঝলাম মেয়েটি যথেষ্ট চতুর টাইপের, অনেক বুদ্ধিমান। ঠিক আছে বলে আমি রাখলাম। যদিও আমি তখন সম্পূর্ণ ফ্রী ছিলাম।

রাতে ৯ টার দিকে ঐ নাম্বার থেকে ফোন আসলো, আমি ধরলাম না। এভাবে বার পাঁচেক সাইলেন্স করলাম। কিছুক্ষণ পর শামিম ভাইয়ের ফোন এলো, কিরে, ফিরোজা তোকে এতবার ফোন দিচ্ছে ধরিস না কেন?

আমি বললাম, বাথরুমে গিয়েছিলাম। মিথ্যা বললাম।

ঠিক আছে তাহলে এখন কথা বল, ফিরোজা লাইনে আছে। শামিম বলল।

আমি কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম আকস্মিক ফিরোজার কনফারেন্সে থাকার কথা শুনে। ফিরোজা এবার বলল, শিলন ভাইয়া, সেদিনের ব্যবহারের জন্য আজো আমি অনুতপ্ত। প্লিজ আমাকে আপনার ছোটো বোন মনে করে ক্ষমা করে দেন। আর আপনি গ্রামে আসেন আপনাকে আমি বড় ভাইয়ের মত সম্মান করে আপান্র পা ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করবো। প্লিজ ভাই আপনি আমাকে আপনার ছোট বোন ভাবেন আজ থেকে। তখন বুঝেছিলাম না তাই আমি আপনাকে অনেক কথা বলে ফেলেছিলাম। আমি সেইদিন থেকেই খুব অনুতপ্ত।

আমি বুঝলাম আমাকে ইমশনালি ব্লাক মেইল করতে চাচ্ছে। আমি শুধু বললাম ঠিক আছে। তবে একটা প্রশ্ন তোমাদের কাছে। তোমাদের এই ভালবাসার কত ভয়াবহ হবে সেটা কি তুমি জানো। মানবে কি তোমার দাদা, বাবা এবং চাচারা? নাকি আমার ভাই টার জীবন নেওয়ার জন্য মিছামিছি ভালবাসার অভিনয় করতেছো। শোন এমন যদি ভেবে থাক তবে এখনও সময় আছে সরে যাও।

শামিম এবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কিরে এসব কি হচ্ছে। তুই তোর ভাবি কে সন্দেহ করতেছিস। তোর ভাবি হয় একটু সম্মান দিয়ে কথা বলবি সবসময়।

ভাবি বলেই তো এভাবে খোলাখুলি বলার সাহস পাচ্ছি। কথা এড়ানোর জন্য এমন টা বললাম।

ওপাশ থেকে ফিরোজার কান্নার আওয়াজ আসলো। কারও কান্না আমি দেখতে পারিনা। তাছাড়া ফিরোজার কান্না দেখে মনে হচ্ছিল পুরো কৃত্রিমতা বর্জিত। মাথা ওলট পালট হয়ে গেলো। ঠিক আছে ফিরোজা, আই অ্যাম সো সরি। আসলে আমি তোমাকে একটু বাজিয়ে দেখছিলাম।

তাহলে বলেন আমাকে ক্ষমা করেছেন? ফিরোজা জিজ্ঞাসা করলো।

ছোটো বোন কোন দোষ করলে ভাইয়েরা ক্ষমা না করে পারে। দোয়া করি তোমরা সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগিয়ে যাও। তোমাদের ভালোবাসা সফল হলে আমার চেয়ে পৃথিবীর কেউ এতো বেশি খুশি হবে না।

এবার ফিরোজা আমাকে হাজার খানেক ধন্যবাদ দিলো বিভিন্ন ভাবে। বলল, ভাইয়া এখন বলেন গ্রামে আসবেন কবে?

রোজার ঈদের পাচদিন আগে ছাড়া তো আসতে পারবো না এটা বললাম।

শামিম এতক্ষণ চুপ ছিল এবার বলল, ঠিক আছে তবে আরও আগে যদি ছুটি পাস তাহলে চলে আসবি, একটুও দেরি করবি না। আর শোন কোন সমস্যা হলে অবশ্যই আমাকে জানাবি।

আমার মনে উদ্বেগ বাড়তে লাগলো, বিভিন্ন রকম চিন্তা ভর করলো। পজিটিভ ও নেগেটিভ দুটি চিন্তাই ভর করে রাখল আমাকে। এভাবে আসতে আসতে রোজার মাস চলে আসলো। একে একে ২০ টি রোজা পার হয়ে গেলো। ২৪ রোজার দিন আমাদের কলেজ ছুটি পড়লো। ১৫ দিনের ছুটি পেলাম সেবার।

আমি আর শোভন বাসের টিকিট কেটে সেইদিনই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পিরোজপুর এসে পৌছালাম। শামিম ভাইকে আগেই জানানো ছিল। ফিরোজাও জেনে ছিল আমি আসতেছি।

শামিম আগে থেকেই আমাদের বাসায় বসে ছিল, আমার বাড়িতে পৌছে কিছু সময় কাটানোর পড়ে শামিম বলল, আমার স্টুডিও তে চল বসে বসে অনেক কথা বলল। আমার অনেক কথা জমা আছে।

জার্নি করার পর আমার খুব মাথা ব্যাথা করছিলো বলে আমি না করলাম। তবে মনে মনে কছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমি ফিরোজার সাথে একাকি আরেকবার মুখোমুখি হব।। ওর আসল উদ্দেশ্য কি টা আমাকে বের করতেই হবে। আমার বিশ্বাস ওকে একা পেলে ওর মুখোশ খুলতে পারবো। কনফারেন্সের সময় কোন জটিল প্রশ্ন করলে শামিম এসে বিষয় টা ঘুরিয়ে দেয়। আসলে শামিম ওকে অনেক অনেক ভালোবাসে তো তাই। এজন্য ওকে আমার একা পাওয়া দরকার। কি ভাবে কি ভাবে ভাবতে লাগলাম।

পরেরদিন আমি নিজেই সন্ধ্যার একটু আগে শোভন কে সাথে নিয়ে শামিমের স্টুডিও তে আসলাম। দেখি দোকান বন্ধ। তো আমি আর শোভন বসে গল্প করলাম কিছুক্ষণ কিন্তু তাই আসলো না। তাই শোভন কে বললাম, চল শোভন শামিম ভাই দের বাড়ি যায়।

শোভন প্রথমে যেতে চাইছিল না পরে আবার কি মনে হল আমার সাথে গেলো। বাড়িতে গিয়ে দেখি শামিম নাই। শামিমের আম্মা আমাকে বলল, বাপ শিলন কবে এসেছি। ঘরে উঠে বস।

এর মাঝে শামিমের খালা শান্তা আসলো, খালা আমার এবং শামিমের সমবয়সী হওয়ায় তিনজনায় খুব ফ্রী ছিলাম। আমি নিজেই খালাকে বললাম, খালা শামিম কোথায়?

শামিম এখন শশুর বাড়ি গেছে। খালা বলে থামল।

খালা প্লিজ ফাজলামো বাদ দ্যান, বলেন না শামিম কোথায়?

এবার শামিমের আম্মা এসে বলল, বাবা শামিম আসলেই ফিরোজাদের বাড়ি গেছে। ফিরোজার মা খুব নাকি অসুস্থ উনাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য সকালে মেহেরপুর নিয়া গেছে। এখনও তো ফিরে আসেনাই। কত মানুষ আসলো ছবি তোলানোর জন্য আর ফিরে গেলো।

আমি এবার বোকার মত প্রশ্ন করলাম, ফিরোজা দের বাড়ির সবাই কি জানে?

শান্তা খালা বলল, জানে মানে! সবাই তো মেনেও নিয়াছে। ওদের বাসায় সবাই আমারা যাওয়া আসা করি এবং ফিরোজার আম্মাও অনেক বার এসেছে।

আমার মাথা ঘুরতে লাগলো, মনে মনে ভাবলাম সম্পর্ক তাহলে অনেক দূর গড়িয়েছে। আমি বাড়িতে চলে আসতে চাচ্ছিলাম খালা বলল, চল নদীর চরে যায় অনেক কথা আছে।

আমিও ভাবছিলাম শামিমের ব্যাপারে আরও কিছু জানার দরকার, এজন্য আমি এবং শান্তা খালা নদীর চরে এসে বসলাম। আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, খালা একটা কথা বলেন তো, আপনি কি কখনও ফিরোজার সাথে কথা বলেছেন?

কথা বলেছি মানে! ছবি উঠেছি, ঘুরেছি, একসাথে আরও কত কথা বলেছি আর তুমি বল কিনা আমি কখনও কথা বলেছি কিনা! তুমি জানো আমাদের ফ্যামিলির সব সদস্যের সাথে ফিরোজার ছবি উঠা আছে। আচ্ছা তুমি এমন উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞাসা করছ কেন?

আমি বললাম, না মানে সত্যিই কি ফিরোজা শামিম কে ভালোবাসে।

খালা বলল, অবশ্যই সত্যি। তাছাড়া সত্যি না হলে কি কেউ এভাবে একটা ফ্যামিলির সাথে মেশে? একটা কথা কি জানো, মেয়েরা যাকে মনদিয়ে ভালোবাসে যার সাথে ঘর বাধতে চাই শুধুমাত্র তার সাথেই এতোটা গভীর হয়।

আমি কিছুই আর ভাবতে পারলাম না, মনে মনে শুধু এটা ভাবলাম তাহলে কি ফিরোজার বোধোদয় হয়েছে। খালাকে বললাম, ঠিক আছে, চল ফিরে যায়।

বাড়িতে ফিরে গিয়ে দেখলাম শামিম ভাই এসেছে। আমাকে হাত ধরে ঘরে নিয়া গেলো, ঘরে ঢুকে খুব অবাক হলাম এটা দেখে যে এই ফ্যামিলির সবার সাথে ফিরোজার ছবি বাঁধায় করে দেওয়ালে টানানো আছে। মনটা এবার কিছুটা নরম হল ফিরোজার প্রতি। মনে হচ্ছিল ফিরোজা এই বাড়ির বউ।

তবে মনে মনে এটাও ভেবে রাখলাম, এখনো আমার অনেক কয়েকটা ব্যাপারে শিওর হতে হবে।

এবার শামিমের সাথে শামিমের দোতলার স্টুডিও তে আসলাম। দোকানের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আগের এ্যানালগ স্টুডিও টি এখন ডিজিটাল করে ফেলেছে। মানে এখন একটা বড় কম্পিউটার কিনেছে। পাঁচ মিনিটেই যে কারো ফটো বের করে দিতে পারে। এজন্য দোকানে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে। পুরো গ্রামে একমাত্র তারই ডিজিটাল স্টুডিও যা আশে পাশের দশ বারোটা গ্রামে নেই। সবাই শামিমের দোকান থেকে কাজ সারে।

শামিম আমাকে কম্পিউটার এর সামনের চেয়ার টাতে বসাল। পিছনে আমার কাঁধে থুতনি দিয়ে দাঁড়ালো। কম্পিউটার স্ক্রিনে একটা সুন্দর শাড়ি পরা মেয়ের ছবি ছিল ওয়ালপেপার হিসাবে। হালকা হালকা চেনা মনে হচ্ছিলো। আমি বললাম, এটা আবার কোন নায়িকা?

শামিম ভাই হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। সাথে সাথে ফিরোজা ফোন করলো, শামিম কেটে দিয়ে ফোন ব্যাক করে হাসতে হাসতে এই ব্যাপার টা ফিরোজা কে বলল, কী ঘটেছে জানো, তোমার শিলন ভাই তোমার ছবি দেখে চিনতে পারে নাই আর বলেছে এটা আবার কোন নায়িকা! এভাবে এই কথাটা নিয়ে দুজনা খুব হাসাহাসি করলো কিছুক্ষণ। আমি শিওর হলাম ঐ নায়িকা মত ছবিটা আসলে ফিরোজার। আমি এই প্রথম ফিরোজার চেহারাটার প্রশংসা করলাম। মনে মনে বললাম, এই জন্যই শামিম ফিরোজা কে দেখে কেন এতো ফিদা হয়ে গেছিলো। যাক পছন্দ আছে শামিমের।

আধাঘণ্টা শামিম কথা বলার পর আমাকে ফোন টা দিয়ে বলল, নে ফিরোজা নাকি তোর সাথে একটু কথা বলবে। আমার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলার পর শেষে বলল, শিলন ভাই প্লিজ ঈদের দিন যেন আমাদের বাসায় যাওয়া হয়।

আমি মনে মনে বললাম তুমি দাওয়াত না দিলেও আমি তোমাদের বাসায় যেতাম আমার নিজ প্রয়োজনে।

শেষের কথা গুলো একটু জোরে বলে ফেলেছিলাম সেজন্য শামিম ভাই বলল, কি, নিজ প্রয়োজনে মানে, কি প্র্যজন। আমি বললাম পরে বলব। এভাবে ঈদ বলে আসলো। ঈদের দিন, শামিম ভাই আমাকে ডাকতে আসলো, ফিরোজাদের বাসায় যাবার জন্যে। যথাসময়ে শামিম আমাকে দুই কেজি মিষ্টি কিনে হাতে ধরিয়ে দিলো এবং আমি ফিরোজাদের বাড়ির দিকে চলতে লাগলাম। প্রাইমারি স্কুল থেকে পূর্বদিকে মাত্র ৫০গজ দুরেই ছিল ফিরোজাদের বাড়িটি।

ঐ পারাতে তখন ওদের বাসাটা ছিল সব থেকে সুন্দর করে তৈরি করা। দূর থেকে বোঝা যায় কোন অভিজাত লোকের বাসায় এটি। ফিরোজার দাওয়াত গ্রহণ করার একটাই উদ্দেশ্য ছিল যে আমি দেখবো শামিম কে ওর ফ্যামিলির লোকজন কেমন মূল্যায়ন করে। আর ওদের ঘরে শামিমের কোন ছবি আছে কিনা? যেমনটি দেখেছিলাম শামিমের বাসাতে।

তো আমি যাবার পর ফিরোজার মা আমাকে উষ্ণ আহবান জানালো। যেটা খুব ভালো লাগলো। ওদের বাসাতে মোট চারটা রুম। একটা রুমে ওর দাদা-দাদি, একটাতে ওর মা-বাবা, এখন অবশ্য ওর মা একাই থাকে। সাথে ফিরোজার ছোটো ভাই। আরেকটা তে ফিরোজা এবং ওর ছোটো বোন আফরোজা থাকে। অন্যটি খালিই থাকে। কোন মেহমান আসলে ঐ ঘরটাতে থাকতে দেই। বাসার গঠন টা আমার কাছে খুব ভালো লাগলো।

আমি যাবার পর পরই আমার অনুস্নধান আমি শুরু করে দিলাম। বাড়ির সবকটি স্থানে পর্যবেক্ষণ করলাম কোথাও শামিমের ফটো নাই। অবশেষে ঢুকলাম ফিরোজার রুমে। বইপত্র ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে লাগলাম শামিমের কোন চিহ্ন আছে কি না। না কোথাও কোন কিছু শামিমের ছিটেফোঁটা পর্যন্ত নাই। অবশেষে ফিরোজার ছোটো বোনের কাছ থেকে পারিবারিক অ্যালবাম টা চাইলাম। আফরোজা আমাকে ৫ কি ৬ টা অ্যালবাম এনে দিলো। বলল দেখেন এখানে আমাদের পরিবারের সবার ছবি আছে।

আমি সবগুলো ভালো করে ঘেঁটে দেখলাম কোথাও শামিমের ছায়া পর্যন্ত নায়। অবশ্য এসব ছবির বেশির অংশই শামিমের উঠানো। কিন্তু শামিমের কোন ছবি এদের বাসায় নায়। অথচ শামিমের পরিবারের সবার সাথে ফিরোজার ছবি উঠা আছে যার একটা কপিও ফিরোজার কাছে নায় এইটা ভাবতে আমার মাথায় কিছু ধুকছিল না।

শেষে খাওয়ার পর ফিরোজার মা বলল, বাবু শিলন তোমার অনেক সুনাম শুনেছি।

আমি বললাম, যতটা শুনেছেন আমি কিন্তু ততটা না। আসলে শামিম আমাকে নিয়ে একটু বাড়িয়েই বলে সবার কাছে। আমাকে খুব ভালো বাসে তো তাই।

না না শামিম কিছু তেমন বলে নি, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তোমাকে একজন আদর্শ ছেলে জানে। তুমি স্কুলে থাকতে সকল শিক্ষকের খুব প্রিয় ছাত্র টি ছিলে টা আমি জানি। তাছাড়া ফিরোজাও বলে তুমি খুব ভালো ছেলে। শিক্ষিত, নম্র, ভদ্র বলে তোমার সুনাম সবার কাছে কাছে। তুমি ঢাকাতে কোথায় যেন থাকো? আমি একে একে ওর মায়ের অনেক জানার বিষয় গুলোকে অবহিত করলাম।

যখন ফিরে আসবো তখন ফিরোজা কে একা পাওয়াতে একটা প্রশ্ন করে বসলাম, তোমার কাছে তো শামিমের একটা ছবিও না তাইনা?

ও কিছুটা হতবাক বনে গেলো, কিন্তু স্মার্ট ভাবে উত্তর করলো, আমি রাখতে চেয়েছি কিন্তু শামিম নিষেধ করেছে। তাছাড়া শামিমের ছবি আমার সমগ্র হৃদয় জুড়েই রয়েছে। এজন্য ছবির দরকার কি?

কেন? তোমার কি মাঝে মাঝে তাঁকে ছবিতে দেখতে ইচ্ছা করে না? আমি পাল্টা করে প্রশ্ন করলাম।

ফিরোজা বলল, হ্যাঁ করে কিন্তু...।

আমি ফিরোজা কে থামিয়ে দিয়ে বললাম, কিন্তু নই, শোন আমার কাছে শামিমের একটা ছবি আছে এটা রাখো, কাউকে জানানোর দরকার নাই। এমন কি শামিম কেও জানাবে না। ঠিক আছে?

ফিরোজা এবার কিছুটা নিরবেই আমার হাত থেকে ছবিটা নিল এবং তাড়াতাড়ি করে বইয়ের মলাটের মাঝে রেখে দিলো।

বিষয়টা আমার কাছে একদিক থেকে খুব ভালো লেগেছিল আবার ওর এতো তাড়াহুড়োটা আমাকে আরো ভাবিয়ে তুলল। যাই হউক ওদের বাসা থেকে চলে আসার পরের দুদিন খুব এঞ্জয় করলাম। আমি সোহাগ, তুষার, মেহেদি, রাজীব, রিন্টু, শিপন, মোহন আর আবার এলাকার সমবয়সী বন্ধুরা মিলে মুজিবনগর সৃতিসৌধে অনেক ঘুরলাম, মজা করলাম।

ঈদের তৃতীয় দিন কোথাও যাওয়ার ছিল না, তাই হাঁটতে হাঁটতে শামিমের স্টুডিও তে এলাম। দেখলাম শামিম নাই। দোকানে শ্মিমের ছোটো ভাই মুশফিকুর। সে আমাকে বসতে বলল। কিন্তু আমি আমি একটা চিন্তার মধ্যে ছিলাম বলে বসলাম না। আমার মনে মনে খুব রাগ হল এই ভেবে যে প্রতিবার ঈদের কয়দিন আমি এবং আমি সময় কাটাই কত রকম কথা বলে। আগে আমাকে সব জায়গায় সাথে করে নিয়ে যেতো বলে আমার সমবয়সী বন্ধুদের আমি সময় দিতে পারতাম না বলে তারা খুব মাইন্ড করতো।

আমি অবশ্য তাদের ওইসব কথাতে তেমন পাত্তা দিতাম না, কারণ শামিমের সাথে থাকলে আমার মন টা অটোমেটিক ভালো হয়ে যায়। এবার শামিম আমাকে সময় দিতে চাচ্ছে না কারণ টা কি? স্টুডিওর ছাঁদে বসে এইগুলো ভাবছিলাম। হটাত শান্তা খালার আগমন, কি ব্যাপার শিলন। মন খারাপ নাকি? কি ভাবছ অত গভীর ভাবে?

আমি এড়ানোর জন্য বললাম, কই না তো কিছু ভাবছি না।

খালা বলল, চলো শিলন নদীর ধারে যায়। বসে বসে অনেক কথা বলা যাবে। কি যাবে?

আমি খালার মুখ পানে তাকালাম, আসতে করে বললাম, হ্যাঁ চলেন যায়। বলে রওনা দিয়ে নদীর পাড়ে এসে বসলাম।

আমি শান্তা খালা কে এবার জিজ্ঞাসা করলাম, জানেন খালা, একটা আশ্চর্য বিষয় কি? আমি ফিরোজার বাড়িতে ঈদের দিন গিয়েছিলাম না? ঐ দিন আমি দেখলাম ওদের বাড়িতে কোথাও আমি শামিমের একটা ছবিও দেখতে পায়নি। আমি ভালো করে খুজেছি। ইভেন আমি একটা ছবি যখন ফিরোজা কে দিলাম,। সে ছবিটা কেন জানি খুব সতর্কতার সাথে নিল। আমার কেন জানি বিষয় টা ভালো লাগলো না, সেজন্য আপনার সাথে শেয়ার করলাম।

খালা এবার আমার কথার সাথে কিছুটা সায় দিয়ে বলল, আমারও কিছু কিছু বিষয়ে সন্দেহ আছে। এমন যে শামিম কে তারা এতো ক্লোজ করে দেখে তবে ফিরোজার বিষয়ে হয়তো নয়। শামিম কে তারা মনে হয় শেষ পর্যন্ত জামাই হিসাবে মানবে না। আবার জানো কিছু কিছু ব্যাপার এই সন্দেহ টাকে চাপা দিয়ে ফেলে। এজন্য আমিও একটা টেনশনে ভুগি। তবে এটা আমি নিশ্চিত শামিম ফিরোজা কে ১০০% ভালোবাসে যাতে কোন রকমের সন্দেহ নেই।

জানো শিলন তোমার চিন্তাধারা গুলোর সাথে আমি একমত হয়ে কিছু পর্যালোচনা করেছি। আমারও মনে হয় এখানে বড় কোন প্রতারণা হতে যাচ্ছে।

আমি খালা কে এবার থামিয়ে দিয়ে বললাম, প্লিজ খালা অমন চিন্তা কখনও করবা না। পজিটিভ করে চিন্তা করবেন সবসময়। আচ্ছা আজকে শামিম ভাই কোথায় গেছে আপনি যানেন?

কেন তুমি জানো না? খালা অবাক হয়ে বলল।

নাতো! আমি জবাব দিলাম।

ফিরোজার মা হটাত করে আবার খুব অসুস্থ হয়ে গেছিলো তাই ওনাকে নিয়ে মেহেরপুর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো, পরে ওখান থেকে কুষ্টিয়া তে শিফট করে নিয়ে গেছে। সাথে ফিরোজা গেছে কী না জানি না। তবে মেহেরপুর পর্যন্ত গিয়েছিলো।

এবার আমি ফোন বের করে শামিম ভাইকে ফোন করলাম। স্বভাবতই লাইন কেটে দিয়ে কল ব্যাক করলো। কান্না জড়িত কণ্ঠে; জানিস শিলন আম্মু খুব অসুস্থ। কিছুক্ষণ আগেই আমরা কুষ্টিয়া তে এসে পৌছালাম।

আমি বললাম, দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি বুঝি আগে, আপানার আম্মা তো বাড়িতে, মানে ফিরোজা মা কি। বলে হাসি আসলো। তবুও হাসি চেপে রাখলাম। এইসময় হাসাটা একজন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এটা উল্লেখ্য শামিম ফিরোজার মাকে আম্মা বলে ডাকে এটা যেমন ফিরোজার ফ্যামিলির সবাই জানে তেমনি শামিমের ফ্যামিলিতেও জানে। আমি জানতাম না যে এতো তাড়াতাড়ি এতদুর আসবে। যাইহউক আমি মনে মনে কিছুটা হলেও অন্তত সেই সময় টা খুশি হলাম। তবে একটা প্রশ্ন অবশ্য আবার মনে আসলো যে ফিরোজার আব্বু এটা জানে কিনা?

শামিম এর কান্না শুনে মনে হচ্ছে যে ও এতো কেদেছে যে এখন ধুকছে। আমি বেশি কথা বারালাম না। তবে শামিম এটা জানালো সেখানে নাকি ফিরোজার আম্মা কে অন্তত দুই সপ্তাহ ভর্তি হয়ে থাকতে হবে। শামিম কেও থাকা লাগবে কারণ ফিরোজাদের ফ্যামিলি তে কোন বড় ছেলে নাই। চাচা এবং মামারা আছে সবসময় ব্যস্ত থাকে।

এইকথা টা শুনে আমি কিছুটা আপত্তি তুলতে চাইলাম এজন্য যে শামিমের পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক গুলো কিন্তু ইনকামের মানুষ কিন্তু একজন টা হচ্ছে শামিম। সদস্যরা বেশির ভাগ আবার পড়াশোনা করে। শামিমের ছোটো ভাই মুশফিক পিরোজপুর স্কুলে ক্লাস সিক্সে পরে, ছোটো বোন সান্ত্বনা পরে প্রাইমারিতে তবে স্কুলে যাওয়ার সময় প্রতিদিন অন্তত দশ টাকা দেওয়া লাগবে, না হলে সেদিন স্কুলে যাবেনা। যাইহউক শান্তা খালা শামিম দের পরিবারেই থাকে সুতরাং তার পড়াশোনার দায়িত্ব শামিমের কাধেই রয়েছে। মেহেরপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজে পরে। যাওয়া আসা ভাড়া এবং হাত খরচ বাবদ প্রতিদিন খালার পিছনে তাও প্রায় একশ টাকার মত খরচ হয়ে যায়। মানে পরিবারের বাড়তি খরচ প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা যায়। যেজন্য প্রতিদিনের ইনকাম টা ওর অবশ্যই জরুরী। শামিম অবশ্য প্রতিদিন প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা ইনকাম করে তার টেইলারস এবং স্টুডিও তে মিলে। মাঝে মাঝে ইনকামের মাত্রা আর বারে। যেমন গ্রামে কারো বিয়ের ভিডিও ফুটেজ তৈরি করা, স্কুল কলেগের বিদায় অনুষ্ঠান এবং নবিনবরনের ফুটেজ করা এসব পুরো কাজ গ্রামে ঐ করে। আসলে শামিমের হাতের কাজ ছিল একদম নিখুত। এজন্য সবাই ওকে বেশি ডাকতো।

ভাবলাম এক্সপ্তাহ ওখানে থাকলে তো পরিবারে অনেক অর্থ সমস্যা পড়বে, এজন্যই হালকা করে নিষেধ করছিলাম। তাছাড়া শামিমের বাবা তেমন কাজ করে না, এবং শামিম নিজেই ওর বাবা কে কাজ করতে দেই না। বলে আপনি অনেক কাজ করে এসেছেন, এখন আর করার দরকার নাই। শুধু বেড়াবেন আর নামাজ কালাম পড়বেন। ওর বাবা একটু ফকরি তন্ত্র করে। শামিমও নিষেধ করে না। শামিম বলে যদি বাবা ওইসব করে একটু প্রশান্তি পান তবে আমি নিষেধ করবো না। বরং নিজেই পরিবারের সবার দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছে।

শামিম অবশ্য খুবই বাসস্তবাদী ছেলে। ওর মনে অনেক স্বপ্ন ওর ছোটো ছোটো ভাইবোন টাকে নিয়ে। শামিম সবসময় বলতো ওর ছোটো ভাইটাকে ইঞ্জিনিয়ার করবে আর বোন টাকে করবে ডাক্তার। শান্তা খালা কে নিয়েও তার আছে স্বপ্ন। শামিম বলে আমি পড়াশোনা করতে পারিনি পরিবারের অভাবের কারণে, আমি আমার পরিবারের কাউকে আমি যে অভাব টা সয়ে এসেছি টা লাগতে দেব না। খালা টাকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াবে এবং ভালো একটা ছেলের সাথে বিয়ে দেবে। আরও একটু অতীতে গেলে দেখা যায় শামিম ভাইয়ের স্কুল জীবন যেখানে শামিম দুর্দান্ত মেধাবি ছাত্র ছিল। আমার বড় আপুদের সাথে পড়তো। কিন্তু একদিন অর্থের জন্য নিজের পড়াশোনা করতে পারেনি। এজন্য পরিবারের কাউকে অভাবে ফেলতে নারাজ। সবার বলা মাত্র চাহিদা পূরণ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এক্ষেত্রে শামিম ১০০% সফল।

আমার কিন্তু কথাটা শামিম শুনে ফেলেছিল, তাই বলল দেখ তুইতো পড়াশোনা করিস, শিক্ষিত ছেলে, তুইই বল এমন অসুস্থ মানুষ কে রেখে নিজের পরিবারের স্বার্থে ছেড়ে যাওয়া কি ঠিক হবে? যে আমি সবসময় যেকোনো মুল্যে সবার পাশে থাকতে চেয়েছি। তাছাড়া উনি আমার জানের আম্মু, যাকে আমিও আম্মু বলে ডাকি। সেই আম্মু কে এই অবস্থায় রেখে আমি কিভাবে যাবো। তুই একটু আমার পরিবারের খেয়াল রাখিস।

আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে আপনি চিন্তা কইরেন না, আমি চাচা-চাচি কে ম্যানেজ করবো। আর হ্যাঁ ফিরোজা কি আপনার সাথেই আছে?

না না। আমার কাছে নাই। মেহেরপর পর্যন্ত এসেছিল কিন্তু আমি বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কারণ দাদার শরীর নাকি খারাপ। শামিম বলল। তাছাড়া আফরোজা রান্না করতে পারবে না। তবে ফিরোজার মেজখালা আমার সাথে আছে।

আমি বললাম, ঠিক আছে কী হয় না হয় আমাকে সব সময় জানাবেন।

শামিম বলল, শোন তুই একটু ফিরোজাদের বাড়ি যাস, কারণ ও খুব কাদতেছে তো। তুই একটু ওকে স্বান্তনা দিস।

আমি মনে মনে খুশি হলাম, কারণ শামিম না বললেও আমি যেতাম। এখনো কিছু প্রশ্নের উত্তর আমার জানা অতি জরুরী।

পরের দিন আমি শান্তা খালা কে সাথে করে গিয়েছিলাম ফিরোজার বাড়িতে। দেখলাম ফিরোজার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবিরা এসেছে। ফিরোজা আমাকে দেখে ভিতরে নিয়ে গেলো। ফিরোজার বান্ধবিরা আমাকে বলল, ভাইয়া কেমন আছেন ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। আমি একে একে সবার প্রশ্নের উত্তর দিলাম। সাথে বললাম, শোন ফিরোজার মন খারাপ তোমরা ওকে একটু সাথ দিয়ো। কারণ আমরা তো সবসময় থাকবো না। ওরা বলল, ঠিক আছে। সবাই চলে গেলে ফিরোজা আমাদের জন্য নাস্তা আনতে গেলো। তখন আমি খালাকে উদ্দেশ্য করে ইশারায় দেখালাম সবকিছু।

খালা বুঝতে পেরে বুদ্ধি করে সেইদিন ফিরোজার ডায়রি দেখেছিল। তাতে শামিমের নামে কোন কোথায় লেখা ছিল না দেখে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলো।

শান্তা খালা তো সরাসরি বেই ফেলেছিল যে ফিরোজা তুমি শামিম কে সত্যিই ভালোবাসো তো।

আমাকে কথাটা ঘুরিয়ে নিলেও ফিরোজা কিন্তু ঠিকই ধরতে পেরেছিল ব্যাপারটা। ঐদিন ফিরোজা তার ভালোবাসা প্রমাণ করান জন্য নিজের হাত কেটেছিল ব্লেড দিয়ে আমাদের সামনেই। ব্লেড দিয়ে কেটে শামিমের নাম লিখতে চাইছিল। আমি থামালাম। ওর হাতে নিজে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলাম। ওষুধ কিনে এনেছিলাম। তারপর খালা ওদের ঐদিন রান্না করে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।

ওইদিনের পর থেকে খালা ওকে পুরো বিশ্বাস করতে শুরু করলো। আসার সময় খালা বারবার বলছিল, এই ঘটনার জন্য নাকি আমিই দায়ি। আসলে মেয়ে মানুষ তো অল্পতেই ফিদা। আমিও আর অবিশ্বাস করবা বলে ভেবেছিলাম।

শামিম এসে ঘটনাটা ফিরোজার মুখ থেকে শোনার পর আমাদের দুজন কেই অনেক বকা দিয়েছিলো, বারবার কাদা কাদা স্বরে বলছিল, কেন তুই ওকে এতো সন্দেহ করিস। জানিস ও আমাকে কতটা ভালোবাসে। ওইদিনের পর থেকে শামিম আমার সাথে সেইভাবে কথা বলত না। একটু যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো। আমিও ঢাকায় চলে আসার পর পড়াশোনার চাপে শামিমকে সময় দেয়নি। বলতে গেলে একরকম অভিমান করেই যোগাযোগ করিনি। আমিও ভেবেছিলাম যতদিন শামিম আমাকে ফোন না দেবে ততদিন আমিও তাকে ফোন দিবো না।

পরের বার ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় খুব খারাপ লাগছিলো এটা ভেবে যে গত বার আসার জন্য শামিম আমাকে ফোন দিয়ে বারবার বলত আমি কোন পর্যন্ত এসছি ইত্যাদি অনেক কিছু। আবার এটাও ভাবনাতে আসতো ফিরোজাও তো আমাকে বারবার ভাইয়া ভাইয়া করতো আর বলত কবে আসবো, কখন পৌছাব ইত্যাদি ইত্যাদি। যেদিন থেকে শামিম ফোন করেনা, সেদিন থেকে ফিরোজাও ফোন করে না। যদি ফিরোজা ভালো মনের মেয়ে হতো তবে কখনই শামিম কে অইভাবে বলতো না। বললেও পরে শামিম কে দিয়ে ফোন করাতো। বলতে পারতো, শামিমকে বোঝাতে পারতো কিন্তু সেই শামিম কে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। নিশ্চয় ঐ মেয়ের কোন খারাপ মতলব আছে। যার থেকে শামিম কে উদ্ধার করতেই হবে। এজন্যই আমার অভিমান ভুলে গেলাম শামিমের সাথে আমি নিজেই যোগাযোগ করবো বলে ভাবলাম।

শেষের দিকে এসে শামিমের সাথে সজিব ভাইয়ের (যার বাড়ি পিরজপুর গ্রামের তিন নম্বার ওয়ার্ডে। বাবার নাম মোঃ ইয়ার খান) যোগাযোগ হয়। সজিব ঢাকার একটা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে মনোবিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। তবে সজীবও একজন ক্রিয়েটিভ ছেলে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সজিব মিডিয়া জগতে দখল নিয়েছিল। বিভিন্ন নাটক, গান, মডেলিং এসবের ভিডিও এডিটর হিসাবে কোর্স করতে থাকেন। মন বিজ্ঞানে পড়ে বলে হয়তো কম কথা ব্লে সবসময়। ফেসবুক এ একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছেন নাম দিয়েছেন Arthik Sojib.। আমার সাথে কথা হওয়ার পড়ে অবশ্য জেনেছিলাম সজিবের ফেসবুক নামটা।

সজিব ভাই শামিম কে ভিডিও এডিটিং এর কাজ টা শিখিয়ে দেন এবং এই কাজটা শেখার পর শামিমের গ্রামে পরিচিত আরও বেড়ে যায়, সেইসাথে ইনকামটাও বাড়ে। বাড়ে ব্যস্ততা। আমাকে এবং সজিব কে কাউকেই ভালো ভাবে সময় দিতে পারেনা। আমাদের গ্রামে দুই দুইটি মাধ্যমিক স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠান এবং নবিনবরন অনুষ্ঠানের ফুটেজ টা ভিডিও টা ক্যাসেট আকারে বের করার দায়িত্ব এখন শামিমের। এছারা গ্রামের কনসার্ট, বিয়ে সসব কিছুই শামিমের ডাক পড়ে।

আমি সেবার এসে শামিম কে সরি বলার পর শামিমের মুখে সেই আগের হাসি। আমিও নিশ্চিত হলাম। তবে হাল ছেরেছিলাম না। ফিরোজা আসলে শামিম কে ব্যবহার করছে কিনা সেটা আমাকে জানতেই হবে। সবকিছুই মনে মনে রাখলাম। সহজে প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফিরোজা অনেক শেয়ানা ঘুঘু। ওকে এইভাবে ধরা যাবে না। এসব ভাবলাম। শামিম আগের মতই আমার সাথে হাসি খুশিতে কথা বলত। এতো কাজের মধ্যে আমার কাছে ফোন দিতো। অনেক রাত পর্যন্ত আমি এবং শামিম স্টুডিওতে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করতাম। মাঝে মাঝে ফিরোজাও ফোনে যোগ দিতো আমার সাথে। আমার ভালবাসার মানুষ আছে কিনা বলল। যদি কখন না বলতাম শামিম এবং ফিরোজা দুজনাই রিতা কে আমার সাথে মিলিয়ে ফেলত। আমি বুঝাতাম রিতা শুধুই আমার একজন ভালো মানের বন্ধু। ওর প্রতি আমার কোন দুর্বলতা নেই। মাঝে মাঝে শামিম বলত ঠিক আছে যা তোকে আমার একমাত্র শালি আফরোজার সাথে বিয়ে দেব। ভালো করে পরা শেষ কর। মাঝে মাঝে আমাকে ও আফরোজা কে নিয়ে অনেক বেশি রাগাত দ্দুজনাই আমাকে। আমি এতো দুষ্টুমির মাঝে ফিরোজার নেগেটিভ সাইড গুলো কে ভুলে গেলাম।

আর কখনও শামিম কে ফিরোজার ওইসব ব্যাপারে বলতাম না। যদি আবার শামিম যোগাযোগ বন্ধ কর দেয়।

সামনে আবারো কোরবানির ঈদ আসন্ন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এবার ঈদে বাড়িতে যাওয়া হবে না। কারণ শামিম এখন মাল্টি-ওয়ার্কার। সবসময় ব্যস্ত থাকেন। বিভিন্ন স্কুলের ভিডিও, বিয়ের ভিডিও, মডেলিং ক্যাসেট ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত। আমাকে একদম সময় দিতে পাড়ে না। আমার সাথে সময় দিলে আবার ফিরোজার সাথে কথা বলতে পারেনা। যখন তখন ফিরোজার বাড়ি থেকে ডাক আসে, তখনি কাজ ফেলে ছুটে যায়। আমি বাড়িতে গেলে ওর সাথেই থাকতাম আগে। এখন আর সেইভাবে সময় দিতে পারেনা। এজন্য কোরবানির ঈদে বাড়িতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাছাড়া পড়াশোনার চাপও ছিল প্রচণ্ড।

কোরবানির ঈদের মাত্র একদিন আগে শামিম ফোন করলো, শিলন তুই একটু আমার স্টুডিও তে আয়তো। অনেক কাজ আছে কম্পিউটার এ।

স্টুডিওতে আসবো মানে, কিভাবে আসবো, আমি তো ঢাকাতে। আমি অবাক হয়ে বললাম।

ঢাকায় মানে, তুই ঈদে বাড়ি আসিস নাই। আসবি না? খুব রাগান্বিত স্বরে বলল শামিম।

আমি আসতে করে বললাম, এবার আমার যাওয়া হবে না।

শামিম ভাই আমার অভিমানটা ধরে ফেলেছিলো, এজন্য তখনি বলেছিল; তুই কি আমার ওপরে খুব রাগ করেছিস। এজনুওই কি বাড়িতে আসিস নি?

আমি প্রসঙ্গ টা বদলানোর চেষ্টা করলাম; বাদ দেন তো, বলেন ভাবি কেমন আছে?

এবার শামিম কিছুক্ষণ হাসল শব্দকরে, তারপর বলল, বাব্বা তুই্‌, তুই এই কথা বলছিস?

হ্যাঁ বলছি! কেন বলব না? আমি বললাম।

হ্যাঁ অবশ্যই বলবি। কিন্তু আগে তো কখনও বলতি না। দাড়া দাড়া আমি তোকে একটু পরে ফোন দিচ্ছি। এইটা বলে শামিম ফোন করে রেখে দিলো।

কিছুক্ষণ পর আবারো শামিমের নাম্বার থেকে ফোন আসলো, তবে এবার প্রথমে কথা বলল ফিরোজা।

আমি কিছুটা অবাক হলাম মনে মন ভাবলাম এখন রাতের বেলা ফিরোজা শামিমদের বাড়িতে এসেছে নাকি?

আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো ফিরোজার কথাতে; কি ব্যাপার ভাইয়া আপনি আসবেন না কেন?

না এমনি আমার এবার আসা হবে না। আমি বললাম।

ফিরোজা এবার কিছুটা হাসি মুখেই বলল, আমি কিন্তু জানি আপনি কেন আসবেন না?

আমি কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, না না শোন আমি শামিম অথবা তোমার ওপর নারাজ নই।

ফিরোজা আমাকে এবার থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি জানি আপনি আমাদের ওপর নারাজ নন। কিন্তু কার ওপরে আপনি নারাজ সেটা আপনি কিছু কিছু জানি।

আমি এবার বুঝতে পারলাম তার কথার উদ্দেশ্য কী, এজন্য প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করলাম, শুধু বললাম; এবার তোমাদের কি প্রোগ্রাম আছে। কোথাও কি ঘুরতে যাবে নাকি?

ফিরোজা হালকা করে বলল, চেয়েছিলাম আপনাকে সাথে নিয়ে আমরা তিনজন অনেক জায়গা ঘুরবো কিন্তু এখন তো দেখি সে আশায় গুরে-বালি। কারণ আপনিই আসবেন না।

আমি বললাম, তাতে কী? সাধারণত ঘুরতে গেলে দুজনাই যাওয়া বেস্ট। তৃতীয় পক্ষ অনুপস্থিতিটা ভালোবাসা টাকে হীন করে দেয়। মানে তৃতীয় পক্ষ না থাকায় ভালো।

ফিরোজা এবার বলল, দেখা যাবে। শোনেন মা একটু আপনার সাথে কথা বলবে। প্লিজ একটু কথা বলেন। ফোনটা ফিরোজা উনাকে দিলো না।

আমি সালাম দিলাম, আনটি আস্‌সালামু আলাইকুম।

আনটি সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কি বাবা তুমি নাকি বাড়িতে আসবা না? তোমার আম্মা কি মন খারাপ করবে না? তাছাড়া এবার ভেবেছিলাম তোমাকে ও শামিম কে আমাদের বাড়িতে খাওয়াতাম।

আমি আনটি কে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমি তো যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপে যেতে যেতে পারবনা। তাছাড়া আমি একটা ছাত্রি পড়ায় তো তার সামনে পরিক্ষা, এছাড়া টিকিট পাইনি এবার।

আনটি বলল, ঠিক আছে আমি যদি টিকিট ম্যানেজ করে দেই তবে কি তুমি আসবে?

আমি আবারো কথা ঘুরিয়ে নিলাম, না না ঐ যে বললাম না আমার ছাত্রি তার ফাইনাল পরীক্ষা তাই থাকতে হবে।

আনটি এবার বলল, ঠিক আছে তবে ঈদের পর পরেই আসার চেষ্টা করো বলে রাখতো।

আমার নিজেকে যেন আজকে খুব খুশি খুশি লাগছিলো। দেখেছিলাম ফিরোজার কথা বলার মাঝে আজকে অনেকটাই দরদ ছিল। তাছাড়া মনে হচ্ছে শামিম কে ওরা এবার মেনে নিয়েছে। ফিরোজাও তার দৃষ্টিভঙ্গি চেইঞ্জ করেছে। মনে মনে এটাও ভাবলাম যে মানবে নাই বা কেন? শামিম কিসে অযোগ্য। নিজের ব্যবসা আছে। ইনকাম মোটামুটি। সবার চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। সমাজ সেবক। সব সৎগুন গুলোই আছে শামিমের মাঝে।

এবার নিজের কাছে আমাকে খুবই অনুতপ্ত লাগছিলো যে কেন এবার ঈদে গেলাম না। ঠিক আছে সামনে গরমের ছুটি দিবে প্রায় দুমাস খানিক। তাছাড়া পরিক্ষাও শেষ হয়ে যাবে তখন ফ্রী ভাবে ঘুরতে পারবো। তখন শামিম এবং ফিরোজার সাথে অনেক জায়গায় ঘুরবো ভাবলাম।

কোরবানির ঈদে শামিম এবং ফিরোজা খুব ভালো করে ইনজয় করেছিলো। ঈদের কয়েকদিন ওরা মেহেরপুরের কিছু দর্শনীয় স্থানে ঘুরেছিল। যেমনঃ মুজিবনগর স্রিতিসৌধ, আমঝুপি নীলকুঠি, বারাদি ফার্ম হাউজ, বরশিবারিয়া কমল উদ্দিন, আটকবর, বাজিতপুর বর্ডার, কুশুম খাল, ভৈরব নদ, ঝাদুখালি কলেজ, মেহেরপুরের কলেজ, পৌরসভা, হল মার্কেট, পৌর ঈদ গা, পৌর কলেজ, ইত্যাদি অসংখ্য স্থানে ঘুরেছে। আসলে মেহেরপুর শহর টা অত্যন্ত সুন্দর রাস্তাঘাট, বিল্ডিং সবকিছু ঝকঝকে পরিস্কার করে সাজানো। আমি ঢাকা শহরে থাকলেও মেহেরপুর আমার সবথেকে প্রিয় শহর। এতসুন্দর শহর আমি কোথাও দেখি নি। এখানের সব রাস্তা গুলোতে শামিম এবং ফিরোজা রিক্সা নিয়ে ঘুরেছে কোরবানির ঈদে।

দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো এবং গরমের ছুটিও পড়ে গেলো। ফেব্রুয়ারী মাসের ২৫ তারিখে আমার গরমের ছুটি পড়লো। দুমাস তেরো দিন ছুটি দিলো। আমি ২৫ তারিখ রাত্রেই মেহেরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মনে মনে অনেক আশা ছিল যে এবার আমার সব বন্ধুদের সাথে ঘুরবো, তাদের কে সমসয় দিতে পারিনা বলে তারা বলে আমি ঢাকায় থাকি বলে নাকি অনেক দাম নিই, তাদের সাথে মিশি না। সবসময় শামিম এবং আমাদের বিশ্বাস পাড়ার ছেলেদের সাথে ঘুরি। অথচ তারা আমার স্কুল জীবনের খুব ভালো বন্ধু ছিল। তাই এবার আমার স্কুল জীবনের ওইসব বন্ধুদের সাথে অনেক ঘুরবো।

শামিম ফিরোজা দুজনার সাথেই খুব ঘুরবো। আর কখনও ফিরোজার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ করবো না। ফিরোজা কেউ এবার ভাবি বলে ডাকবো। আসলে আমি এতদিন ফিরোজাকে ভুল বুঝে এসেছি সেজন্য হালকা করে ক্ষমা চেয়েও নেবো। ফিরোজা সত্যিই খুব ভালো মেয়ে। ও শামিম কে অনেক অনেক ভালোবাসে। আমি এতদিন অন্য কিছু ভাবতাম। যে ভালোবাসা মানে হয়ত ভালবাসার মানুষটার ছবি বইয়ের ভিতরে রাখা। তার সাথে নামার মাঝে প্লাস চিহ্ন দেওয়া ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। ভেবেছিলাম এবার গিয়ে রিতা ও রুমির খোঁজ করবো। আমার একমাত্র মেয়ে বন্ধু রিতা কেমন আছে, আমাকে ভুলে গেছে কিনা টা খোঁজ করবো। আর দূরে থাকবো না। এওস হাজার রকম ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে এসে বাড়িতে পৌছালাম।

২৬ শে ফেব্রুয়ারী সকাল বেলা শামিমের স্টুডিওতে গেলাম। এখনো ঘুমাচ্ছে। বেজায় ঘুম ঘুমাচ্ছে। বেচারি মনে হয় সারারাত মোবাইলে কথা বলেছে ফিরোজার সাথে। আমি বার পাঁচেক ডাকলাম। কোন সাড়া শব্দ নায়। তাই আমি চলে আসলাম যে পরে এসে কথা বলব।

পরে সকাল ১১ টার দিকে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম শামিম মেশিনে বসে কাজ করছে। পাশের কাটিং টেবিলে কে যেন বসে আছে চিনতে পারলাম না। কাছাকাছি যেতেই ওকে চিনতে পারলাম। ওই প্রথমে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আমি কখন এসেছি? ভালো ছিলাম তো?

আমি উত্তর দিলাম। ছেলেটির নাম হচ্ছে সাজিবার। আমরা ওকে সবাই ছোট খোকন বলে ডাকি , এটা ওর ডাক নাম। ওর পরিবারের সবাই ওকে ছোট খোকন বলেই ডাকে। খোকন বিদেশ যাবে অল্প দিনের মধ্যে। আমার পাড়ার ছোটো বেলার খুব কাছের বন্ধু উজ্জ্বলের সাথেই ও যাবে। একসাথেই ট্রেনিং করেছে। আমি বাড়িতে গেলে উজ্জ্বল ও ইমরানের সাথেই বেশি সময় কাটায়।

খোকনদের পরিবারের সাথেও শামিমের ভালো সখ্যতা হয়েছে। খোকনের বাবা কে শামিম দাদা এবং মা কে দাদি বলে ডাকে। খোকনেরা তিনটা ভাই। বড় ভাইটা ঢাকাতে গার্মেন্টসে ভালো পদে চাকরি করে। ওনার নাম হল মজিবার। পরের জন খুবই আদর্শ একজন নাম আজিবার। আমি স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ার সময় আজিবার ভাইয়ের কাছে টিউশন নিতাম। খুব ভালো করে বোঝাতে পারতেন। খুবই ভালো ছেলে। আমাদের পরিবারের সাথেও আজিবাআর ভাইদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা আছে।

আমি যখনি শামিমের দোকানে যেতাম সেই সময়ই দেখতাম শামিম খুব ব্যাস্ত। দোকানে অনেক মানুষ আসতো সবসময়। তাদের কে সময় দিতে গিয়ে আমার সাথে কথা বলতে পারতো না তেমন একটা। তবে সাজিবার মানে ছোট খোকন অনেক ধৈর্য নিয়ে শামিমের সাথে সময় ব্যয় করতো। যেহেতু সাজিবার এবং উজ্জ্বল একসাথেই দুবাই যাবে সেহেতু ওরা দুজন একসাথে ঘুরত। আমি গেলে দেখতাম শামিমের সাথে সাজিবার এবং উজ্জ্বল আছে সবসময়। তবে আমি যাবার সাথে সাথে অবশ্যই শামিম সব কাজ ফেলে হলেও আগে একটু কথা বলবে আমার সাথে।

ওখান থেকে আবার উজ্জ্বলের সাথে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হয়। আমাদের দুজনার মধ্যে হয় গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। উজ্জ্বলের সাথে আমি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতাম। আমাদের গ্রামটা অনেক অনেক বড় ছিল। একদিনে পুরো গ্রামটা ঘোরা কারো পক্ষে সম্ভব না। ওকে সাথে নিয়ে আমার স্কুল জীবনের বন্ধু বান্ধবিদের বাসাতে যেতাম। সবাই আমাকে অনেক দিন পর দেখে খুব খুশি হতো। আমার সকলের প্রিয় ছিলাম বলে সবাই আমার সাথে প্রান খুলে কথা বলত।

বেশি নিয়ে যেতাম আমার স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠ ক্লাসমেট মইদুল দের বাড়িতে। মইদুলের বাবা মাকে আমি খালা খালু বলে ডাকতাম। আরও নিতাম আমার বান্ধবি রেক্সনা দের বাড়ি, শিবলী, শ্যামলী, শাবানা, সালমা দের বাড়ি। নিয়ে যেতাম নুরপুরের মিতা দের বাড়িতে। এর মধ্যে রেক্সনাকে উজ্জ্বল অল্প অল্প পছন্দ করতো। ওদের বাড়িটা ছিল পিরোজপুরের পশ্চিম পাড়ার হটাত পাড়াতে। অনেক টা দূর। আমাদের সাথে মাঝে মাঝে আসতো হান্নান বলে একটা ছেলে। ও অবশ্য আমাদের একরকম আত্নিয় হয়। এভাবে আমরা অল্প কদিনের মধ্যে পুরো পিরোজপুর ছাড়াও পাশের গ্রাম যতারপুর সব ঘুরে শেষ করে ফেলি।

এভাবে সময় ফুরিয়ে এলো আমার আর উজ্জ্বলের। বিশদিনের মধ্যেই সাজিবার ও উজ্জ্বল আরব আমিরাতের প্রধান অঙ্গরাজ্য দুবাই চলে গেলো কাজের সন্ধানে। আমিও আবার একা হয়ে গেলাম। দুই তিন দিন মন খারাপ করে বসে থাকলাম। বেশির ভাগ টাইম বাড়িতে থাকতাম।

দুইদিন পরে হটাত শামিম এবং রাজু ভাই (গানের শিল্পী) আমাকে ডাকল বাড়ির বাইরে থেকে। রাজু ভাই জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার শিলন তোমাকে আর দেখি না কেন স্টুডিওতে?

না এমনি তে। আমার শরীর টা একটু খারাপ তো তাই কয়েকদিন যায়নি। আমি আসতে করে বললাম।

এবার সাথে সাথে শামিম আমার কপালে হাত দিয়ে চেপে দেখল কিছুক্ষণ পরে বলল, কয় জ্বর টর তো গায়ে দেখছি না। মন খারাপ নাকি? চল আমার স্টুডিওতে। গানের প্র্যাকটিস করবো। তুই বসে বসে গান শুনবি। তোর প্রিয় প্রিয় গান গুলো গাইবো।

আমার একটুও ইচ্ছা ছিল না তবুও রাজু ভাইয়ের কথা ফেলতে পারলাম না। ওখানে গিয়ে শুনলাম ১৭ই মার্চ পিরোজপুর হাইস্কুলে কনসার্ট হবে। ঢাকা এবং কুষ্টিয়া থেকে বড় বড় নামি দামি অনেক শিল্পী আসবে। তাদের সাথে শামিম এবং রাজু কেও গান করতে হবে আমাদের গ্রামের পক্ষ থেকে। তাই আমাকে বলল, তুই বল কোন কোন গান গাওয়া ঠিক হবে।

এভাবে তাদের প্র্যাকটিস চলছে। শামিমের কাজের দায়িত্ব অনেক। পুরো অনুষ্ঠান টির ভিডিও ধারণ করবে এবং এডিটিং করার পর ক্যাসেট আকারে বের করবে। সো তাকে ফ্রী পাওয়া যাচ্ছে না। jjযদিও একটু ফ্রী হচ্ছে মাঝে মাঝে তখন দেখা যাচ্ছে ফিরোজার সাথে কথা বলাতে ব্যস্ত। তবে প্রতিদিন রাতে আমি আর শামিম স্টুডিও তে অনেক কথা বলি। ফিরোজার সাথে ফোনে আড্ডা দেয়।

আমি একদিক থেকে খুশিই হচ্ছিলাম এটা ভেবে যে যাক কোন দুশ্চিন্তা তো করছে না। সব সময় শামিম হাসি হাসি থাক্তেছে। এটাই তো আমি সব সময় চেয়ে এসেছি। ওর মন ভালো থাকলে ও সমাজের অনেক ভালো কাজ করে ফেলে হাসতে হাসতে।

কনসার্ট শুরু হবার একদিন আগে রাত্রে কুষ্টিয়া থেকে কাজল আসলো। কাজল সংগীতের সাথে সম্পৃক্ত। কাজল অবশ্য আমার আগে থেকেই পরিচিত। আমার সমবয়সী, এবং আমাকে মামা বলে ডাকে। কাজল আমাদের পারিবারিক আত্মীয়। কাজল এই গ্রামের নাতি। আমাদের বংশের ছেলে। আমার চাচাত ভাই টুটুলের ভাগ্নে।

কাজল আসার পর আমাদের বাড়িতে এসেছিল আমার খোঁজে কিন্তু আমি সেইসময় বাড়িতে না থাকায় দেখা হয়েছিল না। রাত ৯ টার দিকে গেলাম স্টুডিওতে। ওখানে সবগুলো সংগীত বিশারদ উপস্থিত ছিলেন। শামিম, রাজু ভাই, পান্ন ভাই, হিরন ভাই, কাজল এবং কাজলের সাথে আসা বন্ধু এবং ঢাকা থেকে আগত অনেক গুলো শিল্পী ছিল। সবাই গানের প্র্যাকটিস করছিলো।

আমি দরজার গোঁড়ায় দাঁড়ানোর সাথে সাথে কাজল জোরে বলে উঠলো, আরে মামা। কি খবর কোন খোঁজ পাচ্ছি না, আসার পর থেকে। আমি গিয়েছিলাম আপনার বাসাতে কিন্তু পাইনি। নানি কিছু কি বলে নি। এগুলো বলতে বলতে উঠে এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। আমার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেলো মজমার মধ্যে। আমি অবশ্য গান খুব পছন্দ করি কিন্তু এতো ভিড়ের মধ্যে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। এজন্য আমি বললাম না আমি এখানেই থাকি।

আবার রাজু ভাই এবং শামিম এসে আমাকে বলল, না তুই আয় এখানে বস। আমাদের গান সিলেক্ট করে দে। কোন কোন গান গাইবো। সেবার আমি গিয়ে বসলাম। আমার পছন্দ মত গান গুলো ওরা একে একে গাইলো। এবার ঢাকার শিল্পী গুলো গান গাইতে লাগলো। এভাবেই প্র্যাকটিস হতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পরে হটাত সজিব ভাই আসলো। শামিম এসে কথা বলল। আমিও উঠে এসে সজিব ভাইয়ের সাথে কথা বলতে লাগলাম। সজিব নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে। এজন্য দেখলাম কিছুটা ইতস্থ করছে। আমার অবশ্য গান খুব পছন্দ। তারপরেও সজিব কে সঙ্গ দেবার জন্য আমি উঠে আসলাম। স্টুডিওর পাশের ছাঁদে বসলাম। সজিব এবং আমি অনেক কথা বলছিলাম। কিন্তু গানের শব্দে আমাদের কথা কিছুটা বিকৃত হচ্ছিলো। এটা সজিব বুঝতে পেরে বলল, চল আমরা বরং হাটি। আজকে জোস্যনা রাত হাঁটতে ভালো লাগবে। আমি কথাতে সায় দিয়ে সজিবের সাথে নেমে চলে আসলাম হাঁটতে।

পিরোজপুর মন্দিরের কাছে এসে আমি বললাম, বলেন কোন দিকে যাবেন?

চল পশ্চিম দিকে যায়, এদিক টা খুব নিরিবিলি। হাঁটতে ভালো লাগবে। সজিব ভাই উত্তর করলো।

আমি আর সজিব হাঁটছিলাম এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম, হটাত উনি জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি কিছু জানো, শামিম এবং ঐ মেয়েটা কি যেন নাম। আমি মাঝে বললাম ফিরোজা। উনি আবার কথা কন্টিনিউ করলেন, হ্যাঁ ফিরোজা এবং শামিমের ব্যাপারে। কেমন ওদের সম্পর্ক টা।

হ্যাঁ জানি তো। ওদের সম্পর্ক অনেক ভালো পর্যায়ে। আমি আরও বললাম, এমন কি দুই ফ্যামিলির সবাই জানে এমন কি ফিরোজার পরিবার এটা মেনেও নিয়েছে।

এবার সজিব ভাই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি সঠিক কি জানো, মানে বলছিলাম তুমি কোথাও ভুল করছ নাতো

আমি এবার আরও কনফিডেন্ট নিয়ে বললাম, আমি সব জানি ওদের শুরু থেকে এই পর্যন্ত। কিন্তু আপনি কি অন্য কোন কিছুর আভাস পেয়েছেন নাকি?

সজিব ভাই বলল, না, তবে শুনলাম দুইদিন আগে ফিরোজার বাবা হামজাদ এসেছেন। শামিমের ভয় তো ফিরোজার বাবাকে নিয়ে।

আমি বললাম, আরে না তেমন কোন একটা সমস্যা শামিমের জন্য হবে না। তাছাড়া শামিম যখন তাদের ফ্যামিলির এতো গুলো মানুষ কে তাদের ভালবাসার পক্ষে আনতে সক্ষম হয়েছে। আর মাত্র একজন কে পারবে না এটা কোন ব্যাপার না। আমি আরও কনফিদেন্ট এর সাথে বললাম। আমি আরও বললাম, তাছাড়া ফিরোজার মা শামিম কে খুব খুব ভালোবাসে যার প্রমাণ আমি নিজে। উনি ঠিকই উনার স্বামি মানে ফিরোজার বাবা কে ম্যানেজ করে ফেলবে।

এবার সজিব ভাই বলল, গতকাল সন্ধার দিকে দেখেছিলাম ফিরোজার বাপ শামিমের দোকানে এসেছিল। শামিমের সাথে কথা হয়েছিলো তবে কি কথা হয়েছে আমি সেটা জানিনা। তবে একটা বিষয় কি জানো শিলন, আমার মনে হচ্ছে এখানে কোন একটা সমস্যা আছে। তুমি খেয়াল করে দেখেছো শামিম কে কেমন নার্ভাস নার্ভাস লাগছে।

আমি বোকার মতো আবারো বললাম কয়! তেমন তো নার্ভাস দেখলাম না।

এখন অনেক বন্ধুদের সাথে আছে তো তাই নিজেকে স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করছে। যদি তুমি কাল রাতে দেখতে তবে বুঝতে অবস্থাটা। সজিব ভাই বলল, কাল ওদের কনসার্ট তো সেখানে শামিম গান গাইবে, তখনি বোঝা যাবে আসলে ও নার্ভাস কিনা?

আপনি কথাটা অবশ্য মন্দ বলেন নি। আমি বললাম।

পরের দিন কনসার্টে আমি শামিম কে পর্যবেক্ষণ করলাম। আমি আর সজিব ভাই একসাথে বসে গান শুনছিলাম। সজিব ভাই তখন বলল, এবার দেখো শামিম অনেক বেশি নার্ভাস ফিল করছে। আমিও দেখলাম শামিম সত্যিই খুবই নার্ভাস ছিল। গানে সেই তেজ আর দেখা গেলো না। তাছাড়া ওর গান করার কথা ছিল তিন টা কিন্তু নাম রক্ষার্থে মাত্র একটা গান করেছিলো। এসব গুলো সজিব ভাই আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে লাগলো। আমারও খুব শংকা বেড়ে গেলো।

পরের দিন যখন আমি ওর দোকানে গেলাম দেখলাম, ও মেশিনে কাজ করে যাচ্ছে একমনে। অন্যদিন সবসময় কথার খই ফুটত মুখ দিয়ে। পাশের কাপড়ের দোকান মালিক দিপু ভাইয়ের সাথে খুব জোরে জোরে ইয়ার্কি আড্ডা মারত। আমাদের স্কুলের পলি ম্যাডাম কে দিপু ভাই খুব পছন্দ করতো, শামিম এবং আমি দুজনায় দিপু ভাইকে ঐ ব্যাপারটা নিয়ে খুব খেপাতাম। কিন্তু আজ দেখি শামিম কারো সাথেই কথা বলছে না। কেমন যেন ওকে বিধ্বস্ত লাগছে। উদ্বিগ্নতায় ভরা সাড়া অবয়ব।

আমি গিয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? কিন্তু শামিম সুকৌশলে এড়িয়ে গেলো। বলল, না আমার কিছু হয়নি ।আমি সব সময় ভালো থাকি এবং এখনো খুব ভালো আছি।

আমি বললাম, তাহলে মাত্র একটা গান করলেন কেন। গান তো গাওয়ার কথা আপনার তিন টা।

এবার শামিম আরও চতুরভাবে এড়িয়ে গিয়ে বলল, আমি ভিডিও করছিলাম তো সেজন্য গাওয়ার সময় পায়নি।

আমাকে লুকাচ্ছেন তো লুকান, এমন একদিন আসবে যখন আমাকে বলার জন্য খুজবেন। কিন্তু সেইদিন দেইখেন আমাকে সহজে পাবেন না।

এবার শামিম আমাকে বসিয়ে প্রসঙ্গ পালটিয়ে অন্য কথা বলতে লাগলো। হটাত করে আমার অতীত স্পর্শকাতর জায়গায় প্রশ্ন করলো, একটা কথা বলতো, তুই কি রিতা কে খুব ভালবাসিস?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কি ব্যাপার এইকথা আসছে কেন?

না আগে সত্যি করে বলতো সত্যিই কি তুই ওকে পছন্দ করিস? শামিম উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।

আমি বললাম, আমি এখন ওসব চিন্তা করি না।

শামিম তখন আমার দিকে ভালো করে তাকাল তারপর বলল, আমার মনে হয় রিতাও তোকে খুব ভালোবাসে।

আমি হালকা রাগান্বিত ভাবেই বললাম, আপনার এই চোখ দুটি দিয়ে কি একবারও আমাদের দুজন কে একসাথে মিলাইয়ে দেখেছেন? ও আমার থেকে লম্বায় একহাত বেশি। ওর কাছে আমি পিঁপড়া আর ও আমার কাছে হাতি। বুঝেছেন?

শামিম ভাই এবার হো হো করে হাসতে শুরু করলো। শোন ভালবাসার কাছে লম্বা বা খাটো বলে কোন ব্যাপার নেই। সে যদি সত্যিই তোকে ভালোবাসে তবে তোর পাশে দাঁড়ানোর সময় ঝুকে থাকবে মাটির দিকে। তাছাড়া গতকাল ঐ যে ছবি টা দেখলি না কি যেন , হ্যাঁ হ্যাঁ “কুস্তি” হিন্দি মুভি টা। নায়ক টার কি যেন নাম। কি কি কি যেন...

আমি বললাম নায়ক রাজপাল যাদব এবং নায়িকা নার্গিস তিয়ারী। কিন্তু তারা কি করেছে।

ঐ ছবিতে দেখতে পেলি না নার্গিস কত লম্বা আর রাজপাল যাদব কেমন বেটে তবুও তাদের মধ্যে ভালোবাসা হল। মেয়েটি ওকে কখনও উচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন করেছে।

আমিও এবার বললাম, ওইসব কাহিনী ফিল্মেই হয় বাস্তবে ওসবের কোন সত্যতা নাই। তাছাড়া রিতা আমার জীবনের খুব ভালো একটা বন্ধু। আমি ওকে বন্ধু হিসাবেই রাখতে চাই। ভালবাসার আবেগময়ি সম্পর্ক কে নিয়ে টার আর আমার এতো সুন্দর মধুর বন্ধুত্ব কে নষ্ট করবো না।

শামিম বলল, তুই কি এটা মানিস একটা ভালো বন্ধুই হতে পারে একজনার জীবনের সব থেকে ভালো জীবন সঙ্গিনী। ভালবাসার মধ্যে বন্ধুর মত সম্পর্ক টাই তো সবথেকে ভালো।

আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ওসব লেকচার বাদ দ্যান তো। আমার ওয়িসব ভালো লাগে না। তাছাড়া আমার অত বড় সাহস নাই। ওরা অনেক বড়লোক। আমার সাথে ওর মিল কখনই হবে বরং আমি রক্তারক্তি হবে যেটা আমি সবসময় ভয় পেয়ে এসেছি। এজন্যই আমি ওকে ছেড়ে ঢাকাতে গিয়েছি। যাতে দূরে থাকলে এইধরনের কোন সম্পর্ক আমাদের মাঝে কখন উদয় না হয়। এখন বলেন ভাবির খবর কি?

শামিম আসতে করে বলল, হ্যাঁ ভালো।

এভাবে কথা বলতে বলতে আসরের আজান শোনা গেলো। আমি উঠে পড়ে বললাম। আপনি কাজ করেন আমি নামাজ পড়ে আসি।

শামিম আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, চল আমিও যাবো।

আমি খুশি হলাম। কিন্তু কোন কথা জিজ্ঞাসা করলাম না। কারণ নামাজ বিষয়ে আমার জিজ্ঞাসা টা মাথায় এসেছিল যা জিজ্ঞাসা করা বড় অন্যায়।

নামাজ শেষ করে কেবল বসেছি স্টুডিওর সিঁড়িতে। তক্ষনি ফোন আসলো নিচে যাবার জন্য। মানে ফিরোজার বাবা হামজাদ এসেছেন। আমি ও শামিম নিচে গেলাম। আমি চিনতে পারিনি, কারণ আমি কখনও দেখিনি উনাকে। দেখতে অনেক লম্বা চওড়া, সুসাস্থের অধিকারী। শামিম ভাই দেখলাম অনেক খুশি। চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে দিলেন। চা-নাস্তার ব্যবস্থা করলো। আমি বাড়ি থেকে ডাক পাওয়ায় চলে আসলাম। তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিলো আমি শুনিনি।

এভাবে দুতিন দিন পার হল। আমি শামিমের সাথে কয়েকদিন সেই ভাবে কথা বলতে পারিনি। মানে মাঠের কাজে আমার আব্বা কে সময় দিতে হয়েছিলো ঐ তিন দিন। শামিমের সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিলো সরাসরি ২৪ শে মার্চ।

ঐদিন শামিম আর আমি সকাল দশটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত গল্প করেছিলাম। ঐদিন শামিম কোন কাজ করে নি। স্টুডিওর মধ্যে আমার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছিল। মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা বিষয়ের আবির্ভাব করছিল।

আমি মাঝখানে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী কথা হলো শ্বশুর মশায়ের সাথে?

শামিম কিছুটা উত্তেজিত হয়ে সরাসরি বলে, না মেনে নিলে দুজনা একসাথে ঘুমের ওসুধ খেয়ে মারা যাবো। তবুও দুজন কখন এই দেহে প্রাণ থাকতে আলাদা হবো না। ওই জগতে তো কেউ বাধা দিতে পারবে না ভালবাসাতে।

আমি বললাম, এমন ভাবে বলছেন কেন? তাছাড়া আমি দেখলাম তো ফিরোজার আম্মা, দাদা-দাদি এবং চাচা-মামারা সবাই রাজি। উনাকে কিছুটা সময় দ্যান ঠিকই রাজি হবে। তাছাড়া জানেন তো সব বাবা রাই মেয়ের প্রেমিককে সহজে মেনে নিতে পারেনা।। আমার বিশ্বাস দুয়েক মাস যাক উনিও রাজি হয়ে যাবেন।

আমার কথা হয়তো ওর কানে একটাও ঢোকেনি। এজন্য শামিম বলল, আচ্ছা তুই তো সাইন্সের ছাত্র তাহলে বলতো, ৫০০এমজি ঘুমের ওষুধ বিশটা মত খেলে কি মানুষ বাঁচবে?

কী বলছেন এসব? জানেন ৫০০এমজি ওষুধ চার থেকে পাঁচটা খেলেই মানুষ দুয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যাবে। তাছাড়া আপনার মুখে এইসব কথা ভালো লাগছে না। প্লিজ প্রসঙ্গ পালটান।

আমার কেন জানি গাটা কেপে উঠলো, আবারো বললাম শামিম ভাই প্লিজ ঐ ধরনের বাজে চিন্তা মাথায় এনেন না। আমি জানি আপনি হয়ত ফিরোজা কে ছাড়া কষ্ট পাবেন। কিন্তু আমি বলি কি আপনি সব কিছু জয় করেন, আপনি আপনার এই গুনটার কথা সবার কাছে বলি যে শামিম ভাইয়ের মাঝে এক অসাধারণ গুন হল মানুষের মন জয় করার অসীম ক্ষমতা।

শামিম আর কোন কথা বলল না।

পরেরদিন ২৫ তারিখ সকাল বেলা এগারোটা নাগাত শামিমের স্টুডিওতে গেলাম। পেলাম না। ছাঁদে তুহিন বসে ছিল। শামিমের সাথে তুহিনও মাঝে মাঝে সব জায়গায় ঘোরা ঘুরি করে। সেই সুবাদে তুহিনের সাথে আমার একটা ঘনিষ্ঠতা হয়। অবশ্য তুহিন নিজের প্রয়োজনেই আমার সাথে বেশি যোগাযোগ করতো আমার স্কুল লাইফ থেকে। কারণ আমার একটা বান্ধবি শ্যামলী কে তুহিন খুব পছন্দ করতো। শ্যামলী আবার আমার সাথে খুব মিশত। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া আসা করার সময় আমাদের বাড়ি আসতো। আমার মাকে খালা বলে ডাকতো। আমিও সময় পেলে শ্যামলিদের বাড়ি যেতাম। ওর আম্মা আমাকে খুব ভালোবাসতো। একেবারে নিজের ছেলের মত স্নেহ করতো।

এই সব গুলো তুহিন জানত বলে আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয় এবং বলে তাঁর হয়ে যেন ভালবাসার কথা গুলো আমি শ্যামলী কে বলি। আমিও বলতাম। তাদের ভালবাসাতে পূর্ণ সমর্থন দিতাম। কিন্তু বিপত্তি হল, শ্যামলী তুহিন কে ভালোবাসতো না। শ্যামলী ভালোবাসতো শিশুপারার একটি ছেলে কে। ছেলেটি আমার অবশ্য খুব পরিচিত। ওর নাম ছিল শরিফুল। বাবার নাম নবি মাহমুদ। আমাদের সাথেই পড়াশোনা করতো।

যাইহউক তুহিন কে বললাম, চল শামিমের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে আসি। শামিম বাড়ি আছে কিনা?

তুহিন কিছু একটা বলতে চেয়ে চেপে গেল,শুধু আমাকে অনুসরণ করলো। বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিলে চাচি জানালো, কার যেন বিয়ে ঐ হুগলী তলা নাকি যেন পাড়াটার নাম সেখানে ভিডিও করতে গেছে। চাচির সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বছিলাম এর মাঝে তুহিনের ফোন আসায় তুহিন আমাকে বলে চলে গেলো। এদিকে শান্তা খালা আমাকে দেখে বলল, শিলন, দাড়াও তোমার সাথে কথা আছে।

আমি বললাম বিকেলে আসবো খালা। এখন সময় নায়।

খালা বলল, শোন তোমার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে হবে।

আমি বললাম, ঠিক আছে।

খালা আর আমি পাশের নদীর ধাপারে গিয়ে বসলাম। আমি বললাম আচ্ছা বলেন তো শামিমের আসতে কয়টা বাজবে?

খালা বলল, তাতো জানিনা, তবে ফোন করে জেনে নাও না।

আমি এবার ফোন দিলাম, শামিম ভাই আজকে অবাক করে দিয়ে ফোনটা ধরলো। আমি বললাম, হ্যালো শামিম ভাই কখন আসবেন?

রাত ৯ টা বেজে যাবে রে। তুই একটু বাসায় জানায় দিস। শামিম এইটুকু বলেই কেটে দিলো।

বুঝলাম উনি এখন কাজে ব্যস্ত আছে। এবার খালার দিকে ঘুরে বসে গল্প করতে লাগলাম। আমরা নদীর খুব কাছাকাছি বসে ছিলাম। শান্তা খালা প্রথমে শুরু করলো, জানো শিলন তুমি কি ইদানীং লক্ষ্য করেছো শামিম কে কেমন মনমরা মনমরা লাগেছে। খুব দুশ্চিন্তা করছে এটা বোঝা যাচ্ছে। তুমি কি কোন কিছু জানো নাকি, ফিরোজার সাথে কি কিছু হয়েছে?

আমি বললাম, নাতো, তেমন হলে তো আমাকে বলতো। তাছাড়া আমি তো অবশ্যই কিছু না কিছু বুঝতে পারতাম। ঐদিন তো দেখলাম ফিরোজার বাবাও পরপর দুইতিন দিন এসেছেন। শামিমের সাথে কথা বললেন হাসি খুশি মুখে। একসাথে চা খেলেন। সবই তো ঠিক দেখলাম।

খালা এবার বললেন, সমস্যাটা তো ঠিক ঐ জায়গায়। উনি কিছু বিষয়ে হয়তো শামিম কে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তুমি তো জানো শামিম কাউকে কিছু বলে না। নিজের কষ্ট গুলো নিজের মাঝে চেপে রাখে। তোমাকে সব কথা খুলে বলে জানতাম। এজন্যই তোমাকে জানালাম।

আমি বললাম, হ্যাঁ কিছু দুশ্চিন্তা আমার মাঝেও আছে। তবে এটা জানি ফিরোজা রাজি থাকলে কেউ ওদের আলাদা করতে পারবে না। তাছাড়া ফিরোজার মাও রাজি, বাবা কে উনিই রাজি করাবে। আপনি শামিম কে বোঝান। আমিও বুঝাছি।

এভাবে কথা বলতে বলতে রাত ৯ টা ২৫ বেজে গেলো যখন তখন শামিমের ফোন আসলো। তুই কোথায় রে আর তোর সাথে কি শান্তা খালা আছে?

আমি বললাম, এইত আপনাদের বাড়ির সোজাসুজি নদীর পাড়ে। খালা আপার সাথেই আছে।

শামিম বলল, উপরে উঠে আয়। উপরে আসলে বলল, কখন এসেছিস?

এইত বিকেলের দিকে। আমি বললাম।

আমার হাত ধরে বলল, চল খাওয়া দাওয়া করে স্টুডিওতে যায় ভিডিও গুলো এডিট করা লাগবে। তুই আমাকে একটু সাহায্য করবি। কি করবি না। তুই তো এসব আমার থেকেও ভালো জানিস।

আমি কোন কথা বললাম না।

খাওয়া দাওয়া করে স্টুডিওতে এসে কাজ শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর ফিরোজার ফোন আসলে, আমাকে বলল, শিলন তুই একটু কাজ গুলো কর আমি একটু তোর ভাবির সাথে কথা বলে আসি। এইগুলো বলে বাইরে গেলো। আবার কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসলে আমি বললাম কি ব্যাপার এতো তাড়াতাড়ি প্রেম শেষ হয়ে গেলো।

শামিম ভাই বলল, না আসলে আমিই রেখেদিলাম। ঘুমানো লাগবে। কালকে আবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে তোদের স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। যেটি পরিচালনা করবেন তোদের প্রিয় শিক্ষক আমজাদ হোসেন। ওইটা আমার আমার সুন্দর করে ভিডিও করা লাগবে।

আমি বললাম, কোন স্যার বললেন?

আমজাদ স্যার।

আমি এবার বুঝতে পারলাম। আমজাদ স্যার আমার স্কুলের সবথেকে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। আমাকে খুব ভালবাসতেন। বন্ধুর মত আমাদের সাথে মিশতেন। পিরোজপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খুব মেধাবি একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি বাংলা গ্রামার ক্লাস নিতেন। খুবই ভালো করে বোঝাতেন। আমরা সারের কাছে প্রাইভেট পড়তাম। স্কুলের সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গুলো উনি পরিচালনা করতেন। আমাদের স্কুলে স্কাউট বাহিনী তিনিই গঠন করেছিলেন।

আমি আরও বললাম হ্যাঁ সার সবার প্রিয়। শামিম বলল, উনি এতো করে অনুরধ করলেন বলেই তো। শামিমের সাথে সারের পরিচয়টাও আমার মাধ্যমে। আমি বললাম, ঠিক আছে তাহলে এখন ঘুমান। আমি বাড়ি যায় অনেকক্ষণ আগে এসেছি।

আমার ইচ্ছা ছিল অনুষ্ঠান টি সরাসরি দেখবো কিন্তু খুব সকাল বেলা আব্বা আমাকে মাঠে যাইতে বলল, মরিচ উঠানো লাগবে। আমি কোন কথা না বলে মরিচ উথানর জন্য মাঠে চলে গেলাম।

আমি ভেবেছিলাম দুপুরে খাবারের সময় আমি বাড়ি চলে আসবো এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে যাবো। অনুষ্ঠান মুলত বিকেলের দিকেই শুরু হবে। এজন্য আমি মাঠে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলাম। কিন্তু সেদিন সেদিন মাঠে দুপুরের সময় আমি আসতে পারলাম না। মাঠে আমার সাথে মরিচ উঠানোর আরও কিছু শ্রমিক ছিল,যাদের সবার জন্য দুপুরের খাবার নিয়েছিল আমার ছোটো ভাই সামাদ। এইজন্য আর বাড়ি আসা হল না। তাছাড়া অনেক গুলো কাজ তখনও বাকি ছিল। আমি বললাম, কাজ শাএশ করেই একবারেই যাবো। তানাহলে আবার আমার আব্বা এবং সহোদর টা কষ্ট করবে। যেটা আমি বাড়ির একজন সন্তান হয়ে মেনে নেওয়া টা সম্ভব না।

শামিম ভাই এদিকে সকাল ৮:৩০ এর সময় ক্যামেরা নিয়ে স্কুলে হাজির। পুরো অনুষ্ঠানের ভিডিও ধারণ করার দায়িত্ব তাঁর। মাঝে মাঝে আবার মঞ্চের পারফর্ম কারির ছবিও তুলতে হচ্ছে।

সকাল ১১ টার সময় একবার শামিম ভাই আমাকে ফোন দিলো, কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল; শিলন তুইই ঠিক বলেছিলি যে ফিরোজা আমাকে ভালোবাসে না। সে অন্য জনাকে ভালোবাসে। আমার সাথে এতদিন সময় অভিনয় করেছে। আমাকে ব্যবহার করেছে। জানিস আমি এখনই দেখলাম ফিরোজা বাইরের একটা ছেলের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে। কথা বলছে আবার ঘনিষ্ঠ ভাবে ছবিও আছে। ছেলেটাকে চেনা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে এই গ্রামের না।

আমি বিষয়টা হালকা করার জন্য বললাম, শোনেন ওটা কোন বিষয় না। ছেলেটা ফিরোজার বন্ধু হতে পারে। আপনাকে ভালোবাসে বলে ওর কি কোন বন্ধু থাকতে পারে না। আপনিই বলেন। তাছাড়া আমাকে বলেন, শ্যামলী কি আপনার বন্ধু না? টার সাথে তো আপনি কত ঘনিষ্ঠ ভাবে ছবি উঠেছেন, সেখানে কি ফিরোজা কখনও চাপ দিয়েছে। ও যদি শ্যামলিকে আপনার বন্ধু হিসাবে মানতে পারে তবে আপনি কেন পারবেন না?। একটা মানুষের বন্ধু থাকতেই পারে তা নিয়ে এতো সন্দেহের কি আছে? যান গিয়ে কথা বলেন।

শামিম এবার বলল, কিন্তু ওর কোন বন্ধু থাকলে তো অবশ্যই আমাকে জানাত। তাছাড়া বন্ধুর মত আচরণ করলে আমি কখনও তোকে জানাতাম্ম না।

আমি বললাম, হতে পারে ফিরোজা আপনাকে রাগানোর জন্য এমন করতেছে। আপনি যান কথা বলেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া আমি জানি ফিরোজা আপনার সাথে বেশিক্ষণ এমন করে থাকতে পারবে না। হয়তো নিজেই এসে আপনার সাথে কথা বলবে।

শামিম বলল, ঠিক বলেছিস, তোর কোথায় যুক্তি আছে।

এইতো এবার লাইনে আইছেন। তাছাড়া এরপরেও যদি আপনার কোন সন্দেহ কাজ করে তবে ওকে সরাসরি বলে ছেলেটার সম্পর্কে জেনে নেওয়ায় ভালো হবে। আপনি ভাবি কে জিজ্ঞাসা করেন। এইটা বলে আমি ফোন কেটে দিলাম।

কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিলো সেইবারের থেকে এবার ওর আবেগ টা বেশি মনে হচ্ছিলো। আমিই আগে বললাম, কি হলো, ভাবি কি বলল।

তোর কোথায় ঠিকরে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এইটা বলে চুপ করে থাকলো শামিম।

আমি এবার আরও হাসতে হাসতে বললাম, আমি জানিত ফিরোজা এমন কিছু করবে না যাতে আপনি কষ্ট পান। এবার খুশিতো।

নারে শিলন তোর আগের ধারনা পুরোপুরি ঠিক। শামিম এবার কান্নাটা বাড়িয়ে দিলো।

আমি এবার কিছুটা শংকিত হয়ে বললাম। কি হয়েছে আমাকে পুরোপুরি খুলে বলেন তো?

আমি ওর সাথে কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু ও আমার সাথে কথা বলতে চাইনি। আমাকে পুরো এড়িয়ে চলতেছে।

আমি বললাম , ও এই ব্যাপার এইজন্য আপনার রাগ হয়েছে। শোনেন ওইটা ওর স্কুল। ওখানে যেহেতু পড়াশোনা করে হয়তো ওর কোন স্যার বা ম্যাডাম দেখছিলো। এইজন্য আপনার সাথে কথা বলতে পারেনি।

কিন্তু ও তো অনেক অপরিচিত ছেলেদের সাথে কথা বলছে। আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু ওর সাথে একটুও কথা বলতে পারিনি। এভাবে আরও অনেক কথা শামিম বলেই যাচ্ছিলো। আমি তাকে থামিয়ে দিলাম।

আমি বললাম, শোনেন হয়তো কোন সমস্যা আছে। নাহলে তো ও এমন করার মেয়ে না। তাছাড়া আপনি সন্দেহ করছেন কেন? দেখেন আমার বিশ্বাস ফিরোজা একটু ফাক পেলেই আপনার সাথে কথা বলবে।

শামিম এবার বলল, কিন্তু আমার চোখের সামনে ও এসব গুলো করছে আমি থাকতে পারছি না। তুই তাড়াতাড়ি আয়। ন আসলে তুই বুঝবি না। নিজের চোখে দেখলেই আমার কথার সত্যতা কে উপলব্ধি করবি। বল তুই কখন আসবি?

আমি বললাম, আমার আসতে মনে হয় এক বা দেড়টা বাজবে।

ঠিক আছে তুই তাড়াতাড়ি আয় ভাই। আমার কিছু ভালো লাগছে না। এভাবে শামিম কিছুক্ষণ পরপর আরও দুবার ফোন করলো সেই একি অভিযোগ। মাঝে মাঝে ওর অভিযগে ছিল এমন, ফিরোজা এটা আমার সাথে করতে পারলো। জানিস ছেলেটা ওকে কিস করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কিছুটা চিন্তার উদয় হল কিন্তু আমি নেগেটিভ কোন কিছু ভাবলাম না কখনও।

এদিকে দেড়টার দিকে মরিচ উঠানো শেষ হলে আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় আব্বা এসে বলল, ব্যাগে তোর জামাকাপড় আনা হয়েছে,। মেশিন থেকে গোসল করে টু মরিচ গুলো নিয়ে মেহেরপুর নিয়ে যা। আমার শরীর টা অনেক খারাপ লাগছে পথে কন্ন বিপত্তি হতে পারে।

আমি আব্বার কথার ওপরে কখনও কথা বলিনি। তাছাড়া আব্বার শরীরের কথা বিবেচনা করে আমি নীরব সম্মতি জানালাম। মরিচ গুলো সাইকেলে উঠায়ে আমি রেডি হয়ে আমঝুপি রাস্তা দিয়ে মেহেরপুরের দিকে রওনা দিলাম।

রাস্তাতেই দুবার ফোন আসলো শামিমের। এবার বলে তুই কখন আসবি রে। অনুষ্ঠান তো শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আমি অপরাধীর মত বললাম, সরি শামিম ভাই আমাকে মরিচ গুলো বিক্রি করার জন্য মেহেরপুর আসতে হয়েছে। কখন ফিরতে পারবো জানিনা।

শামিম আবার বলল, ওই ছেলেটার সাথে ফিরোজার সম্পর্ক আছে। আমাকে জানিয়েছে ওর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীরা। ওইটা নাকি ওর কোন খালাতো ভাই। ওর সাথেই নাকি পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক আছে ফিরোজা।

আমি কথাটা শুনে ভড়কে গেলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম আপনি বিকেলের দিকে ওর বাসায় যান। ওর মাকে বলেন যাকে আপনি আম্মু বলে ডাকেন। আমি বললাম আমি রাস্তায় আছি সাইকেলের ওপরে,পেছনে মরিচ ভরথি বস্তা। শামিম বলল, ঠিক আছে।

পরের বার যখন শামিমের ফোন এলো ,তখন মাগ্রিবের আজান দিচ্ছিল,আমার মরিচ তখন দাঁড়িপাল্লাতে। পরপর দইবার কেটে দিলাম,কারন নজর রাখতে হচ্ছে মরিচের বশ্তার দিকে আবার টাকা নেওয়ার ঝামেলা।তাছাড়া মোবাইলে চার্জ নেই।

কিছুক্ষণ পর দেখলাম তিনটা মেশেজ আসেছে। মেসেজ খুলে দেখলাম,

১। শিলন তুই কখন আসবি, তোর সাথে অনেক কথা আছে।

২। শিলন, আমার সাথে এতো বড় ধোঁকা কেন হল। তুই তাড়াতাড়ি আয়। তোর সাথে অনেক কথা আছে।

৩। শিলন, আগে তুই সঠিক কথা বলেছিলি। আল্লাহুর কাছে তো আমি বেশি কিছু চাইনি। শুধু মাত্র ফিরোজা কে চেয়েলিয়াম কিন্তু আল্লাহ্‌ তাও দিলো না। আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ। তুই তাড়াতাড়ি আই। তোকে এখন আমায় খুব প্রয়োজন।

তৃতীয় মেসেজ টি পাবার কিছুখন পর আবার ফোন। আমি বললাম, হ্যাঁ কি হয়েছে।

শামিম ভাই বললেন, তুই কখন পৌছাবি। তাড়াতাড়ি আয়। বলে কেটে দিল।

পরের বার যখন ফোন দিলো তখন আমি, মেহেরপুর জাতীয় কবরস্থানে। এবার বলল, তুই তাড়াতাড়ি আয়। তোর সাথে কি আমার শেষ দেখা হবে না?

আমি বললাম, কি বলছেন আপনি। শোনেন বাজে চিন্তা করবেন না। আমি এখুনি আসছি।

এভাবে আমি কথা বলতে বলতে দেখি মোবাইল অফ হয়ে গেছে। মনে চক্কর দিয়ে উঠল, কি করবো বুঝতে পারছিনা। সাইকেল দ্রুত চালিয়ে আসলাম আমঝুপি বাজারে, তখন রাত প্রায় সাতটা। একটা দোকানে গিয়ে নোকিয়া মোবাইলের ব্যাটারি কিনলাম কোন দরদাম ছাড়াই। সাথে ফ্লেক্সিলোড দিলাম ১০০% টাকার। নতুন ব্যাটারি সংযোগ দিয়ে ফোনটা অন করলাম, করার সাথে সাথে একের পর এক মেসেজ আসতে লাগলো শামিমের মোবাইল থেকে।

প্রথম দুটো মেসেজ পরলাম, তাতে লেখাঃ

১। তুই ঠিক বলেছিলি। ভালো থাকিস।পরাশুনা চালিয়ে যায়।

২। তোর সাথে আমার শেষ দেখা করার খুব ইচ্ছা ছিল, সেটা করতে পারলাম না। আর হ্যাঁ, রিতা মেয়েটা তোকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। রিতা ফিরোজার মত নয়রে খুব ভালো মেয়ে। তুই ওকে দূরে রাখিস না। এইটা তোর কাছে আমার আবেদন। প্লিজ তুই ওকে ভালবাসিস। ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। যেকোনো মুল্যে রিতা তোকে পেতে চাই। ওর ভালবাসার মুল্য দিস।

আমি একহাত দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছি আর একহাত দিয়ে শামিমের নাম্বারে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করছি। ফোন বাজতেছে কিন্তু ফোন ধরছে না। এভাবে ফোন দিতে দিতে আমঝুপি পেরিয়ে রধুনাথপুর গ্রামে পৌছালাম। বিভিন্ন রকম টেনশনে আমার পানি পিপাসা লেগেছিলো। একটা দোকানে গিয়ে পানি চাইলাম। দোকানদার তার ছোটো মেয়েকে পানি আনতে বাসাতে পাঠাল।

আমি বললাম, চাঁচা দেরি হলে থাক আমি বরং বাড়ি গিয়ে খাবানে।

দোকানদার বলল, না বাজান, পানি খেয়ে যাও না হলে সাইকেল চালাতে পারবা না। কোথায় আবার এক্সিডেন্ট করবা।

দোকান দারের পরামর্শ টা ভালো লাগলো, সেজন্য পানি খেয়ে আবার দিলাম ছুট। আবারো চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। যখন আমি পিরোজপুর মাঠের মধ্যে পৌছালাম তখনি ফোনটা রিসিভ করলো শামিম। বলল, শিলন তুই কোথায়? এসেছিস?

তার কথাটা যেন জড়িয়ে যাচ্ছিলো গলাতে। মনে হচ্ছিলো খুব কষ্টে বলছেন। নিশ্বাসের শব্দ তার প্রতিটা কথাকে হারিয়ে দিচ্ছিল। কেমন যেন আবোল-তাবোল বকতে লাগলো। এখন আর কান্নার আওয়াজ নাই।

আমি ফোনে তিন বার শামিম ভাই বলে ডাকলাম। কোন সাড়া নাই। তবে জোরে জোরে শ্বাসের আওয়াজ আসতেছে। বোঝায় যাচ্ছিলো শামিম কিছু একটা ঘটিয়েছে। মনে পড়লো তার আমাকে বলা আগের আত্মহত্যা করার প্রতিশ্রুতি। সেই শংকাতে আমার হাত পা খুব কাপ্তে লাগলো। মনে মনে বললাম, না না এটা কখনও হতে পারে না। হাতপায়ের কাঁপুনি আমাকে মেইন রাস্তা থেকে নামিয়ে পাশের ঢালুতে পড়ে গেলাম।

ওখান থেকে আবার রাস্তাতে উঠে এসে সাইকেলে উঠলাম। জোরে প্যাডেল মারতে গিয়ে সাইকেলের চেইন গেলো পড়ে। ভীষণ বিরক্ত আমাকে আক্রোশে ফেলে দিলো। সাইকেল স্ট্যান্ড করে মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখলাম, রাত 8:14 বাজে। অন্ধকারে চেইন উঠাতে পারছিলাম না। কারণ আমি নিজেও রাতে অল্প আলোতে কম দেখি। তাছাড়া মোবাইলের আবার টর্চ নাই। অনেকবার চেষ্টা করে বারবার যখন ব্যর্থ হচ্ছিলাম তখন আর রাগ চেক দিতে পারলাম না। সাইকেল টা শুন্যে উঠায়ে পরপর তিনবার আছাড় দিলাম।

কোন কিছুই মাথায় কাজ করছিলো না। কোন উপায় না পেয়ে আবার চেইন উঠানোর চেষ্টা করলাম। অনেক চেষ্টা করার পর চেইন ব্যাটা উঠলো। এবার আরও দ্রুত চালিয়ে গেলাম।

যখন বাড়ি পৌছালাম তখন ৮:৫৬ বাজছিলো। সাইকেল আমাদের বড়ই কাছে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দৌড় দিলাম শামিমের কাছে। নিচের দোকান বন্ধ এবং স্টুডিওর দোকানও বন্ধ। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। বোঝা যাচ্ছে। মধ্যে কেউ থাকার কথা নয়। কিন্তু এইসময় স্টুডিও তো কখনও বন্ধ করে না। আমার মাথায় কিছু কাজ করছিলো না। শামিমের শেষের ওই কথা গুলো কানে বাজছিল বারবার।

বাড়িতে গিয়ে চাচিকে জিজ্ঞাসা করলাম, শামিম কোথায় চাচি?

চাচির সাদা সিধা উত্তর, সন্ধ্যা বেলা খেয়ে বের হয়েছে। তারপর তো আর বাড়ি আসেনি। কেন স্টুডিও তে নাই?

আমি বললাম, দোকানে মানে। দোকান তো বন্ধ দেখলাম। বাইরে থেকে তালা মারা। বাড়ি থেকে যাবার সময় সাথে কেউ কি ছিল?

এবার খালা এসে আমার পাশে দাঁড়ালো বলল, এই সময়ে তো দোকান খোলার কথা। স্কুলের ভিডিও নাকি এডিট করা লাগবে। কিন্তু দোকান বন্ধ মানে কি? আমি সন্ধ্যার দিকে যখন দেখেছি তখন তো সাথে কাউকে দেখি নি। আমি ওদের কথাটা বললাম না, কারণ মেয়ে মানুষ আরও চিল্লাচিল্লি করে ফেলবে কোথায়?

আমি সোজা স্টুডিওর ছাঁদে আবার আসলাম, এখনো দোকান বন্ধ। আমি বারেবারে শামিম কে ফোন দিচ্ছি। কোন রেসপন্স নাই। কেন এমন করছে বুঝলাম না। আমার অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। এবার ফোন দিলাম রাজু ভাইকে।

রাজু ভাই বাড়িতেই ছিল, গানের আওয়াজ আসছিল। বুঝলাম রাজু গানের প্র্যাকটিস করতেছে। রাজু ফোন ধরে বলল, হ্যাঁ শিলন, বলো কি হয়েছে?

আমি বললাম, আপনার সাথে কি শামিম ভাই আছে?

নাতো। আমার সাথে দুপুরে দেখা হয়েছিলো। তারপরে আর দেখা হয়নি। কেন খুব প্রয়োজন। রাজু ভাই বলল।

আমি বললাম, না এমনি, আর কি। এবার ফোন দিলাম সজিব ভাইয়ের কাছে। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে আমি বললাম, সজিব ভাই আপনার সাথে কি শামিম ভাই আছে?

সজিব বলল, নাতো আমার সাথে তো নাই? কি হয়েছে?

আমি বললাম, হয়তো কোন কিছু একটা হয়েছে। আমি আপনাকে পড়ে বলল। আপনি পারলে একটু খোঁজ করেন। এইগুলো বলে আমি রেখে দিলাম।

এবার মনে মনে তুহিনের কথা। শামিমের স্টুডিওর কাছে তুহিন সবসময় থাকে বলে তুহিনের সাথেও শামিমের খুব বোঝাপড়া ভালো। তুহিন ফোন রিসিভ করে আমার প্রশ্নে উত্তর করলো, আমি রাজার দোকানে কেরামবোর্ড খেলছি। শামিম তো আমার সাথে নেই।

আমি বললাম, ঠিক আছে ।

কোন কি সমস্যা। তুহিন বলল। আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না। বসে ছিলাম স্টুডিওর ছাঁদে। কিছুক্ষণ পর তুহিন আসলো। হ্যাঁ বাপ কি হয়েছে এবার বল। তখন ভিড়ের মধ্যে ছিলাম তো টাই তোর সব কথা বুঝতে পারিনি।

আমি বললাম, আমি যখন মাঠের মধ্যে ছিলাম তখন শামিম ফোন রিসিভ করেছিলো। ওর কণ্ঠ কেমন যেন আড়ষ্ট লাগছিলো। কথা বলতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছিলো। ঘন ঘন নিশ্বাস ওকে হাপিয়ে তুলছিল।

তুহিন বলল, সবার কাছে ফোন দিয়েছিস। আমার তো মনে হয় কারো সাথে কোথাও হয়তো ঘুরতে গেছে।

আমি বললাম, তোর মাথা খারাপ, ঘণ্টা খানেক আগে আমাকে ফোন দিয়ে এমন কাতর ভাবে কথা বলল, আর তুই বলছিস কারো সাথে ঘুরছে। তোর কি কোন কমন সেন্স নাই? তাছাড়া আমি ওর প্রতিটি বন্ধুর কাছে ফোন দিয়েছি। কারো সাথে শামিম নাই। এবং যখন ফোন রিসিভ করেছিলো মনে হচ্ছিলো ও ঘুমিয়ে আছে।

আমি এসে বাড়িতে দেখলাম নাই, দোকান বন্ধ বাইরে থেকে তালা মারা, মানে দকানেও নাই। কথাই আছে কিছু বুঝছি না।।

তুহিন বলল, আচ্ছা ফিরোজার বাড়ি কি খোঁজ নিয়ে দেখেছিস।

আমি বললাম, হ্যাঁ দুবার ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু একবারও ফোন ধরেনি। এবং এখানে এসে একবার দিলাম ফোন ধরছে না। কিহয়েছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

তুহিন বুদ্ধি করে আমার সাথে নাম্বার নিয়ে ফোন করলো, তুহিনের নাম্বার অপরিচিত হওয়ায় এবার ফোন রিসিভ করলো, কে বলছেন? ফিরোজার প্রশ্ন।

আমি তুহিনের সাথে ফোনটা সাথে সাথে নিয়ে বললাম, আমি তোমার শিলন ভাই বলছিলাম, শামিম কি তোমাদের ওখানে?

ফিরোজার কথা বলার ধরণ পুরো চেইঞ্জ হয়ে গেলো, আপনার শামিম ভাই কোথায় আছে টা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? শোনেন আর দ্বিতীয় বার আমাকে ফোন করবেন না। এইটা বলে কেটে দিলো।

আমার মাথার মধ্যে ঝড় উঠে গেলো, এটা ফিরোজা কি বলতেছে, আমি এতোটাই রেগে গিয়েছিলাম যে আমার কথা বের হচ্ছিল না। তুহিন কে আস্তে করে শুধু বললাম, ওখানে নেই।

এবার মনে পড়লো শান্তা খালার কথাটা, বাড়িতে যখন গিয়েছিলাম, তখন বলেছিলো, কাঁঠাল পুতা যাবার কথা। মনে হলো গতকাল রাতে কাঁঠাল পুতা গ্রামের লতিফ মির্জার মেয়ের বিয়ের ভিডিও টার কথা যেটা আমি আর শামিম ভাই রেডি করেছিলাম। ওখানে আজকে দিতে যাবার কথা ছিল ওখানে যায়নি তো?

ওখানকার নাম্বার টা আমার জানা ছিল, সেজন্য নাম্বারটা বের করে ফোন দিলাম।

ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করে জানালো হ্যাঁ এসছিল শামিম। কিন্তু চলে গেছে তো।

আমি বললাম, আচ্ছা আন্টি বলতে পারবেন তখন সময়টা কত ছিল আনুমানিক?

উনি বললেন, হ্যাঁ সেতো সন্ধ্যার আগে এসেছিল। তবে মন মরা মন মরা লাগছিলো। কিছু কি হয়েছে?

আমি বললাম, না তেমন কিছু না। আচ্ছা তাহলে রাখি। বলে ফোন রেখে দিলাম।

চাচিতো বলল, সন্ধ্যা ৭ টার দিকে শামিম ভাত খেয়েছে। তাহলে আমার সাথে শেষ কথা হয়েছে ৮:৪৫ এর দিকে। মাঝের এক দেড় ঘণ্টা তাহলে কি করেছে। ফিরোজাদের বাড়ি কি গিয়েছিলো। তাও তো ফিরোজা জানালো না। এখন হয়তো গ্রামের মধ্যেই আছে।

এবার মনে পড়লো্‌ শামিমের স্কুল জীবনের বান্ধবি নাসরিনের কথা। নাসরিনের বাসা পশ্চিম পাড়াতে। ওর বাবা আমাদের প্রাইমারি স্কুলের একসময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন। নাসরিনের সাথে আমারও খুব ভালো একটা সম্পর্ক। কারণ আমার বড় আপুর বান্ধবি। আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে আসতো। আমার সাথে মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হতো।

আমি নাসরিন আপার নাম্বারটা বের করে ফোন দিলাম, যেহেতু আমার নাম্বার পরিচিত। আমাকে ওর ফ্যামিলির সবাই চেনে। প্রথমে ওর আম্মা ফোন ধরলো, হ্যাঁ বাবু শিলন, কেমন আছো?

আমি বললাম, খালা আমি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন? নাস্রিন আপা কোথায়?

হ্যাঁ বাপ ভালো আছি। নাসরিনের আম্মা বলল, বাবা নাসরিন তো বাথরুমে একটু পড়ে ফোন দাও। আমি ফোন কেটে দিলাম।

কিচ্ছুক্ষন পরেই নাসরিন আপার নাম্বার থেকে ফোন ব্যাক আসলো, রিসিভ করার সাথে সাথেই বলল, কি ব্যাপার শিলন কি হয়েছে। এতদিন পড়ে আপার কথা মনে পড়লো?

না মনে সবসময়ই পড়ে কিন্তু অনেক চাপ তো টাই ফোন দিতে পারিনি। আচ্ছা আপু শামিম কি আপানার ওখানে গিয়েছিলো। আমি প্রশ্ন করলাম।

আপা বলল, হ্যাঁ এসেছিল কিন্তু আমি বাড়িতে ছিলাম না। তাই দেখা হয়নি। আম্মার কাছে শুনেছিলাম ওর মনটা ভীষণ ভার। কেন কিছু কি হয়েছে?

আমি বললাম, আসলে ফোন দিচ্ছি ফোন ধরছে না। মনে হচ্ছে ফোন ওর কাছে নেই।

বলো কি। তুমি আবারো ফোন দাও, আমিও ফোন দিচ্ছি। শোন আমাকে জানিয়ো। এইটা বলে নাসরিন আপা ফোন রেখে দিলো।

এদিকে তুহিন আর আমি একনাগাড়ে শামিমের নাম্বারে ফোন দিয়েই যাচ্ছি। হটাত শামিম একবার ফোন রিসিভ করলো। যেন ফোনে কথা বলতেই পারছেনা। এবার নিশ্চিত হলাম শামিম একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে। আমি কিছু না বলেই কান্না শুরু করে দিলাম একটু শব্দ করেই। আমি আর তুহিন স্টুডিওর বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছিলাম। শামিমের কথাগুলোর কিছু অংশ স্টুডিওর মধ্যে থেকে আসছিলো বলে মনে হচ্ছিলো। আমি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম।

যখন শিওর হলাম তখন তুহিন কে ডেকে বললাম, তুহিন আমি শিওর শামিম ভাই দোকানের ভিতরে আছে। তুহিনও ব্যাপার শিওর হওয়ার পর বলল, ঠিক ও ভিতরেই আছে। আমি বললাম, তালা টা ভাং।

আম্মার কান্নার শব্দে আশেপাশের অনেক মানুষ জমা হয়ে গেছে। তাছাড়া শামিমের সাথে শেষের কথাটা লাউড স্পিকারে দেওয়া ছিল বলে সবায় নিশ্চিত শামিম বিষ খেয়েছে। কিন্তু তাদের এটা বিশ্বাস ছিলনা যে শামিম স্টুডিওর ভিতরে আছে। এজন্য তারা কেউ তালা টা ভাংতে চাচ্ছিল না। ওরা বারেবারে বলছিল শামিম দোকানে নাই।

আমি এবার কারো কথা না শুনেই তালা টা ভেঙ্গে ফেললাম। ভিতরে ঢুকে দেখলাম, শামিম ভাই মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছে।

আমাকে দেখে ভালো সুস্থ্য মানুষের মত উঠে বাইরে চলে গেলো। গায়ে যে কাথা ছিল টা নামিয়ে বাইরে চলে গেলো আমাকে কিছু না বলে। ঐদিন ওইসময় গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না, আমি অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে আম্মার মনে হালকা করে সস্তি আসলো যে শামিম ভাই সুস্থ্য আছে। যেটা ভেবেছিলাম সেটা করেনি। এজন্য আমি খুশিতে কিছু তখন বললাম না।

বাইরে যারা ছিল তারা শামিমের দাড়িয়ে থাকা থেকে বুঝতে পারেনি যে শামিম বিষ খেয়েছে। তাই একে একে চলে গেলো। শামিম বাইরে যেতে চাইলে বাইরের সিঁড়িতে তুহিন থামিয়ে বলল, কি হয়েছে, কোথায় যাও? তুহিন তখনও বুঝতে পারেনি যে শামিম বিষ খেয়েছে।

শামিম তুহিন কে কিছু না বলেই বাইরে নেমে গেলো, রাস্তার পাশে সরকারি টিউবওয়েল এর থেকে পানি নিয়ে খাচ্ছিল। এজন্য তারা কিছুই মনে করেনি। কিছুক্ষণ পরেই তুহিন স্টুডিওর মধ্যে ঢুকল। আমি আগে থেকেই ওখানে মেঝেতেই বসে ছিলাম। আমি অনেক ক্লান্ত ছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে এজন্য কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। তুহিন ঢুকে লাইট মারলো, এবার আমার চোখ গেলো মেঝেতে। ততক্ষন তুহিন লাইট নিভিয়ে ফেলেছে।

আমি তুহিনের হাত থেকে লাইট টা নিয়ে মেঝেতে আলো ফেললাম, সারামেঝে ঝুরে ফ্যাপড়া, মুখের নালা এবং বমি করা। সাদাসাদা। আমি দেখে আবারো কেদে উঠলাম। তুহিন কে দেখালাম। তুহিন এবার বলল, ঠিক তোর প্রথম ধারণাটা একদম ঠিক। শামিম বিষ খেয়েছে। সারামেঝে তে বিষের গন্ধ। চল চল তাড়াতাড়ি শামিম কোথায় গেলো, এখনো নিলে বাঁচানো যাবে।

এবার কানে এলো নিচের পাশের রাজার দোকান থেকে কাকে যেন এভাবে বলছে, এই কে রে। কে ওখানে বমি করতেছে। তখন আমি আর তুহিন দৌড়ে গেলাম, শামিম আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে। আমার কান্না থামছে না। মনে হচ্ছে এখনই শামিম মারা যাবে।

আমি নিঃশব্দ হয়ে গেলাম, কোন কথা বলতে পারছিলাম না। আমার ডান হাতটা শামিম শক্ত করে চেপে ধরছে। বুঝতে পারলাম। অনেক কষ্ট পাচ্ছে। আস্তে আস্তে এবার বলল, আমি... শিলন আমি ফিরোজা কে অনেক ভালোবাসি রে। ওকে ছাড়া আমার বেচে থাকা সম্ভব না। তাই আমি চলে যাচ্ছি। ভালো থাকিস ভাই আমার। আমার পরিবারের দিকে একটু খেয়াল রাখিস ভাই। আমি আর বেশিক্ষণ বাঁচবো না। তোর সাথে শেষ দেখা করবো বলে বেচে আছি।

এরই মধ্যে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। কারণ আমরা সরকারি রাস্তার মাঝ খানে। যার আশাপাশে অনেক গুলো চায়ের দোকান আছে। সবাই উঠে এসেছে। বলছে তাড়াতাড়ি হাস্পাতাআলে নিয়ে গেলে বাঁচানো যাবে।

একটা আলগামন দেখার জন্য রিপন কে ফোন করলাম। রিপন ভাই তাড়াতাড়ি ওর আলগা মন নিয়ে চলে আসলো। শামিম কে উঠায়ে মেহেরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমি শামিমের মাথার কাছে ছিলাম। আমার কোলে শামিম তাঁর মাথাটা দিয়ে ছিল। দুইপাশে ছিল রাজা এবং আমার বড় ভাইয়া ফরিদ। পায়ের কাছে ছিল তুহিন এবং জিয়া মামা।

শামিমের কথা যেন শেষ হতেই চাচ্ছে না। একেরপর এক অবান্তর অবাস্তব কথা বলেই যাচ্ছে। তার কোন কোন টা এমন...

শিলন, আমি তো তাকে নিঃশর্ত ভালোবাসা দিয়েছিলাম, কিন্তু ক্যান সে আমার সাথে এমন টি করলো ইত্যাদি। আমি কি এমন দোষ করেছিলাম। শিলন আমি কি খুব খারাপ? বল বলনা।

আমি কোন কথা বলছিলাম না, তাঁকে শুধু বলছিলাম, আপনার কিচ্ছু হবে না। সান্তনা দেবার জন্য মিথ্যাও বললাম, আমি ফিরোজার সাথে কথা বলেছি। ও আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ওকে আপনার কাছে নিয়ে আসবো।

এবার শামিম বলল, আমার সাথে মিথ্যা বলছিস ভাই, আমাকে তুই খুব ভালবাসিস। তাই না? ও আমার সাথে থাকতে পারবে না। আমি জেনে গেছি।

আমি বললাম, এমনভাবে বলবেন না, আমরা কি কেউ না। আপনি একটা মেয়ের জন্য চলে যাবেন। আপনার জীবনের প্রতি কি আমাদের কোন অধিকার নাই। বলেন? আমি বললাম, শোনেন কেউ আপনাকে ছেড়ে যাবে না। আমি কথা দিচ্ছি ফিরোজা কে আমি এনে দেবো।

জোর করে তার ভালোবাসা আমি কতক্ষন নেবো বল। সে যদি আমাকে ভালোই না বাসে তবে কি করে আমি তাঁকে ভালবাসবো। এইধরনের অনেক কথা বলল।

আমি বললাম, চুপ করেন। আপনার কিছু হবে না। আমি আপনাকে বাঁচাবো।

নুরপুরের মোড়ে এসে পৌঁছালে দেখলাম, শামিম আর কথা বলছে ওইসব বিষয়ে। তবে আস্তে আস্তে বলছে, আমার মত কেউ যেন আর বিষ না খায়। বিষ খাওয়া যে কত কষ্টের তা আমি বুঝেছি। তোরা কেউ বিষ খাস না। এইগুলো বলে আস্তে আস্তে নেতিয়ে আসছিলো। কথা বন্ধ করে দিলো। আআমি ঝাকালে উত্তর দিলো না। শুধু ছোটো ছোটো চোখে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর চোখ বুঝলে। আমার বড় ভাইয়া ফরিদ বলল, শিলন ওকে ঘুমাতে দিস না, জাগিয়ে রাখ। চোখ বুঝতে দিবি না। যতক্ষন হাসপাতালে না পৌছায় ততক্ষণ কথা বলিয়ে নে। নাহলে মারা যাবে।

এইজন্য আমি বিভিন্নভাবে শামিম কে কথা বলিয়ে নিচ্ছিলাম। মিথ্যা করে বলছিলাম, শামিম ভাই এই যে কিছুক্ষণ আগে ফিরোজা ফোন দিয়ে ছিল খুব কাদছে। তার ব্যবহারের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে। ফিরোজার বাবা আপনাকে মেনে নিয়েছে। সবার হাসপাতালে আসার জন্য গারিতে উঠে পড়েছে। কি ফিরোজা কে ক্ষমা করবেন না। ইত্যাদি আরও অনেক কথা বলছিলাম।

শামিম বারবার বলছিল, শিলন তুই মিথ্যা বলছিস। আমি জানি সে কখনও আর আমার জীবনে আসবে না।

আমি বলছিলাম, ফিরোজা এবং ফিরোজার চাচারা সবাই ওই রাস্তা দিয়ে আসছে। সবাই আপনার ভালোবাসা কে মেনে নিয়েছে। এইধরনের বিভিন্ন মিথ্যা কথা বলছিলাম যাতে শামিম কে জাগিয়ে রাখা যায়। ফিরোজার কথা বললে ও মনযগ দিয়ে শুনছিল। আমার দিকে তাকাচ্ছিল।

এভাবে কোলার মোড়ে পৌঁছালে গাড়ি আটকালো ছিনতাই কারিরা। আমি নেমে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলাম, দেখেন ভাই আমাদের ভ্যানে বিষ খাওয়া রোগী আছে। আমাদের যেতে দেন। নাহলে রোগীটাকে বাঁচানো যাবেনা। প্লিজ আমাদের যেতে দ্যান।

এবার ওরা আরও উত্তেজিত হয়ে গেলো, আমার গায়ের দিকে ধেয়ে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো আমাকে হাতের চাকু দিয়ে এখনই মেরে ফেলবে। বলল, তাহলে নিশ্চয় বেশি করে টাকাপয়সা নিয়েই বাইর হইছস। যা আছে দিয়া দেন। অন্তত ৫ হাজার টাকা না হলে ছাড়ছি না। নাদিলে আল্গামন রেখে যা। এটা বেচে আমাদের আরও অনেক বেশি টাকা হবে।

আমি বুঝলাম, কুলাঙ্গাররা টাকা না নিয়ে ছাড়বে না। ওদের মনে কোন মায়া দয়া নাই। আমার হটাত মনে পড়লো, মরিচ বেচা টাকা টা তো আমার পকেটেই আছে। প্রায় ৮ হাজার মত। আমি এবার ওদের কাছাকাছি আসলাম, বললাম, ভাই ওদের যেতে দ্যান দেরি হয়ে গেলে রোগী মারা যাবে। আমি আপনাদের দাবি ৫ হাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছি।

কিছুক্ষণ আমার দিকে ভালো করে দেখে নিয়ে ওই শামিমের ভ্যান গাড়িটাকে যেতে দিলো। আমি ফরিদ ভাইকে বললাম, ভাইয়া শামিম কে কথা বলাতে বলাতে নিয়ে যাও আমি পরের ভ্যানে আসছি বলে ওদের বিদায় দিলাম। ওরা চলে গেলে আমি ভীষণ টেনশনের মধ্যে পকেটের পুরো টাকাটাই ওদের নেতা কে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, নে জানোয়ার রা তোদের মনে তো কোন দয়া মায়া নেই। তোদের দাবি পাঁচ হাজারের অনেক বেশিই আছে।

ওরা টাকা টা নিয়ে দ্রুত মাঠের মধ্যে হারিয়ে গেলো, আমি পরের ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু অপেক্ষার যেন শেষ নাই। মনে হয় পরের ভ্যানে যাদের আসার কথা তারা এই রাস্তার খারাপ দিক সম্পর্কে আগে থেকেই অবহিত। তাই আমঝুপি রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে আসছে মনে হয়।

কি আর করা আমি একা একা অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় ৪০ মিনিট মত অপেক্ষা করার পর দেখলাম একটা পুলিশের গাড়ি আসছে। আমার কাছাকাছি হওয়াতে থামল আমার ইশারাতে।

পুলিশ দারোগা আমাকে সন্দেহ ভাজন মনে করে পিস্তল বের করলো। আমার চোখে আলো মারতেই পেছন থেকে একজন সিপাহি আমাকে চিনতে পেরে বলে উঠলো, আরে শিলন সাহেব যে, এখানে এতো রাতে কি করেন? এবার দারোগা ওদের কাছ থেকে কনফার্ম হয়ে আমার সমস্যার কথা শুনল।

পিছনের যে সিপাহি আমাকে চিনেছিলো ওর নাম ছিল “ইলিয়াস”। ইলিয়াস আমাকে শ্বশুর বলে ডাকতো। কারণ ও যে মেয়েটা কে ভালোবাসতো সে আমার সম্পর্কে ফুফু হয়। আমার ফুফুর নাম ছিল “মিতা”। মিতা ফুফুর সাথে আমার গভীর একটা সম্পর্ক ছিল। আমাকে ফুফু আব্বাজান বলে ডাকতো। ওর বাবার নাম এনামুল। গ্রামের পশু ডাক্তার। ভালো সুনাম আছে। ফুফু মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়ি আসতো। ইলিয়াস এজন্যই আমাকে শ্বশুর আব্বা বলে ডাকতো। ফুফু অবশ্য এতে সেভাবে কখনও সাড়া দিতো না। ইলিয়াস আমাকে বলতো আমি যেন মিতার সাথে তার প্রেম করে দেই।

এবার দারোগা আমাকে বলল, আমরা তো পিরোজপুর ক্যাম্পে যাচ্ছি, তুমি যেতে চাইলে আস্তে পার। তাছাড়া রাস্তাটা ভালো না আমাদের সাথে যাওয়াটায় ভালো।

আমি কোন কথা না বলেই উঠে পড়লাম, পিরোজপুর মন্দিরের কাছে আসলে আমি নামতে চাইলাম। ওরা আমাকে নামিয়ে দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে গেলো।

আমি সোজা শামিমদের বাড়ির উদ্দেশ্যে গেলাম। সবাই দেখি তুমুল কান্না করছে। চাচি, চাচা, খালা, শামিমের ছোটো ভাই বোন, আমার বাবা-মা এবং আপু ভাবি। আমাকে আসতে দেখে সবাই একসাথে জিজ্ঞাসা করতে থাকলো, কি অবস্থা এখন। আমি চলে আসলাম কেন?

আমি রাস্তার দুর্ঘটনার কথা বললাম, সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলো। সেই মুহূর্তে আমার বড় ভাইয়া ফোন দিলো আমার কাছে; ভাইয়ার প্রচণ্ড কান্নাভেজা কণ্ঠ। ভাইরে শামিম আর নাই। আমরা শামিম কে বাচাতে পারলাম না। শামিম মারা গেছে। আমি যেন বিশ্বাস করতে পারলাম না, মুখ দিয়ে কথা বন্ধ হবার উপক্রম হল। কিন্তু চোখের পানি ফুয়ারা বইতে লাগলো। সবাই আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে, ও শিলন বল শামিমের কি অবস্থা।

আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। এবার শান্তা খালা আমার হাতে ঝটকা মেরে বলল, শিলন, বলো শামিমের কি হয়েছে?

এবার আমার মুখ দিয়ে আস্তে করে বাইর হইলো শামিম আর নাই। আমাদের ছেড়ে বলে গেছে।

শান্তা খালা চিৎকার করে কেদে উঠল, না তা কখনোই হতে পারে না!

শামিমের মা আমাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে, না তুমি মিথ্যা বলছো। আমার শামিম মরতে পারে না।

এমন কান্নাকাটির ৩০ মিনিটের মধ্যেই শামিমের লাশ চলে আসলো। পুরো গ্রাম জানানো হল মসজিদের মাইকের দ্বারা। সবাই এক নজর দেখার জন্য রাত থেকেই আসতে শুরু করলো। পুলিশ জানলে ময়না তদন্ত হবে লাশ কাটবে এ করে পরের দিন সকালে কবর দেবার কথা বললো।

আমি নীরবে একপাশে বসে ছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম লাশ ময়না তদন্ত করা হোক। তাহলে বোঝা যাবে বিষ খাওয়ার আগে তাঁকে শারীরিক ভাবে কোন অত্যাচার করা হয়েছিল কিনা? তাছাড়া আমি শামিমের গায়ে লাল লাল আঘাতের অনেক গুলো দাগ দেখেছি। আমি নিশ্চিত ময়না তদন্ত হলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। তাছাড়া জেরা হলে উকিল অনেক কিছু বের করতে সমর্থ হবেন।

কিন্তু আমার কথা কেউ শুনলো না। শামিমের মরদেহ তড়িঘড়ি করে কবরস্থ করে ফেললো। তবে একটা বিষয় আমাকে প্রশান্তি দিলো। সেটা হলো শামিমের জানাযাতে যতো মানুষ শরিক হয়েছিলো যা আমি পূর্বে আমাদের গ্রামের কারো মৃত্যুতে দেখিনি।

মনটা ভীষণ খারাপ নিজেকে খুব অপরাধী অপরাধী লাগছে। মনে বারবার একটা ভাবনা এসে ভর করছে, যদি আমি ঐদিন শামিমকে সঙ্গ দিতে পারতাম তাহলে হয়তো শামিম সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত কখনও নিতো না। আমি থাকলে ওকে বোঝাতাম। কিন্তু আমি ওকে সময় দিতে পারিনি। বেচারি আমার কাছে সকাল থেকে ফোন করছিলো কিন্তু আমি বারেবারে এড়িয়ে গেছি কাজের জন্য। এইগুলো ভাবছিলাম আর নিজেকে খুব করে দুষছিলাম।

এবার আমি শামিমের অমন কঠিন সিন্ধান্ত নেওয়ার কারণটা খুজতে লাগলাম, আমার বিশ্বাস ওই সময় ওর সাথে এমন কিছু খারাপ ব্যবহার হয়েছে যেটা ওকে এতো বড় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। ও বলতো সবসময়, আমি কখনও এই সব কাজ করবো না কারণ এটা মহাপাপ। তাছাড়া আমি মোড়ে গেলে আমাদের পরিবারটা পুরো ভেঙ্গে যাবে। নিশ্চয় কোন কিছু ঘটেছে।

এবার মনে পড়লো ফিরোজার কথা। ঐদিন ফিরোজা আমার সাথে যে ভাষাতে কথা বলে ছিল তাতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় খারাপ ব্যবহার টা কোথায় থেকে ঘটেছে।

তাড়াতাড়ি ফোন বের করে ফিরোজা কে ফোন দিলাম, না ফোন বন্ধ। ওর মাকে ফোন দিলাম। সেই একই অবস্থা। মনে কিছু একটা সন্দেহ দানা বাধতে শুরু করলো। না আমাকে এর কারণ অনুসন্ধান করতেই হবে সেদিন কি ঘটেছিলো। আমি এই গুলো বের করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম।

আমি ভাবলাম, আমি ফিরোজাদের বাড়ি যাবো, যেভাবেই হউক জানতে হবে। দরকার হলে ফিরোজার ছোটো বোন কে জিজ্ঞাসা করবো। না বললে প্রয়োজনে ফিরোজার ৮ বছরের ভাই টাকে জিজ্ঞাসা করবো। বাচ্চারা সাধারণত কখনও মিথায় বলে না। তারা নিজের স্বার্থ বোঝে না।

এইসব কথা গুলো ভাবছিলাম আর হাঁটছিলাম। একসময় ফিরোজাদের বাড়ির গেটের কাছে আসলাম। দেখি গেঁটে বাইরে থেকে তালা মারা। মানে কেউ বাসায় নেই। নিশ্চিত হবার জন্য পাশের বাড়ির একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। ওরা বলল যে ফিরোজারা কেউ বাড়ি নাই। এবার আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হতে লাগলো। আসল ঘটনা কি তা জানতেই হবে।

গেলাম শামিমের স্টুডিওতে। চাচির সাথে স্টুডিওর চাবি নিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকলাম। পুরা স্টুডিও আমি সব কিছু খুজলাম। ছবি যেখানে ওয়াশ করে সেইঘরে ঢুকে এক জায়গায় অনেকগুলো ছাই পেলাম। ছাই গুলো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম এই গুলো চিঠি পুড়ানো ছাই। পাশে দেখলাম ফিরোজার একটা ছবির অংশ যার নিজের নিচের দিক থেকে পুড়ে মুখটা শুধু আছে। বুঝলাম, প্রথমে রাগে ছবিটা আগুনে দিয়েছিলো কিন্তু আগুনে এতসুন্দর মুখটা পুড়বে যেটা শামিম দেখতে পারেনি বলে আবার আগুন নিভিয়ে ফেলেছে।

ল্যাব রুমে ঢুকে দেখলাম, সেখানেও ফিরোজার লেখা চিঠিগুলো আধ-পুরা আধ-পুড়া। বিভিন্ন ভাবে খুজতে খুজতে ফিরোজার লেখা ৪টা চিঠি আমি পেলাম, যেগুলো ফিরোজার প্রথম দিকের লেখা। এইগুলোতে ফিরোজার গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল। এতে প্রমাণ করা যাবে না যে এই মৃত্যুতে ফিরোজার প্রত্যক্ষ হাত ছিল। নাহ, কোনো শক্ত প্রমাণ শামিম রেখে যায়নি।

এবার কম্পিউটার ঘাঁটলাম, প্রথমে My Document ফোল্ডার এ একটি ছোটো গল্প লেখা ছিল। লেখকের জায়গায় শামিমের নাম দেওয়া ছিল। খুব রোম্যান্টিক একটি গল্প। কম্পিউটার এ প্রততি ফাইলে ফিরোজার সুন্দর সুন্দর ছবিতে ভরপুর। এভাবে আমি বিকেল পর্যন্ত স্টুডিও কম্পিউটার সব কিছু দেখলাম। কম্পিউটার এ কিছু পেলাম না। প্রিন্টিং বক্সে দেখলাম অনেক গুলো ৫০০এমজি পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ। বুঝতে পারলাম, শামিম বিষ খাওয়ার আগে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ছিল। এজন্য বাঁচানো সম্ভব হয় নি।

স্টুডিও বন্ধ করে চলে আসবো নিচে, হটাত করে প্রস্রাবের বেগ বাড়ল। স্টুডিওর নিচে সামান্য পাশে একটু ঝোপ মত ছিল যেখানে আমি এবং শামিম প্রায়ই প্রস্রাব করতাম। তাই আমি ওখানে গিয়ে বসলাম। প্রস্রাবরত অবস্থায় ডানে তাকাতেই একটি চেনা ডায়রিতে চোখ আটকে গেলো।

ডায়রি টা উঠায়ে দেখলাম, হ্যাঁ খুবই পরিচিত ডায়রি। প্রায় তিন বছর আগে যেটা আমি প্রথম ফিরোজা কে দিয়েছিলাম ১৪ ই ফেব্রুয়ারী তে শামিমের হয়ে। ঐদিন অবশ্য ফিরোজা ডাইরি টা নিয়েছিল না। কারণ তখন রাজি ছিলনা। পরে আমি ঢাকাতে চলে গেলে সুমন ফিরোজাকে রাজী করায় শামিমের ভালবাসার ব্যাপারে। এবং তখনি ডায়রিটা ফিরোজা নিয়েছিল। আমি ডায়রি টা উঠালাম, পাতা উলটাতেই দেখলাম আমার লেখা সেই কথা গুলো। পরের পেজ গুলো ফিরোজা গান লিখে ভরে রেখেছে।

আমি ডায়রিটা নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।দরজা বন্ধ করে ডায়রি পড়া শুরু করলাম। শেষের কয়েকটি পাতা শুধু শামিম লিখেছে। তাছাড়া পুরো ডায়রিটাই ফিরোজার নিজের হাতে লেখা।

ডায়রিতে ফিরোজা লিখেছেযে, সে কখনও শামিমকে ভালোবাসে নি। বন্ধুরা সবাই মিলে প্লান করে শামিমের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলো। শামিম কে তারা ব্যবহার করার জন্য এই প্লান করেছিলো যার উদ্যোক্তা ছিল সুমন। তবে শামিমের অসীম ক্ষমতা মায়েদের মন জয় করার ক্ষেত্রে। আমার মা শামিমকে আপন ছেলের মত ভাবতো, জামাই হিসাবে না। আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করলে আমি বলেছিলাম। আম্মা তুমি পাগল আছো শামিমের অবস্থান কোথায় আর আমার অবস্থান কোথায়? এজন্য আমি সবসময় শামিমের কাছ থেকে একটা দুরত্ব বজায় রাখতাম। এবং এটা সত্য যে টাকে ভালো মত ব্যবহার করার জন্য মাঝে মাঝে অনেক বেশি অভিনয় করা লাগতো। এভাবেই এগুতে থাকে আমাদের খেলা।

ফিরোজার বাবা আসলে বাঁধে গণ্ডগোল। মাকে রাজি করাতে পারলেও বাবা কে পারেনা। বাবা মনে করে ফিরোজাও শামিম কে ভালোবাসে। উনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন যদি এমন কোন প্রমাণ পাই তবে শেষ করে ফেলবো। উনি ফিরোজার বিয়ে ঠিক করে রাখছিল ওরই খালাতো ভাইয়ের সাথে। বাবার জন্য এই খেলা এইখানেই শেষ হয়ে যায় না হলে হয়তো শামিমকে আরও বছর খানেক পিছে পিছে ঘোরানো যেতো। বাবার কাছে প্রমাণ দিতে যে আমি শামিমকে ভালোবাসি না, এবং তাকে যেন না করে দেই খুব তাড়াতাড়ি এজন্যই ঐদিন সরাসরি আমার খলাত ভাই কে স্কুলে নিয়ে যাওয়া যাতে শামিম বুঝতে পারে।

বিষ খাওয়ার দিন পর্যন্ত ফিরোজা লিখেছিল যে আমি তোমার মত ছেলেকে কেন ভালবাসতে যাবো। তোমার থেকে কত স্মার্ট ছেলে আমার পিছনে লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে। তুমি তো একজন অশিক্ষিত। কোন শিক্ষা গত যোগ্যতা নেই তোমার। তোমার মাটির ঘরে ইদুরের সাথে আমাকে রাখবা। আজব তো। আমি আমার খালাতো ভাই কে ভালো বাসি ছোটো বেলা থেকে। উনি একজন ইঞ্জিনিয়ার আর তোমার সাহস কত তুমি একজন দর্জির বাচ্চা দর্জি হয়ে আমাকে পাওয়ার আশা করো।

শেষের পেজ গুলো শামিম লিখেছে বোঝা যাচ্ছে কাপাকাপা হাতে লেখা। ফিরোজা তাকে নাকি বলেছে, বামুন হয়ে চাঁদের দিকে তাকানো যায়, হাত বাড়ানোও যায় তাই বলে কি চাদকে ধরা যায়? এইধরনের হাজারো কটূক্তিতে ভরা লাস্টের পেজগুলো যেটা ফিরোজা শামিমকে বলেছে। তাছাড়া শামিম কে ফিরোজার চাচারা, এবং দাদা নাকি উত্তম মধ্যম দিয়েছেন যেটা শামিম কে ভীষণ ভাবে অপমানিত করেছেন। শামিম লিখেছেন এতোগুলো অপমান আমি সইবো কি করে। না আমি পারবো না এতো অপমান সয়ে বেচে থাকতে। শেষে ফিরোজার সুখি হবার ব্যাপারে বারবার আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেছেন।

ডায়রিটা পড়ে আমি আর থাকতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেদে উঠলাম। কান্না থামতে চাইলো না। কতক্ষণ কেদে ছিলাম জানিনা। সেই মুহূর্তে আমার বাকশক্তি যেন বন্ধ হয়ে আসছিলো। আমি কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম এইটা নিয়ে কিন্তু শামিমের ফ্যামিলি থেকে কোন রকম সমর্থন পেলাম না। তাছাড়া ফিরোজার বাবারা অনেক ধনি লোক। যেকোনো সময় কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে আমাদের মত নিম্নবিত্ত পরিবারের। এইজন্য চাচা বলল, আমার কলিজার টুকরা গেছে যাক। তোমার বাবার বুক আর আমি খালি হতে দেবো না। উনাদের সাথে আমরা পেরে উঠবো না। এইজন্য বিচার আল্লাহর কাছে জানায়।

আমাকে আমার আব্বা তাড়াতাড়ি ঢাকায় পাঠিয়ে দিলো এইসব ভয় থেকে বাচতে। শামিমের ফ্যামিলি পুরো ভেঙ্গে গেলো। ওর বাবা আরেক জনার প্ররোচনায় পড়ে চাচিকে ভুল বুঝে বাড়ি থেকে তারিয়ে দিলো। আরেক টা বিয়ে করলো। আসলে চাচি প্যারালাইসড ছিল হাঁটতে পারতো না, কাজ করতে পারতো না। এজন্য তাকে তারিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করলো। ভাইবোন এবং খালার লেখাপড়ার খরচের অভাবে পড়ালেখা পুরো বন্ধ হয়ে গেলো। শামিমের অনুপস্থিতি শুধু তার পরিবার কে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। অন্য আরও দশ থেকে পনেরো টা পরিবারকে ভেঙ্গে দিলো। আমার অত সামর্থ্য হয়নি যে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো। তবে ফিরোজার খালা একবার আমাকে ফোন দিয়ে ছিল একটা চাকরি দেখে দেওয়ার জন্য । উনার চাকরির ব্যবস্থা করেছিলাম ঢাকার এক বেসরকারি হাসপাতালে। উনি এখন ঢাকাতেই থাকেন।

যার জন্য বিষ খেয়েছিল সেই ফিরোজা একমাসের মাথায় বিয়ে করলো। কিন্তু আল্লাহর কি বিচার তার নাকি ছোটো থেকেই ওর খালাতো ভাইয়ের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক। তার সাথে বিয়ে হবার পরেও বেশি দিন সংসার টিকলো না। এভাবে পরপর দুইটি বিবাহ বিচ্ছেদ ফিরোজার জীবনে ঘটে গেলো। ফিরোজার রঙিন জীবন আসতে আস্তে ধুসর হয়ে গেলো। ফিরোজা অনুতপ্ততাই ভুগে ভুগে মরতে লাগলো। যার এতো ভালোবাসা সেই ভালোবাসাকে না নিয়ে তার সাথে প্রতারণা তাকে প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে হৃদপিণ্ডে হাতুড়ি পেটা করতে লাগলো।





মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.