নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফিদেল কাস্ত্রো প্রয়াত হওয়ার পর নানাজন নানা মন্তব্য করছেন তার সম্পর্কে। ইতিবাচক, আবার নেতিবাচকও। বাংলানিউজে এমন মন্তব্যের একটা খবরের শিরোনাম দেখলাম, ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘কাস্ত্রো ছিলেন পাশবিক স্বৈরাচারী শাসক’। মত-দ্বিমতের একটা উদহারণ এটা। কেউ বলছে স্বৈরশাসক, আবার কেউ বলেছে বিপ্লবী বিশ্বনেতা। তবে কাস্ত্রো নিজে ১৯৫৩ সালে আদালতের এক বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন মহাবাক্য,
“ আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন, তাতে কিছু যায় আসে না। ইতিহাস আমাকে নির্দোষ বলবে।”
যে ইতিহাসের ওপর কাস্ত্রো বিচারের ভার দিয়ে দিলেন, সেই ইতিহাসের ব্যাখ্যাটা আবার ইংরেজির ‘নয়-ছয়’ এর মতো জটিলতায় ভরা। তার প্রমাণ ট্রাম্পের বক্তব্যই। এক পাশ থেকে এক জন দেখবে ‘ছয়’ অন্য জন বলবে ‘নয়’। দুই মেরুর দু’জনেই বিতর্কে লিপ্ত হয়ে ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে। সারা পৃথিবীর সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক সমীকরণটা মোটামুটি এই সূত্রেই মেলানো।
ফিলিস্তিনের কোনো শিশু গুলতি দিয়ে পাথর ছোড়ে আর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ওই অপমানের জবাব দেয় বুলেট দিয়ে। নিষ্পাপের রক্তে গোসল করে প্রাণঘাতী বুলেট। সারা পৃথিবীই যেন আজ সেই প্রাণঘাতী অস্ত্রের ঝনঝনানিতে উত্তপ্ত।
বিজ্ঞানীদের মতে, বিগ ব্যাং বা বিশাল বিস্ফোরণের ফলে আমাদের এই পৃথিবীসহ মহাবিশ্বের সৃষ্টি। ঠিক তেমনি অস্ত্রের ঝনঝনানির উত্তাপ দিনে দিনে মহাবিস্ফোরণে রূপ নিচ্ছে, যাতে এই পৃথিবী আবার ধ্বংসের কিনারে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ পৃথিবীর যেভাবেই উদ্ভব সেভাবেই হতে চলেছে সমাপ্তি।
কিন্তু অস্ত্র বা গুলতির কোনো অসম প্রতিযোগিতা নয়, নয় কোনো সমর যুদ্ধ। এই বিপদসংকুল সময়ে শুধু সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে, তা ওই অস্ত্রের ঝনঝনানির উত্তাপ থেকেও ভয়াবহতা রূপ নিয়েছে সর্বত্র।
আবহমানকাল থেকে বঙ্গীয় জনপদ তথা বাঙালির অাবাস বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল, তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। শুধু ওই বিষবাষ্পের কারণে। সম্প্রতি নাসিরনগরের ঘটনা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত এখানে ইতিহাসের কোনো ‘নয়’ ‘ছয়’ জটিলতা নেই। ইতিহাস এই সাম্প্রদায়িকতাকে দোষী বলবেই।
সারা পৃথিবীতে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ভূখণ্ডের নানান বৈপরীত্য আছে। কিন্তু মানবতার কোনো দেশ, কাল, স্থান বা পাত্র নেই। সর্বত্র সে মানবতা। মানবতার আবেদন, ভাষা, অনুভূতি সর্বজনীন। এই মানবতা এখন কাঁদছে মায়ানমারেও। সাম্প্রদায়িকতার বিষমাখানো রাষ্ট্রীয় বুলেট সেখানকার রোহিঙ্গা নামক মানবগোষ্ঠীর রক্তে শুধু গোসলই করছে না, রক্তের বন্যায় সেই গোষ্ঠীকে ভাসিয়ে দিচ্ছে নিজ মাতৃভূমি থেকে।
প্রত্যেকটা অঙ্গের সমন্বয়ে যেমন শরীরের কর্মযজ্ঞ চলে, কোনো একটার ব্যত্যয় হলেই পুরো প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব পড়ে, মস্তিষ্কে নেতিবাচক সংকেত পাঠায়। ঠিক তেমনি, দেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বলে কথা নেই, কোনো একটা মানুষের ক্ষতি হলে বা কোনো একটা মানুষ-সন্তান যন্ত্রণায় কাতর হলে হু হু করে কেঁদে ওঠে ‘মা’ মাতৃভমি।
হয়তো সুভা যেমন তার মাতৃভূমিকে আঁকড়ে ধরে কেঁদেছিলো আর বলেছিলো ‘মা’ আমাকে যেতে দিও না। তেমনি দেশের মাটিও বলে, হয়তো আমরা সবাই মানবতার আর্তনাদ শুনতে পাই না বলে তা শুনি না। এখানে আমরা শিক্ষিত, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন, আন্তর্জাতিক মানের বোবা ও বধির। তাই হয়তো শুনতে পাই না। ইতিহাস এখানে কী বলবে আমাদের?
অষ্টম শতকে এক আরব বণিক-জাহাজ পশ্চিম আরাকান উপকূলে ভেঙে পড়ে। স্থানীয় রাজার নির্দেশ হয়, এদের হত্যা করো। অসহায় আরবেরা তখন নিজ ভাষায় রাজার প্রতি ‘রহম’ করার আবেদন জানায়। তারাই এই এলাকার নাম দেয় রহম-ব্রি, যার অর্থ করুণার ভূমি। বর্তমানেও আরাকানে রামব্রি নামের দ্বীপটি আছে, কেবল রহমের কোনো চিহ্ন নেই। বলা হয়, এই রহম থেকেই আরাকানিদের আদি নাম রোহানের উৎপত্তি এবং রোহান থেকে রোহিঙ্গা নামের জন্ম। (সূত্র: প্রথম আলো)
বিতাড়িত ও নির্যাতিত হতে থাকা সেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে অবশ্য সেই ‘নয়’ ‘ছয়’ জটিলতা একটা আছেই। সেটা হলো তারা বাংলাদেশের চোখে ‘উটকো ঝামেলা’ আর মায়ানমারের কাছে ‘বহিরাগত বাঙালি’। কিন্তু মানবতার বিচার? ফিদেল কাস্ত্রোর মতো, তারাও কি বলতে পারে না, “আমরা উটকো ঝামেলাও নই, আমরা বহিরাগতও নই, আমরা মানুষ! আমাদের বাঁচতে দাও!”
নোয়াখালীর তুলসি রানিকে দেখেছি যিনি ‘মা’ ডাক শোনার প্রহর গুনছিলেন, কিন্তু তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে চিরতরে। ক্ষমতার দাপুটেরা তার পেটে লাথি মেরে তার সন্তানের জগতের আলো দেখার হৃদপিণ্ডকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
নূর বেগম। ছবি-প্রথম আলো
আর ছবিতে এই রোহিঙ্গা ‘মা’ নূর বেগমকে দেখছি। যিনি তাঁর স্বামী হারিয়ে বুকের মানিককে নিয়ে বিতাড়িত হয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। কিন্তু বুকের মানিককে আনলেও এখন তাকে নির্বাক তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে ছেলের লাশের দিকে, যাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দাফনের জন্য।
শুধু এই এক নূর বেগম নন। হাজারো নূর বেগম আজ এই পরিণতিতে। বিশ্ব মানবতা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে নাফ নদী পাড়ের ‘রহম’র জমিতে। প্রাকৃতিক নৈসর্গের বাংলাভূমিও আজ মানবতার নারকীয় পরিণতিতে নির্বাক। ‘রা’ শব্দটিও নেই বিশ্বের আধিপত্যশীল দেশ বা সংগঠনগুলোর। এখানে এসেই আবার সেই প্রশ্ন.. এই নিশ্চুপ থাকাকে অথবা এই দায়সারা নীরবতাকে ইতিহাস কী বলবে?
©somewhere in net ltd.