![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সেই দুপুর থেকে আজও আমি আয়নায় নিজেকে দেখি না।
গুলশান একে থাকে অলি। তার বাসায় রাতটা কাটিয়ে থেকে ফিরছিলাম সেদিন,দুপুর তখন,শরতের মেঘময় মধ্যদুপুর।
একটু পরপরই আকাশের মেঘের আল্পনা বদলে যাচ্ছিল,যেন কেউ নীল ক্যানভাসে সাদা রংয়ে একটার পর একটা ছবি আঁকছে। একটাও মনমতো হচ্ছে না বলে,পুরোনোটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে,আবার আঁকতে বসে মেলে ধরছে সুবিশাল নীল ক্যানভাস।
আমি বাসের দোতালায়,জানালার পাশে বসে। বাসে উঠলে মন-মেজাজের পরিবর্তন অবশ্যই হবে। কেউ বিরক্ত হয়,কেউ রাগে! আমার বিষন্ন লাগে।
বাসটাকে মনে হয় আনাড়ি হাতে বানানো বেহুলার লোহার বাসর ঘর। যার মধ্যে অগনিত ফুটো। হাট-খোলা দরজা। এমনকি সকলকেই এই বাসর ঘরে ঢোকার সুতীব্র আহ্বানও চলছে। এ বাসর জলজ্যান্ত-চলমান!
লখীন্দের জীবন সত্যিই বড় বিপন্ন!
বাসে বসে আমি ভাবি। নানান হাবিজাবি। যখন যা চোখে পড়ে,তা নিয়েই। হয়তো কখনো যাত্রীদের সাথে ২ টাকা ভাড়া কম-বেশি নিয়ে তর্কযুদ্ধে-লিপ্ত বাস-হেল্পারকে নিয়েই। ভাবি, খুব গভীরে গিয়ে,চোখ বন্ধঃ সেও মানুষ। তারও কিছু গ্রহ-উপগ্রহ আছে। যাদের সাথে সে মিষ্টি গলায় কথা বলে। ২ টাকার জন্য তিক্ত স্বরের আবির্ভাব ঘটে না তখন। সেও কারো ভাই,কারো ছেলে,হয়তো কারো স্বামী,কিংবা কারো হৃদয়চোর। তার দিকে তাকিয়ে হয়তো কেউ শান্তি খোঁজে।
তারও আলাদা জীবন দর্শন থাকতেই পারে। থাকবেই। সেটা কেমন? তার গোটা জীবনচিত্রটা কেমন? এসব নিয়ে ভাবি।
কখনোবা নির্বাচিত হয় পাশে বসা কোন আনমনা সহযাত্রী। এসব সময়ক্ষেপনের উদ্দেশ্যে তো বটেই,তবে এতে জীবন-বিতৃষ্ণাও কাটে।
কল্পনা তো হাতের পুতুল-যেদিকে সে গেলে সুখ (না হোক অন্তত কিছুটা আত্মতৃপ্তি) কল্পনার পিছু নেয়-পুতুল সেদিকে চালানোই কি স্বভাবিক নয়? তাই এসব ভেবে-টেবে একসময় এই সিদ্ধান্তেই (কখনো সঠিকপথে,কখনো অলীকপথে) আসি যেঃ সংসারে আমার চেয়েও অভাগাও আছে!
মধ্যদুপুরের কড়া রোদ চারিদিকের রং বদলে দিচ্ছিল। জীবনের তাড়া খাওয়া ব্যস্ত নাগরিকদের মধ্যে আরো গতি আরোপ করছে এই ভীষন রোদ।
আমি বাসের দোতালায়,জানালার পাশেই বসে। যাত্রী গুটিকয়েক। রাস্তাও এক কথায় ফাঁকা বলা চলে। মঙ্গলবার ছিল যে সেদিন।
জানালায় বসে একটার পর একটা দৃশ্যপট জরিপ করছিলাম। আমি কোন কিছুই ঝাপসাভাবে দেখতে পারিনা।
সর্বনাশটা কোন এক লেখকের হাত ধরে হয়েছিল। তিনি তার এক আত্মজীবনীতে এমন সুন্দর করে তার পর্যবেক্ষন ক্ষমতার কিছু কেচ্ছা বলেছিলেন,যে আমি লোভে পড়ে গিয়েছিলাম! কৈশোরের শেষ সিঁড়িতে তখন আমি। লোভ গড়ালো অভ্যেসে। যাই দেখি খুব গভীরভাবে দেখি,বুঝতে চাই প্রাণপনে। খুটিনাটি খুব খেয়াল করার চেষ্টা করি।
একসময়ে এটা আয়ত্তে চলে এলো,এখন অবচেতনেই এর কাজ চলে। কোন দৃশ্যপট চোখের সামনে এলে তার গূঢ় অর্থ বুঝতে খুব বিলম্ব হয় না। খুটিনাটি কখনো চোখ এড়ায় না। মানুষের মুখাবয়ব সবচে মজার জিনিস! সেটা দেখার মতো দেখতে পারলে মনের দরজা দিয়ে সোজা অন্দরে ঢুকে যাওয়া যায়! সে ব্যাপারেও যে আমি সিদ্ধহস্ত- অতটা বললে অবশ্য বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।
মানুষের চেয়ে বিচিত্র কিছু কি বিধাতা বানিয়েছেন কখনো? যে তার সব বুঝে যাবো এই নগন্য আমি?
গাড়ি চলছিলো,জানালার পাশে আমি। দৃষ্টি বাইরে,মন অন্য কোথাও।
তিতুমীর কলেজের কাছে একটা ওভারব্রীজ আছে,সেখানো বাস থামলো যাত্রী উঠানো নামনোর জন্য। ছাড়বে হয়তো এক্ষুনি আবার। মানুষজন নেই খুব একটা রাস্তায়।
হঠাৎ আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম একটা দৃশ্য দেখে। দুপুরটাও ছিল স্তব্ধ দুপুর। মন খারাপ করা কেমন যেন!
ওই দৃশ্য দেখে জীবনের কোলাহল কেমন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।
আমার বাসের জানালা হতে হাত পাঁচেক দূরে,ওভারব্রীজটার সিঁড়ির মাঝখানে একটা মেয়ে বসে আছে। একা। কেউ ছিলোনা আশেপাশে। কিংবা থাকলেও চোখে পড়েনি তখন। মেয়েটা বসে ছিলো কি ভঙ্গিতে জানেন? দুহাঁটুতে মুখ গুঁজে,দু’হাতে মুখ দুদিক থেকে ঢেকে। তার শরীরি-ভাষার প্রতিটা রেখাই বলে দিচ্ছিলো মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। তার সমস্ত ভঙ্গিমায় এমন কিছু ছিল একটা যা আমার স্বত্ত্বার অন্তমূলে জোঁকের মতো বসে গেলো!
কেন সে বারবার গুমরে গুমরে কেঁদে উঠছে? আমার ভিতরে কি একটা হয়ে গেলো!
এক পলক দেখে যা বুঝলাম,মেয়েটা আমারই সমবয়সী,পড়নে সুন্দর সাদায় লাল-ফুলওয়ালা জামা। কাঁধ থেকে ঝুলন্ত খয়েরী ব্যাগ, যার এক কোণে উঁকি দিচ্ছিল গোলাপী রংয়ের ছাতা। বেশ সচ্ছল বেশবাশ।
আমি বাসের দোতালায়,জানালার পাশে বসে। সে আমার থেকে বড়জোর পাঁচহাত দূরে। বাস কি এখানে থেমে থাকবে আজীবন?
না,সে তার রাস্তায় চলবেই। আমি কি নেমে পড়ে তার কাছে যাবো না? আমার মনটা খন্ডিত হয়ে গেল। চোখ দুটো যেন কেউ আলপিন দিয়ে গেঁথে দিয়েছে দৃশ্যটার উপর। মনের এক পাশ বলছো,যাও যাও; অন্যপাশ সংকোচ বসে মুখ ফেরাতে বলেই চলেছে।
মনের ভিতের কোথাও কোন ফাঁটলে খুঁজে কোত্থেকে যেন বেরিয়ে এলো একনদী-মায়া। মন শুধু দ্রবীভূতই নয়,সে জলে ভেসেই গেল। প্রচন্ডরকমের ইচ্ছে হলো বাস থেকে নেমে পড়ি,দৌড়ে যাই তার কাছে এক্ষুনি। কাঁধে হাতটা আলতো ছুঁইয়ে বলি,কি কষ্ট তোমার? আমাকে বলবে?
প্রচন্ড ইচ্ছে হলো। প্রচন্ড! এবং একইসাথে চলে এলো সংকোচ!
আমার চিরসঙ্গী। উঠতে চাচ্ছিলাম প্রানপনে,কিন্তু কেউ যেন শরীরের সব পেশী আমার জমিয়ে দিয়েছে। বাস ছেড়ে দিল,ধীরে ধীরে গতি বাড়তে লাগলো! আমি এক চুল নড়তে যদি পাড়তাম!!
জানালায় আমার অত্যুৎসুক মুখ,মেয়েটা বাসের হর্ন শুনে একবার মুখ তুলল!
এক পলক শুধু দেখলাম তাকে। জীবনে হয়তো আর কোনদিন দেখা হবেনা আমাদের আবার। কিন্তু আমি কি করে ভুলবো ওই অসম্ভব স্নিগ্ধ মুশ্রী!!
গাল চোখের জলে ভেজা,ঈষৎ রক্তিম। ঢেউ-ঢেউ রেশমী চুল কাঁধে আর ঘাড়ে যেন হালকা বাতাসে কম্পমান। রোদ লেগে চোখের জল চিকচিক করছে! সারা মুখে মাখা বিষাদ। এক মুহুর্তেই সে দৃশ্যপট থেকে মুছে গেল ঠিকি,কিন্তু চকলেট শেষ হলে যেমন তার মিষ্টি ভাব জিহ্বায় লেগে থাকে অনেকক্ষন, তেমনি তার মিষ্টি চেহারার সুবাস তার অন্তরের বিষাদকেও ছাপিয়েও আমার মনে খুব ঘুরতে লাগলো!
কিন্তু এ আমি কি করলাম? আমি কি পারতাম না,বাস থেকে নেমে গিয়ে তার পাশে একটু দাঁড়াতে?! কেন নামলাম না? কেন নয়? কেন? প্রশ্নটা কাল-নাগের মতো সুতীব্র দংশন করতে লাগলো বুকে বারবার।
এই পৃথিবীতে কি ঘুরে ঘুরে আবার কখনো সামনে পড়বো তার?
সে সম্ভাবনা কি আছে? সংকোচ?
লজ্জা?? কিসের? কার কাছে??
বাসটা এখনো খুব বেশি দূরে চলে আসেনি।এখনো সময় আছে। নেমে কি দৌড়ে চলে যাবো???
খুব ইচ্ছে হলো,খুব! কিন্তু এক চুল নড়তে পাড়লাম নাহ!
সংকোচ??
বাসের গতি বাড়ছিল। জমাট পাথরের মতো বসে ছিলাম। আমার তখন কি চলছিল,কেবল অনুমানযোগ্য,বাস্তবে কেউ কূল পেতো না।
অনেকটা দূরে চলে এসেছিলাম,ফিরে যাওয়া অর্থহীন। কিন্ত তবু আচমকা প্রায় চলন্ত বাস থেকে ঠিকই নেমে পড়লাম।
একটা ওভারব্রীজের সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম,সিঁড়ির মাঝখানে,একই ভঙ্গী।
খুব কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু তা গলার কাছে হৃৎপিন্ডটার সাথে দলা পাকিয়ে আটকে আছে। অর্থাৎ কান্নাও আসছে না। কিন্তু বুকটা মোঁচড় দিচ্ছে খুব। বন্ধ চোখের পর্দায় বারবার সেই দৃশ্যটা বেজে উঠছিল।
মুখ তুললাম। ওভারব্রীজের পাশেই দোতালায় একটা সেলুন,যার খোলা দরজা দিয়ে একটা বিশাল আয়না দেখা যাচ্ছে।
সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম,আয়নায় দেখা যাচ্ছে এক পূর্নাঙ্গ কাপুরুষের প্রতিবিম্ব।
©somewhere in net ltd.