![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একজন ডাক্তার মা আমি যে মাতৃত্বের এই রঙ্গিন সময়টাতে সন্তানকে খাঁটি মানুষ করে গড়ে তুলতে চাই আমার পেশাগত জ্ঞ্যান আর স্নেহ মমতার মিশ্রণে
মা হওয়ার আগে যত নাটক সিনেমা দেখেছি , প্রতিটাতে এভাবেই দেখেছি যে যিনি মা হন তিনি লাজুক মুখে বলেন 'আমি মা হতে চলেছি' আর হবু বাবা তাকে খুশিতে কোলে তুলে নেন , হবু দাদা-দাদি, চাচা-মামা, ফুপু-খালা একে অন্যকে মিষ্টি খাওয়ান .... আর আনন্দময় গান হয় ! কাজেই নিজে যখন মা হবার 'সুখবর' দেয়ার আগে নিজের সাথেও এরকম আনন্দময় কিছু হবে বলে কল্পনা করে নিয়েছিলাম।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক, প্রথম বাধ সাধলো আমার সোনোগ্রাফি রিপোর্ট ! আল্ট্রাসোনো করার সময়ে আমারো মনে হয়েছিল 'কিছু একটা গন্ডগোল আছে'! কিন্তু শুভ খবরের আবেশে আমার 'ম-মন' তখন 'ডাক্তার-মন'কে অগ্রাহ্য করতেই ব্যাস্ত ছিল।
বাসায় এসে বাবাকে রিপোর্ট দেখাতেই আমার ডাক্তার বাবা খুশি হবার বদলে গম্ভীর হয়ে উঠলো, বললো 'দ্বিতীয় আরেকটা আল্ট্রাসোনো করাও'। পরবর্তীতে জেনেছিলাম আমার সন্তানের পজিশন এমন যে আমাকে প্রথম তিন মাসের সময়টুকু শুধুমাত্র রেস্ট নিয়েই কাটাতে হবে।
আমার সুখবর শুরু হল ভয় দিয়ে, শঙ্কা নিয়ে!
দ্বিতীয় ধাক্কা পেলাম যখন শশুরবাড়িতে খবর দিচ্ছি, আমার শাশুড়িমা বললেন 'মা খবরদার জমজ কলা খেয়ো না যেন, জমজ বাচ্চা হওয়া খুব কষ্ট।
আর সূর্য গ্রহণ আছে সামনে তখন কিন্তু কোন কিছু ছুরিতে কাটবানা, বাচ্চার তালু কাটা হবে,!'
বুঝে নিলাম সামনে সময় আসছে আমার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ঠান্ডা মাথায় লড়াই করার, যেখানে একই সাথে টেকল করতে হবে 'আমার নাতি-নাতনির ভালোর জন্যে' টাইপের ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইলকেও!
তৃতীয় ধাক্কা পেলাম, যখন আমার গ্রামের বাড়িতে কাকা-কাকিমাকে সুখবর জানাতে ফোন করলাম । কাকা বললেন, 'আশীর্বাদ করি শত পুত্রের মা হও, আমাদের একটা দাদু ভাই দাও' । জোড়ের সাথে বললাম 'না কাকা আমার তো মেয়ে চাই' । কাকা উত্তর দিলো , 'না না! এসব কি বলো ! আমাদের যেন একটা দাদু ভাই দিতে পারো এই আশীর্বাদ করি!'
আশীর্বাদ পেয়ে খুশি হবার বদলে বিরক্তিতে ভরে উঠলো মন, অনাগত শিশুটিকে জন্মের আগেই এ সমাজ লিংগের ভিত্তিতে স্বাগত জানাতে চায়, শিশুটি সুস্থ জন্মাবার আশীষের বদলে এক বিশেষ লিঙ্গে জন্মাবার নিমন্ত্রণ পায় ! কি অদ্ভূত না? জন্ম দেন একজন নারী কিন্তু সমাজ আরেকজন নারীকে স্বাগত জানাতে চায় না
পরবর্তীতে এক কাছের আন্টিকে জানালাম 'সুখবর' , উনি বললেন 'তুলি বেশি করে মিষ্টি খাবি বুঝলি, টক-ফক খাবি না। টক যারা খায় ওদের মেয়ে হয়। মিষ্টি খেলে ছেলে হয় '। উনি গ্র্যাজুয়েট এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ , দুই ছেলের মা যিনি কিনা সারা জীবন আমাকে , অন্য মেয়েদের খুব আদর করতেন আর বলতেন 'আমারে ঠাকুর এরম একটা মেয়ে দিল না, কত্ত আদর করতাম আমি!!'
কাজেই উনার মুখেও ছেলে সন্তানের কথা শুনে আমি সাহস করে বলে ফেললাম 'আন্টি আমার খুব শখ আমার প্রথম সন্তান মেয়ে হবে, ও আমার বন্ধু হবে যেমন আমি আর মা, আমি ওর ঝুটি করে দিব, ওর সাথে খেলা করবো' ।
উনি বললেন, 'আরে শখ তো বুঝলাম, মেয়ে হলে তো বংশ থাকবেনা '! আমি অনেকটা জেদের বশেই উত্তর দিলাম 'আন্টি আমি সরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করেছি, যখন যেভাবে পেরেছি বাবা মায়ের পাশে দাড়িয়েছি আর যার ছেলে থেকেও লেখাপড়ায় ভালো না , বাবা মায়ের অবাধ্য তাকে দিয়ে বংশরক্ষা হয়? কাজেই মেয়ে হলেও তাকে মানুষ করতে পারলেই বংশরক্ষা হবে আর ছেলে হলেও তাকে যথোপযুক্ত মানুষ না করতে পারলে বংশের মুখে কালি পরবে।'
এরপরেও উনি 'তা তো বুঝলাম রে মা, কিন্ত...'
এরপর আর মনোযোগ দেয়ার প্রবৃত্তিই হয়নি, কিন্তু বুঝে গিয়েছি যে এই সময়েও সন্তান মানুষ করতে হলে সামাজিক, ধর্মীয় ট্যাবু ভেঙ্গে সন্তানকে 'মানুষ' বানাতে যথেষ্টই লড়তে হবে ।
সন্তানের আসার সংবাদ পাওয়া থেকে শুরু করে জন্ম প্রতিপালন প্রতিটা পদক্ষেপে বুঝেছি সমাজ মেয়েদেরকে যে রূপকথার স্বপ্ন্ দেখায় , ব্যাপারটা আসলে ঠিক সেই রূপকথার মত মসৃন নয় ! অবশ্য জীবনের কোনো পদক্ষেপই তো মসৃণ নয় কিন্তু ব্যাপারটা যদি ওভাবেই শুরু থেকেই বলা হতো বা নাটক সিনেমায় বর্ণনা করা হতো তাহলে হয়তো বা ব্যাপারগুলো মেনে নিতে আরো বেশি সুবিধে হতো!
পুনশ্চঃ সন্তানের বাবা কিন্তু ভিষন খুশি হয়েছিল আর বলেছিল 'আমার প্রিন্সেস আসছে'!
©somewhere in net ltd.