![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একজন ডাক্তার মা আমি যে মাতৃত্বের এই রঙ্গিন সময়টাতে সন্তানকে খাঁটি মানুষ করে গড়ে তুলতে চাই আমার পেশাগত জ্ঞ্যান আর স্নেহ মমতার মিশ্রণে
প্রথম মা বা বাবা হবার আগে আজকাল আমরা সবাই গুগুল ঘেটে বই ঘেটে পড়ার চেষ্টা করি কি খেলে হবু মায়ের স্বাস্থ্য ভাল থাকে, কি করলে হবু মা সুস্থ থাকেন । আগে এমনটা হত কিনা তা অবশ্য জানা নেই। আমার ধারণা আমাদের দেশের মানুষেরা “আদ্যি কালের বদ্যি বুড়ি বলে গিয়েছে......” ধরণের প্রচলিত বিশ্বাসের বাইরে যেতেন না । যাহোক , আগে কে কি করতো তা আমাদের ভাবনার বিষয় নয় মোটেই। এখন আমরা ডাক্তারের কাছেও শুনে নেই, বড়দের কাছে শুনে সেটাও ডাক্তারের কাছে কনফার্ম হয়ে নেই।
কিন্তু যতখানি যত্ন হবু মায়ের নেই বা অন্যভাবে দেখলে হবু সন্তানের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখি আর তার জন্ম প্রক্রিয়া যেন বিঘ্নহীন হয় সে খেয়াল যেভাবে রাখি , মা-বাবা হবার পরে আমাদের মানসিকতায় কি কি পরিবর্তন আনলে সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল হবে তা ক’বার ভেবে দেখি আমরা?
অর্থাৎ, আমরা চিন্তা করি সিনেমার দৃশ্যের মত মা হাসপাতালের বেডে শুয়ে মিষ্টি হাসি হাসতে থাকবে আর চারপাশে সবাই বাবুকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করে আদর করতে করতে ২০ বছর পরের দৃশ্য শুরু হবে যেখানে বাবু এসে বলবে “আমি ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি” আর মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানী সবাই জন্মের সময়কার মত হাসতেই থাকবে! এর মাঝে কি করণীয় তা নিয়ে কি আমরা চিন্তা করি? ক’জন করি?
আমিও এর ব্যাতিক্রম নই, আমিও প্রথম মা হবার পরে ঠিক কিরকম আমার ব্যাবহার হলে তার প্রতিফলন দেখবো সন্তানের মাঝে সে চিন্তা করিই নি। বরং এভাবে ভাবতাম “বাচ্চা খালি কাঁদে, এরকম কেন?” , “সারাক্ষণ একটার পর একটা চাইতে থাকে কেন? আমি কখন রেস্ট পাবো?” , “বাচ্চাটা চিতকার করে কেন?”
অর্থাৎ আমি মুখে বলি আর না বলি সন্তানের কাছ থেকে আশা করা শুরু করে দিয়েছি যার পরিণতি একদিন হয়তো “সন্তান ফার্স্ট হবেনা কেন?” কিংবা “আমার সন্তান মেডিকেল/ ভার্সিটিতে চান্স পাবেনা কেন” তে গিয়ে থামবে কিংবা হয়তো বাড়তেই থাকবে!
এর প্রতিকার খুঁজতে যেয়ে নানারকম জার্নাল ঘেটে বিভিন্ন রকম তথ্য, উদাহরণ , উপদেশ পড়েছি । মানুষের কাছে শুনতে চেয়েছি কিভাবে কি করে তারা সন্তানকে সামলাতেন বা সামলান। সব পড়ে শুনে মনে হয়েছে যা বুঝেছি তার সবটা না পারলেও কিছু কিছু জিনিস লিখে রাখা দরকার আমার সন্তান ও অনুজদের জন্য। কেননা, এই ‘অভিভাবক-গিরি’র যাত্রাপথে মাঝেই মাঝেই আমার মনে হয় “এরকম একটা গাইড লাইন আগে কেন কেউ তৈরী করে রাখেনি”
আজ শুধু লিখে রাখি সন্তান যখন কাঁদে তখন ভালো অভিভাবক বা বাবা-মা হিসেবে কি কি করতে পারি
১) প্রথমেই জেনে নেই কখনো কখনো সন্তান কোন রকম সমস্যা ছাড়াই কাঁদতে পারে।
সে যদি নবজাতক হয়ে থাকে তাহলে হয়তো সে নিছক শরীরের উষ্ণতা চাচ্ছে। কিংবা একা একা তার ভয় লাগছে বলে কারো কোলে উঠতে চাচ্ছে । কাজেই নিজে ভয় পাওয়া বা আতংকিত হওয়া যাবেনা ।
মা-বাবা হবার সাথে নিজের মাথায় একটা তথ্য input and save করে ফেলতে হবে “আমি শান্ত থাকবো” ।
আর শান্ত থেকে তাকে কোলে নিতে হবে, শান্ত স্বরে কথা বললে এবং পিঠে ও পাছায় হালকা হাতে বাড়ি দিতে থাকলে সে ধীরে ধীরে থেমে যাবে ।
নবজাতকেরা হঠাত করে কান্না থামাতে পারেনা, খুব জোড়ে চলন্ত গাড়ির ব্রেক করতে যেমন সময় নেয়, ওদেরও পদ্ধতিটা একই রকম। ওই সময়টুকু ধৈর্য রাখতে হবে।
২) নবজাতক যদি বাড়তি দুধ বা পাউডার দুধ খায় তাহলে তার পেটে ব্যাথা হতে পারে, যদি ঠিক মত ঢেকুর তোলানো না হয় তাহলেও পেটে ব্যাথা হতে পারে, colicky baby লিখে গুগুল ঘাটলেও আপনি কিছু গাইডলাইন পেয়ে যাবেন আপনার করণিয় সম্পর্কে।মনে রাখতে হবে, ঝাকাঝাকি করে কান্না থামানোর চেষ্টা করা যাবেনা। সেটা উলটো ক্ষতিকর হতে পারে।
পায়খানা ঠিক মত না হলেও পেটে ব্যাথা হতে পারে। সেটা নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই যাবেনা,
তিন দিন পর্যন্ত পায়খানা না হলেও যদি দিনে ৬ বারের বেশি প্রস্রাব করে তবে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। হাত পা ভাঁজ করে এক্সারসাইজ করানো যেতে পারে।
৩) সন্তান যখন একটু বড় অর্থাৎ ৬মাস থেকে ১ বছর তখনকার সময়ের কান্নার কারণের মাঝে
প্রথম কারণ হল basic needs যা সে মুখে প্রকাশ করতে পারেনা।
তখন খাবার দিয়ে দেখতে হবে, ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করা যেতে পারে আর ডায়াপার চেক করে দেখা যেতে পারে।
এগুলো সবাইই করি আমরা, কিন্তু সাথে আরো একটা কাজ করি। বিরক্ত মুখে বলে ফেলি “উফ আবার কেন!”
ভালো অভিভাবক হওয়া প্রতি মুহূর্তের ট্রেইনিং, প্রতি মুহূর্তের দায়িত্ব। কাজেই শান্ত মুখে “কি হয়েছে মা/বাবা? খুদা পেয়েছে? আমরা কি খাবো?”
কিংবা “আমার বাবু এখন আমার কাছে ঘুমাবে” এধরণের আদরের কথা বলে তাকে শান্ত করতে হবে আর প্রয়োজন মিটাতে হবে।
৪) ১ বছরের পর থেকে শিশুরা যা দেখে তাই অনুকরণ করে। অর্থাৎ আপনি যদি সন্তানকে বা এমনকি গৃহ পরিচারিকাকেও গায়ে হাত তুলে শাস্তি দেন তাও সে দেখে এবং এর কিছুদিন পরে প্রতিবেশিরা যদি তাদের শিশুকে মারার অভিযোগ নিয়ে আসে তখন বুঝে নিন যে এই ফলের বীজ একদিন আপনি রোপণ করে ফেলেছেন।
কাজেই এই সময়ে যখন সন্তান কাঁদে তখন বিরক্ত হয়ে ধমক দেয়া যাবেনা পারতপক্ষে। তাকে আদর করে, কোমল স্বরে বারবার জিজ্ঞেস করতে হবে কি হয়েছে? কোথাও ব্যাথা পেয়েছে কিনা?
তার অসুবিধা থাকলে দূর করতে হবে।
আর সে যদি গৃহপরিচারক বা পরিচারিকার সাথে থাকে খেয়াল রাখতে হবে তাকে মারছে কিনা বা আপনার সন্তান child abuse এ স্বীকার হচ্ছে কিনা।
৫) কান্না করে কিছু চাইলে তাকে শান্ত স্বরে বারবার বুঝিয়ে বলতে হবে যে তার যা চাই সেটা তাকে দেয়া হবে একটাই শর্তে যদি সে কান্না বন্ধ করে বুঝিয়ে বলে যে তার আসলে কি চাই। সেটা যদি তার পক্ষে ক্ষতিকর হয় তাহলে বুঝিয়ে বলতে হবে । না বুঝলে একটুখানি ক্ষতির অনুভূতি হতে দেই, যেমন আমি ছোটবেলা চা খেতে চাইতাম আর চা না দিলে কাঁদতাম বলে মা একদিন খুব শান্তভাবে আমায় ডেকে গরম চা ফু না দিয়েই একটুখানি খাইয়ে দিয়েছিল।
এক দুদিন জিহবা পুড়ে যাওয়াতে কম খাবার খেয়েছি কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর ঐ অভ্যাস একেবারেই চলে গিয়েছিল।
৬) শুধু শুধুই কোন কিছুর জন্যে জিদ করতে থাকলে জরিয়ে ধরে আদর করে মন অন্যদকে ঘুরিয়ে দেয়া যেতে পারে, বা সুরুসুরি দেয়া দেয়া যেতে পারে । বিশ্বাস করুন এটি কাজ করে । হাসতে হাসতে কে আর রাগ বা কান্না করে বলুন?
আর একই সময়ে আপনি আপনার সন্তানকে শিখিয়ে দিলেন ভালোবেসে জয় করা যায় রাগ।
হয়তো একদিন সেও আদর করে আপনার মান ভাঙ্গাবে!
৭)হাতে বেশ খানিকটা সময় থাকলে অন্যরকম কিছু করে তার মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে পারেন । একটা রঙ পেন্সিল আর খাতা এনে মজার কিছু এঁকে দেখাতে পারেন । বা গান শুনাতে পারেন কিংবা সন্তানের সাথে খানিক নেচেও নিতে পারেন।
ঐ আধা ঘন্টা সময়ের বদলে হয়তো আপনি আপনার সন্তানের মাঝে নতুন প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করলেন।
সব কথার শেষ কথা লক্ষ্মী-ভদ্র সন্তানের বাবা-মা হতে চাইলে শান্ত-বুঝদার বাবা-মা হতে হবে আগে। নিজের ধৈর্য কিছুতেই হারানো যাবেনা । আর নিতান্তই রেগে গেলে পরমুহূর্তেই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে আদর করে "sorry" বললে সেও শিখে নেবে যে ভুল করলে দুঃখপ্রকাশ করতে হয়
#happyparenting
©somewhere in net ltd.