![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার এক বন্ধু অসুস্থ। প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা বলছে, ক্যান্সার। বন্ধুবান্ধবদের মাঝে তাই একটু সাজ সাজ রব। সবাইকে জানানো, কি করা যায় তা নিয়ে আলাপ আলোচনা। আমিও ফোন পেলাম। সেই অর্থে আমারও করণীয় কিছু নেই। যা করবেন সার্জন করবেন। এরপরের কাজ অনকোলজিস্টের। আমাদের কাজ শুধু ভদ্রতা রক্ষা করা। ‘একদম ভয় পাবি না। এরচেয়েও কত খারাপ রুগী ভালো হয়ে গেছে।‘ একসময় যেহেতু খুব কাছের বন্ধু ছিল, তাই কথাগুলো শুধু ফোন করে বললে হবে না। দেখা করতে যাওয়াও ভদ্রতার সীমানার ভেতরে পরে। সঙ্গে আপেল কমলা নিয়ে যাওয়াটাও জরুরী।
বন্ধুর অসুখের খবরটা প্রথম জানতে পারলাম ফোনে। আরেকজন বন্ধু জানালো ‘ওকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। রিপোর্ট যে কি আসে?’ আমারও মন কিছুটা খারাপ হয়েছিল। এরপরের বক্তব্যগুলো হয় নিয়মতান্ত্রিক, ‘দোয়া করিস’ ধাঁচের আর কি। সেসব কথাও শুনলাম। নিজে চিকিৎসক হওয়ার জন্যই বোধ হয়, আমার আবেগ একটু কম। মাথার মধ্যে ‘লজিক’ বেশি কাজ করে। বায়োপ্সি রিপোর্ট তখনও আসে নি। শুধু এনডোস্কপিতে খালি চোখে টিউমার দেখা গেছে। সরাসরিই বললাম, লাভ নাই। ‘লজিক’ বলছে, খারাপ কিছু হবে। ‘বয়স’, ‘স্মোকার’ 'প্রেজেন্টেশান' সব মিলালে টিউমারটা ক্যন্সারই হওয়ার কথা। তাই অনেকটা মানসিক ভাবে তৈরি ছিলাম, খারাপ সংবাদের জন্য।
যাই হোক, একজন ভদ্র বাঙ্গালীর মত, এরপরের করণীয় নিয়ে কিছুটা ভাবনা চিন্তা সেরে ফেললাম। আপাততঃ সাহস দেয়া টাইপ একটা ফোন করতে হবে। ফোন নম্বর জোগাড় করলাম। অনেক দিন যোগাযোগ নাই বলে ফোন নম্বরও ছিল না। ‘আর বলিস না, পিচ্চিরা যে কি করেছে, আমার ফোনের সব নাম্বার কেমন করে যেন ডিলিট হয়ে গেছে’ এসব বলে একজন বন্ধুর কাছ থেকে নম্বরটা জোগাড় করলাম। নম্বরটা হাতে পেয়ে, যথারীতি উপদেশমূলক ফোন করার সেই কাজটাও সেরে ফেললাম। এরপরের কাজটা একটু ব্যয় বহুল হয়ে যায়। শেষ দেখা দেখতে ঢাকা যাওয়া। রংপুর থেকে ঢাকা যাওয়ার খরচটা যৎসামান্য হলেও আমার সমস্যা অন্যখানে। ঢাকা যাওয়া মানে এখানে রংপুরে অনুপস্থিত থাকা। আর এখানে না থাকা মানেই, তিন দিনের প্রাইভেট প্র্যাকটিস শূন্য হওয়া। এরপরে যাওয়া আসার খরচ, ওখানে ঘোরাঘুরি, ফেরত আসবার সময় আবার পরিবার পরিজনের জন্য কেনাকাটা করে আনা এসব তো আছেই। বহু হিসাব কিতাব করে, বুকের ওপর পাথর রেখে ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এরপরের কাজগুলোও মোটা মুটি গৎ বাঁধা। ‘ভয় পাইস না’ ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ কিংবা ‘আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে’। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাক্টিস না করলেও মাথায় রাখতে হবে যেন বলার সময় মুখে একটা দুঃখ দুঃখ ভাব থাকে। চোখে পানি আনবার চেষ্টা করাটা রিস্কি, পারবো তো না বরং লেজে গোবরে হয়ে যাবে। হাসি যতটা সম্ভব আটকে রাখতে হবে। রুগী দেখা শেষে বাকী বন্ধুরা একজায়গায় হব। সেখানে অবধারিতভাবে বন্ধুদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা আসবে ‘যাই বলিস, জীবনের কোন ঠিক নেই, কে কবে কখন...’। আলোচনা আরেকটু এগোলে বিষয় হবে, মরবার জন্য কে কতোটা তৈরি। ‘বাড়ী ঘর হয়েছে কি না’ কিংবা নিদেন পক্ষে ‘একটা জমি কেনা হয়েছে কি না’। আলোচনায় আরেকটা বিষয় আসে, এখন মরে গেলে ছেলেমেয়েদের কি গতি হবে। আলোচনার পরবর্তী অংশে থাকবে, বন্ধুদের মধ্যে ইতিমধ্যে ‘টেঁসে’ যাওয়াদের সম্পর্কে আরেক দফা স্মৃতি রোমন্থন হবে। ‘ভাবা যায় এই বয়সে...’
আমার এই বন্ধুটি একটু বেশি বয়সে মাত্র কিছুদিন আগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান করেছে। ফলে আলোচনায় এই ব্যাপারটাও প্রাধান্য পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। ‘বেচারা ডিগ্রি টা এঞ্জয় করতে পারলো না’। ‘এতো কষ্ট করে, এই বয়সে পড়াশোনা করে, ডিগ্রি টা পেলো, আর এখনই এই ট্র্যজিডি!’ ‘ধরা পড়বি আগে পড়, তাহলে আর এতো খাটনি করে না’। ‘একেই বলে ব্যড লাকের কপাল খারাপ’। সবকিছুই মাথায় রেখেছিলাম। আলাপ আলোচনা কিংবা আড্ডায় যতটা সম্ভব হাসি খুশি রাখতে হবে। খুব বেশি না, তবে রামগুরুর এর উত্তরসূরি ও না। কিছু উপদেশ দিতে হবে, তবে সেখানেও রেশনিং রাখতে হবে, বেশি দেয়া যাবে না। কিংবা চেষ্টা করতে হবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেয়ার। ‘আমি সবাইকেই বলছিলাম, পলাশ ভয় পাওয়ার ছেলে না। ও অনেক শক্ত।‘
রংপুর ছাড়বার দিনক্ষণ ঠিক করলাম। যে দুইদিন আমার রুগী সবচেয়ে কম হয় সেই দুইদিনকে নির্ধারণ করলাম। ফলে রওয়ানা দিতে একটু দেরি হল। আমি যখন রংপুর ছাড়ি, তখন এন্ডোস্কপি করে নেয়া বায়োপ্সি রিপোর্ট আংশিক জানি। ম্যালিগ্ন্যান্সি। তবে সেটার ভবিষ্যৎ জানি না। অন্য ক্যান্সারগুলোর চেয়ে ভালো ক্যান্সার। এতেই কিছুটা খুশি হয়েছিলাম। একবার ভেবেওছিলাম, ‘এখন আর যাওয়ার দরকার কি? এখনই তো আর টেঁসে যাচ্ছে না। পরেই বরং যাই। অবরোধ আর শীত কালের জন্য এই কয়দিন এমনিতেই রুগী হয় নি। এখন কেবল রুগী হওয়া শুরু হচ্ছে। আপাতত না গিয়ে মোটামুটি যখন শেষের অবস্থা হবে তখন নাহয়...’ । যেহেতু ‘আসছি’ বলে ফোনটা করে ফেলেছিলাম তাই প্ল্যানটা পরিবর্তন সম্ভব না। ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে তাই সঙ্গে আরও কাজ যোগ করলাম। মিনিস্ট্রি তে একটা কাজ, প্রেসার কুকারের ঢাকনার রাবার কেনা, বইমেলায় নিজের প্রকাশিত বইয়ের স্টলে সময় কাটানো। এক ঢিলে সব মিলিয়ে প্রায় ৪টা পাখি।
অপারেশান এর দুইদিন পরে আমি রওয়ানা দিই। ফলে বাসে উঠবার আগে পর্যন্ত বন্ধুটির অসুখ সম্পর্কে আমার জ্ঞান ছিল, অপারেশান হয়ে গেছে এবং সেটা ভালোই হয়েছে। আর আগের রিপোর্ট অনুযায়ী, একটু ভালো জাতের ক্যান্সার। অপারেশানের পরে পাওয়া বায়োপ্সির রিপোর্ট তখনও হাতে আসে নি। সো, সবাই বেশ এঙ্কারেজিং কথা বার্তা বলার মুডে আছে। নিয়ম বা ভদ্রতা বলে, আমাকেও সেই জাতীয় কথাবার্তা বলেই সময় পার করতে হবে। ‘ইনশাল্লাহ, পরের রিপোর্ট ভালো আসবে, একদম ঘাবড়াইস না।’ জাতীয় কথাবার্তা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতে হবে। আর বন্ধুরা নিজেরা একসাথে হলে শুরু করা যেতে পারে, ‘ইশ’ জাতীয় দুঃখ মেশানো বিলাপ।
নিয়মমত কিছুই হল না। রুমে ঢুকেই দেখা পেলাম ওর ভুবন ভোলানো হাসির। প্রায় দশ বছর পরে দেখা। দেখা গেলো আলাপ আলোচনা দশ বছরের আগের থেমে থাকা জায়গা থেকে শুরু হল। এরপরে গল্পগুজব অতীত থেকে এগোতে থাকলো বর্তমানের দিকে। এতদিন কোথায় কোথায় ছিলো, কি করতো, তারপরে কি হল, এইসব। শুনতে খারাপ লাগছিল না। সেই টিপিক্যাল আড্ডা। যখন হোস্টেলে থাকতে বিকেলে নাস্তা করতে দোতলা থেকে নীচে নামতাম। এরপরে রুমে ফেরার আগে অযথাই যেসব গল্প করতাম সেসব গল্প শুরু হয়ে গেল। দেশ, আওয়ামীলীগ, বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বামপন্থা, কর্নেল তাহের। মুজিব থেকে শুরু করে জিয়া, এরশাদ, আর্মি। এমন সময় ভদ্রতা কড়া নাড়ল। মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল, ‘কেমন আছিস?’ সামনে মৃত্যু ঝুলছে এমন কাউকে এই প্রশ্ন করার মত রসিকতা আর হয় না। তবে উত্তর দিল।
‘বুঝলি, মরে যাওয়া একদিক দিয়ে ভালো। মরলে তো মরলাম ই। কিন্তু এই ওয়েটিং ফর...কি বলবো, বেশি কষ্টের।‘
০৫ ই মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৫:৪১
ডা: আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: তাই?
২| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২২
পাঠক১৯৭১ বলেছেন: সঠিক বাংগালী ডাক্তারের মনের কথা।
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:০৭
ডা: আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: কোনভাবে ডাক্তার দের গালি দিতে পারলেই মজা লাগে, না?
৩| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৪
বর্ষণ মাহি বলেছেন: অবাক হয়ে গেলাম লেখাটি পড়ে । মানুষ কি আসলেই এত নির্লিপ্ত উদাসীন হয়? আপনাকে আপনার লেখার মাধ্যমে না দেখলে বুঝতাম না ।
২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:০৪
ডা: আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: মানুষ এতোটাই নির্লিপ্ত। শুধু স্বীকার করি না।
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৮
মদন বলেছেন: মজা লাগলো