নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানব ধর্মের চেয়ে কোন বড় ধর্ম নাই এই জগত সংসারে।

মোঃ শিলন রেজা

আমার নাম মুহাম্মদ শাহিদ শিলন রেহমান। আমি মেহেরপুর জেলার পিরোজপুর গ্রামে আমার ছোট বেলা কাটিয়েছি। আমি এইচএসসি পাশ করি ঢাকা মোহাম্মদ পুরের বাবর রোডের ছোট্ট একটা বেসরকারি কলেজে থেকে। কলেজ টার নাম হল, ঢাকা এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল কলেজ। পরে আমি একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

মোঃ শিলন রেজা › বিস্তারিত পোস্টঃ

উপন্যাস

৩১ শে মে, ২০১৩ সকাল ৯:২৬

সেদিন আমরা ছিলাম অপরিচিত

শিলন রেজা বিশ্বাস

ঢাকাইয়া জীবনের পনেরো পার হয়ে গেলেও কখনো আমার ট্রেনে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এর হয়তো সম্ববত একটা কারণ হতে পারে এটা যে আমি এই বৃহৎ শহরটার উত্তর-পশ্চিম এলাকা মোহাম্মদপুরে থাকি। এখান থেকে ঢাকা শহরের সবথেকে বড় প্রবেশ পথ গাবতলি বাস টার্মিনাল খুবই নিকটে। টিকেট প্রাপ্তি এবং যোগাযোগ সুবিধা চলে নিরঝামেলায়। কিন্তু এবার আমার কেন যেন ব্যত্যয় ঘটে গেলো। আসলে দক্ষিন বঙ্গের ট্রেন সার্ভিস কে ডিজিটালাইজ করায় আমি কৌতূহল বশত ইন্টারনেট তে একটা টিকিট বুকিং দিয়েছিলাম। আমি সাধারণত পাবলিক কোচে আসা যাওয়া টা পছন্দ করি। যেহেতু এখানে অনেক অচেনা মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। যেটা আমাকে খুবই আবেগি করে তলে। বলতে পারেন এইটা আমার একটা হবি।

তো ট্রেন ছাড়ার আঘা ঘণ্টা আগে আমি স্টেশনে পৌছালাম। ট্রেনে গিয়ে সীটের পজিশন খুঁজে আমি ট্রেনে বসেছিলাম। প্রথম- আলো পত্রিকা পড়ছিলাম কিছুটা মনোযোগ দিয়ে বলা যায়। তবে মনোযোগের মাত্রাটা বেশি টিকছে না। প্রথম-আলো নিউজ পেপার বাংলাদেশে সর্বাধিক পঠিত এর একমাত্র কারণ এর নিরপেক্ষতা। কিন্তু হটাত করে যেন এই পত্রিকার সততা নিয়ে মনে কিছুটা শঙ্কা আসছে। সত্য ঘটনা কয়েকদিন থেকে চেপে রাখছে। এইটা অবশ্য জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখ হতে শুরু হয়ে এই মার্চ মাসের ২৮ তারিখ পর্যন্ত চলছে। অনলাইন, ফেইসবুক, ব্লগ সবখানে অনেক মন্তব্য পাচ্ছি এই পত্রিকাটা সম্পর্কে। বিক্রি কমে গেছে আগের থেকে। আগে পেপার হাতে নিলে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত না পড়ে কাউকে দিলাম না। এখন দু থেকে চার মিনিটে পরা শেষ। আর ভাল লাগছেনা। কি করা দশ টাকা দিয়ে কেনা পেপার টা ট্রেনের জানালা দিলে ফেলে দিলাম। সরকার সকল কিছু কে জিম্মি করে ফেলেছে মনে হচ্ছে। তাই বলে গণমাধ্যম কে! আশ্চর্য। অথচ এই প্রথম-আলো নিয়ে আমার কত বিদেশি বন্ধু দের সাথে অনলাইনে এবং ব্লগে ঝগড়া করেছে, আজ তারাই বলে কি আলি ভাই আপানদের দেশে কি আর কোন ঘথনা ঘটে না ওই শাহবাগ ছাড়া। এমন করলে সামান্য পাগলেও কিন্তু বুঝতে পারে তারা জাতির সাথে বেঈমানি করছে। ২০১৩ সালে এতোগুলো মানবধিকারের লঙ্ঘন হলো যেটা আমরা ভিন দেশি হয়েই দেখতে পাচ্ছি অথচ আপনার দেশের সবথেকে বড় গণমাধ্যম এইটা দেখতে পাচ্ছে না। এইটা কে নিয়ে আপনি বরাই করেন। সারারাত আমার অনেক বিদেশি অনলাইন বন্ধুদের জেরার মুখে পড়েছি। সকালে আবার একই দৃশ্য একই পত্রিকায় দেখে মন টা বিশিয়ে উঠলো। তাই আর পড়তে পারলাম না।

কিছুক্ষন পর নিজের ব্যগ থেকে হুমায়ন আহমেদের বই বের করে পড়তে লাগলাম। এই বইটা হুমায়ন আহমেদের জীবনের শেষ বই। রাজনৈতিক উপন্যাস। ওহ সরি উপন্যাসের নামটাই বলা হয়নি। “দেয়াল” এই বছরের বইমেলা তে বের হয়েছে। আমি বইটি আগের দুবার পড়েছি। তবুও আবার পরতেছি। আসলে ওনার বই গুলো ওমনি একবারে মন ভরে না। সত্য বলতে দিধা করে না। দেয়াল উপন্যাসে উনি শেষ জীবনে এসে দেশের কি অবস্থা তা যেমন লিখেছেন এও লিখেছেন বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস। দেশের স্বার্থে কে কতটুকু অবদান রেখেছেন। কে ফাইদা নিয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এইটা যে শেষ জীবনে এসে উনার এই উপন্যাস প্রকাশ করাতে বাধা দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ। অনাকে চাপ দেওয়া হয়েছিলো কিছু তথ্য মুঝে ফেলার জন্য। পরে তাইই হয়েছিলো। অনেক অনেক তথ্য সেখান থেকে গায়েব করে প্রকাশ করে। যাতে পরবর্তী কোন সরকার এইটা সম্পর্কে ঘাটাঘাটি না করে। তবে তিনি যততুকুই লিখেছেন তাতেই কার কারো হিংসার আগুনে জলছে। উনাকে যখন কিছু সংশোধন করতে বলা হয়ে ছিল তখন কিন্তু উনি বলেছিলেন আমি এই উপন্যাস থেকে একটা বর্ণ পর্যন্ত চেইঞ্জ করব না। বরং এমন একটা দিনের অপেক্ষায় থাকবো যেদিন বাক্স্বাধিনতাতে থাকবে না কোন সরকারি হস্তক্ষেপ। কিন্তু সেইদিন আর উনার জীবনে আসলো না। আমাদের কে কাদায়ে চলে গেলেন অনেক অনেক দুর। তবে সুযোগ দিয়ে গেলেন তাদের যারা উনার বাকসাধিনতাতে হস্তক্ষেপ করে ছিলেন।

আমি এজন্য অনেক মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম। আমি বইয়ে ডুবে ছিলাম। একটা অসাধারন সুন্দরি মেয়ে আমার পাশে এসে কখন যে বসেছে আমি খেয়াল করিনি। মেয়েটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বার কয়েক গলা খ্যাক খ্যাক করেছে তা আমি কিছুটা বুঝেছিলাম কিন্তু আমলে নেইনি। ইভেন মেয়েটি আমার ফেলে দেওয়া ক্রোড়পত্র নিয়েছে আমি দেখতে পাইনি। প্রথম-আলো পত্রিকা ফেলে দিলেও আমি কিন্তু ক্রোড়পত্র টা ফেলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওইটাই মেয়েটা নিয়ে অনেক্ষন পড়েছে আমি খেয়াল করিনি। ট্রেনটাও ছেড়ে এসেছে প্রায় আধা ঘণ্টা আমি তাও খেয়াল করিনি। আসলে আমি দেয়াল উপন্যাস টা খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়ছি।

আমি এবার সামনে হাল্কা করে ঘাড়টা নাড়াতেই মেয়েটির দিকে চখ গেলো। আমি তখন মনে করেছিলাম, হ্যা একটা মেয়ে ঠিকই বসেছে আমার সামনে মুখোমুখি সীটে কিন্তু চখ মেলে দেখেনি সে কতটা সুন্দর। এবার চোখ আমার আটকে গেলো মেয়েটির সৌন্দর্যে। মায়াবি চোখ দুইটি বড় বড় পাপড়ি যুক্ত। ভ্রুগুলো চিকন কিন্তু খুব কালো। মসৃণ গায়ের ত্বক দেখা যাচ্ছে হাফ হাতা কামিজের বাইরের অংশতে। মেদহীন স্বাস্থ্য, স্তনযুগল পরিপক্ক। আমি দেখছি তো দেখছি, নয়ন ভরে দেখেই যাচ্ছি। মেয়েটি ঘুমানোর চেষ্টা করছিল বুঝলাম চোখ বুজে ছিল। আধাঘণ্টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটি।

কেন যেন মেয়ে টিকে খুব চেনা চেনা লাগছে। আমার বিশ্বাস আমি এই মেয়েটিকেই কোথাও দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারছি না একচুয়ালি কোথায় দেখেছি। মেয়েটির সাথে কেউ আছে কি না ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলাম। নাহ, মেয়েটির আশেপাশে কেউ আছে বলে তো মনে হল না। তবে বামপাশে বসা দুইটা ছেলে মেয়েটাকে খুব খারাপ দৃষ্টিতে দেখছে আর হাসছে। দুজনার মাঝে মেয়েটা সম্পর্কে খারাপ খারাপ মন্তব্য শুনতে পাচ্ছিলাম।

আমি তেমন কিছু না ভেবে আবারো পড়াতে মন বসালাম। কিন্তু আমার পাশে থাকা দুজন কেউ দেখলাম, মেয়েটির দিকে কেমন ভাবে যেন তাকাচ্ছে আর হাল্কা করে হাসছে কিছু মন্তব্য কানে গেলো তবুও তেমন কিছু বললাম না। তাকালামও না। আমি পড়ছিলাম আর পড়ছিলাম। কিন্তু এবার ওদের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখলাম। দুজনা কেমন যেন একটু উত্তেজিত মত হয়ে গেলো। একজনাকে দেখলাম মোবাইল বের করে ছবি তুলতে যাচ্ছে। এবার আমি ধমক দিয়ে বললাম, কি ব্যাপার এমন ভাবে দেখার কি আছে? আপনাদের কি বোন নাই?

ওরা দুজনই একটু ভয় পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে ভড়কে গেলো। দুজনা একসাথে বলল, এভাবে সব কিছু দেখা গেলে কোন পুরুষ না দেখে থাকতে পারে। যে এসব দেখে কোন প্রতিক্রিয়া করে না সে মনে হয় কোন ছেলেই না। সে একজন হিজড়া। আমি এবার সামনের দিকে তাকালাম, মেয়েতার পরিপক্ক স্তনযুগলের উপর থেকে ওড়না টা পরে গেছে নিচে। সেজন্য তার বক্ষজোড়া সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

আমি কিছুটা হতবম্ব হয়ে গেলাম, আসলে এই মুহুরতে আমার কি করা উচিৎ বুঝতে পারছিলাম না। অনেক বড় দুঃসাহসের কাজটা করার জন্য মেয়ের পাশের ফাকা সিট টাতে বসে, আস্তে করে মেয়েটির ওড়নাটা বুকে উঠিয়ে দিলাম। পাশের ছেলেগুলো কি বুঝল জানিনা। তবে এটা লক্ষ্য করলাম যারা হা করে দেখছিল বেশিরভাগ প্রস্থান করলো।

আবার মেয়েটির অপজিটের সীটে এসে বসলাম, আমার পাশের লোক দুইটা কিছু একটা ভেবে আমাকে প্রশ্ন করলো, মেয়েটা আপনার কি লাগে ভাইজান?

আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম, না, মানে আমার বন্ধু। একই ভার্সিটিতে পড়ি। আমিও একটা প্রশ্ন করলাম ওদের, আপনারা কোথায় নামবেন?

ওরা বলল, আমরা মির্জাপুর নামবো। আমি কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ ওদের বলেছি আমি মেয়েটির বন্ধু কিন্তু মেয়েটি যদি জেগে যায় তবে জিজ্ঞাসা করে জানলে আমি কিছুটা অপমানিত হব এই শংকাতে থাকলাম। যে ওই ব্যাটারা নামার আগে যেন মেয়েটি না জাগে।

এই শঙ্কা তে আমি আর পড়াতে মন দিতে পারলাম না। টেনশনের অবসান ঘটলো মির্জাপুর আসলে ছেলেগুলো নেমে যাওয়ার পর। ট্রেন মির্জাপুর এসে কিছুক্ষন থামার পর আবার ছেড়ে গেলো। আমিও পুরো টেনশন মুক্ত হলাম।

কিছুক্ষন পরেই মেয়েটি জেগে উঠলো । বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলো। এই যে মিস্টার আপনার এতো অহংকার কেন? আমি তখন আপনাকে কতবার দেখেছি কোন সাড়া দ্যান নাই কেন? আর আপানার কমন সেন্স এতো কম কেনো? ক্রোড়পত্র নিয়েছেন প্রথম-আলো পত্রিকার কিন্তু মুল পত্রিকা কয়?

মেয়েটি এভাবে কথা বলছে আর আমি শুনছি। আরেকবার বলল, কি ব্যাপার আপনি কি কথাও বলতে পারেন না?

আমি এবার বললাম, আসলে আমি বুঝার চেষ্টা করতেছি আমি কি আপানাকে আগে কোথাও দেখেছি?

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, আমি তো সেইতাই তখন বলতে চেয়েছিলাম, আমি আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি আমার মনে হচ্ছে না। এবার মেয়েটা আমার পাশের সীটে এসে বসলো। সীটে দুইপা উঠিয়ে আসন করে বসলো, আমাকেও তার দিকে ঘুরে বসতে বলল। একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছিলো।

এবার আমার মনে এই ভাবনা আসলো মেয়েটা এতো কথা বলে, কিন্তু আমি যাকে মনে করেছিলাম সে তো এতো কথা বলে না। তাই আমি মন থেকে সেই ভাবনা মুছে ফেললাম। আমি শিওর হলাম সেই মেয়ে এই মেয়ে হতে পারেনা। তাই চুপ করে ওর কথা শুনতে থাকলাম।

আচ্ছা বলেন তো, আপনি কি বারাদি গিয়েচ্ছিলেন কখনো? মানে মেহেরপুর বারাদিবাজার চেনেন? মেয়েটি বলল।

আমি আবার চমক ফিরে পেলাম, খানিক টা বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করলাম, হ্যা চিনি। কিন্তু কেন বলেন তো?

মেয়েটি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, আমার পূর্ণ বিশ্বাস আমি আপনাকে ওখানে দেখেছি। এটা হবে বছর তিনেক আগে। আমার স্পষ্ট মনে আছে। আপনি মনে করেন।

আমি কিছুক্ষন আবার পূর্বের চিন্তাতে ফিরে গেলাম। তবে সঠিক ভাবে বুঝতে পারছিলাম না কোথায় দেখেছি। আমি মনে করছিলাম বসুন্ধরা সিতিতে দেখেছিলাম। তবে শিওর হতে পারছিলাম না। কিন্তু মেয়েটা বারাদি বলছে আমি তো বুঝতে পারছিনা আমি কবে বারাদি দেখেছি। বারাদির কাছেই আমার বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। আমি তার বাড়ি যায় ওই রাস্তা দিয়ে তবে বারাদি বাজারে আমি কখনো দাড়িয়ে দাড়িয়ে মেয়ে দেখেছি বলে তো মনে হয় না।

আমি সঠিক কিছু বুঝতে না পেরে মেয়েটিকে বললাম, বছর তিনেক আগে আমি বারাদি বাজারে কিভাবে আপনাকে দেখলাম। দেখেন আমার তো এমন কিছু মনে আসছে না।

মেয়েটি বলল, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আপনার সাথে আরও পাচ জন ছেলে ছিল। আপনারা মোট ছয়জন ছিলেন। আমি একটি ফার্মেসীর দোকানে বসে ছিলাম। আপনারা আমাকে অনেকক্ষণ ধরে ফলো করছিলেন। আমাকে দেখছিলেন আর নিজেদের মধ্যে বাবাবার কি যেন বলছিলেন। আপনাদের মধ্যে কেউ একজন নাকি আমাকে খুব পছন্দ করেছিলেন বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। যদি আমি রাজি হতাম। লসিমনের চালক আমাকে সব বলেছিল বাড়িতে আসার পরে। কি মনে পড়েনা।

এবার তাকে চিনতে পেরে তাকে থামিয়ে দিলাম, হ্যা হ্যা চিনতে পেরেছে। তবে আপনার চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে বুঝতে পারছি।

মেয়েটি এবার অনেক আগ্রহ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো কিছুটা হাসি হাসি মুখ করে, বলেন তো সেদিনের উদ্দেশ্য কি ছিল?

আমি এবার সেদিনের সৃতি চারণ করে তাকে সবকিছু খুলে বললাম... দিনটা আসলে এভাবে শুরু হয়েছিলো। আমাদের গ্রামের নাম পিরোজপুর। এই গ্রামের ছেলেরা মানে আমার সমবয়সী বন্ধুরা ক্রিকেট খেলা দিয়ে রেখেছিলো বড়শী বাড়িয়া গ্রামের সাথে। একটা প্রীতি ম্যাচ খেলার আয়োজন করেছিলো দুইগ্রামের ছেলেরা। আমাদের গ্রামের খেলোয়াড়েরা আগেই চলে গিয়েছিলো। তাদের সমর্থন দেওয়ার জন্য গ্রাম থেকে আরও লোকজন গিয়েছিলো এবং যাচ্ছিলো।

আমি বসেছিলাম আমাদের বাড়ির কাছে নদীর বাধ দেওয়া সিঁড়ির ওপরে। হটাত মেহেদি আর উজ্জ্বল বলে আমার পাড়ার দুইজন ছেলে আমার সমবয়সী আমাকে ডাকতে আসলো যে চল, খেলা দেখে আসি।

আমি বললাম কোথায়?

ওরা বলল, আমাদের গ্রাম আর বরশিবারিয়া খেলা হচ্ছে। আমাদের গ্রাম থেকে সবাই গেছে। চল আমরা তিনজন খেলা দেখতে যায়।

আমি কোন কথা না বলেই রেডি হয়ে চলে আসলাম খেলা দেখতে বড়শী বাড়িয়া ওদের দুজনার মোটর সাইকেলের পিছনে চড়ে। শুধু মাত্র সমর্থন দেবার জন্য। যাতে আমাদের গ্রাম জিততে পারে।

ওখানে গিয়ে দেখলাম, আমাদের সবার বড় এবং সবার প্রিয় সেইসাথে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু সজিব ভাই। উনি আমাদের বড় হলেও আমাদের সাথে বন্ধুর মতই মেলামেশা করে। উনি অবশ্য আমার মতই শুধু মাত্র সমর্থনের জন্যই এসেছে। এভাবে খেলা শেষ হয়ে গেলো। সেইসাথে আমরা অবশ্য পরাজিত হয়েছিলাম ৪৩ রানে।

ফিরবার সময় আমরা ছয়জন সজিব ভাই, তুষার, সোহাগ, একটা বাইকে এবং বাকি আমি, উজ্জ্বল ও মেহেদী অন্য বাইকে করে ফিরবো ভাবছিলাম। হটাত করে সজিব ভাই বলল, চল আমরা একটু দীঘল্কান্দি কলম উদ্যানে ঘুরে আসি। এইটা নাকি অনেক সুন্দর। আমি কখনো দেখিনি। আমার অনেক বন্ধুরা দেখে মুগ্ধ হয়ে আমাকে বলেছে। চল সবাই যায়।

আমি এইটা অসংখ্য বার দেখেছি বলে রাজি ছিলাম না। কিন্তু সজিব ভাইয়ের ইচ্ছার বিরোধিতা করতে পারব না বলে চুপ করে ছিলাম। অন্য সবাই রাজি হলো। সজিব ভাই এবার আমার দিকে লক্ষ্য করে বলল, কি আলি তুমি কিছু বলছ না যে, তুমি কি যাবে না। তুমি কি রাজি না?

আমি বললাম, না না চলেন সমস্যা নাই।

এবার সবাই রওনা দিলাম কলম বাগানের দিকে। কিন্তু সজিব ভাইয়ের দুর্ভাগ্য বলা যায়, এসে দেখি বাগানের মেইন গেট বন্ধ করে দিয়েছে। মানে সন্ধ্যার আগে ধুক্তে দেয়না। আমি জানতাম কিন্তু হটাত মনে ছিল না বলে আসার সময় সজিব ভাইকে নিষেধ করতে পারিনাই।

সজিব ভাই আমার এবার কাছে এসে বলল, কি ব্যাপার মনে হয় তখন আলি আস্তে চাইনি আর আমরা জোর করে আনলাম বলে এসে দেখছি বন্ধ। এবার আমি কিছুটা অসস্থি বোধ করলাম।

আমি নিজে একটু এগিয়ে গেলাম গেইটের দিকে। সজিব ভাইয়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। অনেক আশা নিয়ে এসেছিলো কিন্তু ঢুকতে পারছে না। আমি এখানের সব কিছুই ভাল করে চিনতাম এজন্য বাগানের মালীর কাছে গিয়ে অনেকবার অনুরধ করলাম। বললাম, আমরা আপনাকে বেশি করে টাঁকা দিব প্লিজ আমাদের একটু দেখার সুযোগ করে দেন।

কিন্তু মালি অনেক সৎ ছিল, এজন্য রাজি হলনা।। উনি বলল, আপনি আমাকে অনেক টাকা দিবেন একবার টাতে কি আমার সারাজীবন চলবে। আমার যদি চাকরি চলে যায় সে দায় কে নেবে। নিয়ম ভঙ্গ করারা জন্য আগের মালীর চাকরি গেছে। এখন আপনি আমাকে সেই নিয়ম ভাংতে কইছেন? এটা সম্ভব না। আপনারা বরং আগামি কাল আসেন, আপনাদের সাথে আমি টাকাই নিবো না। ফ্রীতে ঢুকতে দিব। কিন্তু আজ আর ঢোকান যাবে না। এইকথা গুলো উনি একনিশ্বাসে বলে চলে গেলেন।

সজিব ভাই যথেষ্ট বুঝমান ছেলে উনি বলল, চল, আলি ঢোকার দরকার নাই, অন্য একদিন আসবো।

কিছুটা সবার মনখারাপ হল। তবুও সেই মন খারাপ করেই ফিরে আসছিলাম। আমি যে বাইকের পিছনে চড়ে ছিলাম, সেইটা চালাচ্ছিল মেহেদী। সজিব ভাই যে চালাচ্ছিল সেইটা চালাচ্ছিল তুষার। আমার বাসায় একটু তাড়া ছিল যেটা মেহেদী জানতো বলে ও একটু দ্রুতই চালিয়ে আসতে ছিল। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে তুষার একটু চঞ্চল টাইপের। রাস্তা ঘাটে কোন মেয়ে দেখলে তুষার কমেন্ট করবেই। এবং মন ভরে সবাই কে দেখে। বলতে পারেন ইভতিজিং করা আর কি। সেই কাজটা তুষার করতো।

তো আমাদের বাইক আগে আসছিল পরে তুষার। আমরা বারাদি বাজার ছাড়িয়ে এবং মমিনপুর ছাড়িয়ে চৌগাছা তে চলে এসেছিলাম। হটাত আমার শরীর টা কাপুনি দিয়ে উঠলো । পকেটে হাত ঢুকাইয়ে দেখলাম মোবাইল টা ভাইব্রেট দিচ্ছে। সোহাগ ফোন দিয়েছে।

ফোনটা রিসিভ করতেই ফোনটা সোহাগ কেটে দিলো। আমি কিছুটা অবাক হলাম। আমার মাঝে টেনশন ভর করলো। মনে মনে ভাবলাম কি জানি ওরা আমার বাজারের মধ্যে কোন অ্যাকসিডেন্ট ঘটাল নাকি। ওদের কি পুলিশে আটকাল। কিছুক্ষন পর আবার ফোন দিলো এবং আবারো কেটে দিলো। আমি এবার ফোন ব্যাক করলাম কিন্তু ফোন অফ পেলাম। আরও টেনশন বাড়ছিল। আমি এবার মেহেদী কে বাইক স্ট্যান্ড করতে বললাম। এবং কথা গুলো। বললাম। এবার ফোন করলাম তুষারের ফোনে। তুষার রিসিভ করে বলল, এই তোরা তাড়াতাড়ি আইতো এখানে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।

আমি মেহেদী কে বাইক ঘুরাতে বললাম। কিন্তু মেহেদী ভয় পাচ্ছিলো। বলল, নারে বাপ আমি যাবো না। ওরা নিশ্চয় বাজারের মধ্যে মারামারি না হয় কোন এক্সিডেন্ট করেছে। আমরা গেলে আমাদের বাইক কোথায় কেড়ে রেখে দেবে। এই রকম নানা অজুহাত দেখিয়ে যেতে চাচ্ছিল না।

এবার আমার পাশে থাকা উজ্জ্বল বলে উঠলো, এই চল, তোর বাইকের কিছু হলে তার দায়ভার আমি নেবো। এখানে বলি রাখি, উজ্জ্বল আমাদের বন্ধু। ও প্রায় পাঁচবছর আরব আমিরাতের দুবাই শহরে ছিল। ওখানে অনেকদিন চাকরি করেছে। নিশ্চয় টাকা পয়সা কিছু হয়েছে। এজন্য আমাকে ভরসা না করলেও উজ্জ্বল কে সহজেই কেউ ভরসা করতো।

আবার বারাদি বাজারের মধ্যে ফিরে গেলাম। এসে দেখি ওরা তিনজন একটা মেয়েকে খুব ফলো করতেছে। এবার আমি বুঝলাম আসলে কি ঘতেছে। তুষার ছেলেটা কোন মেয়ে দেখলেই ফিদা হয়ে যায়। সামান্য সুন্দরি ওর কাছে বিশ্ব সুন্দরি। আমাকে ডেকে তুষার বলল, দেখত আলি, এইটা কি একের মাল না?

আমি কিছুটা অসস্থিবোধ করলাম, মাল কথাটা শুনে। আমি বললাম, মাল নয় বলল, মেয়ে।

সজিব ভাই এগিয়ে এসে বলল, দেখতো আলি, এই মেয়েটা চলে কি না। তমার কি পছন্দ হয়। আমি বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম। সজিব ভাই অবশ্য বিয়ে করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এজন্য ওর ফ্যামিলি এবং সজিব ভাই নিজেও মেয়ে দেখছিল। বাজার দিয়ে আসার সময় উনার চোখ পরে ওই মেয়েটার অপরে। তারপর উনি আমাদের ফোন করেছেন।

আমাকে ডাকার কারণ, আমি যেন মেয়েটির সাথে গিয়ে কথা বলি এবং নাম ঠিকানা জেনে নিতে পারি। আমাদের ছয়জনার মধ্যে কারো সাহস হচ্ছিলো না। মেয়েটার সাথে গিয়ে কথা বলার। এইজন্যই আমাকে স্মরণ।

মেয়েটি রিতু ফার্মেসীর দোকানে দাড়িয়ে ছিল। পড়নে শাড়ি ছিল ব্লাউজ মেচিং করে পরা। আমি আগে কিছুক্ষন পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম। পরে মেয়েটার সাথে গিয়ে সরাসরি কথা বললাম, আপা আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?

হ্যা অবশ্যই বলতে পারেন। বলেন কি বলবেন? মেয়েটি ত্বরিত জবাব দিলো।

আমি বললাম, আপনি কি সুচনা, আপনার বাসা কি রাজনগর?

মেয়েটি বলল, না না। আমার নাম তো সুচনা নয়। আমার নাম নাজমা সুলতানা। আমার বাসা চুয়াদাঙ্গা তে। কেন বলুন তো?

আমি এবার বললাম, না মানে বলছিলাম। আপানার কি বিয়ে হয়েছে?

এবার উনি বুঝতে পারলেন। বললেন জী আমার বিয়ে হয়েছে। এই ফার্মেসীর দোকান ওয়ালা আমার দেবর হয়।

আমি বললাম, আচ্ছা কিছু মনে করেন না। আপনার ফোন নাম্বার টা কি দিবেন।

নাজমা সুলতানা এবার বলল, না ভাই সরি দিতে পারবো না।

আমি বললাম, কেন দিবেন না। যেকন দিন আমি তো আপনার উপকারেও আসতে পারি।

উনি এবার বললেন, থিক আছে আপনি তো আমার নাম জানলেন। আপনি এক কাজ করেন আপনার নাম ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার টা দিইয়ে যান।

আমি ফোন নাম্বার ঠিকানা সব দিয়ে ফিরে আসলাম। সজিব ভাই বলল, কি ব্যাপার আলি তুমি এতক্ষন ধরে কি কথা বলছিলে।

আমি এবার সব কথা খুলে বললাম। আমরা সবাই হাস্তে শুরু করলাম এই ভেবে যে সজিব ভাই শেশে বিবাহত মেয়েকে পছন্দ করলো। সজিব ভাই বলল, চল আজ এখানে আরও কিছু মেয়ে খুজি যাদের চেহার এবং ফিগার হবে একের।

শেষে আনিকা ফার্মার কাছে এসে আমাদের চোখ আটকে যায়। ঐখানটাই আপনাকে দেখেছিলাম। হাল্কা সবুজ রঙের থ্রিপিচ পরা ছিলেন। অপূর্ব লাগছিল। আপনাকে। আপনি দোকানের মধ্যে টাই বসে ছিলেন। আমরা সবাই এক এক অজুহাতে আপনার বসে থাকা দোকান টাই গিয়েছিলাম ওষুধ আনতে। কথা বলার অনেক চেষ্টা করে ছিলাম। কিন্তু পারিনি। ওই দোকানদার মনে হয় আপানার সম্পর্কে মামা হয় এইটা জেনে ছিলাম।

আপনার ওই দোকানদার মামার বাসা মনে হয় দরবেশপুর। আপনার বাড়ি কুষ্টিয়াতে। আপনার তিন ভাই এক বোন। আপনি অনেক আদরের। এবং ঢাকার কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। এই তথ্য গুলো জেনেছিলাম আপনার লসিমন চালকের কাছ থেকে। আপনার ফোন নাম্বার নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারেনি। আপনাকে সজিব ভাই খুব পছন্দ করেছিলো। আপনার খজ করার জন্য আমরা দরবেশপুর পর্যন্ত গিয়েছিলাম কিন্তু চালকের দেওয়া কোন তথ্য মিল পাইনি। এরপর আমিও ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে আসলে এই বিষয় টা ওইখানেই চাপা পরে যায়।

এতক্ষন মেয়েটি আমার কথা গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এইবার বলল, আমিও মনে করেছিলাম। আপনারা আমাকে বিয়ের পাত্রির মতো দেখছেন। আমার পাশে যে মেয়েটি বসে ছিল, ওর নাম সুখি। সুখি এসে আমাকে আপানদের বিষয় নিয়ে অনেক করে রাগাতো। আমি অবশ্য চাচ্ছিলাম আপনারা এসে যদি আমাকে সরাসরি কথাটা জিজ্ঞাসা করেন।

আমি এবার বললাম, কি ব্যাপার এতক্ষন ধরে আপনাকে নিয়ে এতো কথা হচ্ছে। অথচ আপনার নাম টাই এখন পর্যন্ত জানতে পারলাম না। আজব কাহনি তো।

মেয়েটি বলল, আমার নাম আনিকা। আপনারা অবশ্য এই নামটি ওইদিন ফার্মেসীর দোকানে লেখা দেখেছিলেন। আসলে মামার কোন ছেলে অথবা মেয়ে নাই। টাই আমাকে মেয়ের মতই ভালবাসে। আমিও ছুটি পেলেই সবার আগে মামার কাছে ছুটে যায়।

আমি এবার আনিকার কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, অহ বুঝতে পেরেছি, এইজন্যই আপান্র মামা ওনার ফার্মেসীর নাম রেখেছেন আপনার নামে। আচ্ছা এখন বলেন, আপনি কি করেন। মানে কোন ইউনিভার্সিটি তে অধ্যায়ন করেন?

আমি জাহাঙ্গির নগর ইউনিভার্সিটি তে ক্যামিস্ট্রি তে অনার্স করতেছি। আমার ফাইনাল ইয়ার চলতেছে। বাবা মা এবং মামার খুব ইচ্ছা আমি বিসিএস পরিক্ষা দিয়ে বাংলাদেশে বড় পদে থাকতে চাই।

আমি বললাম, আল্লাহ আপনার মনে আশা পূর্ণ করুক। এখন কি আপনাদের ভ্যাকেশান চলতেছে?

না। ভ্যাকেশান চলছেনা। তবে ঢাকাতে ইদানিং মন টিকছে না। তাই বাড়িতে একটু ঘুরতে যাচ্ছি। ঢাকা এখন রাজনীতিতে অচল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে। আচ্ছা আপনি কি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ তে কখনো গেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের ফাসির দাবির স্লোগানে।

কেন হটাত করে এই গণজাগরণ নিয়ে প্রশ্ন করতেছেন?

না এমনি করলাম আর কি। আচ্ছা আপনি কি করেন সেটা তো জানালাম না। প্লিজ বলবেন কি আপনি কি করেন। আপনি কি ঢাকাতেই থাকেন।

আমি বললাম, আমার নাম তো আগেই বলেছি তবুও আরেকবার সম্পূর্ণ করে বলি, আমার নাম মোঃ আলি রহমান। আমি পেশায় একজন আর্কিটেকচার। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি করতেছি একই বিষয়ে।

আচ্ছা আপনার নাম আলি রহমান তাই না? এই নামে কি আপনার কোন ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। এবং এই নামে কি কোন ব্লগ খলা আছে আপনার?

আমি বললাম, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমার এই নামে একটা ব্লগ এবং একটা ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। ব্লগ নাম টা বাংলাদেশের অনেক ব্লগে আমি ব্যবহার করেছি। কেন বলেন তো।

আমি আপনাকে ফেইসবুক এবং ব্লগে ফলো করি সবসময় আপনি কি জানেন। আপনার ব্লগ লেখা গুলো আমার কাছে খুবই ভালো লাগে। আজ আপনার সাথে এই ভাবে দেখা হবে বুঝতে পারিনি। জানেন আপনার প্রতিটা ব্লগ আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি। ইদানিং আপনার ব্লগ টা রাজনৈতিক কথাতে ভরপুর থাকতেছে। আপনি রাজনীতি বিষয়ে ভালই জানেন। মাঝে মাঝে কূটনীতিক ব্লগগুলো খুব ভালো লেগেছিল। এই যে লিখেছিলেন, “ভারত না পাকিস্তান কে আমাদের শত্রু” এই ব্লগ লেখাটা আমার কাছে অসম্ভব ভালো লেগেছিল। আপনি সত্যিই অনেক ট্যালেন্ট।

তবে ইদানিং ইদানিং কালের শাহবাগ সম্পর্কে আপনার ব্লগগুলো প্রথমে আমাকে খুব আঘাত করেছিলো। এখন অবশ্য আমি বুঝতে পেরেছি, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ এখন আওয়ামী নেতাদের স্বার্থ হাসিল করার মঞ্চ।

কি আপনি শাহবাগের আন্দোলন থেকে আসছেন। আপনি একটা উচ্চশিক্ষিত মেয়ে হয়ে এখনো বুঝেন নি যে এইটা একটা রাজনীতির খেলা। আমিও প্রথমে সাপোর্ট করেছিলাম এই গণজাগরণ কে। কিন্তু পরে ভালো করে খজ নিয়ে দেখলাম, এখানে সরকারি তত্ত্বাবধানে সব কিছু ঘটছে। সবথেকে খারাপ লাগলো, এই আন্দোলন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার একটা চক্রান্ত। আচ্ছা বলেন আপনি কার উৎসাহে শাহবাগে গিয়েছিলেন?

আনিকা এবার একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, আমি এসেছিলাম আমার বন্ধু লাকির অনুরোধে। আপনি হয়তো জানেন এই আন্দলনের শুরুটা করেছিলো লাকি। লাকি যেদিন স্লোগানে বলল, বাংলাদেশের সব যুদ্ধাপরাধির ফাসি চাই তারা যে দলেরই হউক না কেন? সেদিনই লাকি কে আঘাত করেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লীগের এক নেতা। সেইদিন আমিও ছিলাম লাকির পাশে। আমাদের দুজন কে জোর করে সরিয়ে দেই।

লাকির আঘাত টা অল্প হলেও আমি ওকে পাশের বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হসপিটালে নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছিলাম। তখনি ছাত্রলীগের আরও দশবারো জন নেতা এসে আমাদের বিভিন্ন বিষয় মঞ্চে বলার জন্য ভয় দেখায়। তখন লাকি অস্বীকার করে। আমাকে বলে অখান থেকে যেভাবে হউক বেরিয়ে আসতেই হবে। কিন্তু প্রথম টানা এক সপ্তাহ আমরা বেরোতে পারিনি। ওরা আমাদের দিয়ে জোর করে অসংখ্য তথ্য বলিয়ে নিত। ১২তম দিনে আমি লাকি কে নিয়ে চলে আসতে সামর্থ্য হই।

এখন কি আপনি শাহবাগ সম্পর্কে কি মনে করেন?

আনিকা অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বলে, প্রতিদিন ওখানে হাজার হাজার মানুষ হচ্ছে। যারা বিচার চাই। কিন্তু তারা প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছে নানা ভাবে। এখন অবশ্য বুঝেছি যে এইভাবে আন্দোলন করা মানে বিচার ব্যাবস্থা কে হেয় করা। তাছাড়া এই যুদ্ধাপরাধির তালিকায় অনেক নির্দোষ ব্যাক্তির নাম আছে। আমি সেদিন থেকে ঘ্রিনা করতে লাগলাম, যেদিন আমাদের মহানবি (সঃ) এর নামে রাজিব হায়দার নামের এক ব্লগার এতো বাজে বাজে কথা লিখেছে। এবং সরকার দল টা বিরোধী পক্ষের গায়ে চাপানোর জন্য সদা তৎপর। এই নাস্তিক কে তারা শহিদের মর্যাদা দিচ্ছে। আমার স্বল্প নলেজে আমি জানি শহিদ শব্দটার ব্যবহার কোথায়। তাছাড়া প্রথমে না বুঝেই আমি অনেক কিছু স্লোগান দিয়েছি। আপনার একটা ব্লগ আমাকে আমার সঠিক পথে ফিরিয়ে এনেছে। এর কৃতিত্ব অবশ্য পুরোটাই আপনার।

আপনার এই দিন ব্লগে আমি শাহবাগের ওপরে লেখাতে আমি লাকি দুজনায় কমেন্ট করেছিলাম। পরের দিন ইসলাম এবং রাজনীতি এই বিষয়ে আপনি লিখে ছিলেন যেটা আমাকে ইসলামের প্রতি অনেক টেনেছে। আপনি লিখেছিলেন, সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ একবার পড়ার জন্য। আমি লাকি দুজনায় পড়ার পর শাহবাগ সম্পর্কে আর ভাবিনি। জানেন আমি এবং লাকি আপনার সাথে দেখা করার জন্য পাগল ছিলাম।

আমি এবার বললাম, থিক আছে এখন বলেন ব্লগে আপানার কি নাম?

ব্লগে আমার নাম হচ্ছে, “ক্যাটস আই” এবং লাকির নাম হচ্ছে “দেশি মিরর”। ফেইক বুকেও একই নাম আছে আমার এবং লাকির।

আচ্ছা এখন বলেন, আপনারা শাহবাগে যে স্লোগান দ্যান, জামায়াত নিষিদ্ধ করার। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার নাকি কোন বিধান নাই। কোন প্রমান দিতে পারবেন? আমি আপনাকে বলি, পার্শ্ববর্তী হিন্দু দেশ ভারতে ১৪ টা ইসলামি দল আছে। কই তারা তো একবার বলে না ইসলামে রাজনীতি করা যাবে না। একটা জিনিষ দেখবেন, আমাদের যত নবি রসুল এসেছেন, সবাই কিন্তু রাজনীতির সর্ব উচ্চ পদে, আসিন ছিলেন। দেখেন এই উপমহাদেশে মুসলিমরা প্রায় সাড়ে ছয়শ বছর শাসন করেছেন। আবার দেখবেন উপমহাদেশের স্বাধিনতার জন্য মুসলিমরা আগে দৌড়ে এসেছে। মহাত্মা গান্ধী এসছেন ১৯৪৪ সালে। তার আগে থেকেই ১৮৬৭ সাল থেকেই মুসল্মান রা স্বাধিনতার জন্য যুদ্ধ করে আসছিল, দুদু মিয়া, তিতুমির, স্যার আব্দুল লত্তিফ, স্যার আহ্মদ আলি, রহমান মালিক, বরহান সিদ্দিকি, কাশেম খালেক, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ইত্যাদি। তারাও সবসময় চেয়ে ছিল, এই ভারত মহাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পাক।

দেখেন দেশ স্বাধিন হওয়ার পর বাকশাল গঠন করলেন, শেখ মুজিবর রহমান, যাতে কোন বাম রাজনীতি বিদেরা এই স্বাধিন দেশে রাজনীতি করতে না পারেন। কিন্তু আজ দেখেন বাম নেতারা আজ বড় বড় কথা বলে যারাও একসময় এই দেশের স্বাধিনতা চাননি। এইজন্যয় শেখ মুজিব তাদের নিষিদ্ধ করলেন। বামদের ষড়যন্ত্রের কবলে জীবন দিলেন মুজিব। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসলেন। এসে দেখলেন এই সদ্য স্বাধিন হওয়া দেশটা হাজার লক্ষ্য সমস্যায় জর্জরিত। উনি অনেক ভেবেচিন্তে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ তাই ইসলামের আলোকে গড়তে পারলে সবখান থেকে দুর্নীতি মুক্ত হবে। আল্লাহর ভয় সকল কে খারাপ কাজ থেকে মুক্ত রাখবে। এজন্যই তিনি বহুদলীয় গনতন্ত্র চালু করলেন যাতে সকল মানুষ রাজনীতি করার সুযোগ সমান ভাবে পাই। কিন্তু হায় দুর্ভাগ্য সেই মহান নেতা কে আজ অনেক বাম নেতারা গালি দেয়। তিনি না থাকলে এই শেখ হাসিনা দেশেই ফিরতে পারতেন না। রাজনীতি তো দূরে থাক। সেই হাসিনাই আবার শহীদ জিয়াউর রহমান কে স্বৈরাচারী আখ্যা দেন। আবার মজার বিষয় দেখেছেন সেই হাসিনা আবার বাম এবং স্বৈরাচারী দের নিয়ে মহাজোট গঠন করলেন ২০০১ সালে।

আনিকা এবার বললেন, বাব্বা আপনি তো অনেক কিছু জানেন রাজনীতির বিষয়ে। তবে আমি কিন্তু ধর্মের রাজনীতির বিরোধী আপনি যাই বলেন না কেন। কারণ ধর্ম কে রাজনীতির সাথে যুক্ত করা ঠিক হবে না।

আমি বললাম, আচ্ছা আপনি আজ বলেন তো সৌদি আরবে কি কখন দুর্নীতি হয় শুনেছেন। এমন খুনাখুনি হয় শুনেছেন। হয়না। কারণ একটাই ইসলাম ওখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আল কোরআন ওদের সংবিধান। আর আমাদের ক্ষেত্রে কি দেখেন, আমাদের সংবিধানে যে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম” ছিল টা আবার সুরঞ্জিতের সহ্য হয় নি বুদ্ধি দিয়ে সংবিধান বদলিয়ে ফেলল, সেই সাথে মুছে ফেলল , আমাদের শতকরা ৮৬% মুসলিম রাষ্ট্রের নাম। রাষ্ট্র ধর্ম কে মুছে দিলেন। কত কিছুর নাম চেইঞ্জ করলেন। এইটা কি উচিৎ ছিল। আমাদের প্রধান মন্ত্রি নিজেও একজন মুসলিম তিনি কি করে একজন হিন্দুর কথায় সায় দিয়ে এই কাজ করলেন বুঝলাম না।

আপনি দেখবেন, আজ জামায়াত ইসলামি দের দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, আপনাকে একটা ইনফরমেশন দেয়, বাংলাদেশ বছরে যা কর পায় তার ৭০% কর পায় জামায়াত মালিকানাধিন প্রতিষ্ঠান থেকে। সারা বাংলাদেশে তিন লাখ ৫১ হাজার মাদ্রাসা আছে যেগুলো পরিচালিত হয় তাদের অর্থ থেকে, সরকার থেকে কোন রকম অর্থ পায়না সেই প্রতিষ্ঠান গুলো। এখন আসি সারা বাংলাদেশে ৩৯ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যে গুলো জামায়াতের অর্থে চলে। দেশের জন্য আর কত করলে একজন দেশ প্রেমিক হওয়া যায়। আপনি আমাকে বলবেন। তাছাড়া যে বিচার চলছে তা কি আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন বলতে পারবেন। হিউম্যান রাইট ওয়াচ, অ্যামনেস্টি, জাতিসংঘ ইত্যাদি সব গুলো বিরোধিতা করছে এই বিচারের তার পরেও তারা বলছে এটা আন্তর্জাতিক মানের। কিভাবে আমাকে বলেন তো।

এবার আনিকা বলল, আলি ভাই আমরা সবই জানি তবে এটার বিরোধিতা করিনা ভয়ে। তাদের হাত অনেক লম্বা।

এইভাবে কথা বলতে বলতে আমাদের ট্রেন কুষ্টিয়া ছেড়ে চুয়াদাঙ্গা চলে এসেছে আমি এবং আনিকা কেউই খেয়াল করিনি। হটাত আমার টিকিট চেকার এসে বলল, কি বাপজান, নামবে না নাকি? চুয়াদাঙ্গা তো এসে গেছে?

আমি বলল, তাই চুয়াডাঙ্গা চলে এসেছি। এই বলে নামলাম। আমার সাথে সাথে আনিকাও নামলো। আমি ওখান থেকে একটা রিক্সা ডাক দিলাম বড়বাজারে যাবার জন্য। হটাত মনে পড়লো আনিকার কথা। ওর দিকে ঘুরে দেখলাম, আনিকা আমার পিছনে দাড়িয়ে আছে। আমি বললাম, তোমার বাড়ি তো কুষ্টিয়া তে। কুষ্টিয়া নামলে না কেন? তাহলে কি তুমি তোমার মামার বাড়িতে নামবে।

আনিকা বলল, আমি চেয়েছিলাম মামার বাড়িতে নামবো, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনার সাথে যেতে। কি আমি যদি আপনার সাথে আপনার গ্রামে যেতে চাই নিবেন না? আসলে আপনার সাথে কথা বলে আপনার ফ্যান হয়ে গেছি। প্লিজ আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যান। আপনার সাথে কিছুদিন ঘুরে আবার আপনি চলে আসবেন আমার সাথে আমার বাড়ি। রাজি?

আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম, পরে উত্তর করলাম, ঠিক আছে চলুন। আমার কাছে শুধুমাত্র একটা ঘাড় ব্যাগ ছিল কিন্তু আনিকার কাছে ছিল দুইটা বড় বড় ব্যাগ যেটা ওর বইতে সমস্যা হচ্ছিলো এজন্য আমি ওর কাছ থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে নিলাম। এবার এই রিক্সায় করে বড় বাজার পর্যন্ত গেলাম। বড় বাজার থেকে বাসে করে মেহেরপুর যেতে হয় সেখান থেকে আমঝুপি হয়ে পিরোজপুর যেতে সময় লাগে মোটামুটি ৩০ থেকে ৪০ মিনিট।

যখন বড় বাজার পৌছালাম দেখি রাস্তা পুরো ফাঁকা। বুঝলাম হরতাল চলতেছে। এই জামায়াত ইসলামি দলটা শুধু হরতাল ডাকে কিছু না বুঝেই। হরতাল প্রতিবাদের জন্য যদিও সরকারের মাস্তান ছাত্র লীগ, যুবলীগ বাহিনী কাজ করতেছে তবুও সারাদেশে ট্রেন ছাড়া কোন কিছুই চলতেছে না। সরকার বিরোধী দল কে পুরো রাজনৈতিক চাপার মধ্যে রেখেছে। সরকার স্মার্ট ভাবে সব কিছু আড়াল করে রেখেছে দেশের মানুষের কাছে। দেশের হাজার হাজার সমস্যা তা নিয়ে কেউ মাথা ব্যাথা করছে না কিন্তু কবে কারা যুদ্ধাপরাধি ছিলেন সেই ইস্যু নিয়ে দেশের মানুষ কে ফাকি দিচ্ছে সরকার খুব সুকৌশলে।

আমি আনিকাকে বললাম, কি করবেন? গারিতো চলছে না কিভাবে যাবেন?

আনিকা বললেন, যাওয়ার কাজ টা আমাকে করতে দেন। বলে একপুলিশ কে ইশারা করে ডাকল, বলল, স্যার প্লিজ আমাদের একটু বারাদি বাজার পর্যন্ত দিয়ে আসেন না?

পুলিশ অফিসার টি আমাকে অবাক করে দিয়ে দেখলাম, রাজি হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে বারাদি বাজারের দিকে গাড়ি ছুটলেন। চোখের পলকে একসময় বারাদি বাজারে পৌছালাম। আমি এতক্ষণও ভাবছিলাম হয়তো আনিকা বারাদি বাজারে ওর মামার দোকানে নামবেন। কিন্তু বাজারে এসে দেখলাম আনিকার মামার দোকান টি বন্ধ।

পুলিশ অফিসার টিকে আমি ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসলাম। আনিকা আমাকে বলল, নেন এবার বাড়ি পর্যন্ত যাবার ব্যবস্থা আপনি করেন।

আমি একটা সিএনজি ডেকে সোজা পিরোজপুর বাজার পর্যন্ত যাওয়ার জন্য কন্টাক্ট করলাম।

পিরোজপুর যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো। আমাদের আদ্দা দেওয়া ক্লাবের কাছে দাড়িয়ে ছিলেন আমাদের সেন্টু কাকা। উনি আমাকে ডেকে বললেন, কি গো পাশের টা কে?

আমি বললাম, চাচা এটা আমার বন্ধু। একসাথে পড়াশোনা করি। এই কথাটা বলে আমি আনিকার দিকে একটু আড় চখে তাকালাম। দেখলাম আনিকা অল্প অল্প হাস্তেছে।

সেন্টু চাচা চলে গেলে আমি বললাম, কি ব্যাপার আপনি পাগলের মত এমন করে হাসছেন কেন?

আনিকা বললেন, আজ কেই আমার সাথে পরিচিত হয়ে আজকেই বললেন, আমি আপনার সাথে পড়ি। ট্রেনের মধ্যে যে বললেন, আপনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না।

আমি বললাম, মাঝে মাঝে কিছু কিছু পরিস্থিতি মানুষের সামনে হাজির হয় যখন মিথ্যা বলা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। আমিও আজকে সেই পরিস্থিতিতে এসে গেছি এইজন্যই মিথ্যা বললাম।

আনিকা বলল, বাড়ি পর্যন্ত যাবার আগেই এতো মিথ্যা বললেন। বাড়ি গিয়ে কি বলবেন আল্লাহই জানে।

আমি বললাম, চুপ থাকেন। বেশি কথা বলেন নাতো।

আনিকা বলল, একটা অনুরোধ করবো রাখবেন বলেন।

আমি বললাম, হ্যা রাখবো বলেন কি অনুরোধ?

আপনি যদি আমাকে বন্ধু পরিচয় দিতে চান তাহলে আমাকে আপনি এবং তুমি কোন টাই বলতে পারবেন না। শুধু তুই বলে ডাকবেন। আমিও খুশি হবো।

আমি বললাম, আপনি পাগল, একদিনেই এতো ধাপ নিচে নামবো কি করে?

আনিকা আবার বলল, ঠিক আছে আপনার যা করার করেন। আমি আপনাকে তুই বলেই ডাকবো। আপনি যাই মনে করেন না কেন? তাছাড়া আপনি আমার বয়সে বড়। আপনি কেন পারবেন না?

আমি এবার বললাম, ঠিক আছে, এখন বেশি কথা না বলে ব্যাগ নিয়ে সোজা হাঁটতে থাক।

এইতো এবার ঠিক আছে। এক্কেবারে প্রকৃত বন্ধু বন্ধু মনে হচ্ছে। আনিকা এইটা বলে থামল। এবং ব্যাগ হাতে তুলে আমার নিরদেশনা মত চলতে লাগলো।

বাড়ির কাছে গিয়ে দেখলাম, আমার আব্বা বাড়ির আঙ্গিনায় দাড়িয়ে আছেন। আমার পাশে আনিকা কে দেখে মনে মনে অন্য কিছু ভেবেছিলেন। তবে আনিকা যখন আমাকে ডেকে বলল, কিরে আলি এইটা তোদের বাড়ি। অনেক সুন্দর তো এলাকাটা।

এবার আব্বা কিছুটা বুঝতে পেরছিল তবে কোন কথা বলার আগেই আনিকা বলল, চাচা আমি আনিকা। আলির ভালো একটা বন্ধু। আপনাদের বাড়ি অনেকবার আসার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আলি না করায় এবার আমি জোর করেই চলে এসেছি। ভালো করি নি বলেন চাচা?

আব্বা বুঝতে পারছিলেন, মেয়েটা বেশি কথা বলে। বললেন, হ্যা হ্যা খুব ভালো করেছো মা। যাও যাও বাড়ির মধ্যে যাও। এই আলির মা দেখ তোমার আলি আইছে।

আমি যে এবার আসছি তা কিন্তু আমি বাবা মাকে আগে জানাইনি। এজন্য মা জানে না যে আমি আসছি। আমার বাড়ির লোকজনের মধ্যে আমার আদ্দা হত বেশি আমার ভাবি রেখা এবং বড় আপু মনিকা। আমি ঢাকা থেকে আসার সময় সবসময় সবার জন্য উপহার আনি। আমার ভাইয়ের দুইটা ছেলে মেয়ে। মেয়েটা বড় ওর নাম হচ্ছে ফেরদৌসি এবং ছেলেটার নাম ফিরোজ হলেও সবাই বাড়িতে ওকে হপার নামে ডাকে। আসলে নামটা ওর বাবা মানে আমার বড় ভাই ফরিদের দেওয়া।

হপার যেদিন জন্মগ্রহন করে সেদিন ভাইয়া সার্কাস দেখতে গিয়েছিলো। একটা সাদা ফর্সা ছেলে সার্কাস দেখিয়ে ভাইয়ার মন জয় করে ছিল ওই ব্যক্তির নাম ছিল মিঃ হপার। উনি অবশ্য পশ্চিমা দেশের। এখানে অনেক টাকার বিনিময়ে এসেছে। ভাইয়া বাড়িতে ফিরে শুনে যে উনার ঘর আলো করে উত্তরসুরি এসেছে। ভাইয়া মুখ দেখে খুব খুশি হয়ে যায় এবং ওই হপারের মত ফর্সা বলে নাম রাখে হপার।

আনিকা ফিরোজের ওই নামটা শুনে খুব হেসেছিল। আনিকা আমারদের বাড়িতে আসার খবর শুনে আমার সব বন্ধুরা আমার খোজে আমার বাড়ি আসে। ওরা মনে করেছিলো আমি ঢাকার কোন মেয়েকে নিয়ে এসেছি বিয়ে করেছি বলে। যখন আনিকা আমার সাথে তুই তুই করে অনেক ইয়ার্কি ফাজলামো করছিল তখন সবাই বুঝেছিল যে আনিকা শুধুই আমার বন্ধু।

পরের দিন আমি আনিকা কে আমাদের ভৈরবের চরে নিয়ে গেলাম। একটা জমির স্থুল আইলে দুজনা মুখোমুখি বসলাম।

আনিকা প্রথমে বলল, আচ্ছা এই নদীতে পানি নেই কেন? এখন তো বর্ষা মৌসুম।

আমি বললাম, পানির ধারা যদি উলটো মুখে আটকানো থাকে তবে কি করে এই পর্যন্ত পানি আসে বলতো দেখি।

আচ্ছা আলি তুই কতদিন থেকে দেখছিস এই নদীর এমন অবস্থা?

আমি বললাম, যখন আমি ছোট ছিলাম মানে স্কুলে পড়তাম হাইস্কুলে, তখনও দেখেছি এই ভৈরব নদীর পানির প্রাচুর্যটা। যেটা কি বর্ষা কি শীত কি চৈত্র। সকল মৌসুমে এখানে পানির ছিল উথাল পাথাল ঢেউ। যে ঢেউয়ে আমি আড় আমার স্কুল জীবনের বান্ধবি রেহেনা রাতের আধারে নৌকা চালিয়েছে ভোর না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু দেখ আজ বর্ষা কাল হওয়া সত্তেও এক ছিটে ফোঁটা পানিও নেও এই নদীতে। একবার ভেবে দেখ তাহলে চৈত্র মাসে কি অবস্থা বিরাজ করে এখানে।

আচ্ছা এর সমাধান কি? আনিকা বলল।

আমি বললাম, এর কোন সমাধান নাই। কারণ আমাদের মত যুবক সমাজ আজ শাহবাগে গিয়ে একটা অবাঞ্ছনীয় বিষয় নিয়ে মিছিল করতেছে। আমি বলি আচ্ছা আমি ধরলাম, কাদের মোল্লা, সাঈদি, নিজামি, বাচ্ছু, আরও যারা আছে তাদের সবার ফাসি হল কিন্তু এই সমস্যার কি কোন সমাধগান ওইটার মাধ্যমে হবে। বল তো। তুই তো লাকির খুব ক্লজ বন্ধু লাকি কে জিজ্ঞাসা করিস এর সমাধান কি হবে ওদের বিচার হলে। হবে না। আমি একটা বিষয় বলতে চাই জন্ম হউক যথাযথ কর্ম হউক ভালো। কি একমত না আমার কথার সাথে।

আজ আমাদের এখানে বৃষ্টি হচ্ছে না কেন। এইটা কি আমাদের সৃষ্ট সমস্যা নয়। বৃষ্টি কি ভাবে হবে, নদীর পানি শুকিয়ে আকাশে মেঘ জমে তারপরেই না তা আবার বৃষ্টি আকারে এই জমিনে ফিরে আসে। আজ দেখবি শ্রীলংকা তে এতো ঘন ঘন বৃষ্টি হয় কারণ তার চারিপাশে সমুদ্র এইজন্য। আমাদের এলাকার পানি সাপ্লাই নাই তাই বৃষ্টি হয়না। আজ আমাদের নদীর পানি তারা আতকিয়ে ওদের দেশ কে শস্য শ্যামলা করতেছে আড় আমরা মরুভুমি হয়ে যাচ্ছি। ফারাক্কার বাধ এই সমস্যার জন্য দায়ি। এই অবিচার নিয়ে বিশ্ব আজ ভারত সরকার কে চাপ দিচ্ছে কিন্তু আমরা হায়রে ভারত প্রেমি ভারত নাকি আমাদের বন্ধু। বন্দধু হলে কি আরেক বন্ধুর মুখের পানি কেড়ে নেই? এটা কেমন বন্ধুত্ব।তারা একের পর এক বাংলাদেশি কে গুলি করে মারবে কিন্তু আমরা কিছুই বলব না।

আমাদের তো মনে হয় আজকের যুব সমাজ না বুঝেই আন্দোলন করছে। মাঝে মাঝে শুনি কিছু যুবক জোর গলায় বলে, তাদের নাকি এই বাংলাদেশে থাকার অধিকার নায়। আওয়ামী অনেক নেতা তাদের নিষিদ্ধ করার জন্য প্রস্তাব করে। কিন্তু যুদ্ধের সময় তারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলো। দেশ স্বাধিন হওয়ার পরে এসে বড় বড় নেতা হয়ে বসে আছে। আজ কে সংবিধান তাদের আঙ্গুলের ইশারায় চেইঞ্জ হয় রাতারাতি।

আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, দেশ যদি থাকার অধিকার আপনার থাকে তাহলে সেইদিন পালিয়ে গিয়েছিলে কেন? সেদিন কি আপনাদের এটা দায়িত্ব ছিল না দেশটাকে স্বাধীন করবার। দেশকে যদি এতই ভালবাসেন তবে সেদিন পালিয়ে ছিলেন কেন? যারা প্রকৃত দেশ প্রেমিক তারা কখনো বলেনা যে এরা দেশদ্রোহী ওরা দেশদ্রোহী। তারা সবসময় নিরব থাকেন।

জানিস আনিকা আমাদের এই গ্রামে সবসময়ই রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে তারা বিএনপি সমর্থন কারিদের বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, পচা গবর ফেলে টিনের ছাদে। এভাবেই বিপরীত ঘটনা ঘটে ওদের ক্ষেত্রে।

এইভাবে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ফেরদৌসি মানে আমার ভাইয়ের মেয়ে আমাদের ডাকতে আসলো, ও মেজো আব্বু দাদি ডাকছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে বাসায় চলেন।

আনিকা ফেরদৌসি কে ডেকে কোলে বসিয়ে আরও কিছুক্ষণ গল্প করলো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। এর মাঝে উঠে আসলো আমার সেই ছয় বন্ধু দের কথা।

আমার সেই ছয় বন্ধুর অনেকেই আজ দেশের বাইরে থাকে। উজ্জ্বল দুবাই ফিরে গিয়েগিলো সেই ঘটনার মাস খানেক পরেই। সোহাগও সিঙ্গাপুরের ত্রেনিং করে চলে গেছে সে। সেই সিংগাপুরে চলে গেছে আমাদের ছোট বন্ধু তুষারও। গ্রামে আমার সমবয়সী যুবক ছেলের সংখ্যা খুবই কম। মেহেদী পড়তেছে খুলনাতে। ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো বলে এখনও অনার্স শেষ করতে পারেনি। সজিব ভাই বিয়ে করে ফেলেছে। বর্তমান ঢাকাতেই স্থায়ী। আমার বন্ধুদের মধ্যে কাউকে আড় দেখিনা।

বাসায় এসে খাওয়া দাওয়া করে আনিকা বলল, টিভি দেখবে। আমি ওকে টিভি রুমে নিয়ে গেলাম। আনিকা বেশির ভাগ ঢাকাতে কাটাত বলে ও গ্রামের মেয়েদের মত স্টার জলসার নাটক দেখত না। আনিকার এই গুণটাকে আমার খুব পছন্দ হল। আনিকা বাংলাদেশি চ্যানেল গুলো নেড়েচেড়ে বাংলাদেশি সুন্দর সুন্দর নাটক দেখছিল। বাংলাদেশের চলচিত্রের এই দিকটার প্রশংসা আমি সবসময়ই করি। এতো সুন্দর ছোট নাট্য বিশ্বে কোথাও তৈরি করতে পারেনা। কিন্তু আনিকার আর আমার এই আনন্দ বেশিক্ষন থাকলো না। ভিড় জমাতে শুরু করলো কিছুক্ষণের মধ্যে ভারতীয় পচা সিরিয়াল গুলো দেখার জন্য আমাদের প্রতিবেশি যাদের টেলিভিশন নাই।

তারা এসে বারবার বলতে লাগলো যে স্টার জলসা দিতে এই জী বাংলা দিতে, স্টার প্লাসে দিতে জি টিভি তে দিতে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আনিকাকে ইশারায় রিমোট ওদের হাতে দিয়ে আমার কাছে আসতে বললাম। আনিকা আসলে আমি আর আনিকা আমার বাড়ির পাশের বাধের সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। একেবারে মাঝের সিঁড়িতে। এবার আমাদের সাথে আসলো ফেরদৌসি। ফেরদৌসি বলছিল আমি আপনাদের সাথে গল্প শুনবো।

আনিকা বলল, আচ্ছা আলি আমাদের দেশের মানুষ অমন ইন্দিয়া প্রেমি কেন?

আমি বললাম, এটা একটা কূটনীতিক চাল। যেমন দেখবি আমাদের কোন চ্যানেল দেখবি তাদের দেশে প্রচার করা নিষেধ। কেউ যদি প্রচার করে তার জরিমানা হয়। আমার অনেক ব্লগ বন্ধু আছে যাদের বাড়ি ভারতে। তারা ব্লগে আমাদের নাতকের ভূয়সী প্রশংসা করে কিন্তু দুর্ভাগ্য তারা সেটা থেকে বঞ্চিত হয়। কেউ কেউ বলে তাদের হাজার হাজার চ্যানেল আমাদের টা দেখবে কেন? কিন্তু আমি জানি আমাদের নাটক গুলো তারা মন্ত্র মুগ্ধের মত দেখে। ইভেন চ্যানেল গুলো প্রচার বন্ধ করে দেওয়ায় তারা সিডি কিনে আমাদের ঈদের, কোরবানির, ভালবাসা দিবসের যে বিশেষ নাটক গুলো আমাদের দেশে তৈরি হয় সেগুলো ওরা দেখতে মিস করে না কখনো।

তুমি একটা জিনিষ লক্ষ্য করবা, কিছুদিন আগে প্রথম আলো পেপারে একটা জরিপ বের হয়েছিলো, টাতে দেখলাম ভারত সরকার প্রতিবছর বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে ২০ হাজার বিলিয়ন ডলার পাই। চিন্তা করেছো। এতো বড় বপুল অর্থ তারা প্রতি বছর নিয়ে যায় কিন্তু তারা কখনো আমাদের সাথে চ্যানেল বিনিময় করে না। তারা কত বড় স্বার্থপর। কিন্তু এই একি চ্যানেল আমরা পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, এবং চীনা আর যুক্তরাষ্ট্রের কিছু চ্যানেল দেখি বিনিময় পদ্ধতিতে। এতো বিপুল অংকের টাকা আমরা তাদের প্রতিবছর দেই যা দিয়ে আমরা চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবো। কিন্তু আমরা কত বকা দেখ। ভারত সরকার আমাদের দেশটাকে তাদের নিজেদের অঙ্গরাজ্য হিসাবে ব্যবহার করে। ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে কোন রকম টোল সুবিধা না দিয়েই। কিন্তু আমাদের কখনো ট্রান্সপোর্ট সুবিধা তারা দিতে নারাজ।

আরেকটা বিষয় দেখে আমার খুব ব্যথা লাগে, আমাদের সরকার প্রধান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী এসব বিষয় নিয়ে কখন তাদের চাপ পর্যন্ত দেয় না। যেখানে ভারতীয় অনেক বন্ধুরায় আমাকে বলেছে এটা তোমার সরকার কর্তৃক চাপ দাও তাহলে আমরাও তোমাদের দেশের চ্যানেলের সুন্দর সুন্দর প্রোগ্রাম গুলো দেখতে পারবো। সেই জায়গাতে আজ আমদের দেশ নিরব ভুমিকা পালন করতেছে। তারা আমাদের দেশ থেকে কত কিছু নিয়ে যাচ্ছে।

আওয়ামী বাহিনী আজ কথায় কথায় পাকিস্থানের অত্যাচারের কথা তুলে ধরে। আরে সেজন্য তো আমরা তাদের ঘৃণা করি, কিন্তু একটা কথা না বললেই নয় তাহলো পাকিস্তান তো একবার আমাদের শোষণ করেছে কিন্তু ভারতীয়রা আমাদের শোষণ করতেছে আরও আগে থেকে। যখন বংগ ভংগ হয় তখন ইংরেজ সরকার ঢাকাকে আধুনিক শহর করার জন্য যখন সকল প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন হিন্দু দের টা সহ্য হয়নি। তারা ভেবেছিল মুসলমান রা আমাদের উপরে চলে যাবে আবার। টা তারা হতে দেইনি। ঢাকাকে রাজধানি করা তারা মানেনি। বিরোধিতা করতে শুরু করে বংগভংগের। ফলে ঢাকা আবার তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলে হিন্দুদের চক্রান্তে।

আজও হিন্দুদের সেই চক্রান্ত শেষ হয়ে যায়নি। তারা আমাদের সংবিধান থেকে “আল্লাহর ওপর আস্থা” নামটি মুছে ফেলে। বাংলাদেশের স্বাধিনতার যুদ্ধ কে কেন্দ্র করে লাভবান হল তারা।

আনিকা এতক্ষন চুপ ছিল, এবার বলল, আচ্ছা আলি আমি বুঝলাম না তারা কিভাবে আমাদের স্বাধিনতা নিয়ে কূটনীতিক ভাবে লাভবান হল।

আমি বললাম, দেখ আনিকা একটু বিশ্ব মানচিত্রের দিকে খেয়াল কর। যখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের অধিনে ছিল, তখন ভারত পাকিস্তান কে ভয় করতো এটা ভেবে যে পাকিস্তান তাদের চারিদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে, যেকোনো সময় তারা চরম ভাবে আঘাত আনতে পারে তাদের ওপর। এজন্য তারা এইটা ভেবেই সেদিন আমাদের যুদ্ধে সাহায্য করেছিলো। সাথে এটাও মনে মনে চক্রান্ত ছিল যে যদি এই যুদ্ধে বাংলাদেশকে জয়ী করা সম্ভব হয় তবে আটক কৃত সেনাবাহিনির বিনিময়ে কাশ্মির কে তাদের দখল বিনিময় করা সম্ভব হবে।

একসময় যখন আমরা একযোগে যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন হল তখন তারা এসে মাতব্বরি করে পাকিস্তানের সৈন্য গুলো কে তাদের দেশের এবং পাকিস্তানের কাশ্মীর সমস্যার ফায়দা লুটতে সামর্থ্য হল। আমরা যে পাকিস্তানের আত্ন সমর্পণ কৃত ৯৩ হাজার সেনাদের আটকে ছিলাম সেইটা নিয়ে তারা কূটনীতি করতে শুরু করলো পাকিস্তানের সাথে। ভারত সেইদিন ডিল করলো যে যদি কাশ্মিরের অর্ধেক তাদের কে দেই তবেই তারা ওই ৯৩ হাজার সৈন্য কে ফেরত দিবে নতুবা মৃত্যু দণ্ড দেবে, যেটা বাংলাদেশের মানুষ আদও জানতো না।

তাহলে দেখো এই স্বাধিনতা যুদ্ধে কারা লাভবান হল, পাকিস্তান হারাল পূর্ব পাকিস্তান এবং কাশ্মীরের অর্ধেক কে। আমরা বাংদেশিরা হারালাম ৩০ লক্ষ্য মানুষ কে ২ লক্ষ্য মা বোনের সম্ভ্রম কে। আনিকা তুই একটা জিনিষ খেয়াল করে দেখ ভারতীরা আমাদের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিলো নাকি কিন্তু তাদের একটা সৈন্য কি নিহত হয়েছিলো এমন কখনো শুনেছিস।

নাতো আমি কখনো এমন শুনিনি। তবে এতো সব বিষয় তুই জানলি কি করে? আনিকা গম্ভির ভাবে আমাকে প্রশ্ন করলো।

আমি বললাম, তোর এই চোখ দুটি দিয়ে ভালো করে দেখ সব কিছুই দেখবি। সব দিনের আলোর মত ঝকঝক করছে। কোথাও কোন সর্ষে ফুল নায়। আমি দুচোখ মেলে ভালো করে দেখি আর তুই এবং শাহবাগের আবেগি যুবকরা দেখেও না দেখার ভান করে। আচ্ছা বলতে পারবি যে শাহবাগে আন্দোলন টা হচ্ছে তার সাথে একটা কোন ইস্যু যেটা বিরোধী দলেরা করে আসছে সেটা যগ করলে এক সেকেন্ড ওখানে তোদের আন্দোলন করতে দিবে। আজ ওখানে কোন সামান্য দুর্ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে নাম ফেলে দেই এইটা জামায়াত শিবির করেছে। আজকে পুলিশেরা জ্যোতিষী হয়ে গেছে। তারা আগে থেকে জানতে পারতেছে নাকি বিএনপির আন্দোলনে নাশকতা হবে। তাদের কে রাজনৈতিক ভাবে হয়রানি করতেছে।

আনিকা এবার বলল, আমি জানি এটা আমাদের ভুল হচ্ছে। শুধু মাত্র একটা ইস্যু নিয়ে এখানে থাকা। সরকার হয়তো খুব সমর্থন দিচ্ছে কারণ তাদের নৈতিকতার সাথে আমাদের দাবি টা মিলে যাচ্ছে। কিন্তু যদি না মিলতো তবে আমাদেরও জামাত শিবির বানিয়ে দিত।

সরকার সবসময় জামাত কে শিবির কে খারাপ বলে। আমি তাদের কে খারাপ বলবো না। ছত্র রাজনীতি আমি সমর্থন করি। কারণ এই ছাত্র রাজনীতিই আমাদের এই স্বাধীন দেশ স্বাধীন একটা ভাষা উপহার দিয়েছে। আনিকা তুই দেখবি কলেজের সবথেকে মেধাবি ছাত্রটা শিবির সমর্থন করে। শিবিরের ছেলেরা দিনে পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কোরআন তেলয়াত করে। আমার ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু ছাত্র লীগরা দেখবি কলেজে বছরের পর বছর কাতাচ্ছে। পাশ করে বের হয় না। বরং তারাই মেয়েদের ইভতিজিং করে। আজ পর্যন্ত শুনেছিস কখনো কোন শিবির ছেলের হাতে কোন মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে কিন্তু হাজার হাজার উদাহরন আছে যেখানে যুবলীগ এবং ছাত্র লীগের কাছে কলেজ ভার্সিটি ছাত্রি ধর্ষিত। এমন উদাহরন তুই তোর নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীর নগরেই পাবি। যেটা তুই নিজেই জানিস। উনি একশ মেয়েকে ধর্ষণ করে সেঞ্চুরি উৎযাপন করেছে।

আনিকার এবার কথা ফুটেছে বুঝলাম, সে নিজে থেকেই বলল, আসলে কি জানিস আমাদের যুবসমাজ হয়ে গেছে স্বার্থপর। যেখানে গেলে সে তার অর্থনৈতিক সাপোর্ট পাবে সেখানেই যাবে। এবং তার গুনগানই গাবে।

কিন্তু এটাও তাকে ভাবতে হবে, যে নিজের একার স্বার্থ হাসিল করার জন্য দেশের আরও ১২ কোটি মানুষের স্বার্থ কে উপেক্ষা করা তার কখনই উচিৎ হবে না। আসলে আমরা নরমের যম কিন্তু শক্তের ভক্ত।

এতক্ষণ ফেরদসি আমাদের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল এবার বলল, আচ্ছা মেজো আব্বু যম কি?

আনিকা না বুঝেই এবার হাস্তে লাগলো। আমি বললাম আনিকা বেশি জরে হাসিস না। এটা গ্রাম এখানে এতো জোরে জোরে রাতে হাসলে লকে খারাপ ভাববে। এবার আনিকা কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেলো। বলল, তাহলে চল বাসায় যায়। আমি রাজি হলাম বাসায় যাবার জন্য।

পরের দিন আমি সকাল খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মসজিদে গেলাম। ফজরের নামাজ পড়ে বাড়িতে এসে দেখি বাড়ির সাথেই ফেরদৌসি ার আনিকা দাড়িয়ে, আমাকে দেখে আনিকা এবার কিছুটা ঠাট্টা করার জন্য সালাম দিলো, “আস সালামু আলাইকুম” ।

আমি সালামের উত্তর দিলাম। বললাম কি ব্যাপার এতো সকাল সকাল ঘুম ভাঙল কেন? সারারাত মনে হচ্ছে ঘুমাস নি?

আনিকা বলল, সত্যি করে সারারাত আমি ভালো মত ঘুমায়নি। আমি ার ফেরদৌসি অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছি। ফেরদৌসি তোর ব্যপারে অনেক কিছু আমাকে বলেছে। তুই কিভাবে সত্য কথা মুখ ফুতে বলতে পারিস। তোকে একটা অনুরোধ করবো রাশবি?

আমি বললাম, কি অনুরোধ? বল আমি তোর জন্য কি করতে পারি?

আমাকে একটু তোদের গ্রাম টা ঘুরিয়ে দেখা। তোদের এই পিরোজপুর গ্রাম টা অনেক সুন্দর। আনিকা বলল।

আমি বললাম, কিন্তু এইভাবে ঘুরলে তো মানুষ খারাপ বলবে। আবার কিছুক্ষণ ভাবার পর বললাম। আচ্ছা চল ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। আব্বা কে বলে আমি আনিকা এবং ফেরদোসি তিনজনা মিলে ঘুরতে গেলাম।

আমরা ওইদিন ঘুরতে ঘুরতে গিয়েছিলাম পিরোজপুর মাদ্রাসাতে। আমদের কবরস্থান এবং ঈদ্গাহের সাথে মাদ্রাসা টা সামঞ্জস্য ছিল যা আনিকা খুব পছন্দ করেছিলো। আনিকা বলছিল, তোদের গ্রামের মাদ্রসাটি তো অনেক সুন্দর। আচ্ছা এটা কি সরকারে অনুদানে চলে।

আমার মনটা ওইদিন খুবই খারাপ হয়েছিলো বলেছিলাম, আমাদের গ্রামের এই বৃহৎ মাদ্রাসাটি আমাদের গ্রামের মানুষের অর্থে চলে। এখানে কোন সরকারি অনুদান লাগে না। আমাদের এতিমখানার জন্যেও কোন রকম সরকারি সহযোগিতা আসে না। ইসলাম পন্থী মানুষের সাহায্য সহযোগিতাই চলে এটি। এখান থেকে প্রতিবছর ২০০ থেকে ৩০০ ছাত্র ছাত্রি এসএসসি পাস করে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা যে তোরা শাহবাগে দেশের মাদ্রাসা গুলো কে বন্ধ করে দেওয়ার আন্দোলন করলি। বলতো তোদের এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা কতটুকু। আসলে কিছু মানুষ হয়ে গেছে হুগুগে মাতাল।

জানিস আনিকা গত কয়েকদিন আগে আমার সামনে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বাসে করে আসতেছি যাত্রাবাড়ী থেকে শ্যামলী। বাসে এক মহিলা উঠেছে শাহবাগ থেকে। মানে উনি আন্দোলনের শরিক ছিলেন। তো যাচ্ছি কিছুক্ষণ পরে ওই মহিলার কোলে যে বাচ্ছা মেয়েটি ছিল সে সদ্য বাসে ওঠা এক ভদ্র দাড়িওয়ালা লোক কে দেখেই বলতে শুরু করলো, তুই রাজাকার তুই রাজাকার। ওই লোকটা বাসের মধ্যেই হাউমাউ করে কেদে উঠলো, বলল আমি আমার রসুলের (সাঃ) সুন্নাত পালন করতে গিয়ে আমি রাজাকার হয়ে গেলাম?

তো আমি কিছুটা সামনে গিয়ে বাচ্ছা মেয়েটিকে বললাম, বাবু তোমার নাম কি?

মেয়েটি বলল, আমার নাম হাবিবা। আঙ্কেল ওই যে দেখেন আমাদের বাসে রাজাকার এসেছে।

আমি বললাম, তমাকে কে বলেছে উনি রাজাকার।

তখন মেয়েটি ওর আম্মু কে দেখিয়ে দিয়ে বলল, আম্মু আমাকে একটি বড় দাড়ি ওয়ালা কিছু লোক কে দেখিয়ে বলেছিল এরা রাজাকার এদের মুখে থু দেও। আমি এবার কিছুটা বিস্মিত হলাম। ওই মহিলা টির কাছে গিয়ে বললাম, আপনি যে বাচ্ছা টিকে এখনি নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় করে তুলছেন পরে আপনাকে পস্তাতে হবে।

ওই মহিলা আমাকে বলল, রাজাকার কে রাজাকার বলাতে কোন দোষ আছে নাকি?

আমি বললাম, দোষ নাই কিন্তু বাচ্ছাদের এথেকে দূরে রাখা ভালো নয় কি? তাছাড়া আপনি কি নিশ্চিত উনি রাজাকার? আপনি কি স্বচক্ষে দেখেছেন?

উনি বলল, না দেখিনি, তবে টেলিভিশনে প্রচার করা দেখেছি।

আমি বুঝলাম আসলে কল-কব্জা কারা নাড়ছে। আমি তাও বললাম, কারো সম্পর্কে না জেনে তাকে দশারুপ করা ইসলামে অনেক বড় জুলুম। অত্যাচারের সামিল। তাছাড়া সে যদি প্রকৃত অন্যায় করে থাকে তার শাস্তি দেবে আদালত। আমরা এমন করলে তো মহামান্য আদালত কে অবমাননা করার শামিল। তাছাড়া এখন যে ঘটনা ঘটলো কাল সেটা আপনার জন্মদাতা পিতার সাথেও তো ঘটতে পারে। কি ঠিক বলি নি?

উনি মনে হয় বুঝতে পারছিলেন। সেজন্য অনুতপ্ত হয়ে ওই মুরুব্বি লোক টার কাছে গিয়ে তার বাচ্চার এই ধরনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইলেন। আমাকে পরে এসে অনেক ধন্যবাদ জানালেন।

আনিকা এবার বলল, তুই কিন্তু মানুষ কে খুব সুন্দর করে বোঝাতে পারিস। তোর এই গুনটার জন্য যেকেউ তোর প্রেমে প্রেমে যাবে।

এবার আমার ভাইস্তি ফেরদৌসি হো হো হো করে হেসে ফেলল আনিকার কথা শুনে। ফেরদৌসি বলল, মেজো আব্বুর জন্য আমার বীথি খালা পাগল ছিল কিন্তু উনি সময় দেন নি তাকে।

আনিকা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে নিজেকে খুব দামি মনে করিস নাকি? এইজন্য মেয়েটার ডাকে সাড়া দিস নাই?

আমি বললাম, এমন তো কত মেয়েই বলেছে, যদি উদার হয়ে তাদের ডাকে সাড়া দিতে গেলে তো আমি নিজেকেই তো আর খুঁজে পাব না।

আনিকার এবার হাসতে শুরু করলো। আমিও যে হাসচ্ছিলাম না টা কিন্তু না, আমিও অল্প অল্প করে হাসছিলাম। সেদিন আমি আনিকা কে আমার পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে দেখলাম। আবার সন্ধ্যার দিকে যখন নদীর চরে গেলাম দেখা হল আমার স্কুলের জীবনের আরেক ঘনিষ্ঠ বান্ধবি সাগরিকার সাথে। অনেকক্ষণ কথা বললাম, আমি আনিকা এবং সাগরিকা। সাগরিকা আমার স্কুলের সবথেকে চাহিদা পূর্ণ মেয়ে ছিল তার ভালবাসা পাওয়ার জন্য সকলে একরকম পাগল ছিল।

এই ধরনের একটা ঘটনা অবশ্য আমার জীবনের সাথে ঘটেছিল। সাগরিকা আমি মেহেদী আর সাথি বলে একটা মেয়ে রাজা রানি খেলা করছিলাম। খেলা শেষে আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম বলে নিয়ম মত আমায় বলা হয়েছিলো রাজা আর সাগরিকা হয়েছিল সেকেন্ড সেজন্য ওকে রানি বলা হল এবং আমাকে সেইসাথে ওকে কিছুক্ষণ আমার নাম নিয়ে খেপালও। আমি ওদের বললাম যে দেখ্‌ খেলা তো শেষ ওইটা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করা উচিৎ হবে না। আমি বিষয়টা এড়িয়ে গেলেও আমার ক্লাস মেট বন্ধু এবং বান্ধবিরা আমাকে এবং সাগরিকাকে এইটা নিয়ে খুব খেপাত। একবারতো আমার এক বন্ধু শোভন সাগরিকার নাম আমার নামের সাথে জুড়ে লিখল আমার বই এবং খাতাতে। বইটাও ছিল ইসলাম শিক্ষা বই। এইটা আমার কিছু বান্ধবি দেখে ফেলে আমাদের ধর্ম শিক্ষা স্যার কে বলে দিলো। একটা বিষয় বলে রাখি এই ধরনের সমস্যা গুলো এই শিক্ষক কে বললে উনি খুব মারতো।

তো স্যার জানার পর আমাকে এবং সাগরিকাকে ডাকলো। সাগরিকা কেঁদে ফেলল এইজন্য যে ওকে অনেকদিন যাবত এই বিষয়টা নিয়ে পেরেশানি করা হয়েছে। এই জন্য ও বলল আমি এর সমাধা চাই। পরে স্যার বইটা হাতে নিয়ে বলল, আলি এইটা কি তোমার বই আমি বললাম হ্যা। আমি একবারেই চিনতে পারলাম আমার বই কারণ আমি যে মলাট দিয়ে বইটা মুড়িয়েছিলাম টা কারো ছিল না। উনি আমাকে বলল, বইয়ে এসব কেন লিখেছ। আমি প্রথমে কিছুটা অবাক হলাম। কারণ আমি এইগুলো লিখি নাই। কিন্তু বইটা তো আমার যেই লিখুক না কেন এই দায় আমাকেই নিতে হবে। স্যার আমাকে মারার জন্য ওইদিন পাঁচটা কঞ্চি আনিয়েছিল আমার সহপাটি উজ্জ্বল কে দিয়ে। পাঁচটা বেত ভেঙ্গে না যাওয়া পর্যন্ত আমাকে ওইদিন স্যার মেরেছিল।

যেহেতু আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলাম সেহেতু দুয়েক জন ব্যতিত সবাই আমার অনুগত ছিল সবাই এই বিষয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিল। কেউ কেউ আমাকে বলেছিল প্রধান শিক্ষকের কাছে কমপ্লেন দিতে। আমি যায়নি। বলেছিলাম এর দায় সম্পূর্ণ ভাবে আমার কারণ আমি এই বিষয়টাকে এড়িয়ে গেছি। অবশ্য এই ঘটনার পর সাগরিকার সাথে আমার সব বন্ধুরা কথা বলা বন্ধ করে দেয়। অরা ওকে বুঝিয়েছিল যে আলি এইকাজ করেনি। তুই যদি বলতি তাহলে স্যার ওকে এইভাবে অপমান করতো না।

সাগরিকা আসতে আসতে বুঝতে পেরেছিল। পরের বছরের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল দিলো আমি আবারো ফার্স্ট হলাম। সেদিন সাগরিকা আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল এবং খুব অনুরধ করেছিল।

সাগরিকাকে বললাম, কিরে তোর মনে আছে সেইসব ঘটনা?

কেন মনে থাকবে না। জানিস আলি আমি আজও অনুতপ্ত হয়। তোকে ওইদিন অইভাবে আমার জন্য মার খেতে হতেছিলো। সাগরিকা বলল।

আমি বললাম, না রে অনুতপ্ত হওয়ার কিছু নাই। আমি তো তোকে এই বিষয় নিয়ে কখনো দোষারোপ করিনি। তোর অবস্থানে যেই থাকতো সেই একাজ করতো।

এতক্ষন আনিকা আমাদের কথা শুনছিল, এবার বলল, আচ্ছা আলি তুমি পাচ পাঁচটা বেতের মার খেয়ে ছিল তুমি কি কেদেছিলে।

আমি বললাম, না সেই মুহুরতে কাদি নাই তবে বাসাতে বসে অনেকক্ষণ কেঁদে ছিলাম। কারণ দায় টা আমার। যেহেতু বইটা ছিল আমার। কিছদিন আগে দেখলাম, রাজিব বলে একজন ব্লগার নিহত হবার পরে নাকি তার ব্লগে অন্য জনারা হ্যাক করে খারাপ খারাপ কথা লিখেছে। আমার সমর্থন হচ্ছে, ব্লগটা যেহেতু রাজিবের এই দায়িত্বও রাজিব কে নিতে হবে।

সেইদিন বাসায় আসার পর আমি আর আনিকা আমার বড় ভাইদের ঘরে খাওয়া দাওয়া করলাম। কিছুক্ষণ টিভি দেখছিলাম হটাত বাইরে থেকে কার যেন ডাক পেলেন, এই আলি” আলি আছো নাকি?

আমি তাড়াহুড়া করে বাইরে এসে দেখলাম, সজিব ভাই এবং মেহেদী আমাকে ডাকছিল। আমি আসার পর সজিব ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার কবে এসেছ? কোন যোগাযোগ নেই কেন? শুনলাম তোমার সাথে কে বলে এসেছ টাকে নিয়ে ঘুরছ খুব।

আমি বললাম, আরে সজিব ভাই, কি খবর আমি অবশ্য আপনকেই মনে মনে খুজতেছিলাম। আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। এই বলে হাঁটতে হাঁটতে আবার সিঁড়ির কাছে গেলাম। তিন জনা একসাথে একটা সিঁড়ির ডেকে বসলাম। আমিই আগে শুরু করলাম, সজিব ভাই মনে আছে কি, ওই যে বছর চারেক আগে বারাদি বাজারে আমি, তুষার, মেহেদী, সোহাগ, উজ্জ্বল আর আপনি একটা মেয়ে কে অনেকক্ষণ ফলো করছিলাম। মেয়েটি ফার্মেসীর দোকানে বসে ছিল। পরে অনেক্কখন আমরা চেষ্টা করেছিলাম মেয়েটির সাথে কথা বলার। কিন্তু পেরেছহিলাম না। পরে লসিমন চালকের কাছে তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। মনে আছে সেই মেয়েটির কথা আপনার।

সজিব ভাই, হ্যা হ্যা মনে পড়েছে। কি কিছু হয়েছে তার। মানে তার কোণ খজ কি তুমি পেয়েছো।

হ্যা পাবো না কেন? সেই মেয়েটি এখন আমার বাড়িতে এসেছে। ট্রেনের মধ্যে পরিচয়। ওই অবশ্য আগে চিনেছিল। আমার মনে ছিল না। ওই আমাকে মনে করিয়ে দিলো।

মেহেদী বলল, সত্যি নাকি। তাহলে যে মেয়েটি তোর সাথে ঘুরছে ওই সেই মেয়ে! আজব ব্যাপার তো। বাপ চল তোদের বাড়ি ওকে দেখে আসি।

আমি বললাম, রাখ বাড়ি যাবার দরকার নাই। সবাই এখন নাটক দেখায় ব্যস্ত। ওখানে গেলে কথা বলা যাবে না। বরং আমি ডেকে আনি এখানে। বলে আমি ফোন করে সিঁড়ির কাছে আসতে বললাম আনিকা কে।

সজিব ভাই বলল, রাতের বেলা এখানে ডাকা কি ঠিক হচ্ছে?

আমি বললাম, সমস্যা নাই। আমি আর ও প্রতিদিন রাতে এখানে এসে অনেকক্ষণ গল্প করি। তারপরে গিয়ে ঘুমায়। আমার কথা শেষ হবার আগেই আনিকা চলে এসে বলল, কি রে দাকছিস কেনে? কি বলবি। আমি নাটক দেখছিলাম। ডিস্টার্ব করছিলি কেন। এবার ওদের দিকে তাকাল। জস্যনা রাত। চাদের আলো চারিদিকে ফক ফক করছিলো। পরিস্কার সবার মুখ বোঝা যাচ্ছিলো। মেহেদী এবং সজিব ভাইকে দেখে যেন কিছুটা থমকে গেলো আনিকা।

আমি বললাম, কি রে কি ভাবছিস/

এদিকে সজিব ভাই এবং মেহেদী আমাদের কথা বলা দেখে অনেকটা আশ্চারযানিত হল। কি ব্যাপার এই কদিনে এতো ক্লোজ হয়ে গেছে যে তারা তুই তুকারি করে কথা বলছে।

এবার আনিকা আমার কাছ ঘেশে দাড়িয়ে ফিসফিস করে আমার কানের কাছে বলল, আলি ওদের খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। ওদেরও মনে হচ্ছে তোর সাথে বারাদি বাজারে দেখেছিলাম।

আমি একটু শব্দ করেই বললাম, হ্যা ঠিকই ধরেছিস, ওরাও ছিল সেদিন আমার সাথে। কিন্তু আমি বললাম না যে এই সজিব ভাই বিয়ে করতে চেয়েছিল। কারণ সজিব ভাই আমাকে চোখের ইশারাতে নিষেধ করলো আমি বুঝতে পারলাম। এবার চারজনা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললাম ঘণ্টা দুইতিন।

রাত তখন সাড়ে এগারো টা বেজে গেলো, আমার বড় ভাই ফরিদ ভাইয়া আসলো এই পথ ধরে। আমাদের এইভাবে রাস্তা তে কথা বলতে দেখে খুব রাগ করলো। বলল, এই বাড়ির মধ্যে গিয়ে কথা বলা যায় না? চল বাড়ি চল বলে আনিকা কে সাথে নিয়ে চলে গেলো। আমি এবং সজিব ভাই আরও কিছুক্ষণ গল্প করলাম।

পরেরদিন সকাল বেলা উঠে আনিকা আমাকে বলল, দোস্ত আমি আজকেই চলে যাবো। প্রথমে মামার বাড়ি যাবো। তারপরে যাবো আমার নিজের বাড়ি কুষ্টিয়াতে।

আমি বললাম, আমি কি তোকে পৌঁছে দিতে যাবো?

আনিকা বলল, নারে দোস্ত, পৌঁছে দেওয়া লাগবে না। তুই শুধু তোদের বাজার থেকে আমাকে বারাদি পর্যন্ত যাবার গাড়ি ভাড়া করে দে তাতেই হবে।

পরে আনিকা একে একে আবার পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলো। সকাল ১০:৩০ মিনিটের দিকে আমি আনিকা কে নিয়ে তুষারের বাড়ির কাছে প্রাইমারি স্কুলের লসিমন স্ট্যান্ড থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে দিলাম। গাড়ি ওয়ালাকে বলে দিলাম ভালো ভাবে বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।

আনিকা চলে যাবার পর বাড়িতে এসে বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। তার সব কথা গুলো আমি ভাবতে থাকলাম। এটাও ভাবলাম বেশি হিসাবে মন্দ নয় বেশ পারফেক্ট। আমার পরিবারও তাকে যথেষ্ট আপন করে নিয়েছে। এইটা বুঝলাম যখন রাতে খাইতে গেলাম তখন। সবার মন টা কিছুটা হলেও আনিকার কথা ভাবছিল। আম্মা তো বলেই ফেলল, মেয়েটি আমাদের এই ছোট অভাবের সংসারে আনন্দের বন্যা এনেছিল। সবাই কে সব সময় হাসি খুশির মধ্যে রেখেছিলো।

আমি কিছু বলছিলাম না। আব্বা বলল, মাঝে মাঝে ওকে এখানে এসে কয়েকদিন করে থাকতে বলিস। তাহলে আমাদের কিছুটা ভালো কাটবে।

আমি আসতে করে বললাম ঠিক আছে আব্বা বলব।

মা এবার আব্বা কে বলল, একবারের জন্য রেখে দিলে কিন্তু মন্দ হয়না। দুজন কে কিন্তু খুবই মানাবে। আমার ঘর আলোকিত করে থাকবে।

আমি এখনও চুপ ছিলাম কিছু বলছিলাম না। কারণ আমিও খুব মিস করছিলাম আনিকা কে।

মা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যারে আলি, তোরা দুজন কি শুধুই বন্ধু না অন্যকিছু। আমাদের কিন্তু আপত্তি নাই। আনিকা মেয়ে হিসাবে কিন্তু আমাদের সবারই পছন্দ। এমন কি তোর ভাইয়া পর্যন্ত খুব রাজি আনিকা প্রসঙ্গে।

আমি এবার বললাম, কি বলছ কি তোমরা। তুমি জানো ওদের অবস্থান কোথায় আর আমাদের অবস্থান কোথায়? আমাদের টিনের চালা আর চাটায়ের বেড়া দেওয়া ঘরে ওর ফ্যামিলি কখনো আমার হাতে ওকে দেবে না। আর এসব চিন্তা কর না। আনিকা আমার ভালো একটা বন্ধু, আমি চাই ও আমার সারাজীবন বন্ধুই থাকুক। আমি চাইনা যে আমাদের এই বন্ধুত্ব কোণ কারণে নষ্ট হয়ে যাক। এইসব কথা বলে আমি উঠে আসলাম।

রাতে ঘুমাতে গিয়ে বারবার আনিকার কথা মনে পড়তে লাগলো। আমি সারারাত এই বিষয় নিয়ে ভাবলাম, কিন্তু মনে একবার বলছিল তাকে নিয়ে ভাবি আবার মনে হচ্ছিল, তাকে নিয়ে এভাবে ভাবা উচিৎ না। কারণ পরবর্তীতে যদি তার বাবা আমাদের না মানে। তারা তো যথেষ্ট ধনি যেটা প্রকাশ পেয়েছে আনিকার কথা বার্তাতে। এবং আনিকা নিজেও বলেছে ওদের অবস্থান কেমন। এইসব ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে গেলো ।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, আমার ভাইয়ের মেয়ে ফেরদৌসি খুব কান্না কাটি করছে। বারবার বলছে আমাকে আনিকা অ্যান্টির কাছে নিয়ে যান না হলে আমি ভাত খাব না। সারারাত আমার আনিকা অ্যান্টিকে সাড়া ঘুম আসে নি। ফেরদৌসি ওর বাবা কে বারবার বলছে ওকে আনিকার কাছে নিয়ে যেতে।

এবার ভাইয়া আমার কাছে এসে বলল, কি তুই নিয়ে যাবি না আমি যাবো। তোর কাছে ঠিকানা বলে গেছে না? আমাকে দে আমি তোর বিষয়ে কথা বলবো। যদি তুই ভয় পাস তাহলে আমিই এটার সমাধান করি।

আমি কিছুটা শংকিত হলাম এজন্য যে, আনিকা যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে, সেটা আমাকে আগে জানতে হবে। তারপরে আমার ভালবাসার কথা তাকে বলতে হবে।

ভাইয়া বলল, তুই নিজেকে এতোটা দুরবল ভাবছিস কেন, আমরা গরিব তাই আমরা কি কাউকে ভালবাসতে পারিনা? তাছাড়া তুই একজন ইঞ্জিনিয়ার। এটা তোকে সবসময় বড় করবে। আমার বিশ্বাস আনিকা এবং আনিকার পরিবার তোদের বন্ধুত্বকে বিবাহে রূপান্তর করাতে বাধা হবে না। তাছাড়া তোকে তো ওরা আগে থেকেই ভালো করে চেনে। যেহেতু ওর সাথে তোর এতো ক্লোজ বন্ধু।

আমি এবার মনে মনে বললাম, ভয়টা তো ওইখানেই। কারণ ওর ফ্যামিলি তো জানে না যে আমার সাথে ওর এতো ক্লোজ বন্ধুত্ব। মাত্র কয়েকদিন আগে ওর সাথে আমার পরিচয় ঘটেছে।

এভাবে আরও ৬ দিন পার হয়ে গেলো। আমার বাবা মা এবং ভাই ভাবি আমাকে খুব চাপাচাপি করছিলো, আনিকার সাথে কথা বলতে। তাই আমি ফোন বের করে কল করলাম। না ফোন ঢুকছে না। খুব কষ্ট পেলাম। মনে হচ্ছে যতদিন যাচ্ছে ততই আমি আনিকার প্রতি দুর্বল হতে থাকি। কিন্তু কি করবো ফোন তো ঢুকছে না। এভাবে আরও এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। আমি কোনরকম সিন্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কি করবো। আনিকার রেখে যাওয়া দুইটা ডায়রি ছিল সেগুলো ঘাঁটছিলাম। ওর একটা ডায়েরিতে বিভিন্ন গান কবিতা এসএমএস লেখা ছিল অন্যটাতে আনিকার আংশিক জীবনী লেখা ছিল। ওর বাবা, মা, ভাই এং মামা সহ অনেক আত্নিয়র নাম লেখা ছিল, তাদের সাথে আনিকার কাটানো সময় সব দেওয়া আছে। শেশের পাতাতে আমাকে নিয়েও অনেক কিছু লেখা ছিল। আমাকে শেশের দিকে অনুরোধ করেছিলো ওদের বাসায় যাবার জন্য। কিন্তু আমাকে সরাসরি বলে নি। ডায়েরি তে লিখে গেছিলো।

এবার আমি যাবার জন্য আমার নিজের মনসম্মতি পেয়ে গেলাম। পরের দিন বাবা কে বললাম, উনারা এবার আমার প্রতি খুব খুশি হলো। তাড়াতাড়ি যেতে বলল, আমি অবশ্য যেতে আরও ৪ দিন দেরি করলাম। যেদিন আমি বাবার সাআথে অনুমতি নিয়েছিলাম সেদিন ছিল ৯ ই মার্চ। আমি আনিকাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলাম ১৩ই মার্চে।

ওর বাড়ি চিনতে আমার কিছুটা ঝামেলা হয়েছিলো। তবুও অনেক কষ্টে তার বাড়ি পৌছালাম। আমি আমার নিজের পরিচয় দিলাম কিন্তু কেউ ভালো চিনতে পারলো না। পরে বললাম, যে আমি আনিকার ভালো একটা বন্ধু, ঢাকায় থেকে আমি আর ও একসাথে ফিরেছিলাম। সেখান থেকে আমাদের ভালো বন্ধুত্ব হয়। আমাদের বাড়ি ও গিয়েছিল আজ থেকে ২৪ দিন আগে। আমাদের বাড়ি আনিকা ৫ দিন কাটিয়েছিল। কেউ আমার কথা সেইভাবে গুরুত্ব দিয়ে শুনছিল না। সবার মন যেন ভীষণ খারাপ। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

কিছুক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে থাকার পর আনিকার আম্মা আসলো। উনি আমাকে বলল, তুমি ওর বন্ধু কিন্তু তুমি জাননা আনিকা মারা গেছে। আজ তিনদিন হয়ে গেলো। কেমন বন্ধু তুমি আনিকার।

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি যাকে এতোটা ভালো বেসে ফেলেছি সে আমাকে ছেড়ে আগেই চলে গেছে। না না এ হতে পারেনা। আমি হয়তো ভুল ঠিকানায় এসেছি। মনের মধ্যে আমার এই বিশ্বাস জমা হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর আমার সমবয়সী একটা ছেলে এসে আমার হাত টা ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেলো। আমার তখনি বিশ্বাস হয়নি যে আনিকা মারা গেছে।

যে ঘরটায় নিয়ে গেলো আমাকে সেই ঘরটা আনিকার ছিল বুঝতে পারলাম। ঘরের দুই দেওয়ালে দুইটা ছবি আছে আনিকার। টেবিলে ফ্রেমে আটকানো আরেকটা ছবি। একটা অ্যালবাম হাতে নিতেই দেখলাম, আমার সাথে এবং ফেরদৌসির সাথে উঠা আরও তিনটা ছবি। এবার বিশ্বাস হলো হ্যা এই আনিকায় আমার না বলতে পাড়ার আনিকা। যাকে বলার সুযোগ পর্যন্ত আমি পেলাম না।

আমার দুচোখ ঠিকরে পানি বের হয়ে আসলো। মনে বলছিল চিৎকার করে কাঁদি। কিন্তু কাঁদার পরিবেশ এইটা ছিল না। এবার পাশে বসে থাকা ছেলেটা বলল, আলি ভাই প্লিজ কাঁদবেন না।

আমি কিছুটা অবাক হলাম, ভাবলাম এই ছেলেটা আমার নাম জানলো কি করে!

এবার ছেলে টা বলল, ভাইয়া আমি আসিফ আনিকার বড় ভাই। আমি বড় হলেও আনিকার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। একেবারে বন্ধুর মত। ওর সব বিষয় আমি জানি। আপনার কথা এসে আমাকে অনেক অনেক বার বলেছে, বলেছে আমি অনেক মেধাবি, স্মার্ট, বুদ্ধিমান। আপনার সাথে উঠা ছবি গুলো আমাকে দিয়েছিল ওয়াশ করার জন্য। কিন্তু তার আগেই বলে গেলো আমার বোন টা সবাই কে ছেড়ে। তবে যে নরপশুরা আমার ছোট বোন টাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে মেরেছে আমি তাদের ছাড়বো না। ভাইয়া আপনি সাহায্য করলে আমি নিজ হাতে তাদের কে ওইভাবে কষ্ট দিয়ে মারবো।

এবার বুঝলাম, যে আসল ঘটনা কি? আমি বললাম, কারা আনিকা কে মেরেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে? মানে এই বিষয়ে কি কোন মামালা করা হয়েছে? ঘটনা টা আমাকে প্লিজ খুলে বল। আপনি দেখি কিভাবে এটার সমাধান পাওয়া যায়।

আসিফ এবার বলল, আপনাদের বাসা থেকে আসার পর এখানে আরও চারদিন ছিল। পরে একদিন ঢাকা থেকে ফোন আসলো ফারদিন বলে ওর একজন বন্ধু ফোন করেছিলো। ফারদিনের সাথে আনিকার সম্পর্ক ছিল সেটা আমি জানতাম। ফারদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ঘোষণা দিয়েছিলো নাকি দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা সমাবেশ করবে। আনিকা কে উপস্থিত থাকার জন্য সে বারবার চাপ দিচ্ছিল। আনিকা আপনাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর কেন যেন বদলে গিয়েছিলো। বারবার তরুণ দের সৃষ্ট শাহবাগ আন্দোলন কে সে আর সমর্থন করতো না। ওর বয় ফ্রেন্ড ফারদিন কে বোঝাতো আসল ব্যাপার কি ঘটছে। কিন্তু শেষ ও নিজেও বুঝেছিল ওর বয় ফ্রেন্ড ফারদিন ছাত্র লীগের সমর্থক। প্রথমে ফারদিন ওকে বিভিন্ন কায়দায় ভুলিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। পড়ে যখন আপনার কথা মত আরও কিছু প্রসঙ্গ আন্দোলনে যগ করতে চাইছিল কিন্তু তখনি ওর জীবনে কাল হয়ে গেলো। আপনার কথা তখন আনিকা খুব স্মরণ করেছিলো। আমার সাথে প্রতিদিনই ফোন করতো। আপনার বিষয় টা তুলত। আপানার ফোন নাম্বার টা ও কিভাবে যেন ডিলিট করে ফেলেছিল। ওর সিম টা পাক কোড হয়ে যাবার পর নতুন সিম কিনেছিল সেইজন্যই হয়তো আপনিও ফোন দেবার পর ওকে পাননি।

আমি এবার বুঝ্যতে পারলাম, কেন তখন ফোন ঢকে নি।

আসিফ আবার বলল, আলি ভাই আমার পুরো বিশ্বাস এই ঘটনার সাথে ওর বয় ফ্রেন্ড জড়িত। ওর ডায়েরিতে এই বিষয়ে অনেক কিছু লিখে গেছে। আপনার প্রতি আনিকার কিছুটা দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছিলো সেটা ও ওর ডায়েরিতে লিখে গেছে। জানেন আলি ভাই ওকে ওর বয় ফ্রেন্ড সহ অন্যান্য ফারদিনের বন্ধুরা ওকে শারিরিক নির্যাতন করে পরে মেরে ফেলেছে।

আনিকার কখন কি ঘটতো টা সে সাথে সাথে ডায়েরিতে লিখে রাখতো। ওকে যখন ওর বয় ফ্রেন্ড আটকে রেখেছিলো, ফোন কেড়ে নিয়েছিল কিন্তু ওর ব্যাগে থাকা নিত্য সঙ্গি ডায়েরিতে আনিকা সব কথা লিখে গিয়েছিলো। শেষের পাতাতে আপনার কাছে একটা চিঠি লিখে গেছে। আমাকে এইটা যেকোনো মুল্যে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে বলেছিল। আমি অবশ্য যেতাম আপনার বাড়িতে। ঠিকানাও লিখে গেছে ডায়েরিতে।

এইবার আমি এবং আসিফ দুজনাই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। হালকা খাওয়া দাওয়া করার পর আসিফ আমাকে বলল, চলেন আলি ভাই স্টুডিওতে যায়। আনিকার কিছু ছবি আছে যেগুলো আপনাদের বাসাতে গিয়ে উঠেছিল। সেইগুলো আমাকে ওয়াশ করতে দিয়েছিলো।

আমি আসিফ কে অনুস্মরণ করে চললাম। স্টুডিওতে গিয়ে আসিফ দোকান ওয়ালার কাছ থেকে ছবি গুলো চাইলো। ছবি গুলো আমার হাতে দিয়ে বলল, নেন আলি ভাই দেখেন কেমন হয়েছে।

আমি বের করে সব ছবি গুলো দেখলাম, আমার সাথে অনেক গুলো ছবি উঠা ছিল। ফেরদৌসির সাথে অনেক গুলো উঠা। আমার পরিবারে সবার সাথে আনিকার ছবি উঠা আছে। এমন কি আমার বড় ভাই ফরিদের সাথেও দুইটা ছবি উঠা ছিল। আমি এগুলো দেখে আরও আবেগি হয়ে গেলাম। চোখ ছিটকে পানি আসতে চাইলো। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে ব্যাকআপ দিলাম, কিন্তু আসিফের চোখ এড়াতে পারলাম না।

আসিফ এবার আমাকে আসার সময় হাঁটতে হাঁটতে বলল, আচ্ছা আল্লি ভাই আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?

আমি ভড়কে গেলাম। আসিফ আমাকে আবারো অবাক করে দিয়ে বলল, আপনি কি আনিকা কে ভালবেসে ফেলেছিলেন? নাকি বন্ধুই ভাবতেন?

আমি বললাম, জানিনা। তবে ওর মত মেয়ে আমার জীবনে আমি কখনো দেখিনি। সত্যিই ও খুব ভালো মেয়ে। আমি কৌশলে এড়িয়ে গেলাম কিন্তু চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।

বাসায় চলে আসলাম সেইদিনই। সবাই আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করলো কি খবর আনিকার। কেমন আছে ও। আমাদের কারো কথা জিজ্ঞাসা করছিলো কিনা। ইত্যাদি অনেক কথা আমি কোন প্রশ্নেরই জবাব দিলাম না। শুধু কাদছিলাম। চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল খুব করে। আমার কান্না দেখে আমার পরিবারের লোকজন কি বুঝেছিল জানিনা। তবে আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি।

আমি নিজে থেকেই বলে ছিলাম, আনিকা খুন হয়েছে। ঢাকায় কিছু পশুরা ওর ওপর অমানুবিক অত্যাচার করার পরে ওকে হত্যা করতে ভুলিনি।

এই কথা শুনে আমার আম্মা অনেক কেদেছিল। আমার ভাইস্তি ফেরদৌসির কান্না তো থামতেই চাচ্ছিল না। সবাই কেদেছিল ওর জন্য। আমার সাথে ঠিকানা নিতে চেয়েছিল যাবে বলে। কিন্তু যেতে নিষেধ করায় আর যায়নি।

আমিও কয়েকদিন পর চলে আসি ঢাকাতে। এসে আবারো ব্লগে লেখা লেখি শুরু করি। কি যেন মনে হওয়ায় আমি আর্কাইভ থেকে নিজের পুরাতন পোষ্ট গুলো দেখতে যায়। তখনি চোখ পড়ে আনিকার একটা কমেন্ট যেটা ছিল ৭ই মার্চ। মানে ঢাকায় এসে আনিকা আমার পুরনো সব ব্লগ পোষ্ট পড়েছে। এবার ফেইসবুক ওপেন করে দেখলাম, প্রায় ৭৬ টা মেসেজ। যেগুলো সবই আনিকা পাঠিয়েছে।

আমি একে একে খুলে খুলে দেখলাম এসএমএস গুলো যার ভাষা গুলো কিছুটা এমন...।

১) হ্যালো, আলি কি খবর কেমন আসিস। তুই কি এখন ঢাকায়।

২) দোস্ত তোর কথা সম্পূর্ণ সত্য। এই গণজাগরণ একদলীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন। আমি আর এর মধ্যে নেই।

৩) জানিস আমি জানিয়ে দিয়েছি ওকে, আমি আর এসবের মধ্যে নাই।

৪) দোস্ত আমার একটু সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তোর হেল্প প্রয়োজন।

৫) আলি তুই ঢাকা আসবি না?

৬) আমি তোর নাম্বার ভুলে গেছি। আমার আগের সিমটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই তুই হয়তো ফোন দিয়ে আমাকে পাবি না। আমার নতুন নাম্বার হল ০১৬৭২৫০৪৭৩৫ প্লিজ দোস্ত ফোন দে। কথা আছে।

৭)প্লিজ দোস্ত আমাকে বাঁচা। এই কুত্তার বাচ্চা আমাকে মেরে ফেলবে।

৮) প্লিজ দোস্ত আমাকে এখানে অরা আটকে রেখেছে।

৯) আলি তোর মত ছেলে দের সাথে বন্ধুত্ব না করে আমি কেন যে এর সাথে বন্ধুত্ব করলাম।

১০) ওরা আমাকে বলেছে আমাকে নাকি মেরে ফেলবে।

১১) মরার আগে আমাকে ওরা নাকি ব্যবহার করবে। তুই এদের ছাড়িস না। যদি আমাকে একটুও ভালবাসিস আমার এই সতিত্বের বিচার তুই করবি।

১২) আমি তোকে ভালবেসে ফেলে ছিলাম। ইচ্ছা ছিল তোর সাথে জিয়া উদ্যানে দেখা করে আমার মনের কথা বলব। কিন্তু সেই সময় আমি আর পেলাম নারে দোস্ত। তুই এর বিচার করিস।

এই ধরনের সব মেসেজ গুলো ছিল। আমি পড়ছিলাম আর কাঁদছিলাম। এভাবে সবগুলো পড়ার পর বুঝতে পারলাম যে মরার সময় আনিকা আমার কাছে খুব আকুতি জানিয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে রক্ষা করতে পারলাম না।

এসএমএস পড়া শেষ হলে আমার সাথে আনা আনিকার ডায়েরি টা নিয়ে পড়তে লাগলাম। যেখানে সব লিখা আছে যে আমাদের ওখানে যাবার পর কি কি করেছে। আমার প্রতি তার দুর্বলতার কথা গুলো লিখে গেছে। যেটা অবশ্য আসিফ আমাকে নিশ্চিত করেছিলো। শেষের দিকে আমাকে একটি চিঠি লিখেছিল। চিঠির ভাষা টা ছিল এমন,

আমার জানের দোস্ত, আলি রহমান,

আমার পক্ষ থেকে একরাশ পলাশ ফুলের সুগন্ধি উপহার থাকলো তোর জন্য। তুই বলেছিল, পলাশ তোর প্রিয় ফুল, এজন্য আমি তোকে পলাশের শুভেচ্ছা জানালাম। জানিস আজকাল তোকে খুব বেশি বেশি মিস করছি। মাঝে মাঝে মনে হয় তোকে তুমি বলে ডাকি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য তোর ফোন নাম্বার টাই আমি হারিয়ে ফেললাম। আমার মনের ছোট একটা ঘর যেখানে আমি একজনকে জায়গা দিয়েছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এতো তাড়াতাড়ি মন হারানো আমার উচিৎ হয়নি। তোকে কেন যেন নতুন করে ভালবাসতে ইচ্ছা করে।

আমার কথা বাদ দে। তোর খবর কি। তোর সাথে ও তোর পরিবারের সাথে কাটানো পাঁচটা দিন আমার সব থেকে সুন্দর সময় গেছে। এখন মনে হয় যেন তোর সাথে এভাবেই সারাজীবন কাটায়। একটা বিষয় আমি জানতে পারিনি যে তুই কাউকে ভালবাসিস কিনা? তোকে ভীষণ ভালবাসতে ইচ্ছে করে। আমার বয় ফ্রেন্ড টা আগে আমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করতো। এখন আমাকে ও ব্যবহার করতে চাচ্ছে। আমার নিজেকে আর পরিচয় দিতে ইচ্ছে করছেনা।

একটা কথা বলব, শাহবাগের এই নাটক কে আমি যখনি অস্বীকার করি। তখনি আমার উপর অত্যাচার শুরু করলো ও এবং ওর ছাত্রলীগের বন্ধুরা। আমি এইটা বলতে পারবো, যে মরার আগে আমি কোন ভুল নিয়ে মরিনি। তোকে দেখার আরেকবার ইচ্চা জেগেছিল কিন্তু আমাকে কোথায় আটকে রেখেছে আমি এইজায়গা চিনিনা। আমার ফোন কেড়ে নিয়েছে।

দোস্ত দয়া করি অনেক অনেক ভালো থাক। মৃত্যুকে সামনে নিয়ে এখন বুঝতে পারছি। আল্লাহ ছাড়া কোন ভরসা নাই। তাই আল্লাহর দরবারে আমি নিজেকে সমারপন করছি। আমার মত কোন মেয়ে যেন তাদের বয় ফ্রেন্ডের কথা রাখতে এইসব আন্দোলনে না আসে।

ভালো থাকিস দোস্ত।

ইতি

আনিকা



চিঠিটা পড়ার পর আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যে কোন মুল্যে আমি আনিকা হত্যার কুল কিনার বের করবো। আমি প্রথমে এই সব ডকুমেন্ট সহ উপস্থিত হলাম মোহাম্মদপুর থানা তে। থানার দারোগা ছিলান, আশফাক হামিদ মণ্ডল। উনি আমাকে হতাশ করে দিয়ে বললেন। পাগল হয়েছেন আপনি, এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে যদি শোনে ছাত্রলীগের নামের ধর্ষণের এবং হত্যার মামলা করা হয়েছে তবে আপনার জবন তো যাবেই সেসাথেই আমার চাকরিও যাবে।

আমি বললাম, তাই বলে আপনি মামলা নিবেন না?

উনি বলল, এইসব আলামত প্রমান করতে পারবে না। তাছাড়া কে খুন করেছে সেটা তো পরিস্কার না।

আমি বললাম, কে খুন করেছে সেতাই তো বের করতে হবে। এইজন্যই তো আপনাদের কাছে আসা। কিন্তু উনি আমাকে আবারো হতাশ করে দিয়ে ফিরিয়ে দিলো। আমি অনেক গুলো থানাতে ঘুরলাম কিন্তু কোথাও মামলা নিলো না। শেষে গেলাম বনানী থানাতে। ওখানেও সেই একই অবস্থা।

এবার আমি কিছুটা রেগে গিয়ে বললাম, আপনার নিজে থেকে দেশের বড় বড় নেতাদের নামে মামলা করেন, আর এই মামলা টা আপনার করতে পারবেন না। যেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে ধর্ষিত এবং খুন হয়েছে। অথচ কিছুদিন আগে দেখলাম, গাড়ি পুড়ানোর ঘটনা তে পুলিশ নিজে বাদি হয়ে মামালা করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগিরের নামে আর একজন ছাত্রলীগের কর্মীর নামে মামলা করতে পারবেন না? হায়রে দেশ। আমাদের শেষ ভরসা হচ্ছেন আপনারা আর আপ্নারাই বলছেন মামলা নিতে পারবেন না।

আমি চলে আসতে যাচ্ছিলাম, একজন বয়স্ক সিপাহি আমাকে দাড় করিয়ে বলল, বাবা তুমি এক কাজ কর আমার বিশ্বাস তুমি তোমার সমস্যার সমাধানে পৌছাতে পারবে। বলে একটা নাম্বার লিখতে বলল। নাম্বার লেখা শেষে বলল, বাবা এইটা একটা এনজিও এর নাম্বার। উনারা নিজ দায়িত্বে এই ধরনের সমসায়র সমাধান করে থাকেন। উনারা কোন দল দেখেন না।

আমি ওই চাচা কে ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসলাম। বাসায় ফিরে ফোন দিলাম ওই নাম্বারে। একটা মেয়ে ফোন রিসিভ করে জানতে চাইলো আমার উদ্দেশ্য। উনি সব শোনার পর বলল, ঠিক আছে আপনি আমাদের অফিসে চলে আসুন।

আমি জানতে চাইলাম অফিস টা কোন জায়গায়। উনি জানালো কেরানি গঞ্জ। আমি অবাক হয়ে একটু টেনেই বললাম, কি বললেন, কেরানি গঞ্জ, অতদুরে। আমি তো অতদুরে গিয়ে সময় দিতে পারবো না।

এবার উনি বলল, আচ্ছা বলেন, আপনি কোথায় থাকেন, আমি নিজে যাবো সেখানে।

আমি আবারো অবাক হয়ে বললাম, এখানে আসবেন মানে। আমিতো একটা ফ্যামিলি বাসাতে থাকি এখানে মেয়ে মানুষ এলাও করে না।

উনি এবার বলল, আপনার সমস্যা টা জটিল। ঠিক আছে আপনি জিয়া উদ্যানে চলে আসেন। বসে কথা বলা যাবে। এবং প্লান করা যাবে।

আমি উনার দেওয়া টাইম মত জিয়া উদ্যানে গিয়া দেখি সুন্দর চেহারা সম্পূর্ণ একটা মেয়ে। বয়স টা ৩৫-৩৭ হবে আর কি। কিন্তু দেখলে অত বয়সী মনে হয় না। শাড়ি পড়া ছিল। আমার চিনতে সমস্যা হল না। উনি আমাকে নিয়ে একটা নির্জন জায়গাতে বসলো। তারপর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জানলো।

আমি উনাকে বললাম, আমি আপনাকে কাজে সবরকম সহযোগিতা করবো। উনি বলল, আপনাকে তো থাকতেই হবে। না থাকলে তো বিরাট সমস্যা। তাছাড়া আপনি একজন ব্লগার। আপনি লকাশন বের করতে পারবেন। কি পারবেন না?

আমি বললাম, হ্যা সেটা করতে পারবো।

উনার নাম ছিল উজালা সেন। উনি বললেন, সমস্য নেই না পারলেও আমি আপনাকে সাহায্য করবো। আপনাকে একটু আমার সাথে সময় দিতে হবে। আমার মনে তখন কিছুটা প্রশান্তি আসলো।

দুইদিন পরে উনি আমাকে আবার দেখা করতে বলল, এবার অফিসে যেতে বলল, অফিস টা কেরানি গঞ্জে হলেও মিরপুর পল্লবী তে উনাদের একটা শাখা ছিল। অখানেই আমাকে যেতে বলল। আমি সকাল সাড়ে দশটার দিকে অফিসে পৌঁছে দেখলাম অফিসে শুধু নারি কর্মচারী। আমাকে যেতেই সামনে থাকা সুন্দরি মেয়েটি বলল, আপনি কি আলি রহমান ভাই।

হ্যা, আমি আলি। আমাকে এখানে আসতে বলা হয়েছিলো।

উনি আমাকে উনাকে অনুস্মরণ করতে বললেন। সেই বিল্ডিং টা ১৪ তলা ছিল। লিফটে উঠে ১৪ তলাতে আমাকে নিয়ে গেলো। একটা সুন্দর ঝকঝকে অফিস দেখিয়ে দিয়ে বলল, এইটা উজালা সেনের অফিস। উনি ভিতরেই আছেন। আপনি যান।

উনি চলে যাওয়ার পর আমি অফিসটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম। সারা অফিস সুন্দর করে সাজানো। চারি দেওয়ালে বিভিন্ন পুরস্কার বিতরণী তে পাওয়া এই এনজিওর ছবি। গোটা কয়েক জায়গায় দেখলাম উজালা সেনও পুরস্কার গ্রহণ করছেন। আমি এসব গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম, কখন যে উনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমি সামান্যও বুঝতে পারিনি।

উনার কথাতে আমার মনভঙ্গ হল। কি ব্যাপার এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন?

হ্যা দেখছিলাম আর কি আপনাদের কাজের সুনাম। উনি কিছুটা গর্ব করে হাসলেন। আমাকে বললেন, আসেন ভিতরে আসেন। আপনার কেইস টা নিয়ে এখন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের সামনে কোন শক্ত প্রমাণ নেই। কিন্তু কিছু ইনফরম্যাশন আছে যা আমাদের খুনি পর্যন্ত নিয়ে যাবে। চিন্তা করেন না আমার সাথে পুলিশ প্রশাসন এর বিশেষ গ্রুপ এর ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের দুইজনার সাথে যোগাযোগ হয়েছে। যাদের কে আমি আগে থেকেই চিনি। আমার সব রকম কাজে তাদের সাহায্য সহযোগিতা পাই সবসময়। উনারা শুধু আমাকে খুনি পর্যন্ত পৌছাতে বলেছেন। এখন আসুন আনিকার শেষ মুহূর্তের মেসেজ গুলো থেকে আইপি বের করার চেষ্টা করি।

আপনি কি আইপি অ্যাড্রেস বের করতে পারেন? আমি আমার সব সাইবার স্পেশালিষ্ট দের দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা কেউ পারেনি। ওরা বলছে আইপি হিস্ট্রি নাকি মুছে ফেলা হয়েছে। এইজন্য বের করা সম্ভব না। আপনিও তো একজন সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ। আপনি একটু চেষ্টা করেন। আর আমি আনিকার বন্ধু বান্ধবিদের মাধ্যমে ওর বয় ফ্রেন্ড কে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।

আমি বললাম, এইটা তো অনেক সময় সাপেক্ষ্য ব্যাপার। একদিনে মনে হয় সম্ভব হবে না। আমাকে এক সপ্তাহ সময় দেন। আমি বের করার চেষ্টা করি।

উনি বললেন, ঠিক আছে আপনি এক সপ্তাহের মধ্যে বের করেন। ঠিকানা জানার পর আমাকে জানাবেন। এই বলে একটা কার্ডে ঠিকানা লিখে বলল, এইটা আমার বাসার ঠিকানা।

তারপরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুত ঘটতে লাগলো। আমি আইপি অ্যাড্রেস থেকে ঠিকানা বের করলাম, ৫৬/৩ বেলি রোড, ডি ব্লক, হাউজ নং ২৫৬, মালিবাগ, ঢাকা। উজালা ম্যাডাম কে ডাকতেই চলে আসলো। দুইজন একসাথে রিক্সা করে ওখানে গেলাম। বাসাটা অনেক সুন্দর। দারোয়ান কে বললাম, কিন্তু উনি আমাদের ঢুকতে দিতে চাইলেন না। পরে উজালা সেন র্যাএবের এক অফিসার কে ফোন করে আসতে বলল। উনার নাম ছিল তপন মজুমদার। সিনিয়র ডিটেকটিভ অফিসার। কারদ দেখানর পর আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিলো। বিল্ডিং টা ৯তলা ছিল। আমরা তিনজনা ছাদে উঠে আইপি ঠিক কিনা জানার জন্য আবার ইন্টারনেট চেকিং করলাম। হ্যা খাপে খাপে মিলে গেছে।

বাড়িওয়ালার কাছ থেকে সব ভাড়াটিয়াদের নাম ঠিকানা বয়স কি করে জানলাম। কবে উঠেছে সব জানলাম। একটা ফ্যামিলি ছিল রিসেন্টলি শিফট করেছে। তাদের সদস্য সংখায় ছিল চারজন। বাবা-মা এবং এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা নাকি ইডেন মহিলা কলেজে পড়ে, ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার সন্দেহ টা এই ফ্যামিলির ওপরে ছিল।

এইজন্য দারওয়ান কে ডেকে বললাম, আচ্ছা মামা এই ৬তলার বি তে যে একটা ফ্যামিলি ছিল। আপনি কি তাদের চিনতেন। মানে কখনো কি কথা হয়েছে?

দারোয়ান মামা বলল, এই ফ্যামিলি এই বাসাতে তেমন একটা থাকতো না। ওদের মেয়েটি ইডেন কলেজের হোস্টেলে থাকতো। আর ফ্যামিলি বনানীতে চলে গেলে এই ছেলেতি একাই থাকতো। তবে মাঝে মাঝে আসতো আবার মাঝে মাঝে চলে যেতো। কয়েক দিন পর পর আসতো।

আপনি কি তার নাম জানতেন? আমি প্রশ্ন করলাম।

দারোয়ান মামা কে এবার অফিসার তপন দা বলল, একটু মনে করে দেখুন তো কখনো কেউ তাকে নাম ধরে দেকেছিল কিনা।

উনি এবার বলল, মাস দেড়েক আগে উনি আর উনার কয়েকটা বন্ধু এসেছিলো। আমাকে কি যেন আনতে পাঠিয়েছিল। তবে আমার মনে একটা খকটা লেগেছিল, এই মামা তো আমারে কখনো কোথাও পাঠায় না। আজকে কি ব্যাপার? পড়ে দেখেছিলাম, একটা মেয়েকে ওরা সাথে এনেছিল। আমাকে বলেছিল ওদের সাথে নাকি পড়ে। তো আমি আর কিছু মনে করিনি।

আমি বললাম, তাহলে আমার ধারনায় ঠিক। আমি বললাম, ওরা এখন কোথায় জানেন কিছু?

উনি বলল, না মামা আমি এইসব বিষয়ে আর জানিনা।

এবার আমিতো খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। এবার উজালা সেন বলল, আমাদের হাতে এখনও সুযোগ আছে।

আমি বললাম, কি সুযোগ?

উনি বলল, ওর বোনটা তো নাকি ইডেন মহিলা কলেজে পড়ে ওই আমাদের নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, কিন্তু ওই মেয়ের নাম তো আমরা জানিনা।

উজালা বলল, চলুন আমরা ৬তলার পাশের ফ্ল্যাটে কারো কাছে জিজ্ঞাসা করি এই ব্যপারে।

আমি কিছু না বলে রাজি হলাম এবং তপন সার চলে গেলো। বলল কোন ইনফরম্যাশন পেলে তবে যেন জানায় উনাকে। পাশের ফ্ল্যাটে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, হ্যা মেয়েটি নার ফারহানা নাজমিন।

পরেরদিন উজালা একাই গেলো ইডেন কলেজে ফারহানা কে খুঁজে বের করার জন্য। অনেক কষ্টে খুঁজে পেলো তাকে তবে ইনফরম্যাশন কিছু দিতে পারেনি। সেইদিন উজালা আমাকে ফোন করে বলেছিল।

তবে উজালা ফারহানার পিছু ছারেনি। ফারহানা কে ফলো করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ফারদিনের কাছে পোঁছায় উজালা। তবে তারপরের দিন থেকে আমি আর কোন খোঁজ পাইনি উজালার। ফোন বন্ধ। তপন দার কাছে ফোন দিয়েও লাভ হল না। এবার আমি আরও চিন্তিত হলাম। উনার অফিসে খোঁজ নিলাম। তারা বলল, আজ তিন দিন থেকে নাকি যোগাযোগ নাই। বাসাতে খোঁজ নেওয়া হয়েছিলো সেখানেও নাকি নাই।

আরও দুইদিন পরে উজালার সন্ধান মেলে এভাবে, আমি সন্ধ্যার দিকে বসে কফি পান করতেছিলাম, আর সংবাদ দেখছিলাম। হটাত একটা খবরে আমি আঁতকে উঠি। দেখায় যে সাভার আশুলিয়াতে একটা মেয়ে কে গন ধর্ষণের পর হত্যা করে রেখে গেছে দুর্বৃত্তরা। আমার মনটা কেন যেন একটু সাড়া দিয়ে উঠে এই খবরটায়।

আমি তখনি ছুটে যায় সাভার থানাতে। সেখান থেকে একজন আমাকে মরগে নিয়ে যায়। দেখি হ্যা উজালার নিথর দেহ টা পরে আছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঁচড়ের দাগ। আমি বলি হ্যাঁ ইনি আমার পরিচিত আমার আপন কেউ। এই বলে লাশ আমি নিয়ে আসি। উজালার সম্পর্কে তখনও আমি তেমন কিছু একটা জানিনা। ওর অফিস থেকে একজনার কাছে জানলাম, বছর চারেক আগে ওর হাজব্যান্ডের সাথে ডিভোর্স হয়ে যায়। ওর স্বামি মুসলমান ছিল। ওরা ভালবাসা করে বিয়ে করেছিলো। উজালার পরিবার উজালা কে ত্যাজ্য করে। শুনেছিলাম উজালার বাবার বাড়ি ময়মনসিংহ। তবে আর বেশি কিছু জানিনা। তবে জানি উজালার দুইটা ছেলে-মেয়ে আছে যেগুলো উনার কাছেই থাকে।

আমি সবকিছু জানার পর আরও বড় একটা আঘাত অনুভব করলাম, কেন জানিনা। তবে দুইদিনের পরিচয়ে এমন টি হওয়া আমার নিজের কাছে নিজেকে হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন করলো। এবার আমার মানিব্যাগ থেকে উজালার দেওয়া বাসার ঠিকানাটা দেখে বাসাতে গেলাম।

কলিং বেল চাপতেই দুইজনা দৌড়ে আসলো। তখনও তারা জানে না যে তাদের মা মারা গেছে। দরজা খুলে আমাকে দেখে তারা মনে হয় খুশি হয়নি, তারা আশা করেছিলো তাদের মা ফিরে এসেছে। ওরা বলল, আংকেল মাম্মি তো এখনও আসেনি।

আমি কোন কিছু বলতে পারছিলাম না। শুধু বললাম, তোমাদের মায়ের নাম কি উজালা সেন?

মেয়েটা ছোট ছিল, হ্যাঁ উনিই আমাদের মাম্মি কিন্তু মাম্মি এখনও আসেনি কেন। আজকেও আসবেনা?

আমার চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি বের হয়ে গেলো। আমি বললাম, চল আমি তোমাদের তোমার মাম্মির কাছে নিয়ে যেতে এসেছি। ছেলেটা বড় ছিল। ছেলেটার বয়স ৯ এবং মেয়েটির বয়স ৬ বছর। দুইজনায় খুব সুন্দর। হয়তো এর বাবা তাও খুব ফর্সা ছিল। যাইহউক অনেক ভাবে বুঝিয়ে তাদের নিয়ে আসলাম হাস্পাতালে। মনে চাচ্ছিল না যে বাচ্ছা দুটিকে তার মায়ের লাশ দেখায়। কিন্তু এতো বড় সত্য গোপন করে তাদের কে বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না। তাই বলে দিলাম।

ছেলেটার নাম ছিল রোহান এবং মেয়েটির নাম প্রিথা। ছেলেটি অনেক বুঝমান। সে বুঝতে পারছিল তার মা মারা গেছে। কিন্তু মেয়েটি বুঝতে পারেনি। এইজন্য প্রিথা বারবার বলছিল, ও মাম্মি ওঠো। এখানে এভাবে ঘুমিয়ে আছো কেন। বাসায় চল। এইধরনের অনেক কথা বলছিল যেগুলো শুনে আমার নিজের খুব কষ্ট হচ্ছিলো।

উজালার শেষ কৃত্ত হয়ে গেলে আমি চলে আসছিলাম। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে বাচ্চা গুলর কাছে টেনে নিয়ে গেলো। তপন ভাইকে বলে রোহান এবং প্রিথার দায়িত্ব নিলাম আমি। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ উপস্থিত হল আমার কাজের জন্য আজ উজালা কে জীবন দিতে হল। দেশের অবস্থা কবে যে উন্নতি হবে এই আশায় প্রতিক্ষিত রইলাম। কিন্তু একটা ভাললাগা আমাকে আচ্ছন্ন করলো যে কিছুদিন আগে আমি এদের কাছে অপরিচিত থাক্লেও আজ আমি এদের আবদার পূরণে আগেই পরিচিত মুখ। আমি ছাড়া তাদের কেউ হয়তো আছে কিন্তু সমাজ ব্যবস্থা এই কলুষিত রাজনীতি থেকে মুক্তি না পেলে এবাভেই কাতাতে হবে সবাই কে তার মুল্যবান জীবন। এখনও আকাশের তারাতে, আমাবস্যার অন্ধকারে, পূর্ণিমার ভরা আলোতে, খুজি আনিকা কে। যার ভালবাসা আমাকে এখনও আচ্ছন্ন রাখে। আমরণ হয়তো এভাবেই চলবে। রাত গভির থেকে গভির হয়। রাত জাগা পাখি গুলো তাদের দাকন্ন আওয়াজ গুলো বন্ধ করে দেই। তখনও আমি জেগে থাকি। বেল্কনির পাশে দোলন চেয়ার দুলতে থাকে। ঢুলু ঢুলু চোখে যখন ঘুমের সাগরে আমি পারি দেই সেই মুহূর্তেই আনিকার ছবিটি আমার চোখে ভেসে আসে।

আকুতি ভরা কণ্ঠে বলে, আলি আমি যদি তমাকে ভালবাসতে পারতাম তবে তোমার কাছে একটা অনুরোধ করতাম। আমার জবান থেকে বের হয় বল আনিকা কি অনুরধ করবে।

তারসাথে শেষ কথকপন হওয়ার আগেই প্রিথা আমার বৃদ্ধা আংগুলি টি ধরে টানতে থাকে আর বলে, আংকেল আংকেল দেখত আমার চোখে কিযেন পড়েছে।

মুহূর্তেই আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, প্রিথার দিকে তাকালে প্রশান্তি পাওয়া যায়। নিষ্পাপ বাচ্চারা। কাল ওর মা মারা গেলো, কিন্তু সেই ভাবে মনে নেই। আবার যখন পড়ছে মনে। দুরবার কান্না এসে ভোর করছে প্রিথাকে। যা আমাকে কাঁদাতেও বাধ্য করছে।

এই বাচ্চা মেয়েটি আমার অবলম্বন হয়ে আছে মনে হচ্ছে। সামাজিক একটা বাধা আমাকে নিবৃত্ত করছে তাকে আমার মেয়ে হিসাবে নিতে। কিন্তু সকাল বেলা আজকে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে না আজ থেকে এরা আমার সব। কোন বাধা আমাকে আর নিবৃত্ত করতে পারবে না!









মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.