![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেশের প্রায় প্রতিটি গণপরিবহণেই প্রতিনিয়তই ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। সরকারি আদেশ অনুযায়ী প্রত্যেকটি সরকারি ও বেসরকারি বাসেই তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও তা শুধু মাত্র নামেই 'সংরক্ষিত'। বেশিরভাগ সময়েই এই সংরক্ষিত আসনগুলো নারীদের দখলে না থেকে পুরুষের সংরক্ষনেই থাকে। দেশের প্রতিটি গণপরিবহণেই নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীদের জন্য মাত্র নয়টি সিট বরাদ্দ থাকার কথা থাকলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিন থেকে চার সিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেই তিন-চারটি আসনও কান্ডজ্ঞানহীন পুরুষ যাত্রীদের দখলেই থাকে। সংরক্ষিত আসন উদ্ধার করতে গিয়ে পুরুষ যাত্রীদের বিরূপ আচরণে নারীদের পড়তে হয় অস্বস্তিতে। আবার, 'সিট নেই' বিরম্বনা তো রয়েছেই। অনেক সময় পরিবহনে চাপ বেশি থাকলে তখন বহু বেসরকারি বাসে নারীদের সংরক্ষিত আসনে পুরুষ যাত্রীদের বসিয়ে 'সিট নেই' বলে নারীদের উঠতে দেয়া হয় না। এমনকি সংরক্ষিত নয়টি আসন ছাড়া অন্য আসনে বসলে পুরুষ যাত্রীরা শুরু করেন তর্কবিতর্ক। যানবাহনে ওঠার ক্ষেত্রে নারী শিশুদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা একেবারেই বিলুপ্ত। আবার, এই সংরক্ষিত আসন শুধুমাত্র রাজধানি ঢাকার ভিতরেই রয়েছে। ঢাকার বাইরে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেই।
গণপরিবহনগুলোয় নারীদের দুর্ভোগের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে যৌন হয়রানির। কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করে ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠে যখন দেখে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলো পুরুষের দখলে, তখন দুর্ভোগের আর সীমা থাকে না। তাই অনেকেই শুধুমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে, বাসের পা-দানিতে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করেন। দু-একজন সচেতন পুরুষ যাত্রী আসন ছেরে দিলেও অনেকেই চলেন উল্টো পথে। আবার তাদেরকে সংরক্ষিত আসন ছেড়ে দেয়ার কথা বললে, অনেকেই উল্টো প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'আমি টাকা দিয়ে যাচ্ছি সিট ছাড়বো কেন?', 'অন্য সিটেওতো মেয়েরা বসছে তাতে সমস্যা হয় না, নারীর সিটে পুরুষ বসলেই দোষ', 'প্রয়োজনে নিজে গাড়ি কিনে যাতায়াতকরন'সহ এরকম অসংখ্য তীব্র তর্ক-বিতর্কের মুখে পরতে হয় নারীদের। যখন পরিবহণে চাপ বেশি থাকে তখন বহু বেসরকারি বাসে নারীদের সংরক্ষিত আসনে পুরুষ যাত্রিদের বসিয়ে 'সিট নেই' বলে নারীদের উঠতে দেয়া হয় না। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানবাহনে উঠতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানিসহ নানারকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে নারীরা।
অন্যদিকে সরকারিভাবে পরিচালিত বিআরটিসি মহিলা বাস সার্ভিস থাকলেও তা কেবলই নামমাত্র। কালেভদ্রে হঠাৎ দেখা মিললেও মিলতে পারে। নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার ঘোরটোপে মহিলা বাস সার্ভিসের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরীর মহিলা যাত্রীরা। গণপরিবহণে এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে বিকল্প বাহনে যাতায়াত করায় নারীর আয়ের একটা বড় অংশই চলে যাচ্ছে পথ খরচায়।
২০০৮ সালে ঢাকার বড় বাসে নয়টি এবং মিনিবাসে ছয়টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণের শর্ত দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পরিবহণ কমিটি (ঢাকা মেট্রো আরটিসি)। কিন্তু বেশকয়েকদিন রাজধানীতে সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, কয়েকটি বাসে 'মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন' লেখা থাকতে দেখা গেছে। তবে সেখানে নারী নয়, স্থান হয়েছে পুরুষ যাত্রীদের। বিআরটিসির বাসেও নারী আসনে পুরুষ বহনের দৃশ্য দেখা গেছে।
ঢাকায় চলাচল করা মিনিবাসগুলোতে অলিখিতভাবে চালকের বাঁ পাশের লম্বা আসন নারীদের জন্য বরাদ্দ। সেখানে চারজনের আসনে গাদাগাদি করে বসানো হয় পাঁচজন। নারীদের সংখ্যা আরও বেশি হলে তাঁদের স্থান হয় ইঞ্জিনের ওপর উত্তপ্ত বনেটে। কয়েকজন নারী যাত্রী রসিকতার সুরে বলেন, বাসায় রান্নাঘরের চুলার গরম। আর বাসেও নারীদের জন্য ইঞ্জিনের ওপর তপ্ত আসন বরাদ্দ। অথচ রুট পারমিটে শর্ত হিসেবে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখতে বলা হয়েছে চালকের পেছনে। 'সিটিং সার্ভিস' নামের বাস-মিনিবাসে কখনো কখনো ঐ লম্বা আসনেও পুরুষ যাত্রী বসেন। আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকায়ও আছে বিপত্তি, অস্বস্তি। ওঠানামার সময় হেলপার-কন্ডাক্টরের অসদাচরণ তো আছেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গণপরিবহণগুলোর বেশিরভাগ হেলপার-কন্ডাক্টরই ওঁৎ পেতে থাকেন নারী যাত্রীর শরীর ছোয়ার জন্য। মাঝে মধ্যে নারীরা প্রতিবাদ করলেও হেলপার-কন্ডাক্টরের বাজে কথার তীব্রতায় তা ধোপে টেকে না। গতকাল এরকমই একটি ঘটনা লক্ষ্য করা যায় রাজধানীর পোস্তগোলায় 'বোরাক পরিবহণে'। এই মিনি বাসটি নারয়ণগঞ্জের পাগলা থেকে এসেছে। অনেক হুরোহুরি ধাক্কাধাক্কি করে চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠলেন আয়শা খানম ও তার স্কুল পরুয়া মেয়ে সানজিদা আক্তার। তারা নামবেন 'দয়াগঞ্জ'। বাসে চালকের বা পাশের চারটি অলিখিত আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত বলা হলেও সেখানে বসে আছেন পুরুষ যাত্রীরা। আয়শা খানমের স্থান হয় উত্তপ্ত ইঞ্জিন কাভারের উপরে। এ সময় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিনই সকালে এই পথে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যান। নারীদের জন্য আলাদা আসন সংরক্ষণ দূরে থাক, ওঠারই সুযোগ পান না। এই পথে রিকশা চললেও ভারা অনেক বেশি। এতো বেশি ভারা প্রদান করে প্রতিদিন তাদেও মত মধ্যবিত্ত পরিবারের যাতায়াত সম্ভব না। তিনি বলেন, এভাবে যুদ্ধ করে বাসে চড়তে গিয়ে প্রায়ই অস্বস্তি লাগে, হয়রানিরও শিকার হতে হয়। কাউকে বলাও যায় না। মেনে নেওয়াও কঠিন।
বোরাক পরিবহণের ঐ বাসের কন্ডাক্টর লাভলুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ঐ মহিলারে আগেই কইছি সিট খালি নাই। তারপরও উঠছে, আমি কি করমু? বারিত্তে সিট আইন্না দিমু'। পরবর্তিতে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে এই কন্ডাক্টরের সুর চেঞ্জ হয়ে যায়। তখন তিনি বলেন, 'মামা অনেকেই মহিলাগো সিটে বয়। কইতে গেলে গালাগালি করে, আবার মাঝে মইধ্যে মারতেও আসে। এই জন্য এহন আর কেউরে কিছু কইনা'।
যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী গণমাধ্যমে বলেন, ঢাকা ও এর আশপাশে অনুমোদিত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ছয় হাজারেরও কম। যানজটের কারণে এগুলোরও পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে গণপরিবহণ কোনো চাহিদাই পূরণ করতে পারছে না। আর নারীদের জন্য তো সারাদেশের গণপরিবহণে রীতিমতো দুর্বিষহ অবস্থা। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে তাঁর সামনেই একটি মিনিবাস এক নারীকে শান্তিনগরে না নামিয়ে কাকরাইলে নিয়ে আসে। সেখানে মিনিবাসটি পুরো থামার আগেই হেলপার ঐ নারীকে ঠেলে নামিয়ে দেয়। এতে তিনি সড়কে পড়ে যান।
ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট নামের একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১৩ সালে ঢাকার নারী পোশাককর্মীদের জীবনমান ও হাঁটার বিষয়ে একটি গবেষণা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিরাপত্তার অভাব, আর্থিক অসচ্ছলতা ও পরিবহনস্বল্পতার কারণে বেশির ভাগ নারী পোশাককর্মী হেঁটে কর্মস্থলে যাতায়াত করেন।
আমার এ লেখাটি গত ১৪ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত
©somewhere in net ltd.