নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

রাজা সরকার

আমি একজন সামান্য লেখক।

রাজা সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিরে দেখা এক জন্ম-কথা।

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:০৩

(১)



১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় যেদিন গণহত্যা সুরু হলো তার পরদিন সকালেও শ্রীমন্তপুরসহ আশে পাশের কোন গ্রামেরই জীবনযাত্রায় কোন রকম ব্যাঘাত ঘটেনি। কৃষকরা যেমন লাঙল বলদ নিয়ে মাঠে গেছে। মাছ ধরার জন্যও কেউ কেউ জাল নিয়ে বেরিয়ে গেছে ভোর রাতে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা কেউ কেউ বই শ্লেট নিয়ে পড়তে বসে গেছে । ইস্কুল বন্ধ। কিন্তু বাড়িতে পড়তে হবে । গোয়াল খালি করে গরু নিয়ে মাঠে চলে গেছে কেউ। পুকুর-ঘাটও যথারীতি বাড়ির বৌ ঝি-দের প্রাত্যাহিকতায় থেকেছে মুখর। রান্না হবে বলে কারো কারোর রান্নাঘরের উনুনে আগুনও দেয়া হয়ে গেছে। নিজস্ব নিয়মেই চলেছে জীবন এখানে তখনও।



কামান বন্দুক বা মেশিনগানের সঙ্গে প্রাণান্ত আর্তনাদের আওয়াজ তখনও এখানে অশ্রুতপূর্ব। কিংবা ব্জ্রপাতের মত সেই সংবাদও তৎক্ষণাৎ এই গ্রামে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বরং মন্থর যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে সেই দুঃসংবাদ ক্রমশঃ গ্রামের মানুষ পেতে সুরু করলো সুক্ষ্ম অথচ তীব্র বেদনার মতো আরো ক'দিন পর থেকে। ততদিনে আবার নানা মুখে নানা স্বরে সেই সব সংবাদের বীভৎসতা বাতাসে পাক খেতে সুরু করলো। যার ফলে দিন কয়েকের মধ্যেই বিমূঢ় মানুষেরা পেতে সুরু করলো এক অচেনা আতঙ্কের স্বাদ। যে স্বাদ ভাতের থালায় বা বিছানার বালিশে বা নিস্তব্ধ রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠে টের পাওয়া যাচ্ছে। আর এই অচেনা আতঙ্কের স্বাদ'এর মধ্য দিয়ে অচিরেই তারা তাদের অজান্তেই সারা দেশের মানুষের সঙ্গে এক কাতারে এসে গেল ।



কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে কোন মীমাংসা যেন কেউ খুঁজে পাচ্ছেনা, যে নিজের দেশের মিলিটারিরা নিজের দেশের মানুষদের এই হারে মারতে পারে বা ঘরের মেয়েদের ধরে ধরে নিয়ে যেতে পারে কী ভাবে। প্রথম প্রথম এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু ক্রমে সব সংবাদের ভয়াবহ সত্যতা প্রকাশ পেতে সুরু করলো। ভাঙ্গা সুরু হলো গ্রাম জীবনের ছন্দ । ঘটনা আরো প্রকাশ হয়ে পড়লো যে হিন্দুরাই নাকি প্রথম টার্গেট। ঢাকা থেকে দ্রুত গতিতে হত্যাযজ্ঞের বৃত্ত পরিধি বাড়তে সুরু করেছে। কবে যে তা শ্রীমন্তপুর এসে পৌঁছে যাবে সেই আশঙ্কা সবার মনেই জায়গা করে নিয়েছে। এই অবস্থায় যমজ ভাইয়ের মতো পাশের মুসলমান প্রধান গ্রাম অমৃতপুর এসে শ্রীমন্তপুরের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। দুই গ্রামের জোয়ান ছেলে পুলেরা রাত-পাহারার বন্দোবস্ত করে ফেলল । সশস্ত্র মিলিটারি যখন ঘাতকে পরিণত হয় তখন তার রূপ কি প্রকারের হয়ে থাকে বলাবাহুল্য তার কোন অভিজ্ঞতা এদের কেন, হয়তো এদেশের কারোরই ছিলনা। তবু এই উদ্যোগ সহমর্মিতার এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত হিসেবেই বয়স্করা দেখলো।



অঞ্চলটা প্রান্তিক এবং অনুন্নত ভাটি অঞ্চল হিসেবে খ্যাত। যোগাযোগ ব্যবস্থা সেই আদিযুগের। যাতায়াত বর্ষায় নৌকা আর খরার সময় নিজের দুই পা। কোন পরিবর্তন নেই। তখনও চাকার ব্যবহার যেন ঠিকঠাক চালু হয়নি। কাছাকাছি রেল ইস্টিশন মোহনগঞ্জ মাইল পাঁচেক দূরে। চাকা গড়ানোর মতো সড়ক পথও তেমনি। মানুষ এসব নিয়ে খুব মাথা ঘামায় বলে মনে হয় না। জীবন এর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলে। ছেলেপুলেদের কাছে ঠিক এখান থেকে ঢাকা অনেকটা রূপকথার মতো মনে হয়। ফলে ঢাকাতে কি হচ্ছে বা হয়েছে তা নিয়ে তারা খুব চিন্তাণ্বিত নয়। ঘটনার ভয়াবহতা কতদূর তা অনুধাবন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। ফলে গ্রাম পাহারার ব্যাপারটা এইসব অল্পবয়সীদের কাছে নিস্তরঙ্গ গ্রাম জীবনে একটা অনাস্বাদিত তরঙ্গের বিষয় হয়ে উঠলো। তাদের উৎসাহ অপরিসীম। প্রতি রাতে নিয়ম করে চলছে গ্রাম পাহারার কাজ।



ততদিনে খবর চলাচলের অনেক মুখ তৈরি হয়ে গেছে। প্রতিদিনই নানা মুখে নানা খবর এসে পৌঁছোচ্ছে এই গ্রামাঞ্চলে । সারাদেশেই মিলিটারিরা ছড়িয়ে পড়েছে। তৈরি হয়েছে তাদের নানা রঙের দোসর। তাদের মিলিত অত্যাচারে আতঙ্কে মানুষ দেশ ছাড়তে সুরু করেছে। সেই মানুষদের মধ্যে হিন্দুরাই বেশি। এই সব খবরের ফলে গ্রাম পাহারায় উৎসাহের জোয়ারে ভাঁটার টান অনুভব করতে খুব বেশি সময় লাগলো না। দুই গ্রামের বয়স্করা বসে পরামর্শ করে ঠিক করলো যে হিন্দুদের জন্য এই গ্রামে মিলিটারি আসতে পারে। আসলে তারা সব সময় যে ধর্ম বিচার করে মারে তা নয়--এসে গেলে মুসলমানও মারা পড়তে পারে। সুতরাং হিন্দুদের দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হলো। বর্ষা সুরু হয়ে গেছে। নৌকা করে বর্ডারে চলে যাওয়া যেতে পারে। বাড়িঘর সহায়সম্পত্তি নিয়ে কোন চিন্তা করতে বারণ করে দেয়া হলো। অশান্ত দেশ শান্ত হলে সবাই ফিরে আসবে। শেষ খবর মোহনগঞ্জে মিলিটারি ক্যাম্প চালু হয়ে গেছে। পাশাপাশি রাজাকার বাহিনি দোসরের কাজ সুরু করে দিয়েছে। এই খবরটাই শ্রীমন্তপুরের যে টুকু স্বাভাবিকতা ছিল তাও কেড়ে নিল। ঘরে ঘরে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি সুরু হয়ে গেল।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.