নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষ বাঁচে আশায়, শূন্যে বাঁধি আশা।

আমার ব্লগ http://dokhinabatas.blogspot.com/

দক্ষিনা বাতাস

আর পড়া নয়, এখন শুধুই ঘোরা। কয়েকদিন শুধু ঘুরব আর ঘুরব।দূর পাহাড়ে যাব, চাকমাদের ব্যাং ভাজা খাওয়া দেখব, মগ মেয়ের ঝরণা থেকে কলস ভরে পানি নেওয়া দেখব। সাগরে যাব, ডলফিনের সাথে সাঁতার কাটব, সুটকি ভরতা আর রূপচাঁদা ফ্রাই দিয়ে ভাত খেয়ে রৌদ্রে গা ড্রাই করে নেব। ভরা নদীতে মাঝিদের সাথে নৌকায় শুয়ে কাঁটাব রুপালী রাত্রি।

দক্ষিনা বাতাস › বিস্তারিত পোস্টঃ

সিলেটের পথে পথে

২২ শে মে, ২০১৪ দুপুর ২:১৭

দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ সিলেট, ছোট বেলা সম্পর্কে সিলেট সম্পর্কে এই উপমাটিই সব থেকে বেশী শুনে এসেছি। সবুজ শ্যামল সেই সিলেট এখন আমার সামনে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে বলছি কারণ আমাদের ট্যুরের বাস যখন সিলেটে পৌঁছায় ঘড়িতে তখন সকাল সাতটার মত বাজে। ডিসেম্বরের শীতের সকাল কুয়াশার চাঁদর ম্যুড়ি দিয়ে আছে। ঢাকা থেকে আমরা গতকাল রাত দশটায় যাত্রা শুরু করেছি। এসি বাসে কম্বল সরবরাহ করায় ঘুমের তেমন ব্যাঘাত হয় নাই। মাঝখানে ব্রাম্মণবাড়িয়ায় একটি হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে যাত্রা বিরতি দিয়েছিলাম। মধ্যরাতে ঘন কুয়াশার মাঝে দাঁড়িয়ে গরম কফিতে চুমুক দিতে মন্দ লাগেনি। দূর আকাশে কুয়াশার ভিড়ে রুপোর থালার মত চকচকে গোলগাল চাঁদখানা ডিম লাইটের মত মৃদু আলো ছড়াচ্ছে।



সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সিলেট বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত। সিলেটের প্রাচীন নাম শ্রীহট্ট। কথিত আছে শিবের স্ত্রী সতি দেবীর খন্ডিত দেহের মধ্যে এক খানা হাত এই অঞ্চলে পড়ে। সেই শ্রী হস্ত কালক্রমে শ্রীহট্ট রূপ লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ঐতিহাসিক এরিয়ান কর্তৃক লিখিত বিবরনীতে ‘সিরিওট’ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিওয়েন সাং ভ্রমন বিবরণীতে এই অঞ্চলের নাম ‘শিলিচিতল’ বলে উল্লেখ করেন। ইখতিয়ার উদ্দিন বিন মুহাম্মদ বক্তিয়ার খিলজী বাংলা দখল করার পর এই অঞ্চলকে মুসলিম শাসকেরা শিলহট্ট নামে উল্লেখ করতেন। ধারণা করা হয় সেই শিলহট্টই আজকের সিলেট।



সিলেটের উপকন্ঠে শহর থেকে প্রায় ১১ কিমি দূরে খাদিম নগরে অবস্থিত যাকারিয়া সিটি রিসোর্টে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবুজ গাছগাছালি ঘেরা তিনটি টিলা নিয়ে চমৎকার রিসোর্ট। মূলগেট পেরিয়ে কিছুদূর এগোতেই ছোট একটা পুকুর। লাল শাপলায় পুরো পুকুর ছেয়ে আছে। পুকুরের পাড়ে হলুদ মাইক ফুলের কম্বিনেশনটা বেশ মানিয়েছে। টিলার উপর একটি দ্বিতল মোটেল। নাম মধুমালতি। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলো টিলার পাদদেশে অবস্থিত ক্যামেলিয়া নামের কটেজে। কটেজের ছাদে চৈনিক স্থাপত্যরীতি অনুসরন করা হয়েছে। ক্যামেলিয়া নামটি বরাবরই আমার কাছে রোমান্টিক লাগে। ক্যামেলিয়া যে একটি ফুলের নাম এটা প্রথম জানি রবী ঠাকুরের ক্যামেলিয়া কবিতা পড়ে।



ক্যামেলিয়ার রুম সার্ভিসের মান প্রশংসাযোগ্য। গরম পানির শাওয়ার ছেড়ে গোছল করে নিলাম। বাথরুম থেকে বেরুতেই শীত হামলে পড়লো। ডিসেম্বরের শীত কাবু করার ধান্দায় আছে। কম্বলের নিচে বসে শরীরে উত্তাপ আনার চেষ্টা করছি। ল্যাবের বিশ্বজিৎদা দরজায় নক করে জানিয়ে গেলেন নাস্তা করেই জাফলং এর উদ্দেশ্যে রওনা করতে হবে।



সিঁড়ি বেয়ে টিলার উপরের কটেজে উঠে গেলাম। চমৎকার একটি রেস্টুরেন্ট। এক সুদর্শনা তার সহকর্মীদের নিয়ে আমাদেরকে রেস্তোরায় অভ্যর্থনা জানালো। প্লেটে খাবার নিয়ে কোনার দিকে একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। সেগুন কাঠের ফ্রেমে বড় বড় কাচ লাগানো। সেই কাঁচের মধ্য দিয়ে টিলার ঢালে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি দেখতে দেখতে নাস্তাটা সেরে নিলাম। গাছের পাতায় সকালের রোদ ঝিলিক দিচ্ছে।



আবার বাস জার্নি। গন্তব্য জাফলং। প্রকৃতিকন্যা জাফলং যেখানে পাহাড় আর নদীর এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে। সিলেট শহর থেকে জাফলং শহরের দূরত্ব ৬২ কিমি। এবার পুরো পথে চোখ মেলে রইলাম পথের দিকে। দুচোখ ভরে দেখার চেষ্টা করছি সিলেটকে। ঘন্টা দুয়েক পরে দুপুরের দিকে আমরা জাফলং এর সীমানায় পৌঁছে গেলাম। দুরে কালো কালো পাড়ারশ্রেনী দাঁড়িয়ে আছে। পথের দুধারে রাশি রাশি পাথর জমা করে রাখা হয়েছে। মাঝখানে আমাদেরকে লালাখাল ব্রিজের গোড়ায় সাময়িক বিরতি দেয়া হয়েছিলো। মাঝারী একটা খাল। খালের বুকে স্বচ্ছ নীল জল। নদীর ওপারে একটা ঘাট। ধাপে ধাপে সিড়ি উঠে গেছে উপরে। পানির ভেতরে ছোট ছোট মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। জায়গায় জায়গায় লোকে টুকরি দিয়ে পাথর তুলছে খাল থেকে। ব্রিজের পিলারের গোঁড়া থেকেও পাথর তুলতে দেখলাম। প্রশাসনের এই ব্যাপারে নজর রাখা উচিত ছিলো। শুনেছি লালখালের নৈসর্গিক পরিবেশ অনেক বেশী মনোমুগ্ধকর। ট্রলারে করে ঘুরতে হবে। যারা ট্যুর ব্যবস্থপনায় ছিলেন তাদের অদক্ষতায় লালাখালের পাড়ে লাল বালুতে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুলেই ফিরতে হলো। মনের মধ্যে কিছু আফসোস কাজ করছে।



জাফলং বাজারে নেমে পুলকিত বোধ করলাম। মানুষের ভিড় ভাট্টা অনেক বেশী, আমাদের মত বেড়াতে আসা লোকের সংখ্যাই বেশী। গাছে গাছে প্রচুর বাদূড় ঝুলে আছে। খুব বেশী অবাক হইনি। কারণ ইতোমধ্যে আমি ইন্টারনেট ঘেটে জেনে নিয়েছি জাফলং রাজবাড়ি এবং বাজারে প্রচুর পরিমানে বাদূড় বাস করে। বাজারের গলি ধরে নদীর তীরে নেমে গেলাম।



শীতের দুপুরে রোদের উষ্ণতা বেশ আরামদায়ক। বাংলাদেশের সব পর্যটন স্পটে ছোট খাট মেলার মত বাজার থাকে। এখানেও আছে। দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে বাহারী সব পন্য দেখতে লাগলাম। সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীলবসনা স্বচ্ছ এক নদী। নদীর স্বচ্ছ পানিতে পা ডুবালাম। বরফ শীতল ঠান্ডা। সেই ঠান্ডা পানিতে নেমে পাথর শ্রমিকেরা পাথর তুলছে। নদীর বালুচরে লাল সাদা নানা রঙের নানা আকারের পাথর নদী থেকে তুলে জড়ো করে রাখা হয়েছে। জাফলং এলাকার মানুষের প্রধান পেশা পাথর উত্তোলন। পর্যটনস্পট হিসেবে এই অঞ্চল সুপরিচিত হলেও চোখে পড়ার মত তেমন কোন উন্নয়ন কাজ চোখে পড়লো না। বাংলাদেশের ঢাকা কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা দূর না হলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয়।



সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত। জাফলং জিরো পয়েন্টে তামাবিল স্থল বন্দর অবস্থিত। নদীর ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডাওকি অঞ্চল। কালো কালো ডাওকি পাহাড় আমার সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টিপাত ভারতে সীমান্তবর্তী শিলং মালভূমির পাহাড়গুলো থেকে প্রচুর পরিমানে গন্ডশিলা ডাওকি নদী দিয়ে ভাসিয়ে আনে। বর্ষাকালে দূরে ডাওকি পাহাড় থেকে ঝরে পড়া শ্বেত শুভ্র ঝরনা এবং খরশ্রোতা নদী এক মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি উপহার দেয়। কিন্তু শীতেও এই নদীর সৌন্দর্য্য কম উপভোগ্য নয়! সাপের মত একে বেঁকে বয়ে চলছে নদীটি।



নদীর নীল জল পেরিয়ে সাদা বালুর চর, চরের পরে সবুজ পাহাড় সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে। পাহাড়ের মাথায় ধোঁয়ার মত কুয়াশা জমে আছে। সবুজ পেয়িয়ে উপরে নীল আকাশ। নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভাসছে। এমন মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি মানুষকে কবি বানিয়ে দেবে অবলীলায়। এখানে ছোট ছোট ট্রলার ভাড়া পাওয়া যায়। প্রতিটা ট্রলারে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। কৈশোরে সদ্য পা দেওয়া বালকেরাই ট্রলারের মাঝি। ছোট ট্রলার, আমরা কয়েকজন উঠতেই তলিয়ে যায় এমন ভাব। তলিয়ে গেলে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। নদীর গভীরতা অল্প। পানির মধ্য দিয়ে স্থানীয় বাচ্চারা পর্যন্ত অবলীলায় হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছে। আমি তো দক্ষিণ বঙ্গের সন্তান। ভালোই সাঁতরাতে পারি। পাথর বহন করা ট্রাকগুলো নদীর পানিতেই নামিয়ে ধোয়াধুয়ি করছে হেলপারেরা। ট্রলারে করে আমরা বাংলাদেশের শেষ সীমান্তে পৌছে গেলাম। এখানে মানুষ আর মানুষ, গিজগিজ করছে। পায়ের নিচে এখন শুধুই পাথর।



বড়সড় একখানা পাথরের সামনে একখানা লাল রঙের টিনের সাইনবোর্ড লাগানো। সাদা কালিতে লেখা ‘সামনে ভারত, প্রবেশ নিষেধ।’ তৃতীয় লাইনে লেখা ‘আদেশপক্রমে B.G.B কর্তৃপক্ষ’। অল্প একটু পানি পেরোলেই বিশাল এক পাহাড় মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের সবুজ গাছের মাঝে বিশাল একখন্ড প্রস্তর বুক চিতিয়ে আছে। অনেকটা শার্টের বোতাম খুলে বুক দেখানোর মত। এই পাহাড় ভারতের অংশে পড়েছে। পাহাড়ের গায়ের রাস্তা দিয়ে গাড়ী চলতে দেখা যাচ্ছে। এত কাছে ভারত কিন্তু ইচ্ছে করলেই আমরা যেতে পারি না। আমাদের পূর্ববর্তী শাসকদের কারো কারো ব্যর্থতার ফসল এই দেশ বিভাগ। আমার খুব আফসোস লাগে সব পাহাড়গুলো কেন ভারতের ভাগে পড়েছে। সমগ্র বাংলা এবং আসাম ও ত্রিপুরা নিয়ে চমৎকার একটি দেশ হতে পারতো ‘বাংলাদেশ’। যা হয়নি তার জন্য এখন আফসোস করাই বৃথা। পাথরের উপর দিয়ে পায়চারী করছি। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের দুই দেশের দুই সীমান্তরক্ষী প্রায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ভারতের পাথরে পা দিলেই সেই ভারতীয় হাত উঁচিয়ে তেড়ে আসছে। আমি একবার তার চিৎকার উপেক্ষা করেই ভারত অংশে হেঁটে এলাম। বিএসএফের লোকটা কি বলতে বলতে ছুটে এলো। কি ভাষায় কথা বলে বুঝলাম না। তার ভাষা হিন্দী না। হিন্দী ম্যুভি দেখার কল্যাণে এখন অধিকাংশ হিন্দী কথা বুঝতে পারি। বিএসএফ সদস্যটি বিডিআর থুড়ি বিজিবি সদস্যটি হাতের ইশারায় কিছু বললো। বাংলাদেশী ছেলেটিও হাতের ইশারায় কিছু উত্তর দিলো। ব্যাপারটায় আমি মজা পেলাম। কেউ কারো ভাষা বোঝেনা কিন্তু ভাবের বিনিময় ঠিকই হচ্ছে। ছেলেটি আমার কাছে এসে বলল, কি দরকার ভাই এই এক হাত দূরের পাথরের উপর যাওয়ার। এদিক দিয়ে ঘোরেন’।



জানতে চাইলাম, ‘পাথরের উপর গেলে ওর কি সমস্যা? ভারতে চলে তো যাচ্ছি না।’



ছেলেটি উত্তর দিলো, ‘ওর কোন সমস্যা নেই। কিন্তু রুল ইজ রুল। ওই পাহাড়ের মাথায় ইন্ডিয়ানদের ক্যাম্প। ওখান থেকে দুরবিন দিয়ে সারাক্ষন এখানে নজর রাখা হয়। ওকে এখানে পোস্টিং দিয়েছে বাংলাদেশীদের প্রবেশ রোধ করার জন্য। ওর ডিউটি ও করছে। না হলে যে পানিশমেন্ট হবে’।



‘কিন্তু ওর পিছেই তো একদল মেয়ে বসে আছে’।



‘ওরা খাসিয়া। ওরাও ভারতীয়’।



‘কি বলেন! খাসিয়ারা বাংলাদেশী না। ওদেরকে তো এই পাশের পাহাড়টা থেকে নেমে আসতে দেখলাম’।



‘খাসিয়া বাংলাদেশেও আছে। তবে এরা ভারতীয়। এই পাহাড়টাও ভারতের। ঐ যে ব্রিজ দেখা যাচ্ছে’।



ডাউকি নদীর উপর সুদৃশ্য একটা ব্রিজ। দুই পাহাড়কে একত্রিত করেছে। তার মানে এই ব্রিজের তলা দিয়ে ডাউকি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীর স্বচ্ছ জলে খাসিয়া মেয়েরা স্নান করছে। পাথরের উপর কাপড় শুকোতে দিয়েছে। এক মহিলা ইয়া বড় এক গামলার মধ্যে কিছু ধুচ্ছে আপন মনে। চারপাশে এত মানুষ, তার দিকে চেয়ে আছে, ছবি তুলছে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। পরিস্থিতি মানুষকে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে বাধ্য করে। এই মেয়েটিও মানিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ মনে হলো এই মেয়েটির জায়গায় যদি আমি হতাম আর অপরিচিত কেউ যদি এভাবে এসে ছবি তুলত তবে কি আমি সেটা মানতে পারতাম? কখনোই পারতাম না। আমি ক্যামেরার ফোকাস সরিয়ে নিলাম।



হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়লাম নদীর শীতল জলে। বিশাল একখন্ড প্রস্তর আছে, সবাই সেটার উপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আমিও বাদ গেলাম না ছবি তোলাদের দল থেকে। আবার সেই ট্রলারে করে ফিরে এলাম জাফলং বাজারে। বাজার ঘুরে আব্বু এবং আম্মুর জন্য খাসিয়াদের তাঁতে তৈরী দুই খানা চাদর কিনলাম। ছোট ভাইয়ের জন্য কি কিনবো খুঁজে পেলাম না। বিকেল গড়িয়ে গেছে। সবাই ক্ষুধার্ত। আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্রীপুর পিকনিক স্পটে। বাস ছাড়লো।



উচু নিচু পথ বেঁয়ে আমরা পিকনিক স্পটের এক খোলামেলা উদ্যানে চলে এলাম। প্রকৃতি পরে দেখা যাবে আগে পেট পূজো সেরে নেই। চিকেন দিয়ে সাদা ভাত। খেতে মন্দ লাগলো না। এক গাছের নিচে ঘাসের উপর প্লেট হাতে বসে পড়লাম আমরা কয়েকজন। ফুরফুরে বাতাস বইছে। পিকনিক পিকনিক একটা ভাব চলে এলো। বাচ্চারা প্যাকেট হাতে ঘুরছে। কেউ খাবার খেতে না পারলে চেয়ে নিচ্ছে। পার্কের লোকগুলো বাচ্চাগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাড়া খেয়ে বাচ্চাগুলো দূরে চলে যাচ্ছে। কিছু পরে আবার ফিরে আসছে। মুখের দিকে বাচ্চারা এভাবে তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায়! আমি একটা বাচ্চাকে ডেকে তার পলিথিনে আমার প্লেটের খাবারগুলো ঢেলে দিলাম।



আরে দূরে ঐটা চা বাগান না! চা বাগানই তো। আমরা যারা প্রথম চা বাগান দেখছি তারা সবাই আগ্রহ নিয়ে চা বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছবিতে দেখা চা বাগানের মতই দেখতে, পুরো টিলার মাথা থেকে ঢাল পর্যন্ত বিস্তৃত, ছবির মতই সুন্দর কিন্তু শেষ বিকেলের আলোয় অতোটা সবুজ মনে হলো না।



দুইপাশে ইউক্যালিপটাসের বন, মাঝখানে লাল মাটির পথ। সেই পথ ধরে হেঁটে চলে এলাম বাসের কাছে। বাসে করে চলে গেলাম দূর থেকে দেখা সেই চাবাগানে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এতক্ষণে মনে হয় মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে। স্বল্প আলোয় চাবাগানে নেমে পাতা ছুয়ে যতগুলো সম্ভব ছবি তুলে নিলাম। মাঝা সমান উঁচু চা গাছের মাঝে দাঁড়িয়ে দূরে ঢেউ খেলানো সবুজ টিলাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।



যাকারিয়া সিটি রিসোর্টে ফিরে এলাম। গরম জলে গোছল সেরে রেস্তোরার গিয়ে রাতের খাবারটা সেরে ফেললাম। ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু এখনো অনেক প্রোগ্রাম বাকী। এর কোনটাই মিস করতে চাই না। রিসোর্টের অডিটোরিয়ামে আমাদের ট্যুর পার্টির জন্য কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। লাল গালিয়ায় মোড়া আচ্ছাদিত সুন্দর অডিটোরিয়াম। ব্যাপার স্যাপার একটু আয়েশী খরচটাও সেরকম। স্বাস্থ্যবতী সুকন্ঠী এক স্থানীয় ললনা বেশ কয়েকটি বাংলা গান শুনিয়ে গেলো। আরে সিলেটে এলে কি হাছন রাজার গান না শুনে থাকা যায়! ‘বাউলা কে বানাইলো রে হাছন রাজারে বাউলা...’।



কনসার্ট শেষ হলো। রাত বারোটার দিকে টিলার উপরে আয়োজন করা হলো বারবিকিও পার্টির। আলো নিভিয়ে ক্যাম্পফায়ার জ্বালানো হলো। গনগনে আগুনের শিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। মুরগী পোড়া খাওয়া শেষে র্যা ফেল ড্র’র আয়োজন করা হলো। এই সব ড্র ট্র আমার ভাগে কখনো পড়ে না। অধিকাংশ সময় দেখি আমার সামনের পিছনের নাম্বারের ভাগে পুরষ্কার জোটে। আর নাম্বার মিলিয়ে আমি হতাশ হই। এবার আর নার্ভের উপর চাপ দেবো না। চুপ করে বসে রইলাম। আমার পরের নম্বর একটা পুরষ্কার পেয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আমিও একটা পুরষ্কার পেলাম। পঞ্চম পুরষ্কার। ফুলদানী। সাথে প্লাস্টিকের ফুল। ভাগ্যটাই কি প্লাস্টিক হয়ে যাচ্ছে।



পরদিন বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠলাম। সবুজ প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়ালাম দুই বন্ধু। ছোট খাট একটা মিনি চিড়িয়াখানা আছে এখানে। চিত্রল এক হরিন মায়াবী চোখ মেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গাছ থেকে কিছু পাতা ছিড়ে বাড়িয়ে ধরলাম। হরিন চারটা এগিয়ে এসে খাওয়া শুরু করলো।



সারা সকালটা আজ নষ্ট হয়ে গেলো মিস ম্যানেজমেন্টের কারণে। সকাল আটটায় বেরোনোর কথা। ভাবীরা সেজে গুজে বাচ্চাদের গুছিয়ে বেরোতে বেলা এগারোটা বাজিয়ে দিলেন। স্থানীয় এক মাঠে সবাই মিলে ক্রিকেট খেলে দুপুরে রিসোর্টে ফিরে আসলাম। রিসোর্টের সুইমিং পুলে হাত পা ছুড়ে দাপাদাপি করে গোছল সারা হলো। সে এক মজার অভিজ্ঞতা।



সন্ধ্যায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাকারিয়া সিটি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। সিলেট এসেছি। হযরত শাহ জালালের মাজারে যাওয়া হবে না এ কেমন ট্যুর প্লান আমি বুঝতে পারলাম না। সন্ধ্যায় রাতের খাবারের জন্য হোটেল ভ্যালি গার্ডেনে বিরতি দেয়া হলো। হোটেলের খাবারের মান খুবই ভালো। এখানে বাস কিছুক্ষন অপেক্ষা করবে। আমার মত অনেকেই হযরত শাহজালালের মাজারে যেতে ইচ্ছুক। নিজেদের উদ্যোগে সিএনজি করে মাজারে চলে এলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে। অন্ধকার পরিবেশ। টিলার উপর মাজার। সিড়ি বেয়ে মাজারে ঢুকলাম। ঘুরে ঘুরে দেখছি। পেছনের অংশে নায়ক সালমান শাহ’র কবরও জিয়ারত করে এলাম।



হযরত শাহজালালের পুরো নাম শায়খ শাহজালাল কুনিয়াত মুজারবাদ। তিনি ৬২১ হিজরী সন ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে ইয়েমেনের কুনিয়া প্রদেশে জন্মগ্রহন করেন। জন্মসূত্রে তিনি মক্কার কুরাইশ বংশের বংশধর। শাহজালালের মাতা তার জন্মের তিন মাসের মাথায় এবং পিতা পাঁচ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। মামা আহমদ কবিরের কাছে তিনি প্রতিপালিত হন। মক্কা থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি একা যাত্রা শুরু করেন। তার শিক্ষাগুরু ও মামা শায়খ আহমদ কবির তাকে মক্কার মাটি দিয়ে বলেন যে স্থানের মাটির সাথে এই মাটির বর্ণ গন্ধে মিল খুঁজে পাবে সেখানে তুমি ইসলাম প্রচার করবে। ১৩০৩ সালে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে হযরত শাহজালার (রঃ) ৩২ বছর বয়সে বঙ্গে আসেন। পথিমধ্যে ভারতে নিজামুদ্দিন আওলিয়ার সংগে তিনি সাক্ষাৎ করেন। দুজনের প্রীতিময় সম্পর্কের নিদর্শন স্বরুপ নিজামুদ্দিন আওলিয়া তাকে একজোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। এই কবতুর বাংলাদেশে জালালী কবুতর নামে সুপ্রসিদ্ধ। মাজারের প্রাঙ্গনে শতশত জালালী কবুতর বসে আছে। খুটে খুটে গম খাচ্ছে।



শাহজালাল (রঃ) সিলেটে আসার পর অত্যাচারী রাজা গৌড় গোবিন্দের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজা গৌড় গোবিন্দ পলায়ন করেন। সিলেটের মাটির সংগে মক্কার মাটির সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে তিনি এখানেই আস্তানা গাঁড়েন এবং বাংলায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তিনি ৩৬০ জন সফর সংগী সংগে করে সিলেটে আসেন। এজন্য সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ বলা হয়।



শাহজালাল (রঃ) এর মাজারের আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে গজার মাছ। তার হয়ে যাওয়ায় সেভাবে গজার মাছ দেখতে পেলাম না। সিড়িতে কালো কালো মাছের উপস্থিতি দেখেই সন্তুষ্ট হতে হলো।



মন্তব্য ১০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে মে, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৫

সুমন আহমদ বলেছেন: অসাধারন উপস্থাপন..

২২ শে মে, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৭

দক্ষিনা বাতাস বলেছেন: ধন্যবাদ সুমন আহমেদ

২| ২২ শে মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০২

মাইদুল আলম সিদ্দিকী বলেছেন: আমি সিলেটি আর আপনার লেখায় সিলেট সম্পর্কে কথাগুলো আমার কাছে অনন্য মনে হয়েছে। এখন আমার সিলেট প্রীতি আরও বেড়ে গেল মনে হচ্ছে।
সত্যিই চমৎকার বর্ণনা দিলেন।

২২ শে মে, ২০১৪ রাত ৮:৪৩

দক্ষিনা বাতাস বলেছেন: নিজের এলাকাকে অবশ্যই ভালোবাসা উচিত। আপনাকেও ধন্যবাদ।

৩| ২২ শে মে, ২০১৪ রাত ৯:০৯

তাসজিদ বলেছেন: সিলেটে গিয়েছি একবার!!! তাও মাত্র ৩ ঘণ্টার ট্যুরে !!!

২৬ শে মে, ২০১৪ সকাল ৯:১৫

দক্ষিনা বাতাস বলেছেন: হা হা হা। তিন ঘন্টায় আর কি সিলেট দেখা সম্ভব!

৪| ২২ শে মে, ২০১৪ রাত ১০:৩১

মামুন রশিদ বলেছেন: বেশ লিখেছেন! চেনা প্রকৃতিকে আরো নতুন করে জানলাম ।

২৬ শে মে, ২০১৪ সকাল ৯:১৩

দক্ষিনা বাতাস বলেছেন: ধন্যবাদ মামুন সাহেব।

৫| ২২ শে মে, ২০১৪ রাত ১০:৪৪

সুমন কর বলেছেন: তথ্যবহুল পোস্ট। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ। যেতে হবে।

২৬ শে মে, ২০১৪ সকাল ৯:১২

দক্ষিনা বাতাস বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ সুমন কর

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.