নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সব থেকে সব পরিচয় আমি একজন মানুষ

দুর্জয় রায়

লেখক হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তবে, মাঝে মাঝে লিখতে ভালো লাগে

দুর্জয় রায় › বিস্তারিত পোস্টঃ

কিছু গল্পের নাম হয় না

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৩:১৬

এক......
সাদেকুল সাহেব বললেন, তুমি কি জানো এখানে তোমাকে কেন ডাকা হয়েছে??
আমি বললাম, হ্যাঁ অনেকটা জানি।জামিল ভাই বলেছে।
কি বলেছে শুনি??
বলেছে আমার কল্পনাতীত এমন কাজ করতে হবে। বিনিময়ে যা আমি চাবো দেওয়া হবে।
-তোমার নাম অভ্র, তাই না??
জি স্যার।
-তো অভ্র আমি যদি বলি তোমাকে জান দিতে হবে। দিতে পারবে??
জি পারবো।
সাদেকুল সাহেব আমার কথায় অবাক হলেন। আবার বললেন, বিনিময়ে তোমার কি চাই??
মিমের চিকিৎসার সব খরচা দিতে হবে।
-মিম কে?? তোমার বোন?
উহু আমি অনাথ।
-তাহলে মিম কে??
আমার মেসওয়ালার মেয়ে। আপনজন বলতে এই মিম ই আছে। আমার খেলার সাথী।
-বল কি?? রক্তের সম্পর্ক নেই তবু মেয়েটার জন্য নিজের জীবন দিবে!!
-কিছু সম্পর্ক রূপরেখায় সীমাবদ্ধ নয়। এই সম্পর্ক গুলো রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বড় হয়।
-আচ্ছা ঠিকাছে। মিমের চিকিৎসার সব খরচা আমি দিবো। শুনেছি তুমি নাকি নিজের পিছনে খুব একটা খরচা করো না। তা না করে টাকা জমিয়েছ!!
-জি স্যার। এতদিন তাই করে মিমের ট্রিটমেন্ট করেছি। নিজের উপার্জন সব শেষের পথে যখন তখন হাত পাততে বাধ্য হয়েছি। অনেকে হাসাহাসি করেছে। কেউ আবার ঘাড়ে হাত চাপড়ে সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু দিনশেষে আমি নিজের কাছে হেরেছি। পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। নিজের অসহায়ত্বে জেগে থাকা রাতে হেসেছি।
- আচ্ছা যা হওয়ার হয়েছে। এরপর সব ঠিক হবে। মিম আবার তোমার সাথে খেলবে। জামিলের সাথে তোমার কিভাবে পরিচয়??
-উনি আমার এলাকার বড় ভাই। একবার উনি মস্ত বড় বিপদে পড়েছিলেন। আমি একটু হেল্প করেছিলাম। সত্যি বলতে তা পরে আর করা হয়নি। তবু জামিল ভাইয়ের নজরে আমি নাকি ভিনগ্রহের প্রাণী!!
-ঠিকি তো। জামিলের ওয়াইফের জন্য তুমি কিডনি ডোনেট করতে প্রস্তুত ছিলে। সব টেস্টিং সম্পন্ন হয়েছিল। শুধু ট্রান্সপ্লান্ট করা বাকি ছিল।
-বাকি ছিল। কিন্তু হয়নি তো। পরে অন্যখান থেকে ডোনেটকারীর সন্ধান মিলে। ---এতে তো তোমার ভূমিকা ছিল ভাবনার বাইরে।
তুমি কোনোকিছুর বিনিময় ছাড়াই কিডনি ডোনেট করতে রেডি ছিলে। কতজন এমন করে। আর তাই আজো জামিল কৃতজ্ঞ।
-স্যার, মূলকথায় আসি?
-হ্যাঁ অবশ্যই।তবে যে প্রশংসার যোগ্য তা করা উচিৎ। আচ্ছা আজ তুমি যাও। মানসিক প্রস্তুতি নিতে তোমার হয়তো সময় লাগবে। আমি তোমাকে পরে ডেকে নিবো।
-না স্যার কোন সময় লাগবে না। আমি প্রস্তুত মানসিক ভাবে। আপনি শুধু বলেন আমাকে কখন মরতে হবে??
.
সাদেকুল সাহেব আমার কথায় হাসলেন। কিছুটা তাজ্জব হলাম। একটা মানুষের সাথে তিনি মৃত্যুচুক্তি করতে চলেছেন, এতে হাসার কি আছে মাথায় আসলো না। ভদ্রলোক হাসা থামিয়ে বললেন, তুমি ভাবছো লোকটা আমার মৃত্যুর কথায় হাসছে কেমন করে, তাই না??
আমি মাথা নাড়লাম।
তিনি বললেন, তোমাকে জীবন দিতে হবে না। তোমাকে একটু ঝালিয়ে নিলাম। সব আমার মেয়ের সঙ্গের দোষ।
একথা বলেই ভদ্রলোক আবার হেসে উঠলেন। আমার তখনো মাথায় আসছে না তাহলে আমাকে কি করতে হবে।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমার সাথে উপরের রুমে চল। এখান থেকে তোমার পরীক্ষা শুরু।
.
এক যুবতি মেয়ে আরেক পূর্ণবয়স্ক মহিলার সাথে খেলা করছে। মেয়েটার বিহেভিয়ার নরমাল না। হয়তো অটিস্টিক হবে।
সাদেকুল সাহেব বললেন, অভ্র কি ভাবছো??
- উনি আপনার কন্যা??
- হুম। হয়তো খেয়াল করেছ ওর বিহেভিয়ার নরমাল না। আজ থেকে কয়েকবছর আগে মেয়েটা অন্যরকম ছিল। সারাবাড়ি মাতিয়ে রাখতো। কিন্তু একদিন সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। মেয়েটা চোখের সামনে নিজের মাকে দুর্ঘটনায় মরতে দেখেছে। আর এর ফলে মেয়েটার মস্তিষ্কে প্রভাব পড়ে।
.
ভদ্রলোকের চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। আর একটু হলে হয়তো কেঁদে ফেলবে। পকেট থেকে রুমাল বের করে উনার দিক এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক চোখ মুছে বললেন, মেয়েটা ছাড়া এ দুনিয়ায় আমার আপন বলতে আর কেউ নেই। ভয়ে থাকি সবসময়, এই জালিম দুনিয়ার মানুষের নজর থেকে তাই তো আড়ালে রেখেছি। কিন্তু কদিন আগে মেয়েটা বায়না ধরে বাইরে যাবে। নিজ মুখ সে আমার কাছে কিছু চেয়েছিল; না বলতে পারিনি। অফিসের জুনিয়র কলিগের বিয়েতে নিয়ে যাই ওকে। সেখানে সব বিপদের শুরু।
- কেমন বিপদ??
- মেয়েটার মনে বিয়ে নিয়ে কৌতূহল জাগে সেখানে। আমাকে বলে কি, বাবা বিয়ে হলে কি হয়?? হাসি মুখে বলেছিলাম, মেয়েদের দ্বিতীয় জন্ম হয়। নতুন এক দুনিয়ায় পদার্পণ করে।
- তো আপনার মেয়ে এখন বিয়ে করতে চায়, তাই তো??
- তোমার বাস্তবিক জ্ঞান প্রখর দেখছি। হু মেয়েটা এখন বিয়ে করতে চায়। আজ মাসখানেক ধরে খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে বিয়ের স্বপ্ন বুনে চলেছে। ডাক্তার বলেছে, মেয়ের কথামতো কাজ করতে। তাহলে হয়তো আবার সে স্বাভাবিক হবে।
- হু বুঝলাম। এখানে আমার কি কাজ?
- এই তো ছোট জিনিসটা ধরতে পারলে না। ডাক্তারের কাছে এমন কথা শুনার পর ছেলে খোজা শুরু করি। এমন কেউ যে বিপদে আছে। চুক্তির বিনিময়ে আমার কাজ করে দিবে।
- ওহ তাহলে আপনার মেয়ের জন্য ছেলে কি আমায় খুঁজতে হবে!!!!
ভদ্রলোক আমায় আর কিছুনা বলে রুমের ভিতরে যেতে বললেন।
দুই.....
ভাবতে পারছি না কি করবো! হুট করে মিমের অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়েছে। মিমের যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্রিটমেন্ট শুরু করতে হবে। কিন্তু আমি ই বা কি করবো!!! গরীবের ঘরে বড় কিছুর কথা খাপ খায় না। রোগের ক্ষেত্রেও তাই। বড়লোকের ঘরে বড়বড় রোগ হলেই শোভা পায়। দাদিমা বেচে থাকাতে নিজের কোনদিন চিকিৎসা করান নি। দাদির যকৃতের ব্যামো ছিল। দাদি বলতেন গরীবের জন্য জ্বর সবচে বড় রোগ। এর উপরে রোগ হলে চিকিৎসা করেও যদি মরে যাই আফসোসের সীমা রবে না। দুটো ভাত ই জোটে না। দাদিমার কথা গুলো আজ চিরন্তন বাণী মনে হচ্ছে।
.
সেদিন সাদেকুল সাহেব যখন বলল তার মেয়ে বিয়ে করতে হবে, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পরে উনার দৃঢ়তা দেখে বিশ্বাস করতে হয়েছিল।
দুজন কে রুমে রেখে সাদেকুল সাহেব নিচে নেমে যায়। মন দুরুদুরু করছিল। না জানি মেয়েটা কি করে!! হয়তো কিছু প্রশ্ন করবে। শ্বশুরকুল সম্পর্কে জানতে চাইবে, আমি কি করি? ইনকাম কত করি?? তাও জানতে চাইতে পারে।
কিন্তু না!! আমার সব জল্পনাকল্পনা গুড়ো করে মেয়েটা আমার কাছে আসার চেষ্টা করে! আমার তখন মনে হচ্ছিল, এই বুঝি হার্ট স্ট্রোক করবো। এ অনুভূতি আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন ছিল।
বিপদগ্রস্ত ছিলাম কিন্তু মন বিবেক বেচে খেতে দেয় নি। গরীবের ব্যাংক হিসাব শূন্য হলেও এই আত্মসম্মানবোধ ই যে তার অমূল্য সম্পদ!! ফিরে চলে আসি সেদিন ; আর যোগাযোগ করিনি।
আজ মনে হচ্ছে ফিরে যাবো নাকি? পেটে ক্ষুধা রেখে আত্মসম্মানের বড়াই করলে চলে!!! যাই করি আমি; একটা জীবন তো বাচতো।
.
অভ্র কাঁদছিস কেন!!!
সব ঠিক হয়ে গেছে। আর কাঁদিস না ভাই।
.
আমি কান্না করছি??
হাত দিয়ে দেখলাম সত্যি চোখের কোনে জল। তা মুছে নিলাম। মাথা তুলে দেখি মেসমালিক; মিমের আব্বু দাঁড়িয়ে। পাশে সাদেকুল সাহেব। তিনি তাহলে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
.
মিম ঘুমিয়ে আছে। আমি পাশে ওর হাত ধরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল করিনি। সন্ধে বেলা নার্স এসে আমায় জাগিয়ে তুললো। ঘড়িতে দেখি মাগরিব নামাযের সময় আর নেই। এশার সময় কাজা পড়ে নেওয়া যাবে। এখন আমাকে সাদেকুল সাহেবের বাসা যেতে হবে। আজ যা হওয়ার হবে। তার আগে নার্সের কাছে সব রিপোর্ট বুঝিয়ে নিলাম। নার্স হয়তো এতে বিরক্ত হচ্ছে কিন্তু আমি যে শান্তি পাবো না মনে এ না হলে!!
.
সাদেকুল সাহেব যখন বললেন, মেয়েটা তোমায় ঝালিয়ে নিয়েছে; আমি যেন দ্বিতীয়বারের মতো জন্ম নিয়েছিলাম।
আজি রেজিস্ট্রি হবে, মানে বিয়ে হবে। আমি এতো তোরজোড় দেখে খানিকটা অবাক হয়েছি। পরে সাদেকুল সাহেব নিজেই বললেন, মেয়ে তোমার উপর বড্ড ইমপ্রেস। তাই আর দেরি করতে চায় না। সুদূর ভবিষ্যৎ এ কি হবে জানা নেই। তাই বলে তো উপরওয়ালার কাছে হাতদুটো তুলে শোকরিয়া আদায় করতে ভুলতে পারি না। আমি সাদেকুল সাহেবের কাছে কিছু সময় চেয়ে নিলাম। এশার আযান দিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি; মসজিদে নামায পড়ে নতুন জীবনের দোয়া করবো।
.
মেয়ের নাম অর্পিতা। রেজিস্টার্ড খাতায় সবকিছু লেখা হচ্ছিল। তাতে সাইন করার আগে সাদেকুল সাহেব কে কিছু বলার ছিল। কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। আরেকটা জিনিস মাথায় ঘোরপ্যাঁচ খাচ্ছিল। সাদেকুল সাহেব কিছু সময়ের জন্য আমাকে জামাই বানাচ্ছে নাকি সাধারন আর দুটো দম্পতির মতো আমরাও সংসার করবো। এর সাথে আরো কিছু বলতে চাই। সাহস ই পাচ্ছি না।
.
সাদেকুল সাহেব আমার মনের দোদুল্যমানতা হয়তো বুঝতে পারলেন। বললেন, অভ্র কিছু বলতে চাও?
বললাম, আপনার কাছে শুধু মিমের চিকিৎসার টাকা নেওয়ার কথা ছিল, তা হয়ে গেছে। এর বেশি কিছু আমি চাই না। মানে আমি যা উপার্জন করি বা করবো তা দিয়ে আপনার মেয়ের ভরণপোষণ করতে চাই। বিশ্বাস করেন আপনার মেয়ে অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না।
সাদেকুল সাহেব আমার কথায় হেসে ফেললেন। বললেন, মেয়ের সাথে তোমার কথার বড্ড মিল দেখছি। আমি জামাই খুঁজতে ভুল করিনি তাহলে।
আমার একথায় কেমন জানি লাগলো। হয়তো লজ্জা পেলাম। উহু!! তা হতে যাবে কেন?? আমি তো উনার মেয়েকে তো ঠেকায় পরে বিয়ে করছি নাকি অন্যকিছু!!!
.
লাল বেনারসি তে অর্পিতা এসে আমার সামনে বসলো। সেদিন ভয়ার্ত চোখে ওকে দেখেছিলাম। আজ অন্যরকম লাগছে। ঠিক বাঙ্গালী আর দুচারটা বউয়ের মতো!
অবশেষে বিয়েটা হলো। আমার যে বিয়ে হবে ভাবনার বাইরে ছিল। আসলে নিজের ছন্নছাড়া জীবনে কাউকে জড়ানোয় রাজি ছিলাম না।
.
বিদায় নেওয়ার আগে অর্পিতা খুব করে কান্নাকাটি করলো। নিজে হাত ধরে সাদেকুল সাহেব মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিলেন। আমার হাত ধরলেন তিনি। বললেন, মেয়েটার বুঝ হয়নি এখনো। হলেও তা কম। বুঝেশুঝে সবকাজ করিও। তোমার সাথে আমি কোনো ডকুমেন্টের ভিত্তি সম্পর্ক গড়তে চাইনা। উকিল বলেছিল দলিলে তোমার সাইন নিতে। কিন্তু আমার বিশ্বাস আছে তোমার উপর।
সাদেকুল সাহেবের শেষ কথার মর্মার্থ বড্ড গভীর ছিল। তাকে আশ্বস্ত করলাম, অর্পিতার মত না থাকার আগপর্যন্ত ওর কাছে আসবো না। অর্পিতা সবসময় ই আপনার মেয়ে থাকবে। আপনার যখন মন বলবে ওকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারেন।
.
কথাবার্তা খম করে গাড়ি তে বসলাম। আস্তে আস্তে এর গতি বাড়ছে। অর্পিতা যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় সাদেকুল সাহেব কে দেখছে। চোখদুটো দিয়ে পানি অনবরত পড়ছে। অর্পিতার মানসিক অবস্থা যাই হোক না কেন!! সে আগে নারী। আপনজন ছেড়ে চলে যাওয়াস কষ্ট পেতে বুঝ হওয়ার দরকার পড়ে না। এক অবুঝ শিশু তার মায়ের কাছ থেকে দূরে গেলেও তো কান্না করে।
.
তিন.....
.
মেসে আসবাবপত্র বলতে পড়ারটেবিল আর সিঙ্গেল বেডটা রয়েছে। সাথে রান্না করার জিনিসপাতি। বিছানার চাদর বিশ্রী গন্ধ করছে। ওদিকে অর্পিতা আমার বই গুলো দেখছে। এই ফাকে আমি বিছানার চাদর বদলে নিলাম। ঘড়িতে দেখি রাত বড্ড হয়েছে।
অর্পিতা কে বললাম, এই শুনেন?? আসেন শুয়ে পড়বেন।
একথা পরপর কয়েকবার বললাম। কোনো জবাব নেই। হাফিয়ে গিয়ে বিছানাতে বসে পড়লাম।
হুট করে অর্পিতা বলল, আমি অচেনা কেউ না তো। আমি কারো বউ। তাই আপনি করে বললে শুনবো না হু!
এই মেয়ে বলে কি!!!
আমি খানিক অবাক হয়ে হাসলাম। বললাম, এই শুনো? আসো শুবে।
এবার অর্পিতা হেসে বিছানার কাছে আসলো। বললাম, বিছানায় শুয়ে পড়ো।
অর্পিতা বলল, আর আপনি??
.
মেয়েটা তো বড্ড বদমাইশ। আমাকে তুমি করে বলতে বলে নিজে আপনি করে বলছে। বললাম, আমি নিচে পাটি বিছিয়ে শুবো।
অর্পিতা এ কথা শুনে চোখ রাঙ্গালো। ব্যস, এতেই অতো সুন্দর করে গুছানো বিছানা থেকে তোশক সরাতে হলো। এতোটুকু বিছানায় তো দুজন শোয়া যাবে না।
নিজের উন্নতি তে অবাক হলাম। কিচ্ছু সময়ে অর্পিতার মনের কথা পড়ে নিলাম।
.
আজ আর অফিস যাই নি। সবার আগে একটা খাট আর টিভি কিনতে হবে। জমানো টাকা যা আছে এতে হয়ে যাবে। কিন্তু অর্পিতা কে নিয়ে সমস্যায় পড়লাম। এই গরমে ওকে নিয়ে বের হওয়া ঠিক হবে না। অর্পিতা কে বললাম, তোমাকে জামিল ভাইয়ার বাসায় রেখে আসি?? আমাকে বেরুতে হবে।
অর্পিতা বলল, কোথায় যাবেন?? নিশ্চয় অফিস যাবেন না।
বললাম, মার্কেটে যাবো। তোমাকে তো রোজ রোজ আর পাটি তে শুতে দিতে পারি না। আর অফিস যাবো কাল থেকে। তোমার সময় কাটানোর কিছু ব্যবস্থা তো করতে হবে নাকি!! তাই ভাবছি একটা টিভি কিনলে কেমন হয়।
অর্পিতা হতদম্ভ লাগলো মনে হয়। নিশ্চয় বিশ্বাস করতে পারছে না; আমি ওকে নিয়ে এতো টা ভাবছি। না ভেবে উপায় আছে, আমি যে ওকে ভালো রাখার ওয়াদা করেছি কারো কাছে।
খানিক পর অর্পিতা খুশি হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে আমিও যাবো।
.
অর্পিতা ভুলবশত হলেও আমার পছন্দের কালো শাড়ি পড়েছে। মেয়েটাকে কতোটা সুন্দর লাগছিলো বুঝাতে পারবো না। কিন্তু একটু পরে বুঝতে পারলাম অর্পিতা ঠিকমতো শাড়ি পড়তে পারে নি। কুচি যেমনতেমন করে গিট দিয়েছে।
অর্পিতা কিছু বলতে চেয়েও বলল না। আমি ওকে কাছে ডাক দিলাম। তারপর ওকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কুচি করা শেখালাম। সমস্যা হলো কুচি গিট করা নিয়ে। অর্পিতা কে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছি। একটু পর অর্পিতা মুচকি হেসে কুচি নিজ হাতে নিলো। আর আমিও জান ফিরে পেলাম।
রিক্সায় প্রথম কোনো রমণীর সাথে বসা। অনুভূতিটা অন্যরকম লাগছিল। রাস্তা ভালো না হওয়ায় ভয় করছিল অর্পিতা কে নিয়ে, ওহ ঠিক মতো বসেছে তো। মন বলছিল ওর হাতদুটো ধরে রাখি। তবে সাহস পেলাম না।
.
এখন মীমকে দেখতে হসপিটাল যাচ্ছি। বউয়ের আদেশ, মান্য না করে উপায় আছে। ততক্ষণে অর্পিতা ঠিকি আমার বাম হাত ওর দুটো হাতের মাঝখানে শক্ত করে ধরে রেখেছে। অর্পিতা অনেকটা স্বাভাবিক কিন্তু আমার হার্ট যেন উসাইন বোল্ট হয়ে গেছিলো। বড্ড জোরে ধুকপুক করছে।
.
মিমের সাথে দেখা করে মার্কেটের কাজ সেরে নিলাম। সকালবেলা অর্পিতা কিছু খায় নি। তাই একটা রেস্তোরায় আসলাম। সিটে বসে বললাম, আচ্ছা কি খাবে??
অর্পিতা হেসে বলল, আইসক্রিম।
বললাম, খালি পেটে কেউ আইসক্রিম খায় নাকি।
আমার কথায় অর্পিতা মুখ ফুলিয়ে নিলো। অর্পিতা কে এমন সময় পিচ্চি কিউট একটা বাচ্চা লাগছিল।
বললাম, আগে হালকা কিছু খেয়ে নেই। তারপর আইসক্রিমও নিয়ে দিবো।
এতেই অর্পিতার মুখে হাসি ফুটলো আর ঠিক করে বসলো।
.
সব্বাই আমাদের দিক তাকিয়ে আছে। দু প্লেট বিরিয়ানি অর্ডার করতে গিয়েও অর্পিতা দিলো না। আমাকে খাইয়ে দিতে হবে। তাও আবার চামচ দিয়ে না। এক প্লেটে নাকি দুজন কে খেতে। আর এতেই বদমাইশ লোকগুলো মজা নিচ্ছে।
খাওয়ার ফাকে বললাম, তোমাকে এমন করে আগে কেউ খেয়ে দিতো বুঝি??
অর্পিতা একটু ভাবলো। তারপর বলল, না দুজন স্বামী স্ত্রী খেতে দেখেছি। কিন্তু মনে পড়ছে না।
নিশ্চয় ওর বাবা মা হবে। অর্পিতার রোগ বলতে কিছু হয়নি। শকট খেয়েছিল শুধু। আমার বিশ্বাস ভালো কিছু মুহূর্ত কাটালে ঠিক স্বাভাবিক হবে।
.
মেসে ফিরে দেখি খাট আর টিভির গাড়ি এসে গেছে।ওগুলো নামিয়ে নিলাম। দুজন মিলে সেটিং করলাম। রাত হওয়াতে ডিশ সংযোগ দেয়া আর হলো না। অর্পিতা বোর ফিল করবে না তো?? তাই অর্পিতা কে বললাম, এবার ঈদে ভালো ভালো নাটক হয়েছিল। আমার কাছে কালেকশন আছে। দেখবে??
অর্পিতা আহ্লাদিত হয়ে বললাম, সিয়ামের নাটক আছে নিশ্চয়। ওকে আমার যা লাগে না। আমার প্রথম ভালোবাসা।
একথা বলে অর্পিতা ফ্রেশ হতে গেলো। অর্পিতার মুখে সিয়াম কথা শুনে বুকের বাম পাশটা চিনচিন করে উঠলো। আগে প্রেমিকদের জন্য তাহসান নামক পেইন ছিল। প্রেমিকার মুখে গুনগান শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ না হয়ে উপায় ছিলো না। এখন নতুন কিছু হচ্ছে। সত্যি এরা আমাদের প্রেমিক সমাজের জন্য পেইন।
.
সিয়াম কে পেইন বলে ভুল করিনি। ওর এখন পর্যন্ত দুটো নাটক দেখলাম। দুটো নাটকে সিয়াম ওর প্রেমিকার নাম ছোট করে ডাকে। এই ধরুন মৌনতা থেকে মৌ, সানজিদা থেকে সনজু। এখন অর্পিতা বায়না ধরেছে ওকেও ছোট্ট নামে ডাকতে হবে।
নাটক আর কি দেখবো; গবেষণায় লেগে গেলাম। অর্পিতা কে ছোট্ট করে কি নামে ডাকা যায়। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম অর্পি। অর্পিতা থেকে অর্পি।
.
বেশ সময় চলে গেছে। এ সময়টাতে অর্পি কে বুঝার বেশ সময় পেয়েছি। নতুন ছোট্ট একটা বাসা নিয়েছি। নতুন বাসার কিচেনে রোজ অর্পির রান্নার ইনভেনশনস চলে। অফিসে থেকে ফিরে আমাদের নাটক দেখার আসর জমে। বাংলা চ্যানেল গুলো তো সব খবর দেখাতে ব্যস্ত থাকে। আর ভারতীয় কিছু মুভি ছাড়া সিরিয়াল আমি ওকে দেখতে দেই না।তাই নিয়ম করে রোজ নাটক ডাউনলোড দিতে হয়।
.
অর্পি চিন্তা করলে কপালে ভাজ পড়ে। কাজ করে টায়ার্ড হলে হাতদুটো শূন্যে নাড়াচাড়া করে। কপালের টিপ টা একটু বাকা করে পড়ে । অর্পি আমার কাছে এখন ঠিক যেন সমাধা করা কোনো উকিলের কেসের মতো। সব পরিষ্কার, সব।
.
মহরম আর পূজা সামনে। তাই অফিস ছুটি। বাসায় বসে পেপার পড়ছিলাম। আর মহারাণী রান্নাঘরে পাক্কা বাঙ্গালি বউয়ের মতো রাধতে ব্যস্ত। তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি সাদেকুল সাহেব। আমি সালাম দিলাম।
ভদ্রলোক বাসা গোয়েন্দার মতো পর্যবেক্ষণ করছে। কিছুক্ষণ পর বলল, মনে হচ্ছে যেন অর্পিতার আগের রুমে ঢুকে পড়েছি। তুমি তো সবকিছু ওর মতো সাজিয়েছ দেখছি।
আমি জবাবে কিছুনা বলে হাসলাম। এতদিনে নিজেকে অর্পির মতো করে গড়তে মননিবেশ করেছি। কি জন্য করেছি জানি না। হয়তো মায়া জন্মেছে ওর উপর।
সাদেকুল সাহেবের সাথে বেশ কথা হলো। একসময় তিনি বললেন, অর্পিতা কে আমি নিতে এসেছি। মনে করো আমাদের চুক্তি এখানে শেষ।
এই একথায় আমার পৃথিবী থমকে গেলো। অর্পি শুধু আমার বউ নয়; এতদিনে আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে। অর্পি কে ছাড়া যে আমি বাচবো না তা নয়। কিন্তু ওকে ছাড়া আমি বাচতে চাই না।
.
কি হলো?? কখন থেকে আপনাকে চা নিয়ে যেতে বলছি। নাহলে যে আপনার মাথাব্যথা শুরু হবে।
.
অর্পি একথা বলতে বলতে রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। বাবা কে দেখামাত্র ইমোশনাল হয়ে গেলো। বলল, এতদিন মনে পড়লো বুঝি!!
সাদেকুল সাহেব বললেন, মনে তো তাকে পড়ে যাকে ভুলা যায়। আমি কি তোকে ভুলতে পারি মা!!
- হয়েছে হয়েছে। এসব কথায় আমি গলছি না।
এরপর বাবা মেয়ে ভালোমন্দ বহুত কথা বলল। এদিক আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। শেষবারের মতো একবার অর্পি জড়িয়ে বিদায় বলার ইচ্ছে হচ্ছিল বড্ড।
.
অর্পি কে বললাম রেডি হয়ে নিতে।
অর্পি অবাক হয়ে বলল, কেনো? কোথাও যাচ্ছি আমরা??
বললাম, বাবা তোমাকে নিতে এসেছে একেবারে।
একথা শোনামাত্র অর্পি চট করে আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। আমাদের সামনে যে সাদেকুল সাহেব বসে আছে তা সত্ত্বেও। একটু পর বলতে লাগলো, আমি যাবো না, যাবো না, না না না।
সাদেকুল সাহেবের চোখে জল দেখলাম। তিনি বললেন, নারে মা তোর বর মজাক করছে।
অর্পি আমায় জোরে চিমটি কাটলো। লেগেছে বহুত। শ্বশুর মশায় সামনে বসে থাকায় নিজের কষ্ট শব্দে রুপ দিতে চেয়েও পারলাম না।
.
সাদেকুল সাহেব আমার প্রতি সন্তুষ্ট বুঝা শেষ। শ্বশুর মশায় চলে যেতে চাইলে আমি আটকালাম। অর্পির এক কথা দুপুরবেলা খেয়ে যেতে হবে। ওর কথা মানে আমার কথা।
শ্বশুর মশায়কে হালকা চা নাস্তা দিয়ে রান্নাঘরে অর্পি ডাক দেওয়া তে গেলাম। গিন্নী এক এক করে খরচ বলছে। আর আমি লেখা বাদ দিয়ে ওর দিক তাকিয়ে আছি। বদ মেয়ে আবার আমায় চিমটি কাটলো!!! এবার অর্পির ছেলেমানুষি তে হেসে ফেললাম। জীবনের সবচে বড় উপরহার টা সাদেকুল সাহেব আমাকে দিয়েছে। অর্পি আমার জীবনের সাদাকালো অধ্যায়ের রঙ্গিন মলাট। আমার জীবনে সুন্দরতা এই রঙ্গিন মলাট!!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.