নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সব থেকে সব পরিচয় আমি একজন মানুষ

দুর্জয় রায়

লেখক হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তবে, মাঝে মাঝে লিখতে ভালো লাগে

দুর্জয় রায় › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প:- স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:১২


এই শুভ্র, শুভ্র ! এই শুভ্র ওঠো ৷ ডাক শুনে সাথে সাথে জেগে উঠি, শরীর ঘামে ভিজে গ্যাছে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকি ৷
প্রতিদিনের মত আজ ও দুঃস্বপ্নটা দেখি ৷
কেও একজন অনেকদূর থেকে আমাকে নাম ধরে ডাকে ৷ অস্পষ্ট ভাবে মুখটা দেখতে পাই, মায়াবী একটা মুখ, চোখে মোটা কাচের চশমা ৷
আমাকে ডাকছে আর চিৎকার করে কাঁদছে ৷
মুখটাকে অনেক চেনা চেনা মনে হয় ৷ মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটাকে জিগ্গেস করবো ৷
এই মেয়ে তুমি কাঁদছো কেনো ? আমার নাম জানলে কিভাবে?
কিন্তু তখন ই কোথা থেকে একটা কালো হাত এসে পেছন থেকে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে অন্ধকারের কোনো এক অতল গহ্বরে ফেলে দেয় ৷ তখন ঘুমটা ভেঙে যায় ৷
ঘড়ির দিকে তাকাই আজো ভোর হয়ে গ্যাছে ৷ আবার ঘুম দেই ৷ একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৷
.
মা ছোটো বেলায় মারা গ্যাছে , বাবা আবার বিয়ে করেছে প্রতিমাসে টাকা পাঠিয়ে বাবার দায়িত্ব শেষ ৷
কখনো শরীর কেমন আছে কথাটাও জিগ্গেস করে না ৷
বাড়ি গেলে সৎ মায়ের মানষিক অত্যাচার ৷
তাই শহরে বাসা নিয়ে একা একাই থাকা হয় ৷
মাঝে মঝে মনে হয় কেও যদি আমাকে একটু ভালোবাসা দিতো তার জন্য আমি জীবনটা দিয়ে দিতেও রাজি হতাম ৷
.
আজকেও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে অনেক রাত হয়, বাসায় ফিরতে হবে ৷
আমিও উঠি মাথাটা কেমন জানি ঝিমঝিম করে ওঠে, আজেবাজে জিনিস খেয়ে বমি তুলি, কিরে শুভ্র তুই যাবি না?
তোরা যা আমি পরে যাবো ৷
সবাই নিজ নিজ বাসায় ফেরে ৷ কিছুক্ষণ পর আমিও উঠি ৷
বুঝতে পারছি শরীরের টেম্পারেচার ধিরে ধিরে বাড়ছে,শরীর খারাপ হচ্ছে , জ্বরটা আবার আসছে ৷
চোখ বুজি মাথাটা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগে , বাসায় ফেরার তাড়া নেই ৷
সেখানে আমার জন্য কেও অপেক্ষা করে নেই ৷ চোখ বুজে রুমের প্রতিটি জিনিসকে অনুভব করার চেষ্টা করি , টেবিলে রেখে দেয়া বুয়ার রান্না করা খাবার, বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা অনেকগুলো ম্যাগাজিন , অবহেলা অযত্নে ধুলো জমে থাকা ল্যাপটপ ৷সব
সব কিছু থাকলেও সেখানে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই ৷ বুকের মধ্যে তখন কেমন জানি চিনচিনে ব্যাথা হয় ৷
.
টলতে টলতে রাস্তাই উঠি, আজকে সারাটা শহর হাটবো ৷
এটা ধনি ব্যাক্তিদের এলাকা , কাওকে চোখে পড়ে না ৷ কিছুক্ষণ পর পর ঝিঝি পোকারা গান গেয়ে ওঠে , আমি ধমক লাগাই ৷ কিছুক্ষণ পর আবার গান গাওয়া শুরু করে ৷
আমি হাটতে থাকি শতশত মানুষেরা রাস্তায় সংসার পেতেছে ৷ সারাটাদিন পরিশ্রম করে এখন পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে ৷
চোর, রিক্সাওয়ালা, পান ওয়ালা ৷ সবাই একি রাস্তার বাসিন্দা তবু কারো কিছু হারানোর ভয় নেই ৷ মা তার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে ৷
.
-এই মানুষগুলোর সাথে নিজের জীবনকে মেলাতে পারি না ৷ শরীরের তাপমাত্রা অনেকগুন বেড়ে গ্যাছে ৷
আর হাটতে পারি না ৷
ক্লান্ত শরীর নিয়ে একসময় হাটু ভেংগে রাস্তায় শুয়ে পড়ি ৷
আকাশে কত সুন্দর চাঁদ উঠেছে ৷
দেখতে ভালো লাগছে ৷ মায়ের মুখটা কল্পনা করি, মা আমাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাচ্ছে ৷
সেই মায়াবী মুখ, কপালে কালো টিপ, চোখে দেয়া কাজল নিয়ে আমার কপালে টিপ দিয়ে দিচ্ছে ৷
তাকিয়ে থাকতে পারি না আর ৷ ধিরে ধিরে গভির এক অন্ধকারে হারিয়ে যাই ৷
.
কপালে ঠান্ডা একটা হাতের ছোয়ায় জেগে উঠি ৷
চোখ পিটপিট করে তাকাই আমার ওপর ছোট্টো একটা মুখ ঝুকে আছে ৷
নাহ এখনো হয়তো স্বপ্ন দেখছি, সাথে সাথে চোখ বুজি ৷ এখনি হয়তো চোখ খুলে দেখবো কেও নেই ৷ শহরের কোনো এক রাস্তার গলিতে হয়তো পড়ে আছি ৷
.
ছোট্টো গলার ডাক কানে আসে, মা,, ভাই চেতন পাইছে ৷
চোখ খুলে তাকাই, অচেনা পরিবেশ ৷ মধ্যে বয়স্ক এক ভদ্র মহিলা এসে কপালে হাত রেখে বলে
জ্বর ছাইড়া গ্যাছে , এই নিরু তোর ভাইকে এক গ্লাস গরম দুধ দে তো ৷
তুমি ভালো হইয়া যাবা বাবা, চিন্তা কইরো না ৷ শহরে গেছিলাম তুমি খালি গায়ে রাস্তাই পইড়া ছিলা, মনে হয় চোরে সব লইয়া গ্যাছে ৷
আমার মেয়ে নিরু ৷ অনেক আগে ওর বাপে মইরা গ্যাছে ৷
ওর এক ভাই ছিলো, ওর ভাই ওরে খুব ভালোবাসতো , রাতদিন ভাইএর পিছন পিছন ঘুরতো ৷
তোমাকে রাস্তায় পইড়া থাকতে দেইখা তোমাকে ওর ভাই মনে হয়, আমার পোলাটা একবছর হলো অসুখে মারা গ্যাছে ৷
তোমাকে নিয়ে আসার জন্য কান্না কাটি শুরু করে ৷ তাই এই গেরামে নিয়া আসছি ৷
তুমি ২দিন অচেতন ছিলা, নিরু সারাদিন সারারাত তোমার মাথায় পানি পটি দিছে ৷
ভদ্রমহিলা মুখে আচল গুজে কাঁদছে ৷
.
মা এর পেছনে ৯,১০ বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে ৷
ইশারায় কাছে ডাকি , বলি এই তুই আমার বোন হবি? তুই তো আমার ভাই, বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে মেয়েটি ৷
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ছোটোরা কত অদ্ভুদ ভাবে হাঁসতে পারে ৷
কেনো জানি মনে হয় মনে হয় এই সহজ সরল ২জন মানুষের জন্য আমি সব কিছু করতে পারি ৷
.
ভদ্রমহিলা জিগ্গেস করে ৷
আচ্ছা বাবা তোমার নাম কি? তোমাকে ভদ্দর ঘরের ছেলে মনে হয়, তোমার বাবা মা কে খবর দেই, আইসা লইয়া যাক ৷
মনে মনে পণ করি বেঁচে থাকতে আমি কখনো আর ফিরে যাবো না ৷ আর কখনো ঐ চার দেয়ালের মাঝে আটকে থাকবো না ৷
.
আমি উত্তর দেই ৷ আমার নাম শুভ্র, আমার কেও নেই ৷ আমাকে আপনাদের কাছে রাখবেন ?
আমার কিছু লাগবে না আপনাদের সব কাজ করে দেবো ৷ শুধু একবেলা খেতে দিলেই হবে ৷
....
.....তারপর অনেকদিন পার হয়ে গ্যাছে ৷
এখন আমি পুরোদমে কৃষকের ছেলে ৷ নিরুর মাকে মা ডাকি ৷ নিজের ছেলের মতই আদর করে ৷
গরুর ঘাস কেটে আনা থেকে শুরু করে সব কিছু করি ৷ মা মাঠে খাবার নিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে খাওয়ায়, আমি গোপনে চোখের জল মুছি ৷
রাতের বেলায় ছোট্টো নদীটির পাশে বসে জোৎস্না দেখি, আকাশের দিকে তাকিয়ে মাকে বলি, মা আমি অনেক ভালো আছি ৷
দেখো আমি তোমার বখে যাওয়া সেই খারাপ ছেলেটি আর নেই ৷
.
যৌতুক দিয়ে নিরুর বিয়ে দিলাম , বোনের স্বামী আমাকে সহ্য করতে পারে না, গেলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয় ৷
বোন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে ৷ বোনের কান্না দেখতে পারি না ৷ চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফিরি ৷
অসুস্থ মা এর চিকিৎসা করানোর জন্য ভিটে মাটি সব বিক্রি করে দিতে হয় ৷
.
হসপিটালের বেডে শুয়ে মা একদিন ডাকে, বাবা তুই শক্ত হ ৷ আমার সময় ফুরিয়ে আসছে ৷
মা এর হাত ধরে বলি, মা তোর কিছু হবে না ৷ নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি তোকে বাঁচাবো ৷
মা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আমি শক্ত হবার চেষ্টা করি ৷ তবুও চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ৷ আজ আবার নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় ৷
জীবনটাকে তীল তীল করে শেষ করে দেয়ার জন্য নেষা করে একটা কিডনি প্রায় নষ্ট হবার পথে আরেকটা কিডনি বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা করাই ৷
কিন্তু মাকে বাঁচাতে পারিনা ৷
আমি আবার সব হারিয়ে ফেলি ৷ ঝড় এলো স্নেহ,মমতা ভালোবাসার দেয়াল টাকে ভেংগে দিয়ে চলে গেলো ৷ পুরোটাই যেনো দুঃস্বপ্ন ৷
.
আমি আবার সব হারিয়ে শহরের পথে পাড়ি জমাই ৷ কয়েকটা বছরে শহরটা অনেক বদলে গ্যাছে ৷
রাতের শহরে অন্ধকার নিরিবিলি একটা জায়গা খুজে আমিও রাস্তার বাসিন্দা হয়ে যাই ৷
সারাদিন সারারাত এই রাস্তার গলিতে শুয়ে থাকি বসে থাকি , গলিটাকেই আপন মনে হয় ৷
কারো মায়া হলে দুই টাকা দিলে কিছু কিনে খাই ৷ না দিলে না খেয়েই দিন কেটে যায় ৷
.
সকালের সহজ সরল সুর্যটাকে উত্তপ্ত হতে দেখি ৷ রাতে চাঁদের আলো খেয়ে মনে মনে পেটের ক্ষুধা মেটাই ৷
এর মধ্যে কয়েকটা দিন কেটে গ্যাছে, অভ্যাস্ত হয়ে গেছি ৷
রাস্তার এই গলিটা ছাড়াও এই রাস্তার হাড্ডিসার কুকুরগুলোর ওপর মায়া জন্মে গ্যাছে ৷
এদেরকে কেও কখনো খেতে দেয় না ৷ একটা বিস্কিট খেতে দিলেও এরা তার ভক্ত হয়ে য়ায় ৷
কিছু খাওয়া জুটলে এদের না দিয়ে খেতে পারি না ৷ কুকুরগুলো সারারাত আমার চারপাশ ঘিরে শুয়ে থাকে ৷
ধিরে ধিরে শরীর দুর্বল হতে থাকে ৷ পেটের যন্ত্রণা টাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয় ৷
.
যখন যন্ত্রণা শুরু হয়, মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদি ৷ তখন চোখ দিয়ে অনর্গল জল বের হয় ৷
বুঝতে পারি আমার সময় ফুরিয়ে আসছে ৷
সেদিন দুপুর বেলায় কারা যেনো কুকুর গুলোকে ধরে নিয়ে যায় ৷
সারাটাদিন ঘোরের মধ্যে রাস্তাই পড়ে থাকি ৷ রাত্রিবেলায় শরীরের সব যন্ত্রণা, ব্যথা চলে যায় , আজ কুকুর গুলোও নেই ৷ একাকি রাস্তাই পড়ে থাকি ৷ আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে ৷ শেষ সময়ে ঝাপসা চোখে চাঁদটাকে দেখি ৷
আমার সময় ফুরিয়ে আসছে আমি চোখ বুঝি ৷
মনে হয় দুর থেকে কেও আমাকে ডাকছে ৷ এই শুভ্র ¡ শুভ্র ৷
খুব কষ্টে চোখের পাতা দুটি টেনে তোলার চেষ্টা করি ৷ আবছা অন্ধকারে মুখটাকে দেখি, স্বপ্নে দেখা সেই মায়াবী মুখ মোটা কাঁচের চশমা ৷
এই শুভ্র,,, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? তোমাকে কত খুজেছি ৷ তোমার এই অবস্থা কেনো? আমাকে চিনতে পারছো না? আমি তৃনা ... আমি ফিরে এসেছি ৷
এই শুভ্র .... মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে ৷ আমার মায়া লাগছে ৷
তৃণাকে চিনতে পারি, এটা সেই মেয়ে যাকে ভালোবেসেছিলাম ৷ ভেবেছিলাম এই মেয়েটিকে নিয়ে আমি নতুন করে বাঁচতে শিখবো ৷ কিন্তু মেয়েটি আমায় ছেড়ে গিয়েছিলো ৷
তৃণা শক্তকরে আমার হাত টা ধরে চিৎকার করে কাঁদছে ৷ এই শুভ্র ওঠো ,, তোমার কিচ্ছু হবে না , এই শুভ্র ... ওঠো ৷
চোখের কোনা দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ৷ কেনো জানি আবার এই মেয়েটির জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করছে ৷
মনে মনে বলি সত্যি যদি ভালোবাসো আমাদের আবার দেখা হবে ৷
কোনো এক ছোট্টো শহরের গলির মোড়ে, কিংবা কোনো ছোট্টো একটি গ্রহের দুটি প্রানি হিসেবে , আমরা আবার ভালোবাসবো ৷
.
শুভ্র হারিয়ে যায় ৷
শুভ্ররা আর কখনো ফিরে আসবে না ৷
কিন্তু বিশাল এই পৃথিবীর, ছোট্টো একটি রাস্তার এই ছোট্টো গলিটি শুভ্রর প্রতিটি দুঃখ-কষ্টের সাক্ষী হয়ে থাকবে আজীবন ৷
এই শুভ্র, শুভ্র ! এই শুভ্র ওঠো ৷ ডাক শুনে সাথে সাথে জেগে উঠি, শরীর ঘামে ভিজে গ্যাছে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকি ৷
প্রতিদিনের মত আজ ও দুঃস্বপ্নটা দেখি ৷
কেও একজন অনেকদূর থেকে আমাকে নাম ধরে ডাকে ৷ অস্পষ্ট ভাবে মুখটা দেখতে পাই, মায়াবী একটা মুখ, চোখে মোটা কাচের চশমা ৷
আমাকে ডাকছে আর চিৎকার করে কাঁদছে ৷
মুখটাকে অনেক চেনা চেনা মনে হয় ৷ মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটাকে জিগ্গেস করবো ৷
এই মেয়ে তুমি কাঁদছো কেনো ? আমার নাম জানলে কিভাবে?
কিন্তু তখন ই কোথা থেকে একটা কালো হাত এসে পেছন থেকে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে অন্ধকারের কোনো এক অতল গহ্বরে ফেলে দেয় ৷ তখন ঘুমটা ভেঙে যায় ৷
ঘড়ির দিকে তাকাই আজো ভোর হয়ে গ্যাছে ৷ আবার ঘুম দেই ৷ একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৷
.
মা ছোটো বেলায় মারা গ্যাছে , বাবা আবার বিয়ে করেছে প্রতিমাসে টাকা পাঠিয়ে বাবার দায়িত্ব শেষ ৷
কখনো শরীর কেমন আছে কথাটাও জিগ্গেস করে না ৷
বাড়ি গেলে সৎ মায়ের মানষিক অত্যাচার ৷
তাই শহরে বাসা নিয়ে একা একাই থাকা হয় ৷
মাঝে মঝে মনে হয় কেও যদি আমাকে একটু ভালোবাসা দিতো তার জন্য আমি জীবনটা দিয়ে দিতেও রাজি হতাম ৷
.
আজকেও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে অনেক রাত হয়, বাসায় ফিরতে হবে ৷
আমিও উঠি মাথাটা কেমন জানি ঝিমঝিম করে ওঠে, আজেবাজে জিনিস খেয়ে বমি তুলি, কিরে শুভ্র তুই যাবি না?
তোরা যা আমি পরে যাবো ৷
সবাই নিজ নিজ বাসায় ফেরে ৷ কিছুক্ষণ পর আমিও উঠি ৷
বুঝতে পারছি শরীরের টেম্পারেচার ধিরে ধিরে বাড়ছে,শরীর খারাপ হচ্ছে , জ্বরটা আবার আসছে ৷
চোখ বুজি মাথাটা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগে , বাসায় ফেরার তাড়া নেই ৷
সেখানে আমার জন্য কেও অপেক্ষা করে নেই ৷ চোখ বুজে রুমের প্রতিটি জিনিসকে অনুভব করার চেষ্টা করি , টেবিলে রেখে দেয়া বুয়ার রান্না করা খাবার, বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা অনেকগুলো ম্যাগাজিন , অবহেলা অযত্নে ধুলো জমে থাকা ল্যাপটপ ৷সব
সব কিছু থাকলেও সেখানে জীবনের কোনো চিহ্ন নেই ৷ বুকের মধ্যে তখন কেমন জানি চিনচিনে ব্যাথা হয় ৷
.
টলতে টলতে রাস্তাই উঠি, আজকে সারাটা শহর হাটবো ৷
এটা ধনি ব্যাক্তিদের এলাকা , কাওকে চোখে পড়ে না ৷ কিছুক্ষণ পর পর ঝিঝি পোকারা গান গেয়ে ওঠে , আমি ধমক লাগাই ৷ কিছুক্ষণ পর আবার গান গাওয়া শুরু করে ৷
আমি হাটতে থাকি শতশত মানুষেরা রাস্তায় সংসার পেতেছে ৷ সারাটাদিন পরিশ্রম করে এখন পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে ৷
চোর, রিক্সাওয়ালা, পান ওয়ালা ৷ সবাই একি রাস্তার বাসিন্দা তবু কারো কিছু হারানোর ভয় নেই ৷ মা তার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে ৷
.
-এই মানুষগুলোর সাথে নিজের জীবনকে মেলাতে পারি না ৷ শরীরের তাপমাত্রা অনেকগুন বেড়ে গ্যাছে ৷
আর হাটতে পারি না ৷
ক্লান্ত শরীর নিয়ে একসময় হাটু ভেংগে রাস্তায় শুয়ে পড়ি ৷
আকাশে কত সুন্দর চাঁদ উঠেছে ৷
দেখতে ভালো লাগছে ৷ মায়ের মুখটা কল্পনা করি, মা আমাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাচ্ছে ৷
সেই মায়াবী মুখ, কপালে কালো টিপ, চোখে দেয়া কাজল নিয়ে আমার কপালে টিপ দিয়ে দিচ্ছে ৷
তাকিয়ে থাকতে পারি না আর ৷ ধিরে ধিরে গভির এক অন্ধকারে হারিয়ে যাই ৷
.
কপালে ঠান্ডা একটা হাতের ছোয়ায় জেগে উঠি ৷
চোখ পিটপিট করে তাকাই আমার ওপর ছোট্টো একটা মুখ ঝুকে আছে ৷
নাহ এখনো হয়তো স্বপ্ন দেখছি, সাথে সাথে চোখ বুজি ৷ এখনি হয়তো চোখ খুলে দেখবো কেও নেই ৷ শহরের কোনো এক রাস্তার গলিতে হয়তো পড়ে আছি ৷
.
ছোট্টো গলার ডাক কানে আসে, মা,, ভাই চেতন পাইছে ৷
চোখ খুলে তাকাই, অচেনা পরিবেশ ৷ মধ্যে বয়স্ক এক ভদ্র মহিলা এসে কপালে হাত রেখে বলে
জ্বর ছাইড়া গ্যাছে , এই নিরু তোর ভাইকে এক গ্লাস গরম দুধ দে তো ৷
তুমি ভালো হইয়া যাবা বাবা, চিন্তা কইরো না ৷ শহরে গেছিলাম তুমি খালি গায়ে রাস্তাই পইড়া ছিলা, মনে হয় চোরে সব লইয়া গ্যাছে ৷
আমার মেয়ে নিরু ৷ অনেক আগে ওর বাপে মইরা গ্যাছে ৷
ওর এক ভাই ছিলো, ওর ভাই ওরে খুব ভালোবাসতো , রাতদিন ভাইএর পিছন পিছন ঘুরতো ৷
তোমাকে রাস্তায় পইড়া থাকতে দেইখা তোমাকে ওর ভাই মনে হয়, আমার পোলাটা একবছর হলো অসুখে মারা গ্যাছে ৷
তোমাকে নিয়ে আসার জন্য কান্না কাটি শুরু করে ৷ তাই এই গেরামে নিয়া আসছি ৷
তুমি ২দিন অচেতন ছিলা, নিরু সারাদিন সারারাত তোমার মাথায় পানি পটি দিছে ৷
ভদ্রমহিলা মুখে আচল গুজে কাঁদছে ৷
.
মা এর পেছনে ৯,১০ বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে লজ্জা পাচ্ছে ৷
ইশারায় কাছে ডাকি , বলি এই তুই আমার বোন হবি? তুই তো আমার ভাই, বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে মেয়েটি ৷
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ছোটোরা কত অদ্ভুদ ভাবে হাঁসতে পারে ৷
কেনো জানি মনে হয় মনে হয় এই সহজ সরল ২জন মানুষের জন্য আমি সব কিছু করতে পারি ৷
.
ভদ্রমহিলা জিগ্গেস করে ৷
আচ্ছা বাবা তোমার নাম কি? তোমাকে ভদ্দর ঘরের ছেলে মনে হয়, তোমার বাবা মা কে খবর দেই, আইসা লইয়া যাক ৷
মনে মনে পণ করি বেঁচে থাকতে আমি কখনো আর ফিরে যাবো না ৷ আর কখনো ঐ চার দেয়ালের মাঝে আটকে থাকবো না ৷
.
আমি উত্তর দেই ৷ আমার নাম শুভ্র, আমার কেও নেই ৷ আমাকে আপনাদের কাছে রাখবেন ?
আমার কিছু লাগবে না আপনাদের সব কাজ করে দেবো ৷ শুধু একবেলা খেতে দিলেই হবে ৷
....
.....তারপর অনেকদিন পার হয়ে গ্যাছে ৷
এখন আমি পুরোদমে কৃষকের ছেলে ৷ নিরুর মাকে মা ডাকি ৷ নিজের ছেলের মতই আদর করে ৷
গরুর ঘাস কেটে আনা থেকে শুরু করে সব কিছু করি ৷ মা মাঠে খাবার নিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে খাওয়ায়, আমি গোপনে চোখের জল মুছি ৷
রাতের বেলায় ছোট্টো নদীটির পাশে বসে জোৎস্না দেখি, আকাশের দিকে তাকিয়ে মাকে বলি, মা আমি অনেক ভালো আছি ৷
দেখো আমি তোমার বখে যাওয়া সেই খারাপ ছেলেটি আর নেই ৷
.
যৌতুক দিয়ে নিরুর বিয়ে দিলাম , বোনের স্বামী আমাকে সহ্য করতে পারে না, গেলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয় ৷
বোন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে ৷ বোনের কান্না দেখতে পারি না ৷ চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফিরি ৷
অসুস্থ মা এর চিকিৎসা করানোর জন্য ভিটে মাটি সব বিক্রি করে দিতে হয় ৷
.
হসপিটালের বেডে শুয়ে মা একদিন ডাকে, বাবা তুই শক্ত হ ৷ আমার সময় ফুরিয়ে আসছে ৷
মা এর হাত ধরে বলি, মা তোর কিছু হবে না ৷ নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি তোকে বাঁচাবো ৷
মা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আমি শক্ত হবার চেষ্টা করি ৷ তবুও চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ৷ আজ আবার নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় ৷
জীবনটাকে তীল তীল করে শেষ করে দেয়ার জন্য নেষা করে একটা কিডনি প্রায় নষ্ট হবার পথে আরেকটা কিডনি বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা করাই ৷
কিন্তু মাকে বাঁচাতে পারিনা ৷
আমি আবার সব হারিয়ে ফেলি ৷ ঝড় এলো স্নেহ,মমতা ভালোবাসার দেয়াল টাকে ভেংগে দিয়ে চলে গেলো ৷ পুরোটাই যেনো দুঃস্বপ্ন ৷
.
আমি আবার সব হারিয়ে শহরের পথে পাড়ি জমাই ৷ কয়েকটা বছরে শহরটা অনেক বদলে গ্যাছে ৷
রাতের শহরে অন্ধকার নিরিবিলি একটা জায়গা খুজে আমিও রাস্তার বাসিন্দা হয়ে যাই ৷
সারাদিন সারারাত এই রাস্তার গলিতে শুয়ে থাকি বসে থাকি , গলিটাকেই আপন মনে হয় ৷
কারো মায়া হলে দুই টাকা দিলে কিছু কিনে খাই ৷ না দিলে না খেয়েই দিন কেটে যায় ৷
.
সকালের সহজ সরল সুর্যটাকে উত্তপ্ত হতে দেখি ৷ রাতে চাঁদের আলো খেয়ে মনে মনে পেটের ক্ষুধা মেটাই ৷
এর মধ্যে কয়েকটা দিন কেটে গ্যাছে, অভ্যাস্ত হয়ে গেছি ৷
রাস্তার এই গলিটা ছাড়াও এই রাস্তার হাড্ডিসার কুকুরগুলোর ওপর মায়া জন্মে গ্যাছে ৷
এদেরকে কেও কখনো খেতে দেয় না ৷ একটা বিস্কিট খেতে দিলেও এরা তার ভক্ত হয়ে য়ায় ৷
কিছু খাওয়া জুটলে এদের না দিয়ে খেতে পারি না ৷ কুকুরগুলো সারারাত আমার চারপাশ ঘিরে শুয়ে থাকে ৷
ধিরে ধিরে শরীর দুর্বল হতে থাকে ৷ পেটের যন্ত্রণা টাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয় ৷
.
যখন যন্ত্রণা শুরু হয়, মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদি ৷ তখন চোখ দিয়ে অনর্গল জল বের হয় ৷
বুঝতে পারি আমার সময় ফুরিয়ে আসছে ৷
সেদিন দুপুর বেলায় কারা যেনো কুকুর গুলোকে ধরে নিয়ে যায় ৷
সারাটাদিন ঘোরের মধ্যে রাস্তাই পড়ে থাকি ৷ রাত্রিবেলায় শরীরের সব যন্ত্রণা, ব্যথা চলে যায় , আজ কুকুর গুলোও নেই ৷ একাকি রাস্তাই পড়ে থাকি ৷ আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে ৷ শেষ সময়ে ঝাপসা চোখে চাঁদটাকে দেখি ৷
আমার সময় ফুরিয়ে আসছে আমি চোখ বুঝি ৷
মনে হয় দুর থেকে কেও আমাকে ডাকছে ৷ এই শুভ্র ¡ শুভ্র ৷
খুব কষ্টে চোখের পাতা দুটি টেনে তোলার চেষ্টা করি ৷ আবছা অন্ধকারে মুখটাকে দেখি, স্বপ্নে দেখা সেই মায়াবী মুখ মোটা কাঁচের চশমা ৷
এই শুভ্র,,, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? তোমাকে কত খুজেছি ৷ তোমার এই অবস্থা কেনো? আমাকে চিনতে পারছো না? আমি তৃনা ... আমি ফিরে এসেছি ৷
এই শুভ্র .... মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে ৷ আমার মায়া লাগছে ৷
তৃণাকে চিনতে পারি, এটা সেই মেয়ে যাকে ভালোবেসেছিলাম ৷ ভেবেছিলাম এই মেয়েটিকে নিয়ে আমি নতুন করে বাঁচতে শিখবো ৷ কিন্তু মেয়েটি আমায় ছেড়ে গিয়েছিলো ৷
তৃণা শক্তকরে আমার হাত টা ধরে চিৎকার করে কাঁদছে ৷ এই শুভ্র ওঠো ,, তোমার কিচ্ছু হবে না , এই শুভ্র ... ওঠো ৷
চোখের কোনা দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ৷ কেনো জানি আবার এই মেয়েটির জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করছে ৷
মনে মনে বলি সত্যি যদি ভালোবাসো আমাদের আবার দেখা হবে ৷
কোনো এক ছোট্টো শহরের গলির মোড়ে, কিংবা কোনো ছোট্টো একটি গ্রহের দুটি প্রানি হিসেবে , আমরা আবার ভালোবাসবো ৷
.
শুভ্র হারিয়ে যায় ৷
শুভ্ররা আর কখনো ফিরে আসবে না ৷
কিন্তু বিশাল এই পৃথিবীর, ছোট্টো একটি রাস্তার এই ছোট্টো গলিটি শুভ্রর প্রতিটি দুঃখ-কষ্টের সাক্ষী হয়ে থাকবে আজীবন ৷

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.